বৈজ্ঞানিকের দপ্তর টেকনো টুকটাক-লিখিব পড়িব কিশোর ঘোষাল শীত ২০১৭

কিশোর ঘোষাল   এর সমস্ত লেখা একত্রে

কিশোর ঘোষাল

বিজ্ঞানের উন্নতি প্রসঙ্গে আমরা কম্পিউটার, টিভি, মোবাইল, এরোপ্লেন কিংবা মহাকাশচারী রকেট – এইসবের কথাই বলি। কিন্তু জরুরি কিছু মৌলিক বিজ্ঞানের সূত্রপাত না হলে এই সব আবিষ্কার যে হতেই পারত না, সে কথা আমরা মনেও করি না। এই পর্বের আগের কয়েকটি পর্বে, এই ধরনের কিছু আবিষ্কারের কথা তোমাদের বলেছি, তার মধ্যে আছে আগুনের ব্যবহার, চাকা আবিষ্কার, মুদ্রা বা টাকার ব্যবহার, ঘরবাড়ি বানানো, রাস্তাঘাট বানানো ইত্যাদি। এবারে বিজ্ঞানের যে প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করবো, সেই লিপি বা হরফ আবিষ্কার না হলে, আমার এই লেখা, তোমরা পড়তেই পারতে না। আমাদের স্কুলে কলেজে বই পড়ে শেখা, কিংবা পরীক্ষার খাতায় লিখে সে পড়ার পরীক্ষা দেওয়া, কিছুই হতো না। তোমাদের বাবা-মা, দাদা-দিদি, কাকু-কাকিমা, মামা-মামিমা, সারাদিন স্মার্টফোনের পর্দায় চোখ রেখে নানান মেসেজ লিখে চলেছেন, কিংবা পড়ে চলেছেন, সে লেখাপড়াও কী করে হত, লিপি বা হরফ আবিষ্কার না হলে?

মানুষের জীবনে আগুনের ব্যবহার শিখে ফেলাকে সব থেকে বড়ো আবিষ্কার বললে, এতটুকুও বাড়িয়ে বলা হয় না। আগুনের নিরাপদ ব্যবহার মানুষের হাতে এনে দিয়েছিল বেশ কিছুটা অবসর সময়। যে সময়ে তারা নতুন কিছু করার এবং নতুন ভাবনার সুযোগ পেয়েছিল। গুহার মধ্যে নিরাপদ এবং অনেকটা নিশ্চিন্ত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে উঠতে, মানুষ বুঝতে পারছিল, শুধুমাত্র কথা বলে, ইশারা-ইঙ্গিত করে, একে অন্যকে সব কথা ঠিকঠাক বোঝানো যাচ্ছে না। মনের কথা এবং মনের ভাব কথা ছাড়াও, কীভাবে বর্ণনা করা যায়, সেটা যেন আচমকাই ঘটে গেল আজ থেকে প্রায় ৩০,০০০ বছর আগে।

আদিম মানবের বড়ো একটা দল এই যে গুহায় রয়েছে, তারা রোজ ভোর থাকতে জঙ্গলে যায় শিকার করতে। ছোট ছোট কয়েকটা দলে তারা ভাগ হয়ে যায়। সব্বাই মিলে একদিকে যাওয়ার থেকে চার পাঁচটা দল, চারদিকে ছড়িয়ে গেলে, শিকার পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ গুহা থেকে কতদূরে, কোন জঙ্গলে সুবিধে মতো জন্তু শিকার করা যাবে, সে তো আর আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। গুহায় থাকে শুধু অসুস্থ মানুষেরা, বুড়ো-বুড়ি আর শিশুরা।

গতকালও তারা একইভাবে বেরিয়েছিল। চারদলের মধ্যে একটাই দল ফিরেছিল বেশ কিছু শিকার করা নিহত জন্তু নিয়ে। দুটো দল সারাদিন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে পরিশ্রান্ত, কিন্তু তেমন কিছুই যোগাড় করতে পারেনি। আর শেষের দলটা ফিরেছিল সন্ধেরও বেশ কিছুটা পরে, পুরোপুরি বিধস্ত। সে দলের বেশ কয়েকজন মারাত্মক জখম। ওরা ফেরার পর থেকেই সকলে ভয়ার্ত আর উদ্বিগ্ন। এরকম জখমে অনেক সময়েই বেশ কিছু মানুষ মারা যায়, কিছু করার থাকে না। দলের নেত্রী এক প্রৌঢ়া শক্তিমতী মহিলা। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা মতো কিছু পাতা, শিকড়, লতা পাথরে থেঁৎলে-বেঁটে জখমের জায়গায় প্রলেপ দিয়েছেন। কিছুটা উপশম হয়তো হয়েছে, কিন্তু কয়েকদিন না গেলে বোঝা যাবে না। আহত মানুষগুলো গুহার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে, সেবা ও চিকিৎসার পর, একসময় অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

শিকারে গেলে দু একজনের ছোটখাটো চোট আঘাত লেগেই থাকে, সেটা তেমন কেউ গায়ে মাখে না। কিন্তু আজকের আঘাত ব্যাপক। চারপাঁচজন মহাশক্তিশালী যুবক সাংঘাতিক আহত। এদের কিছু হয়ে গেলে, দলের শক্তি অনেকটাই কমে যাবে। দলনেত্রী ভীষণ উদ্বিগ্ন, তিনি চিন্তিত মুখে, অবসন্ন মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর ছোট ছেলেকে জিগ্যেস করলেন,

‘ঠিক কী হয়েছিল, বল তো? কী করে এমন হল?’

দলনেত্রীর যুবক ছোট ছেলেও ওই দলে ছিল। তার কোন বিপদ হয়নি। বাবা, কাকা, অন্য ভাইদের মতো সে তেমন সাহসী শক্তিশালী নয়। দলের সকলেই সমান বীর এমন তো হতে পারে না। যারা একটু দুর্বল, তারাও শিকারের দলে নানান কাজ করে। তারা নিঃশব্দে পশুদলের পিছনে চলে যায়, তারপর সমস্বরে আওয়াজ দিয়ে বিভ্রান্ত কিছু পশুকে জঙ্গলের ফাঁকা জায়গায় তাড়িয়ে আনে। সেখানে দু একটা দলছুট পশুকে সবাই ঘিরে ধরে, তার দিকে তির ছোঁড়ে, ধারালো পাথর ছোঁড়ে। আহত পশু মাটিতে পড়ে গেলে, তাকে মেরে ফেলার জন্যে সবাই মিলে বারবার আঘাত করে। সফল শিকারের পর, গাছের মোটা ডাল কেটে, শক্ত লতা দিয়ে বেঁধে মৃত সেই পশুকে বয়ে আনার যোগাড় করে। দলের সামনে না থাকলেও, খুব কাছে থেকে সে দেখেছে ভয়ংকর ঘটনাটা। তার চোখে মুখে এখনো আতংক। মায়ের প্রশ্নে সে বলল,

‘আমাদের তাড়া খেয়ে জানোয়ারগুলো দৌড়তে লাগল। অন্যদিন একদিকেই দৌড়োয়, আমরা পাশ থেকে আক্রমণ করি। আজ কেন কে জানে, অনেকগুলো জানোয়ার ঘুরে এসে আমাদের দিকেই যেন দৌড়ে এল’। পিছনে বসে দলনেত্রীর বৃদ্ধ কাকা সব দেখছিলেন, সব কথা শুনছিলেন। তিনি জিগ্যেস করলেন,

‘ওরা কী জানোয়ারের পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাতেই দাঁড়িয়েছিল’?

‘না একদম রাস্তাতেই নয়, তবে কাছাকাছি’।

‘বুঝেছি’। গুহার মুখে জ্বলতে থাকা আধপোড়া কাঠের একটা টুকরো তুলে নিয়ে, গুহার সমতল দেয়ালে আঁকতে লাগলেন, একদল পশু আর কিছু মানুষের অবয়ব। দেওয়ালে কাঠকয়লার কালো আঁচড় টেনে, বৃদ্ধ বুঝিয়ে দিতে লাগলেন, পশুদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পথের কোথায় দাঁড়ানো উচিৎ শিকারীদের। কীভাবে দাঁড়ানো উচিৎ।

‘তোরা কী এভাবে দাঁড়িয়েছিলি’?

‘না দাদু। আমরা ছিলাম পিছনে, ওরা সামনের দিকে’।

দেওয়ালে আবার তিনি এঁকে তুললেন কিছু অবয়ব। কিছু পশু এসে আক্রমণ করছে শিকারীদের। আঁকতে আঁকতে জিগ্যেস করলেন,

‘এভাবে কী?’

‘হ্যাঁ দাদু। ওই ভাবে’।

‘ভুল, ভুল। মারাত্মক ভুল হয়েছে। তারই মাশুল দিতে হচ্ছে আমাদের। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার জন্যে সকলকেই বলছি। শুধু শক্তির ভরসাতে সফল হওয়া যায় না, বরং তাতে প্রায়ই বিপদ আসে। শক্তির সঙ্গে জানতে হয় পদ্ধতি। এতগুলি শক্তিধর প্রাণ আজ বিপন্ন, কারণ তারা সঠিক উপায় জানত না’।

পাথরের পাত্রে রাখা, পশুচর্বিতে জ্বলা দীপের ম্লান আলোয়, সকলেই যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল জঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে চলা পশুদের, আর তাদের নিজেদের অবস্থান। বহুদিনের শিকারে অভিজ্ঞ সেই বৃদ্ধ শুধুমাত্র কথা দিয়ে তাদের সঠিক বোঝাতে পারতেন কী? পারতেন না। গুহার দেওয়ালে ছবি এঁকে, তিনি খুব সহজে তাঁর দলের যুবকদের শিকার করার পদ্ধতির যেমন পাঠ দিলেন, তেমনি সমস্ত মানব সভ্যতাকে ঠেলে দিলেন অভিনব এক সম্ভাবনার দিকে।

গুহাচিত্র (cave painting) বলতে সাধারণতঃ গুহার দেওয়ালে কিংবা ভিতরের ছাদে (ceiling) আঁকা ছবিকে বোঝায়। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগেকার আঁকা এই সব গুহাচিত্র  পৃথিবীর বহু দেশেই পাওয়া গেছে। এই গুহাগুলির বৈশিষ্ট্য হল, এগুলির অবস্থান খুব দুর্গম, ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের গায়ে। আর এই গুহাগুলিতে মানুষেরা খুব দীর্ঘদিন বাস করত এমন প্রমাণও পাওয়া যায় না। পণ্ডিতেরা বলেন, এই চিত্রগুলি নিছক গুহা সাজানোর জন্যে দেখতে সুন্দর হবে বলে আঁকা হয়েছিল, মোটেই নয়। নিজের দলের মধ্যে, এমনকি অন্য দলের মানুষদের কোন বার্তা বা নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, এই চিত্রগুলি আঁকা হয়েছিল।

সবথেকে প্রাচীন গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, ইন্দোনেশিয়ার মারোস জেলার একটি গুহায়। পণ্ডিতেরা বলেন প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার বছরের পুরোন। এছাড়া ইওরোপের ফ্রান্স, স্পেন, রোমানিয়াতেও যে সব গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলি ত্রিশ থেকে বত্রিশ হাজার বছর আগেকার। ফ্রান্স এবং স্পেনে এরকম প্রায় ৩৪০টি গুহা পাওয়া গেছে, যেখানে প্রচুর গুহাচিত্র দেখা যায়। স্পেনের কুয়েভা ডি লা মনেদা (Cueva de las Monedas) এর মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গুহাচিত্রগুলির প্রধান বিষয় হল শিকার কাহিনী। নানান ধরনের হরিণ, বাইসন, ঘোড়ার দল যেন ছুটে চলেছে। মানুষের ছবি কম, থাকলেও সেগুলি যেন প্রতীকি। জন্তুদের ছবিগুলি যেমন জীবন্ত, মানুষের ছবিগুলি সেভাবে আঁকা হত না। তার একটা কারণ হতে পারে, সেই সময়ের মানুষেরা মনে করতো, যে কোন প্রাণীর ছবি আঁকলে, তার আয়ু কম হয়ে যায়। কাজেই নিজের দলের মানুষদের ছবি এঁকে, তাদের আয়ু কম করতে কে আর চাইবে? বরং জন্তুদের জীবন্ত ছবি আঁকলে, তাদের আয়ু যদি কম হয়ে যায়, তাতে শিকারী দলের সুবিধে। শিকারের ঝক্কি যেন কিছুটা কম হয়ে যায়!

প্রথম দিকে কাঠকয়লার (charcoal) কালো রঙ দিয়ে শুরু হলেও, পরের দিকে লাল, হলুদ রংয়ের গুঁড়ো দিয়েও ছবি আঁকত সেই যুগের মানুষেরা। লাল রংয়ের জন্যে লাল মাটি হিমাটাইট (hematite), হলুদের জন্যে একধরনের হলুদ মাটি (অকার, ochre) ব্যবহার করত।

ভারতবর্ষে মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকা গুহাতেও এমন সব গুহাচিত্র আবিষ্কার হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই গুহাগুলির কয়েকটিতে আদিম মানুষের বসবাস ছিল প্রায় একলাখ বছর! আর সব থেকে প্রাচীন যে গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার বয়েস তিরিশ হাজার বছরের কম নয়। এই গুহাচিত্রগুলির প্রধান রঙ লাল আর সাদা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সবুজ এবং হলুদও দেখা যায়। এই গুহাচিত্রগুলির বিষয় শিকারের দৃশ্য যেমন আছে, তেমনি আছে সমসাময়িক সামাজিক নানান অনুষ্ঠানের ছবিও!

ভিমবেটকা গুহায় এমন ছবি অনেক দেখা যায়।

দেখা যাচ্ছে সারা বিশ্বেই মোটামুটি একই সময়কালে গুহাচিত্রগুলির সৃষ্টি হয়েছিল। যে চিত্রগুলি আজও আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলি রঙদার দক্ষ চিত্রকরের আঁকা। কিন্তু তারও আগে আমাদের দলের সেই বৃদ্ধ লোকের আঁকা সাধারণ কাঠকয়লার স্কেচ কবেই মুছে গিয়েছে কালের নিয়মে। কিন্তু তাঁর সেই বার্তাটি রয়ে গেল তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মনে, আর সেই বার্তা হল, ছবি এঁকে বা লিখে একজনের কথা অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এমনকি যিনি আঁকছেন বা লিখছেন, তাঁর মৃত্যুর বহুযুগ পরেও সেই বার্তা রয়ে যাচ্ছে গুহার গায়ে। মানুষ গুহা ছেড়ে যখন সমতলে নেমে এসে নদীর ধারে চাষবাস শুরু করল, পশুপালন শুরু করল, গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে বসবাস শুরু করল, তখন আরো জরুরি হয়ে উঠল এই বার্তা দেওয়া ও নেওয়ার পদ্ধতি ।

অতএব আদিম জীবন থেকে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসে গেল চিত্রলিপি বা পিক্টোগ্রাফ (pictograph)। এই চিত্রলিপির উদ্দেশ্য ছিল সমাজে সকলের মধ্যে কিছু বিধি-নিষেধ, ধর্মীয় নিয়ম-কানুন প্রচার করা এবং ব্যক্তিগত নাম ও তার অধিকারে থাকা ধনসম্পদের রেকর্ড নথিভুক্ত করা। বুঝতেই পারছো, শিকারের সহজ গল্প বলা সরল ছবির থেকে, জটিল বিষয়ের জন্যে অনেক জটিল হয়ে উঠতে লাগল চিত্রলিপি। বিশ্বের প্রাচীনতম চিত্রলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে, দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার সুমের সভ্যতায়। পণ্ডিতদের মতে, মোটামুটি ৩৫০০ বিসিতে (যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৩৫০০ বছর আগে) সুমের সভ্যতায় এই লিপির বহুল প্রচলন ছিল। এরই কাছাকাছি সময়ে মোটামুটি ৩২০০ বিসিতে মিশর সভ্যতায় যে চিত্রলিপির ব্যবহার পাওয়া যায় তার নাম হিয়েরোগ্লিফ। মিশরের পিরামিড, মন্দির এবং প্রাচীন প্রাসাদের গায়ে এই লিপির অজস্র নমুনা আজও দেখতে পাওয়া যায়।  প্রাচীন ভারতে সিন্ধু সভ্যতারও বেশ কিছু লিপির (মোটামুটি ২৬০০ বিসি) নমুনা পাওয়া গেছে, যেগুলিকে চিত্রলিপি বলে মনে করা হয়।  কিন্তু এখনো সিন্ধু সভ্যতার এই লিপি পড়ে ওঠা যায়নি বলে, কোন কোন পণ্ডিত এগুলিকে লিপি বলতে নারাজ, তাঁদের মতে এগুলি সাধারণ কিছু চিত্র সংকেত। 

   

চলবে

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a comment