বৈজ্ঞানিকের দপ্তর টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সীজ ঋজু গাঙ্গুলী বসন্ত ২০১৮

 ঋজু গাঙ্গুলীর সমস্ত জয়ঢাকি লেখা একত্রে

টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’জ?

ঋজু গাঙ্গুলী

পর্দায় তখন ফুটে উঠছে সমুদ্রতলের অনেক-অনেক নিচের একটা ছবি।

দিনের আলো পৌঁছয় না বলে সেখানে চিররাত্রি, কিন্তু ফটোগ্রাফারের কুশলতা আর ক্যামেরার দৌলতে সেই পরিবেশও সবজেটে নীল হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছচ্ছিল।

একটা ভাঙাচোরা জাহাজের ওপর ফোকাস দানা বাঁধছিল, কিন্তু তখনই হঠাৎ ক্যামেরাটা নড়ে উঠল। মনে হল, যেন একটা বিরাট ছায়া চলে গেল ওপর দিয়েই!

ঈষৎ উষ্ণ এবং আরামদায়ক পরিবেশেও শনিচক্র যেভাবে সিঁটিয়ে গেল, তা হয় শুধু যখন উত্তুরে হাওয়া কোনো ভাবে ঘরে ঢুকে পড়ে।

বুঝতে পারলাম, কলকাতার ধোঁয়াটে পরিবেশে, আরামদায়ক সোফায় বসে থেকেও অতল জলের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে সব্বাই। তারা তখন পৌঁছে গেছে অতল জলের তলায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। তাদের মাথার ওপর চেপে বসছে জলের নিষ্করুণ চাপ, এবং সামনে-পেছনে-নিচে অপেক্ষা করছে মৃত্যু!

তখন থেকেই মনে-মনে কথাগুলো গোছানো শুরু করেছিলাম। সিনেমাটা শেষ হওয়ার পর কোয়ার্টারে ফিরে হাত-পা ধুয়ে চায়ের কাপ মুখে ঠেকানোর আগেই শ্রীমতীর কাছ থেকে প্রশ্নটা এল, “হ্যাঁগো, সমুদ্রের তলায় তো সাঙ্ঘাতিক সব বিপদ থাকেই, তাই না?”

“অক্টোপাস!”, গায়ে চাদরটা টেনে নিয়েও একটু কেঁপে উঠে বলল তোশালি।

“হাঙর!”, একটা পকোড়ায় কামড় দিয়ে বলল মধুরিমা, “জ’স দেখনি?”

“আরে, অক্সিজেন ফুরোলে তো দম আটকেই তো মারা যাবে!”, এবারের মন্তব্য অনুমিতার।

“বাবা”, মেঘনা যোগ দিল আলোচনায়, “সমুদ্রের গভীরে এত বিপদ জেনেও মানুষ সেখানে যায় কেন?”

গম্ভীর মুখে চা শেষ করলাম। শনিচক্র সেই সময়টা আমাকে আর ঘাঁটায়নি, বরং “কুসুমদোলা” নামক কিছু একটা অত্যন্ত জটিল জিনিসের বিভিন্ন সম্পর্কে নন-লিনিয়ার ইকুয়েশনের সম্ভাব্য সলিউশন নিয়ে আলোচনায় মগ্ন ছিল। কিন্তু কাপটা টেবিলে রাখামাত্র পাঁচ জোড়া চোখ আমার ওপর স্থির হল।

“সমুদ্র মানে স্বাধীনতা, বাণিজ্য, অভিযান, এসবের পাশাপাশি যে বিপদও, এই ব্যাপারটা মানুষ জেনেছে একেবারে গোড়ার দিনগুলো থেকেই। যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় আটশো বছর আগে রচিত ‘ওডিসি’-তে গ্রিক বীর ওডিসিয়াস-কে ট্রয় থেকে নিজের দেশ ইথাকায় পৌঁছনোর জন্য সম্ভব-অসম্ভব সবরকম বিপদের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, আর সেইসব বিপদের বর্ণনার আড়ালে লুকিয়ে ছিল সমুদ্রকে নিয়ে মানুষের মনে জমে থাকা অনেক ভয়ের চিহ্ন।

কিন্তু আধুনিক পৃথিবীর কাছে সমুদ্রকে একইসঙ্গে রোমান্স ও রোমাঞ্চের মিশ্রণ হিসেবে পেশ করার কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন জুল ভের্ন। ১৮৬৯-এর মার্চ থেকে ১৮৭০-এর জুন অবধি ‘ম্যাগাসিন দ’এজুকেশন এত দে রিক্রিয়েশন’-এ ধারাবাহিক ভাবে, এবং ১৮৭১-এর নভেম্বরে ১১১-টা অলঙ্করণে সমৃদ্ধ হয়ে ডিলাক্স সংস্করণ আকারে ভের্ন-এর যে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়, আজও গোটা পৃথিবীর কাছে সমুদ্র নিয়ে হওয়া গল্প-উপন্যাস-সিনেমার মধ্যে সেটার নাম একেবারে প্রথম দিকেই উচ্চারিত হয়।

টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ আন্ডার দ্য সি’জ!”

“ওটা শুধু ‘সি’ হবে না?”, একটু সন্দিহান হয়ে জানতে চায় মধুরিমা।

“মূল লেখায় ওটা সেভেন সি’জ বা সব সমুদ্র বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে”, আমি বলি।

“এটা মাথায় রাখতে হবে যে সেইসময়ের মেট্রিক লিগ, মানে ৪ কিলোমিটার, হিসেবে বিশ হাজার লিগ মানে পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় চার গুণ!

মুশকিল হল, রেভারেন্ড লুই পেজ মার্সিয়ের ১৮৭৩ সালে এই উপন্যাসটির যে অনুবাদ করেন, তাতে আরো অজস্র ভুল, বেপরোয়া কাটছাঁট, রাজনৈতিক-উদ্দেশ্য প্রণোদিত পরিবর্তন, এসবের পাশাপাশি এই ভুলটাও ঢুকে যায়, ফলে বহুবচনের ‘সি’জ’ একবচনের ‘সি’ হয়ে যায়।

তবে যত পরিবর্তনই হোক না কেন, ভের্ন-এর এই উপন্যাসটি অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যের একেবারে প্রাথমিক, এবং সফলতম উদাহরণ হয়ে রয়ে গেছে এখনও। উপন্যাসটার কথা বলতে গেলে তিনটে জিনিস আমাদের মনে পড়বেই।

“প্রথমত, ক্যাপ্টেন নিমো। ওডিসি-তে ওডিসিয়াসকে যে একচক্ষু দানব বা সাইক্লপ পলিফেমাস-এর মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সে নিজেকে ‘উটিস’ বলে পরিচয় দিয়েছিল, গ্রিক ভাষায় যার মানে হল ‘নামহীন’। ভের্ন সেই অনুসারেই তাঁর আপাত নিষ্ঠুর, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে নরম মনের ট্র্যাজিক প্রতিনায়ক হিসেবে ক্যাপ্টেন নিমো, যাঁর নামের মানেও হল ‘নামহীন’,-কে গড়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, নটিলাস। ভের্ন এই সাবমেরিনের নাম নিয়েছিলেন ১৮০০ সালে রবার্ট ফুলটনের বানানো পরীক্ষামূলক সাবমেরিনের থেকে, যাতে আরোপ করা হয়েছিল ফরাসি নেভির প্রথম সাবমেরিনের নানা বিশেষত্ব। সমুদ্রের গভীরে, মেরুর বরফের সঙ্গে লড়াইয়ে, এবং শেষে ভয়ঙ্কর ঝড় বা মেলস্ট্রমের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া সাবমেরিন নটিলাস পাঠকদের এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে ৩০শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ কমিশনড হওয়া মানবেতিহাসের প্রথম নিউক্লীয় শক্তিতে চালিত সাবমেরিনের নামও ছিল ইউ.এস.এস নটিলাস!

তৃতীয়ত, নটিলাসের ওপর জায়েন্ট স্কুইড বাহিনীর আক্রমণ। উপন্যাসটার কথা বলতে গেলে এই একটা bigganriju02ব্যাপার সবার মনে পড়তে বাধ্য। ঠিক কী হয়েছিল সেখানে, তা বোঝার জন্য মূল ফরাসি বইয়ের তিনটে ছবি তুলে দিলেই সবচেয়ে ভালো হবে।

ভের্ন এই জায়ান্ট স্কুইডের আক্রমণের প্রেরণা পেয়েছিলেন ভিক্টর হুগো’র উপন্যাস “টয়লার্স অফ দ্য সি” থেকে। হুগো তাঁর লেখায় দৈত্যাকৃতি অক্টোপাসটিকে শিল্প বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, যার সঙ্গে লড়েছিল একলা এক ফরাসি। ভের্ন হয়তো তাঁর লেখায় স্কুইড-দের এনেছিলেন ১৮৪৮-এর বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে, কিন্তু পরবর্তীকালে শিল্পীরা ওই স্কুইডটিকে নরওয়ে ও গ্রিনল্যান্ডের সমুদ্রে ত্রাস সৃষ্টিকারী কিংবদন্তির ভয়ঙ্কর প্রাণী ‘ক্র্যাকেন’-এর সঙ্গেই মিশিয়ে দিয়েছে, যার সেরা প্রমাণ হিসেবে এই ছবিটি তুলে ধরা যায়:

 bigganriju03 (Large)

“স্কুইড আর অক্টোপাসের তফাৎ কী?”, একটা মোক্ষম প্রশ্ন তোলে তোশালি।

আমার নিজেরো যে জিনিসটা প্রায়ই ঘেঁটে যায়, সেটা খোলসা করার সুযোগ পাই আমি এবার, “সেফালোপড পরিবারের সদস্য হলেও এদের মধ্যে কয়েকটা পার্থক্য আছে।

প্রথমে বলি স্কুইডের কথা।

bigganriju04-large.jpg

টিউথিডা অর্ডার-ভুক্ত প্রাণী স্কুইডের প্রধান খাদ্য হল মাছ এবং কুচো চিংড়ি। এরা বাঁচে মোটামুটি ন’মাস থেকে পাঁচ বছর অবধি। আর মাপে এরা ভীষণ ছোটো সেপিওলিড স্কুইডের মতো ইঞ্চি খানেক থেকে শুরু করে কলোসাল স্কুইডের মতো প্রায় ২০ মিটার অবধি লম্বা হতে পারে। জায়েন্ট স্কুইড, অর্থাৎ ভের্নের উপন্যাসের যারা ভিলেইন, তাদের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ১৩ মিটার।

স্কুইডের চেহারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জিনিস হল তাদের শরীরের মধ্যে উপস্থিত একটা শক্ত কাঠামো বা পেন, যেটা অত্যন্ত দ্রুত চলা বা ঘোরার সময়েও তাদের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। অক্টোপাসের শরীরে এমন কোনো শক্ত অঙ্গ নেই।

অক্টোপাস সমুদ্রের সবচেয়ে অদ্ভুত, এবং কৌতূহলোদ্দীপক প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম।

bigganriju05

 অক্টোপোডা অর্ডার-এর প্রাণী অক্টোপাস সমুদ্রের তলদেশের কাছাকাছি এলাকায় যেসব ক্রাস্টাশিয়ান, মানে শামুক-ঝিনুক জাতীয় প্রাণী থাকে, তাদের খেয়ে বাঁচে। এদের আয়ুষ্কাল এক থেকে তিন বছর। মাপের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে প্রচুর বৈচিত্র্য দেখা যায়, ফলে উলফি স্কুইড হয় মাত্র দেড় সেন্টিমিটার, আবার জায়েন্ট অক্টোপাস প্রায় ন’মিটার অবধি হতে পারে মাপে।

অক্টোপাস ও স্কুইড, দু’জনের শরীরেই মাথা, ম্যান্টল বা শক্ত উপরিভাগ, সাকার-যুক্ত আটটা হাত থাকলেও স্কুইডের অতিরিক্ত দুটো সাকার-রিং বা হুকওলা টেন্ট্যাকল আছে, আর আছে মাথার ওপর দুটো পেশিবহুল ‘ফিন’ যারা চলাচলে সাহায্য করে। অক্টোপাসের এগুলো নেই। ফলে এদের শিকার ধরার পদ্ধতিও আলাদা।

অক্টোপাস শিকারকে ধরে নিজের ধারালো ঠোঁট দিয়ে তার গায়ের শক্ত খোল ফাটিয়ে সেখান দিয়ে একটা বিষ শিকারের শরীরে মিশিয়ে দেয়। শিকার অচেতন বা অসাড় হয়ে পড়লে অক্টোপাস নিজের লালা দিয়ে শিকারের শরীরকে নরম, প্রায় তরল করে দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে ছিঁড়ে খায়। কিন্তু স্কুইড এসব না করে, স্রেফ তার লম্বা টেন্ট্যাকল দিয়ে শিকারকে ধরে, ছিঁড়ে খায়”।

শ্রোতাদের মুখ-চোখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছিলাম, খাদ্য আর খাদকের এই বর্ণনাগুলো হজম করতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। অনুমিতা হয়তো সেজন্যই তড়িঘড়ি জানতে চাইল, “সমুদ্রের ঠিক কতটা গভীরে থাকে এই স্কুইড আর অক্টোপাস?”

পোস্ট-ডিনার কফির কাপ হাতে নিয়ে আমি উত্তরটা দিই।

“সমুদ্রকে গভীরতার দিক দিয়ে পাঁচটা ভাগে ভাগ করা যায়।        

bigganriju06 “সমুদ্রের সবচেয়ে ওপরের অংশে, অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২০০ মিটার বা সাড়ে ছ’শো ফিট অবধি গভীরতার জায়গাটাকে বলা হয় এপিপেলাজিক জোন। যেহেতু সূর্যের আলো এবং তাপ এই অংশটুকুতেই ভালোভাবে ঢুকতে পারে, তাই তাপমাত্রার হেরফের হয় এখানেই। এই জায়গাটুকু, এবং কন্টিনেন্টাল শেলফ-এর ওপরের অগভীর নেরিটিক জোন, এই অংশটায় সূর্যের আলো থাকে বলে একে ইউফোটিক জোন-ও বলা হয়।

যেহেতু সমুদ্রের এই স্তরে কোনো সেডিমেন্ট বা থিতিয়ে পড়া স্তর নেই, তাই সেসব খুঁড়ে খাবার বের করার মতো কোনো প্রাণী বা ডিপোসিট ফিডার-ও এখানে নেই। এখানে যারা থাকে তারা সবাই ভাসমান জিনিস খাদক বা সাসপেনসন ফিডার।

সূর্যের আলো পৌঁছয় বলে সমুদ্রের যাবতীয় উদ্ভিদ, মানে ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষ করে নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করার ক্ষমতা রাখে এমন জীব এই স্তরেই থাকে। এদের মধ্যে আছে সি-উইড বলতে যা বোঝায় সেইসব অ্যালজি ও ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন।

এদের খেয়ে যারা বাঁচে সেইসব জুপ্ল্যাঙ্কটন, এবং তাদের খেয়ে যারা বাঁচে সেইসব মাছ ও অন্য প্রাণী, মানে মোট সামুদ্রিক জীবজগতের প্রায় ৯০% এখানেই পাওয়া যায়।

এদের মধ্যে আছে হাঙর, গড়নের দিক দিয়ে হাঙরের জাতভাই ‘রে’, জেলিফিশ এবং তার বেরাদর ম্যান-অফ-ওয়ার, সামুদ্রিক কাছিম, সিল, এবং কোরাল এই স্তরেই থাকে।

আত্মরক্ষা এবং শিকার ধরার খাতিরে এই স্তরের বেশ কিছু প্রাণীর মধ্যে কাউন্টারশেডিং বলে একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যাতে শরীরের ওপরের অংশটা হয় গাঢ় রঙের, আর নিচের অংশটা হয় হালকা রঙের। এতে ওপর থেকে তাকালে অন্ধকার জল থেকে তাকে আলাদা করতে পারে না, আবার নিচ থেকে দেখলে ওপরের আলোকোজ্জ্বল অংশ থেকেও তাকে চট করে দেখা যায় না।

“দুশো মিটার থেকে শুরু করে ১০০০ মিটার, মানে প্রায় ৩২০০ ফিট গভীরতা অবধি জায়গাটাকে বলা হয় মেসোপেলাজিক জোন। এখানে সূর্যের আলো খুব ক্ষীণ হয়ে পৌঁছয় বলে একে টোয়াইলাইট জোন-ও বলা হয়।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, সমুদ্রের এই স্তরটা খুঁজে পাওয়া যায় মাত্র পঁচাত্তর বছর আগে! ১৯৪২ সালে মার্কিন বৈজ্ঞানিকেরা সাবমেরিন ঠেকানোর জন্য গবেষণা করতে গিয়ে এই স্তরটা খুঁজে পান”।

bigganriju07

“তার আগে কি লোকে সমুদ্রের সবটা একই রকম গভীর বলে ভাবত?”, শ্রীমতী প্রশ্ন তোলেন।

“আসলে সমুদ্রের তলায় কী বা কারা আছে”, আমি বলি, “সেটা জানার জন্য সোনারের সাহায্য নিতে হয়, যা শব্দ তরঙ্গ ছুড়ে আকাশে রাডারের মতো করে জলের নিচের একটা ‘ছবি’ ফুটিয়ে তোলে।

বিজ্ঞানীরা দেখেন, জলের একটা গভীরতায় গিয়ে সাউন্ড স্পিড গ্রেডিয়েন্ট, মানে গভীরতার সঙ্গে শব্দের বেগের হেরফের হওয়ার হিসেবটা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। এটা তখনই হয়, যদি হঠাৎ করে জলের তাপমাত্রা খুব কমে যায়। জলের এই স্তরটাকে বলে থার্মোক্লাইন।

এখান থেকেই আলাদা একটা অঞ্চলের অস্তিত্ব টের পান বিজ্ঞানীরা, যেখানে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে কমে ৪ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে, আর তারপর স্থির থেকেছে অনেক দূর অবধি” ।

“এখানে কোন-কোন প্রাণী থাকে, বাবা?”, মেঘনা জানতে চায়।

“সূর্যের আলো এখানে যতটা পৌঁছয়, সেটা অ্যালজি বা উদ্ভিদের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই এখানে আছে মূলত উদ্ভিদভোজী, ভাসমান টুকরো-টাকরা খেয়ে বাঁচা প্রাণী, আর মাংসাশী প্রাণী, তথা মাছ। শুনে সামান্য মনে হলেও ২০১৫-র একটা স্টাডি থেকে জানা গেছে, সমুদ্রের এই স্তরের বায়োমাস বা জীবভর প্রায় দশ বিলিয়ন টন!

আরো সহজ করে বললে, পৃথিবীর মোট মাছের ৯০% এই স্তরে বাস করে!”

গোল-গোল চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে আরেরকটু প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিতেই হয় আমায় “এই স্তরের বাসিন্দাদের মধ্যেই আছে নানা অদ্ভুত প্রাণী, যেমন:

 ব্রিসলমাউথ:

গনোস্টোমাটিডে নামক গালভরা নামের এই মাছের পরিবারটি বৈচিত্র্যে ছোটো, কিন্তু সংখ্যায় বিশাল বড়ো।

bigganriju08

দু থেকে ত্রিশ সেন্টিমিটার অবধি লম্বা এই মাছেরা সংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো ভার্টিব্রাটা।

স্যোর্ডফিশ:

তিন থেকে সাড়ে চার মিটার অবধি লম্বা এই মাছেরা প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টি।

bigganriju09 (Large)

এক্টোথার্মিক প্রাণী হিসেবে এরা সমুদ্রের গভীরেও নিজের শরীর গরম রাখতে পারে। তাছাড়া, এদের চোখের পাশে থাকা একটা বিশেষ অঙ্গ এদের চোখকে আশেপাশের জলের চেয়ে প্রায় দশ থেকে পনেরো ডিগ্রি গরম রাখে, ফলে শিকার খুঁজে নিতে এদের দারুণ সুবিধে হয়।

 স্কুইড:

এদের নিয়ে আগেই অনেক কিছু বলেছি আমরা। জায়ান্ট স্কুইড কীরকম দেখতে, তার একটা নমুনা পেশ করেই আমরা অন্যান্য প্রাণীদের কথায় আসব।

 

 উলফ ইল:

শক্ত শ্ব-দন্ত (ক্যানাইন) আর মোলার দিয়ে ক্রাস্টাশিয়ান বর্গের শামুক বা অন্য প্রাণীদের চূর্ণ করে খেতে পারে এমন ‘উলফ ফিশ’ গোত্রের এই মাছেরাও দু’মিটার অবধি লম্বা, আর আঠেরো কিলোর বেশি ওজনের হতে পারে।

bigganriju11

কাটলফিশ:

bigganriju12সেপিডা অর্ডারভুক্ত এই প্রাণীরা আদতে মোলাস্ক। পনেরো থেকে পঞ্চাশ সেন্টিমিটার অবধি লম্বা হতে পারে এরা।

বিপদে পড়লে কাটলফিশ নিজের সাইফন থেকে যে খয়েরি রঙের তরলটা ছুঁড়ে চারদিক অন্ধকার করে পালানোর চেষ্টা করে, সেই রঙটির জন্য একসময় গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় এটির প্রচুর চাহিদা ছিল। এখনও আমরা সেই রঙটাকে সেপিয়া বলেই চিনি।

এই প্রায়ান্ধকার জগতে এমন কিছু প্রাণীও থাকে, যারা বায়োলুমিনিসেন্ট, অর্থাৎ নিজেরাই আলো ছড়ায়। বিরল উদাহরণের মধ্যে পড়বে, চেইন ক্যাটশার্ক। নাম শুনলে ভয়ঙ্কর কিছু বলে মনে হলেও আসলে এটি লাজুক প্রকৃতির, মাত্র ষাট সেন্টিমিটার মাপের মাছ।

bigganriju13

কিন্তু গভীর সমুদ্র বলতে আমরা যা ভাবি, তার আসল এলাকা শুরু হয় এর পর।”

“সেটা কী?”, জানতে চায় অনুমিতা।

“মিডনাইট জোন”, গলায় রহস্য ফুটিয়ে বলি আমি। শ্রোতারা নড়েচড়ে বসেছে দেখে ব্যাপারটা বিশদ করতে হয় এবার।

“মোটামুটি এক হাজার থেকে শুরু করে চার হাজার মিটার অবধি গভীরতার যে জায়গাটা, সেখানে সূর্যের আলো একেবারেই পৌঁছয় না। এটার বিজ্ঞানসম্মত নাম ব্যাথিপেলাজিক বা ব্যাথিয়াল জোন। এপিপেলাজিক ও মেসোপেলাজিক জোন মিলে যে ইউফোটিক জোন, মানে যেখানে বেশি বা কম হলেও সূর্যের আলো পৌঁছয়, তার চেয়ে এই স্তরের এলাকা অনেক বড়ো। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে উদ্ভিদ তো নেই-ই, প্রাণীও ইউফোটিক জোনের চেয়ে কম আছে। যারা আছে, তাদের মধ্যে এই এলাকার গাঢ় অন্ধকার, কম তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও খাদ্য উপাদানের অভাব, এসব সহ্য করে টিঁকে থাকার ও শিকার খোঁজার জন্য বিশেষ কিছু ক্ষমতা তৈরি হয়।

“এখানে খাবারের প্রাথমিক উপাদান হল মেরিন স্নো”।

মধুরিমা বলতে বাধ্য হল, “জলের তলায় বরফ আসবে কোত্থেকে?”

“সেটাই তো”, মেঘনা সদ্য পড়া ফান্ডা কাজে লাগিয়ে বলে, “জল জমে বরফ হওয়ার সময় তো আয়তনে বেড়ে যায়, ফলে হালকাও হয়ে যায়। সেটা জলের অত গভীরে আসবে কীভাবে?”

“আরে এ বরফ সে বরফ নয়!”, আমি উত্তেজিত শ্রোতাদের শান্ত করার চেষ্টা করি, “জলের ওপরের স্তর থেকে যেসব গুঁড়ো বা দানা ভেসে-ভেসে নিচে আসে, তাদেরকেই মেরিন স্নো বলা হয়। এর পৌষ্টিক মূল্য খুবই কম, তাই এত গভীরে যারা এই খেয়ে বেঁচে থাকে, তাদের খাবার হজম করে পাওয়া শক্তির হার, এবং চলাফেরা করার ক্ষমতা, দুই-ই কম হয়।

স্বাভাবিক ভাবেই, এরা ঝাঁপিয়ে শিকার ধরার বদলে শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে পছন্দ করে। এদের পেশি থেকে শুরু করে সবই হয় নমনীয় আর জলীয়, যাতে জলের সাঙ্ঘাতিক চাপ এরা সহ্য করতে পারে”।

“এখানে কারা থাকে?”, সিধি বাত, নো বকওয়াজ স্টাইলে শুধোয় অনুমিতা।

“স্কুইড, জায়েন্ট স্কুইড শিকার করতে পারে এমন স্পার্ম হোয়েল, অক্টোপাস, স্পঞ্জ, কিছু মোলাস্ক, আর কিছু অদ্ভুত চেহারা ও স্বাভাবের মাছ”, আমি বলি।

“অদ্ভুত মানে?”, এতক্ষণ কথা বলে গলা শুকিয়ে গেছিল আমার। সামনে কফির কাপ রেখে বলেন শ্রীমতী, “যেসব জীবের ফটো দেখলাম, তাদের চেয়েও অদ্ভুত?”

“আলবাত!”, কফির গন্ধ নাকে নিয়ে উৎসাহিত হয়ে বলি আমি, “এখানে যেসব মাছ থাকে তাদের ফটো দেখলে প্রাণপাখি পালাতে চাইবে রীতিমতো!

নমুনা পেশ করা যাক গোটাকয়েক: –

 হাম্পব্যাক অ্যাংগলারফিশ:

bigganriju16

এই মাছটি নিজের বায়োলুমিনিসেন্ট আভা দিয়ে শিকারকে আকৃষ্ট করে, তারপর নিজের চাইতে অনেক বড়ো মাছকেও গিলে ফেলে।

কী সৌভাগ্য আমাদের, যে এই ভীষণদর্শন মাছটি মোটে তিন সেন্টিমিটার থেকে আঠেরো সেন্টিমিটার অবধিই হয়!

ফ্যাংটুথ:

bigganriju15

নিজের আয়তনের তুলনায় সবচেয়ে বড়ো দাঁতের মালিক, এবং গভীরতম সমুদ্রের বাসিন্দা এই মাছটিও দেখতে বিকট, তবে লম্বায় এটি ষোলো সেন্টিমিটার ছাড়ায় না। 

ভাইপারফিশ:    bigganriju14নাম শুনে পিলে চমকে গেলেও গভীর সমুদ্রের বাসিন্দা, নিজের শরীরের আলো-তৈরি-করতে-সক্ষম ফটোফোরের জ্বলানেভার মাধ্যমে শিকারকে আকৃষ্ট করে প্রথমে কামড়ে ও পরে গিলে ফেলা এই মাছটিও ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার অবধিই হয়”।

“তাহলে তো মানুষের এইসব প্রাণীর থেকে ভয় পাওয়ার মতো কোনো কারণই নেই”, একটু হতাশ হয়ে বলে মধুরিমা।

“মানুষের আসল ভয় পাওয়ার জিনিস বলতে অক্টোপাস আর স্কুইড ছাড়া আর যেটির কথা সমুদ্র প্রসঙ্গে মাথায় আসে, জলের অ্যাপেক্স প্রিডেটর সেই প্রাণীটি হল:

bigganriju17

প্রাগৈতিহাসিক হাঙর মেগালোডনের বংশধর এই প্রাণীটি লম্বায় ১১ ফুট থেকে শুরু করে ২০ ফুট অবধি হয়। সাধারণত একে সমুদ্রের তীরের কাছাকাছি বেশি পাওয়া গেলেও প্রায় ১২০০ মিটার অবধি গভীরতাতেও গ্রেট হোয়াইট শার্ক দেখা যাওয়ার নিদর্শন আছে।

তবে হ্যাঁ, এদের ফেভারিট শিকার, মানে মাছ, সিল, সি-লায়ন, এরা যেহেতু বেশি গভীরতায় থাকে না, তাই এরাও অতটা গভীরে নামে না। তাছাড়া, দুর্ধর্ষ শিকারি হিসেবে নানারকম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও ১২ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেই এরা স্বচ্ছন্দ, তাই জল যত গভীর আর ঠাণ্ডা হয়, এদের সেইসব এলাকায় থাকার সম্ভাবনাও কমে যায়”।

একটু দম নিয়ে আমি বলি, “কিন্তু তাই বলে একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সমুদ্রের তলা থেকে মর্নিং ওয়াকের মতো করে ঘুরে আসা যায়”।

“কেন?” সমস্বরে প্রশ্ন এল। কফিটা শেষ করে আমি আবার কথা শুরু করি।

“থার্মোক্লাইন-এর নিচে, ১০০০ ফ্যাদম বা ১৮০০ মিটারের বেশি গভীরতায় সমুদ্রের যে এলাকাটা ছড়িয়ে আছে, সেটাকেই ‘গভীর সমুদ্র’ বা ‘ডিপ সি’ বলা হয়। প্লিনির সময় থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি অবধি সমুদ্রের এই স্তরটা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা খুব একটা স্বচ্ছ ছিল না।

১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ অবধি গভীর সমুদ্রে ঘোরাঘুরি করে আধুনিক সমুদ্রচর্চার গোড়াপত্তন করে রয়্যাল সোসাইটি অফ লন্ডনের উদ্যোগে আয়োজিত, ক্যাপ্টেন জর্জ ন্যারেসের নেতৃত্বাধীন একটি অভিযান। সেটিকে তার প্রধান জাহাজ ‘এইচ.এম.এস চ্যালেঞ্জার’-এর নামানুসারে ‘চ্যালেঞ্জার এক্সপিডিশন’ বলা হয়। চার্লস ওয়াইভিল থমসনের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৭০,০০০ নটিক্যাল মাইল বা ১,৩০,০০০ কিলোমিটার এলাকা পর্যবেক্ষণ করেছিল এই অভিযান। প্রায় ৪৭০০ তখনও অবধি অনাবিষ্কৃত সামুদ্রিক প্রাণীর খোঁজ পাওয়া যায় এই অভিযানে। তাছাড়া, ড্রেজিং-এর মাধ্যমে এবং জাল ফেলে সমুদ্রের অনেক-অনেক গভীর জায়গা থেকেও নানা রকমের মাছ ও প্রাণী ধরে এই অভিযানের জাহাজগুলো, যা থেকে প্রমাণ হয়ে যায়, গভীর সমুদ্র আদৌ নিষ্প্রাণ নয়। তবু, দীর্ঘদিন অবধি মানুষের ধারণা ছিল, সমুদ্রের গভীরে অত ঠাণ্ডা, জলের চাপ, এবং আলোর অভাবে প্রাণের বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা নগণ্য।

কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এবং তারপরে রাজনৈতিক নজরদারি তথা যুদ্ধ-প্রস্তুতির জন্য হঠাৎ করে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলো সমুদ্রের দিকে তাকানোয় সমুদ্রের তলায় ঠিক কী আছে, সেটা জানতে উদ্যোগী হয় মানুষ।

এই ব্যাপারটা আরো বেশি উল্লেখযোগ্য কারণ সমুদ্রতল থেকে ৪০০০ মিটারের বেশি গভীরতায় যে অ্যাবিসোপেলাজিক, বা লোয়ার মিডনাইট জোন, তার সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান এখনও মহাকাশ বা চাঁদের সম্বন্ধে জ্ঞানের তুলনায় কম!

ভালো কথা, সমুদ্রের তলায় গভীরতম বিন্দুটি কোথায়, তোমরা কেউ জান?”

হঠাৎ এই প্রশ্ন তোলায় রোষকষায়িত লোচনের শিকার হলাম, কিন্তু বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হয় বলেই বোধহয় উত্তরটা তোশালির জিভের ডগাতেই ছিল, “প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম দ্বীপপুঞ্জের কাছে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ, বা আরো সঠিকভাবে বললে তার নিচে ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’ হল সমুদ্রের তলায় সবচেয়ে গভীর জায়গা। সমুদ্রতল থেকে প্রায় এগারো হাজার মিটার নিচু ওই জায়গাটা”।

“তার মানে”, বিস্ফারিত চোখে বলে অনুমিতা, “মাউন্ট এভারেস্ট-ও ওর মধ্যে ঢুকে যাবে?”

“মাউন্ট এভারেস্ট ঢুকে গিয়েও জায়গা থাকবে”, রিনরিনে গলায় ফোড়ন কাটে মেঘনা, “এভারেস্ট তো মোওওওটে ৮৮৪৮ মিটার উঁচু!”

“হ্যাঁ!”, আমি আবার মূল কথায় ফিরি, “গভীর সমুদ্র নিয়ে আমাদের জানাশোনা আবার শুরু হয় ১৯৬০ সালে, যখন ট্রিইস্টে নামক একটি ব্যাথিস্কেইফ বা স্ব-চালিত সাবমার্সিবল নামিয়ে এই চ্যালেঞ্জার ডিপ অবধি পৌঁছনোর চেষ্টা হয়। কিন্তু তার আগে এলাকাটা ঠিক কোথায়, সেটা একবার বুঝে নেওয়া যাক।

২৩শে জুন ১৯৬০ জাক পিকার্ড, এবং মার্কিন নেভি-র লেফটেন্যান্ট ডন ওয়ালশ এই ট্রিইস্টে-র সওয়ারি হয়ে চ্যালেঞ্জার ডিপে প্রথম মনুষ্যবাহী মিশন সফল করেন।

১০,৯১১ মিটার বা ৩৫,৭৯৭ ফিট গভীরতার চ্যালেঞ্জার ডিপ-এ পৌঁছনোর পর এই গভীর অন্ধকার জগতের ছবিটা একটু-একটু করে মানুষের সামনে স্পষ্ট হতে থাকে।

bigganriju18

“৪০০০ থেকে ৬০০০ মিটার গভীর এই জায়গাটায় সূর্যের আলো কখনোই পৌঁছয় না। চিররাত্রির এই অঞ্চল স্বাভাবিক ভাবেই দারুণ ঠাণ্ডা, তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রির মধ্যেই থাকে। তবে এখানে সবচেয়ে মারাত্মক হল জলের চাপ। বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৭৫০ গুণ এই চাপ সহ্য করে এই স্তরে টিঁকে থাকতে পারে শুধু জায়েন্ট স্কুইড, আর একটি বিচিত্র প্রাণী”।

“কী সেটা?” সবার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ খেয়াল হল, সামনের বাটিটা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে, কারণ আমি যখন ‘অতল জলের আহ্বান’-এ সাড়া দিচ্ছিলাম, তখন অন্যদের হাত ও মুখ দুটোই চলছিল। “মানছি না, মানব না” স্টাইলে ঘাঁড় গোঁজ করায় সুফল পাওয়া গেল। সোফায় বসা রাজেন্দ্রাণীরা নিজেদের বিস্তর ঠেলাঠেলি করে শেষ অবধি উঠলেন, আমার জন্য এক প্লেট পকোড়া বানালেন (সঙ্গে অবশ্যই নিজেদের জন্যও), এবং সসের বোতলসহ প্লেটটিকে আমার সামনে রেখে গুছিয়ে বসলেন।

“অ্যাবিসোপেলাজিক বা অ্যাবিসাল জোন-এর এক বিচিত্র প্রাণী হল জায়েন্ট টিউব ওয়ার্ম”, গরম পকোড়া আর নরম গালের মধ্যে একটা ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করার ফাঁকে আমি বলি।

bigganriju19

“দেখে যেটাকে সমুদ্রের তলায় একঝাঁক ফুল ফুটে আছে বলে মনে হচ্ছে, আসলে সেটা হল চার সেন্টিমিটার ব্যাসের, প্রায় আট ফুট লম্বা পোকাদের একটা কলোনি।

কিটিন, মানে যে বস্তুটি দিয়ে আমাদের নখ তৈরি হয়, তারই তৈরি একটা শক্ত টিউবের মধ্যে থাকে এই মোলাস্ক জাতীয় প্রাণীটি। সমুদ্রের তলায় যেসব ভলক্যানিক ভেন্ট, বা ফাটল আছে, যেখান থেকে গরম জলের সঙ্গে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস বেরিয়ে আসে প্রচুর পরিমাণে, সেখানেই এরা থাকে। ওই উজ্জ্বল লাল অংশগুলো আসলে পরিবেশের গ্যাস আর জল থেকে প্রয়োজনীয় নিউট্রিয়েন্টস বা পৌষ্টিক উপাদান সংগ্রহ করতে কাজে লাগে।

টিউব ওয়ার্মের কোনো পাকনালী নেই, কিন্তু তার শরীরে যেসব ব্যাকটেরিয়া থাকে, তারাই টিউব ওয়ার্মের জন্য, কেমোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় এই গ্যাস ও অন্যান্য জিনিস থেকে খাবার বানিয়ে দেয়।

কিন্তু এর নিচে সমুদ্রের যে অংশটি আছে, সেই হেডিওপেলাজিক বা হেডাল জোন-টি কার্যত আমাদের নাগালের বাইরেই থেকে গেছে!

“গ্রিক কিংবদন্তির আন্ডারওয়ার্লডের শাসক হেডেসের নামাঙ্কিত এই এলাকা শুরু হয় মোটামুটি ৬০০০ মিটার গভীরতার পর থেকে, এবং সমুদ্রের তলায় যে গভীর ট্রেঞ্চ বা খাতগুলো আছে, সেই খাতের নিচে প্রায় ১১,০০০ মিটার অবধি চলে গেছে এই এলাকা।

একটা সময় অবধি এটাকে আলাদা কোনো এলাকা বলে ভাবা হত না, বরং আল্ট্রা-অ্যাবিসাল জোন বলেই চিহ্নিত করা হত। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে একটি ড্যানিশ, ও একটি রুশ অভিযানে বিজ্ঞানীরা এটা দেখেন যে ৬০০০ মিটারের বেশি গভীরতায় জীবনের অস্তিত্ব থাকলেও তার প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। এরপর এটা প্রমাণিত হয় যে বায়ুমণ্ডলের চাপের চেয়ে প্রায় ১১০০ গুণ চাপেও বেশ কিছু বহুকোষী প্রাণী এই এলাকায় টিঁকে থাকতে পারে, তবে তাদের মধ্যেও বড়োসড়ো প্রাণী প্রায় কিছুই নেই।

ট্রিইস্টে ছাড়া এই এলাকায় যেতে পেরেছে খুব কম যন্ত্র, আর মানুষের কথা তো না বলাই ভালো। জাপান এজেন্সি ফর মেরিন-আর্থ রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি প্রথমে কাইকো, এবং পরে আবিসমো নামক আনম্যানড সাবমার্সিবলের সাহায্যে এই এলাকায় একাধিক অভিযান চালিয়েছে, এবং বেশ কিছু অজ্ঞাত ব্যাকটেরিয়াকে চিহ্নিত করেছে, যাদের নিয়ে গবেষণা চলছে।

এছাড়া এই গভীরতায় নামতে পেরেছে উডস হোল ওশ্যোনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের ‘নেরেয়ুস’।

কিন্তু ২৬শে মার্চ, ২০১২, বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরনের দ্বারা সঞ্চালিত সাবমার্সিবল ‘ডিপ-সি চ্যালেঞ্জার’ এই গভীরতায় নেমে প্রথম সোলো ম্যানড মিশন হয়। ক্যামেরন ওখানে প্রায় ঘন্টা তিনেক কাটিয়ে আরো একটা রেকর্ড করেন। ১০,৯০৮ মিটার গভীরতা অবধি রেকর্ড করে এই মিশন”।

“হ্যাঁগো, ওখানে জলের এত চাপ বলেই কি সব প্রাণীরা আকারে ছোটো হয়?”, শ্রীমতীর প্রশ্নটা শুনে আমি খুশি হই, কারণ সেটা আমাকে সমুদ্রতল নিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তুলে ধরার সুযোগ করে দেয়।

“জলের অতটা গভীরে যেসব প্রাণী থাকে, জলের চাপ সহ্য করার জন্যই তাদের শরীরে জলের ভাগ খুব বেশি হয়। এবার, জলের প্লবতা বা ভেসে ওঠার প্রবণতা এত বেশি যে তাকে চেপেচুপে ছোটো করা প্রায় অসম্ভব। ফলে, ওপর থেকে যত চাপ পড়ে, এই অঞ্চলের বেশ কিছু বাসিন্দা আকারে ততটাই বড়ো হয়!”, আমি বলি।

“বড়ো মানে?”, প্রশ্ন করে মধুরিমা, “কতটা বড়ো?”

“একটা নির্দিষ্ট আকারের কোনো প্রাণীর চেহারা কতটা বড়ো হতে পারে, সেটা ঠিক করে দেয় দুটো সূত্র”, আমি বলি।

“ক্লাইবারের নিয়ম বলে যে কোনো প্রাণীর আকার যত বড়ো হবে, তার মেটাবলিজম ততই ভালো হবে, যার ফলে খাদ্য থেকে শক্তি আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা তার ততই বেশি হবে। যেমন, বেড়াল ইঁদুরের চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ বড়ো, ফলে তার মেটাবলিজম-ও ইঁদুরের তুলনায় ৩২ গুণ বেশি। গভীর সমুদ্রে খাবার বলতে ওপর থেকে নেমে আসা মেরিন স্নো, আর জল-সর্বস্ব শরীরের অন্য প্রাণী ছাড়া কিচ্ছু নেই। এইরকম পরিবেশে আকারে বড়ো হলে সেই প্রাণীর টিঁকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে, তবে এর সঙ্গে রক্ত চলাচলের হার থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু নির্ভর করে।

বার্গম্যানের নিয়ম বলে, পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা কমলে প্রাণীর আকার বাড়ে। তবে এই নিয়মটাও মূলত গরম রক্তের প্রাণীদের জন্য প্রযোজ্য।

তাই, এখনও এটা ঠিক নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে কেন এই গভীরতায় কিছু-কিছু প্রাণী এতটা বড়ো হয়। তবে বড়ো যে হয় তা বোঝার জন্য…

কলোসাল স্কুইড:

bigganriju20

সাত হাজার ফিটের চেয়েও বেশি গভীরতায় পাওয়া গেছে ১৪ মিটার লম্বা, ৭৫০ কেজি ওজনের এই প্রাণিটিকে। জায়েন্ট স্কুইডের মতো হাত আর টেন্ট্যাকলে শুধু সাকার আর দাঁত নয়, এই প্রাণীটির হাতের শেষে ধারালো হুক-ও আছে! এইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এই প্রাণীটি স্পার্ম হোয়েলকেও শিকার করে।

জাপানিজ স্পাইডার ক্র্যাব:

bigganriju21

৬০০০ মিটার গভীরতাতেও পাওয়া গেছে এই প্রাণীটিকে। ২০ কিলো অবধি ওজনের হতে পারে এই প্রাণীটি। আর আয়তন? দাঁড়ার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অবধি ১২ মিটার অবধি হতে পারে এ, আর সেটা হয়তো ওপরের ছবিটা দেখে কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে, তাই না?

জায়ান্ট আইসোপড:

bigganriju22

খাবারের একেবারেই টুকরো-টাকরা খেয়ে বাঁচা এই প্রাণীরা এমনিতে ৮ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার সাইজের হয়, কিন্তু সমুদ্রের গভীরতায় এরা যে ৩০ ইঞ্চি বা ৭৬ সেন্টিমিটার অবধি সাইজের, এবং ১.৭ কিলো ওজনের হতে পারে, তা বোঝার জন্য ফটোটি দেখাই কাফি!

এছাড়া টিউবওয়ার্মের কথা তো আগেই বলেছি। এই ডিপ সি জাইগ্যান্টিজম-এর ভরসাতেই হলিউড “ডিপ রাইজিং” নামক সিনেমাটা বানিয়েছিল!”

“কিন্তু…”, তোশালি অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা বলার সুযোগ খুঁজছিল, এবার ফাঁক পেয়ে বলে ওঠে, “তাহলে আটলান্টিস…?”

আমি সভয়ে আবিষ্কার করলাম, বাইরে রাত ঝিম-ঝিম করলেও তোশালির এই প্রশ্নটা শুনে শ্রোতারা সবাই আবার শোয়া-বসা অবস্থা থেকে আমার দিকে জ্বলজ্বলিং চোখে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু এবার আমাকে একটু কড়া হয়েই বলতে হল, “আর প্রশ্ন নয়, এখন ঘুমোনোর সময়”।

তীব্র আপত্তি, প্রতিবাদ, ঘ্যানঘ্যান, “কাল তো রোববার…”, এসবে কর্ণপাত না করে জনতাকে ঘুমোতে পাঠিয়ে আমি অসমাপ্ত থ্রিলারের মলাটটা দেখে মনে-মনে হাসি।

সমুদ্রের সব গল্প কি এক রাতে শেষ হয়?

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s