প্রতিবেশী গাছ সব পর্ব একত্রে
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
বেশ কয়েকটা বছর আগের কথা। খবরের কাগজ পড়ে জানলাম এদেশের এক নামী সাধুবাবা খাদ্য হিসাবে লাউয়ের শরবত পান করেন। সেকথা জেনে একটু খটকা লেগেছিল সেদিন। মনে হয়েছিল লাউয়ের এমন কী গুণ রয়েছে যার জন্য সাধুবাবা এর শরবত পান করেন?
যতটুকু দেখেছি সাধুবাবার চেহারা বেশ উজ্জ্বল। নিত্য যোগ সাধনার ফলে তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এমন একজন ব্যক্তি অহেতুক লাউয়ের শরবত পান করবেন না। তাই লাউয়ের উপকারিতা কী কী রয়েছে সেই সম্বন্ধে একটা কৌতূহল বরাবরই ছিল। শ্রী শিবকালী ভট্টাচার্যের ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ এবং বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র ঘেঁটে অনেক তথ্য জানতে পেরে সে কৌতূহলের কিছুটা নিরসন হল।
লাউ গাছ ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্রই চাষ হয় মূলত সবজি হিসাবে ব্যবহারের জন্য। ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য বহু দেশেই বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এই গাছের চাষ হয়। একটি মজার তথ্য জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। পৃথিবীতে একেবারে প্রথম চাষ হওয়া গাছগুলির (আদ্যিকালে, যার লিখিত ইতিহাস নেই) একটি হচ্ছে এই লাউ গাছ। তবে সেই সময় লাউ-এর চাষ করা হত খাদ্য হিসাবে নয়, শুকনো লাউয়ের খোলা বা খোল জল রাখার পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হত। এমন সব তথ্য বিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করে আমাদের উপহার দিয়েছেন যা প্রায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়!!
গ্রামগঞ্জের প্রায় সব বাড়িতেই লাউ গাছ দেখতে পাওয়া যায়। বাড়ির ছাদে বা বাড়ি সংলগ্ন বাগানে মাচা করে এর চাষ করা হয়। এই লতানে গাছের ডাঁটি নলাকার, কয়েকটি কোণ বিশিষ্ট। সরু স্প্রিং-এর মত আকর্ষ বের হয় যা আশপাশের গাছ, বাড়ির দেওয়াল বা খুঁটিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে গাছকে উপরের দিকে উঠতে সাহায্য করে। এই গাছের পাতা ঘন সবুজ বর্ণের, গোলাকৃতি যার মাঝে খাঁজ রয়েছে। ফুল সাদা, দেখতে সুন্দর। ফল লম্বা অথবা গোলাকার। প্রথম অবস্থায় ত্বকে ছোট ছোট রোম দেখা গেলেও পরে ত্বক মসৃণ হয়ে যায়। পরিণত ফল সবুজ বর্ণ থেকে ধূসর হয়ে যায় এবং খোসা শক্ত হয়। ফলের মধ্যে অনেক বীজ থাকে। বীজের খোসা শক্ত, রং কালচে হলুদ বা ধূসর।
এ দেশে লাউয়ের চাষ এবং ব্যবহার হয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরেই। কবিরাজ এবং দেশীয় চিকিৎসকেরা ভেষজ হিসাবে এই গাছ ব্যবহার করেছেন। শিবকালী ভট্টাচার্য মশাই লিখেছেন, “অলাবু গোল হবে (যার প্রচলিত নাম লাউ), এটি আকারে লম্বাও হয় যার নাম তুম্ব।” অন্যত্র লিখেছেন, “আমাদের অপেক্ষাকৃত প্রাচীন বনৌষধির গ্রন্থ ‘রাজ নিঘণ্টুতে’ গোরক্ষতুম্বী ও ক্ষীরতুম্বী, এই দুই প্রকার মিষ্ট অলাবু (লাউএর) উল্লেখ দেখা যায়।” প্রাচীন কালে এদেশের বৈদ্য সম্প্রদায় লাউ গাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে চিকিৎসার কাজে লাগিয়েছেন। তার কয়েকটি উদাহরণ নীচে লেখা হল।
১) পিত্তশেষ্মাজনিত জ্বরে
২) চোরা অম্বলে
৩) দাহে
৪) অর্শোবিকারে
৫) অধিক পিপাসায়
৬) পিত্তশেষ্মা বিকারে
৭) পায়োরিয়া
৮) দূষিত ক্ষতে
৯) মেচেতায়
১০)মুখ লাবণ্য ধরে রাখতে
১১) ছুলিতে
১২) চোখে ছানি পড়ায়
মজার কথা এই লাউ যদিও সারা বছর বাজারে পাওয়া যায় কিন্তু সকলে সবজি হিসাবে লাউকে পছন্দ করে না। অথচ এর উপকারিতার শেষ নেই একথা আমরা অনেকেই জানি না। লাউয়ের কয়েকটি ভেষজ গুনের কথা লেখা হল।
১) লাউ দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করে । লাউয়ে ক্যালরির পরিমাণ কম। তা ছাড়া এই খাদ্যে ফ্যাটের পরিমাণ অল্প হওয়ায় মেদবহুল ব্যক্তিরা সহজেই লাউ খেতে পারেন।
২) ত্বক ভাল রাখতে সাহায্য করে। বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে ত্বককে রক্ষা করতে সাহায্য করে। ব্রণের সমস্যা দূর করতে লাউ উপকারী।
৩) রাত্রে ভাল ঘুমের জন্য। লাউ শাক ঘুমের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা রাখে।
৪) খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে । লাউয়ে যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার রয়েছে, তাছাড়া এর প্রায় ৯৬ শতাংশ জল। তাই লাউ খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে।
৫) মূত্রবর্ধক। লাউয়ে প্রচুর পরিমাণ জল থাকার জন্য মূত্রবর্ধকের কাজ করে।
৬) অকালে চুল পাকা এবং টাক পড়া রোধ করে লাউ
৭) লাউ-এ ভিটামিন, মিনারেল, লৌহ ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। তাই খাদ্য হিসাবে লাউ খুব মূল্যবান।
৮) লাউ-এর রস (শরবত) কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে।
ভেষজ ও সবজি হিসাবে ব্যবহার ছাড়া লাউয়ের আর অনেক ধরনের ব্যবহার রয়েছে। এক একটি অঞ্চলে এক এক ধরনের ব্যবহার প্রাধান্য পায়।
১) আফ্রিকার পশ্চিম অঞ্চলে পরিণত লাউয়ের ভিতরের সাদা অংশ বের করে শক্ত খোলটি জল বা খাবার রাখার পাত্র
হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
২) ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এর ব্যবহার কিছুটা ভিন্নধর্মী। লাউয়ের খোল মাছ রাখার পাত্র হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়া কাপ, বাটি বা বেসিন পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
৩) আফ্রিকার কিছু কিছু অঞ্চলে লাউয়ের খোল তাল গাছের রস থেকে তৈরি মাদক দ্রব্য রাখার পাত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
৪) মধ্য আমেরিকার কিছু অঞ্চলে লাউয়ের বীজ ভেজে গুঁড়ো করে ভাত এবং দারুচিনির সঙ্গে মিশিয়ে পাক করে একটি পানীয় তৈরি করা হয়।
৫) বেশ বড় লাউয়ের খোল জলে ভাসমান ডিঙি হিসাবেও ব্যবহার করা হয়।
৬) তামাক সেবনের পাইপ তৈরি করা হয় লাউ থেকে।
৭) এদেশে অনেক বাদ্যযন্ত্রে লাউয়ের খোল ব্যবহার করা হয়। লাউয়ের খোল শব্দ বিবর্ধনে [resonator] সাহায্য করে। এই ধরনের কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রের নাম লেখা হল – সেতার, রুদ্রবীণা, সরস্বতী বীণা, বিচিত্রবীণা, সুরবাহার, একতারা, দোতারা, তাম্বুরা বা তানপুরা, ইত্যাদি।