প্রথম পর্বঃ ব্যাঙ ও লাওস
অংশুমান দাশ
যেতে যেতে যখন গলা শুকিয়ে কাঠ, থামা হল রাস্তায়। আমাদের দেশের ধাবার মত – তবে আরও ছিমছাম। বাইরে রোদে চেয়ার টেবিল পাতা। লাওস-এর ওয়াটাওএ এয়ারপোর্ট থেকে চলেছি সাভান্নাখেত-এর দিকে। আগামী সাতদিন ওখানেই আমার ডেরা – কেমন করে চাষের পরিকল্পনা করতে হয় সেসব শেখাতে হবে কৃষি আধিকারিকদের। যাই হোক, নতুন এসেছি দেশটায় – দোকানে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখছি – একদিকে কাবাবের শিক ঝুলছে, লজেন্স, সিগারেট। অন্যদিকে থরে থরে কাচের জার। যেরকম থাকত আমাদের ইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের ল্যাবে। কৌত’হল হল, দেখি গিয়ে। বাঃ, বেশ একটা জারে সাপ, নানারকম সাপ – কোথাও কাঁকড়াবিছে, কোথাও তেঁতুল বিছে। দোকানের মালিকের তো বেশ বিজ্ঞান মনস্কতা! ভাষা তো বুঝিনা, কফি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা। স্মিত হাস্যে আমার সহকর্মী বললেন
– আচ্ছা তোমাকে একদিন খাওয়াব।
– খাওয়াবে মানে?
– ওই যে মদিরা।
সব্বনাশ, বলে কী! ওগুলো নাকি দিশি মদিরার জার, আর তাতে সাপ বিছে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে যাতে মদের ওষধি গুণ বাড়ে। বাবারে – কোনটা বিষ আর কোনটা ওষুধ। আমি তাড়াতাড়ি কফির কাপে উঁকি দিয়ে দেখি, ওখানে আবার কেউ দেহ রেখেছে কিনা।
এরপর থেকে যখনই খাচ্ছি খাবার সমপর্কে জেনে নিচ্ছি ভালো করে। এমনিতে আমার কোনও বাছবিচার নেই – তবে জেনেশুনে খাওয়াই ভালো। হোটেল রেস্তোরাঁর খাবার বেশ চমৎকার। ঝাল নেই। সেদ্ধ সেদ্ধ। সকালে মাড়ভাতে ডিমের ভুজিয়া। দুপুরে মুরগিভাজা, আঠা আঠা ভাত আর তার সঙ্গে করলার স্যুপ। কখনও দিশি শাক ভাজা – তার মধ্যে ঢেঁকি শাক বেশ চেনা গেল। একদিন ছোট ছোট চুনোমাছ ভাজা। একটু অন্যরকম স্বাদ, তবে খুব একটা পরীক্ষামূলক নয়।
টনক নড়ল একদিন সকালে।
লাও-এ গাছপালা বেশি, পোকামাকড়ও। একটা গঙ্গাফড়িং-এর মত পোকা, দেখতে ঠিক যেন একটা পাতা – আমি ছবি তুলছি, একজন মহিলা এগিয়ে এসে বললেন – বাঃ, এটা বেশ ভালো।
– ভালো তো বটেই, কী চমৎকার দেখতে!
– যেমন দেখতে, খেতেও তেমন।
বলেই ডানাটা ভেঙে দিয়ে টপ করে মুখে চালান! আমি হতভম্ভ। ধীরে ধীরে জানা গেল, যা যা হেঁটে চলে বেড়ায় তার প্রায় সবই লাওবাসীরা আনন্দ সহকারে খেয়ে থাকেন। এমনিতে লাও-এর মানুষজন অতি শান্ত, ঝগড়ুটে নয়, হুল্লোড়ে নয় – তাদের কথা বলাতে বেশ পরিশ্রম লাগে। কিন্তু স্মিতহাসির কোনও অভাব নেই। সেই হাসি হেসে একজন জানালেন, “আমাদের দেশে, জানেন তো, খাবারের অভাব হবেনা। আমরা সব খেতে পারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের থাকতে হত জঙ্গলে জঙ্গলে, কখন যে বোমা পড়বে তার তো ঠিক ছিল না। আমাদের গোটা জাতি মনে হয় আমাদের এই বিচিত্র খাবার স্বভাবের জন্যই টিকে গেছি।”
সত্যি কথা, এত বোমার খোলস এখনও পড়ে আছে যে সে সব দিয়ে লোকে বাড়ির গেটের থাম, সিঁড়ির রেলিং বানিয়েছে এন্তার। খাওয়ার ব্যাপারটা পরখ করব সন্ধ্যায়।
এখানে একটা স্থানীয় বাজার বসে। রাস্তার ধারে। হাজির হলাম। নানারকম মাছভাজা, সবই কাঠিতে গাঁথা আর ছাঁকা তেলে ভাজা। তার মধ্যে নানাবিধ পোকা এবং ব্যাঙ। ছোট ব্যাঙ, বড় ব্যাঙ – একদম আস্ত, চামড়া শুদ্ধ। এবং তারপর সাপ। জ্যান্ত। কেটে কুটে পেটে যাওয়ার জন্য তৈরি। খাদ্যশৃঙ্খলের সব স্তরই এসে হাজির।
আমার ব্যাঙ খাওয়ার বড় শখ। কিন্তু গোটা ব্যাঙ আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি তাকে খাচ্ছি – এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না মোটেই। তাই এ যাত্রা ক্ষান্ত দিলাম। একটা দোকানে লোকে গোটা ডিম থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে দেখে এগিয়ে গেলাম। হাঁসের ডিমের মধ্যে ছানা থাকা অবস্থাতেই তাকে সেদ্ধ করে নুন গোলমরিচ দিয়ে খেয়ে ফেলছে টপাটপ। বেজার মুখে পরের দোকানে গিয়ে সেখানে মৌচাকের মধ্যে জ্যান্ত লার্ভা রোস্ট করে খাওয়া দেখে আরও মুষড়ে পড়লাম। ডিম, গোটা গোটা লঙ্কা দিয়ে গুটিপোকা ভাজাও লোকে বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে দেখলাম। তবে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়াটাও দেখলাম তার পরের দোকানে। ছোট ছোট মাছ, হালকা তেলে সাঁতলানো তখনও জ্যান্ত। তাদের কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়ার প্রবল চেষ্টা হচ্ছে। আর তারা টেবিলময় প্রাণের ভয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। গরুর ঠোঁট, গরুর জিভ, মুরগির পা, গরুর রক্ত জমাট করে চাউ মিন দিয়ে স্যুপ, সেদ্ধ ইল মাছ, লেবুতে জারানো শুওরের কাঁচা মাংস – এইসবের চাপে সন্ধার টিফিনটা মাঠে মারা গেল সেদিন।
সাধারণভাবে লাওসের খাবার কিন্তু বেশ পুষ্টিকর। অত্যধিক ঝাল-মশলা নেই। কেবল সব খাবারেই লেমনগ্রাস দেওয়ার চল। আর তাদের ভীষণ পছন্দ হল বেশ কিছুদিনের পচানো মাছের আচার – বেশ বিজাতীয় গন্ধ। লেমনগ্রাস আর এই মাছের আচার, দুই-এ মিশে সে কী খুশবু! এমনকি একদিন এক কৃষকের বাড়িতে হরিনের মাংসও ওই বিজাতীয় গন্ধের কারণে পেট পুরে খাওয়া গেল না।
দিন এগিয়ে আসছে। আর আমার ব্যাঙ খাওয়া হচ্ছে না। এই দুঃখে যখন আমি ভেঙে পড়েছি, সেই সময় পাওয়া গেল একটু বড় ব্যাঙ, যাকে পিস করা যাবে, ফলে আমাকে অন্তত ব্যাঙের চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খেতে হবে না, আমি বেশ পিসফুলি খেতে পারব। খেয়ে দেখলুম, দিব্বি বাদুরভাজার মত খেতে। হ্যাঁ, বাদুরভাজা খেয়েছিলাম নেপালে – সে আবার বেশ মাছভাজার মত খেতে। সে গল্প আর একদিন।
এরকম গল্প করেছিলো আমার এক বন্ধু চিন ঘুরে এসে। এই লেখাটা সুস্বাদু।
LikeLike
পছন্দের
LikeLike