ভ্রমণ ওভার টু অসলো টিনা সরকার বসন্ত ২০২০

টিনা সরকার


ব্যক্তিগত কিছু দরকারে হঠাৎ করে পাড়ি দিলাম সুদূর নরওয়েতে। ওখান থেকে যেতে হবে সুইডেনে। মাত্র কয়েকদিনের প্রস্তুতি, হজগজ করে যা পারলাম প্যাকিং করলাম, বিশেষ করে শীত পোশাক। সামনে ছয় মাস রাতের ভ্রুকুটি। আবার বন্ধুজনের দেওয়া সমুদয় প্যাকেট তাদের পরিজনদের জন্য যার সম্মিলিত ওজন দশ কেজির মতো, সেগুলো নিতে গিয়ে নিজের কিছু বাদ দিলাম। যাক গে, মানুষের জন্যি মানুষ।
কলকাতা থেকে পরশু রাতে রওনা। পথে দোহা হয়ে অসলো। একা একা ট্রাভেল করতে আমার ভালোই লাগে, কারণ ভুলভাল করলেও বকার কেউ নেই।
বলার বিষয়টা হল, ২০২০-র ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য দোহা তুলকালাম তৈরি। এয়ারপোর্টেও তার ছোঁয়া। নিজের গেট নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে চারতলায় উঠলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম, ট্রেনে করে ঈপ্সিত গেটে যেতে হবে। শুনে হাঁ হলাম। কারণ, আমার দুটি ফ্লাইটের গ্যাপ ছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট এবং আমি নিশ্চিত ছিলাম ফ্লাইটটা মিস করব। আমার হাঁ মুখকে আরও বড়ো করে দু’কামরা বিশিষ্ট একখানি মিনি বুলেট ট্রেন সামনে হাজির হল। তাতে চেপে মিনিট খানেকের মাথায় একজন ব্রিটিশ নাগরিকের সহায়তায় সঠিক গেটের সামনে পৌঁছে গেলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় ট্রেনের ছবি তুলতে পারিনি। তবে চমৎকৃত হয়েছি। কী উন্নত দেশ!
পরবর্তী সাত ঘণ্টা ঘুমিয়ে আরাম করে অসলো পৌঁছে দেখি, সেই বিশেষ চিরশত্রু ব্যক্তিটি নিতে আসেননি। ফোন করা সম্ভব নয় আর, মাছিও নেই যে মারব। ইতিউতি দু-চারটি ছবি তুললাম। খানিক বাদে উনি এসে জানালেন, তাঁর লেট হয়নি, আমি আগে পৌঁছে গেছি। বলার নেই কিছু। অতঃপর বাড়ির পথে।
যাত্রাপথের এবং বাড়ির সামনের কয়েকটা ছবিঃ
অসলোতে এসেছি সাতদিন হয়ে গেল। প্রথম দুটি দিন একটু শুয়ে বসে, ঘরসংসার চিনতেই কাটল। হাজার হোক অন্য লোকের সংসার, সে আবার মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন নয়। এখানে যা খুশি করা চলবে না, এই সতর্কবার্তা মাথায় রেখেই চলতে হবে আমায়।
বেড়াতে আসা এক জিনিস। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন বেড়ানোর একটা শিডিউল থাকে, মন-টন সব আনন্দে থাকে। আজ এই এই দেখব, এই এই কিনব ইত্যাদি। আমার তো তা নয়। আবার বরাবরের মতো থেকেও যাচ্ছি না যে ঘর-গেরস্থালি গুছাতে বসব। না ঘর কা, না ঘাট কা। নাহ্‌! নিজেকে ধোবির পোষ্য ভাবতে ভাল্লাগছে না।
দু’দিন কাটাবার পরে শনি-রবি বের হলাম শহর চিনতে। পাঠকরা শব্দটা খেয়াল করুন, ‘চিনতে’, ঘুরতে নয়। প্রতিবারই শত্রু ভদ্রলোকটি এই কাজটা খুব যত্ন নিয়ে করেন। কাজের আর খুব দরকারি পয়েন্টগুলোর সঙ্গে সঙ্গে বাস-ট্রাম-ট্রেনের রুটগুলোর একটি ম্যাপ গিফট করে ঘাড় ধরে চিনিয়ে দেন আর যানবাহনে চাপার একটি মান্থলি টিকিট কেটে দেন। ল্যেহ, এবার চরে খা টাইপস!
অনেক দেশেই আছে, একটা টিকিটে বাস, ট্রাম, ট্রেন, মেট্রো রেল এবং ফেরি সার্ভিস অ্যাভেল করা যায়। নরওয়ে তেমনি এক দেশ।
ইউরোপীয় দেশগুলো প্রাকৃতিক নিয়মে এবং মানুষের আচরণ ও শৃঙ্খলাবোধের প্রতিফলনে সর্বদা সুন্দর, পরিষ্কার। আর এখানে তো আরও লোক কম, শব্দ কম, ক্রাইমের সংখ্যা শূন্য। তবে অন্য সমস্যা আছে। বড্ড ঠাণ্ডা, ঘ্যানঘেনে বৃষ্টি আর সুয্যিমামা এদেশের প্রতি একেবারেই সদয় নন। ফলে ভিটামিন ডি-র খুব ডেফিসিয়েন্সি দেখা যায়। ভারতবর্ষে আমরা যে মিনিমাগনা রোদ এবং উত্তাপ পাই, সঙ্গে ফ্রি অফ কস্টে ভিটা-ডি, কিস্যু মূল্য দিই না গো এসবের! যেমন বাড়িতে থাকলে মায়ের মূল্য বুঝি না, এখানে এসে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
সোমবার গেলাম অফিসিয়াল কাজ সারতে। একা একা ট্রামে চেপে চিন্তায় ছিলাম কিছুটা। কারণ, ভাষা নরওয়েজিয়ান আর সামি (আসল উচ্চারণ আলাদা, আমার মতো আমি বললাম)। ইংলিশটা আমাদের থেকেও খারাপ, লেখা ল্যাটিন হরফে। মানে ইংলিশ অ্যালফাবেট দেখে, বানান করে যা মনে হচ্ছে, আসল উচ্চারণ তার ধারপাশ মাড়াচ্ছে না। এক দুর্বোধ্য শব্দগুচ্ছ, তাও আবার ওই কায়দার অ্যাকসেন্টে! ঠিক জায়গামতো নামতে পারব কি না খুবই সন্দেহ ছিল। হরিনাম জপতে জপতে পৌঁছে গেছি। ওমা, দেখি শত্রুমশাই দাঁড়িয়ে! বউ হারিয়ে যাবে কি না ভেবে এ-ব্যাটাও চাপে ছিল।
যথাসময়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন, বায়োমেট্রিক, ছবি ইত্যাদি শেষ করে পরের ধাপ। আধার নম্বরের মতো একটা নম্বর দেবে, সেটা পেলে পরবর্তী কাজগুলো করতে পারব। যে কাউন্টারে গেলাম, এক মোটি গোল মহিলা পেপারস দেখে পাশের কাউন্টারের মেয়েটির সঙ্গে অনেক কথা বলল। হাতে আমার কাগজটা। বুঝলাম, হয়ে গেল আমার! নির্ঘাত আটকালাম! সে ফিরে এসে ঠাঁই ঠাঁই করে কী বলল, মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। আমি বিনীত বাংরেজিতে বললাম, শুধু ইংলিশেই বলতে বা বুঝতে পারি। তখন কুঁতে কুঁতে বোঝাল, সে এখন আমাকে এই আধার নম্বরের কাগজটা দিতে অপারগ যেহেতু আমি এখানে কাজ-টাজ কিছু করছি না এবং আমার স্বামী স্কিলড প্রফেশনাল, তাই আমার সব পেপারস পোস্টে আসবে চারদিন পরে।
কী রাগ হল! আপদ কোথাকার! অথচ আমার এই কাগজটা আজ চাইই চাই। নম্বর না পেলে পরের সব কাজ আটকে যাবে।
বিমর্ষ হয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। তারপর ভাবলাম, আমি কোন রাজ্যের মানুষ, অ্যাঁ? পশ্চিমবাংলার মুখ ডোবাব? হেরে যাব! নো নো, কাজ তো উদ্ধার করতেই হবে।
দাঁড়িয়ে নজর করলাম, ত্রিশটি কাউন্টারের মধ্যে কে হেসে কথা বলছেন, ভালো ব্যবহার করছেন। বুঝে নিয়ে ফের টোকেন সংগ্রহ করে কাউন্টার নাম্বার আটাশে কথা বলা শুরু করতেই সে ভদ্রলোক আবার নিজের ভাষায় কিছু বলতে লাগলেন। এবার বুঝতে পারলাম, আমি ওঁদের ভাষা বলতে পারি কি না জানতে চাইছে। কারণ, সে ইংরেজি ভালো বলতে পারে না। আরে ভাই, গায়ের রঙ দেখেও কি বোঝে না আমি ওই ভাষা বলতে পারব না?
তাপ্পর আমি ধীরে ধীরে একটা একটা করে শব্দ বলে (সঙ্গে হাত-পা নেড়ে ও কাগজ দেখিয়ে) বোঝালাম। সব শুনে, “ওখ্যেই।” বলে উঠে গেল। ঠিক আধ মিনিট পরে প্রিন্ট আউট আমার হাতে।
তার মানে সামান্য কাজ। আগের ওই মহিলা গতরটা নড়িয়ে, কষ্ট করে উঠলেন না শুধু উঠে গিয়ে পেপারটা প্রিন্ট করতে হবে বলে। অর্থাৎ, সব দেশেই প্রায় একই ধরন, আমরা শুধু নিজেদেরকে বেশিই খারাপ ভাবি। কাজ উদ্ধার করে মনটা ভালো হল।
ফেরার পথে একটু এদিক ওদিক করলাম একা-একাই। কিছু তার ছবি, আর কিছু শনি-রবির ছবি দিলাম। পরের লেখাটায় চারপাশের কথা লিখব। জায়গাটাকে আর একটু জানা চেনা দরকার।

ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s