সুপর্ণা দেবের আগের ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখাঃ ক্যানবেরা ক্যানভাস রোদ্দুরের চিঠি, ডিডগেরিডুর সুর, অরোর তিনখানা গল্প, গ্রাফিত্তি ইতালিয়া : মুরানো বুরানো
শীতের রাতগুলো খুব খুব লম্বা হত। আমাদের ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বাড়ি। বাড়ির পেছনে মস্ত ঘন পাইনের বন। ঘোড়া ছিল প্রায় সবারই বাড়িতে। লোম ঝুমঝুমে কুকুরও। সুইডেনের এই অঞ্চল টার নাম ডালারনা। আমার ছোটবেলায় বন্ধু এমিলকে মনে পড়ে । মনে কী আর এমনি এমনি পড়ে? ওই যে হীরামন, আমার তোতা পাখি, ঘাড়ে বসে মাথা ঠুকরিয়ে দেয়। ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক। আমার তখন অনেক অনেক পুরোনো নানান কথা মনে পড়ে যায়। এমিল কিন্তু আর পাঁচটা বাচ্চার মত ছিল না, জানো ! আমি দেখতাম ও খুব আনমনা। খেলতে ভালবাসত না। জঙ্গলের দিকে পালিয়ে পালিয়ে যেত। ওর মা ছুটে ছুটে গিয়ে ওকে ফিরিয়ে আনত। আমাদের বলে যেত, এই একটু নজর রাখিস এমিলের ওপর।
এমিলের কথা বলতেও একটু অসুবিধে হত। তবে ওর কতগুলো ব্যাপার ছিল, জানো! এক হল গান। বা যে কোনো সুর ওকে খুব টানতো। দুই হল, যে কোনো কাগজ চারকোল বা কাঠের টুকরো ভোঁতা ছুরি পেলেই কিছু না কিছু বানাতেই থাকবে, আঁকতেই থাকবে। আর শেষটা হল তুমি যদি ওর বাড়িতে যাও, চলে আসবার সময় ও ছাড়তেই চাইতো না। সে কী ভীষণ চেঁচামেচি। শান্ত করাই মুশকিল হতো।
আমাদের ছোট্ট গ্রামের সবাই প্রায় কাঠ কাটত। আমার বাবা, এমিলের বাবা। লগ হাউস থাকত গ্রামে। কাঠ কেটে সেখানে জড়ো করত। আমাদের বাড়িতেও কাঠ বোঝাই করা থাকত । শীতের সেই সব দিনে বাইরে বেরুনোর প্রশ্নই নেই। চারদিকে বরফ, হাড় হিম ঠান্ডা। মায়েরা শুকনো জমানো খাবার খেতে দিত , গরম সুরুয়া বানাতো।
আমাদের বাবারা কাঠ কাটতে অনেক গভীর জঙ্গলে চলে যেত। যখন প্রচন্ড বরফ পড়ত বাড়ি ফিরে আসতে পারত না।
মা বলত বনের গভীরে ওরা থাকার জায়গা বানিয়ে নিয়েছে। বাবারা যখন ফিরে আসত সঙ্গে নিয়ে আসত পুতুলের মত ছোট্ট ছোট্ট কাঠের ঘোড়া। আমরা খুব মজা পেতাম। ওগুলোই আমাদের খেলনা। বাবা বলত ঝড়তি পড়তি কাঠের টুকরো টাকরা দিয়ে এইসব আমরা সন্ধে বেলায় বসে বসে বানাতাম। ছেলেমেয়েদের কথা খুব মনে হত কিনা ।
এমিলের বাবাও আনত কাঠের পুতুল ঘোড়া। আমরা ঘোড়া ঘোড়া খেলতাম, ঘোড়ার লড়াই হতো। এমিল তো খেলত না। ও কী করত জানো ! যত কাঠের টুকরো জড়ো করে ভোঁতা একটা ছুরি দিয়ে ঘোড়া বানাতো। ওর বাবার বানানো ঘোড়া দেখে দেখে। মুখ তুলে তাকাত না। গরম পড়লে সুনটুনি মুনটুনি ফুল, চড়াই পাখি, কাঠবিড়ালি ওর চারপাশে খেলে বেড়াত।
২
সুইডেন হেরিটেজ শিল্পকলায় ডালারনা অঞ্চলের কাঠের পুতুল ঘোড়ার খুব কদর। একে বলে ডালা হর্স। প্রায় সতেরশ সালে এর জন্ম।
এই কাঠ কাটা ডালা হর্স সেইসব কাঠুরিয়াদের হাতের সৃষ্টি। তারাই এর প্রধান শিল্পী। পরিবার ছেড়ে লম্বা লম্বা ঠান্ডার রাতে ঘন জঙ্গলে বরফ জমা রাতে আগুনের সামনে গোল হয়ে বসে গল্প করতে করতে এই ঘোড়া বানাত।
১৭১৬ সালে সুইডেনের রাজা সপ্তম চার্লস ভয়ানক যুদ্ধ শুরু করলেন ইউরোপের নানা দেশের সঙ্গে। এই ডালারনা মোরা অঞ্চলের পাহাড়ে প্রচুর সেনা সেই সময় ঢুকে পড়ে ছিল। ভয়ানক ঠান্ডা। রসদ,খাবার কমে আসছে।এক সেনা মনের দুঃখে বসে বসে ওই আমাদের বাবার মতই একটা ঘোড়া বানাল। বাড়িতে ফেরার আগে ঘোড়া গায়ে লাগিয়ে দিল লাল রঙ। ওটা ওর বাচ্চাকে দেবে বলে। আমাদের পাহাড়ে লাল রঙটা পাওয়া যেত। ফালুনে নামে জায়গায় একটা তামার খনি ছিল। লাল রঙ টা তাই সহজে জোগাড় হয়ে যেত । ওই মনমরা সেনাটি তার বানানো কাঠের খেলনা ঘোড়ায় লাল রঙ লাগিয়ে দেয়। সুইডেন সমেত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ গুলোর লোকশিল্পের ধাঁচ টিকে বলে কারবিট (Kurbit)। কারবিট এর পুরোনো অর্থ কুমড়ো। তবে পাতাপুতির নকশা দেখে মনে হয় কুমড়ো নয় তার ফনফনে লতা থেকেই এই নকশার জন্ম।
সেই মনমরা সেনাটি এবারে ওই লাল রঙা ঘোড়ার বসার জায়গায়, ঘোড়ার বকলশে ওই কারবিট নকশা এঁকে দিয়ে বেজায় খুশি হয়ে যায়। তবে কুমড়োর ওই লকলকে লতা কী করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে এলো সে অনেক বড় গল্প। আমার তো মনেই ছিল না। হীরামন, আমার তোতা পাখি, সেই বলে বলে দিচ্ছিল।
এদিকে বাচ্চার জন্য খেলনা বানালে কী হবে, পেটে তো খাবার নেই। তাই সেনাটি যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, বাড়ির গিন্নি অমন সুন্দর একখানা পুতুল ঘোড়া দেখে তাকে এক বাটি গরম স্যুপ খেতে দেয়। ওই সেনাটিকে দেখে এবারে অন্য সেনারাও পুতুল ঘোড়া বানিয়ে রঙ করে কারবিট নকশা করে তার বিনিময়ে খাবার পেতে লাগলো ওখানকার লোকজনদের কাছ থেকে। কাঠুরিয়ারা যে পুতুল বানাত শীতের সেই রাত্তিরগুলোতে, সেগুলো এখন আরো চনমনে হয়ে উঠলো সেনাদের হাতে এসে। মানুষের খিদে, তা সে আমার বাবার মত কাঠুরেই হোক বা রাজার সেনা, সেই খিদের থেকেই জন্মালো কনকনে শীতের দেশের ডালা ঘোড়া। তাই সুইডেনের হস্ত শিল্প মানেই ডালা ঘোড়া।
৩
এমিলও কিন্তু ঘোড়াকে রঙ করার চেষ্টা করেছিল। বাচ্চা তো, তার ওপর একেবারেই অন্যরকম। যা পারত তাই করত। এমিলের বাবা ফেলে দেওয়া কাঠ থেকে একটা বাঁশিও বানিয়ে দিয়েছিল। ওর বাবা যেদিন শহরে চলে গেলো আরো ভাল কোনো কাজের সন্ধানে, এমিলকে সেদিন ধরে রাখা যায়নি। এতো কাঁদছিল, এতো কাঁদছিল !
তারপর কত কত সময় পেরিয়ে গেল। কত সময়, তা আমি ঠিক করে বলতে পারব না। সেটা পারে কেবল হীরামন।
একদিন দেখি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম শহরের পুরোনো পাড়া গামলাস্তান দিয়ে হাঁটছি, আমার ভাইপো অরোর সঙ্গে।
ও মা, গামলাস্তানের দোকানে দোকানে ডালা ঘোড়া। আমার মাথার মধ্যে কী রকম যেন করতে লাগল! অরো বলল, “তুমি এমন করছ কেন?”
আমি বললুম, “জানিস, এই ঘোড়াগুলো আমি দেখেছি আগে।”
আরো বলল, “কোথায়? স্বপ্নে? হি হিহিহি, তুমি তো এখানে কোনদিন আসোইনি!”
আমি বললুম, “সামনের ওই চার্চটায় চল। মাথা ঘুরছে। একটু বসব। জল খাবো।”
৪
গামলাস্তান, স্টকহোমের পুরোনো পাড়া। রাজপ্রাসাদ, পুরোনো বাড়ি, চার্চ, হেরিটেজ বিল্ডিং, নোবেল একাডেমি, ডালা হর্স একাডেমি সবই এখানে। এখানেই সব হেরিটেজ ওয়াক করানো হয়। পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। চলতে গেলে খটখট আওয়াজ হয়। এখানেই সবচেয়ে পুরোনো চার্চ, সেন্ট নিকোলাস চার্চ, দ্য গ্রেট চার্চ। এখানেই অপেক্ষা করছিল একটা সারপ্রাইজ। বিস্ময় !
এমিলের সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হয়ে যাবে, কোনোদিনই ভাবিনি। স্টকহোমের এই পুরোনো পাড়ার চার্চে ঢুকেছি। অসাধারণ একটি পাইপ অর্গান। চকচকে ঝকঝকে বিরাট। সুন্দর নকশা। সোনালি রঙের। দেওয়ালে হার্প বাজনার ছবি। একজন গাইড, ওই চার্চের ই একজন, অনেক তথ্য বলে বলে দিচ্ছিলেন। আমাদের চোখ পাইপ অর্গানের দিকে। উনি হঠাৎ বললেন, চলুন আপনাদের ওপরে নিয়ে যাই। অর্গানের ঘরে।
আমরা খুব ই খুশি। এমন যেচে দেখাতে চাইছেন যখন! বিদেশ বিভুঁইয়ে আশাই করা যায় না। সেই মধ্যযুগীয় সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ওপরে।
ওপরে দেখি, সে এক কর্ম যজ্ঞ। নানান ধরনের যন্ত্রপাতি, এই তার, ওই তার। নানান রকম রিড।
এরই মধ্যে আমার মনের মধ্যে কে যেন বলছে আমাকে কেউ দেখছে! আমি মাথা ঘোরাতেই এমিলকে দেখতে পেলাম। চিনতে পারলাম।
“তুমি? এখানে?”
এমিলের চোখদুটো চিকচিক করছে। গোঁফের সরু সবুজ রেখা। তাইতো! ওর বাবা শহরে চলে যাবার পর ওদের সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছিল। সারাদিন কাঁদত। তারপর ও কোথায় হারিয়ে গেছিল। মনে পড়ল, আবছা আবছা মনে পড়ল।
ওই যে ওর একটা অসুখ ছিল বলেছিলাম না? কেউ কোথাও চলে গেলে ও খুব কষ্ট পেত। ও মানতে পারত না। মানাতেও পারত না। আবার বুঝিয়ে বলতেও পারত না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। আমি পরে জেনেছি এই অসুখটাকে বলে অটিজম।
এমিলকে এভাবে দেখব, ভাবতেই পারছিলাম না। অবিকল এমিলের মাথা। একটু ভাঙাচোরা, টেবিলের ওপর রাখা!
চার্চের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, “একে কোথায় পেলেন?”
উনি খুব হকচকিয়ে গেলেন।
“তাইতো! কী করে, কী ভাবে অর্গান রুমে এই মূর্তিটা এল, আমার তো জানা নেই।”
এমিল আস্তে আস্তে বলল, “সন্ধেবেলা এসো কিন্তু। এরা আজ অর্গানে বাখ বাজাবে।”
আমি ওই ভদ্রলোককে বললাম, “কনসার্ট আছে আজ, না? বাখের সিম্ফনি বাজানো হবে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
বললাম, “ওই ঢোকার মুখে লেখা দেখলাম, তাই।”
সন্ধেবেলা অপূর্ব সুন্দর পাইপ অর্গান বেজে উঠল। গমগম করছে। আর সেই মধ্যযুগীয় চার্চে, মোমবাতির আলতো আলোয় এমিলের প্রিয় সিম্ফনি আলোর ডোম বেয়ে, মা মেরির চুল ছুঁয়ে যিশুর চোখের পাতা,পায়ের পাতা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে আমার হাতের তালুতে একটা জোনাকি হয়ে জ্বলতে লাগল!