ভ্রমণ দূরের মাটির ধুলো (ভেনিস) অরুন্ধতী রায়চৌধুরি শরৎ ২০১৬

আরেক পর্ব- দূরের মাটির ধুলো (প্যারিস)   অরুন্ধতীর আরো এক লেখা প্লুটো ও প্রসারপিনা

bhromonvenice01 (Medium)

ভেনিস – ‘ভেনিৎসিয়া’! ইতালীয়দের মিষ্টি হাসিভরা মুখে ওর এই আদরের নাম। সুন্দর ভাষা – শৈশবের আধো উচ্চারিত কথার মত। এরা হাসিমুখে যখন বলে – ‘গ্রাতসিয়া সিনিওরা’, ‘গ্রাতসিয়া সিনিয়র’, – ধন্যবাদ জানায়, মনে ভারী ফুর্তি আনে। আমাদের ভাষার ধন্যবাদ টুকুতে কি এদের মত আরও একটু আন্তরিকতা মেশানো যেত না!

পয়লা অক্টোবর। ফ্লোরেন্স থেকে আসছি ভেনিসের পথে। উপর থেকে দেখেছিলাম নিচে শুধু জল। – উপকূলবর্তী সমুদ্রের বিস্তার। তার মাঝখানে টুকরো টুকরো ঘাসের জমি খানিকটা ছড়িয়ে পড়ে আছে – ওই ভেনিস। কে জানত তখন ওই ধূসর দ্বীপখন্ডটুকুর মধ্যে যে সৌন্দর্য, তা কত কবির স্মৃতির, – কত শিল্পীর সার্থক স্বপ্নের প্রতীক!

সমুদ্রের ওপর দিয়ে দীর্ঘ সেতু গেছে বিমান-ঘাঁটি থেকে ভেনিসের গায়ে। সেই সেতু পার হতে আমাদের আধঘণ্টার মত লাগল। দুধারে ঢেউ ভেঙে পড়ছে আর দিগন্ত ছাড়িয়ে এড্রিয়াটিকের নীল জলের বিস্তারে চোখের আরাম। দূরে ভেনিসের উপকূলে বন্দরে অগুনতি জাহাজ আর ক্রেইন – কালো কালো রেখায় ছবি যেন আকাশের পটভূমিতে। কুমারিকার সেতু-বন্ধন মনে পড়ল। সেদেশ-এদেশ, একাল আর সেকাল – এমন কত যুগ যুগ ধরে মানুষের অসাধ্য সাধনের প্রয়াস।

bhromonvenice02 (Medium)ভেনিসের প্রান্তে বাসের রাস্তা শেষ হল। এবার শুরু গন্ডোলার সাম্রাজ্যি। এরা সব কালো, সরু-লম্বা নৌকা। যতই চেয়ে দেখি, মনে হয় না এরা রক্তমাংসের শরীরের এত কাছের। যদি কোন হেঁয়ালির রাজ্য থাকে আর থাকে আনাচে কানাচে তার দোত্যি-দানা লুকিয়ে, তবে এই নৌকা ঠেলেই বোধহয় সেই যাদুকর রাজকুমার রাজকন্যার সন্ধান পেয়েছিল।

খালের পরে খাল গেছে বড়ো থেকে ছোটো, আরও ছোটো, – আরও, যেমন আমাদের কলেজ স্ট্রিট, মির্জাপুর অ তারপর ছকু খানসামার গলি। তাদের দুপাশে আছে যেমন সারি সারি দোকানঘর, বাড়ি, এরও তেমনি জল থেকে উঠে গেছে শেওলাধরা উঁচু উঁচু কালো পাথুরে দেওয়াল। এ দৃশ্য কিন্তু অভিনব। মোটর, বাস কি ট্রাকের সন্ধান নেই। বড়ো বড়ো লঞ্চ আমাদের স্টেটবাসের মতই স্টপেজে থামছে আর চাকুরেরা উঠছে নামছে দল বেঁধে। ছোটো লঞ্চ তো আছেই, আরও আছে মোটর বোট আর অসংখ্য গন্ডোলা। এই খুদে গন্ডোলারা ব্যস্ত শহরকে আরও ব্যস্ত করে তোলে। অনবরত ছোটাছুটিতে খালের জল তোলপাড় হয়। শেওলাধরা বাড়ির সুন্দর নেমে আসা সিঁড়ির পৈঠায় ছল্‌ছল্‌ ঢেউ তুলে ভারী মজা পায়।

গ্র্যান্ড-ক্যানাল যেখানে শেষ হল আরম্ভ হল অথৈ সমুদ্র। ছড়ানো ছোটো ছোটো দ্বীপে প্রাসাদে, গির্জা, ছোটো-বড়ো বাড়ি দিয়ে সাজানো এক একটি পল্লী যেন। এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় মোটর-বোট আর গন্ডোলারা যাতায়াত করে, যেমন করে আমাদের ট্যাক্সি আর রিক্সাওয়ালারা বর্ষার জল ভেঙে এগোয়!

এই সব দ্বীপ-খন্ড ছাড়িয়ে আরও দূরে, বহু দূরে চোখে দিগন্তে আলোর মালা – ‘লিডো’। কাছের গির্জা থেকে ভেসে আসা সন্ধ্যার ঘণ্টাধ্বনি ঢেউয়ের সঙ্গে কেঁপে মিশে যায়। খালের উপর যে অসংখ্য সেতু তাদের মনোরম কারুকার্য অতীতকে কাছে আনে। কাঠের আর পাথরের এই সেতুগুলো একভাবে দাঁড়িয়ে আজ বহু যুগ ধরে।

bhromonvenice04 (Medium) আমাদের ইতিহাসের পাতার ‘ব্রীজ-অফ-সাইস’ আজও তেমনই আছে। কে জানে কারাগারে নিক্ষিপ্ত বন্দির কত দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে। হতভাগ্যদের এপার থেকে ওপারের বন্দিশালায় চালান করা হত যখন, তাদের দৃষ্টি শেষবারের মতই হয়ত মুক্তি খুঁজত এই আকাশে যাকে পেছনে নিয়ে আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এই সেতু কিভাবে তার অতীত দিনের কথা? নিচের বয়ে চলেছে মন্থর, কালো শেওলা-সবুজ জল। কারাগারের গরাদের ফাঁকে এখন কিন্তু দেখা যায় ঝক্‌ঝকে রঙিন বেলোয়ারি কাঁচের দোকান!

bhromonvenice05 (Medium)আমরা উঠেছিলাম হোটেল-কাস্তেল্লোতে ভেনিসের প্রাণকেন্দ্র সান-মার্কো-স্কোয়ারের এক ধারে। আমাদের কিন্তু সত্যিই ভারী সুবিধে হল যখন তখন এই চত্ত্বরটিতে চলে আসার। বহু দূর থেকে নাম শোনা গেছে সান-মার্কো গির্জার – চোখে দেখে ভালো লাগল।

গির্জার সামনে প্রাঙ্গণ – এক ধারে দাঁড়ালে আর এক প্রান্তের মানুষের মুখ চেনা যায় না এত বড়ো। লাখো লাখো পায়রা ওড়ে আর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে, বুড়ো-বাচ্চায় জটলা করে – বাদাম চিবোয়। প্রাঙ্গণ ঘিরে এক প্রাসাদ। এই প্রাসাদের নিচেটা এখন শৌখিন দোকানে দোকানে ছেয়ে গেছে। ভেনিসের কাচের কারুকার্য, ঝালর, ঝাড়-লন্ঠন আর ঘর সাজাবার অসংখ্য অকল্পনীয় উপকরণ। রাতের বেলা জোরালো আলোয়, রঙিন কাঁচের ঠিকরে পড়া রোশনাইয়ে জমে ওঠে আড্ডার আসর।

খোলা আকাশের তলে ‘কাফে’ ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। হলুদ-সবুজ-সাদা-নীল হালকা চেয়ার পাতা এলোমেলো। মিষ্টি অর্কেস্ট্রার সুরে দূরদেশের অতিথিদের তৃপ্ত করে। সন্ধে হয়ে এল। প্রাণচঞ্চল ভেনিসে যেন সারাদিনের উৎসব। বিকেলের বিষণ্ণতা তাই স্পর্শ করে না।

লঞ্চে উঠলাম। সমুদ্রের জল একাদশীর চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। বাড়ির কথা মনে পড়ছে থেকে থেকে। কোথায় কোন সুদূরে শ্যামল বাংলার ছেলেমেয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। পায়ের কাছে ধূসর, নোনা জল আছড়ে পড়ছে। ঠান্ডা জলের ছোঁয়ায়, এত অন্তরঙ্গতার মাধুর্য।

bhromonvenice03 (Medium)‘লিডো’তে পৌঁছলাম। চমৎকার রাস্তা গেছে সমুদ্রের ধার দিয়ে ‘ক্যাসিনো’র দিকে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর সৌধের সামনে নাবলাম বাস থেকে। হেঁটে চললাম জনহীন স্বল্পালোকিত রাস্তা ধরে। একদিকে প্রাসাদ, অন্যদিকে ধুধু বালি। দারুণ হাওয়ায় সমুদ্রের জোলো ভেজা গন্ধে ছুটে এসে ধাক্কা দিচ্ছে অন্ধকার ভূতুড়ে গাছগুলোয়। এ রাস্তাই! কি উন্মাদনা, উত্তেজনা চিত্র-প্রতিযোগিতায়। উঁচু গ্যালারী বাঁধা হয়েছিল রাস্তার ধারের দর্শকদের জন্যে, রাস্তার অপর পারে। আজ সেখানে তার কিছু অংশ এখনও ইতস্তত ছড়িয়ে আছে আর স্ক্রু-বল্টু। হঠাৎ মনে পড়ে গেল সত্যজিৎ রায়ের কথা। এখানে এই বাঙালির ছেলে বিরাট এক সম্মানের অধিকারি হয়েছিলেন।

‘লিডো’ থেকে ফিরে এলাম। ছোটো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলাম রাতের খাওয়া। পায়ে হাঁটা গলির আসে-পাশে নিচু নিচু প্রচুর খানাঘর। খাদ্যসম্ভার – সামুদ্রিক মাছের রান্না। অতি বৈচিত্রপূর্ণ! দেড়-ফুট লম্বা আর ইঞ্চি ছয়েক চওড়া বিশালাকার সুসিদ্ধ, লাল টকটকে চিংড়িরা শুয়ে আছে দিব্যি কাঁচের ঘরটিতে। ‘ঈল’ মাছেরা সাপের মত ওই চিংড়িদের জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। অতিকায় সামুদ্রিক শামুক ও ঝিনুকের শোভা স্যালাড পাতা ও নানান রঙের সব্জির সাজিতে। এ দৃশ্যে আমাদের অবস্থা হল সাংঘাতিক। আজগুবি কাঁকড়া আর ভেটকি মাছেরা যেন আমাদের তাড়া করে এল। মাছ আর মুখে তুলতে পারলাম না। নিছক রুটি-বেগুন ভাজা (এদের এটা প্রিয় খাদ্য) চিবিয়ে সে রাত্তিরে অব্যাহতি পেলাম। এমন রাক্ষুসে খাওয়া কেন, আর অমন বিভীষিকাময় সাজ-সজ্জাই বা কেন? শিল্পীর ক্যানভাসেই এদের মানায় ভালো। খাওয়ার প্লেটে আনলেই কিন্তু ঘটল বিপর্যয়।

রাত বারোটায় সান মার্কো স্কোয়ারের ঘড়ি ঘরের ওপর থেকে দেখতে পেলাম গভীর রাতের ভেনিসের সৌন্দর্য। জল আর জল, তাকে বেঁধেছে আলোর মালা – লালে-হলুদে-সবুজে, ঠিক ভেনিসের রঙিন কাচের মালার মত। বহু নিচে ছুটে চলেছে এদিকে ওদিকে ক্ষুদ্র আলোক বিন্দু – জলযানরা। তাদের প্রতিবিম্বে জল চঞ্চল হয়ে উঠছে থেকে থেকে। সমুদ্রে যেন বিন্দু নোনা জল – শান্ত, ঘরের মানুষটি। আকাশে জলে আর ডাঙাতে এমন নিবিড় অচ্ছেদ্য বন্ধন কোথাও আর দেখিনি।

পরদিন ভোর ছ’টায় হোটেল থেকে রওনা হলাম বাক্স-ব্যাগ, ঝোলা-ঝুলি কাঁধে। আমাদের হোটেলের খুব কাছেই ছিল এয়ার-টারমিনাল। ওখানে জিনিসপত্র জমা করে দিয়ে এলাম জলের ধারের বাঁধানো রাস্তায়। তখনও সূর্য ওঠেনি। ঠান্ডা ভোরের ভেজা হাওয়ায় দেখি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা লেগে গেছে তাদের গন্ডোলা আর মোটর বোট পরিষ্কার কাজে। লাফিয়ে চলে যাচ্ছে এক নৌকো থেকে আর একটিতে। রাত্রের শিশির, জল স্পঞ্জ দিয়ে শুষে নিচ্ছে নিপুণ ক্ষিপ্রতায়। নিংড়ে নিচ্ছে ঠান্ডায় জমে যাওয়া লাল ছোটো ছোটো হাতে।

আটটার মধ্যে পৌঁছলাম উড়োজাহাজ ঘাঁটিতে। ভেনিসের একটি দিন, শিশুর খেলাঘরে যেন হঠাৎ বড়োর ঢুকে পড়া আর আলাদিনের রাজত্বে একটিবার ঘুরে আসা।

অলঙ্করণঃ লেখক

মূল প্রকাশঃ শারদীয় তরুণতীর্থ ১৯৬৩ । লেখকের কন্যা শ্রীমতী যশোধরা রায়চৌধুরীর সৌজন্যে প্রাপ্ত ও অনুমতিক্রমে প্রকাশিত

জয়ঢাকের ভ্রমণ লাইব্রেরি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s