শ্রদ্ধাঞ্জলি আহত ঈশ্বর কৃষ্ণেন্দু দেব শরৎ ২০২০

আহত ঈশ্বর

কৃষ্ণেন্দু দেব

সামনের ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী পূর্ণ হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এক ‘অজেয় পৌরুষ’ ও ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’-এর অধিকারী ছিলেন তিনি। আমরা জানি, উনবিংশ শতাব্দীর সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ এই ভারতীয়ের অতিমানবীয় কর্মকাণ্ড মূলত কলকাতাকে কেন্দ্র করেই সারা বাংলা তথা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। অথচ গতবছরই দেখলাম এই শহর কলকাতার বুকেই ভাঙা হল তাঁর মূর্তি। এমন কাজ যে আগেও হয়নি তা নয়। মৃত্যুর পরে এই লাঞ্ছনা নিশ্চয়ই বিদ্যাসাগর মশায়ের প্রাপ্য ছিল না।

তবে একথাও সত্যি যে, জীবিত অবস্থাতেও ওঁকে কম যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি। ওঁকে আহত করেছিল ইংরেজ শাসক, তাদের করুণা-লোভী জমিদার শ্রেণির বাবু সম্প্রদায়, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের একটা বড়ো অংশ এবং পরিবারের আপনজনেরাও। এই তালিকায় তাঁর পরম আরাধ্যা জননী, সহধর্মিণী এবং একমাত্র পুত্রও বাদ ছিলেন না। পাশাপাশি বিদ্যাসাগরকে দেখে যেতে হয়েছে একাধিক বন্ধু-মৃত্যু, আর তাঁর প্রিয় কন্যাদের বৈধব্য। বন্ধু ও আত্মীয় বিচ্ছেদের বেদনা আর প্রবল অর্থাভাবে জর্জরিতও হতে হয়েছে। তাও মানুষটা নিজের সংকল্প থেকে কখনও সরে আসেননি, অন্যায়ের কাছে একবারের জন্যও মাথা ঝোঁকাননি। আসলে নিজের অদম্য জেদ আর অসীম পাণ্ডিত্যকে পাথেয় করে তিনি এক অসম যুদ্ধ লড়তে নেমেছিলেন। কর্মজীবনের প্রথমভাগে ঐ যুদ্ধে খানিক সাফল্য পেলেও শেষ তিন দশক যেন নৈরাশ্যই ওঁর সঙ্গী হয়েছিল। ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাও যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেননি। লড়ে গেছেন মাথা উঁচু করে, তবে ঢক্কানিনাদ না করেই। মাইকেলের ভাষায় তাই আমাদের ঈশ্বর হলেন একজন Proud, silent, lonely man। আর এই কারণেই উনি চিরপ্রণম্য।

বিদ্যাসাগর বেঁচে ছিলেন ৭১ বছর। সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে ওঁর লড়াইয়ের কথা কমবেশি সবাই জানেন। তা আলোচিতও হয়েছে বহুল পরিমাণে। কিন্তু নিজের কর্মজীবন থেকে শুরু করে আমৃত্যু, এমনকি মৃত্যুর পরেও উনি যে বারংবার আঘাত পেয়েছেন, হয়েছেন ক্ষতবিক্ষত, সে বিষয় নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। আজ তাই সেসব কথাই স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করব এই নিবন্ধে।

প্রথমেই আসা যাক ইংরেজ শাসক এবং তাদের ধামাধরা দেশিয় বড়োকর্তাদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মতবিরোধ প্রসঙ্গে। আমরা জানি ১৮৪১ সালের ১০ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজ থেকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার ১৯ দিন বাদেই মাত্র একুশ বছর বয়েসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত পদে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর ১৮৪৬ সালের এপ্রিলে পেলেন সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বভার। রসময় দত্ত তখন ঐ কলেজের সেক্রেটারি। পেশায় আইনজীবী ঐ মানুষটি রোজ দু’ঘণ্টার জন্য কলেজে আসতেন। বিদ্যাসাগর নিজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেই কলেজের নিয়ম-কানুন বা পঠন-পাঠনের বিষয়ে নানা পরিবর্তন দরকারি বলে মনে করলেন। সেকথা জানালেন রসময় দত্তকে। কিন্তু সেসব প্রস্তাব উকিলবাবুর যথারীতি মনে ধরল না। তিনি চাইলেন পুরনো নিয়মই বহাল রাখতে। কর্মজীবনে বিদ্যাসাগরের এই প্রথম খারাপ লাগা। তাই পরের বছরই ছেড়ে দিলেন সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব।

উনি আবার চলে গেলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। আসলে ‘বিদ্যাসাগর আর যাহা হউন, গতানুগতিক ছিলেন না। কেন ছিলেন না তাহার প্রধান কারণ, মননজীবনই তাঁহার মুখ্য জীবন ছিল।’ (রবীন্দ্রনাথ) তাই শিক্ষা-সংস্কার নিয়ে তাঁর ভাবনা রসময় দত্তের সঙ্গে মিলবে না, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর আবার ফিরে এসেছিলেন সংস্কৃত কলেজে। ১৮৫১-র জানুয়ারিতে পেলেন অধ্যক্ষের পদ। সেই সময়ে সেক্রেটারির পদটাও তুলে দেওয়া হল। তাই শিক্ষা-সংস্কারের যে পরিকল্পনা আগেই করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত করতে ওঁকে আর বিশেষ বেগ পেতে হল না। সব বর্ণের হিন্দুদের জন্য খুলে দিলেন সংস্কৃত কলেজের দরজা। পঠন-পাঠনে নিয়ে এলেন কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা। সিলেবাস করলেন আধুনিক আর বিজ্ঞানসম্মত।

বিদ্যাসাগর যে শিক্ষা-সংস্কারের মাধ্যমে ভারতীয় ছাত্রদের ভাবনা-চিন্তাকে স্বচ্ছ এবং আধুনিক করতে চেষ্টা করছেন, তাদের পুরনো ভাববাদী চিন্তাধারা থেকে বের করে বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন, সেটা ইংরেজ শাসকরা ভালো চোখে দেখেনি। তারা বুঝেছিল এতে তাদের দেশ শাসনে অসুবিধা হবে। কারণ ছাত্ররা যত ঠিক  জানবে, তত তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বিচারের ক্ষমতা বাড়বে। তৈরি হবে জাতীয়তাবোধ। সেটা ইংরেজদের মোটেই কাম্য ছিল না। তাই তারা নানাভাবে পুরনো ভাববাদী ধারণাই ছাত্রদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করল। এই প্রসঙ্গে ব্যালান্টাইনের প্রস্তাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

১৮৫৩-র সেপ্টেম্বরে বারানসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ জেমস আর ব্যালান্টাইন কলকাতায় এসে সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করেন। ব্যালান্টাইন চেয়েছিলেন আইরিশ বিশপ জর্জ বার্কলের ‘An Inquiry into Human Knowledge’ বইটা কলকাতার সংস্কৃত কলেজের পাঠ্য করতে। কারণ বার্কলের দর্শনের সঙ্গে বেদান্তের ভাবনার সাযুজ্য আছে। অতএব ওটা পাঠ্য হলে ভারতীয় ছাত্ররা ইউরোপীয় শিক্ষার প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হবে। মানে ব্যালান্টাইন চেয়েছিলেন ভারতে ভাববাদী চিন্তারই প্রসার ঘটাতে। পাশাপাশি তিনি এও প্রস্তাব দেন স্টুয়ার্ট মিলের যে লজিক বইটা পড়ানো হয়, সেটা পুরো পড়ানোর দরকার নেই। উনি বইটার একটা সারসংক্ষেপ লিখেছেন, সেটাই পাঠ্য হোক।

বিদ্যাসাগর কিন্তু দুটো প্রস্তাবেই আপত্তি জানালেন। বার্কলের দর্শন বলছে, আমাদের চারপাশের দুনিয়াটা আসল নয়, তা আমাদের মনের তৈরি করা। আমরা যেমন ভাবি, বস্তুজগতকে ঠিক তেমনটাই মনে হয়। ভারতীয় শাঙ্কর বেদান্তও বলে এই জগতটা মায়া, স্বপ্ন দেখার ভ্রম মাত্র। ব্রহ্ম ছাড়া সবই মিথ্যা। বিদ্যাসাগর অজ্ঞেয়বাদী বাস্তবচিন্তার মানুষ। তাই অনেক মিল থাকলেও এই দুই দর্শনই যে ভাববাদী ও ভ্রান্ত সেটা উপলব্ধি করতে ওঁর বিশেষ অসুবিধা হয়নি। তাই বার্কলে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে উনি প্রবল আপত্তি তুললেন।

বেদান্ত বহুদিন ধরে সংস্কৃত কলেজে পড়ানো হচ্ছে। সেটা পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিতে গেলে তুলকালাম বেধে যাবে। বাস্তববাদী বিদ্যাসাগর তাই এতদিন বেদান্ত নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি। ভেবেছিলেন স্টুয়ার্ট মিলের লজিক বিস্তারিতভাবে পড়লেই ছাত্ররা যুক্তিবাদী হয়ে উঠবে। সেই জন্যই ঘনিষ্ঠ মহলে মন্তব্য করেছেন, কতকগুলো কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়তেই হয়। কী কারণে পড়তে হয় তা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্ত দর্শন সে সম্বন্ধে আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। …যখন এগুলো পড়তেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসেবে ভালো ইংরেজি দর্শন শাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার। কিন্তু যখনই জানলেন মিলের লজিক বইটাও সংক্ষিপ্ত করে দেওয়া হবে, তখন আর প্রতিবাদ না করে পারলেন না।

ইংরেজরা বুঝে গেল, বিদ্যাসাগর তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে যুক্তিবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে চান। আগেই বলেছি, তাতে তাদের অসুবিধা বিস্তর। ভারতের মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে উঠলে এদেশে ইংরেজদের উপনিবেশ নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন উঠে যাবে। ভারতীয়রা একবার জগতটাকে বস্তুগত ভাবতে শিখে গেলেই উঠবে প্রতিবাদের ঝড়। তার থেকে ব্যালেন্টাইনের মতো জগতটাকে ‘মায়া’ বলে শেখাতে পারলে এই বিশাল উপনিবেশকে শাসন করতে কোনও অসুবিধা হবে না। তাই অচিরেই প্রশাসক বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ইংরেজদের মতবিরোধ শুরু হল। ১৮৫৯ সালে মতান্তর চরমে ওঠায় বিদ্যাসাগর সরকারের সঙ্গে সবরকম সম্পর্ক ছেদ করে দিলেন। পেনশনও নেননি। তাঁর পদত্যাগের বেশ কিছুদিন পরে সরকার জুবিলি উপলক্ষ্যে বিদ্যাসাগরকে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু উনি তা গ্রহণ করেননি।

মাথায় রাখতে হবে, বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র আটত্রিশ। গত আট বছর তিনি অসীম উদ্যম ও উৎসাহ নিয়ে তিনি শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে সরকারি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছিলেন দেশবাসীর স্বার্থে। প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু নিমেষে সবকিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। তাঁর জীবনে নৈরাশ্যের আবির্ভাব সম্ভবত সেদিন থেকেই। এরপর বিদ্যাসাগর বেঁচে ছিলেন আরও বত্রিশ বছর। বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধে দীর্ঘ আন্দোলন করেছেন। কিন্তু সেই আন্দোলনের সফলতা দেখে যেতে পারেননি। এই আঘাতই বা কম কীসে?

***

এবার আসি সমাজ, বিশেষত কলকাতার বিশিষ্ট শিক্ষিত সমাজ বিদ্যাসাগরকে কতটা আঘাত করেছিল সেই প্রসঙ্গে। আমরা জানি সেকালে বাল্যবিধবাদের দুঃসহ কষ্ট দূর করার জন্য বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি ১৮৫৫-র জানুয়ারিতে ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একখানা বই লিখে ফেললেন। প্রতিবাদের ঝড় উঠল। বিদ্যাসাগর বুঝে গেলেন রক্ষণশীল সমাজ বিধবা বিবাহের ব্যাপারটা মোটেই সহজে মেনে নেবে না। অতএব বিধবা বিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে উনি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি নিলেন। খুঁটিয়ে পড়লেন সব হিন্দুশাস্ত্র। ১৮৫৫-র অক্টোবরেই বিধবা বিবাহের সপক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণসহ ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ বইটার দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রকাশ করেন। তাতে উদ্ধৃত করলেন পরাশর সংহিতার সেই শ্লোক, ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।/ পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।’

অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্র মতেও বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। প্রচেষ্টার ফল মিলল। ১৮৫৬ সালে জুলাইয়ে পাশ হল বিধবা বিবাহ আইন লর্ড ক্যানিং-এর সহযোগিতায়। বিধবা বিবাহ আইন প্রচলন ও প্রয়োগের সময় নিজের পরিবারের সঙ্গে প্রায় বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল বিদ্যাসাগরের। ভাই শম্ভুচন্দ্র চিঠিতে লিখলেন, ‘পিতামাতা অসন্তুষ্ট হইতেছেন।’ বিদ্যাসাগর তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ‘আমি জ্ঞানত তাঁহাদের সুখের কোনও ব্যাঘাত ঘটাই নাই। তাঁহারা কেন আমার সুখ প্রদায়ক কর্মের ব্যাঘাত হইবেন?’

আমরা জানি, পরবর্তীকালে উনি প্রবলভাবে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতাও শুরু করেছিলেন। পুস্তক রচনা, সভাসমিতির আয়োজন, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ—কোনও প্রচেষ্টাই বাদ দেননি। এই কাজে কিছু লোককে পাশে পেয়েছিলেন বটে, তবে বিরোধিতা পেয়েছেন অনেক বেশি। লোকের গালমন্দ শুনেছেন, রাধাকান্ত দেব তো লেঠেল পাঠিয়ে শারীরিক আক্রমণের চেষ্টাও করেছেন। একদল লোক তাঁকে লোভী, স্বার্থপর এমনকি ব্যাভিচারীও বলেছে।  বিদ্যাসাগর নিজেই লিখছেন, ‘আমাকে লোকেরা এতদূর নীচ কথা পর্যন্ত বলিয়া সময়ে সময়ে গালি দিয়াছে যে আমি চরিত্রহীন বলিয়া অল্পবয়স্কা বিধবাদিগকে বাড়িতে আশ্রয় দেই।’

বিদ্যাসাগর তাঁর সমাজ-সংস্কারমূলক কাজের সময় কী প্রবল সামাজিক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং সেই কারণে তাঁর হৃদয় কতটা ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল, তার কিছু নিদর্শন এবার তুলে ধরা যাক। ১৮৫৫ সালে  বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত বইটি বের হয়। তার আগে পটলডাঙার শ্যামাচরণ দাস নিজের বিধবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় বিধবা বিবাহের সপক্ষে একটি ব্যবস্থা পত্র সংগ্রহ করেন। তাতে কাশীনাথ তর্কালঙ্কার, ভবশঙ্কর বিদ্যারত্ন, রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত, ঠাকুরদাস চূড়ামণি, হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত, মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ প্রমুখ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের স্বাক্ষর ছিল। কিন্তু ওঁরাই পরে আবার বিধবা বিবাহের চরম বিরোধী হয়ে ওঠেন। এই আচরণ বিদ্যাসাগরকে খুব ব্যথা দিয়েছিল।

রামমোহনের ছেলে রমাপ্রসাদ রায় বিদ্যসাগরের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। উনি বিধবা বিবাহের প্রচেষ্টাকে সবসময় সমর্থনও করতেন। বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলনেও নিজেকে সক্রিয়ভাবেই যুক্ত করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন বহুবিবাহ নিরোধক আইনের একটা খসড়াও। এহেন রমাপ্রসাদই একটা কাণ্ড করে বসলেন। বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের পর যখন প্রথম বিধবা বিবাহটি অনুষ্ঠিত হল, তখন নানা অজুহাত দেখিয়ে সেখানে এলেনই না। বিদ্যাসাগর রামমোহন পুত্রের ঐ আচরণে প্রবল দুঃখ পেয়েছিলেন। রমাপ্রসাদের বাড়ি গিয়ে সরাসরি জানিয়েও ছিলেন সেই ক্ষোভের কথা। ওখান থেকে চলে আসার সময় দেওয়ালে টাঙানো রামমোহনের ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ওটা ফেলে দাও, ফেলে দাও।’

শুধু রামপ্রসাদ নন, ছিলেন এরকম আরও কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। তাঁর জন্য একটা বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গিয়েছিল। অথচ ঐ বিয়ের কার্ডেই তাঁর নাম ছাপা ছিল। পাত্র ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য গুরুচরণ মহলানবীশ। প্রাণ ভয়ে তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল কলকাতায় প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে।

এই পিছিয়ে আসাদের দলে সেই সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কেশবচন্দ্র সেনও বাদ ছিলেন না। বিদ্যাসাগর যখন বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করার জন্য আইন তৈরি করার জন্য আন্দোলন করছেন, তখন কেশব সেন ছিলেন তার অন্যতম সমর্থক। ১৮৭২ সালে সহবাস সম্মতি আইনও পাশ হয়ে যায়। কিন্তু ওই বছরই কেশব সেনের নাবালিকা কন্যার জন্য কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ বিবাহের প্রস্তাব পাঠালে কেশবচন্দ্র সানন্দে তাতে রাজি হয়ে যান এবং ব্রাহ্ম হয়েও রীতিমতো হিন্দু রীতি মেনে সাড়ম্বরে বালিকা কন্যার বিয়ে দিয়ে দেন।

ওদিকে মেদিনীপুরের কেদারনাথ দাস নিজেই একসময় উৎসাহী হয়ে বিধবা বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু দু’বছর বাদেই তাঁর হঠাৎ মনে হয় যে তিনি খুব গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন। তাই সেই জন্য তিনি অনুতপ্ত হয়ে প্রায়শ্চিত্তও করেন সকলকে জানিয়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিন চন্দ্র পালকে তো বিবাহ বিবাহ করা থেকে বিরত করার জন্য রীতিমতো হুমকি দেওয়া হয়েছিল। অনেককে করা হয়েছিল একঘরে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ধোপা-নাপিত।

শুধু বিধবা বিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রেই নয়, সমালোচনা হয়েছিল নারী শিক্ষা প্রচলনের ক্ষেত্রেও। বাংলার ছোটো লাট হ্যালিডের স্ত্রী শিক্ষা নিয়ে আগ্রহ ছিল বলে বিদ্যাসাগর সহজেই মেয়েদের স্কুল চালু করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আমরা জানি, ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে, এই সাত মাসে বিদ্যাসাগর মোট ৩৫টা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে সমর্থ হন। কিন্তু এই সময় কলকাতা তথা বাংলার শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ কিন্তু জোরের সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের পাশে দাঁড়াননি। বাড়ির মেয়েদের যাতে স্কুলে না পাঠানো হয়, তার জন্য অনেকক্ষেত্রে অভিভাবকদের শাসানোও হয়েছে, নির্যাতনও চলেছে। রটিয়ে দেওয়া হয়েছে যে মেয়েরা স্কুলে গেলে খুব দ্রুত বিধবা হবে। অনেক শিক্ষিত মানুষ আবার উদাসীন থেকেছেন। তাই সোমপ্রকাশ (১৮৮০) লিখেছিল, ‘যদি শিক্ষিতরা তৎকালে জড়বৎ ও উদাসীনবৎ ব্যবহার না করিয়া সজীবতা প্রদর্শন-পূর্ব্বক তাঁহার সহায়তা করিতেন, এতদিন বিধবাবিবাহ প্রচলিত হইয়া উঠিত।’

বিদ্যাসাগর একটার পর একটা সংস্কার কাজে জড়িয়ে পড়েছেন, আর হারিয়েছেন একের পর এক বন্ধুকেও। ১৮৬৬ সালে তিনি আরম্ভ করেছিলেন বহুবিবাহ বিরোধী আন্দোলন। যদিও তার আগেই শুরু হয়েছিল কুলীন প্রথা নিয়ে সামাজিক সমালোচনা। ‘সনাতন ধর্ম-রক্ষিণী সভা’ও এই কুপ্রথা নিবারণের জন্য আলোচনার ডাক দিয়েছিল, উদ্যোগী হয়েছিল এব্যাপারে পণ্ডিতদের মত নিতে। এতে বিদ্যাসাগর আশান্বিত হয়ে ওঠেন এবং আন্দোলনটিকে শাস্ত্রীয় সমর্থন দিতে প্রচুর পরিশ্রম করে রচনা করেন ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি বই। গ্রন্থটিতে ‘সনাতন ধর্ম-রক্ষিণী সভা’-র উদ্যোগকে সাধুবাদও জানান।

ওই ‘সনাতন ধর্ম-রক্ষিণী সভা’রই অন্যতম দুই সদস্য তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারানাথ তাঁর মেয়েকে বেথুন স্কুলে পড়তেও পাঠিয়েছিলেন। ওঁরা দু’জনে একটা সময়ে বহুবিবাহ বিরোধী আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানোর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর যখন ১৮৮৬ সালে ওই আইন চালু করার উদ্যোগ নিলেন তখন তারানাথ আর বিদ্যাভূষণ একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলেন। দু’জনেই প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে বহুবিবাহ মোটেই শাস্ত্রবিরোধী নয়। পাশাপাশি একথাও বললেন, ‘যে প্রণালীতে উহা সম্পন্ন হইয়া থাকে তাহা অত্যন্ত ঘৃণাকর, লজ্জাকর ও নৃশংস।’ তবে তা আটকানোর জন্য আইন তৈরি যে খুব জরুরি সেকথা কিন্তু ওঁরা মোটেই স্বীকার করলেন না। তাঁদের বক্তব্য ছিল শিক্ষার প্রসার ঘটলেই এই কুপ্রথা আস্তে আস্তে ঠিক উঠে যাবে। অতএব ‘তজ্জন্য আর আইনের আবশ্যকতা নাই।’

১২৭৮ বঙ্গাব্দ। সোমপ্রকাশে তারানাথ লিখছেন, ‘বিদ্যাসাগর বহুবিবাহের অশাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদনার্থে যেরূপে শাস্ত্রের অভিনব অর্থ ও যুক্তির উদ্ভাবন করিয়াছেন, অবশ্য বুদ্ধির প্রশংসা করিতে হয়; কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখিলে এই অর্থ ও যুক্তি শাস্ত্রানুমোদিত বা সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না।’

এমন অপবাদ অবশ্য বিদ্যাসাগরকে আগেও শুনতে হয়েছে। শ্যামাপদ ন্যায়ভূষণ তাঁর ‘বিধবা ধর্মরক্ষা’ নামের গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘উনি ঋষিবচনের প্রকৃতার্থ গোপন করিয়া অযথা অর্থ প্রকাশে হিন্দুসমাজকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন…।’

সনাতন শিক্ষায় শিক্ষিত রক্ষণশীল পণ্ডিত সমাজ তাঁকে আক্রমণ করবেন, তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করবেন, একথা বিদ্যাসাগরের জানাই ছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রমানাথ ঠাকুর, সত্যশরণ ঘোষাল, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিংবা নবগোপাল মিত্রের মতো মানুষেরাও যে ওঁকে লাগামছাড়া আক্রমণ করতে পারেন কিংবা বহুবিবাহ রোধের বিরোধিতা করতে পারেন, সেটা বোধহয় বিদ্যাসাগর স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।

বিদ্যাসাগরের আরও দুই বন্ধু কৃষ্ণদাস পাল ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র ১৮৬৬ সালে বহুবিবাহ রোধের জন্য আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু ১৮৭৫-এ সরকার যখন তাঁদের মতামত জানতে চাইল, তাঁরা দু’জনেই আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে বসলেন। এই সময়ে বিদ্যাসাগর খুব বিভ্রান্ত আর হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সমাজ সংস্কারের বিষয়ে কার ওপর ভরসা করবেন, কাকে বিশ্বাস করবেন না, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও ঈশ্বরকে আঘাত করতে ভোলেননি। ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে উনি সূর্যমুখীর মুখ দিয়ে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলিয়ে দিলেন, ‘যে বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত তবে মূর্খ কে?’ এই সময়েই নবগোপাল মিত্র তাঁর ‘ন্যাশনাল’ পত্রিকায় বিদ্যাসাগরকে সমাজ সংস্কারে আর মাথা না ঘামিয়ে সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করতে পরামর্শ দিলেন।

বিদ্যাসাগর নিজে উদ্যোগ নিয়ে প্রায় ষাটটা বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন, খরচ হয়েছিল ৮৭০০০ টাকা। অনেকেই একাজে অর্থ সাহায্য করবেন বলা কথা দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তা রাখেননি। রাজা প্রতাপচন্দ্র কথামতো ৪২০০০ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাকিরা চাঁদা পুস্তকে সই করেও পরে পিছিয়ে গেছেন। মানে ৩৫০০০ টাকা ঋণশোধ বিদ্যাসাগরকেই করতে হয়েছিল। সেজন্য প্রতিবছর পাঁচ হাজার করে সুদ গুনেছেন। যা রোজগার করেছেন তার অনেকটাই চলে গেছে সুদ দিতে। সোমপ্রকাশে কেউ একজন চিঠি লিখে একথা জানিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর এই সময়ে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন। দুর্গামোহন দাসকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সদাভিপ্রায়সঙ্কল্প  সকল সময়ে সম্পন্ন হইয়া উঠে না। শ্রেয়াংসি বহু বিঘ্নানি—শুভকার্যে নানা বিঘ্ন। …কত বিষয়ে কত চেষ্টা কত উদ্যোগ করা যায়, কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই যে সকল সফল হইয়া উঠিবে না তাহার প্রধান কারন এই যে, যাহাদের অভিপ্রায় সৎ ও প্রশংসনীয় এরূপ লোক অতি বিরল। এবং শুভ ও শ্রেয়কর বিষয়ে বাধা ও ব্যাঘাত জন্মাইবার লোক সহস্র সহস্র। এমন অবস্থায় চেষ্টা করিয়া যতদূর কৃতকার্য হইতে পারা যায় তাহাতেই সৌভাগ্য জ্ঞান করিতে হয়।’

বন্ধু ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতেও বেদনা ও হতাশা স্পষ্ট। ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্ব্বে জানিলে আমি কখনোই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। তৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতেই আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, নতুবা বিবাহ আইন প্রচার প্ররযন্ত করিয়া ক্ষান্ত থাকিতাম। দেশহিতৈষী সৎকর্ম্মোৎসাহী মহাশয়দিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া ধনেপ্রাণে মারা পড়িলাম।’

প্রথম বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠান হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর, ১৮৫৬। পাত্র শ্রীশচন্দ্রকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর রীতিমতো প্রায়শ্চিত্ত করে জাতে উঠতে হয়েছিল। মেদিনীপুরের কেদারনাথ দাসের উৎসাহে তাঁর ছোটোভাই হৃদয়নাথ দাসের সঙ্গে যে বিধবা বিবাহ হয়েছিল, তা পরে সোমপ্রকাশের (১৪ মার্চ, ১৮৬৪) ভাষায় একেবারে ‘নির্ব্বাণপ্রাপ্ত’ হয়েছিল। কেদারনাথ প্রায়শ্চিত্ত করে ক’দিন পরে ঘোষণা করেন যে তিনি আবার ভাইয়ের বিয়ে দেবেন এবং বিধবাটিকে তিনি ত্যাগ করলেন। বিধবাটির ভাইও একটা সভায় সকলের সামনে ঘোষণা করে যে সেও তার বোনকে একেবারে ত্যাগ করছে।

বাজারে বেশ ভালোরকম রটানো হয়েছিল যে সরকার বিধবা বিবাহ আইন চালু করার পরেই সিপাইরা রেগে গিয়ে বিদ্রোহ করেছে এবং সেই জন্য সরকার নাকি আইনটা তুলেও নিয়েছে। ‘বিদ্যেসাগরের কর্ম্ম গিয়েচে, প্রথম বিধবা বিবাহের বর শিরীষের (শ্রীশচন্দ্র) ফাঁসি হবে।’

বিধবা বিবাহকে ব্যঙ্গ করে নানা প্রহসন লেখা হল। বিধবাবিরহ (১৮৬০) বলা হল ‘সেই সাগরের ঐ রূপ তেজ ও কল্লোল কিছুই নাই, এখন কেউ তার রবও শুনতে পায় না…।’

ভাবতে অবাক লাগে, এত নিন্দা, এত ব্যঙ্গ, এত অপবাদ সহ্য করেও কিন্তু বিদ্যাসাগর নিজের কাজে অবিচলই ছিলেন!

বিদ্যাসাগরের নিজস্ব কিছু মূল্যবোধ ছিল। কোনও পরিস্থিতিতেই সে নীতি থেকে তিনি সরে আসতেন না। এই কারণেও তাঁকে বিদ্রূপের স্বীকার হতে হয়েছে। একবার বর্ধমানের রানি কলকাতার নামীদামী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সম্মানিত করতে বিপুল দানের আয়োজন করেছিলেন। একে সেকালে ‘পণ্ডিত বিদায়’ বলা হত। বিদ্যাসাগর কখনও সেরকম দান গ্রহণ করতেন না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ বংশে জন্মেছেন বলে অমন পরিশ্রমহীন অর্থ নিতে তাঁর আত্মসম্মানে লাগত। বর্ধমানের রানির দেওয়া টাকাও সেই কারণেই নেননি।

এই ঘটনার পর ১৮৫৪ সালের ২২ জুলাই ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এ জনৈক এক ব্রাহ্মণের চিঠি ছাপা হয়েছিল। তাতে উনি লিখলেন, ‘বর্দ্ধমানেশ্বরী শ্রীল শ্রীমতী মহারাজ্ঞী তুলাদান করিয়া কলিকাতাস্থ প্রধান পণ্ডিতগণের নিকট বিদায় প্রেরণ করিয়াছিলেন তাহা আদরে সকল মহাশয়েরা গ্রহণ করিয়াছেন, তন্মধ্যে কেবল শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভট্টাচার্য্য মহাশয় উক্ত বিদায় গ্রহণ করেন নাই। কহিয়াছেন যে আমি গর্ভনমেন্টের স্থানে তিনশত টাকা মাসিক বেতন পাইতেছি, তাহাই আমার যথেষ্ট হইয়াছে আর অন্য প্রকারে উপার্জ্জন করিতে বাসনা নাই… বিদ্যাসাগর গর্ভনমেন্টের অধিক প্রিয় পাত্র হইলেও বর্দ্ধমানেশ্বরীর দান অবজ্ঞা করিয়া ফিরিয়া দেওয়া অতি অসঙ্গত কার্য্য হইয়াছে আমি বোধ করি… হায়, আমাদের বাঙ্গালী লোকের কুস্বভাব বিদ্যা প্রভাবেও দূর হইতেছে না, অন্যদেশীয় লোকেরা বিদ্যায় বিদ্বান হইলেও বহু সংখ্যক ধনোপার্জ্জন করিতে পারিলেও আপনারদিগের সভ্যতা পরিত্যাগ করিতে পারেন না কিন্তু বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগরের বিন্দুমাত্র স্পর্শ করিয়াই ও তিনশত টাকা মাসিক বেতনপ্রাপ্ত হওয়াতেই অহঙ্কারে একেবারে চক্ষু কর্ণ উভয়েন্দ্রিয় হারাইয়াছেন…।’ এরপরে আমার আর মন্তব্যের কিছু নেই। পাঠক যা বোঝার বুঝে নেবেন।

***

এবার নিজের পরিবারের কাছ থেকে বিদ্যাসাগর কেমন আঘাত পেয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। ১৮৬৯ সালের (১২৭৬ বঙ্গাব্দ) আষাঢ়ে বীরসিংহ গ্রামে মুচিরাম শর্মার সঙ্গে মনোমোহিনী নামের এক বিধবা মহিলার বিয়েকে কেন্দ্র করে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মতবিরোধ হয়। শোনা যায়, মুচিরাম-মনোমোহিনী তাঁদের অঞ্চলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও বিধবাবিবাহবিরোধী জমিদার পরিবার হালদারদের হাত থেকে বাঁচতে প্রাণভয়ে বিদ্যাসাগরের ভাইদের কাছে আশ্রয় ও বিয়েতে সাহায্য প্রার্থনা করেন। এর আগেই ওই জমিদার অন্য একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগদানের অপরাধে বিদ্যাসাগরের শ্বশুরমশাইকে শুধু অপমান করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করতেও বাধ্য করেছিলেন।

বিদ্যাসাগরের ভাইয়েরা ওই মুচিরামকেই আশ্রয় দেন এবং বিয়েতে সাহায্য করবেন বলেন। অন্যদিকে হালদার জমিদারের পক্ষ থেকে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেওয়া হয় যে তিনি ওই বিয়ের ব্যাপারে কোনোরকম উদ্যোগ নেবেন না, একেবারে নিরপেক্ষ থাকবেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও ওঁকে কিচ্ছুটি না জানিয়েই ওঁর দুইভাই এক প্রতিবেশীর বাড়িতে গোপনে মুচিরাম-মনোমোহিনীর বিয়ে দিয়ে দেন। এতে জননী  ভগবতী দেবী ও স্ত্রী দীনময়ীরও সমর্থন ছিল পুরোমাত্রায়। ফলে বিদ্যাসাগর যারপরনাই রুষ্ট হন, আহতও। তিনি ভাইদের ভর্ৎসনা করে বলেন (শম্ভুচন্দ্রের ভাষায়), ‘তোমরা তাহাদের (হালদারদের) নিকট আমাকে মিথ্যাবাদী করিয়া দিবার জন্য এই গ্রামে এবং আমাদের সম্মুখস্থ ভবনে বিবাহ দিলে। ইহাতে আমার যতদূর মনঃকষ্ট দিতে হয়, তাহা তোমরা দিয়াছ। যদি তোমাদের একান্ত বিবাহ দিবার অভিপ্রায় ছিল, তাহা হইলে ভিন্নগ্রামে গিয়া বিবাহ দিলে এরূপ মনঃকষ্ট হইত না… আমি তাহাদের নিকট মিথ্যাবাদী হইলাম। …অদ্য হইতে আমি দেশত্যাগ করিলাম।’

বলাই বাহুল্য, বিদ্যাসাগর সেদিন কারুর কথাই শোনেননি। নিজের জন্মভিটে, মা-স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-পরিজন, নিজের হাতে গড়া স্কুল—সবকিছু ছেড়ে চলে এলেন চিরদিনের জন্য। ওই বছরই গোড়ার দিকে আগুন লেগে ওঁদের বসতবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগর পরিবারের সব ভাইদের জন্য আলাদা ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, ইতিমধ্যেই ওঁদের একান্নবর্তী সংসার ভেঙে গিয়েছিল। সেদিনের পর আরও বাইশ বছর বেঁচে ছিলেন বিদ্যাসাগর, কিন্তু কোনোদিন আর বীরসিংহের মাটিতে পা রাখেননি। রাগের চেয়ে অভিমানই বোধহয় বেশি ছিল।

১৮৬৯ (১২৭৬ সালের ২৫ অগ্রহায়ণ) বিদ্যাসাগর তাঁর পরিবারের সদস্য এবং গ্রামের কয়েকজনকে একগুচ্ছ চিঠি লিখলেন। চিঠিগুলো আসলে পরিবার ও গ্রামের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা। কতটা আঘাত পেয়ে যে উনি চিঠিগুলো লিখেছিলেন, সেটা ওই চিঠিগুলোর ভাষা ও বিষয়বস্তু দেখে সহজেই বোঝা যায়। এ যেন সংসার-প্রতিবেশী ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার সংকল্প। মাকে চিঠিতে বিদ্যাসাগর লিখছেন, ‘নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোনও বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোনও সংস্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই। বিশেষত ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে তাহাতে পূর্বের মতো নানা বিষয়ে সংসৃষ্ট থাকিলে অধিক দিন বাঁচিব এরূপ বোধ হয় না। এখন স্থির করিয়াছি যতদূর পারি নিশ্চিন্ত হইয়া জীবনের অবশিষ্টভাগ নিভৃতভাবে অতিবাহিত করিব। এক্ষণে আপনার শ্রীচরণে এজন্মের মতো বিদায় লইতেছি।’

ওই চিঠির একেবারে শেষে বিদ্যাসাগরই আবার মাকে নিজের কাছে মানে কলকাতায় এনে রাখার আকুতি জানাচ্ছেন। লিখছেন, ‘আপনার চরণসেবা করিয়া চরিতার্থ হইব।’ ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৬৫-তেই কাশীবাসী হয়েছিলেন। ওইদিন ঈশ্বর কাশীতে বাবাকেও চিঠি পাঠান। তার শুরুটাও ঐ আগের চিঠির মতোই। পরের অংশে চরম আক্ষেপের সুর। বিদ্যাসাগর ঠাকুরদাসকে লিখলেন, ‘সংসার বিষয়ে আমার মতো হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি। কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে বিষয়ে কোনও অংশে কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই। যে সকলকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা পায় সে কাহাকেও সন্তুষ্ট করিতে পারে না।’

চিঠিতে ওই ‘সকলকে’ বোঝাতে যে বিদ্যাসাগর নিজের পরিবারের লোকজনের কথাই বলেছেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। আগেই বলেছি, ওই চিঠিগুলোর বছর দুই আগেই বীরসিংহ গ্রামের বিদ্যাসাগরের দীর্ঘদিনের একান্নবর্তী পরিবারখানা ভেঙে গিয়েছিল। সব ভাইয়েরাই আলাদা হয়ে গেছে এবং তারা নিজেদের ভাগের সম্পত্তির অংশও দাবি করেছে। এখানে মজার ব্যাপার হল, যে সম্পত্তির অংশ তারা দাবি করেছে তার প্রায় পুরোটাই বিদ্যাসাগরের একার উপার্জনে নির্মিত। শম্ভুচন্দ্র বা দীনবন্ধুকে নিয়ে বিদ্যাসাগরের খুব একটা সমস্যা ছিল না, মূল বিরক্তিটা ছিল ছোটো ভাই ঈশানচন্দ্রকে নিয়ে।

আসলে ঈশানচন্দ্রের আগের দুই ভাই হরচন্দ্র ও হরিশ্চন্দ্র পরপর কলেরায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় মারা গিয়েছিলেন। হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পরেই পুত্রশোকে কাতর ঠাকুরদাস ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, ছোটো ছেলে ঈশান আর নাতি নারায়ণকে তিনি আর কলকাতায় পাঠাবেন না। অনেক বুঝিয়েও বাবার এই গোঁ ভাঙতে পারেননি ঈশ্বরচন্দ্র। ষোলো বছর বয়সেও ছেলে নারায়ণ পড়ে রইল গ্রামের পাঠশালাতেই। একেই বলে বোধহয় প্রদীপের তলায় অন্ধকার। ঠাকুরদার অতিরিক্ত আদরেই যে ছেলে মানুষ হচ্ছে না, সেটা বুঝতে ওঁর বিশেষ অসুবিধা হয়নি। প্রচণ্ড ক্ষোভে তাই বিদ্যাসাগর ঠাকুরদাসকে একদিন বলে ফেললেন, ‘আপনি ঈশান ও নারায়ণের মাথা খাইতেছেন, তথাপি আপনি লোকের নিকট কীরূপে আপনাকে নিরামিষাশী বলিয়া পরিচয় দেন?’

এরপর কোনও এক সময়ে নারায়ণকে তিনি একরকম জোর করেই কলকাতায় নিয়ে এসে সংস্কৃত কলেজের বিদ্যালয় বিভাগে ভর্তি করে দেন। কিন্তু নারায়ণ সেখানে পড়েছিলেন মাত্র কয়েক মাস। কিছুদিন পরেই পালিয়ে গ্রামে ফিরে যান। তাও ঠাকুরদাস ছোটো ছেলে ও নাতিকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। তাতে ফল হয়েছে মারাত্মক। ওঁরা দু’জনেই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। ঈশানচন্দ্র তো বিভিন্ন লোকের কাছে বারেবারে টাকা ধার করেছেন, আর সেই ঋণ শোধের দায়িত্ব বর্তেছে বিদ্যাসাগরের ওপর। ঠাকুরদাস চিঠি লিখে সেই আদেশ দিয়েছেন ঈশ্বরকে, ‘তাহার (ঈশানচন্দ্রের) অনেক ঋণ আছে, তাহা পরিশোধ করিয়া পাঠাইবে।’

তাতে বিদ্যাসাগরের বিরক্তি চরমে পৌঁছেছিল। অন্য ভাই শম্ভুচন্দ্রের কাছে সেই বিরক্তি গোপনও করেননি। চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, ‘ইতিপূর্ব্বে একবার তাহার যথেষ্ট ঋণ পরিশোধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তৎকালে কোনও কর্মের ভার দিব বলিয়াছিলাম। সে কোনও কর্মে লিপ্ত থাকিতে ইচ্ছা করে নাই।’ চিঠির এই বয়ানই বলে দিচ্ছে কনিষ্ঠ ভাইটিকে নিয়ে তখন কী পরিমাণ হতাশ এবং বিব্রত ছিলেন বিদ্যাসাগর। মাথায় রাখতে হবে, বিদ্যাসাগর ওই সময়ে বিপুল ঋণে জর্জরিত, ষাটটি বিধবা বিবাহ দিতে কী পরিমাণ ঋণ করেছিলেন সেকথা আগেই বলেছি। এর সঙ্গে ছিল ১৮৬৬ – ৬৭ সালের দুর্ভিক্ষে বীরসিংহ ও বর্ধমানে নিজের খরচে অন্নসত্র খোলার জন্য ঋণ।

একটি প্রেস ও বুক ডিপোজিটরি করেছিলেন, যার নাম সংস্কৃত মুদ্রণযন্ত্র। উনি নিজে তখন প্রবল ব্যস্ত—বিধবা বিবাহ ও নানারকম সমাজ সংস্কারের কাজ করছে, বই লিখছেন, মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন ও অন্যান্য বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। তাই প্রেস ও ডিপোজিটরির কাজ নিজে দেখার সুযোগ তেমন পেতেন না। বেতনভোগী কর্মচারীরা সে সুযোগ পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাল; চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করল। বিদ্যাসাগর কষ্ট পেলেন। তাই ১৮৬৯ সালে তাই মাত্র আট হাজার টাকায় সাধের প্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিলেন দু’জনকে। বুক ডিপোজিটরি বেচে দিলেন কৃষ্ণনগরের ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়কে। তখন তাঁর মন যে অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত, তা বোঝাই যায়। যা তিনি ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়কে দিলেন দশ হাজার টাকায়, সেই ডিপোজিটরি কিনে নেওয়ার লোক কিন্তু আরও ছিল। তাঁর বিপুল ঋণের বোঝা এতে আরও খানিকটা লাঘব হতে পারত

বিদ্যাসাগর সেই সময়ে যা রোজগার করেছেন, তার অনেকটাই চলে গেছে ধার শোধ করতে। ঠাকুরদাসকে চিঠিতে জানিয়েও ছিলেন সেই কথা, ‘কার্যগতিকে ঋণে বিলক্ষণ আবদ্ধ হইয়াছি। ঋণ পরিশোধ না হইলে লোকালয় পরিত্যাগ করিতে পারিতেছি না। ঋণে নিষ্কৃতি পাইলে কোনও নির্জ্জন স্থানে গিয়া অবস্থিতি করিব। আপনার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহার্থে যাহা প্রেরিত হইয়া থাকে, যতদিন আপনি শরীর ধারণ করিবেন কোনও কারণে ব্যতিক্রম ঘটিবেক না।’

শুধু ঈশানচন্দ্রকে নিয়ে নয়, নিজের একমাত্র ছেলে নারায়ণচন্দ্রকে নিয়েও বিদ্যাসাগরের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। স্ত্রী দিনময়ীকে চিঠিতে লিখছেন, ‘আমার সাংসারিক সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে, আর আমার সে বিষয়ে অণুমাত্র স্পৃহা নাই। বিশেষত ইদানীং আমার মনের ও শরীরের যেরূপ ঘটিয়াছে… এক্ষণে তোমার নিকটে এ জন্মের মতো বিদায় লইতেছি… তোমার পুত্র উপযুক্ত হইয়াছেন, অতঃপর তিনি তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। তোমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহের যে ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছি বিবেচনাপূর্ব্বক চলিলে তদ্বারা স্বচ্ছন্দরূপে যাবতীয় আবশ্যক বিষয় সম্পন্ন হইতে পারিবেক।’

নারায়ণচন্দ্র যে একজন বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন, সেটা কিন্তু নিজের ইচ্ছাতেই। সেখানে বিদ্যাসাগরের কোনও জোরাজুরি ছিল না। তবে হ্যাঁ, ওই সিদ্ধান্তকে বিদ্যাসাগর অবশ্যই মনেপ্রাণে সমর্থন করেছিলেন। ভাই শম্ভুচন্দ্রকে চিঠি লিখে জানিয়েও ছিলেন সেকথা, ‘আমি বিধবা বিবাহের প্রবর্তক। আমরা উদ্যোগ করিয়া অনেক বিধবা বিবাহ দিয়াছি। এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবা বিবাহ না করিয়া কুমারী বিবাহ করিলে আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না। নারায়ণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া এই বিবাহ করিয়া আমার মুখ উজ্জ্বল করিয়াছে।’

কিন্তু দিনময়ী ছেলের এই বিধবা বিবাহের সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে পারেননি। মনে খুবই আঘাত পেয়েছিলেন এবং তার জন্য দায়ী করেছিলেন স্বামীকেই। ১৮৭০ সালের ১১ আগস্ট নারায়ণচন্দ্রের বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছরের বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর সঙ্গে, মির্জাপুর স্ট্রিটে কালীচরণ ঘোষের বাড়িতে। সেই বিয়েতে ভগবতী বা দিনময়ী কেউই হাজির ছিলেন না। নববধূকে বরণ করেছিলেন তারানাথ তর্কবাচষ্পতির স্ত্রী। ১৮৬৫-তেই ঠাকুরদাস কাশীযাত্রা করেছিলেন। আর নারায়ণচন্দ্রের বিয়ের পরের মাসেই ভগবতীও অভিমানে কাশিবাসী হলেন। বিদ্যাসাগর তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে অবশ্য কাশী গিয়েছিলেন। ১৮৭১-এ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ভগবতীর মৃত্যু হয়। কলকাতায় সেই খবর যখন বিদ্যাসাগরের কাছে পৌঁছেছিল, তিনি শোকে একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। কেঁদেছিলেন শিশুর মতো।

আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ছেলের বিয়ের পর বিদ্যাসাগর দারুণ আনন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরের বছরই নারায়ণচন্দ্র হাঁড়ি আলাদা করে ফেলেছিলেন। আসলে নারায়ণচন্দ্রের নানা কাজ বিদ্যাসাগর একেবারেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কারণ, ছেলের জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলার বড়ো অভাব ছিল। শৈশব ও কৈশোরে ঠাকুরদার অন্ধ স্নেহ তাঁকে বেপরোয়া করে তুলেছিল। বিদ্যাসাগর এসব মেনে নিতে পারেননি।

আরও নানাভাবে তিনি নিশ্চয়ই ছেলের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই জন্যই বোধহয় কৃষ্ণনগরের উকিল যদুনাথ রায়ের যখন পুত্রবিয়োগ হল, তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে গিয়ে বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘পিতা ও মাতা হওয়া অপেক্ষা অধিকতর মহাপাতকের ভোগ আর নাই। পিতামাতাকে প্রকৃত প্রস্তাবে সুখী করেন, এরূপ পুত্র অতি বিরল কিন্তু অসদাচরণ… প্রভৃতি দ্বারা পিতামাতাকে যাবজ্জীবন দগ্ধ করেন এরূপ পুত্রের সংখ্যাই অধিক।’

অনুমান করাই যায়, চিঠির এই বাক্যগুলো নিজের পুত্রের আচরণপ্রসূত। তাই ১৮৭২ সালে মানে নারায়ণচন্দ্রের বিয়ের দু’বছরের মধ্যেই প্রবল বিরক্ত হয়ে পুত্রকে ত্যাজ্য করেছিলেন। দু’বছর বাদেই কড়া নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, নারায়ণ যেন তাঁর বাড়িতে প্রবেশ না করেন। দিনময়ী আবার এটাও মেনে নিতে পারেননি। তাই তখন থেকেই স্ত্রীর সঙ্গেও কার্যত বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দিনময়ী থাকতেন বীরসিংহের গ্রামের বাড়িতে, কখনও কলকাতায় আসতেন না। বিদ্যাসাগর আবার নিজের সংকল্প অনুসারে যেতেন না নিজের গ্রামে। বিদ্যাসাগরের আগেই দীনময়ী মারা গিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর সব শুনেও আর গ্রামের বাড়িতে যাননি, উপস্থিত থাকেননি স্ত্রীর শ্রাদ্ধবাসরেও। তবে পারলৌকিক কাজের সব ব্যবস্থা তিনিই কলকাতা থেকে করে দিয়েছিলেন।

১৮৭৫ সালের ৩১ মে। গভীর রাতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের ৬৩ নম্বর বাড়িতে নিজের হাতে বিদ্যাসাগর লিখলেন তাঁর ইচ্ছাপত্র বা উইল। তখন ওঁর বয়স মাত্র পঞ্চান্ন। উইলটিতে ছিল পঁচিশটি অনুচ্ছেদে। ছিল তাঁর নিজের সম্পত্তির তালিকা, পঁয়তাল্লিশ জন নরনারীকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক বৃত্তি দেবার নির্দেশ। এক্ষেত্রে একটা কথা অবশ্যই বলা জরুরি যে ঐ ৪৫ জনের মধ্যে ২৬ জনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কিন্তু কোনও রক্তের সম্পর্ক ছিল না। এছাড়াও ইচ্ছাপত্রে দাতব্য চিকিৎসালয় ও মায়ের নামে স্থাপিত বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য অর্থের সংস্থান করে রাখা ছিল। সব থেকে নজরকাড়া জায়গা ছিল উইলের পঁচিশ নম্বর অনুচ্ছেদটি। তাতে ছিল, ‘আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী। এজন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতু বশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতুবশতঃ তিনি চতুর্বিংশধারা নির্দিষ্ট ঋণ পরিশোধকালে বিদ্যমান থাকিলেও আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা… এই বিনিয়োগ পত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না।’

বিদ্যাসাগরের ছিল পাঁচ সন্তান। তাদের মধ্যে নারায়ণচন্দ্র সবার বড়ো এবং সে-ই একমাত্র পুত্র। ঈশ্বর সেই পুত্রকে নিজের সব কিছু থেকে বঞ্চিত করছেন। কতটা আঘাত পেয়ে একজন সংবেদনশীল মানুষ এমন কাজ করতে পারেন, সেটা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে ছেলেকে সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত কিন্তু মোটেই হটকারী ছিল না। কারণ ওই উইল লেখার পর বিদ্যাসাগর আরও ষোলো বছর জীবিত ছিলেন। পরে রাগের বশে ঐ কাজ করে ফেলেছেন মনে করলে ইচ্ছাপত্রটি বদলাতেও পারতেন। কিন্তু ওই দীর্ঘ সময়ে তিনি উইলের একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি।

***

সমাজ ও শিক্ষা সংস্কার করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর শুধু মানসিক আঘাতই পাননি, শারীরিক আঘাতও পেয়েছেন। যা তাঁকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কষ্ট দিয়েছে। আসলে ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই বিদ্যাসগরের শরীর ভাঙতে শুরু করেছিল। ১৮৬৬ সালের শেষ দিকে শিক্ষাব্রতী মিস মেরি কার্পেন্টার বিলেত থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। কয়েক দশক আগে রাজা রামমোহন রায় যখন বিলেত গিয়েছিলেন, তখন লন্ডনে এই মিস কার্পেন্টারের বাবার আতিথ্যই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। মেরি এ দেশের স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ও উন্নতি নিয়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন। ওদিকে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজ থেকে ইস্তফা দিলেও নারীশিক্ষা বিস্তার বা অন্যান্য সমাজসংস্কারের কাজে ইংরেজ সরকারকে সবসময় সাহায্য করতেন। বেথুন স্কুলে মিস কার্পেন্টারের পরিচয় হল বিদ্যাসাগরের সঙ্গে। বিদ্যাসাগরকে সঙ্গে নিয়েই বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখতে লাগলেন তিনি।

১৮৬৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর উত্তরপাড়ায় মেয়েদের একটি স্কুল পরিদর্শন করে ওঁরা সকলে ফিরছিলেন। একটা গাড়িতে আছেন বিদ্যাসাগর আর অন্য গাড়িতে আছেন মেরি, ডি.পি.আই অ্যাটকিনসন এবং ইন্সপেক্টর অব স্কুলস উড্রো সাহেব। বালি স্টেশনের কাছে বিদ্যাসাগরের গাড়িটা হঠাৎ উলটে গেল। বিদ্যাসাগর ছিটকে পড়লেন গাড়ির বাইরে, প্রচণ্ড আঘাতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি। সেদিন মিস কার্পেন্টার পথের মধ্যে বসেই অচেতন বিদ্যাসাগরের মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়েছিলেন। কলকাতায় আনা হল বিদ্যাসাগরকে। ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার জানালেন, লিভারে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে ও অ্যাবসেস দেখা দিয়েছে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর ব্যথা কিছু কমলেও কোনোদিনই আর যকৃতের সমস্যা থেকে বেরতে পারেননি। সত্তরের দশকের শেষ থেকে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করল। মন তো ক্ষতবিক্ষত ছিলই। এই সময়েই মানে ১৮৭৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁর সৃষ্ট মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন বি.এ পড়ানোর অনুমতি পেয়ে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। এই দেশে সম্পূর্ণ বেসরকারি পরিচালনায় ওটাই প্রথম ডিগ্রি কলেজ। এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা তীব্র নৈরাশ্যের মধ্যে বলা যেতে পারে এটাই বিদ্যাসাগরের জীবনের শেষ বড়ো সাফল্য। বিদ্যাসাগর সেদিন দারুণ খুশি হয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে শরীর আরও ভেঙে পড়ল। তাই কলকাতার বাদুড়বাগান লেনের বাড়ি ছেড়ে বিদ্যাসাগর মাঝে মাঝে চন্দননগরে, গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেও শুরু করেন। তখন যেন আরও নিঃসঙ্গ তিনি। তাই নানা শোকস্মৃতি তাঁকে ঘিরে ধরছে। বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতনি প্রভাবতীকে খুব স্নেহ করতেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৮৬৫ সালে মাত্র তিন বছর বয়সেই সে চলে গিয়েছিল পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। সেই ফুলের মতো মেয়েটির কথা তখন মনে পড়ত বিদ্যাসাগরের। মন হয়ে যেত ভারাক্রান্ত। মেয়েটির কথা ভেবে ঈশ্বর লিখেছিলেন, ‘…বোধহয় যদি এই নৃশংস নরলোকে অধিকদিন থাক, উত্তরকালে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ অপরিহার্য, ইহা নিশ্চিত বুঝিতে পারিয়াছিলে।’ জীবিতকালে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ না করলে কারুর মধ্যে এই উপলব্ধি আসে না।

এছাড়া বিদ্যাসাগর শেষজীবনে কার্মাটাঁড়েও একটা বাড়ি কিনেছিলেন। জামতাড়া ও মধুপুরের মাঝে ছোট্ট এই স্টেশনে মূলত সাঁওতালদের বাস। একটু শান্তি পাওয়ার আশায় ছুটি পেলেই উনি ওখানে চলে যেতেন। বিদেশ থেকে হোমিওপ্যাথি বই আনিয়ে নিয়েছিলেন। সেই বই পড়ে ওদের চিকিৎসাও করতেন বিদ্যাসাগর। ওই হতদরিদ্র সরল সাধাসিধে মানুষগুলোর সাহচর্য সেই সময়ে ওঁকে নিঃসন্দেহে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল।

১৮৯১ সালের জুন মাসে বিদ্যাসাগর পাকাপাকিভাবে বাদুড়বাগান লেনের বাড়িতে চলে আসেন। আর কোথাও যাতায়াতের চেষ্টা করেননি। পেটের ব্যথায় প্রবল কাতর তিনি। কিন্তু সেটা যতটা সম্ভব গোপন করার চেষ্টা করছেন, যেমন এতদিন লুকিয়ে এসেছেন মনের যন্ত্রণা। একদিন প্রসিদ্ধ ইংরেজ ডাক্তার বার্চ ও ম্যাকনেল এলেন ওঁকে দেখতে। কিন্তু লিভার ক্যানসার সন্দেহ করে চিকিৎসা করতে রাজি হলেন না। তখন ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার নিলেন চিকিৎসার ভার। উনি নিয়মিত বিদ্যাসাগরকে দেখে যেতেন। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি। ওই জুলাই মাসের ২৯ তারিখ মধ্যরাত্রে চলে গেলেন ঈশ্বর। মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিভারে ক্যানসারই লেখা হয়েছিল।

***

কথায় বলে, মরেও শান্তি নেই। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রেও যে এমনটা ঘটেছে, সেটা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীনই ১৮৫২, ১২ এপ্রিল বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন ‘Notes on Sanskrit College’, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার এবং পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানভাণ্ডার উভয় থেকেই জ্ঞানসম্পদ আহরণ করে বাংলা ভাষা-শিক্ষা-সাহিত্যের বুনিয়াদিকে শক্ত করা। বিদ্যাসাগর গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, ‘সংস্কৃত কলেজটিকে তাই বিদ্যাসাগর সেকালের টোল-চতুষ্পাঠী করতে চাননি। আবার তার সংলগ্ন হিন্দু কলেজের মতো ‘দেশী সাহেব’ তৈরির কারখানাও করতে চাননি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানবিদ্যার সত্যকারের মিলনতীর্থ করতে চেয়েছিলেন তিনি সংস্কৃত কলেজকে। কেবল সংস্কৃত কলেজ নয়, সারা বাংলাদেশ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনতীর্থ হোক, এই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো কামনা এবং সবচেয়ে রঙিন স্বপ্ন ছিল।’

কিন্তু একথা একদল শিক্ষিত বাঙালি বুঝতে চাইলেন না। তাঁরা বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে বিদ্যাসাগরের শিক্ষাভাবনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে অভিযোগ করলেন যে মেকলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে যা কিছু শিক্ষা পরিকল্পনা করেছিলেন, বিদ্যাসাগর সেটাই নাকি বাস্তবায়িত করেছিলেন। তাঁরা এটা বিচার করলেন না যে মেকলে  কোম্পানির স্বার্থে কেবল প্রচুর শিক্ষিত কেরানি আর বেশ কিছু জজ, উকিল, দারোগা বানাতে চেয়েছিলেন। আর তাদের প্রশিক্ষিত করার জন্য কিছু শিক্ষক। উদ্দেশ্য, তারা ইংরেজ বণিকদের কাজের সুবিধা করে দেবে। তারা দেহে ভারতীয় হলেও মনে হবে ইংরেজ। অর্থাৎ মেকলে কোনও অবস্থাতেই বাঙালি মননের উন্নতি ঘটাতে চাননি। চাননি বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যের বিকাশও।

অন্যদিকে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন ধর্মীয় শিক্ষার খোলস থেকে এদেশের শিক্ষাকে টেনে বের করে ছাত্রদের বিজ্ঞানসম্মত এবং উদার-ধর্মনিরেপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। চেয়েছিলেন জাত-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে শিক্ষার অধিকার পাইয়ে দিতে। সেই শিক্ষা অবশ্যই যুক্তিবাদী আধুনিক শিক্ষা, প্রাচীন ভাববাদী আধ্যাত্মিক শিক্ষা নয়, যাতে সমাজে সমস্ত স্তরের মানুষের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছতে পারে। সমাজের সবরকমের বৈষম্য দূর হয়। এমন ভাবনা আজকের ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। না হলে আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও করোনার সংক্রমণ রুখতে গোমূত্র খাওয়া বা রোদে দাঁড়ানোর নিদান দেওয়া হত না। দেশ জুড়ে হাজার হাজার নির্ভয়া বা দলিতদের চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হত না।

বিদ্যাসাগর শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারকে নৈতিক দায়িত্ব বলে মেনে নিয়েছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন, কিন্তু সে যুগের গোঁড়া ব্রাহ্মণদের দলে ছিলেন না। ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী একজন সংস্কারহীন মানুষ। পুজো-আচ্চা বা ধর্মীয় আচারে স্বভাবতই ওঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। সেই জন্যই গুরুবাদ থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে রেখেছিলেন। আর সেই জন্যও ঈশ্বরকে পড়তে হয়েছিল কদর্য আক্রমণের মুখে। তবে জীবদ্দশায় সেসব শুনে যেতে হয়নি এটুকুই যা সান্ত্বনা।

এই প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের বিবরণ দেওয়া যেতেই পারে। আমরা জানি, রানি রাসমণি স্থাপিত দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন গদাধর চট্টোপাধ্যায় যিনি পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ পরমহংস নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশনের শ্যামবাজার শাখার প্রধান মহেন্দ্র গুপ্ত (শ্রীম) ছিলেন রামকৃষ্ণদেবের পরম ভক্ত। রামকৃষ্ণ চাইছিলেন কলকাতায় অভিজাত মহলে প্রতিষ্ঠা পেতে। বিদ্যাসাগর সেই সময়ের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাই রামকৃষ্ণ শ্রীম-র মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়ে দেখা করার একটা দিন স্থির করে ফেলেন। ১৮৮২ সালে ৫ আগস্ট বিকাল পাঁচটা নাগাদ রামকৃষ্ণ শিষ্য ভবনাথ হাজরা ও শ্রীমকে নিয়ে বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগান লেনের বাড়িতে হাজির হন। বিদ্যাসাগর ওঁকে স্বাগত জানিয়ে বর্ধমান থেকে আনা মিষ্টি পরিবেশন করেন, মানে আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি করেননি। এরপর দু’জনের মধ্যে যে প্রারম্ভিক বাক্যালাপ হয়েছিল তা বহুল প্রচারিত।

রামকৃষ্ণ: আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল, বিল, হ্রদ, নদী দেখেছি, এইবার সাগর দেখছি।

বিদ্যাসাগর: তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান।

রামকৃষ্ণ: না গো। নোনা জল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যাসাগর সাগর। তুমি ক্ষীর সমুদ্র।

কিন্তু এর পরের ঘটনাগুলো অনেকেই জানেন না। সেগুলোই এবার একে একে বলে ফেলা যাক। বিদ্যাসাগরের ঘরে রামকৃষ্ণ সেদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ছিলেন। প্রায় পুরো সময়টা তিনি একাই কথা বলেছেন। ধর্ম-দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অদ্বৈতবাদ-দ্বৈতবাদ—আরও কত কী! গান করেছেন, সমাধিস্থ হয়েছেন। কথায় কথায় এও জানিয়েছেন যে পণ্ডিতের চেয়ে সাধু শ্রেষ্ঠ। কারণ পুথিগতবিদ্যা অসার। বিদ্যাসাগর শুধু শুনে গেছেন, মন্তব্য করেননি কিছুই। শেষে রামকৃষ্ণ ওঁকে রাসমণির বাগানে আসার জানিয়ে চলে আসেন। সৌজন্য রক্ষার্থে বিদ্যাসাগর সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেন।

এরপর দীর্ঘদিন কেটে গেল। রামকৃষ্ণ প্রিয় শিষ্য শ্রীম’-র কাছে খোঁজখবর নিতেন, বিদ্যাসাগর তাঁর সম্পর্কে কিছু বলেন কি না বা কবে আসবেন রাসমণির বাগানে। কিন্তু ঐ সাক্ষাতের পর ঈশ্বর রামকৃষ্ণ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহও আর দেখাননি। রামকৃষ্ণ বুঝে যান, বিদ্যাসাগরকে তিনি আদৌ প্রভাবিত করতে পারেননি। তখনই শুরু করেন অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করতে। কখনও বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর সত্য কথা কয় না কেন?’ আবার কখনও মন্তব্য করেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের এক কথায় তাঁকে চিনেছি, কতদূর বুদ্ধির দৌড়। …ঈশ্বরকে না জানলে ক্রমশ ভিতরের চুনোপুঁটি বেরিয়ে পড়ে। শুধু পণ্ডিত হলে কী হবে?’

এছাড়া নাম না করে উনি বিদ্যাসাগরকে পরোক্ষে ‘শকুনি’, ‘কামিনী-কাঞ্চনলোভী’ বলতেও দ্বিধা করেননি। এতক্ষণ যা যা বললাম, তার সমস্তটাই শ্রীম’-র লেখা ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’ থেকে নেওয়া। পাঠক মিলিয়ে নিতে পারেন। সুখের কথা, এসব বিদ্যাসাগরের কানে যায়নি। তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে শ্রীম এই তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষীকে এইভাবে অযথা আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল জেনে আমাদের মতো আমজনতার হৃদয়ও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।

আরেকটা ঘটনা বলে এই নিবন্ধের ইতি টানব। এই কয়েক দশক আগে পর্যন্তও বিদ্যাসাগরের নামে কিছু মানুষ অপবাদ রটিয়েছেন যে ছেলেবেলার বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের লেখা ‘শিশুশিক্ষা’ বইটির কপিরাইট উনি নাকি বেমালুম গায়েব করে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি তা ধোপে টেকেনি, মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। যে মানুষটা পরিচিত-অপরিচিত হাজারও লোককে দিনের পর দিন করে গেছেন আর্থিক সাহায্য, দুর্ভিক্ষের সময় কয়েকমাস ধরে বর্ধমান আর বীরসিংহ গ্রামে নিজের টাকায় অন্নসত্র চালিয়েছেন, শুধু দানধ্যানের জন্যই বাঙালির কাছে দানসাগর নামে পরিচিত ছিলেন, সেই বিদ্যাসাগর হঠাৎ সামান্য ক’টা টাকার জন্য বাল্যকালের বন্ধুর কপিরাইটের টাকা যে মোটেই আত্মসাৎ করতে পারেন না, সেটা অভিযোগকারীরাও নিশ্চয়ই জানতেন। অর্থাৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এই অপবাদ রটানো হয়েছিল। প্রসঙ্গত বলে রাখা জরুরি, মাত্র ৫৫ বছর বয়সে যে উইল বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, তাতে যে ২৬ অনাত্মীয়কে মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল, তাঁদের মধ্যে মদনমোহনের মা, স্ত্রী ও বিধবা কন্যাও ছিলেন।

গ্রিক পুরাণের এক বিদ্রোহী নায়কের নাম প্রমিথিউস। তিনি স্বর্গ থেকে মানুষকে আগুন এনে দিয়েছিলেন। মানব প্রেমিক প্রমিথিউসকে এর জন্য সহ্য করতে হয়েছিল অনেক যন্ত্রণা, অনেক নির্যাতন। আর আমাদের ঈশ্বর উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা তথা ভারতের অন্ধকার সমাজ ব্যবস্থায় সচেষ্ট হয়েছিলেন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালাতে। তাই প্রমিথিউসের মতো তাঁকেও যে লাঞ্ছিত, অপমানিত আর ক্ষতবিক্ষত হতে হবে, তাতে আর আশ্চর্য কোথায়?ঋণ স্বীকার: নিবন্ধটি লিখতে আমি যাঁদের বই ও প্রবন্ধ পড়েছি এবং প্রচুর তথ্য পেয়েছি তাঁরা হলেনইন্দ্র মিত্র, অশোক মুখোপাধ্যায়, কণিষ্ক চৌধুরি, চিন্ময়ী মুখোপাধ্যায়, আলী আনোয়ার, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য, বিনয় ঘোষ, গোলাম মুরশিদ, রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায়, আশীষ লাহিড়ী, শ্রীম, রামরঞ্জন রায়, দেবযানী গুহ, লক্ষণ ঘোষ, দেবপ্রসাদ শিকদার, স্বপন বসু প্রমুখ। এছাড়া ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকেও তথ্য পেয়েছি অনেক।

বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষ্যে  প্রকাশিত  “ঈশ্বর এক নিঃসঙ্গ ফিনিক্স” 

Order at JOYDHAK WEBSTORE
Order at Amazon
Order E-pub at google Playstore   

 

2 thoughts on “শ্রদ্ধাঞ্জলি আহত ঈশ্বর কৃষ্ণেন্দু দেব শরৎ ২০২০

  1. খুব ভালো লাগল। শক্তিশালী লেখনী। মূল্যবান প্রবন্ধ।

    Like

  2. বিরল তথ্য সমৃদ্ধ একটা সৃষ্টি।অনেক কিছু জানতে পারলাম। ভালো লাগলো ।শুভ কামনা।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s