স্টিফেন হকিং ক্রোড়পত্র: কৃষ্ণগহ্বর, ব্যতিক্রমী বিন্দু ও স্টিফেন হকিং – গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়- শরৎ ২০১৮

ফিরে যান মূল ক্রোড়পত্রে

(১)

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ

স্কুলে আমরা সবাই নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের সূত্র পড়েছি। নিউটন বলেছিলেন,  ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো দুটি বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। যদি দুটি বস্তুর ভর যথাক্রমে m ও M, এবং তাদের মধ্যে দূরত্ব r হয়, তবে তাদের মধ্যে এই আকর্ষণ বলের মান হল,

F = GmM/r2

এখানে G হল নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। এই সূত্র সৌরজগতের অধিকাংশ গ্রহ উপগ্রহ ধূমকেতুর গতিবিধি ব্যাখ্যা করতে পারলেও দুটো সমস্যা থেকে গিয়েছিল। সৌরজগতে বাকি সব গ্রহের হিসাব মিলে গেলেও বুধের কক্ষপথের ক্ষেত্রে নিউটনের তত্ত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের একটা তফাত রয়ে যায়। তফাতটা খুব সামান্য, কিন্তু নিউটনের তত্ত্বে ঐ ছোট্ট তফাতও থাকা সম্ভব নয়।

অপর সমস্যাটা তখনই বোঝা যায়নি। টেকনিকাল কথায় বললে নিউটনের তত্ত্ব হল action at a distance তত্ত্ব — কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জায়গার মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে। এই মুহূর্তে সূর্য যদি ধ্বংস হয়ে যায়, নিউটনের তত্ত্ব মানলে সেই খবর সারা ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জায়গায় একই সঙ্গে পৌঁছে যাবে।  ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theory of Special Relativity) প্রকাশ করেন। তিনি দেখান যে স্থান ও কাল আলাদা বা পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। আমরা কোনো বস্তুর অবস্থান বোঝাতে তিনটে মাত্রা ব্যবহার করি। সময়কে আমরা আলাদা ভাবে মাপি। আইনস্টাইন দেখালেন যে এরা সবাই মিলে এক চতুর্মাত্রিক জগৎ সৃষ্টি করে যাকে আমরা বলি দেশকাল। এই তত্ত্বেই তাঁর সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 প্রথম খুঁজে পাওয়া যাবে – অর্থাৎ ভর ও শক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একটা সিদ্ধান্ত আমরা এখান থেকে খুঁজে পেতে পারি – শূন্যস্থানে আলোর থেকে দ্রুত কোনো কিছু যেতে পারে না। তাহলে বিশ্বের সমস্ত জায়গায় একই সঙ্গে কোনো ঘটনারই প্রভাব পড়া সম্ভব নয়।

যদি বস্তুর বেগ না পাল্টায় তাহলে তার গতিবিধি বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু যদি বেগ একই না থাকে? যদি একটা পাথরের টুকরোকে উপরে তুলে ছেড়ে দিই, তাহলে তা পৃথিবীর দিকে পড়বে তো বটেই, তার বেগও ক্রমশই বাড়তে থাকবে। এই রকম বেগ পরিবর্তনকে আমরা বলি ত্বরণ। আইনস্টাইন এই ধরণের বেগ নিয়ে চিন্তা করছিলেন। তাঁর সেই ভাবনার ফলই হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (General Theory of Relativity)। আইনস্টাইন দেখলেন যে মাধ্যাকর্ষণ এবং ত্বরণসম্পন্ন গতিকে একই নিয়মে বাঁধা যায়। সেই নিয়মই হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ।

নিউটনের তত্ত্বে মাধ্যাকর্ষণ হল একটা বল। নতুন তত্ত্বে সে আর বল নয় — দেশকালের বিকৃতি। এই বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। নিউটনের প্রথম গতিসূত্র অনুসারে বস্তুর উপর বল প্রয়োগ না করলে সে সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকবে। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, কারণ সূর্যের আকর্ষণ বল তাকে সরল রেখায় যেতে দেয় না — এই ছিল নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের কথা। আইনস্টাইন দেখালেন যে পৃথিবী আসলে সোজা রাস্তায়ই যাচ্ছে, কিন্তু সূর্যের টানে সোজা রাস্তাটাই গেছে বেঁকে। যে বস্তুর ভর যত বেশি, তার দেশকালকে বিকৃত করার ক্ষমতাও বেশি। একটা রবারের পর্দা টানটান করে অনুভূমিক ভাবে বেঁধে রেখেছি। আমরা যদি একটা হালকা মার্বেলের গুলি নিয়ে গড়িয়ে দিই, সেটা ঠিক সরলরেখা বরাবর যাবে। এবার পর্দার ঠিক মাঝখানে একটা ভারি বাটখারা রেখে দিলাম। আমরা দেখব যে এবার মার্বেলের গুলিটা বাটখারাটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে বেঁকে গেল। তার মানে কি  বাটখারা আর গুলির মধ্যে আকর্ষণ বল কাজ করছে? তা নয়, বাটখারা পর্দাকে বাঁকিয়েছে, গুলিটা সেই বাঁকা পথ অনুসরণ করছে। ঠিক তেমনি ভর (বা শক্তি) তার আশেপাশে দেশকালকে বাঁকিয়ে দেয়, সেই দেশকালের বক্রতার জন্য অন্য বস্তুর পথ বেঁকে যায়। আমাদের মনে হয় আকর্ষণ বল কাজ করছে। শেষ বিচারে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে আমরা জ্যামিতি বলতেই পারি, তবে এই জ্যামিতি আমরা স্কুলে যে ইউক্লিডিয় জ্যামিতি পড়ি তার থেকে আলাদা। এখানে সমান্তরাল রেখারা মিলে যেতে পারে, ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি একশ আশি ডিগ্রির চাইতে কম বা বেশি হতে পারে। যে বস্তুর ভর বা শক্তি যত বেশি, তার আশপাশের দেশকালকে বাঁকানোর ক্ষমতাও তত বেশি। 

তাহলে কি নিউটন ভুল? না। আইনস্টাইন দেখালেন যে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মান যদি খুব বেশি না হয়, তাহলে তাঁর এবং নিউটনের হিসাবের কোনো পার্থক্য হয় না বললেই চলে। এক মাত্র যেখানে মাধ্যাকর্ষণ খুব জোরালো, সেখানেই আমরা দুই তত্ত্বের মধ্যে তফাত খুঁজে পাব। সূর্যের আশপাশে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের মান বেশি। বুধ সূর্যের খুব কাছে আছে, তাই বুধের কক্ষপথের হিসাব নিউটনের সূত্র থেকে ঠিকঠাক মেলে না। আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে বুধের কক্ষপথের হিসাব ঠিকঠাক মিলে গেল। তেমনই আর এক জায়গা হল সিঙ্গুলারিটি বা ব্যতিক্রমী বিন্দু। সে কথায় আমরা পরে আসব।  

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ আরও অনেকগুলি ভবিষ্যৎবাণী করে।  নিউটন ও আইনস্টাইন, দুজনের তত্ত্বই তীব্র মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আলো বেঁকে যাওয়ার কথা বলে, কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে এই বেঁকে যাওয়ার পরিমাণ নিউটনের তত্ত্বের দুগুণ। সূর্যের কাছাকাছি সেই রকম জোরালো মহাকর্ষ ক্ষেত্র আছে, তাই নক্ষত্রের আলো যখন সূর্যের পাশ দিয়ে যায়, তখন তা বেঁকে যাওয়ার কথা। তবে সূর্যের পিছনের তারা দেখা শক্ত, সূর্যের অতি উজ্জ্বল আলো সবাইকে ঢেকে দেয়। একমাত্র পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সেই সব জ্যোতিষ্কদের  দেখতে পাওয়া সম্ভব।  সূর্যের পাশ দিয়ে গেলে আলো কতটা বাঁকবে ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তা অঙ্ক কষে বার করেন। ১৯১৯ সালের ২৯ মে দক্ষিণ আমেরিকাতে ও আফ্রিকাতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সে সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের উৎসাহে দুটি অভিযান পাঠানো হয় দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকাতে। এডিংটন নিজে গিয়েছিলেন আফ্রিকা। সূর্যগ্রহণের সময় তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় আইনস্টাইনের হিসাব একদম ঠিক।

পরে আরো অনেক ভাবে আলোর উপর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সঙ্গের আলোকচিত্রে মাঝখানের দুটি উজ্জ্বল বস্তু হল একটি ছায়াপথ গুচ্ছের অংশ। ছায়াপথ গুচ্ছের ভর খুব বেশি, তাই তার আকর্ষণ পিছন থেকে আসা আলোকে বাঁকিয়ে উত্তল লেন্সের মতো কাজ করে। বৃত্তচাপের মতো আলোর রেখা হল আসলে একটিই উৎস থেকে আসছে, কিন্তু আলো বেঁকে যাওয়ার ফলে বৃত্তচাপের মতো দেখতে লাগছে।

(সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ অনুযায়ী  মহাকর্ষ ক্ষেত্রে সময় ধীর গতিতে চলে। পৃথিবীতেই পরীক্ষা করে এই বিষয়টা প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর কাছে মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র অপেক্ষাকৃত বেশি তীব্র – পৃথিবী থেকে যত দূরে যাব, তার মান কমে যাবে।  তার মানে সমুদ্রতলের কাছে একটা ঘড়ি যে রকম সময় দেখাবে, পাহাড়ের উপরে গেলে সে আরো একটু তাড়াতাড়ি চলবেএর সঙ্গে ঘড়ির কলকব্জার কোনো সম্পর্ক নেই, পাহাড়ের উপরের থেকে সমুদ্রতলে সময় ধীরে চলেতফাতটা খুব কম, এক সেকেন্ডের ক্ষেত্রে এক লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগেরও কম। কিন্তু আধুনিক ঘড়িতে এই পরিমাণ পার্থক্য মাপা যায়। মেপে দেখা গেছে আইনস্টাইনের তত্ত্ব পুরোপুরি নির্ভুল তোমরা জিপিএস ব্যাপারটা জানো, সেখানে সাধারণ ও বিশেষ দু’রকমের আপেক্ষিকতাবাদের জন্যই সময়ের পরিবর্তনকে হিসেবে রাখতে হয়।

আলো যে শুধু বেঁকে যায় তা নয়, মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে সময় ধীরে চলার ফলস্বরূপ তার কম্পাঙ্কও যায় কমে। দৃশ্য আলোকে যদি রামধনুর সাতটা রঙে ভেঙে নিই, তাহলে বেগুনি আলোর কম্পাঙ্ক বেশি, তারপর কমতে কমতে লাল আলোর ক্ষেত্রে কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম হয়। কম্পাঙ্ক কমে যাওয়ার অর্থ আলোর রঙ লালের দিকে যাওয়া, তাই একে বলে লোহিতাপসরণ (red shift))

(২)

কৃষ্ণ গহ্বর ও ব্যতিক্রমী বিন্দু

এবার আমরা আসি কৃষ্ণ গহ্বরের কথায়। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সমীকরণগুলো বেশ জটিল, একশো বছরে মাত্র কয়েকটা বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম সমাধানটি নির্ণয় করেন কার্ল শোয়ার্জসচাইল্ড। ১৯১৬ সালে তিনি আইনস্টাইনকে সমাধানটা লিখে পাঠিয়েছিলে। আইনস্টাইন এত সহজ সমাধান দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

প্রথমেই একটা কথা বলতে হবে, গোলীয় প্রতিসাম্য (spherical symmetry)। একটা রবারের বল নিলাম, যে দিক দিয়েই দেখি বলটাকে একই রকম লাগে বিজ্ঞানীরা একে বলেন গোলীয় প্রতিসাম্য শোয়ার্জসচাইল্ড কোনো ভর সম্পন্ন গোলীয় প্রতিসম বস্তুর জন্য বস্তুটির বাইরে শূন্যস্থানে আইনস্টাইনের সমীকরণের সমাধান করেছিলেন। আরো একটা শর্ত ছিল, বস্তুটিকে নিজের অক্ষের চারপাশে ঘুরলে চলবে না। সেই সমাধানকে ব্যবহার করে ১৯৩৯ সালে জে রবার্ট ওপেনহাইমার এবং হার্টল্যান্ড স্নাইডার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব ব্যবহার করে কৃষ্ণ গহ্বরের কথা প্রথম বলেছিলেন। তার মানে ওপেনহাইমার-স্নাইডার যে কৃষ্ণ গহ্বরের কথা বলেছিলেন তারা গোলীয় প্রতিসম এবং নিজের অক্ষের চারপাশে ঘুরছে না।

একটা কথা বলে রাখা ভালো, নিউটনের তত্ত্ব থেকেও কৃষ্ণ গহ্বরের ধারণা পাওয়া যায়, তবে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যে ধরনের কৃষ্ণ গহ্বরের কথা বলে তা অনেকাংশেই আলাদা। কৃষ্ণ গহ্বরের সৃষ্টি কেমন ভাবে হতে পারে সে কথায় আমরা পরে আসব। আগেই বলেছি যে ভর তার চারপাশের দেশকাল ক্ষেত্রকে বাঁকিয়ে দেয়। শোয়ার্জসচাইল্ড সমাধান অনুযায়ী কোনো বস্তুর ভর যদি একটি বিন্দুতে চলে যায়, তাহলে সেই বিন্দুতে দেশকালের বক্রতা অসীমে পৌঁছে যায়। একে বলছি সিঙ্গুলারিটি বা ব্যতিক্রমী বিন্দু।

সিঙ্গুলারিটি শুনেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা স্কুলেও সিঙ্গুলারিটির মুখোমুখি হয়েছি। একটা গ্রাফ পেপারে y=1/x2 সমীকরণের লেখচিত্র আঁক। x=0 বিন্দুতে y-এর মান অসীম হয়ে যাচ্ছে। এও এক ধরনের সিঙ্গুলারিটি। অর্থাৎ যদি কোনো বিন্দুতে কোনো রাশির মান অসীম হয়ে যায়, আমরা তাকে ব্যতিক্রমী বিন্দু বলতে পারি।

এখানে আরো একটা বিষয় দেখা দরকার।  ধরা যাক সূর্যকে চাপ দিয়ে ছোট করা হচ্ছে। যত ছোট হবে, তার উপরিতলের ঠিক বাইরে আকর্ষণ বল তত বাড়বে। তার মানে আলোও তার আকর্ষণে আরো বাঁকা পথে চলবে। শোয়ার্জসচাইল্ড সমাধান থেকে দেখা যায় সূর্য যখন খুব ছোট হয়ে যাবে, তখন তার কেন্দ্র থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে থাকলে কোনো বস্তু, এমনকি আলোর পক্ষেও আর তার মাধ্যাকর্ষণকে অস্বীকার করে ঐ দূরত্বের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কেন্দ্র থেকে ঐ দূরত্বটাকে বলে শোয়ার্জসচাইল্ড ব্যাসার্ধ। কেন্দ্রের চারপাশে এই যে গোলক, যার ভিতর থেকে কোনো কিছুই আর বেরিয়ে যেতে পারবে না, তার নাম ঘটনা সীমান্ত (Event Horizon)। বস্তু বা আলো প্রবেশ করতে পারে তাই তা গহ্বর। আলোও বেরোতে পারে না, তাই তা কৃষ্ণ।

(ব্যতিক্রমী বিন্দুর কথা বলেছিলাম, তার আবার রকমফের আছে। কোনো কোনো ব্যতিক্রমী বিন্দু শুধুমাত্র আমরা কীভাবে অঙ্কটা করতে শুরু করেছি, তার উপর নির্ভর করেবাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘটনা সীমান্ত এধরনের ব্যতিক্রমী বিন্দু। অঙ্ক করার কায়দা পালটে দেখানো যায় যে সেখানে কোনো সিঙ্গুলারিটি নেই। কোনো মহাকাশচারী যদি কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে পড়তে থাকেন তাহলে ঘটনা সীমান্ত পার হওয়ার সময় তিনি আলাদা করে কিছু বুঝতে পারবেন নাতবে একবার ঘটনা সীমান্ত পার হওয়ার পরে আর ফেরার কোনো উপায় নেই। আবার কোনো কোনো ব্যতিক্রমী বিন্দু আমাদের অঙ্ক করার পদ্ধতির উপরে নির্ভর করে না।  কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্রে এই দ্বিতীয় ধরনের ব্যতিক্রমী বিন্দু থাকতে পারেআমাদের আলোচনার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। )

সাধারণ ভরের জন্য শোয়ার্জসচাইল্ড ব্যাসার্ধের মান খুব ছোট। পৃথিবীর সমান ভরের কৃষ্ণ গহ্বরের শোয়ার্জসচাইল্ড ব্যাসার্ধ এক সেন্টিমিটারের থেকেও কম। ভরটা সূর্যের সমান হলে তা হবে তিন কিলোমিটার। তার মানে সূর্যের ভর একই রেখে তাকে যদি তিন কিলোমিটারের থেকে ছোট করা যায়, তাহলে একটা কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হবে। সূর্যের ব্যাসার্ধ হল সাত লক্ষ কিলোমিটার। তাই প্রথমে মনে করা হত যে অঙ্ক যাই বলুক, আসলে সে রকম কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

তবে বিজ্ঞানীরা আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন যে কৃষ্ণ গহ্বর বাস্তবে থাকতেই পারে। তারকাকে বাইরে থেকে চেপে ছোট করার কোনো সুযোগ নিশ্চয় নেই, কিন্তু কোনো তারকা যখন তার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে, তখন সে নিজের মাধ্যাকর্ষণের জন্যই সংকুচিত হয়। ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর আগেই দেখিয়েছিলেন যে ভর যদি খুব বেশি হয়, তাহলে তারকার সংকোচনকে বন্ধ করার মতো কোনো বল নেই। কিন্তু বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন চন্দ্রশেখরের গবেষণার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন বলে বিজ্ঞানী মহলে তাঁর কাজের স্বীকৃতি আসতে দেরি হয়। সেই গল্প এখানে পড়া যাবে।

শেষ পর্যন্ত ওপেনহাইমাররা দেখালেন যে তারকার ভর যদি খুব বেশি হয়, তাহলে তার সম্ভাব্য অন্তিম পরিণতি কৃষ্ণ গহ্বর। ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী রয় কের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণ থেকে নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণ গহ্বরের সমীকরণ সমাধান করেন। তার পরেই বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ এক উপপাদ্যে দেখালেন যে কোনো বিশেষ পরিস্থিতি নয়, কোনো তারকার ভর যদি বেশি থাকে, এবং তা যদি নিজের চারদিকে আবর্তন না করে, তাহলে তার অন্তিম পরিণতি অবশ্য কৃষ্ণ গহ্বর।

উনিশশো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মহাকাশে আমরা এমন কিছু  কিছু বস্তুর খোঁজ পেতে শুরু করি যাদের কৃষ্ণ গহ্বর ছাড়া অন্য কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। কোয়াসার বলে একধরনের বস্তুকে দেখা যায় যাদের শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা নিউক্লিয় বিক্রিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। আগেই বলেছি যে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের জন্য কোনো বস্তু যখন উপর থেকে নিচে পরে, তখন তার বেগ ক্রমশই বাড়তে থাকে। কৃষ্ণ গহ্বরের আকর্ষণ অনেক বেশি। কোনো তারকার মতো ভারি বস্তু যদি সেই প্রবল টানে গহ্বরের মধ্যে পড়ে,  তার বেগ অনেক বেড়ে যায়। এই গতির শক্তি বিভিন্ন ভাবে আলোতে রূপান্তরিত হয়। মনে করা হয় এটাই হল কোয়াসারের বিপুল শক্তির উৎস।

১৯৬৪ সালে মহাকাশে হংসমণ্ডল নক্ষত্রমণ্ডলীতে (Cygnus) একটা খুব শক্তিশালী এক্স রশ্মির উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়। তার ভর মেপে দেখা গেল সূর্যের ভরের পনের গুণ। কিন্তু সেখানে দূরবিন দিয়ে কোনো তারকার চিহ্ন পাওয়া গেল না। যে বস্তু থেকে এক্স রশ্মি বেরোচ্ছে, তার আয়তনও খুবই ছোট। এত ছোট এত ভারি কোনো বস্তু, যার থেকে কোন আলো বেরোচ্ছে না, তা একটা জিনিসই হওয়া সম্ভব – কৃষ্ণ গহ্বর। এই গহ্বরের কাছেই একটা বিরাট তারকা আছে।  তার থেকে গ্যাস কৃষ্ণ গহ্বর গিয়ে পড়ছে এবং সেই গ্যাস উত্তপ্ত হয়ে এক্স রশ্মি বিকিরণ করছে – এটাই বিজ্ঞানীদের ধারণা।

 (৩)

স্টিফেন হকিঙের গবেষণা

স্টিফেন হকিং পিএইচডি ডিগ্রির জন্য কেম্ব্রিজে কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল কৃষ্ণ গহ্বর ও সিঙ্গুলারিটি। তাঁর সুপারভাইজার ডেনিস স্কিয়ামার উদ্যোগে পেনরোজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। হকিং ১৯৬৬ সালে তাঁর কৃষ্ণ গহ্বর বিষয়ে ডক্টরেটের থিসিস জমা দেন। পেনরোজের কৃষ্ণ গহ্বর সংক্রান্ত উপপাদ্যটি ব্যবহার হচ্ছিল বিশাল তারকার মৃত্যুকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যাতে, হকিং সম্পূর্ণ এক নতুন ক্ষেত্রে সেটিকে প্রয়োগ করলেন। আমরা জানি যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছিল এক মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে যার নাম দেওয়া হয়েছে বিগ ব্যাং। মহাবিশ্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। তার অর্থ অতীতে মহাবিশ্ব ছিল আরও ক্ষুদ্র এবং তার ঘনত্ব ছিল আরো বেশি। মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্ত তাহলে কেমন ছিল?  হকিং দেখালেন সেই মুহূর্তে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল অসীম, অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে এক সিঙ্গুলারিটি থেকে। এমন নয় যে হকিংই এই কথা প্রথম বলেছিলেন, কিন্তু তখনো পর্যন্ত ধারণা ছিল যে খুব নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতেই মহাবিশ্বের  ঘনত্ব অসীম হওয়া সম্ভব, কিন্তু সাধারণভাবে হয়তো সে কথা সত্যি নয়। আমাদের বিশ্বের ক্ষেত্রে আদি ঘনত্ব হয়তো অসীম ছিল না। পেনরোজের উপপাদ্য প্রয়োগ করে হকিং দেখালেন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র নয়, মহাবিশ্বের প্রায় সমস্ত মডেলের ক্ষেত্রেই আদি মুহূর্তের সিঙ্গুলারিটিকে এড়ানোর কোনো উপায় নেই। (ব্যতিক্রম হল স্থিতাবস্থার মডেল যেখানে ধরে নেয়া হয় যে মহাবিশ্ব চিরকাল ধরে একই রকম আছে। তবে নানা রকম পর্যবেক্ষণ থেকে এই মডেল প্রায় বাতিল হয়ে গেছে।)

ডক্টরেট পাওয়ার পরে হকিং রজার পেনরোজের সঙ্গেই কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁদের যৌথ গবেষণার ফল হিসাবে আমরা আরো কয়েকটি উপপাদ্য পেয়েছি যাদের একসঙ্গে পোশাকি নাম হকিং পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যসমূহ। এই গবেষণায় কাজে লেগেছিল একটি বিশেষ সমীকরণ যার সঙ্গে আমাদের দেশের এক বিজ্ঞানীর নাম জড়িত। সাধারণ আপেক্ষিকতা বা জেনারেল রিলেটিভিটি বিষয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরির আবিষ্কৃত রায়চৌধুরি সমীকরণ ব্যবহার করেছিলেন হকিং ও পেনরোজ। কোন কোন ক্ষেত্রে তারকারা শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবে, হকিংরা তা নির্ধারণ করলেন। ব্র্যান্ডন কার্টারের সঙ্গে মিলে হকিং আরো দেখান যে নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান কোনো কৃষ্ণ গহ্বরের চরিত্র ব্যাখ্যা করার জন্য মাত্র দুটি জিনিস জানা দরকার তা হল তার ভর ও কৌণিক ভরবেগ। এই দুটি রাশির সাহায্যেই আমরা কৃষ্ণ গহ্বরের বাইরের কোনো পর্যবেক্ষক গহ্বর সম্পর্কে কী দেখতে পাবে তা বলে দিতে পারি। যদি দুটি বস্তুর ভর ও কৌণিক ভরবেগ সমান হয়, সংকোচনের ফলে তাদের থেকে যে দুটি কৃষ্ণ গহ্বর পাওয়া যাবে, গহ্বরের বাইরের পর্যবেক্ষকের কাছে তাদের সমস্ত চরিত্র একেবারে একই রকম হবে। কেরের সমাধান থেকে তাদের সমস্ত ধর্ম নির্ণয় করা যাবে। একে বলে ‘No hair theorem’। তারকা বা অন্য কোনো ভারি বস্তু, যা থেকেই কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হোক না কেন, সেই বস্তু সম্পর্কে গহ্বর সৃষ্টি হওয়ার আগের অন্য কোনো তথ্য ঘটনা সীমান্তের বাইরে পাওয়া যাবে না।

(প্রসঙ্গত বলে রাখি, কৃষ্ণ গহ্বর সম্পর্কে আরো একটা তথ্য জানা দরকার হতে পারে, তা হল তড়িৎ আধান বা ইলেকট্রিক চার্জ। সেক্ষেত্রে যে সমাধান পাওয়া গেছে তার নাম কের-নিউম্যান সমাধান। তবে মহাবিশ্বে সাধারণত সব বড় বস্তুই তড়িৎ নিরপেক্ষ, অর্থাৎ তাদের আধান শূন্য। তাই কের সমাধানই বেশি কাজে লাগে। ) 

হকিং, কার্টার এবং জেমস বার্ডিন তিনজনে মিলে এর পর কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে একটা সম্পূর্ণ অন্য দিক তুলে ধরেন। সে কথায় যাওয়ার আগে তাপগতিবিদ্যা সম্পর্কে দু একটা কথা মনে রাখা দরকার। এনট্রপি বলে একটি রাশি আছে যাকে আমরা বলি বিশৃঙ্খলার মাপ। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে যে কোনো প্রক্রিয়ায় এই এনট্রপি সবসময়েই বৃদ্ধি পায়। তেমনি যে কোনো বস্তুর একটা তাপমাত্রা থাকে। কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষেত্রে এই এনট্রপি বা তাপমাত্রা কেমন করে পাওয়া যাবে? হকিংরা দেখালেন কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা সীমান্তের ক্ষেত্রফল হল তার এনট্রপির পরিমাপ। তেমনি ঘটনা সীমান্তে অভিকর্ষজ ত্বরণ হল তার তাপমাত্রার মাপক। একইভাবে আমরা সহজেই বুঝতেই পারি পারি কৃষ্ণ গহ্বরের ভর হল তার মোট শক্তির পরিমাপ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিজ্ঞানী জ্যাকব বেকেনস্টাইনও এ বিষয়ে গবেষণাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এর পরেই আসে হকিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার কৃষ্ণগহ্বর থেকে নির্গত বিকিরণ যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত। আগেই বলেছি যে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল থেকে কখনোই কোনো কিছু বেরিয়ে আসে না। অথচ হকিংরা দেখিয়েছেন যে কোনো কৃষ্ণ গহ্বরের একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে এবং তাপমাত্রা থাকার অর্থ হল তাপগতিবিদ্যা অনুসারে তার থেকে বিকিরণ নির্গত হবে।  এই দুই বিপরীতকে মেলাব কেমন করে?

হকিং এখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শরণাপন্ন হলেন। গত শতাব্দীর ঠিক সূচনাতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম দিয়েছিলেম ম্যাক্স প্লাঙ্ক। আইনস্টাইন, নিলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার, পল ডিরাক, রিচার্ড ফেইনম্যান সহ আরো অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে যে কণাসমূহের গতির সঠিক ব্যাখ্যা একমাত্র কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব। তেমনি আমরা এও জানি যে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তন ব্যাখ্যার চাবিকাঠি। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই দুই তত্ত্বকে মেলানো সম্ভব হয়নি। হকিঙের গবেষণাকে এই মেলানোর বিষয়ে প্রথম ধাপ বলা যেতে পারে। আরো সঠিক ভাবে বললে হকিং দেখিয়েছিলেন এই দুই তত্ত্বকে মেলাতে গেলে বিজ্ঞানের আরো এক মৌলিক তত্ত্বকে হিসাবে আনতেই হবে তা হল তাপগতিবিদ্যা। এ বিষয়ে হকিঙের কৃতিত্ব অনন্য। সংক্ষেপে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক।

আমরা জানি যে কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সবচেয়ে উন্নত রূপ হল কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী এ ধরণের শক্তিশালী ক্ষেত্র শূন্যস্থানেও কণা ও তার প্রতিকণা সৃষ্টি করবে। ইলেকট্রন-পজিট্রন এধরনের কণা প্রতিকণার উদাহরণ। হকিং বললেন যে ঘটনা সীমান্তের ঠিক বাইরে মাধ্যাকর্ষণের শক্তি থেকে যে কণা-প্রতিকণা যুগ্ম তৈরি হবে, তার মধ্যে একটি কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। অপরটি কৃষ্ণ গহ্বরে প্রবেশ করবে। এর ফলে দেশকালের বক্রতা সামান্য কমে যাবে, বা অন্যভাবে বললে গহ্বরের ভর কমে যাবে। এর মানে বেরিয়ে যাওয়া কণাটির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি কৃষ্ণ গহ্বরের ভর থেকেই পাওয়া যাবে। দূরের পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হবে যেন কৃষ্ণ গহ্বর থেকে কণাটি বেরিয়ে এল। কৃষ্ণ গহ্বরের তাপমাত্রা নির্ধারণ হকিংরা আগেই নির্ধারণ করেছিলেন, তাই তাপগতিবিদ্যা অনুযায়ী তা থেকে বেরোনো বিকিরণের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত তা আমরা জানি। হকিং দেখালেন তাঁর প্রস্তাবিত বিকিরণ একই চরিত্রের হবে।     

হকিঙের তত্ত্ব থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কৃষ্ণ গহ্বরের ভর কমে আসবে, তারা তাহলে চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু তারকার মৃত্যুর সময় সৃষ্ট গহ্বর বা ছায়াপথসমূহের কেন্দ্রে যে অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর আছে, তাদের তাপমাত্রা খুবই কম, তাই তাদের থেকে নির্গত বিকিরণের পরিমাণও খুব কম। তাই তারা তাদের চারিদিক থেকে যে পরিমাণ ভর নিজের ভিতরে টেনে নেয়, তার পরিমাণ এই বিকিরণের থেকে বেশি। তাই তাদের ভর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমছে না। কিন্তু মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় এক ধরনের খুব কম ভরের কৃষ্ণ গহ্বর সৃষ্টি হওয়ার কথা, তাদের তাপমাত্রা অনেক বেশি। তাই তাদের ক্ষেত্রে হকিং বিকিরণের পরিমাণ অনেক বেশি এবং ভর কমতে কমতে তারা একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধরনের কৃষ্ণ গহ্বর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, হয়তো হকিং বিকিরণই তাদের দেখার একমাত্র পথ। তাই এখনো পর্যন্ত হকিং বিকিরণ  সনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। মৃত্যু পর্যন্ত হকিঙের এই আক্ষেপ ছিল।

একটা কথা বলে রাখা ভালো। তোমরা সবাই হয়তো লাইগোর নাম শুনেছ। সম্প্রতি এই যন্ত্রের সাহায্যে আমরা দুটি কৃষ্ণ গহ্বরের মিলন থেকে নির্গত অভিকর্ষ তরঙ্গ ধরতে সক্ষম হয়েছি। এই প্রবন্ধে এবিষয়ে আরো কিছু জানা যাবে। তবে এই তরঙ্গ কিন্তু কোনো মতেই হকিং বিকিরণ নয়।

বিগ ব্যাং সিঙ্গুলারিটি বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি কৃষ্ণ গহ্বরের ভিতরে কি আছে তা বাইরে থেকে জানা সম্ভব নয়। তাহলে কোনো কণা যদি কৃষ্ণ গহ্বরের ভিতর পড়ে যায়, তার সম্পর্কে সমস্ত তথ্য কি মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যায়? পদার্থবিদ্যার অন্য ক্ষেত্রে কিন্তু এই তথ্য কখনোই হারায় না। এই আপাত বৈপরীত্যকে বলে হকিং কূট (Hawking paradox)। হকিং প্রাথমিক ভাবে মনে করতেন যে কৃষ্ণ গহ্বরে পড়ে যাওয়া কণা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য হারিয়েই যায়, পরে তিনি মত পরিবর্তন করেন। বিজ্ঞানী জন প্রেস্কিলের সঙ্গে এই নিয়ে বাজি ধরার গল্প হয়তো অনেকেরই জানা। পরবর্তীকালে তিনি কৃষ্ণ গহ্বর সম্পর্কে আরো অনেক মত দিয়েছিলেন, তবে তা এখনো বিতর্কিত।

শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখি। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে সাধারণ আপেক্ষিকতার মিল ঘটানো এখন সুদূর পরাহত। তাই ব্যতিক্রমী বিন্দুর সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। 

ফিরে যান মূল ক্রোড়পত্রে

Leave a comment