গল্প ওলটপালট অনুষ্টুপ শেঠ বর্ষা ২০১৮

অনুষ্টুপ শেঠ

ঘোর বর্ষা। সে যে কী বৃষ্টি কী বলব! মাঠ ভেসে যায় ঘাট ভেসে যায়, ঘরদুয়োর উঠোন বাগান ভাসিয়ে নিয়ে শুধু ছলছল জল মত্ত বাদল।

ঘরে টিমটিমে হ্যারিকেন। জোলো হাওয়ায় শীত করছে, পাতলা সুতির চাদরখানা কষে মুড়ি দিয়ে বসে বাইরের টানা ঝরঝর শব্দ শুনে যাচ্ছে মিঠি। সামনে ইতিহাস বই। বাতাসে খিচুড়ি ওমলেটের সুবাস।

তক্তপোশের অন্য পাশে, কোণা করে বসে পা নাচাচ্ছে তুলি। তারও হাতে বই, বাংলা ব্যকরণ। হ্যারিকেনের আলো বিলক্ষণ পৌঁছচ্ছে না কোণায়, কাজেই না পড়ার বৈধ কারণ আছে বইকি। তবে গুনগুন করে ‘এমন আষাঢ়ে / তাড়া করে ষাঁড়ে’ এই স্বরচিত গান গাওয়ার কতটা যুক্তি আছে সে বলতে পারা মুশকিল।

বেশ দরদ এসে গেছিল গাইতে গাইতে, হঠৎ মিঠি ডুকরে ওঠে, “এই দিদি! ওটা কী রে?”

একদিকের ভ্রূ কুঁচকে (এটা নতুন স্টাইল, প্র্যাকটিশ চলছে) তাকায় তুলি, “কোথায় কী?”

মিঠি জবাব না দিয়ে বিচ্ছিরিভাবে হেঁচকি তুলতে লেগে যায়।

অগত্যা ঘরের চারদিকে নজর চালায় তুলি। ছাঁটের জ্বালায় দুটো জানলাই ভেজা, এবং ভেজানো। ফাঁকফোকর দিয়ে আসা হাওয়ায় নীল সাদা পর্দাগুলো দুলে দুলে উঠছে। লোডশেডিং, আলো পাখা দুই বন্ধ।

মায়ের একপাল্লার দেরাজ, বইয়ের তাক, স্টীল আলমারি, ক্যালেন্ডার, বাঁধানো গণেশের ছবি কোথাও কোন নতুন ‘কী’ চোখে পড়ে না। মিঠি কিন্তু চেয়েই আছে একভাবে।

“হল কী তোর?”

মিঠি শুধু হাত বাড়ায়। হ্যারিকেনের আলোয়, কেঁপে কেঁপে ওঠা পর্দার ছায়া খেলে তার মুখে, প্রসারিত হাতে আলোয় ছায়ায় আলপনা খেলে যেতে থাকে। বাইরের বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে তুলি নিজের বুকের ধকধক শব্দ শুনতে পায়। মিঠিটা এমন করছে কেন!

আবার পিছন ঘুরে খুব ভাল করে চোখ চালায় তুলি। সেই আলমারি, ঘরে ঢোকানোর সময় ঘষা খাওয়া, হ্যান্ডেলের পাশে একটা হলদে হাঁসের স্টিকার। সেই ক্যালেন্ডার, বাংলা, আষাঢ়।  ছুটির লাল দাগগুলো এই আলো-আঁধারিতে কালো দাগগুলোর সাথে মিলিয়ে গেছে প্রায়। সেই অমলেটের গন্ধ।

মিঠির হেঁচকি থেমেছে এতক্ষণে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, “ওদিকে কী দেখছিস!”

তুলির যদি এরপর বোনের কানটি ধরে কষকষ করে মলে দিতে ইচ্ছে করে, খুব অন্যায় হয় কী? তুই ঘোড়াড্ডিম আঙুল তুলে দেখাচ্ছিস তালগাছের মাথা, তো আমি সেদিক দেখব না তো কি পুকুরপাড়ে চাইব?

“তালগাছ না। তোর মাথা।”

“আমার না, মাথাটা তোরই গেছে।” বলতে বলতেই মাথায় হাতটা বুলিয়ে নিতে গেছিল তুলি। ঠক করে কীসে ঠেকে যায়।

শক্তপোক্ত। খাড়া। অমসৃণ।

মাথার অন্য দিকটাতেও তদন্ত করতে পাঠায় হাতটাকে। অনুরূপ আরেকটি জিনিসে হাতড়াতে হয় সেদিকেও।

ঠিক ১০০ ডেসিবেলের একটা চীৎকার ছেড়ে তুলি অজ্ঞান হয়।

*****

এই ছাতার বিষ্টি ধরলে হয়! তাল তাল ছাড়া কাপড় জমছে, কাচবে কি মানুষ শুকোচ্ছেই না কিছু। ঘরে ঘরে কাপড় মেলে তার নিচে লুকোচুরি খেলে বেড়ানো সন্ধ্যাদেবীর বিলকুল না-পসন্দ্‌ – সে অবন ঠাকুর যতই বলুন না কেন। কাজে কাজেই মেজাজ টং। রেগে থাকলে আবার তাঁর হাতের রান্নাটা খোলে ভাল। এই যে বিশুদ্ধ ভুনি খিচুড়িটি নামাচ্ছেন, এটি খেলে মনুষ্যজন তো বটেই, লক্ষীছাড়া ইন্দ্রদেবও হাত চাটতে চাটতে জুলজুল করে তাকাবে যদি আট্টু পাওয়া যায় সেই আশায়।

খুব বাস ছেড়েছে বটে। ঢাকনাটা সরিয়ে সবে ঘিয়ের শিশিটা খুঁজতে গেছেন, আবার কাশির দমকটা উঠল। আর এই বর্ষাবাদলে হবে না! কালই টের পেয়েছেন ঠান্ডাটা বেশ একটু বুকে বসে গেছে। খাচ্ছি খাই করে ওষুধটা আর খাওয়া হয়নি এখনো। এমনকি সকালে রঞ্জিত বাবু কাফ সিরাপের শিশিটা রান্নাঘরে রেখে দিয়ে গেছেন পর্যন্ত, “তোমার যা দয়ার শরীর, কাশিকে অন্তত অত বুকে করে রেখো না!” এই বাণী সহযোগে। তা বাণী বেরোবে না? তিনি তো বৃষ্টি সোহাগী, বৃষ্টির জলে নাকি তার মাথায় কাব্যের পুঁইডগা লকলকিয়ে বাড়ে। এসব আদিখ্যেতা থামাতে অবশ্য সন্ধ্যাদেবীর একখানা চাউনিই যথেষ্ট, পুঁইডগা পুঁইঘন্টা হয়ে যায় অচিরাৎ। তবে এখন কাশির চোটে পাঁজর চেপে ধরে মনে হয় হাতের কাছে গুছিয়ে দিয়ে গিয়ে ভালই করেছে লোকটা। একেবারে হাপ বোতল গলায় ঢেলে দিলেই হবে।

এর ঠিক তেরো সেকেন্ড পরে তুলির অনৈসর্গিক আর্তনাদ সন্ধ্যাদেবীর কানে ধাক্কা মারে। সেই ধাক্কায় সন্ধ্যাদেবী কাফ সিরাপটা গলায় না ঢেলে সোজা খিচুড়িতে ঢেলে দেন।

*****

রঞ্জিতবাবু অনেকক্ষণ ধরে বাইরের দরজার সামনে, বা বলা ভাল, পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। পরণে ফতুয়া। শীত শীত করছে বটে, কিন্তু পাঞ্জাবিগুলো কাচা হয়নি। পাজামার ঝুল গোড়ালির সাড়ে তিন ইঞ্চি ওপরে শেষ হয়েছে, কারণ কোমরে খুব কষে গুটিয়েছেন।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছেন, ছাতা মাথায় একটু ভিজতে বেরোলে ঠিক কতটা খিঁচুনি খেতে হবে গিন্নির কাছে। একেই তো জামাকাপড়ের পাহাড় জমে গেছে, আরো একটা পাজামা ভিজে গেলে কি ভিসুভিয়াসে অগ্ন্যুৎপাতের চান্স আছে? এত মনোরম বৃষ্টি, মনটা বড়ই চাইছে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। এই প্রকৃতির লোভেই তো পাড়ার একদম প্রান্ত ঘেঁষে, জঙ্গুলে পোড়ো জমিগুলোর হাতের নাগালে বাড়িটা বানিয়েছেন। এখন অশ্রান্ত বারিধারার কল্লোল শুনতে শুনতে, বহিরঙ্গে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে’ গাইতে গাইতে হারিয়ে যেতে মন আনচান করছে, কিন্তু তুচ্ছ পাজামার মোহ তাঁকে এতক্ষণ আটকে রেখেছে।

অবশ্য হারিয়ে গেলে চলবে না, দশটার মধ্যে না ফিরলে গিন্নি খেতে দিতে অস্বীকার করতে পারেন। খিচুড়ির গন্ধটি যা ছেড়েছে, না খেয়ে থাকার কথা ভাবাও পাপ, মহাপাপ। আচ্ছা পুরোনো একটা পাজামা পরে গেলে কেমন হয়, যেটা কাচার জন্যই আছে?

এই আইডিয়ার জন্য নিজের পিঠ চাপড়াতে হাত তুলেছিলেন রঞ্জিত বাবু। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলির আর্তনাদ ভেসে এল। হকচকিয়ে গিয়ে, দরজা খুলে কুকুরখ্যাপা বৃষ্টির মধ্যে সটাং বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পাজামা তো বটেই জামাটাও মুহূর্তে ভিজে কাঁই হয়ে গেল। ধুত্তোর!

*****

রাত বারোটা বেজে গেছে। কাফ সিরাপের গুণেই হোক, কি ঘটনার শকেই হোক, চারজন অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুমিয়ে পড়ার আগে অবধি তুলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। আর মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে প্রতিবার চমকে চমকে উঠেছেন সন্ধ্যাদেবী। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না সত্যি সত্যি মেয়ের মাথায় একজোড়া মজবুত শিং গজিয়েছে! জন্মে এমন অশৈলী কান্ড শোনেননি তিনি। এমনকি রাজ্যের যে ভূত পেত্নীর গপ্পো পড়েছেন ছোটতে, তাতেও কোথাও এমন কিছু পাননি।

তা উনি আর এত কী পড়েছেন, ওই পড়ুয়া লোকটারই দশা দেখ! এদিকে তো নিত্যিনতুন বই কিনছে আর বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছে, অথচ আজ মেয়ের মাথায় শিং দেখে কেমন খারাপ টিভির ছবির মত কাঁপছিল! দাঁতে দাঁত লেগে হাঁটুতে হাঁটু ঠুকে সে কি ছিরি! ওসব ন্যাকরাপনা সন্ধ্যাদেবীর পোষায় না, মিঠির বক্তব্য শুনেই তিনি প্রম্পটলি হাত পা এলিয়ে মুচ্ছো গেছিলেন। অবশ্য তার তিন মিনিট পর নিজেই উঠে বসে তুলির মুখে চোখে জল ছিটিয়ে, আর রঞ্জিতবাবুকে মুখে জল ঝাপটার সাথে দা কাটা তামাকের মত কড়া একখানা ধমক দিয়ে দুজনকে চাঙ্গা করে বসিয়েছেন। কোন রিস্ক না নিয়ে মিঠির মুখেও একরাশ জল ছিটিয়ে দিয়েছেন। তারপর আঁচল দিয়ে নিজের মুখটুখ ভাল করে মুছে নিয়ে, গুছিয়ে বসে মেয়েদের জেরা করে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছেন।

বোঝার মত নয় অবশ্য, মানে কেন কী করে এসব আর কী বুঝবেন? কিন্তু কী হয়েছে, আর তার সম্ভাব্য ফলাফল কী কী হতে পারে সেটা নিজেও বুঝেছেন, ক্যাবলাকান্ত লোকটাকেও বুঝিয়েছেন। নইলে হাঁউমাউ করে পাড়া জানিয়ে একাকার করত। কিন্তু সন্ধ্যাদেবীর পাকা মাথা, পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, কী করে হল পরে ভাববে, কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে কেটে বাদ দিয়ে আসবে।

রঞ্জিতবাবু মিনমিন করে বলতে গেছিলেন, “আবার গজায় যদি?”

এক ঝামটা খেয়েছেন, “আবার গজালে আবার যাবে। যতবার গজাবে ততবার যাবে।”

“ততবার যাব? যদি রোজ গজায় রোজ যাব?”

“না তো কী! বলি নিজের দাড়ি রোজ কাটো না?”

রঞ্জিতবাবু হতভম্ব গলায় বলেন, “দাড়ি আর শিং এক হল?”

“এক না তো কী? রামছাগলের দুটোই থাকে দেখনি!”

এরকম গোলমেলে যুক্তির পর রঞ্জিতবাবু কোনদিনই কিছু বলতে পারেন না, আজও পারেননি।

সুতরাং সকালে উঠেই ডাক্তারের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত বহাল রেখে চারজন খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি যে তখন ধরে এসেছে, সে খেয়ালও হয়নি আর কারো।

*****

রাতের দিকেই ধ্যানটা জমে ভাল। জঙ্গলের মধ্যে এই ঢিপিমত জায়গাটায় ছাউনির নিচে আসন পেতে রোজই বসেন মহিম সন্ন্যাসী। আজও পিঠ সোজা করে, চোখ বুজে সুখাসনে বসে ছিলেন। জটাজূট কিছু নেই অবশ্য, বড্ড মাথা কুটকুট করে বলে ওসব ফেলে দিয়েছেন। ঘন চাঁচড় কেশ টেনেটুনে ছোট করে একটা পনিটেল রেখেছেন তার বদলে। আর একমুখ কাঁচা পাকা দাড়িগোঁফ। অন্ধকারে কালো আলখাল্লা পরা সিড়িঙ্গে শরীরটা ভূতুড়ে দেখতে লাগছিলো। তার থেকে ঠিক সাত হাত দূরে সজনে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে, একজন সেই ধ্যানমূর্তির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল। কি করে এমন নিবাত নিকম্প বসে আছেন কে জানে, এই ঝুরঝুপুসি জঙ্গলে মশা কম! তবে মহিম সন্ন্যাসীর শরীর যেমন পাকানো, চামড়াও বোধহয় তেমনি পুরুষ্টু। মশারা শান্তাপিসির গুণছুঁচ নিয়ে এলেও সুবিধে করতে পারবে না। তার ওপর জড়িবুটি দিয়ে বানানো যা দুর্গন্ধ চটচটে তেল মাখেন সারা গায়ে, গন্ধেই মশারা অজ্ঞান হয়ে যাবে।

মশা কেন, ও নিজেও তো এত দূর থেকে গন্ধ পাচ্ছে। এই যে এতক্ষণ ধরে সন্ন্যাসীকে দেখেই যাচ্ছে, দেখেই যাচ্ছে, এর একটা কারণ তো ওই দুর্গন্ধ বটেই। তবে আরেকটা কারণ হল ভয়। সন্ন্যাসীর রাগী বদনাম আছে। মানে, এমনিতে মাটির মানুষ, আর কলকে সেবা করলে তো কথাই নেই, কিন্তু রেগে গেলে বড্ড রেগে যায়। সাঁতরা বাড়ির ছোটকর্তা কিরীটীকুমার সাঁতরা নাকি নাকি স্বচক্ষে মহিম সন্ন্যাসীর নাক দিয়ে আগুন বেরোতে দেখেছে। বেচারা দোষের মধ্যে খালি জিগ্যেস করেছিল বাবাজীর ব্রহ্মলাভের আর কত দেরি! তাতেই ইনি এমন ক্ষেপে তাড়া করলেন যে তার পরের আসল বক্তব্যটা, মানে ব্যাপারটা হয়ে গেলেই যে সাঁতরারা এখানে  একটা মন্দির বানিয়ে দিতে চায়, সে আর বলার সুযোগই পাওয়া গেল না।

পরে অবশ্য রাগ-টাগ পড়লে, আর চ্যালা মিহিজামানন্দের মধ্যস্থতায় মিটমাট হলে পর সেসব কথাবার্তা হয়ে গেছে। তবু, নাক দিয়ে আগুন বেরোনো রাগ কি মুখের কথা!

কিন্তু গরজ বড় বালাই। বিপদটা ঘটেছে কখন কে জানে, টের পেয়েছে এই ঘন্টা দুই হবে। সন্ধেটা নামতেই রামাই ফিরে এসেছে খেলার মাঠ থেকে যেমন রোজ আসে, তাকে ঘরে ঢুকিয়ে দেখে সর্বনাশটি সমুৎপন্ন হইয়াছে।

প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছিল। সত্যি সত্যি এটা  কী করে হতে পারে কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না। মাঠে অন্য দুষ্টুগুলোর সঙ্গে মারামারি করার ফলে ভেবেছিল প্রথমে। কিন্তু চেহারায় তেমন কোনই লক্ষণ নেই, আর সেটা হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত তো! এ যা হয়েছে,  এমন কিছু হবার কথা নয়। কখনোই নয়। কিন্তু হয়ে বসে আছে এও তো কথা! খানিকক্ষণ ভেবলে বসে থাকার পর, যা থাকে কপালে বলে রামাইকে সঙ্গে নিয়ে গুটি গুটি এসে হাজির হয়েছে এই আখড়ায়। কেউ যদি এর সুরাহা করতে পারে, তো সে মহিম সন্ন্যাসীই।

“সন্নেসী ঠাকুর! ও সন্নেসী ঠাকুর! শুনছেন? বড় বিপদে পড়ে এয়েচি বাবা!”

মহিম সন্ন্যাসী চোখ খুলে প্রথমে খুঁজেই পাচ্ছিলেন না কে ডাকছে! পাবার কথাও না, কারণ ডাকটা আসছিল তাঁর পিছন থেকে, যাতে চটে গিয়ে নাক দিয়ে আগুন বের করলেও গায়ে ছ্যাঁকা না লাগে। তা দুবার এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরানোর পর বুঝতে পারলেন এটি খেলার মাঠের পাশের একতলা পুরনো বাড়িটার বুড়িমাসি। কোন কালে ডাকনাম ছিল বুড়ি, এখন সত্যিকারের পুরো পাকামাথা বুড়ি হয়ে গেলেও ওই নামেই ডাকে সবাই। একা বিধবা মানুষ, কটা হাঁস আর একটা ছাগল নিয়ে নিরিবিলি নিজের মত থাকে। তার আবার কি এমন বিপদ হল যে এই রাত্রে ছুটে আসতে হল! সঙ্গে আবার ছাগলটাকেও এনেছে দেখছি!

“অ বাবা, বিপদ বল বিপদ, মুশকিল বল মুশকিল! এতখানি বয়েসে এমন অসৈরণ কক্ষণো দেখিনি গো বাবা!”

“আহা খুলে বল বাপু। এ তো কিছু বুঝছি না!”

তা, খুলে বলার পর, সবটা বুঝতে মহিম সন্ন্যাসীর খুব বেশিক্ষণ লাগল না। বুড়িমাসির ভয় পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক, সকালে মাঠে ছেড়ে এসেছিল নধর শিঙেল ছাগল, আর সন্ধেতে ঘরে তুলতে গিয়ে যদি দেখে সে পুরুষ্টু শিং বেবাক গায়েব, ল্যাপাপোঁছা মাথা, তো সেটা ভূতুড়ে কাণ্ড মনে হতেই পারে! তবে কিনা মহিম সন্ন্যাসী কি থেকে কি করে এমনটা হয়েছে সেটাও খুব অনায়াসে বুঝে ফেললেন – অবশ্য না বুঝলেই আশ্চর্য হত, কারণ কীর্তিটা তাঁর নিজেরই।

হয়েছিল কঘ, আজ দুপুরে সাঁতরাবাড়ি থেকে জব্বর দুই জামবাটি ভর্তি ফু্লকপি-শিম-বড়ির ঝোল আর কাতলার কালিয়া দিয়ে গেছিল। ফলে ডাবল ভাত খেয়ে ফেলে, অবেলা অবধি ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়ে উঠে দেখেন নাক দিয়ে কাঁচা জল গড়াচ্ছে আর মুহূর্মুহু হাঁচি হচ্ছে। তাই নিয়েই সান্ধ্য প্রকরণ সারতে বসেছিলেন। বেশ খানিক পরে হুঁশ হলো যে তিনি হাঁচির ফাঁকে ফাঁকে “উচ্চন্ডবিনিময়” আর “সাঙ্গপাঙ্গউপাঙ্গ” এই দুই মহামন্ত্র ঘেঁটে ঘন্ট পাকিয়ে দিয়েছেন, এটার দু’লাইন বলছেন তো ওটার মাঝের তিন লাইন। বোঝামাত্র সব থামিয়ে শশব্যস্ত উঠে পড়েছিলেন, কিন্তু এবার বোঝাই যাচ্ছে ততক্ষণে ওলটপালট যা হবার হয়ে গেছে। কে জানে ধারে কাছে কার মাথায় গিয়ে শিংজোড়া আটকে গেছে!

তবে, ঘাবড়ালেন না একটুও। সন্ন্যাসী তো আর এমনি এমনি হননি, সাধনা টাধনাও করেছেন বিস্তর। মিহিজামানন্দকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে, বইপত্র ঘেঁটে, খানিক কাটাকুটি করে ‘বিপরীত জগাখিচুড়ি কাটান মন্ত্র’ বানাতে বেশি সময় লাগল না। মন্ত্রটা যে কাজ করল, সে তো চোখের সামনেই রামাইয়ের মাথায় দেখতে পেলেন!

দেখতে সন্ধ্যাদেবীও পেয়েছিলেন অবশ্য পরদিন। সকালটা যে এত সুন্দর হতে পারে ভুলতে বসেছিলেন তিনি। একে ঐ হাড়জ্বালানি বৃষ্টি থেমেছে, তার চেয়েও বড় কথা তুলির মাথার শিং ভ্যানিশ হয়ে গেছে। নিজেনিজেই। সবাই মিলে খুব করে হাতড়ে দেখেছেন, এক ফোঁটাও শিং নেই আর তুলির মাথায়। যেমন আপনি এসেছিল, তেমন আপনি চলে গেছে। রহস্য!

“তোমায় আর রহস্য নিয়ে ভেবে ভেবে নিজের মাথায় টাক ফেলতে হবে নাকো! গেছে। আপদ গেছে। এবার চৌবাচ্চায় সাবান গুলে ছাড়া কাপড়্গুলো ভিজিয়ে দিয়ে আমায় উদ্ধার করো দিকি!”

পরম পরিতৃপ্তিতে এই ঝংকার দিয়ে সন্ধ্যাদেবী রান্নাঘরে চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ মাথা চুলকেছিলেন রঞ্জিতবাবু।

*****

অবিকল একই ঢং এ এখন মাথা চুলকোচ্ছিল মিহিজামানন্দও। সন্ন্যাসীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, আগামীকালই দুজোড়া হাঁসের ডিম বাবাজির চরণে ভেট দিয়ে যাবে সেই কথা দিয়ে, গদগদচিত্তে বুড়িমাসি তার ছাগল আর ছাগলের শিং নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেবার পর।

বেশ একটা সার্থকতার তৃপ্ত হাসি নিয়ে বসে বসে তাদের যাওয়া দেখছিলেন মহিম সন্ন্যাসী, তারার আলোয় তাঁর মাথাজোড়া টাক ঝিলিক দিচ্ছিল।

আর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে, অনভ্যস্ত পনিটেল চু্লকোতে চুলকোতে মিহিজামানন্দ ভাবছিল, হাঁসের ডিমের ঝোল রাঁধবে না কালিয়া!

ছবি মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

3 thoughts on “গল্প ওলটপালট অনুষ্টুপ শেঠ বর্ষা ২০১৮

  1. আমার ১২ বছরের ছেলে গপ্প পড়তে পড়তেই খিচুড়িতে কাফ সিরাপের গন্ধ পাচ্ছিল। এখন রেঁধে দেখবে বলছে।গল্প আমাদের সবারই খুব পছন্দ হয়েছে।

    Liked by 1 person

  2. আহা ! ছোটবেলাটা যেন চোখের সামনে উল্টো-পাল্টে এলো…

    Like

Leave a comment