বৈজ্ঞানিকের দপ্তর গ্রহের ফের ঋজু গাঙ্গুলী বর্ষা ২০১৭

ঋজু গাঙ্গুলির আগের লেখা কিং সলোমন্‌স্‌ মাইন্‌স্‌

কলিং বেলের কাছে আঙুলটা নিতে গিয়েই খটকা লাগল।

শনিবারের রাত, দরজার বাইরে বাহারি জুতো আর চটির একটা ছোটোখাটো স্তূপ।

কিন্তু সব এত চুপচাপ কেন?

দরজা খোলার পর ভেতরে একঝলক তাকিয়েই বুঝলাম, আমার আশঙ্কা সত্যি। টিভিটা বন্ধ, সোফায় চৌকো বা কাত হয়ে রয়েছে মেঘনা, মধুরিমা, তোষালি, অনুমিতা, আর আমার বউ। রান্নাঘরে জয়া খুটুরখাটুর করছে ঠিকই, তবে এছাড়া ফ্ল্যাটে কোনো আওয়াজ নেই।

ব্যাপার সিরিয়াস!

আমার দিকে তাকিয়ে প্রথম মুখ খুলল অনুমিতা, “আচ্ছা ঋজুদাদা, এই উত্তর-দক্ষিণ উলটে যাওয়ার ব্যাপারটা যখন হবে, তখন দিন-রাত কি এখনকার মতো করেই হবে, না কি পৃথিবীর ঘোরাও থেমে যাবে?”

লোকে বলে, ষোলো বছরের সরকারি চাকরি আর সাড়ে তেরো বছরের বিবাহিত জীবনের পর আমি নাকি কিছুতেই অবাক হই না। ওসব কথায় একদম কান দেবেননা, কারণ অনুমিতা-র এই কথাটা শুনে আমি জুতো খোলা ভুলে হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“অনু পোলার শিফটের কথা বলছে, ভাইদা”, একটু প্রাঞ্জল করে বলে মধুরিমা, “মানে পৃথিবীর উত্তর আর দক্ষিণ মেরু তো এবার পালটে যাবে, তাই না?”

“এই শিফট-টাই কি বছর চারেক আগে হওয়ার কথা ছিল? মানে, সেই যে মায়া ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০১২-র পর আর কিছু নেই…” হালকা করে বলে তোষালি।

“পৃথিবী ওলটপালট হতে চলল, আর তুমি কিচ্ছু জাননা!”, রীতিমতো হতাশ গলায় বলেন শ্রীমতী।

আমাকে ভেবলে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে মেঘনা কিছু আন্দাজ করে। ওর এনে দেওয়া জলের বোতলের প্রায় অর্ধেকটা খালি করে মাথাটা ঠান্ডা হয়।

একটা চেয়ার টেনে গুছিয়ে বসি আমি।

শনিবারের সন্ধেয় আমাদের ফ্ল্যাটে যে আড্ডাটা বসে, তার সঙ্গে ইতিমধ্যেই আপনারা পরিচিত হয়েছেন। এই ‘শনিচক্র’-য় আজকের সংযোজন অনুমিতা, যে সচরাচর অন্য দিনে মেঘনাকে গান শেখাতে এলেও আড্ডার টানে নিজের রুটিন বদলেছে ইদানিং। বুঝলাম, আজকেও এই আড্ডার সদস্যরা লেটেস্ট ব্লকবাস্টারের তুলনামূলক বিশ্লেষণ, বা ঠিক কোন মাসে গ্যাংটক/পুরী/গোয়া/কোচি বেড়াতে যাওয়া উচিৎ সেই নিয়ে আলোচনা না করে একটি আক্ষরিক অর্থে হেভি-ডিউটি বিষয় বেছেছেন। এও বুঝলাম, সদ্য কেনা পত্রিকার ‘ভূত’ সংখ্যাটা হাতে নিয়ে সোফায় কাত হওয়ার পরিকল্পনাটি আপাতত মুলতুবি রাখাই শ্রেয়।

ঘড়ির দিকে একবার সতৃষ্ণ নয়নে চাইলাম। রাত পৌনে আটটার সময়ে চা চাওয়াটা নিতান্তই বিপজ্জনক, তবে এই মুহূর্তে আমি ভিআইপি। ‘শোলে’-তে ঠাকুরের কথা অনুযায়ী লোহা গরম থাকাকালীন হাতুড়ি মেরে দেওয়ার ফল পাওয়া গেল। বেটার হাফ রান্নাঘরের উদ্দেশে হাঁক পেড়ে জয়াকে আমার জন্য এক মগ চা করতে বললেন। নিশ্চিন্ত হয়ে আমি কথা শুরু করলাম।

“প্রথমেই একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার। ‘পোলার শিফট’, অর্থাৎ একটা গ্রহের ভৌগোলিক উত্তর ও দক্ষিণ মেরু জায়গা বদল করার ঘটনা এখনও অবধি সৌরজগতের ইতিহাসেই ঘটেছে মাত্র কয়েকবার ঘটেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও অবধি এটা ঘটেইনি”।

সবাইকে উশখুশ করে উঠতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি বলে চললাম, “পৃথিবীর ইতিহাসে যেটা হয়েছে সেটা নিয়ে পরে বলছি। আগে এই উত্তর-দক্ষিণ পালটে যাওয়ার ব্যাপারটা খোলসা করা দরকার।

“পোলার শিফট-এর দুটো উদাহরণ আমাদের সৌরজগতে দেখা যায়। প্রথমটা দেখা যায় ভেনাস বা শুক্রগ্রহ-র ক্ষেত্রে। এই গ্রহ নিজের অক্ষ বা অ্যাক্সিস-এর চারপাশে যে অভিমুখে ঘোরে, সেটা সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের ঘূর্ণনের বিপরীত। এটার অনেক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তবে নিতান্তই আজগুবি থিওরিগুলো ঝেড়ে ফেললে এর একটাই সন্তোষজনক কারণ পাওয়া যায়, আর সেটা হল: কোনো একটি বিশাল বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষে শুক্র পুরো উলটে গিয়ে হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে যায়। পোলার শিফটের দ্বিতীয় উদাহরণ হল ইউরেনাস, যার ঘূর্ণন অক্ষ বরাবর সোজাসুজি না হয়ে পাশাপাশি হয়। এক্ষেত্রেও কোনো সংঘর্ষ তার এই অবস্থার জন্য দায়ী হতে পারে; অথবা সৌরজগতের দুই বড়ো ‘দাদা’ বৃহস্পতি বা জুপিটার, আর শনি বা স্যাটার্নের মধ্যে অভিকর্ষগত টানাপোড়েনের ফলেও এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কারণ যাই হোক না কেন, এই দুই গ্রহে প্রাণ যদি তার আগে থেকেও থাকে, সেসব যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল এর ফলে, তাই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

কিন্তু”… আবার ঘর জুড়ে প্রবল উশখুশ শুরু হতে দেখে আমি একটা ঢোঁক গিলেই গলা ভেজালাম, আর হুড়মুড়িয়ে বলে চললাম।

“পৃথিবীর ক্ষেত্রে এমন কিছু হতে পারে, এটা অনেক দিন ধরে বলা হয়ে আসছে। সত্যি বলতে কী, ডুমসডেয়ার বা ধ্বংস তথা প্রলয়ের প্রেডিকশন করে বাজার গরম করা লোকেদের খুব ফেভারিট একটা থিওরি হল এই পোলার শিফট। এদের প্রায় সব ফান্ডার উৎস হল চার্লস এইচ হ্যাপগুড-এর একদা বেস্টসেলার “পাথ অফ দ্য পোল”। এই বইয়ে হ্যাপগুড বিভিন্ন পুরোনো মানচিত্র, আন্টার্কটিকার পুরোনো চেহারা নিয়ে প্রকাশিত নানা তত্ত্ব, আর কিছু-কিছু ভৌগোলিক তথ্যের ভিত্তিতে ‘দাবি’ করেন যে পৃথিবীর ভৌগোলিক উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বেশ কয়েকবার জায়গা বদল করেছে, এমনকি পৃথিবীর উপরিভাগ বা ক্রাস্ট কেন্দ্রীয় কোরে ডুবে গেছে ও কোর থেকে নতুন ক্রাস্ট তৈরি হয়েছে! এই থিওরি, আর সঙ্গে প্ল্যানেট এক্স, মানে সৌরজগতের তথাকথিত আপাত অদৃশ্য দশম গ্রহ-র সূর্যের কাছে আসার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে বিভিন্ন গাঁজাখুরি থিওরি মিশিয়ে ডুমসডেয়ার-রা এইসব হাবিজাবি কথা রটিয়েছে। যেহেতু মায়া ক্যালেন্ডার ২০১২-র পর আর এগোয়নি, তাই এরা হালে কিছুটা পানি পেয়েছিল।

তবে এই থিওরিগুলো এখন, যাকে বলে, থরোলি ডিসক্রেডিটেড হয়ে গেছে। এখন আমরা সমুদ্রতলের বিভিন্ন জায়গার ম্যাগনেটিক ফিল্ড পর্যবেক্ষণ করে এটা বুঝেছি যে পৃথিবীর উপরিভাগ বা ক্রাস্টের বিভিন্ন অংশ নড়াচড়া করে। গন্ডোয়ানাল্যান্ড আর আঙ্গারাল্যান্ডের সংঘাতে হিমালয় তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা তো প্লেট টেকটনিক্স-এর উদাহরণ হিসেবে পাঠ্য বইয়েই আছে। এটাও মাথায় রাখা উচিৎ যে ভারতের এই ‘উত্তরায়ন’ এখনও চলছে, তবে বছরে ইঞ্চিখানেক করে। তাই ভৌগোলিক মেরু বা পোল উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে যাওয়ার কথাগুলো স্রেফ গুল”।

তোষালি প্রশ্ন তোলে, “পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথাগুলো বলে লোকের কী লাভ হয়?”

আমি বলি, “মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটা পাঁঠা ছিল”।

আমার বউ বিরক্ত হয়ে বলে, “একটা সিরিয়াস প্রসঙ্গেও তোমায় ইয়ার্কি মারতেই হবে?”

আমি বলি, “শোনো না। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটা পাঁঠা ছিল। তার বন্ধু আর পড়শিদের ওই পাঁঠাটার ওপর অনেকদিন ধরে নজর ছিল। তা তারা একদিন, বেশ আনুষ্ঠানিক জাব্বাজোব্বা পরে নাসিরুদ্দিনের বাড়ি গিয়ে বলল, ‘বড়ো খারাপ খবর শুনলাম মোল্লাসাহেব। পৃথিবী নাকি কাল ধ্বংস হয়ে যাবে’।

নাসিরুদ্দিন বলল, ‘পাঁঠাটাকেও তাহলে ধ্বংস করা যাক’।

পাঁঠার মাংস খেয়ে সবাই ভারী জামাকাপড় খুলে একেবারে ঘরোয়া পোশাকে আরামসে ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে দেখে, তাদের দামি-দামি জামাকাপড় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। নাসিরুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, ‘পৃথিবীই যখন ধ্বংস হয়ে যাবে, তখন ওইসব জামাকাপড় রেখে কী লাভ? তাই আমি সেগুলোকেও ধ্বংস করে দিয়েছি’।

মোদ্দা কথা হল, এই ডুমসডে বা কেয়ামত সমাসন্ন হওয়ার কথাটা বাজারে ছড়ালে অনেক লোক ফাঁকতালে প্রচুর লাভ করতে পারে। হলিউডের কথাই ভাবো। ‘দ্য কোর’ নামক টোটাল ভুলভাল জিনিসে ভর্তি সিনেমাটাও বাজারে চলল স্রেফ লোকের এই ভয়ের কাঁধে ভর দিয়ে যে পৃথিবীর নিজের অক্ষ বরাবর ঘূর্ণন থেমে গেলে কী হবে! আর 2012-র কথা তো আমরা সবাই জানি”।

মেঘনা এবার মুগ্ধ কন্ঠে যোগ দেয়, “কী ভালো ছিল মুভিটা”।

সিনেমাটার পিন্ডি চটকাতে উদ্যত হচ্ছিলাম, কিন্তু অনুমিতা আলোচনাটা মূল প্রসঙ্গে ফিরিয়ে আনে, “তাহলে এই উত্তর-দক্ষিণ নিয়ে কথাগুলো এখন আবার উঠছে কেন?”

আমি বলি, “কথাটা উঠছে জিওম্যাগনেটিক রিভার্সাল নিয়ে”।

স্রোতাদের মুখচোখ দেখে বুঝি, আমি চিনা বা রাশিয়ান ভাষায় কিছু বলে ফেললেও এই প্রতিক্রিয়াই হত। ইতিমধ্যে চা এসেছে, এবং অর্ধেক উড়েও গেছে। বাকিটা সযত্নে লালন করার ফাঁকে আমি বলি, “পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ে তোমরা কিছু জান?”

সবাই এত জোরে মুন্ডু হেলাতে লাগল, যে আমার ভয় হল, মাথাগুলো কাঁধ থেকে না খুলে পড়ে যায়।

আমি কাজ কমানোর আশায় বললাম, “আচ্ছা বেশ। কোনো জিনিস ম্যাগনেটিক বা চৌম্বকীয় কেন হয়, মানে চুম্বক ঠিক কেন ওইরকম ভাবে আচরণ করে, সেটা নিশ্চই তোমরা জান?”

এবারো প্রতিক্রিয়া একই রকম দেখে আমি এত জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম যে সামনের সেন্টার টেবিলে রাখা ডিসকাউন্ট কুপন সম্বলিত কয়েকটা বিউটি পার্লারের হ্যান্ডবিল উড়ে গেল। সমবেত “হায়-হায়” থামলে, আর সেইসব অমূল্য নিধি যথাস্থানে ফেরত এলে আমি শুরু করলাম।

“কয়েক সহস্রাব্দী বা মিলেনিয়াম আগেই মানুষ এটা দেখে যে লোডস্টোন, মানে প্রকৃতিতে পাওয়া চুম্বক, যা আসলে প্রাকৃতিকভাবেই চুম্বকে পরিণত হওয়া একধরনের লৌহ-আকরিক ম্যাগনেটাইট মাত্র, লোহাকে আকৃষ্ট করতে পারে। গ্রিসের ম্যাগনেশিয়া অঞ্চলে পাওয়া যাওয়া এই ধরনের পাথর, বা ম্যাগনিটিস লিথোস থেকেই ম্যাগনেট কথাটা এসেছে।

অ্যারিস্টোটল চুম্বক ও চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, মানে ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার সূত্রপাত করলেও এখানে ভারতের একটা ছোট্ট অবদানের কথাও বলতেই হয়: সুশ্রুত শল্যচিকিৎসার কাজে চুম্বক ব্যবহার করেছিলেন বলে মনে করা হয়। এরপর ম্যাগনেটিজম নিয়ে প্রচুর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা হয় চিন-এ। দশম শতাব্দীতে চিনা বিজ্ঞানী শেন কুও তাঁর একটি প্রবন্ধে ম্যাগনেটিক নিডল-কে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলেন, যাতে ভৌগোলিক উত্তর মেরু আরো নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই চিনা জাহাজে লোডস্টোন কম্পাস ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যেখানে একটি চামচের আকারের লোডস্টোন সবসময়েই দক্ষিণ দিকে মুখ করে ঝুলে থাকত।

দ্বাদশ শতাব্দীতে আলেক্সান্ডার নেক্যাম, এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পিটার মারিকোর্ট ও ইয়েমেনের বৈজ্ঞানিক আল-আশরফ-এর মাধ্যমে ম্যাগনেটিজম নিয়ে চর্চা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম গিলবার্ট প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত কাজ ‘অন দ্য ম্যাগনেট অ্যান্ড ম্যাগনেটিক বডিজ, অ্যান্ড অন দ্য গ্রেট ম্যাগনেট দ্যাট ইজ আর্থ’। এই বইয়ে গিলবার্ট ‘টেরেল্লা’ নামে পৃথিবীর একটি মডেল বানিয়ে বুঝতে পারা বেশ কিছু জিনিস লেখেন, এবং তাঁর এই বইয়েই প্রথম, একেবারে স্পষ্টভাবে, বলা হয় যে পৃথিবী নিজেই একটি চুম্বক, আর সেজন্যই কম্পাসের সূচ উত্তর দিকে মুখ করে থাকে। এটা এজন্যেই উল্লেখযোগ্য যে এর আগে লোকের ধারণা ছিল, ধ্রুব তারা বা পোলারিস-এর আকর্ষণে কম্পাস উত্তরমুখী হয়। কেউ তো এমনও ভাবতেন যে উত্তর মেরুতে একটা বিশাল চুম্বকীয় ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বীপ আছে বলেই লোডস্টোন এমন আচরণ করে!

উনিশ শতকের ইউরোপে একের পর এক দিকপাল বিজ্ঞানীর কাজের মাধ্যমে ম্যাগনেটিজম নিয়ে আমাদের ধারণাটা আরেকটু স্পষ্ট হয়। ওরস্টেড দেখান যে তড়িৎ প্রবাহিত হলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। এরপর অ্যাম্পিয়ার, গস, বায়োট ও স্যাভার্ট, এবং মাইকেল ফ্যারাডে তাঁদের কাজের মাধ্যমে একেবারে প্রমাণ করে দেন যে তড়িৎ বা ইলেকট্রিসিটি আর চুম্বকীয় বল বা ম্যাগনেটিজম আসলে একই শক্তির রকমফের মাত্র, যা শেষ অবধি জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের হাতে সূত্র আর সমীকরণের বাঁধনে ধরা পড়ে। এরপর আসেন আইনস্টাইন তাঁর স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি নিয়ে। এসবের প্রভাবে তড়িৎ-চুম্বকীয় বল, মানে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের শুধু স্বভাব নয়, উৎস বিষয়েও আমরা বেশ কিছু জিনিস জানতে পারি”।

আলোচনাটা ভারী হয়ে যাচ্ছে বুঝে, এবং চনমনে চোখগুলো ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে দেখে ইতিমধ্যে গৃহকর্ত্রী ফিল্ডে নেমেছিলেন। ফলে, নিতান্তই অসময় হওয়া সত্বেও ধূমায়মান পকোড়ায় ভরা একটা ডিশ সামনে আবির্ভূত হল। কিছুক্ষণের হুশ-হাশ-‘কী গরম’-‘এত ঝাল কেন’ শেষ হলে, আক্ষরিক অর্থে ফর্টিফায়েড হয়ে, আমি আবার শুরু করি।

“যেকোনো পদার্থ যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি, তাদের অণু-পরমাণু এসব নামে আমরা জানি। একটি মৌলের পরমাণুর চেহারা কেমন সেটা বুঝতে গেলে সৌরজগতের ছবিটাই আমাদের সামনে ভাসে, যেখানে সূর্যের মতো কেন্দ্রে আছে নিউট্রন-প্রোটন ঠাসা নিউক্লিয়াস, আর তার চারপাশে গ্রহের মতো নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরপাক খাচ্ছে ইলেকট্রনের ঝাঁক। এখন যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্স এসে এই মডেলকে একেবারে বাতিল করে দিয়েছে, তবে বোঝার সুবিধার্থে আমরা এটা দিয়েই শুরু করি।

এই সব সাব-অ্যাটমিক পার্টিকল, মানে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন নিজের নিজের অক্ষের চারপাশে ঘুরপাক খায় মূলত তাদের চারপাশে চলতে থাকা নানারকম আকর্ষণ-বিকর্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। চার্জের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় নিউট্রন আর পজিটিভ চার্জ বহনকারী প্রোটনে ঠাসা নিউক্লিয়াস ভীষণ ভারী, আর স্থায়ী। সেখানে এই ঘূর্ণনের ফলে আশেপাশে তেমন একটা তড়িচ্চুম্বকীয় প্রভাব পড়েনা। ইলেকট্রনগুলো নিজের অক্ষের ওপর ঘুরপাক খেলে একটা বল তৈরি হয় বটে, তবে সেটাও আমরা যা নিয়ে গ্যাঁজাচ্ছি তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হল নিউক্লিয়াসের চারদিকে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন বা অরবিট্যাল মোশন”।

“ধুর! এইসব জিনিস তো ক্লাসে পড়ানো হয়। তুমি বলো, পৃথিবীতে ঠিক কী হচ্ছে, যা নিয়ে লোকে এতসব কথা বলছে”, বিরক্ত কন্ঠে বলে মধুরিমা।

“ঠিক বলেছিস”, গলা মেলায় অনুমিতা, “এসব শুনলেই আমার গায়ে জ্বর আসে। তুমি এই পড়াশোনার জিনিসগুলো বাদ দিয়ে বলো তো”।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর ক্লাস নাইন-টেনের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি মনে-মনে প্রভূত শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি জানিয়ে, আবার শুরু করি।

“মোদ্দা কথা হল, সাধারণ অবস্থায় একটা পদার্থের অণুতে ইলেকট্রনগুলো এমনভাবে থাকে, যাতে তাদের নিজের টানাপোড়েন একে-অপরকে কেটেকুটে দেয়, ফলে বস্তুটা স্থায়ী থাকে। মানে, তোদের একজন যদি আরেকজনের হাত শক্ত করে ধরে বনবনিয়ে ঘুরপাক খাস তাহলে হাতে টান পড়লেও যেমন কেউই ছিটকে পড়বিনা, তেমন করেই পদার্থের ভেতরে ইলেকট্রনের ঘোরাঘুরি সত্বেও জিনিসটা ঠিকঠাক থাকে। কিন্তু…

একটা শক্তিশালী ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের মধ্যে পড়লে একটা পদার্থের ইলেকট্রনগুলো এমনভাবে যুদ্ধ করতে চলা সৈন্যবাহিনীর মতো লাইন দিয়ে দাঁড়ায় যে তাদের মধ্যে একটা নেট পজিটিভ-নেগেটিভ, তথা উচ্চ শক্তিস্তরের নর্থ আর নিম্ন শক্তিস্তরের সাউথ ব্যাপার তৈরি হয়। এটাই হল ম্যাগনেটিক ডাইপোল, আর এই জিনিসটা হলেই সেই বস্তুর মধ্যে চুম্বকের ধর্ম দেখা যায়”।

“সব কিছুই কি এরকম ভাবে চুম্বক হয়ে উঠতে পারে?”, জানতে চায় তোষালি।

“নাঃ”, আমি বলি, “একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ডে একটা বস্তু ঠিক কেমন আচরণ করে তার ভিত্তিতে তাকে প্যারাম্যাগনেটিক, ফেরোম্যাগনেটিক, অ্যান্টিফেরোম্যাগনেটিক, ফেরিম্যাগনেটিক, এমন আরো নানা গোত্রে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে যারা ফেরোম্যাগনেটিক, তাদের মধ্যেই চুম্বক বেশি পাওয়া যায়। লোডস্টোন মানেই তো চুম্বক হয়ে যাওয়া ম্যাগনেটাইট, যা ফেরোম্যাগনেটিক পদার্থের সেরা নমুনা”।

“আচ্ছা বাবা”, এবার মেঘনা যোগ দেয় আলোচনায়, “ম্যাগনেটাইট মানেই কি তাহলে ম্যাগনেট?”

“না-না!”, আমি আঁতকে উঠি, “পৃথিবীতে যত ম্যাগনেটাইট পাওয়া যায়, তার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশই চুম্বকের মতো আচরণ করে”।

“কেন?”, প্রশ্নটা সমস্বরে উড়ে আসে।

শ্রোতাদের মনোযোগ ফিরে পাওয়া গেছে বুঝে, কিঞ্চিৎ আত্মপ্রসাদ অনুভব করেই বলি, “নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ডক্টর পিটার ওয়াসিলিউস্কি রীতিমতো হাতে-কলমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে একটা বিশেষ ধরণের ক্রিস্টালাইন গঠন হলে তবেই ম্যাগনেটাইটের কোনো একটা নমুনা চুম্বকে পরিণত হতে পারে। কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়, কারণ পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডে সেরকম নমুনা ফেলে রেখেও দেখা গেছে যে তাতে কোনো রকম চৌম্বকীয় ক্ষমতা-টমতা তৈরি হয়না। গিলবার্ট সেই পাঁচশো বছর আগেই একটা গির্জার মাথায় বসানো লোহার চুম্বক হয়ে যাওয়ার কথা লিখে গেছিলেন। নিউ মেক্সিকোর ল্যাংমুর ল্যাবরেটরি, যেটা বজ্রপাত নিয়ে গবেষণার প্রধান কেন্দ্র, তাতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে গিলবার্টের পর্যবেক্ষণ সঠিক ছিল। অর্থাৎ বজ্রপাতের মতো কিছু হলে, মানে খুব অল্প সময়ের জন্য খুব বেশি মাত্রার তড়িচ্চুম্বকীয় বল কোনো ফেরোম্যাগনেটিক জিনিসের ওপর কার্যকরী হলে তা ম্যাগনেট হয়ে যেতে পারে।

যেমন, চাল-ঘি-মাংস নিয়ে সবাই ঘাম ঝড়ায়, কিন্তু আমার বউ হাত লাগালে তবেই সেগুলো বিরিয়ানি হয়ে ওঠে”।

ভবি ভুলল না। সোফা থেকে আওয়াজ ভেসে এল, “এখন আর চা না। আমাদের প্রশ্নের উত্তর দাও শিগগির”।

বেজার মুখে “সংসার অসার” গোছের মন্তব্য করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু মেঘনা আবার প্রশ্ন তুলল, “তাহলে পৃথিবী ম্যাগনেট হল কীভাবে?”

“হ্যাঁ, এটাই হল আসল ব্যাপার”, বলে আমি গুছিয়ে বসি। আশেপাশে যে শরীরগুলো ক্রমেই ভার্টিকাল থেকে হরাইজন্টাল হয়ে পড়ছিল, সেগুলোও নড়েচড়ে ওঠে।

“পৃথিবীর উপরিভাগ, মানে সমুদ্র-মহাদেশ এসব যাতে থাকে সেই ক্রাস্ট থেকে, ম্যান্টল হয়ে, আমরা যখন ক্রমশ ভেতরে ঢুকতে থাকি, তখন, মোটামুটি দু’হাজার মাইল ভেতরে গেলে যা পাওয়া যাবে তা হল একটা তরল জায়গা, যেটাকে লিকুইড কোর বলা চলে। কিন্তু জলের বদলে এই অংশটায় আছে সাংঘাতিক গরম তরল লোহা, সঙ্গে কিছু সালফার আর নিকেল। এর থেকেও ভেতরে গেলে পাওয়া যাবে একটা নিরেট কেন্দ্রীয় জায়গা, বা সলিড কোর।

লিকুইড কোরে থাকা এই তরল লোহা, যা ফেরোম্যাগনেটিক, এই অংশের তাপ ও চাপ ব্যালেন্স করতে গিয়ে খুব মন্থর গতিতে হলেও ঘুরপাক খেতে থাকে। এই ঘূর্ণনে বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনের বিন্যাস ঘটে তৈরি হয় ইলেকট্রিসিটি বা তড়িৎ। সেই তড়িৎ পৃথিবীর নিজের অক্ষ বরাবর পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘূর্ণনের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৈরি করে এমন একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড, যাকে মাইকেল ফ্যারাডের তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে ব্যাখ্যা করে বলা হয় “ডায়নামো এফেক্ট”।

ঠিক কীভাবে পৃথিবীর এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয় সেটা বোঝার জন্য বিস্তর চেষ্টা হয়েছে। অনেক অংক কষেও এর কোনো মডেল দাঁড় করানো কঠিন হয়েই থেকেছে, কারণ পৃথিবীর ভেতরে, মানে ‘কোর’ অংশে চাপ আর তাপ এমন ভয়ানক যে কোনো মডেলকেই পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য বলা চলেনা। অধুনা মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যান ল্যাথ্রপ এই রহস্যভেদ করার জন্য গিলবার্টের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। তিনি দশ ফুট ব্যাসের একটা ধাতব গোলকের ভেতরে গলন্ত সোডিয়াম ভরছেন। সোডিয়ামের গলনাঙ্ক ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি হওয়ায় একমাত্র সেটিই ল্যাবরেটরির পর্যবেক্ষণযোগ্য পরিবেশে তরল রাখা যাবে। এই গোলকের মোট ভর হবে ২৬ টন! তারপর এই গোলকটাকে, নিরক্ষরেখার কাছে পৃথিবী যে বেগে ঘোরে সেই ঘন্টায় ৮০ মাইল বেগে ঘোরানো হবে। ল্যাথ্রপ আশা করছেন যে এর ফলে একেবারে নিখুঁতভাবে বোঝা যাবে, পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে ঠিক কেমন করে তৈরি হয় এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড তথা ডায়নামো এফেক্ট।

এই এফেক্ট তথা ফিল্ডের ফলে পৃথিবীর ভেতরে তৈরি হয় এক ঝাঁক ফিল্ড লাইন, যারা পৃথিবী নামক চুম্বকের দ্বারা প্রভাবিত এলাকার সীমারেখা নির্ধারণ করে। এই ফিল্ড লাইনগুলো পৃথিবীর চৌম্বকীয় দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরুতে, যারা যথাক্রমে ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু আর উত্তর মেরুর কাছেই অবস্থিত, ধেয়ে যায়।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, এই ফিল্ড লাইনগুলো শুধুই মাটির মধ্য দিয়ে, বা সমুদ্রতল, এমনকি বায়ুমণ্ডল দিয়ে গেছে তা নয়। এরা বায়ুমণ্ডলের সীমা ছাড়িয়েও ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরুর কাছ থেকে পৃথিবীর বাইরে বহু-বহু দূর অবধি বেরোয়, আর তারপর লম্বা, আরো লম্বা, আরো-আরো লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর মেরুর কাছে এসে ঢুকে পড়ে ভেতরে।

এই ফিল্ড লাইনগুলো দিয়ে যে জায়গাটা মোটামুটি ঢাকা পড়ে, সেটাই হল পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ার, যা পৃথিবীকে নানা মহাজাগতিক রশ্মি আর সূর্যে হওয়া বিশাল আগ্নেয় বিস্ফোরণ ও ঝড়ের ফলে সেখান থেকে পৃথিবীর দিকে হামলে পড়া সোলার উইন্ড বা প্লাজমার আক্রমণ থেকে বাঁচায়। যদি এই প্লাজমা পৃথিবীতে এসে পৌঁছত তাহলে ওজোন স্তর স্রেফ উড়ে যেত, আর তাহলেই গল্প শেষ হয়ে যেত। মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল, এবং সেখানে প্রাণের বিকাশের যাবতীয় সম্ভাবনা এই সোলার উইন্ডের ধাক্কাতেই লোপ পেয়েছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।

পৃথিবীকে বাঁচানোর পাশাপাশি ম্যাগনেটোস্ফিয়ার আরো একটা কাজ করে। সূর্যের করোনা থেকে বেরিয়ে সেকেন্ডে ২০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার অবধি বেগে ছুটে আসা চার্জ-বহনকারী কণাগুলো নিজেদের সঙ্গে করে নিয়ে আসে ইন্টারপ্ল্যানেটারি ম্যাগনেটিক ফিল্ড। পৃথিবীর পৃষ্ঠতল বা সারফেসের সমান্তরাল বরাবর ছুটে চলা ফিল্ড লাইনের ওপর লম্বালম্বি আছড়ে পড়ে এই কণাগুলোর অধিকাংশই আটকে যায়। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর কাছে উত্তরমুখী জিওম্যাগনেটিক ফিল্ডের সঙ্গে যে কণাগুলোর সংঘর্ষ হয়, যদি তাদের ইন্টারপ্ল্যানেটারি ফিল্ডের অভিমুখ তখন দক্ষিণ দিকে থাকে, তাহলে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়। সেই ফাঁক দিয়ে এই কণাগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একেবারে ওপরে আয়নোস্ফিয়ারে ঢুকে পড়ার সুযোগ পায়, আর কণায়-কণায় সংঘর্ষ হয়ে তৈরি হয় অরোরা বা মেরুজ্যোতি! যেহেতু আমাদের বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি আছে নাইট্রোজেন, তাই তা আয়নিত হয়ে তৈরি হওয়া নীল আর বেগুনি রং মেরুজ্যোতিতে সবচেয়ে বেশি হাজির থাকে। তারপরেই থাকে আয়নিত অক্সিজেনের থেকে পাওয়া লাল আর সবুজ।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ম্যাগনেটিক নর্থ আর সাউথ পোল কি জায়গা পাল্টাচ্ছে?

তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন হল, যদি সেই ওলট-পালট হয়ই, তাহলে কী হবে?”

“হ্যাঁ ভাইদা”, বলেওঠে  মধুরিমা, “সেরকম হলে কী-কী হতে পারে?”

“খবরে দেখি সোলার ফ্লেয়ারের ফলে স্যাটেলাইট অকেজো হয়ে গেছে। তাহলে তখনও কি আমাদের সব স্যাটেলাইট অকেজো হয়ে যাবে?”, জানতে চায় তোষালি।

“আচ্ছা, পাখি আর মাছেরা তো পৃথিবীর এই ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে কাজে লাগিয়েই চলাফেরা করে, তাই না? ওদের তখন কী হবে?”, উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে অনুমিতা।

শ্রোতাদের গ্রিপে পাওয়া গেছে বুঝে আমি আবার উৎসাহিত হই। বলি, “তাহলে আগে বুঝতে হবে যে এই চুম্বকীয় উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর জায়গা-বদলটা সত্যিই হয় কি না।

অতীতে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের অভিমুখ কেমন ছিল সেটা বোঝা যায় আগ্নেয়গিরি থেকে বেরোনো ব্যাসল্ট শিলা পর্যবেক্ষণ করে, আর সেটাও সবথেকে ভালো দেখা যায় সমুদ্রের তলায়।

মিড-আটলান্টিক রিফট নামক ভৌগোলিক চ্যূতিরেখাটা ভূতত্ত্ববিদেরা মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন। আসলে ওই রেখার দু’ধারে উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপ ক্রমেই একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে নিচ থেক উঠে আসছে লাভা, যা একটু-একটু করে ঠান্ডা হয়ে ব্যাসল্ট হয়ে যাচ্ছে, আর সেই ব্যাসল্টকে দু’ধারে সরিয়ে দিচ্ছে দুটি বিপরীতমুখী প্লেট। এই জমাট বাঁধা ব্যাসল্টে আছে প্রচুর পরিমাণে ফেরোম্যাগনেটিক পদার্থ, যারা ঠান্ডা হওয়ার সময় পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড অনুযায়ী নিজেদের চুম্বকীয় সত্তাকে সাজিয়ে ফেলছে, আর সঙ্গে নিজের মধ্যে পাকাপোক্তভাবে ধরে ফেলছে এই ফিল্ডের অভিমুখকেও।

এর ফলে, এই ব্যাসল্টের স্তর থেকে যুগ-যুগ ধরে জিওম্যাগনেটিক ফিল্ডের অভিমুখ কেমন ছিল, তা বোঝা যায়। আর সেটা দেখতে গিয়েই বিজ্ঞানীদের চক্ষু চড়কগাছ হয়।

এটা বেশ স্পষ্ট হয় যে পৃথিবীর ম্যাগনেটিক নর্থ আর সাউথ পোলের অভিমুখ অতীতে বেশ কয়েকবার উলটে গেছে”।

“এই ব্যাপারটা কীভাবে হয়েছে এর আগে? কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়…?” জানতে চান শ্রীমতী।

“চুম্বকীয় মেরু যে স্থির বা ধ্রুব নয়, সেটা বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই জানতেন। ১৮৩১ সালে জেমস রস প্রথমবার ক্যানাডিয়ান আর্কটিকে ম্যাগনেটিক নর্থ পোল সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। তারপর, ১৯০৪ সালে রোয়াল্ড আমুন্ডসেন যখন তাকে আবার খুঁজে পান তদ্দিনে সে পাড়ি দিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। তারপর থেকে এটা দেখা গেছে যে উত্তর মেরু বছরে প্রায় দশ কিলোমিটার করে উত্তর দিকে সরে যাচ্ছে, আর হালে তার বেগ হয়েছে বছরে চল্লিশ কিলোমিটার!

আর”, একটু নাটকীয় বিরতি নিয়ে বলি আমি, “এর পাশাপাশিই দেখা গেছে যে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র উনিশ শতকের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ কমে গেছে”।

“তার মানে…” উদ্বেগে অনুমিতার গলা চোকড হয়ে যায়। মহাপুরুষদের স্টাইলে হাত তুলে সবাইকে আশ্বস্ত করি আমি।

“ম্যাগনেটিক ফিল্ড কতটা জোরালো তা বোঝা যায় তার ডাইপোল মোমেন্ট থেকে। উনিশ শতকে কার্ল ফ্রেডরিক গস একঝাঁক কঠিন অংক কষে এটা গণনার ফর্মুলা ও পদ্ধতি বলে যান, এবং সেটার বাস্তবায়ন করতে সেই যুগেই ব্রিটিশ ও রাশিয়ান সাম্রাজ্য রীতিমতো সহযোগিতা করে। ১৮৩৫ থেকে এখন অবধি পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রাবল্য মাপা হয়ে চলেছে। সেইসব জটিল হিসেবের মধ্যে না গিয়েও বলি, পৃথিবীর এই ‘কমে যাওয়া’ মোমেন্ট-ও কিন্তু গত সহস্রাব্দীর গড় মোমেন্টের দ্বিগুণ। তাছাড়া, এই উত্তর-দক্ষিণ ম্যাগনেটিক ফিল্ড কমজোর হয়ে গিয়ে পৃথিবীর নিরক্ষরেখা বরাবর অবস্থিত একটা দুর্বল ফিল্ড জোরালো হয়ে ওঠা দিয়ে কিন্তু জিওম্যাগনেটিক রিভার্সাল, অর্থাৎ চৌম্বক মেরুর উত্তর-দক্ষিণ পালটে যাওয়া ব্যাখ্যা করা যায়”।

“নিরক্ষরেখা বরাবর ফিল্ড মানে?”, তোষালি আমার কথার মধ্যে থাকা ফুলটসটা নাগালে পেয়ে যায়।

একটা শ্বাস ফেলে আমি বলি, “ডায়নামো এফেক্ট ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝা না গেলেও এটা মনে করা হয় যে লিকুইড কোরের তরল লোহার স্তরের ঘূর্ণন থেকে উত্তর-দক্ষিণ ডাইপোল যেমন তৈরি হয়, তেমন ভাবেই তৈরি হয় আরেকরকম দুর্বল ডাইপোল, যার অভিমুখ হয় আড়াআড়ি।

যদি পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ডাইপোল দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতেই থাকে, তাহলে দুটো সলিড মেরুর বদলে অনেকগুলো দুর্বলতর মেরু তৈরি হয় আস্তে-আস্তে। তখন যে অবস্থাটা তৈরি হতে পারে সেটা মোটামুটি এরকম:

এই অবস্থা বেশিদিন চলা সম্ভব নয় বলে স্বাভাবিকভাবেই আবার একটা ডাইপোল, মানে উত্তর-দক্ষিণ অবস্থা তৈরি হয়, তবে তখন ফিল্ডের অভিমুখ পালটে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে শেষ এই ঘটনা ঘটেছে আজ থেকে প্রায় সাত লক্ষ আশি হাজার বছর আগে। ব্যাপারটার পাথুরে প্রমাণ যাঁরা পেয়েছিলেন সেই বিজ্ঞানীদের নামানুসারে একে বলা হয় ব্রুনস-মাতুয়ামা রিভার্সাল। পৃথিবীর এক-এক জায়গায় এই পরিবর্তন ঘটতে এক-এক রকম সময় লেগেছিল, কোথাও বারোশো বছর, কোথাও দশ হাজার বছর”।

একটা সমবেত দীর্ঘশ্বাস শুনে বুঝলাম, রাতারাতি পৃথিবীর মেরুবদল হওয়া ও তার ফলাফল নিয়ে জল্পনাকল্পনায় আমি কয়েক বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছি। আলোচনা দ্রুত শেষ করে দেওয়ার আশায় আমি আরো বললাম, “ওই রিভার্সালের পর থেকে ভৌগোলিক হিসেবে মিডল প্লিস্টোসিন যুগ শুরু হলেও তখন যে পৃথিবীর ইতিহাসে বিরাট কিছু বিপর্যয় ঘটেছিল, এমন কিচ্ছু কিন্তু সেই সময়ের ফসিল ও অন্যান্য জিনিস থেকে মনে হয়না।

এরপরেও অবশ্য আরেকবার পৃথিবীর চৌম্বক মেরুবদল ঘটেছে। গত তুষার যুগের শেষ দিকে, আজ থেকে মোটামুটি একচল্লিশ হাজার বছর আগে, প্রায় আড়াইশো বছর ধরে পৃথিবীর উত্তর আর দক্ষিণ মেরু দিক বদলায়। রিভার্শনের সময় পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্বাভাবিকের মাত্র পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছিল বলে মনে করা হয়। মেরুদের অবস্থান বদলে যাওয়ার পরে যে ফিল্ড তৈরি হয় তার প্রাবল্যও ছিল পরিবর্তনের আগের পঁচাত্তর শতাংশ। এর ফলে মহাজাগতিক কণারা পৃথিবীতে বেশি পরিমাণে পৌঁছেছিল বলে কার্বন-১৪ আর বেরিলিয়াম-১০ আইসোটোপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীর প্রাণী বা উদ্ভিদকুলের ওপর এমন কিছু প্রভাব পড়েছিল বলে জানা যায়নি। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, এই বদলে যাওয়া মেরুরা নিজেদের সেই অবস্থানে ছিল মাত্র চারশো বছরের কিছু বেশি”।

“তাহলে এখন জিওম্যাগনেটিক রিভার্সাল হওয়ার কি আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে?”, জানতে চায় তোষালি, “কারণ একটা লেখায় পড়েছিলাম যে এটা নাকি, মানে, ওভারডিউ!”

আমি হতাশ গলায় বলি, “এই ফান্ডাটার জন্য দায়ী হল অ্যালান একার্ট-এর একটা বই, “দ্য হ্যাব থিওরি”। এই বইয়ে হার্বার্ট অ্যালান বোর্ডম্যান (এইচ.এ.বি) নামে এক ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার ৯৪ বছর বয়সে অনেক হিসেব-নিকেশ করে আবিষ্কার করেন যে পৃথিবীর চৌম্বক মেরুরা প্রতি কয়েক হাজার বছর পর জায়গা বদলায়, যখন, অ্যাজ ইউজুয়াল, যাবতীয় মেকানিক্যাল জিনিস অচল হয়ে যায়, তুমুল সব ঝড়ঝঞ্ঝা দেখা দেয়, পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড লাইন বুঝে যারা চলাফেরা করে সেই পাখিরা পথ ভোলে আর মাছ, এমনকি তিমিরা দিকভ্রান্ত হয়ে ডাঙায় উঠে আসার চেষ্টা করে, ইত্যাদি। তিনি মার্কিন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করার অনেক চেষ্টা করেও পাত্তা না পেয়ে শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দিকে মোমের গুলি চালান, যাতে লোকে তাঁর কথায় গুরুত্ব দেয়। এই হ্যাব চরিত্রটিও আসলে হিউ অচিনক্লস ব্রাউন বলে এক বাস্তব চরিত্রের আদলে নির্মিত।

যাইহোক, এই ফান্ডা লোকের মাথায় এমন করে ঢুকে যায় যে পৃথিবীতে গড়ে এই জিওম্যাগনেটিক রিভার্সাল লাখ দুয়েক বছর পর হয় বলে, আর শেষ রিভার্সাল সাত লক্ষ আশি হাজার বছর আগে হয়েছে বলে, কারো-কারো মতানুযায়ী এটা ওভারডিউ। অথচ আমরা জানি যে ক্রিটেশিয়াস যুগে দুটি রিভার্সালের মধ্যে ফাঁক ছিল পাক্কা চল্লিশ লক্ষ বছরের।

আসলে লিকুইড কোর থেকে তৈরি হওয়া ফিল্ডে যে কিছুটা টলমল অবস্থা থাকবে, তা তো স্বাভাবিক। তাই, মোটামুটি হাজার পঞ্চাশেক বছর পর-পরেই পৃথিবীর মেরুদের জায়গা বদল করার একটা বাই চাপে। কিন্তু, নতুন মোবাইল কিনতে ইচ্ছে করলেই যেমন কেনা যায়না, কারণ সেটা কিনতে গেলে যা লাগবে সেই টাকাপয়সার ওপর অন্য অনেক ফ্যাক্টরের শাসন চলে, ঠিক তেমন করেই লিকুইড কোরে তৈরি হওয়া ফিল্ড থাকবে না থাকবেনা তা ঠিক হয় ইনার কোরের মাধ্যমে”।

“কীভাবে?”, প্রশ্ন তোলে মধুরিমা।

“ইনার কোর একান্তভাবেই নিরেট, তাই তাতে ফিল্ড তৈরি হয়না। কিন্তু লিকুইড কোরে তৈরি হওয়া ফিল্ড লাইনগুলো শেষ হয় ওতেই এসে। অর্থাৎ, সেই অবশেষ ফিল্ড, যা কিনা ভীষণরকম স্থায়ী, পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন না হলে নতুন ফিল্ড লাইন তৈরি হওয়া অসম্ভব। তাই মনে করা হয় যে প্রতি দশটা জিওম্যাগনেটিক রিভার্সালের মধ্যে মাত্র একটা শেষ অবধি ঘটে”।

বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে, আর আজকের সেশনটা ভালোভাবেই উতরে গেল বলে সগর্বে বলি, “তাই নিশ্চিন্ত মনে চুলে রং-টং করাও। এমন কিছুই ঘটতে চলছেনা যাতে লোকে তোমাদের ছেড়ে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে”।

পার্টিং শটটা যথাস্থানেই পৌঁছত যদিনা জয়া ঠিক তখনই “ম্যাডাম, কাল সকালে এরা কী খেয়ে বেরোবে?” প্রশ্ন তুলে আবির্ভূত হত। আর তক্ষুনি শ্রীমতীর মনে পড়ে গেল সকাল থেকে আমাকে মাত্র বারতিনেক মনে করানো কথাটা। ফলে…

“হ্যাঁগো, তুমি কি আমার একটা কথাও মন দিয়ে শুনতে চেষ্টা কর না?”

“আম…”

“তোমাকে সকাল থেকে বলছি যে সস শেষ, এদিকে এরা সব সকালে বেরোবে স্যান্ডউইচ নিয়ে। তুমি এতবার বেরোলে, এমনকি একবার চুপিচুপি আনন্দ-র শো’রুমে ঢুকে বই কিনবে বলে প্রায় গড়িয়াহাট গেলে, কিন্তু এটা আনতে পারলেনা?”

“কিন…” (আনন্দ-র খবরটা যে বিশ্বাসঘাতক পাচার করেছে তাকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছিনা-দেব না)

“সাহুর দোকান বন্ধ হওয়ার আগে গিয়ে সস নিয়ে এস শিগগির। যাও।”

চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম…

অনুমিতা আর মেঘনা বিছানা থেকে হারমোনিয়াম তুলে বাক্সে ঢোকাতে এবং খাটের চাদর পরিপাটি করতে ব্যস্ত হয়েছে।

তোষালি পরের দিনের পরীক্ষার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছে।

মধুরিমার হঠাৎ খেয়াল হয়েছে যে ওর মা’র সঙ্গে কথা বলাটা খুব জরুরি।

শনিচক্র অ্যাস্টেরয়েড বেল্টে পরিণত হয়েছে!

ভগ্নহৃদয়ে চটিতে পা গলাতে গিয়ে চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল।

প্রায় পৌনে আট লাখ বছর আগের এক গুহার বাইরে তখন রাত নেমেছে। হোমো ইরেক্টাস গুহাস্বামী একটা মোটা চামড়া দিয়ে গা ঢেকে ঘুমে প্রায় ঢুলে পড়েছে। এমন সময়…

কাংস্যবিনন্দিত কন্ঠে গুহা প্রকম্পিত হল। শোনা গেল, “সবাই নিজের-নিজের মতো করে ফল আর মাছ পেল। শুধু এই একজন এসে বলল, কীসব দিকবদল হয়ে নাকি গাছে আর ফল ধরেনি, মাছও নাকি অন্য দিকে চলে গেছে! শুধু গল্প বানানো। কাল সকালে কী খাওয়া হবে?”

বৈজ্ঞানিকের দপ্তর সব লেখা একত্রে

4 thoughts on “বৈজ্ঞানিকের দপ্তর গ্রহের ফের ঋজু গাঙ্গুলী বর্ষা ২০১৭

  1. খুব ভাল লেখা। কঠিন বিষয়ের প্রাঞ্জল উপস্থাপনা। সাধু সাধু!

    Liked by 2 people

  2. অসাধারণ। গল্পের ছলে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যাখ্যা এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে!

    Liked by 1 person

Leave a reply to Keya Cancel reply