বিচিত্র দুনিয়া-নিষিদ্ধ স্নেক আইল্যান্ড-অরিন্দম দেবনাথ-শরৎ ২০২২

 অরিন্দম দেবনাথ   এর সমস্ত লেখা

bichitra82 (5)

বিশ্বের ভয়ংকর বিষধর সাপের বাস এই দ্বীপে, সাধারণের প্রবেশ নিষেধ জানিয়েছেন অরিন্দম দেবনাথ

ইলহা দা কুইমাদা গ্র্যান্ডে, অতলান্তিক মহাসাগরের মাঝে একটি ছোট্ট দ্বীপ। দ্বীপ না বলে বড়ো পাথরের স্তূপ বলাই ভালো। মাত্র ৪২০০০০ বর্গমিটার মানে ০.৪২ বর্গ কিলোমিটার আয়তন দ্বীপটির। হেঁটে একবার দ্বীপটিকে ঘুরতে বড়োজোর দশ মিনিট লাগার কথা। দ্বীপটির সবচাইতে উঁচু অংশ সমুদ্রতল থেকে ২০৬ মিটার। ব্রাজিলের সাও-পাওলো শহর থেকে প্রায় তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের মাঝের এই দ্বীপটি প্রায় এগারো হাজার বছর আগে সমুদ্রের বুক থেকে জেগে উঠেছিল বলে অনুমান। দ্বীপের ০.২৫ বর্গ কিলোমিটার অংশ জুড়ে আছে বর্ষণ বনের বিশাল বিশাল গাছ আর সমুদ্রের কিনারা জুড়ে আছে বড়ো বড়ো পাথরের টুকরো আর ঘাসজমি।

সমুদ্র এখানে এত উত্তাল যে দ্বীপের কাছে সহজে পৌঁছানোই যায় না। অভিজ্ঞ মাঝিমাল্লারাও দ্বীপের কাছে যাওয়ার সাহস সহজে দেখায় না, পাছে ডুবোপাথরে ধাক্কা খেয়ে নৌকো ডুবে যায়। এই দ্বীপে একটি লাইট হাউস আছে দূর থেকে মাঝিমাল্লাদের বিপদ থেকে সতর্ক করে দেবার জন্য।

bichitra82 (6)

ওই লাইট হাউসে অবশ্য আলো দেখাবার জন্য এখন আর কেউ থাকে না, এটি ব্রাজিলের নৌবাহিনী দেখভাল করে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি বসিয়ে। ১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত বহুবছর আগে একটি পরিবার ওই লাইট হাউসের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকতেন ওই দ্বীপে। লাইট হাউসের ভেতর একটা ঘরে ওরা থাকত। কিছুদিন হঠাৎ করে ওদের উপস্থিতি টের না পাওয়ায় খোঁজ নিতে গিয়ে টের পাওয়া যায় সবাই মারা গেছে। ব্রাজিল সরকার ১৯২০ সাল থেকে ওই দ্বীপে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। বর্তমানে শুধু অনুমতিপ্রাপ্ত গবেষক ও নৌবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরাই ডাক্তার ও বিষ বিরোধী ইঞ্জেকশন সঙ্গে করে যেতে পারেন এই দ্বীপে।

 এই দ্বীপ সাধারণ মানুষের বাসস্থান ছিল না কোনোদিনই। এমনকি সচরাচর জেলেরাও মাছ ধরতে যেত না দ্বীপের কাছাকাছি। একবার এক জেলের সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে খিদে পাওয়াতে খাবারের খোঁজে গিয়েছিল ওই দ্বীপে। পরদিন ওই জেলের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেছিল। ওই দ্বীপটা ছিল সবার কাছে আতঙ্কের দ্বীপ। শুধু কিছু অতি উৎসাহী মানুষ কালেভদ্রে যেত ওই দ্বীপে সোনার খোঁজে। কিন্তু কেউ ফেরত আসত না।

না, এই দ্বীপে কোনও সোনার খনির অস্তিত্বের কথা শোনা যায়নি। তবে এই দ্বীপ যে একটি রত্নভাণ্ডার, তাতে দ্বিমত নেই। একসময় এই দ্বীপ ছিল জলদস্যুদের এক অন্যতম ডেরা। লুট করে আনা সম্পদ এরা লুকিয়ে রাখত এই দ্বীপে। আর সেই সম্পদ পাহারা দেবার জন্য রেখে দিয়েছিল ভয়ংকরতম পাহারাদার। ধীরে ধীরে এই পাহারাদাররা তাদের বংশবিস্তার করে দ্বীপের দখল নেয়।

bichitra82 (2)

এই দ্বীপে দীর্ঘদিন কেউ যেত না। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ওই নিষিদ্ধ দ্বীপে কলা বাগান বানানোর জন্য আগুন জ্বালিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করতে যেতেই যারা জঙ্গল আগুন লাগাতে গেছিলেন তাঁরা শিউরে উঠেছিলেন। কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।

ওই দ্বীপের পাহারাদাররা ছাড়া ওই দ্বীপে আর যারা আশ্রয়ের জন্য যায়, তারা হল পরিযায়ী আর সামুদ্রিক পাখির দল। এরা ছাড়া ওই দ্বীপের অন্য বাসিন্দারা হল ঝাঁকে ঝাঁকে রাক্ষুসে আরশোলা আর পঙ্গপালের দল। অবশ্য এরাই দ্বীপের পাহারাদারদের খাবার।

শুধুমাত্র যাদের ওফিডিওফোবিয়া মানে সাপের ভয় আছে তারাই নয়, যে-কেউ এই দ্বীপের বর্তমান মূল বাসিন্দাদের কথা জানলে সেখানে যেতে উৎসাহ দেখাবেন না। তবে কেউ কেউ ওই দ্বীপে লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও যেতে চায়। তবে যায় শুধুমাত্র টাকার লোভে। এরা হল বায়ো-পাইরেটস। জৈব জলদস্যু। এরা ওই দ্বীপে তাদেরই কোনও পুর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পাহারদারদের বংশধরদের ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে।

bichitra82 (3)

এক-একটি এই লুপ্তপ্রায় প্রজাতির পাহারদারের দাম দশ থেকে তিরিশ হাজার ডলার। গুপ্তধনের থেকে কোনও অংশে কম নয় এই পাহারাদারদের মূল্য।

এই দ্বীপের প্রধান বাসিন্দা হল দক্ষিণ আমেরিকার ভয়ংকরতম সরীসৃপ, পিট ভাইপার (গোল্ডেন ল্যান্সহেড)। হলদে-রঙা শরীরে বাদামির ছোঁয়া থাকে এই গোখরো প্রজাতির সাপেদের। প্রায় মিটার খানেক লম্বা হয় এই সাপ। এই সাপের কামড় খেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা পেয়ে বেঁচে গেলেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে হতে পারে।

bichitra82 (3)

গোল্ডেন ল্যান্সহেডের বিষ হেমোটক্সিক। এর মানে এটি লাল রক্তকোষকে আক্রমণ করে এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। এর দংশনে শরীরে আভ্যন্তরীণ রক্তপাত, টিস্যুর নেক্রোসিস, মস্তিষ্কে সম্ভাব্য রক্তক্ষরণ এবং অন্যান্য উপসর্গগুলি দেখা দেয়।

দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চল থেকে গোল্ডেন লাঞ্চহেড প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও এরা এখানে বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে। এছাড়াও আরও অন্যান্য প্রজাতির কিছু বিষধর সাপ। সাপেরা ছাড়া আর কোনও স্থলচর প্রাণী এই দ্বীপে নেই। সাপের সংখ্যা তো আর গোনা যায়নি। তবে কয়েক হাজার তো বটেই। যদিও মুখে মুখে ফেরে এই দ্বীপে সাপের সংখ্যা চার লাখের কাছাকাছি, মানে প্রতি বর্গ মিটারে একটি করে সাপ। কিন্তু কিছু সর্প বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এ কখনও হতে পারে না। সাপেদের জন্য অত খাবারই লভ্য নয় ওই দ্বীপে। তবে আনুমানিক প্রতি ১৪০ বর্গ মিটারে একটি করে সাপ আছে। মানে পুঁচকে একটা ছোটো পাড়ার মতো দ্বীপে প্রায় হাজার চারেক সাপ! আর এই সাপগুলো বেঁচে আছে শুধুমাত্র পাখি, আরশোলা আর গঙ্গাফড়িংয়ের মতো পোকা খেয়ে।

ব্রাজিল সরকার পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় সরীসৃপটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাউকেই দ্বীপের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয় না। নৌসেনারা বিশেষ বাহিনী এই দ্বীপটিকে পাহারা দেয় রীতিমতো।

bichitra82 (4)

ছবি – সংগৃহীত


বিচিত্র দুনিয়া সমস্ত লেখা একত্রে 

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s