বিচিত্র দুনিয়া-কাদার ফাঁদ-অরিন্দম দেবনাথ শীত ২০২০

 অরিন্দম দেবনাথ   এর সমস্ত লেখা

যদি জেলেটির নজর কাদাপাড়ের দিকে না যেত তাহলে নরওয়েজিয়ান দম্পতির যে কী পরিণতি ঘটত ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।
দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ১৫০ কিলোমিটার লম্বা সমুদ্র-ঘেঁষা ক্রবি প্রদেশের চুনাপাথরের সবুজে ছাওয়া খাড়া পাহাড়ের গা, আন্দামান সমুদ্রতল থেকে সোজা উঠে গেছে। না, মেঘ ছুঁইছুঁই নয় কোনো পাহাড়ই। জলতল থেকে মাত্রই কয়েকশো ফুট উঁচু। সবজে নীল জল আর সোনালি বালুবেলা ছাড়িয়ে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। আর আছে তট-ঘেঁষা গুহা, জলপ্রপাত, অসংখ্য ছোটো ছোটো দ্বীপ ও প্রবাল প্রাচীরের হাতছানি। কেয়াকিং, স্নোরকিলিং, বিচ ট্রেকিং, সেইলিং, বার্ড ওয়াচিং ছাড়াও সমুদ্রের ওপর ঝুলে থাকা পাহাড়ের গায়ে রক ক্লাইম্বিং-এর টানে শুধু থাইল্যান্ডবাসীরাই নয়, বিশ্বের বহু টুরিস্ট প্রতিবছর আসেন ক্রবি প্রদেশে। এই অঞ্চলে অনেকগুলো রক ক্লাইম্বিং স্কুল আছে পর্যটকদের রক ক্লাইম্বিং-এর রোমাঞ্চ উপভোগ করানোর জন্য। কাছেই আছে ফসিল সমুদ্রতট। সেখানে গেলে দেখা পাওয়া যায় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে এখানে বসবাসকারী প্রাণীর জীবাশ্ম। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের স্বর্গ এই ক্রবি।
অথচ দেড়শো বছর আগেও এই জায়গাগুলো ছিল শ্বাপদসঙ্কুল। মূলত এইসব অঞ্চল থেকেই হাতি ধরে চালান যেত রাজকার্য ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে। ১৮৭৫ সালে ক্রবি প্রথম সে সময়কার রাজদরবার থেকে চতুর্থ শ্রেণির শহরের মর্যাদা পায়। শুরু হয় ক্রমোন্নতি। ব্যাঙ্কক থেকে ৭৮০ কিলোমিটার দূরত্ব ক্রবির।
প্রকৃতির টানে এক নরওয়েজিয়ান দম্পতিও এসেছিলেন ক্রবিতে। পাখির ছবি তোলার টানে তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন সমুদ্রের কিনারা ধরে। প্রথমে তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না সমুদ্রতটের ছোটো ছোটো পাখির ছবি তোলার জন্য। কিন্তু ভালো করে দেখে নিয়েছিলেন পাখিদের উপস্থিতি ও তাদের গতিবিধি।

যে স্থানটিকে ছবি তোলার জন্য বেছে নিয়েছিলেন দম্পতি, তার কাছেই ক্রবি মুয়াং মিউনিসিপ্যালিটির একটি ড্রেনের জল এসে পড়েছে সমুদ্রের ধারে। অনেকটা খাঁড়ির মতো জায়গাটা। সমুদ্রের তট এখানে শক্ত ও বালিময় নয়, বরং খানিক কর্দমাক্ত। দম্পতি এ ব্যাপারে সচেতনও ছিলেন। কাদায় গেঁথে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে প্লাস্টিকের গামলা নিয়েছিলেন সঙ্গে। তেপায়ার ওপর লম্বা লেন্স লাগানো ক্যামেরা খাড়া করে প্লাস্টিকের গামলায় দাঁড়িয়ে ভিউ ফাইন্ডারে চোখ লাগিয়ে খুদে পাখিদের ছবি তুলছিলেন নরওয়েজিয়ান ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক। ছবি তুলতে মশগুল ভারী শরীরের চিত্রগ্রাহক টেরই পাননি যে তিনি ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন পাঁকের গভীরে। পায়ের তলায় প্লাস্টিকের গামলা থাকায় চট করে জল বা কাদার স্পর্শ অনুভব করাও সম্ভব ছিল না। যখন বিপদ টের পেলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওঁর স্ত্রীও ওঁকে কাদার ফাঁদ থেকে বের করে আনতে গিয়ে তলিয়ে যেতে থাকেন পাঁকের ভেতরে।
সমুদ্র এখানে জনবিরল নয়। জেলেদের ব্যস্ততা সমুদ্র-কিনারা ঘেঁষে চলতেই থাকে দিনভর। বয়স্ক দম্পতিদ্বয় যেখানে ছবি তুলছিলেন, তার পাশেই ছিল এক ছোটো জেটি। ছোটো ছোটো মোটর লাগানো বোট নিয়ে মাছ ধরা চলে দিনরাত। ক্ষুদে বোটে চেপে মাছ ধরতে থাকা চুয়াল্লিশ বছরের তাইওয়ানি চ্যাট উবনচিন্ডার জেটির কাছে নৌকো নোঙর করতে গিয়ে দেখেন খানিক দূরে কোমর সমান কাদায় গেঁথে দুজন হাত নাড়তে নাড়তে চিৎকার করছেন। ইংরেজি না বুঝতে পারলেও চ্যাটের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, তখনি ঝাঁপিয়ে না পড়লে ধীরে ধীরে কাদার বুকে সমাধি হবে দুজনের। কাদাপাড়ে ছোটো ছোটো গর্ত আছে যে! চোরাবালি না হলেও কোনো ভারী বস্তু ওর ওপর পড়লে ধীরে ধীরে তা তলিয়ে যাবে জলকাদার মাঝে, কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। কেউ জানতেও পারবে না যে দুজন কাদায় ডুবে মারা গেছেন। হারিয়ে যাওয়া দুটো মানুষকে কিছুদিন খুঁজে পুলিশ হাল ছেড়ে দেবে।
কাদাতটের চরিত্র ভালোভাবে জানা রোগা-পটকা চেহারার চ্যাট নিজের ছোটো নৌকোকে জলের কিনারায় নোঙর করে এক হাঁটু কাদা পার হয়ে পৌঁছে যান দুই দম্পতির কাছে। প্রথমেই ট্রাইপডে দাঁড় করানো ক্যামেরাটিকে সরিয়ে নিয়ে যান নিরাপদ জায়গায়। তারপর ফিরে এসে হাতে হাত জড়িয়ে কাদার পাঁক থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করেন ফটোগ্রাফার ভদ্রলোককে। কিন্তু একচুলও নড়ানো যায়নি ভদ্রলোককে। তারপর বগলের তলা দিয়ে দু-হাত দিয়ে আঁকড়ে অনেক চেষ্টা করেও কাঁদার পাঁক থেকে তুলতে ব্যর্থ হন চ্যাট। উলটে আরো বিপদ হতে যাচ্ছিল—পিছলে কাদাভরা গর্তে ঢুকে যাচ্ছিল সে। তখনো ওই একই গর্তে কোমর সমান কাদায় গেঁথে ছিলেন ওঁর স্ত্রী। ভদ্রলোককে ছেড়ে এবার মহিলাকে কাদা থেকে তোলার চেষ্টা শুরু করে চ্যাট। প্রথমেই মহিলার পিঠে থাকা ছোট্ট ডে-প্যাক আর স্লিং ব্যাগ খুলে নিয়ে রেখে আসে নিরাপদ জায়গায়। তারপর টেনে তোলা যাবে না বুঝে মহিলার পাশে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েন কাদার ওপর। ইশারায় মহিলাকে বুঝিয়ে দেন ওর পিঠের ওপর ভর দিয়ে কাদা থেকে নিজেকে টেনে তুলতে। খানিক কসরত করার পর সমর্থ হন বয়স্কা মহিলা। চ্যাটের পিঠের ওপর চেপে বসতে পারেন উনি। কাদার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে পৌঁছে যান খানিক দূরের নিরাপদ অঞ্চলে।
কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন ভদ্রলোক চেষ্টা করেন কাদার ওপর শুয়ে থাকা চ্যাটের পিঠে ভর দিয়ে ওঠার। ভারী শরীর নিয়ে বার বার ব্যর্থ হতে থাকেন উনি। চ্যাটের রোগা পাতলা শরীরের হাড় ভেঙে যেতে পারত ওঁর শরীরের চাপে। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি ছিলেন না চ্যাট। তিনি জানতেন সময়। সময়ের এক বিশাল ভূমিকা আছে উদ্ধারে। যত দেরি হবে ততই পাঁক-গহ্বরে তলিয়ে যাবেন ভদ্রলোক। গুটিগুটি পায়ে আরো কিছু মানুষজন জড়ো হলেও চোরা কাদাবালির পাঁক থেকে উদ্ধার করাটা সহজ ছিল না। সঠিক সাহায্য না পেলে হিতে বিপরীত হতে পারত।

বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হবার পর কোনোরকমে ডান পা-টা চ্যাটের শরীরের ওপর তুলতে সমর্থ হন উনি। তারপর বাঁ-পাটাকে টেনে তুলে শুয়ে থাকা চ্যাটের পিঠে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যান। চ্যাট নিঃশব্দে একগাল হেসে দু-বার মাথা দুলিয়ে সৌজন্য দেখিয়ে এক হাঁটু কাদা ডিঙিয়ে ফিরে যান নিজের নৌকায়। সিগালের দল কিঁ কিঁ করে আওয়াজ করে বাহবা জানায় চ্যাটকে। ছোটো ছোটো ব্যাঙ আর মাছের দল কাদার ওপর লাফ দিতে দিতে সঙ্গ দেয় চ্যাটকে।
সে রাতেই শহরের মেয়র থেরাসাক সিক্স্রতাবিকে সঙ্গে করে ফটোগ্রাফার দম্পতি হাজির হন চ্যাট উবনচিন্ডার বাড়ি। প্রাণ বাঁচানোর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কিছু টাকা তুলে দেন দরিদ্র চ্যাটের হাতে। আর শহরের মেয়র এক অনুষ্ঠানে চ্যাটকে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস আর অসম সাহসিক উদ্ধার কাজ চালানোর জন্য পুরস্কৃত করা হবে বলে ঘোষণা করেন।

না, উদ্ধারকাজ নিঃশব্দে হলেও রোমাঞ্চকর উদ্ধার কাহিনি ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি। শহরের মেয়র কোন এক উৎসাহীর তোলা ভিডিও ফেসবুক সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে দেন। মাত্র চারদিনে ২.৭ মিলিয়ান মানুষ ভিডিওটি দেখেন। এই রইল সেই ভিডিওর হদিশ।
https://www.facebook.com/1813785478/videos/10203649573239235/

ছবি – থেরাসাক সিক্স্রতাবির ফেসবুক পাতা থেকে নেওয়া। ক্রবির ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

বিচিত্র দুনিয়া সমস্ত লেখা একত্রে 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s