তীক্ষ্ণ শ্রুতিকটু কোনও শব্দ যদি মানুষের সহনশীল ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং তা যদি মানবদেহের ক্ষতিসাধন করে থাকে তাহলে এই সুরবর্জিত ও কর্কশ শব্দ থেকে উৎপন্ন দূষণকে বলা হয় শব্দ দূষণ। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী গ্রাহাম বেলের নামানুসারে শব্দ পরিমাপের এককের নাম ডেসিবেল।
বিশ্বে বিভিন্ন কারণে হতে পারে শব্দ দূষণ, যথা- কলকারখানার শব্দ, যানবাহনের শব্দ, বাজি ফাটানো বা কোনও বিস্ফোরণের শব্দ ইত্যাদি। বিভিন্ন যানবাহন যথা- মোটরগাড়ি, বাস, লরি, রেল এবং প্লেনের শব্দে শব্দ দূষণ হতে পারে। রাজ্য ও কেন্দ্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যানবাহন থেকে উৎপাদিত শব্দের দূষণের মাত্রা ৭০ ডেসিবেল স্থির করে দিয়েছে, অর্থাৎ এই সীমারেখা অতিক্রম করে হর্ন বাজানো উচিত নয়। ভারতে কলকারখানাযুক্ত স্থানে গড়ে ৮ ঘণ্টায় ৯০ ডেসিবেল শব্দকে সর্বোচ্চ বলে ধার্য করা হয়েছে। তাছাড়াও নানান ধরনের বাজি ফাটানো বা আকস্মিক কোনও কারণে বিস্ফোরণ ইত্যাদির ফলেও হতে পারে শব্দ দূষণ। এছাড়াও শব্দ দূষণের হাজারো কারণ থাকতে পারে।
শব্দ দূষণরূপী দানব প্রভাব বিস্তার করতে পারে মানবশরীর ও মনে। নিবিড় গবেষণার ফলে জানা গেছে, শব্দ দূষণের প্রভাব পড়তে পারে প্রাণী এবং পরিবেশের উপরও।
আমরা আমাদের কানের সাহায্যে কোনও শব্দ শুনতে পাই। সুমধুর কোনও শব্দ আমাদের কানের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে ও এটা আমাদের দেহ এবং মনে অপূর্ব আনন্দের শিহরন ঘটায়। কিন্তু শ্রুতিকটু কোনও শব্দ যদি আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে থাকি, তাহলে আমাদের কর্ণের গভীরে অবস্থিত ‘অর্গান অফ কটি’কে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে আমাদের শোনার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এটিকে ‘নয়েস ইনডিউসড হিয়ারিং লস’ বলে। যা দু-ভাবে শরীরের ক্ষতিসাধন করতে পারে যেমন এক, উচ্চ প্রাবল্যের শব্দ এককালীন হঠাৎ শুনলে আমাদের অন্তঃকর্ণের ককলিয়া নামক শ্রুতিযন্ত্র স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটিকে ‘অ্যাকাউস্টিক ট্রমা’ বলে। সাধারণত এক্ষেত্রে শব্দের মাত্রা ১৫০ ডেসিবেল বা তার উপরও হতে পারে। সাধারণত শব্দের প্রাবল্য ৮৫ ডেসিবেল বা তার উপর হলে সেটা যদি আমরা অবিরত শুনতে থাকি তাহলে আমাদের শ্রবণ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। হৃৎপিণ্ডের ওপরও এইরকম শব্দের প্রভাব খুবই ক্ষতিকর। এক, শব্দমাত্রা যদি ৯০ ডেসিবেল বা তার ঊর্ধ্বে উঠে তাহলে মানব শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। দুই, আমরা যদি সর্বদা ৬০ ডেসিবেল বা তার ঊর্ধ্বের কোনও শব্দ শ্রবণ করি, তাহলে ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন’ নামে বিশেষ হৃদরোগ হয়। তাছাড়াও উচ্চ প্রাবল্যের শব্দে আমাদের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ু এবং ভেগাস স্নায়ুর উদ্দীপনা বাড়ে, তার ফলে হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বাড়ে। শরীর ছাড়াও মানুষের মনের ওপরও শব্দের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। আমাদের মনের চাপ ও টেনশন বাড়ে। এর ফলস্বরূপ সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে এবং মন ও শরীর যেহেতু একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, তাই আরও নানান রোগ যেমন মধুমেহ, অনিদ্রা ইত্যাদি হতে পারে।
শব্দ দূষণ থেকে গৃহপালিত ও বন্য প্রাণীদের হতে পারে বধিরতা, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বৃদ্ধি হ্রাস ইত্যাদি। কিছু প্রাণী যেমন বাদুড় এবং নিশাচর প্রাণীরা নানান ধরনের উচ্চমাত্রার শব্দ তৈরি করে এবং এর মাধ্যমে এরা শিকার ধরে এবং বিভিন্ন জায়গায় উড়ে বেড়ায়। কিন্তু শব্দ দূষণ এই ধরনের শব্দকে মাস্কি করে, যা তাদের জীবনযাত্রাকে পালটে দেয় এবং তাদের বাঁচার ক্ষমতাকে হ্রাস করে।
মাফলার একটি বিশেষ ধরনের শীতবস্ত্র, যা আমাদের মাথাকে আবৃত করে ও কান দুটোকে ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা করে। এই অতিসাধারণ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভিদবিদ, প্রকৃতিবিদ এবং বিভিন্ন গবেষকরা গ্রিন মাফলার নামক এক নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছেন। এই মাফলার শব্দ দূষণের মাত্রা ও তীব্রতাকে হ্রাস করে। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা যায়, চার থেকে ছয় সারিতে যদি পরস্পর গাছ লাগানো হয়, যেটা কোনও ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চল অথবা কোলাহলপূর্ণ অঞ্চলে কোনও গ্রাম, শহর বা বসতিকে আবৃত করে রাখে। তার ফলে বাইরের কোনও শব্দ বা কোলাহল ওই অঞ্চলটিতে স্বল্প প্রবেশ করে। তাহলে এটিকে তখন গ্রিন মাফলার বলে। সম্প্রতি ভারত সরকার, রাজ্য সরকার এই গ্রিন মাফলার প্রকল্পটিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, গ্রিন মাফলার অভেদ্য পাথরের দেয়ালের ন্যায় বাধার পাহাড় তৈরি করে এবং ওই বিশেষ অঞ্চলে শব্দ দূষণ প্রতিরোধ করে। এখানে চিরহরিৎ বৃক্ষ বা গাছগাছালি লাগানো হয় এবং তা হয় নিশ্ছিদ্র এবং ঘন সন্নিবিষ্ট। তার ফলে গাছগুলি নীলকণ্ঠ মহাদেবের ন্যায় শব্দ দূষণরূপী বিষ শোষণ করে। আমেরিকার এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের মতে, এই মাফলার প্রায় ১০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দের প্রাবল্য এবং ৫০% পর্যন্ত শব্দ দূষণের মাত্রা হ্রাস করতে পারে। ভারতবর্ষে খুবই পরিচিত দুটি বৃক্ষ হল নিম এবং অশোকগাছ। এই গ্রিন মাফলার তৈরি করতে এদের ব্যবহার করা হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কেবলমাত্র শব্দ দূষণ প্রতিরোধ করা নয়, আমরা ভারতের দিকে দিকে প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে পারব। ফলস্বরূপ, সুজলা-সুফলা হবে এই প্রকৃতি, রোধ হবে ভূমিক্ষয়, জল দূষণ, বায়ু দূষণ ও অন্যান্য দূষণের হাত থেকে বাঁচবে আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি। আমরা ফিরে পাব আর্যাবর্তের সেই পুরোনো প্রকৃতিকে।
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর
Khub sundar likhecho. Ei vabe r o onek valo lekho…
LikeLike