অনিরুদ্ধ সেন-এর আরো গল্প- জটিল হিসেব , পঞ্চু প্রধানের দোয়ায়, রক্ষক, পেঁচো ও বেয়ারা ইমেল, ভূতুড়ে দ্বীপ, পেঁচোর সাত সতেরো, কাছে থেকে দূর রচিল
সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০( তৃতীয় স্থান)
দীপ একজন পোড় খাওয়া জাহাজি। এখন সে সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার, শিগগিরই চিফ ইঞ্জিনিয়ার হবে। কঠিন জীবনযাত্রায় গড়াপেটা তার শরীর-মন টিপিক্যাল ‘ভেতো বাঙালি’ সুলভ নয়। বছরের মাস নয়েক কাটে জলে, বাকি তিন মাস কলকাতায় ফিরে বৌ-ছেলে-মেয়ের সঙ্গে জমিয়ে সংসার। ছেলেমেয়েরা তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করলে বলে, “কী করি বল, ভূপৃষ্ঠের তিন-চতুর্থাংশ জল। আমিও বছরের তিন-চতুর্থাংশই জলে কাটাই।”
এবার তার যাত্রা প্রশান্ত মহাসাগরের এক নিরালা অঞ্চলে। চেন্নাই থেকে তার জাহাজ প্রথমে ফিলিপিনস যাবে, তারপর হাওয়াই। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত, তবে ভৌগোলিকভাবে আমেরিকার থেকে আড়াই হাজার মাইল দূরে। সেখান থেকে জাহাজে মাল নিয়ে যেতে হবে আরো হাজার আড়াই মাইল দূরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের মাজুরো বন্দরে।
অবশেষে জাহাজ হাওয়াইয়ের হনলুলু বন্দরে পৌঁছল। দীপ আগে এদিকে আসেনি। সুন্দরী হাওয়াইয়ের সমুদ্র ও ভূপ্রকৃতি তাকে মুগ্ধ করল। হপ্তা খানেকে লোড-আনলোড সারা, এবার যাত্রা মাজুরোর লক্ষ্যে। মাজুরো পৌঁছতে দিন বারো লাগবে। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ নানা ইউরোপীয় শক্তির হাত ফিরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত। অধুনা তারা সরকারিভাবে স্বাধীন, তবে আমেরিকার ‘তত্ত্বাবধানের’ একটি রাষ্ট্র। আমেরিকান সাহায্যের ওপরই তারা টিকে আছে, রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি। জাহাজের অধিকাংশ পণ্যই এখানে নামবে। মূলত কৃষিজ কিছু পণ্য অবশ্য এখান থেকে উঠবে।
দীপের সঙ্গে একজন নাবিক লিওনার্দোর আলাপ হয়েছিল। জাহাজ মাজুরোর কাছাকাছি এলে একদিন রাতে দীপ দেখল, লিওনার্দো ‘ক্রো’জ নেস্ট’-এ উঠে বাইনোকুলার দিয়ে কী দেখছে। ‘ক্রো’জ নেস্ট’ দূর সমুদ্র পর্যবেক্ষণের জন্য মাস্তুলের একটা উঁচু জায়গা। কিন্তু এত রাতে? লিওনার্দো নেমে এলে দীপ তাকে ধরল, “কী ব্যাপার?”
“দেখেছি, ওই ভূতুড়ে আলোটা দেখতে পেয়েছি।” উত্তেজিতভাবে বলল লিওনার্দো।
“ভূতুড়ে আলো?”
“হ্যাঁ, ভূতুড়ে দ্বীপের ভূতুড়ে আলো।”
দীপের কৌতূহল হল। তার জেরায় লিওনার্দো তখন বলল এক বিচিত্র কাহিনি। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত বিকিনি দ্বীপপুঞ্জে একসময় কিছু স্থানীয় জনজাতির বসতি ছিল। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকান সরকার তাদের পুনর্বাসন দিয়ে দ্বীপগুলিকে জনশূন্য করে সেই অঞ্চলে বছর পনেরোর মধ্যে গোটা ত্রিশ পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। অধুনা ‘ভূতুড়ে’ আখ্যাত এই দ্বীপটি বিস্ফোরণস্থলগুলির থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছিল। তবু সেখান থেকেও মানুষদের সরানো হয়েছিল।
পারমাণবিক বিস্ফোরণ বন্ধ হয়েছে। কালক্রমে দ্বীপগুলির তেজস্ক্রিয়তার মাত্রাও সহনশীলতার সীমায় এসেছে। মানুষ চাইলে হয়তো সেখানে যেতে পারে, কিন্তু বসবাস বা চাষবাস অসম্ভব। বিস্ফোরণে উৎপন্ন সিজিয়াম ধাতুর উপস্থিতি দ্বীপগুলোকে নিষ্ফলা করে দিয়েছে।
তার মধ্যে ওই অনামা দ্বীপটিকে ঘিরে সম্প্রতি কিছু জনরব সৃষ্টি হয়েছে। আকাশ থেকে দেখলে, জনহীন পাথুরে দ্বীপটি ঝোপজঙ্গলে ভরা। জনশ্রুতি, ওখানে নাকি এখনো তেজস্ক্রিয়তা খুব বেশি, পা দিলেই মৃত্যু। আরো শোনা যায়, রাতে দূর দিয়ে যেতে যেতে কিছু মাঝিমাল্লা ওখানকার আকাশে নানা ভৌতিক আগুনে-মূর্তি দেখেছে। যেমন এখন দেখল এই লিওনার্দো। দূর থেকে যেটুকু বোঝা গেছে, ওটা সমুদ্রের বুকে কয়েকশো ফুট উঁচুতে এক বিচিত্র আলো। আবছাভাবে সেটাকে একটা কদাকার মূর্তিই মনে হয়।
লোকে বলে, ওই দ্বীপেও নাকি পারমাণবিক বিস্ফোরণ হয়েছিল। তখন কিছু অধিবাসী গভীর জঙ্গলে ছিল বলে কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে যায়, ফলে তারা বিস্ফোরণে নিহত হয়। তাদের আত্মা নাকি এখনো দ্বীপটিকে বসবাসের অযোগ্য করে রেখেছে আর দূর থেকে দেখা দিয়ে ওদিকে যেতে বারণ করছে।
“ইন্টারেস্টিং!” বলল দীপ, “আমি ভূত-টুত মানি না। আমার তো এখনই গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করছে ব্যাপারটা কী।”
“সিরিয়াসলি?” লিওনার্দো বলল, “আমি কয়েকবার এখানে এসেছি। প্রত্যেকবারই একটা অদম্য ইচ্ছে হয়েছে ওখানে যাবার। কিন্তু পিছিয়ে এসেছি, কারণ এই কাজে আমার একজন সঙ্গী দরকার—একজন ব্রেভ হার্টের।”
“সে তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে।” দীপ সামনে ঝুঁকে হাত মেলাল।
“সত্যি?” উৎফুল্ল লিওনার্দো বলল, “কিন্তু ক্যাপ্টেন কি আমাদের ছাড়বে?”
“সে ভার আমার।” দীপ শুভরাত্রি জানিয়ে উত্তেজিত মনে ঘুমোতে গেল।
সত্যি বলাটাই সবচেয়ে সহজ। ক্যাপ্টেন ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার দীপের বহুদিনের চেনা। তাদের কাছে সে-সব খুলে বলল। ক্যাপ্টেন খুব ডেয়ার-ডেভিল। একবার পাইরেটদের হাতে পড়েও কৌশলে বেরিয়ে এসেছেন। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “দারুণ! আশা করি তোমরা সফল হবে আর ভূতুড়ে দ্বীপের রহস্য সমাধানে আমার জাহাজের নামও থাকবে। জাহাজ এখানে অন্তত সাতদিন থাকবে। তার মধ্যে…”
“আমরা ফিরে আসব।”
“যদি কোনো বিপদ হয়?” চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কণ্ঠে সংশয়।
“কেটে বেরিয়ে আসব। তবে যদি নিতান্তই না ফিরি, প্লিজ আমাদের বাড়িতে খবরটা দিয়ে আমাদের বকেয়াটা পাঠিয়ে দেবেন। জাহাজের এরপরের যাত্রায় কোনো জটিলতা নেই, আপনিই বাকিটা চালিয়ে দিতে পারবেন। আমি সব দেখে নিয়েছি, তবু যাবার আগে ইঞ্জিন-ফিঞ্জিন ভালো করে চেক করে নেব।”
“কিন্তু তোমাদের কিছু হলে তো দায়টা আমাদের ওপরই চাপবে।”
“না, স্যার। আপনারা কিছু জানেন না, কিছু শোনেননি। আমরা ছুটি নিয়ে শোরে গিয়ে আর ফিরিনি, ব্যস!”
***
“চিফদের আমি ম্যানেজ করেছি, বাকিটুকু তোমার। কী কী লাগবে, কোত্থেকে পাব…”
“সব ছকে রেখেছি।” লিওনার্দোর মুখে আত্মবিশ্বাসী হাসি।
প্রথমে তারা গেল লিওনার্দোর পরিচিত স্প্যানিয়ার্ড দিয়েগোর কাছে, স্পিড বোট ভাড়া করতে। ভাড়ায় রফা হল। কিন্তু ভূতুড়ে দ্বীপ শুনে পাইলট বেঁকে বসল। তেজস্ক্রিয়তা, তার ওপর ভূতের ভয়। শেষে ঠিক হল, দ্বীপের মাইল দশেক দূরে নেমে তারা একটা ছোট্ট রবার বোটে দাঁড় টেনে ওই দ্বীপে পৌঁছবে। ওখানে মোবাইলের সিগন্যাল পৌঁছবে না। তবে দীপের একটা স্যাটেলাইট ফোন আছে। এরপর দরকার তেজস্ক্রিয়তা মাপার যন্ত্র গাইগার কাউন্টার। সেটাও পাওয়া গেল। সর্বশেষে কিছু শুকনো খাবার আর ইমার্জেন্সি কিটস কিনে যাত্রা।
সময় নষ্ট না করে সেই রাতেই রওনা দিল বোট। সমুদ্র স্থির থাকলে ঘণ্টা আটেকে পৌঁছে যাবে। তখন ভোর হবে। দ্বীপের দিকচিহ্ন চোখে দেখে রবার বোট প্যাডেল করা যাবে।
কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর সমুদ্র অশান্ত হল। তার মধ্যেও স্থিরভাবে জল কেটে এগোতে লাগল স্পিড বোট, তবে তার বেগ স্তিমিত হল। সামনে ধকল আছে, ওরা দুজন তাই ঠিক করল পালা করে ঘুমিয়ে নেবে। লিওনার্দো শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। অস্থির সমুদ্র কেটে বোট চলছে, জলের দিকে তাকিয়ে আছে দীপ। কালো অন্ধকারে কিছু দেখার নেই, শুধু ঢেউয়ের মাথায় জ্বলছে ফসফরাসের মালা।
কথামতো রাত দুটোয় লিওনার্দোকে তুলে দিয়ে ঘুমোতে গেল দীপ। কতক্ষণ পর জানে না, লিওনার্দোর ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। “এসে গেছে?” ধড়মড়িয়ে উঠে বসল দীপ।
নিঃশব্দে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল লিওনার্দো। তখনো অন্ধকার কাটেনি। দূরে প্রায় দিগন্তের কাছে দীপ দেখল এক অদ্ভুত আলোর ছটা। সেটা বাড়ছে, কমছে, দপদপাচ্ছে। সব মিলিয়ে যেন এক রূপকথার দৈত্য বিকট হাঁ খুলছে আর বন্ধ করছে।
পাইলট ঘাবড়ে গেল। তার পিঠ চাপড়ে দীপ বলল, “ওসব আলোক-বিভ্রম। ভোরের আলো হলেই কেটে যাবে। তুমি আমাদের আর একটু কাছে নিয়ে চলো, বাকিটা আমরাই ম্যানেজ করে নেব।”
ভোর হওয়ার আগেই সেই আলোটা সত্যিই মিলিয়ে গেল। কিন্তু তার বদলে এক গাঢ় কুয়াশা দ্বীপটাকে তার পুরু চাদরে লুকিয়ে ফেলল। আরো ঝামেলা, একটু এগোতেই দেখা গেল নেভিগেশনাল এইডগুলি কাজ করছে না, ম্যাগনেটিক কম্পাসও নয়। অকূল সমুদ্রে আন্দাজে পথ চলা মুশকিল। কিন্তু দীপ হেসে বলল, “আমার স্যাটেলাইট ফোন আছে কী করতে?” এবার ওটার সাহায্য নিয়ে তিন ঘাগু নাবিক এগিয়ে চলল অজানা দ্বীপে।
যন্ত্র যখন দেখাল আর দশ মাইল বাকি, তারা উষ্ণ করমর্দন করে পাইলটকে বকশিস দিয়ে বিদায় নিল। কথা রইল, ওদের মেসেজ পেলে সে রওনা হয়ে ওদের আবার পিক-আপ করে নিয়ে যাবে।
উন্মুক্ত সমুদ্রে রবার বোটে যাত্রা একটা অ্যাডভেঞ্চার। দুই সাহসী নাবিক অবশ্য পিছপা নয়। চলতে চলতে তারা দ্বীপের কাছে এল। যত এগোচ্ছে কুয়াশার জালটা তত পিছু হঠছে। যেন এটা সত্যি নয়, মরীচিকার মতো এক মনের ভুল। যখন বাইতে বাইতে তারা প্রায় অবসন্ন, বোঝা গেল দ্বীপটা এবার ধরাছোঁয়ার মধ্যে এসেছে।
এমন সময় একটা বিভ্রাট হল। উপকূলে সমুদ্র অশান্ত। একটা দুরন্ত ঢেউ এসে তাদের বোটটাকে উলটে দিল। অনেক কষ্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা অধিকাংশ মালপত্র উদ্ধার করল। সেখানে জল অগভীর। হেঁটে হেঁটে অত্যাবশ্যক জিনিসগুলি উপকূলে রাখতে রাখতে হঠাৎ একটা চোরা স্রোতের টানে বোটটা বাইরের সমুদ্রে পড়ে মিলিয়ে গেল।
বিপর্যয়টার তাৎপর্য মাথায় ঢোকার আগেই দীপ দেখল, তার স্যাটেলাইট ফোন সিগন্যাল পাচ্ছে না। কী হল? জীবনপণ করেও সে ফোন আর ব্যাটারি প্যাকে জল লাগতে দেয়নি। ফোন কাজও করছে। শুধু সিগন্যাল নেই।
“শিট, শিট!” বার বার যন্ত্রটা নেড়েচেড়ে, ঠুকে দেখতে লাগল দীপ। বৃথাই চেষ্টা! হঠাৎ মালুম হল, এই জনহীন দ্বীপে তারা এখন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগহীন।
“কাম অন, বস!” লিওনার্দো উৎসাহ দিয়ে বলল, “দিয়েগো খুব দায়িত্বশীল। আমরা দু-একদিনের মধ্যে খবর না পাঠালে নিশ্চয়ই অথরিটিকে বলে রেসকিউ টিম পাঠাবে।”
“বেশ!” অনেক কষ্টে মুখে হাসি এনে বলল দীপ, “আপাতত চলো এগোই। যার জন্য এসেছি, অন্তত এই দ্বীপের ভূতের রহস্যের সমাধান হলে মরেও শান্তি পাব।”
প্রথমে স্বল্প প্রাতরাশ। তারপর দুজন পিঠে বোঝা নিয়ে এগিয়ে চলল। ইতিমধ্যে দীপ দেখে নিয়েছে দ্বীপে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা একটু বেশি, তবে বিপদসীমার নীচে। বেলা বাড়ছে। একটু পর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তারা দেখল, কুয়াশার দেওয়ালটা এখন বার-দরিয়ায় আর এবার বহির্বিশ্বকে তাদের দৃষ্টির থেকে লুকিয়ে ফেলেছে।
দ্বীপের মাটি রুক্ষ, পাথুরে। সেখানে জন্মেছে শুধু কঠিন প্রকৃতির কিছু ঘাস ও ঝোপঝাড়। অনেক খুঁজেও এখনো মানুষ, জানোয়ার বা অতিপ্রাকৃত কিছুর খোঁজ মেলেনি। সূর্য মাথায় চড়ছে। ঘণ্টা কয়েক পর তারা ক্লান্ত হয়ে ওর মধ্যেই একফালি ছায়া খুঁজে একটু বসে কিছু খেয়ে নিল। তারপর কখন যে চোখের পাতা জুড়িয়ে এসেছে জানে না।
ঘুম ভাঙল প্রায় অতীন্দ্রিয় এক অনুভূতিতে। মনে হচ্ছে, বিপদ, ভীষণ বিপদ! ধড়মড়িয়ে উঠে বসল দীপ। উঠে পড়েছে লিওনার্দোও। সে বাতাসে কীসের গন্ধ শুঁকল। তারপর সমুদ্রের দিকে আঙুল তুলে বলল, “দ্যাখো।”
দীপ সভয়ে দেখল, দূর আকাশে একটা কালো ফানেল। সেটা এদিকেই ধীরেসুস্থে এগিয়ে আসছে। অভিজ্ঞ জাহাজির বুঝতে অসুবিধে হল না, এক ভয়ংকর টর্নেডো। এটার ব্যাপ্তি সামান্যই, দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু তার মধ্যেই যাত্রাপথে যা পড়বে তছনছ করে দিয়ে যাবে। এই প্রায় উন্মুক্ত প্রান্তরের বুকে তারা খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে।
একটা আশ্রয় দরকার, কোনোমতে মাথা গোঁজার একটা পাকাপোক্ত ছাউনি। কিন্তু এই জনহীন দ্বীপে তা কোথায়? হঠাৎ যেন দূরে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল একটা বাড়ির অবয়ব। দুরন্ত আশায় ভর করে দুজন পাগলের মতো সেদিকে ছুটল। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দীপের পায়ের তলার মাটি সরে গেল আর সে এক গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেল। মুহূর্তে জ্ঞান হারাল।
***
জ্ঞান ফিরলে দীপ দেখল, এক ছোট্ট খাটে শুয়ে। পাশের একটা খাটে আধশোয়া লিওনার্দো পিটপিটিয়ে তাকে দেখছে।
“ভূতগুলো আবার আসছে।” সে ফিসফিসিয়ে বলল, “পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলখাল্লায় সর্বাঙ্গ ঢাকা মুখোশপরা দুজন মানুষ ঘরে ঢুকল। দীপের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলল, “জ্ঞান ফিরেছে।”
“ভূত নয়, টেররিস্ট।” দীপও ফিসফিসিয়েই বলল।
কিন্তু ওরা শুনে ফেলেছে!
“একদম বাজে বকবে না।” একজন ধমকে উঠল।
“তবে আপনারা কারা?”
“এসে যখন পড়েছ, জানতেও পারবে। আগে খেয়েদেয়ে একটু সুস্থ হও।”
একটা লম্বা টেবিল। তার দু-ধারে জনা দশেক আলখাল্লা পরা, মুখঢাকা মানুষ আর ওরা দুজন। টেবিলের শীর্ষে বসা মানুষটি ব্যক্তিত্বব্যঞ্জকভাবে হাত নেড়ে বললেন, “টেররিস্ট আমরা নই, তোমরা। আমরা তোমাদের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।”
টিপিক্যাল উন্মাদ আদর্শবাদীদের কথা, যারা নিজেদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সপক্ষে কোনো একটা অজুহাত খাড়া করে। তবু এদের হাতেই পড়েছে, তাই দীপ নরম সুরে বলল, “কেন, আমরা কী করলাম?”
“অর্থ আর ক্ষমতার লোভে তোমরা প্রতিদিন পরিবেশকে ধ্বংস করে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলছ। আমরা বিভিন্ন দেশের কিছু নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী সেই বিষগুলি দূর করে পৃথিবীকে আবার বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।”
“এ তো অতি মহৎ কাজ, পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানীই করছেন। কিন্তু আপনারা সেটা এভাবে লুকিয়ে করছেন কেন?” দীপের স্বরে সংশয়।
“করছি, কারণ বাইরের পৃথিবীতে যখনই আমরা এই কাজগুলি করতে গেছি আমাদের অজস্র বাধার সামনে পড়তে হয়েছে। ওই অর্থ আর ক্ষমতা—ঘুষ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে আমাদের পথভ্রষ্ট করতে চেয়েছে। তাই আমরা এখানে পালিয়ে এসে দলবদ্ধভাবে কাজ করছি।”
“ফ্রন্ট লাইন রিসার্চে অনেক অর্থ, উপকরণ ও মানবসম্পদ লাগে। এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় ভূগর্ভে বসে আপনারা সে-সব পাবেন কীভাবে?”
“পাব নয়, পেয়েছি। অনেক আলোকপ্রাপ্ত ধনী আমাদের স্পনসর। অনেক ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ানও আমাদের দলে, যাদের প্রাথমিকভাবে এনে কয়েক বছরে আমরা এই পাতালপুরী তৈরি করেছি। সময় থাকলে তোমরা স্বচক্ষে দেখেই বুঝবে করা যায় কি না।”
“কিন্তু এখানে আপনারা গোপনীয়তা রক্ষা করেন কীভাবে? যে কেউ তো এসে পড়তে পারে।”
“এখানে তেজস্ক্রিয়তার ভয়। কৌশলে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচার করে আমরা ভয়টা বাড়িয়ে তুলেছি। তারপর, ওই ভূতের ভয়।”
“আরে, আমরা তো ভয়ে নয়, ওই কৌতূহলেই এসেছি। এখন কি প্লিজ বলবেন, ব্যাপারটা কী?”
“বেশ, বলছি। তোমাদের নাম?”
“আমি দীপ, ইন্ডিয়ান। আর ও লিওনার্দো, স্প্যানিয়ার্ড।”
“তা লিওনার্দো, তোমার ইংরেজিতে অসুবিধে নেই তো?”
“উঁহু, আপনি বলে যান।”
“তোমরা হলোগ্রাফির কথা শুনেছ?”
“শুনেছি।” দীপ বলল, “ওই যাতে কালো চশমা পরে কোনো ছবিকে ত্রিমাত্রিকভাবে দেখা যায়।”
“তার চেয়েও বেশি। আমাদের লেজার হলোগ্রাফিতে প্রজেক্টর থেকে প্রক্ষিপ্ত ছবিগুলি খালি চোখেই আকাশপটে দেখা যায়। এমন অনেকগুলি প্রজেক্টরে আমরা সারারাত নানা ভৌতিক ছবি আকাশে দেখাই। নানা আলোক-বিভ্রম তৈরি করে কুয়াশার পর্দায় সব ঢেকে ফেলার চেষ্টা করি।”
“আমার স্যাটেলাইট ফোন এখানে সিগন্যাল পাচ্ছে না।” দীপ বিড়বিড়িয়ে বলল।
“আমাদের ইলেকট্রনিক কাউন্টার-মেজারের জন্য। এভাবে আমরা স্যাটেলাইট থেকে পাঠানো সিগন্যালগুলি বিগড়ে দিয়ে ওদের দেখাতে চাই এই দ্বীপে গাছপালা, জনপ্রাণী কিছু নেই—যাতে কেউ আসতে আগ্রহী না হয়। তোমাদের মতো অতি কৌতূহলী কাউকে অবশ্য আগে পাইনি।”
“কিন্তু ওই ঝড়ের পাল্লায় পড়ে পাগলের মতো না ছুটলে তো আমরাও আপনাদের আস্তানার সন্ধান পেতাম না।”
“তোমরা ভাবোটা কী? তোমরা দ্বীপের কাছাকাছি আসার পরই আমাদের ইলেকট্রনিক নজরদারিতে পড়ে গেছ। তোমাদের বোট ওলটানো, সিগন্যাল না পাওয়া, ঝড়ের পাল্লায় পড়া—সবই আমাদের ক্যামেরা ট্র্যাক করেছে। তোমরা দৈবাৎ এখানে এসে পড়োনি, আমরা ওই বাড়ির মরীচিকা দেখিয়ে তোমাদের আমাদের ট্র্যাপ-ডোরগুলির একটার ওপর নিয়ে আসি। এই দ্বীপের ধারেকাছে কেউ এলে তার দায়িত্বও আমাদের।”
“বুঝলাম। কিন্তু এতসব দুর্ধর্ষ কারিগরি প্রয়োগ করে আপনারা কী মহান রিসার্চকে রক্ষা করছেন?”
এবার দ্বিতীয় এক মুখোশধারী মুখ খুললেন। গলার স্বরে বোঝা যায়, মহিলা।
“মহান নয়, সামান্য কিছু প্রচেষ্টা। এটা দিয়েই আমাদের শুরু। এরপরেও আমরা পরিবেশ দূষণ দূর করতে আরো নানা পদক্ষেপ নেব। তোমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড জানি না। তোমরা কি সালোকসংশ্লেষ জানো?”
লিওনার্দোর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দীপ বলল, “আমরা দুজনেই টেকনিক্যাল লাইনের। তবে স্কুল অবধি বিজ্ঞান পড়েছি, ওটা জানি। অর্থাৎ সূর্যের আলো ও বায়ুমণ্ডলের জলের সাহায্যে গাছ যেভাবে তার খাবার তৈরি করে।”
“অর্ধেকেরও কম জানো। প্রথমত, গাছের খাবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আমাদেরও খাবার। দ্বিতীয়ত, সালোকসংশ্লেষে গাছ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমিয়ে অক্সিজেন বাড়িয়ে আমাদের বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু সেই গাছকে তোমরা নিজেদের সাময়িক স্বার্থে নির্বিচারে ধ্বংস করছ। সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ। এখানকার কথাই ধরো। উষ্ণ মণ্ডলের এই দ্বীপে পাগলের মতো গাছপালা জন্মাত। কিন্তু এখন তেজস্ক্রিয় বর্জ্যের কল্যাণে বহু দশক এখানে ঝোপঝাড় ছাড়া কিছু জন্মাবে না। সব মিলিয়ে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ এত বাড়ছে যে শিগগিরই উষ্ণায়ন ছাড়ো, আমরা ভালোভাবে নিঃশ্বাসই নিতে পারব না। এই বিষ দূর করতে আমরা কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষ নিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছি। এ নিয়ে গবেষণা অনেক হয়েছে, আমরা চাইছি তাকে বাস্তবে বড়ো মাত্রায় প্রয়োগ করতে। চলো, দেখাচ্ছি।”
মুখোশধারী এবার ওদের দুজনকে কিছু অলিগলির মধ্য দিয়ে একটা হলঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটা বোতাম টিপতেই ছাদটা প্রায় সরে গিয়ে দেখা দিল অজস্র স্কাই লাইটের মতো কাচের জানালা। উজ্জ্বল রোদ ঘরের যেখানে এসে পড়ল, সেখানে রয়েছে অনেকগুলি সোলার প্যানেলের মতো প্যানেল।
“সালোকসংশ্লেষের দুটি পর্যায়। প্রথমে সূর্যালোক ও গাছের পাতার ক্লোরোফিল অনুঘটকের উপস্থিতিতে জল থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদা হয়। ওই অক্সিজেন বাতাসে মিশে যায়। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে সূর্যালোক ছাড়াই উন্মুক্ত হাইড্রোজেন বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে মিলে গাছের এবং আমাদের খাদ্য গ্লুকোজ তৈরি করে।
“গাছ ঝাড়েবংশে সাফ হচ্ছে। তাই ওই কাজগুলিকে কৃত্রিমভাবে করে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমিয়ে অক্সিজেন বাড়ানোর চেষ্টা অনেকদিনের। ক্লোরোফিলের বদলে নানা রাসায়নিক পদার্থ অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তার মধ্যে একটা…”
“টাইটেনিয়াম অক্সাইড। টাইটেনিয়াম আপনারা এই অঞ্চলে অনেক পাবেন।” উত্তেজিতভাবে বলে উঠল দীপ।
“বাহ্, জানো দেখছি!” এতক্ষণে মুখোশধারীর কথায় সম্ভ্রম, “তবে শোনো, আমরা আরো একধাপ এগিয়েছি। যতই পাওয়া যাক, টাইটেনিয়ামের ভান্ডার অফুরন্ত নয়। কিন্তু গাছের অভাব পূর্ণ করতে কৃত্রিম অনুঘটকের জোগান হতে হবে কার্যত সীমাহীন। তাই আমরা ক্লোরোফিলটাই কৃত্রিমভাবে তৈরি করছি। ক্লোরোফিল হচ্ছে কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন আর ম্যাগনেসিয়ামের যৌগ। এর মধ্যে প্রকৃতিতে জৈব পদার্থে কার্বন, অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন অফুরন্ত। বাতাসে নাইট্রোজেনও প্রায় তাই। বাকি ম্যাগনেসিয়াম। তা, সেটাও আছে মাটিতে। তার থেকে নিষ্কাশন অবশ্য তত সহজ নয়। কিন্তু…”
“আপনারা সমুদ্রের কাছে যান।” উত্তেজতভাবে বলে উঠল লিওনার্দো, “সমুদ্রই ম্যাগনেসিয়ামের অফুরন্ত ভান্ডার।”
দীপ চমকে তার দিকে তাকাল। মুখোশধারীও অবাক হয়ে বললেন, “নাবিক, তুমি এসব জানো?”
“আমি এককালে ওশানোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য ডিগ্রি না নিয়েই নাবিকের কাজে লেগে যাই।”
মুখোশধারী তার পিঠ চাপড়ে বললেন, “ডিগ্রি ছাড়াও পড়াশোনা হয়। শেখার শেষ নেই আর তা কখনো বিফল হয় না। তুমি একদম ঠিক বলেছ। আমরাও মাটি ছাড়া সমুদ্রের থেকে ম্যাগনেসিয়াম আহরণে মন দিয়েছি। এই দ্বীপের তলা দিয়ে অজস্র সুড়ঙ্গ গিয়ে সমুদ্রে মিশেছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে স্কুবা ডাইভিং করে আমরা সেখানে নেমে তথ্য আর স্যাম্পল জোগাড় করছি। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা তার থেকে ব্যাপক হারে ম্যাগনেসিয়াম নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করবে। এই সমুদ্র থেকে আমরা খাদ্যও আহরণ করছি।”
“এতসব আপনারা করছেন শুধু বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমিয়ে অক্সিজেন বাড়াবার জন্য?”
“না। হাইড্রোকার্বন ভিত্তিক ফসিল জ্বালানি কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। তার বিকল্প পরিচ্ছন্ন জ্বালানি হিসেবে এখন হাইড্রোজেনের নাম উঠে আসছে। জলের কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষ সৌরশক্তির সাহায্যে জলকে বিশ্লিষ্ট করে হাইড্রোজেন নির্গত করার এক সহজ উপায়। সমুদ্রে জলের ভান্ডার অফুরন্ত, সৌরশক্তিও অপর্যাপ্ত। তাই উৎপন্ন হাইড্রোজেনের একাংশ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে পৃথিবীর পরিচ্ছন্ন শক্তির চাহিদা মিটিয়েও বাড়তি হাইড্রোজেনটুকু পরের ধাপে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে যুক্ত করে জৈব খাদ্য তৈরির কাজে লাগানো যাবে। খাদ্য বানাতে গাছ মাটি থেকে নানা সারবস্তুও আহরণ করে। কৃত্রিম ‘গাছ’কে সে-সব দেওয়ার ব্যবস্থাও আমরা করছি।”
“বাহ্!” মুগ্ধ দীপ বলল, “এবার?”
“চলো, আবার টেবিলে ফিরে যাব।”
“কেমন বুঝলে?” জিজ্ঞেস করলেন একজন মুখোশধারী।
“ফ্যান-টাস-টিক!” একসঙ্গে বলে উঠল দীপ ও লিওনার্দো। তারপর দীপ যোগ করল, “আপনাদের কি এটাই একমাত্র কাজ?”
“না। আমাদের এমন আরো অনেক গোপন সেন্টার আছে। সেগুলোতে নানারকমের কাজ হয়। তার সবেরই উদ্দেশ্য এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা।”
“সেগুলো কি সবই এমন…”
“নিরালা দ্বীপে? না, কয়েকটি আছে সভ্যতার কেন্দ্রস্থলে। কিন্তু না জানলে তুমি খুঁজে পাবে না।”
“কিছু মনে করবেন না, আপনারা মূলত কোন দেশের?”
“আমাদের কোনো দেশ, জাত, ধর্ম নেই। আমরা আন্তর্জাতিক, পৃথিবীর যে-সব দেশে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় তাদের সবার থেকেই আমাদের লোক আছেন। যেমন, তোমাদের ভারত আর স্পেন থেকে। শুধু সর্বোপরি একজন আছেন, ওই যে টেবিলের মাথায় বসে, তিনি আমাদের শিক্ষক বা মেন্টর। প্রতি পদক্ষেপে আমাদের একধাপ এগোবার দিশারী।”
“আমরা কি তাঁর সঙ্গে একবার হাত মেলাতে পারি?”
মুখোশধারী হেসে বললেন, “না। কারণ এটা ওঁর প্রক্ষিপ্ত ভারচুয়াল ইমেজ।”
“প্রক্ষিপ্ত… কোথা থেকে?”
আবার হেসে বললেন মুখোশধারী, “থাক, বললে তোমরা ভয় পেতে পার।”
“এলিয়েন?” উত্তেজিতভাবে বলে উঠল দীপ, “ওহ্, উনি তবে পৃথিবী রক্ষার মিশন নিয়ে বহির্বিশ্ব থেকে এসেছেন, উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এখানে প্রতিষ্ঠা করতে?”
“ঠিক তা নয়। উনি বাইরের, আবার আমাদের ভেতরের। উনি শিক্ষক, আর প্রকৃত শিক্ষক কখনো ছাত্রদের অঙ্কটা কষে দেন না, তাদের একধাপ সামনে থেকে তাদের সেটা কষতে শেখান। হ্যাঁ, মাত্র একধাপ সামনে থেকে।”
“ভূতুড়ে দ্বীপের একমাত্র ভূত।” লিওনার্দো দীপের কানে ফিসফিসিয়ে বলল।
“তাহলে সন্দেহের নিরসন ঘটল? নইলে আরো কিছুদিন থেকে যাও।”
“মাফ করবেন।” দীপ বলল, “আমরা এবার ফিরব। আমাদের জাহাজ কয়েকদিন পরই ছাড়বে। অবশ্য কীভাবে ফিরব সেটাই সমস্যা।”
“কোনো ব্যাপার নয়। তোমাদের ডিঙি ভেসে গিয়েছে? ভয় নেই, সমুদ্র যা নেয় প্রায়ই তা ফিরিয়ে দেয়। ওটা এখন আমাদের তত্ত্বাবধানেই আছে। তোমার স্যাটেলাইট ফোনের সিগন্যালও সাময়িকভাবে চালু করছি, যোগাযোগ করে স্পিড বোট ডেকে নাও।”
করমর্দনের পর দীপ বলল, “ইচ্ছে করছে আপনাদের প্রচেষ্টায় সামিল হতে।”
“খুব ভালো! মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আর ওশানোলজিস্ট দুই-ই তো আমাদের ভীষণভাবে দরকার।”
“তবে একটু সময় চাই।”
“বেশ, যখন হয় মাজুরো চলে এস। আমরা তোমাদের খুঁজে নেব। এরপর এসে দেখবে, এই পাতালপুরী স্বনির্ভর। প্রয়োজনীয় খাদ্য, শক্তি ও বায়ুশোধনের ব্যবস্থা আমরা কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষ থেকেই করছি।”
“আপনারা সফল হোন!” গাঢ়স্বরে বলল দীপ।
“কিন্তু ফিরে গিয়ে ভূতের ব্যাপারে কী বলবে?”
“আপনি জানেন।” দীপের মুখ উদ্ভাসিত।
***
না, এরপর কোনো অসুবিধা হয়নি। বোটচালকের জিজ্ঞাসার উত্তরে লিওনার্দো বলেছিল, “পাগল, ওখানকার ছায়াও মাড়িও না। ভূত তো আমাদেরও ধরেছিল। তাদের পায়ে পড়ে আর কোনোদিন আসব না বলায় দয়া করে ছেড়ে দিল।”
আর ক্যাপ্টেনকে দীপ বলেছিল, “দূর, ওসব অপটিকাল ইলিউশন। তবে সত্যিই ওই দ্বীপে রেডিয়েশন এখনো অত্যধিক, মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক। তাই তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম।”
ফেরার পথে ডেকে দাঁড়িয়ে দুজনে ‘ভূতুড়ে দ্বীপ’-এর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, যা দেখল তা সত্যি, না স্বপ্ন? আবার কি কখনো তারা ওই অদ্ভুতুড়ে দ্বীপে যাবে?
অলঙ্করণ- স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস