গল্প-ক্যালাইডোস্কোপ-রঞ্জন দাশগুপ্ত-বর্ষা ২০২১

golpocaleidoscope

ক্যালাইডোস্কোপ (Kaleidoscope) কাকে বলে তোমাদের মধ্যে অনেকেই জেনে ফেলেছ। আবার অনেকেই হয়তো কোনোদিন নামই শোননি। তাতে লজ্জার কিছু নেই। কারণ, এখন তো আর এটা তেমন দেখাই যায় না। এখন তোমাদের চোখের সামনে টিভিতে কার্টুন চ্যানেল। হাতে নিত্যনতুন ভিডিও গেম। আমাদের ছোটবেলায় এসব ছিল না। তখন ক্যালাইডোস্কোপ ছিল আমাদের কাছে দারুণ একটা আমোদের জিনিস।
এটার মধ্যে তেমন কারিকুরি কিছু নেই। একটা ছোট্ট নলের মতো জিনিস থাকে। তার ভিতরে একপ্রান্তে ছোট্ট একটা ফুটো দিয়ে সামান্য আলো আসে। আর সেদিকেই নলটার ভিতরে থাকে ত্রিভুজের আকারে লাগানো তিনটে আয়না। আর তার সামনে রংবেরঙের কাচের চুড়ি ভাঙা। উলটোদিকের আরেকটা ফুটোতে চোখ রেখে তাকালে দারুণ দারুণ সব রঙিন ডিজাইন দেখা যায়। নলটা ঘোরালে চুড়ির টুকরোগুলোও ঘোরে। ডিজাইন বদলে বদলে যায়। একেবারে সাধারণ বিজ্ঞান। তবে এই সামান্য জিনিসটা নিয়েই বড়ো আতান্তরে পড়ে গিয়েছিল রোশনাই। যাকে নিয়ে আজ আমাদের গল্প। মানে সত্যি ঘটনা!
রোশনাইয়ের বাবা রাজ্য সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। আর কাজের সুবিধার জন্য তিনি থাকেন কলকাতাতেই। রোশনাইও কলকাতার একটা নামি স্কুলে পড়াশোনা করে। গোলপার্ক যেতে একটা বড়ো উড়ালপুল আছে। তার কাছাকাছি ওদের তিন কামরার ফ্ল্যাট। দিনের বেলাতেও যে খুব একটা রোদ-টোদ ঢোকে তা নয়। তবে সবই তো অভ্যেসের ব্যাপার! সবচেয়ে বড়ো কথা, ওদের পাড়াতে ওর অনেক বন্ধু। আর সেখানে দুর্গাপুজোটা হয় খুব জমজমাট। বিশাল প্যান্ডেল। প্রচুর লাইট। দারুণ প্রতিমা। আর দোকানই বসে কতরকমের। টিভিতেও পুজোটা দেখায়। মানে যাকে বলে হইহই ব্যাপার। তাই দুর্গাপুজোতে রোশনাই কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। কিন্তু তা হলে হবে কী! রোশনাইয়ের বাবার আবার পুজোর সময় বাঁকুড়াতে দেশের বাড়ি যাওয়া চাই-ই। ঠাকুমা সেখানে থাকেন কিনা। তাছাড়া ওর কাকু-কাকিমা। কাকু চাষবাস সব দেখেন।
একেবারে প্রত্যন্ত এলাকা। ওখানে দুর্গাপুজোর সময় মুগ ডাল আর গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি হয়। সবজি, চাটনি, পায়েস আর বোঁদে। এই বোঁদে জিনিসটা রোশনাইয়ের একদম ভালো লাগে না। কিন্তু ওখানের লোকজনের আবার বোঁদের প্রতি প্রচণ্ড ভক্তি! আর বাড়িতে হয় লালচে ঢেঁকি-ছাঁটা চালের ভাত। সেটা কলকাতার ঝকঝকে সাদা, পাতলা পাতলা, সুন্দর কিন্তু বিস্বাদ চালের মতো নয়। বরং অনেক বেশি সুস্বাদু। তার সঙ্গে মুসুরির ডাল, বড়ি-আলু-পোস্ত আর পুকুরের টাটকা মাছের ঝাল। ঘরময় আঁশটে গন্ধ ওঠে। ম্যানেজ করে নিতে হয়। তবে মশা নেই ওই গাঁয়ে।
সবচেয়ে মজার হল ওখানের বাড়িটা। বিরাট উঠোনের একদিকে টিনের চালের একটা বড়ো পাকা ঘর আছে। এককোণে খড়ে ছাওয়া গোয়াল আর অন্যদিকে খড়ে ছাওয়া মাটির রান্নাঘর আছে। তবে মূল বাড়িটা হল মাটির দোতলা। দেখেছ কোনোদিন? দেখোনি! সে এক দারুণ ব্যাপার। উপর-নীচে চারটে ঘর। ছাদটা তালগাছের গুঁড়ি দিয়ে ধরা। তালগাছ পোকায় কাটে না কিনা। তাই। হাঁটলে কীরকমের একটা গুমগুম শব্দ হয়।
ওখানে গোটা বাড়ির মধ্যে ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশন আছে কেবলমাত্র টিনের চালের পাকা ঘরটাতে। সেই ঘরেই ছোটোমতো একটা টিভিও আছে। বাকি ঘরে আবার সোলার লাইট। রান্না হয় গোবর গ্যাসে। একটা বিরাট গর্তের মধ্যে গোবর ফেলা হয়। সেখানে একটু গন্ধ ওঠে। পাইপ বেয়ে গ্যাস আসে। ওই গ্যাসে ছোটোখাটো রান্না হয়। বাতিও জ্বলে। যদিও আলোটা একটু কম আর মাঝে মাঝে কাঁপে। ফ্যান চলে না। তবে চারদিকে প্রচুর গাছগাছালি। গরম লাগে না সেরকম।
ছোটো একটা নদীও আছে। তেমন স্রোত নেই তাতে আর উপরে ছোট্টমতো একটা ব্রিজ। তার থামের কাছে নদীর জল ঘুরপাক খায়। গ্রামের বড়ো দাদারা সেখানে হাত দিয়ে মাছ ধরে। স্নান করতেও দারুণ মজা লাগে।
সবচেয়ে মজার জিনিস অবশ্য ওদের ঘরের পিছনের কয়েতবেল গাছগুলো। সাদা সাদা, অদ্ভুত তাদের গুঁড়ি। আর কয়েতবেলের শাঁস একটু তেঁতুল, কাঁচা লঙ্কা, নুন, অল্প চিনি দিয়ে রোদে ফেলে তারপর খেতে যা লাগে! আমার তো ভেবেই গালটা ব্যথা ব্যথা করছে।
এতসব মজা থাকা সত্ত্বেও দেশের বাড়িতে রোশনাইয়ের যেতে না চাওয়ার পিছনে কলকাতার পুজোর আনন্দ ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার আছে। সে হল নানকু! ওর কাকুর একমাত্র ছেলে। রোশনাইয়ের একমাত্র ভাই।
ভাই হলে হবে কী, নানকু বড্ড দুষ্টু। এই তো আগের বছরই পুজোর সময় ওরা দেশের বাড়িতে গিয়েছিল। নানকু রোশনাইয়ের চুল ছিঁড়ে, কানে ধুলো ঢেলে, ঢিল ছুড়ে একাকার কাণ্ড করেছিল। নদীতে স্নান সারার সময় আঁজলা করে জল পর্যন্ত ছুড়েছিল। তাই এবার আর রোশনাইয়ের ওখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না।
দুঃখের ব্যাপার হল বাবা-মায়েরা কোনোদিন নিজের ছেলেমেয়ের কথা শোনেন না। তাই সপ্তমীর দিন সকাল সকাল উঠে বিরক্ত মুখে রোশনাইকেও বাবা আর মায়ের সঙ্গে বেরোতে হল। প্রথমে ধর্মতলা, সেখান থেকে ভলভো বাসে দুর্গাপুর। তারপর এমনি বড়ো বাস। তারপর আবার বাস আর তারপর লড়ঝড়ে একটা ‘জঙ্ঘা’ গাড়িতে চেপে, (সেগুলোর আসল নাম কী কী জানি। বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদেশি সৈনিকেরা ফেলে গিয়েছিল। তারপর এখনো এদিকের লোকেরা ব্যবহার করে।) শেষমেশ বেলা আড়াইটেতে ওরা পৌঁছল বাবাদের দেশের বাড়িতে।
নানকুকে কিন্তু রোশনাই প্রথমে চিনতেই পারেনি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। গ্রামের মাঝের মাটির রাস্তা ধরে ওদের হেঁটে আসতে দেখে দৌড়ে এল। রোশনাইয়ের হাত ধরে একমুখ হেসে বলল, “দিদিভাই!”
অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। খাড়া খাড়া চুলগুলো পর্যন্ত বসে গেছে। একবছর আগের দুষ্টু ছেলেটাকে এখন চেনাই যায় না।
কাকুও দরজার কাছে চলে এসেছিলেন। হেসে মাকে বললেন, “ওই দেখো বৌদি, আরেকজনের কাণ্ড! সকাল থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে। খালি বলে দিদিভাইরা কখন আসবে! এখনো এল না কেন! রাতে বোধ হয় ভালো করে ঘুমোয়ওনি। প্রশ্ন করে করে জেরবার করে দিল।”
শুনে বাবা বড়ো বড়ো চোখে রোশনাইয়ের দিকে তাকিয়ে, বোধ হয় মনে মনে ওকে ধমকে, পকেট থেকে মস্ত একটা চকোলেট বের করে নানকুর হাতে দিলেন। তারপর ওর মাথাটা একটু ঘেঁটে দিয়ে বললেন, “এই নে নানকু।”
নানকু বড়ো বড়ো চোখ করে বলল, “এটা আমার আর দিদিভাইয়ের জন্যে?”
মা হেসে বললেন, “না সোনা! এটা খালি তোমার জন্য।”
নানকু বলে উঠল, “না না! এটা আমরা দুজনে মিলেই খাবো।”
কাকিমা চোখ পাকিয়ে বললেন, “হয়েছে হয়েছে! ওঁরা অনেকটা পথ আসছেন। বিরক্ত কোরো না। জেঠু-জেঠি আর দিদিকে স্নান-টান সেরে একটু ফ্রেশ হয়ে দুটো ভাত খেতে দাও আগে।”
ওরা অবশ্য আগে ঠাকুমার কাছেই গেল। ঠাকুমা নীচের তলার একটা ঘরে বসে ছিলেন ওদেরই অপেক্ষায়। প্রণাম-ট্রনাম সেরে নিয়ে রোশনাই ঘেরা উঠোনের এককোণে কুয়োর পাশের কলঘরে স্নান সারতে গেল। ততক্ষণ নানকু উঠোনের মাঝের নিমগাছটার তলায় একটা মোড়ায় ঠায় বসে থাকল। এমনকি বাবা-মা ওর জন্য যে নতুন জামাপ্যান্ট নিয়ে এসেছেন, সেটাও দেখতে গেল না। এত বেলা হয়ে গেল, এখনো খায়নি পর্যন্ত। ওর সঙ্গেই খাবে।
সবারই দারুণ খিদে পেয়েছিল। তাই নীচের তলার গোবর নিকোনো মেঝেতে আসন পেতে বসে ওই ঢেঁকি-ছাঁটা চালের ভাত, করলা ভাজা, হিং দিয়ে বিউলির ডাল, কাঁচা কুমড়োর তরকারি, আলু-পোস্ত, কুচো মাছের ঝাল দিয়ে প্রচুর ভাত খাওয়া হল। রোশনাই তো কলকাতাতে থাকলে করলা, মানে ওখানে যেগুলোকে উচ্ছে বলে, খেতেই চায় না। তবে নানকু বলল, “খেয়ে নে দিদিভাই। করলা খেলে রক্ত পরিষ্কার হয়।” তখন খেয়েও ফেলল। কড়কড়ে করে ভাজা। মোটেই খারাপ লাগল না। ঠাকুমা এমনিতে চোখে ভালো দেখেন না। তবু ওদের পাশে বসে তালপাতার একটা পাখা দিয়ে নাগাড়ে বাতাস করে গেলেন।
খাওয়ার পর বাবা-মায়েরা ঘুমোলেন না। ঠাকুমার কাছে শুয়ে বসে গল্প করতে লাগলেন। এই অবেলার খাওয়ার পর ঘুমোলেই নাকি অম্বল হয়ে যাবে। বাসন্তীপিসি বাসন মাজতে গেলেন। আর রোশনাই আর নানকুর কিন্তু খুব ঘুম পেয়েছিল। ওরা দোতলায় একটা তক্তপোষে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য ডুবে গেছে। বেলা শেষের আলতো একটা আলো লেগে আকাশের গায়ে। উঠোন জুড়ে আকাশের আর গোবর গ্যাসের বাতির আলো মিলে একটা ঝিমঝিমে ভাব। চোখ ঘষতে ঘষতে নীচে নেমে রোশনাই দেখে সেখানে গুচ্ছের লোক। গ্রামে বাবার যে বন্ধুবান্ধব আছেন তাঁরা তো এসেছেনই, তার সঙ্গে কাকিমার দুই দাদা, বৌদি আর দুটো ওর থেকে একটু বড়ো দাদা আর একটা ওর বয়সী মেয়ে। তারা ওই মামুদের, মানে কাকিমার দাদাদের ছেলেমেয়ে। খুবই উপরচালাক বলে মনে হল। ওরাও গাঁয়ের পুজো দেখতে এসেছে।
নানকু আগেই উঠে পড়েছে। ওকে দেখে এগিয়ে এসে হাত ধরে ওই তিনজনের কাছে নিয়ে গিয়ে সটান বলে বসল, “এই দ্যাখ! এটা আমার দিদিভাই। কলকাতাতে থাকে আর দারুণ ছবি আঁকে।”
শুনেই রোশনাইয়ের গলা ব্যথা ব্যথা করছিল। ও জন্মেও ভালো ছবি আঁকতে পারে না। বেগুন আঁকতে গেলেও সেটা খালি স্টার, মানে তারার মতো হয়ে যায়। তাই ছাগল আঁকতে গেলে ও ভালুক আঁকা দিয়ে শুরু করে। শেষমেশ সেটা তো ওইদিকেই যাবে!
ফর্সামতো একটা চালিয়াত ছেলে, আকাশ না কী যেন নাম, সে আবার বলল, “কই, তোর দিদিভাইকে বল তো একটা ট্রেনের ছবি আঁকতে!”
শুনেই রোশনাই ঢোঁক গিলল।
নানকু অবশ্য সেদিকই মাড়াল না। বলল, “কেন! দিদিভাই কি তোর চাকর নাকি, যে যা বলবি তাই করবে! দু-দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। তা ছাড়া আঁকা একটা মুডের ব্যাপার।”
এসব বৈরিতা বেশিক্ষণ থাকল না যদিও। উপায়ও নেই কিনা। রোশনাইয়ের কলকাতার বন্ধুরা তো আর এখানে নেই। আর একটা ঘরে প্রায় সমবয়স্ক এতগুলো ছেলেমেয়ে থাকলে মিলেমিশেই থাকতে হবে। তাই শেষ বিকেলে পাঁচজন ‘একাই’ গ্রামের মেলা দেখতে বেরোল। বাবা প্রথমে একটু আপত্তি করছিলেন। বলছিলেন, “ওরা একা যাবে। যদি আবার হারিয়ে-টারিয়ে যায়!”
ঐশী নামে যে মেয়েটা, শিলিগুড়িতে থাকে, সে তখন নাক-টাক কুঁচকে বলল, “কাম অন আঙ্কল! অত ছোটোও না আমরা। সেন্ট মেরিতে ক্লাস সেভেনে পড়ি। আর এখানে একটা পুঁচকে মেলাতে হারিয়ে যাব! ডোন্ট ওরি অ্যাট অল। ওরা যদি হারিয়েও যায়, তাহলে আমিই ওদের রেস্কিউ করে নিয়ে আসব।” মহা চালিয়াত মেয়ে।
যাই হোক। কাকু মিটিমিটি হাসছিলেন। তিনি বললেন, “আরে দাদা, চিন্তা করিস না। মেলায় বেশিরভাগ তো গাঁয়ের লোক। নানকু সবাইকে চেনে। ওরাও ওকে চেনে। যেতে দে। সারাদিন কত আর ঘরে বসে থাকবে।”
বেরোন হল। কাকু সবাইকে কুড়িটা করে টাকা দিলেন। সেই ছোট্ট নদীটার পাশে এতটুকু একটা মেলা। এখানের থেকে বেশি দোকান রোশনাইদের পাড়াতেই আছে। অনেক বেশি ভালো জিনিসও পাওয়া যায়।
বেলাশেষের লালচে আলোটুকুও মিলিয়ে গেল যেতে যেতেই। সাদা রঙের মাটির রাস্তা ধরে যাচ্ছে কত লোক। নদীর হাওয়া ফুরফুর করছে চারদিকে। একটু দূর থেকেই দেখা গেল দোকানগুলোতে হ্যাজাক আর এমার্জেন্সি লাইট জ্বলে উঠছে। জায়গাটা গ্রাম থেকে একটু বাইরের দিকে। ইলেকট্রিসিটি টানার অসুবিধা।
দোকান বলতে হরেক মাল পঁচিশ টাকা, তিরিশ টাকা। ঝুটো গয়না, খেলনা এইসব। প্লাস্টিকের ঘোড়া ঘুরছে। নাগরদোলা আছে। সেটাতে অবশ্য ওরা চড়ল না। উপর থেকে নামার সময় মাথা ঘোরে। খাবার দোকানও আছে। পাঁপড়ভাজা, আলু টিকিয়া, খাজা আর চপ-শিঙাড়া।
একজায়গাতে বিক্রি হচ্ছিল ঘুগনি। ফুল প্লেট পাঁচ টাকা। হাফ প্লেট তিন টাকা। ঐশী সবাইকে হাফ প্লেট করে ঘুগনি খাওয়াল। একে দারুণ ঝাল, তার উপরে আবার কাঁচা লঙ্কা কুচি দেওয়া। যদিও টেস্ট দারুণ। এরপর রোশনাই দু-টাকা করে পাঁপড়ভাজা নিল সবার জন্য। ওর হাতে থাকল আর মাত্র দশ টাকা। এবারে সকলের জন্য পুজোর বাজার করতে গিয়ে বাবার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে বলে রোশনাই আর তাঁর কাছে কিছু চায়নি।
ঐশী আর তার দুই দাদা এবার আলাদা হয়ে গেল। ওইদিকে আলো ঝলমলে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে তারা। নানকু ওর বয়সী একটা ছেলের সঙ্গে গল্প করছে। রোশনাই দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখল। ঐশীদের সঙ্গে গেল না। ওর কাছে বেশি টাকা নেই। ওরা নানা জিনিস কিনবে। কী দরকার সঙ্গে যাওয়ার!
বড়ো করে একটা শ্বাস ফেলল রোশনাই। ওর নিজের স্কুলের, পাড়ার বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ছিল। এখনো তিন-চারদিন ওকে থাকতে হবে এখানে। কীভাবে যে সময় কাটাবে!
এলোমেলো ঘুরতে শুরু করল ও। লোকজনের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এদিক ওদিক। কত মানুষ এসেছে। কত আনন্দ করছে তারা। কেউ রোশনাইয়ের চেনা নয়।
ঘুরতে ঘুরতেই ওর চোখ পড়ল অনেক দূরে নদীর প্রায় গায়ে গায়ে ফাঁকা জায়গায় জ্বলা মিটমিটে একটা হ্যারিকেনের দিকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল ও।
সবার থেকে দূরে একা বসে আছে একজন রোগাপাতলা দুঃখী বুড়ো লোক। নদীর হাওয়ায় তার মাথার সাদা চুলগুলো উড়ছে। হ্যারিকেনের হলুদ আলো কেঁপে কেঁপে পড়ছে লোকটার আঁকিবুঁকি কাটা মুখে। সামনে চকরাবকরা একটা ছেঁড়া চাদর পাতা। তার চার কোণে চারটে আধলা ইট দিয়ে চাপা দেওয়া আছে। মাঝখানে একটা হ্যারিকেন আর নানা জিনিস। পাখির মাথার কঙ্কাল, কীসের হাড়, গুচ্ছের শুকনো শেকড়, রংচটা ছোটো বাক্স, শিশিতে কোথাকার জল। একটাও খদ্দের নেই তার আশেপাশে।
রোশনাই সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বুড়ো মানুষটা মাথা তুলল। কিন্তু তার মুখে হাসি ফুটল না। রোশনাই তখন চোখ দিয়ে খুঁজছিল ওর নেওয়ার মতো কী আছে লোকটার কাছে। নেই। কিচ্ছু নেই।
“কী নেবে খুকি?” নীচু গলায় প্রশ্ন করল লোকটা।
“আমার নেবার মতো কিছু আছে এখানে?” রোশনাই পালটা প্রশ্ন করল।
লোকটা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর মাথা নামিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল, “আমার কাছে যা আছে সব আজব জিনিস। প্রতিটার পিছনে একটা করে গল্প আছে। তবে তার মধ্যে তোমার নেওয়ার মতো কিছু নেই। খালি একটা জিনিস। দাঁড়াও।”
পাশে রাখা ঝোলার ভিতর হাত ভরে লোকটা হাতড়াতে লাগল। তারপর কী যেন একটা বার করে সেটা রোশনাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও।”
রোশনাই তাকিয়ে দেখল লোকটার হাতে একটা ছোট্ট নলের মতো জিনিস। ও অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “কী এটা?”
“এটাকে বলে ক্যালাইডোস্কোপ।”
হাত বাড়িয়ে জিনিসটা তুলল রোশনাই। নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে বলল, “ক্যালাইডোস্কোপ! নাম শুনেছি। এটার পিছনেও কি গল্প আছে?”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “এটার গল্পটা ভালো করে জানি না। মনে হয় একবার শুনেছিলাম, এটা দিয়ে মহাকাশের ফুটো দেখা যায়। কিন্তু সবাই দেখতে পায় না। কী করে যেন আমার হাতে এসে পড়েছে। তবে এই জিনিসটার সঙ্গে ছড়া আছে একটা।”
“কী ছড়া?” চোখগুলো বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করল রোশনাই।
লোকটা গলাটা ঝেড়ে নিল একবার। তারপর অদ্ভুত একটা সুর করে বলতে থাকল,
“এই পারেতে ডানকেল
আয় যদি দেখবি খেল।
আকাশ মাঝে পাহাড় ভাঙা
তার উপরে চাঁদটি রাঙা।
আট চাদরের ভিতর দিয়ে
ভোর রাত্রে সময় নিয়ে
দেখবি মহাকাশের ফুটো,
নয়টি জগৎ একটি মুঠো।
ডানকেলরা মূর্খ বড়ো
ঘর ভাঙাতে বেজায় দড়।
তিন টুকরোয় ভাঙল ঘর
ফুটো দিয়ে নজর কর।
আকাশগাড়ি দেখবে সাথে,
পৌঁছবে ঠিক দিন বা রাতে।
তিন টুকরো জুড়বে এক
ডানকেল তুই দাঁড়িয়ে দেখ।
আজকে ঘরে জায়গা নাই
এ-পার থেকেই দেখবে তাই।
হায় রে কপাল ভাঙা বাড়ি
আসবে কখন আকাশগাড়ি।”
রোশনাই খুব অবাক হচ্ছিল। মানে কী এই ছড়াটার! এরকম একটা অদ্ভুত জিনিস তার হাতে আসবে? ও হাতের মুঠোয় নলটা চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করল, “দাম কত এটার?”
“দাম তো অনেক খুকি! তবে সকাল থেকে একটা জিনিসও বিক্রি হয়নি। খাইওনি কিছু। তিরিশটা টাকা পেলে দিয়ে দেব।”
একটা ঢোঁক গিলল রোশনাই। নীচু গলায় বলল, “দশ টাকায় হবে না? আমার কাছে আর নেই।”
লোকটা মাথা নাড়িয়ে না বলল। তারপর জিনিসটা ফেরত নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল রোশনাইয়ের দিকে। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যালাইডোস্কোপটা ফেরত দিতেই যাচ্ছিল, ঠিক সে-সময় পিছন থেকে নানকুর গলা শোনা গেল, “দিদিভাই, আমার কাছে কুড়ি টাকা আছে এখনো। এই নে!”
ও মা! নানকু ওকে একা ছাড়েনি। ঠিক পিছন পিছন এসেছে। রোশনাইয়ের জিনিসটা হাতছাড়া করার ইচ্ছে ছিল না। ও লজ্জা লজ্জা মুখে ওর কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে বলল, “ঘরে গিয়ে তোকে ফেরত দিয়ে দেব। ঠিক আছে ভাই?”
“ধুর!” হাসল নানকু। “ফেরত দিবি কেন! আমি তো তোর ভাই!”
ভারি ভালো ভাই পেয়েছে রোশনাই। কী মিষ্টি আর ঠান্ডা। মনটা অনেকটা ভালো হয়ে গেল রোশনাইয়ের। ওর কোনো বন্ধুর এত মিষ্টি ভাই নেই।

রাতে খাওয়ার একটু আগে বাবা, কাকু আর দুই মামু মিলে দেখতে চাইলেন কে কী কিনেছে। ঐশী কিনেছে গুচ্ছের সাজার জিনিস। আকাশদাদা আর বুম্বাদাদা ব্যাটারি দেওয়া গাড়ি, টয়েজ। ওর জিনিসটা দেখে ঐশী আর বুম্বাদাদা কনুই দিয়ে একজন আরেকজনকে ঠেলা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। নানকুকে জিজ্ঞাসা করতে ও জানাল, ও কিছু কেনেনি। পরে কিনবে।
রোশনাই আপত্তি করে বলল, “না গো! আমরা দুজন মিলে এইটা কিনেছি।”
“কই দেখি!” কাকু খুব উৎসাহ দেখিয়ে জিনিসটা হাতে নিয়ে আলোর দিকে চোখ করে ফুটো দিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “এটা তো একটা ক্যালাইডোস্কোপ মনে হচ্ছে! দাদা, তোর মনে আছে, আমাদের ছোটবেলায় আমরাও একটা কিনেছিলাম? সেটা নিয়ে তোর আমার কত মারামারি!”
বড়ো মামু বললেন, “তোরা এবার এসব কেন কিনতে গেলি! ভালো কিছু পেলি না?”
রোশনাই তক্ষুনি ওর সঙ্গে যে ছড়াটা আছে সেটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সময়েই মা সকলকে খেতে ডাকাতে আর বলা হল না।
সবাই চলে যাওয়ার পর কাকু পিছিয়ে এসে রোশনাইকে ফিসফিস করে বললেন, “কিচ্ছু চিন্তা করিস না। কাল তোদেরকে আমি একশো করে টাকা দেব। যা ইচ্ছে কিনিস।”
চিন্তা করতে বয়েই গেছে রোশনাইয়ের। মা বলেছেন, এই বয়স থেকে বেশি সাজাগুজোর দিকে মন দেওয়া উচিত নয়। তাছাড়া সে-সব তো একদিন শেষ হয়ে যাবে। আর ব্যাটারি দেওয়া গাড়ি কি রোশনাইয়ের কম ছিল! গাদা গাদা! এখন ব্যাটারি শেষ হয়ে পড়ে আছে সব। তবে একশো টাকা পেলে ও তার থেকে অর্ধেক ভাইটাকে দিয়ে দেবে।

রাতে দারুণ ঘুম হল। দোতলার গুমগুমে ঘরে তক্তপোষের উপরে শুল আকাশদাদা আর বুম্বাদাদা। নীচে রোশনাই আর ঐশী দু-দিকে। মাঝে নানকু। একটাও মশা নেই এখানে। আর এই ঘরটাতে ফ্যান না থাকলেও দারুণ ঠান্ডা। কাকিমা একবার ঘুরে গেলেন। নানকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাব্বা! আমার নানকু তো মা ছাড়া শুতেই চায় না। আর এখন ভাইবোনেদের পেয়ে আর মায়ের নাম পর্যন্ত করে না।”
শুনে নানকুর কী লজ্জা! আর আকাশদাদারা সে নিয়ে ঠাট্টা করতে লাগল।
খুব ভালো ঘুম এসেছিল। কিন্তু শেষরাতে, যখন ভোর হব হব, তখনই একটা ধাক্কা খেয়ে রোশনাইয়ের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে তো মনেই পড়ে না কোথায় আছে। তারপর কানের কাছে নানকুর ফিসফিস শুনতে পেল, “দিদিভাই! ও দিদিভাই!”
চোখ মুছে একটু উঠে বসে রোশনাই বলল, “নানকু! কী হল রে!”
নানকু ফের ফিসফিস করে বলল, “চুপ কর। আস্তে! একটু উঠে আয় না আমার সঙ্গে।”
কী হল আবার। রোশনাই ঘুম চোখে কোনোরকমে উঠে নানকুর পিছন পিছন নীচে এল। একেবারে উঠোনে। দেখে, খিড়কির দরজাটা খোলা। নানকু কি এর আগে বাইরে বেরিয়েছিল নাকি! দুজনে চুপিচুপি বাইরে এল। বেশ ঠান্ডা সেখানে। কয়েতবেলের গাছ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। রাতের অন্ধকার মুছে আসছে। আবছা আলোতে আকাশে তারা মিটমিট করছে। কয়েতবেলের সাদা সাদা গুঁড়িগুলো অদ্ভুত লাগছে।
রোশনাইয়ের ভয় ভয় করছিল খুব। ঠাকুমা একবার নিশিডাকের গল্প বলেছিলেন। ওসবে অবশ্য ওর বিশ্বাস নেই। তবুও! নানকুকে ও চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, “কী বলছিলি রে?”
নানকু ওর হাতে ক্যালাইডোস্কোপটা তুলে দিয়ে বলল, “আট চাদরের ভিতর দিয়ে, ভোর রাত্রে সময় নিয়ে… ওই লোকটা বলেছিল না? দেখ!”
ওর ইশারামতো উত্তরে একটা মিটমিটে তারার দিকে ক্যালাইডোস্কোপটা তুলে ধরে ফুটোতে চোখ রাখল রোশনাই। আর তারপরেই ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
অসীম নীল মহাকাশ। তার মাঝে ধূসর এক পর্বতমালা। মাথার কাছে ওগুলো সাদা সাদা কী? বরফ? তারও উপরে বিশাল এক গোল তারা। তবে তারাটা বেশি উজ্জ্বল নয়। কীরকম যেন ম্লান, গোলাপি রঙের।
নানকুর দিকে তাকাল রোশনাই। ও শুকনো ঠোঁট চেটে বলল, “নলটার মাথার কাছে দেখ একটা সাদা তিরচিহ্নের মতো আছে। ওটা আর মাথার নীচের লাল দাগটা এক লাইনে এনে উত্তরদিকে তাকালেই এটা দেখা যাচ্ছে। ওই লোকটা বলেছিল না এটা দিয়ে মহাকাশের ফুটো দেখা যায়?”
“এটা কি কোনো গ্রহ?”
“জানি না দিদিভাই। ডানকেল না কার যেন কথা বলছিল। তাদের ঘর ভেঙে গিয়েছিল। এটাই নয় তো? গ্রহের ভাঙা অংশ?”
এটার উত্তর কারুরই জানা ছিল না। তবে আন্দাজ করতে দোষ কী!
মজার ব্যাপার আরো আছে। লাল দাগটা সাদা তিরচিহ্ন থেকে সরে গেলে নলটা অবিকল একটা সাধারণ ক্যালাইডোস্কোপ। তবে এই অল্প আলোতে তার রঙের ঝিলমিলানি ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। আবার লাল আর সাদা এক লাইনে এনে চাপ দিলে সেখানের ছবিটা জুম হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এক মরুভূমির মতো অঞ্চল চারদিকে। আর তার মাঝে বরফে ঢাকা পর্বত! আশ্চর্য।
ওই আকাশচুম্বী পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা একটা হ্রদ। চারদিক থেকে ঢালু জমি নেমে এসেছে জলে। সেখানে টলটলে জল। আর পর্বতের গায়ে ছোটো ছোটো গুহার মধ্যে বাস একধরনের বাঁদর জাতীয় প্রাণীর। এখান থেকে খুব ভালো বোঝা না গেলেও আন্দাজ করা যায় তাদের আকার আকৃতি অনেকটা ইতিহাসের বইতে দেখা আদিম মানবদের মতো। দু-পায়ে একটু ঝুঁকে হাঁটে। সারা শরীরে লোম। তবে জামাকাপড় পরে না।
মূল কৃতিত্ব অবশ্য নানকুর। ও একা একা ঘাঁটাঘাঁটি করে এসব বার করেছে। তবে দিনের আলো যখন পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠল, তখন আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ততক্ষণ দুই ভাইবোন ঘুম ভুলে ক্যালাইডোস্কোপটার পিছনে পড়ে থাকল।

একটা ঘরে অনেক লোকজন থাকার সুবিধে আর অসুবিধে দুটোই আছে। সুবিধে হল কেউ নজরের আড়ালে যায় না, সবার উপরে সবার নজর থাকে। আর অসুবিধেও হল, ওই যে! কখনো নজরের আড়ালে থাকা যায় না!
যেটা দেখা গেল, সকালের আলো বাড়তে আর যন্ত্রটা দিয়ে কিছু দেখা যায় না। কালো একটা পর্দা নেমে আসে। অবশ্য সামনের দিকটা ঘুরিয়ে দিলে আবার সামান্য একটা ক্যালাইডোস্কোপ। তবে নানকু আর রোশনাই দুজনে মিলে এই আশ্চর্য জিনিসটা হাতে পেয়ে ঘরের মধ্যে আলগোছে থাকল। চুপচাপ। নীরব। কারুর সঙ্গে কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না ওদের।
ঘরে অনেক লোকজন। আত্মীয়রা তো আছেই, তার সঙ্গে বাবা আর কাকুর বন্ধুরা। তবু ব্যাপারটা লুকোনো থাকল না। বড়ো মামু এসে একবার জিজ্ঞাসা করে গেলেন,”‘কী ব্যাপার নানকু! তোমরা নাকি আকাশদের সঙ্গে কথা বলছ না?”
নানকু আমতা আমতা করে বলল, “না তো মামু! কথা বলছি তো!”
একটু পরে এলেন কাকিমা। চাপা স্বরে, চোখ বড়ো করে নানকুকে বলে গেলেন, “কী অসভ্যতা শুরু করেছ নানকু! ওদের সঙ্গে কথা বলছ না শুনলাম! ছি! এরকম করলে ওরা কি আর আসবে?”
কী আর করা! ওদের সঙ্গে বেরোতেই হল। অবশ্য বেরিয়ে দেখা গেল ওরা মোটেও নানকু আর রোশনাইয়ের সঙ্গে বেশি কথা বলতেই চায় না। নিজেদের মধ্যেই হাসাহাসি করছে। কথা বলছে। নানকু আর রোশনাই সারাক্ষণ শুকনো মুখে ওদের সঙ্গে যন্ত্রের মতো ঘুরে গেল। গাঁয়ের পথ, পুরোনো ইটের দাঁত বার করা বাড়ি, নদী আর খোলা নীল আকাশে আশ্চর্য এক সাদা রোদ। যা কলকাতাতে তো দেখাই যায় না, এমনকি এই গাঁয়েও ঠিক এই সময়ে, এই দিনেই দেখা যায়।
শেষে বারোয়ারি পুজো মণ্ডপে একচালা ঠাকুর দেখা। সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে ঠাকুরের ভোগ খাওয়া। তারপর দুপুরে বিছানাতে শুতেই চোখ জড়িয়ে এল। রাতের ঘুমটা ঠিক করে হয়ইনি ওদের।

সন্ধেবেলায় যে যার নিজের মতো ঘুরে এল বাইরে। মা, কাকিমা আর মামিরা পুজো মণ্ডপের সামনে রয়ে গেলেন। বাবা, কাকু আর মামুরা স্থানীয় ক্লাবের বড়োদের আড্ডায়। ঐশী, আকাশদাদা আর বুম্বাদাদাদের সঙ্গেই ছিল ওরা দুজনে। আকাশদাদা বেজায় গল্প করতে পারে। একবার নাকি ক্রিকেট খেলার সময় এমন জোরে বল মেরেছিল, সে আকাশে উঠতে উঠতে গিয়ে পড়ল একটা মালগাড়ির মধ্যে। আর পাওয়া যায়নি। আর বুম্বাদাদা একবার ফুটবলে এমন শট মেরেছিল যে, গোলকিপার বল সমেতই জালে জড়িয়ে গিয়েছিল! ঐশীর আবার খালি সানস্ক্রিন লোশন, লিপস্টিক আর ময়েশ্চারাইজারই ধ্যানজ্ঞান।
আঁধার নেমে আসতেই আলাদা হতে হতে সরে পড়ল নানকু আর রোশনাই। দৌড়ে ফিরে এল ঘরে। ওদের মন সেখানেই পড়ে।
গোবর গ্যাসের টিমটিমে আলোতে ঘর জুড়ে রহস্যময় আলো-আঁধারি। অত বড়ো উঠোনটা ফাঁকা। সামান্য আলো এসে পড়ছে সেখানে। ঠাকুমা গুনগুন করে নিজের ঘরে হরিনাম করছেন আর বাসন্তীপিসি রান্নাশালায় লুচি ভাজছেন। তার গন্ধে ভুরভুর করছে চারদিক।
বাসন্তীপিসির ছেলেপুলে নেই। স্বামী অনেক দূরে কোথায় কাজ করেন। পুজোতে ছুটি পাননি। আর বাসন্তীপিসিও-বা কার জন্য ছুটি নেবেন! খুব গরিব তাঁরা। এখানে থাকলে দুটো খেতে পান।
উঠোনে দুজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে বাসন্তীপিসি ‘কে রে’ বলে এগিয়ে এলেন। ওদের চিনতে পেরে একটু থমকে গিয়ে বললেন, “নানকু! এখানে কী করছিস? ঠাকুর দেখতে যাসনি?”
নানকু একবার তাকাল রোশনাইয়ের দিকে। তারপর ঢোঁক গিলে বলল, “দিদিভাইয়ের তো বেশি হাঁটা অভ্যেস নেই। পা ব্যথা করছিল। তাই ফিরে এলাম।”
বাসন্তীপিসি এবার রোশনাইয়ের কপালে হাত রেখে দেখলেন। চিন্তিত মুখে বললেন, “মাথা ধরেনি তো! নতুন জায়গা। ফাঁকা উঠোনে থাকিস না বেশিক্ষণ। এ-সময় মাথায় হিম পড়ে। ঘরে গিয়ে বোস।”
উনি চলে যেতেই ওরা দুজন তড়িঘড়ি ক্যালাইডোস্কোপটা বার করল। এখন কি দেখে যাবে কিছু? এই সন্ধেবেলায়?
যাচ্ছে! যাচ্ছে! ওখানেও হয়তো এখন সন্ধেবেলা। সেখানের আকাশে তিনটে ম্লান চাঁদ। অনেক বড়ো। কিন্তু আলো বেশি নেই। তবে দেখা যায়।
কোনো বিস্ফোরণে কি এই গ্রহটা ভেঙে গিয়েছিল? জানা নেই। তবে এটা সম্ভবত কোনো গ্রহের একটা টুকরোই। সেখানে মরুভূমি আর পাহাড়ে ঘেরা একটা হ্রদকে আশ্রয় করে বাঁচার চেষ্টা করছে বাঁদর জাতীয় কিছু প্রাণী। তারা পালাতে পারেনি তাদের গ্রহ ছেড়ে। আর তাদের কঠিন সময়ের একটা লাইভ টেলিকাস্ট চলছে ক্যালাইডোস্কোপটাতে।
প্রায় শ’পাঁচেক বাঁদর জাতীয় প্রাণী থাকে পর্বতের নীচের কোটরগুলোতে। সকালে দেখা গিয়েছিল তারা খাবারের জন্য হ্রদের জল বা অন্য যে তরলই থাকুক সেটাতে, তার উপরেই নির্ভরশীল। আর অদ্ভুত শৃঙ্খলাবদ্ধ জীব তারা। ওদের কেউ হ্রদ থেকে সাপের মতো বিচিত্রদর্শন কোন প্রাণী ধরেছিল। বাঁদরদের মধ্যে যার শরীর সবচেয়ে বড়ো, সেই হয়তো ওদের নেতা। ও এগিয়ে এসে একটা পাথরের মতো জিনিসের টুকরো দিয়ে বেশ কয়েকটা খণ্ড করল প্রাণীটার। ওটা ওঠাবার সময় সকলেই আনন্দে লাফাচ্ছিল। যদিও খাবারের ভাগ পেল মাত্র কয়েকজন। বাকিরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল একপাশে।
কী এক রোগে ওদের অনেকে হয়তো মারাও যাচ্ছে। সকালেই এরকম দুটো বাঁদর মারা যাওয়াতে তাদের দেহ হ্রদে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। জল থেকে লাফিয়ে একটা অদ্ভুত প্রাণী তাদের শরীরটা গিলে নিয়েছিল অনেকটা। আরো কিছু ছোটো ছোটো জলজ প্রাণী, যদি ওটা জলই হয়, ছেঁকে ধরেছিল বাকি শরীরটাকে। হ্রদের ভিতরে আর উপরে পরস্পরের খিদে মেটাচ্ছে তারা। খাদ্যখাদকের কী বিচিত্র সম্পর্ক!
মৃতদেহগুলো হ্রদে ফেলে দেওয়াতেই রোগটা আরো বেশি ছড়াচ্ছে সম্ভবত। ছোট্ট একটা বাঁদরকে সকালবেলাতেই ছটফট করতে দেখেছিল ওরা। তারপর আর দেখা হয়নি। সে কি এখনো বেঁচে?
কম্পিত বুকে রোশনাই ক্যালাইডোস্কোপে চোখ রাখল। এবারেরটা নানকু স্যাক্রিফাইস করেছে। ও দেখবে একটু পরে। তবে তার বুকের ভিতরে কী চলছে সেটা আন্দাজ করা কঠিন নয়।
আছে। ওই বাচ্চাটিই সম্ভবত, বেঁচে আছে এখনো। হ্রদের পাশে শুয়ে আছে সে। তার মাথার কাছে বড়ো দুটো বাঁদর। একজন হয়তো মা। আরেকজন… সেই নেতাগোছের বাঁদরটি। ওর বাবা।
আরো দুটো বাঁদরের শব বিসর্জন দেওয়া হল জলে। কয়েকজনকে বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখল ওরা। যদি শব্দ পাওয়া যেত, নিশ্চয়ই বুকফাটা কান্নার আওয়াজও আসত।
হ্রদ থেকে আরেকটি প্রাণী ধরা হল বঁড়শি দিয়ে। খিদে থেমে থাকে না শত শোকের মাঝেও। অন্ধকারে ভালো বোঝা যায় না। তবে এটা অনেকটা বাদুড়ের মতো প্রাণী। যদিও আকারে অনেক বড়ো। শরীরের দু-পাশে ডানার মতো জিনিস আছে। বাচ্চার বাবা উঠে এল। টুকরো করল। এবার নিজেও পেল একটা ভাগ। কিন্তু নিজে না খেয়ে এসে দিল বাচ্চার মায়ের হাতে। সেও খেল না। উঠে গিয়ে আরেকজনের হাতে দিয়ে এল মাংসের টুকরো। বাচ্চার এই বিপদে কি মা খেতে পারে! কে বলে দয়া, মায়া, মমতা কেবল মানুষদের একচেটিয়া? সব জায়গাতেই মায়েরা একরকমের।
যেন দুধর্ষ এক রিয়ালিটি শো! পলকে পলকে কষ্ট, দুঃখ, উত্তেজনা। অসম্ভব টেনশন চলছে দুই ভাইবোনের মনে। চোখ ফেরানো যায় না।
“রোশনাই!”
বাবারা ফিরে এসেছেন। ঝটপট ক্যালাইডোস্কোপটা লুকিয়ে ফেলল নানকু। বলল, “যাই জেঠু!” একবার তাকাল রোশনাইয়ের দিকে। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল ওদের।

রাতে শুতে শুতে বেশ দেরি হয়ে গেল ওদের। অত লোকের খাওয়াদাওয়া। তারপর বেশ কিছুক্ষণ বাবা-মামুরা মিলে উঠোনে বসে গল্প করলেন। মা আর কাকিমা বাসন্তীপিসির সঙ্গে বাসন ধোওয়াতে হাত লাগালেন। তাতেও অনেক দেরি হল। বিছানায় শুয়ে ঐশী, আকাশদাদা আর বুম্বাদাদাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ছটফট করতে লাগল রোশনাই আর নানকু। তারপর কখন যেন ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেল ওদের।
ভারি দুঃখের একটা স্বপ্ন দেখছিল নানকু। দেখছিল ও ঘরে একা। বাবা, মা, জেঠু, জেঠিমা, দিদিভাই সবাই কখন যেন চলে গিয়েছে কোথায়। ও ঘরে একেবারে একা। এমনকি ঠাম্মা আর বাসন্তীপিসিও নেই। ও কেবলই কেঁদে কেঁদে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরছে। ডাকছে তাঁদের। কিন্তু সাড়া পাচ্ছে না। এখন কী করবে নানকু?
ঠিক সেই সময় উঠোনের নিমগাছটার আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে ওর মাথাতে হাত রাখল। ওর নাম ধরে ডাকল। কে, কে?
ধড়মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসল নানকু। আধো অন্ধকার এখন। আর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ওকে ডাকছে রোশনাই। কেমন যেন ধরা গলায় ও নানকুকে বলল, “আয় নানকু। দেখে যা। লাস্ট সিন চলছে!”
চুপিচুপি বিছানা ছেড়ে উঠে এল নানকু। খিড়কির দরজা দিয়ে কয়েতবেলের গাছগুলোর কাছে গিয়ে থামল। আকাশে অল্প আলোর মধ্যে মিটমিট করছে ক’টি তারা। সেই অল্প আলোতে দেখা গেল দিদিভাইয়ের চোখ ফোলা। মুখটা কাঁদো কাঁদো। বাচ্চাটা কি মারাই গেল শেষপর্যন্ত?
নিথর হয়ে পড়ে আছে বাচ্চাটির দেহ। তাকে এখন শুইয়ে দেওয়া হয়েছে হ্রদের একেবারে পাশে। পিছনে বুক চাপড়ে কাঁদছে তার মা। ওর বাবা পিছনে শ’ দেড়েক বাঁদরকে সঙ্গে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে। এই দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গত করছে ধূসর আকাশ আর মৃতপ্রায় এক তারা। বড়ো মনকেমন করা এক ছবি। এই সময় কি আমাদের পৃথিবীতেও আসবে একদিন?
আরো কিছুদিন। তারপর ওদের কেউ আর থাকবে না। মহাকাশের এক অজানা গ্রহ থেকে একেবারে মুছে যাবে অনুন্নত, কিন্তু বড়ো সভ্য এক প্রাণীগোষ্ঠী।
ফুঁপিয়ে উঠল নানকু। বাচ্চাটি তো একাই মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিল না। বহুদূরে, পৃথিবী বলে এক গ্রহের দুটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরও লড়াই ছিল এটা। যে লড়াই ওরা জিততে পারল না।
রোশনাইয়ের দিকে যন্ত্রটা এগিয়ে দিল নানকু। সেও ফুটোতে চোখ রেখে একই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিল। অদ্ভুত এক ব্যথা আর কান্নায় বুকটা ভরে যাচ্ছিল ওর।
মা-টা কাঁদছে। বাচ্চার বাবা নীচে ঝুঁকছে বাচ্চাটার শরীরটাকে তোলার জন্য। তার পিছন থেকে এগিয়ে আসছে আরো জনা দশেক প্রাণী। এই ছোট্ট শরীরটাও এবার হ্রদের গর্ভে ছুড়ে ফেলা হবে। কেউ থাকবে না! কেউ না! ওদের সবাই শেষ হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।
হঠাৎই সেই ম্লান আকাশে তীব্র এক সোনালি রঙের আলোর ঝলকানি। ও কী! ওখানের আকাশে ভাসছে তিন কোনা আকৃতির আশ্চর্য কয়েকটি জিনিস। কোনো মহাকাশযান কি? নিশ্চয়ই তাই। কারণ, এবার সেগুলো থেকে জমিতে নেমে এল সবুজ আলোর এক সিঁড়ি। আর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল আগাগোড়া অজানা কোনো পোশাকে আর হেলমেটের মতো জিনিসে ঢাকা কয়েকটা প্রাণী। তাদের হাতে নাম না জানা যন্ত্র। হাবভাব একেবারে মানুষের মতো। নীচের বাঁদরেরা ওদের দেখে সরে যায়নি। লাফালাফি করছে তারা। উত্তেজনায় রোশনাই তার বাঁ-হাতে নানকুর হাতটা চেপে ধরল।
মহাকাশযানের প্রাণীগুলোর মধ্যে একজন হ্রদের কাছে চলে গেছে। আরেকজন তার হাতের টর্চের মতো যন্ত্রটা দিয়ে বাচ্চাটার সমস্ত শরীরে অদ্ভুত এক আলো ফেলল। তাতে বাচ্চাটা কি একটু নড়ে উঠল এবার?
আরো দুজন হেলমেটে ঢাকা প্রাণী ওখানের জমিতে মস্ত কী একটা যন্ত্র বসিয়েছে। সেই যন্ত্রটা ওদের বয়েও আনতে হয়নি। নিজে নিজেই উপরের তিন কোনা জিনিসটা থেকে ভেসে নেমে এল সেটা। তার দু-পাশে বসে দুজনে কীসব আলোচনা করছে।
ওদের মধ্যে একজন চমকে উঠল হঠাৎ। তারপর ওখান থেকে সরাসরি এদিকেই যেন তাকাল সে। ক্যালাইডোস্কোপের ফুটো দিয়ে একেবারে রোশনাইয়ের দিকে। কেঁপে উঠল রোশনাই। তারপরেই সেই প্রাণীটা তার হাতের একটা লম্বা মতো যন্ত্র তাক করল এদিকে। সেটা থেকে বেরিয়ে এল তীব্র এক বেগুনি আলোর ঝলকানি। চোখ যেন ঝলসে গেল রোশনাইয়ের। আর তারপরেই…

বিরস মুখে হাতের ক্যালাইডোস্কোপটা নাড়াচাড়া করছিল রোশনাই। নানকু উদগ্রীব হয়ে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হল দিদিভাই?”
রোশনাই ওর দিকে তাকাল একবার। তারপর শুকনো মুখে জবাব দিল, “ওই গ্রহের উন্নত প্রাণীরা চলে এসেছে। ওরা বুঝতে পেরেছে যে, আমরা এদিক থেকে দেখছিলাম। লিঙ্ক কেটে দিল!” তারপর একটু দম নিয়ে বলল, “তবে একটা ভালো খবরও আছে। ওরা বাচ্চাটার চিকিৎসা শুরু করেছে। ওদের কাউকে আর মরতে হবে না।”
বলা হয়নি। রোশনাই আর নানকু আবার সেই ছোট্ট মেলাটাতে গিয়েছিল। যদিও বুড়ো লোকটার সঙ্গে দেখা হয়নি ওদের। এই মেলাতে ওর জিনিস বিক্রি হয় না। তাই হয়তো অন্য কোনো মেলাতে চলে গিয়েছে সে।

অলঙ্করণ- শিমুল সরকার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s