গল্প-বোধ-বিতস্তা ঘোষাল- বসন্ত ২০২১

বিতস্তা ঘোষালের আগের গল্প-এক যে ছিল কন্যা-, মেঘ বর্ষা ঝিলের গল্প 

জানিস ভুট, সাকসেস ফেলিওর এই শব্দগুলো খুব আপেক্ষিক। চিরকাল ফার্স্ট বেঞ্চে বসা প্রথম হওয়া ছাত্রটিই হয়তো জীবনের বিশাল রঙ্গমঞ্চে দাগ কাটতে পারল না। আর শেষ বেঞ্চে কোনোরকমে টেনেটুনে পাস করা ছাত্রীটি এমন এক কাজ করল যা স্কুলের, পরিবারের, বন্ধুবান্ধবদের মুখ উজ্জ্বল করে তুলল। কাজেই পরীক্ষার ফল নয়, ভালো করে নিজের প্রয়োজনে পড়াটা করে রাখা দরকার। তার সঙ্গে নিজেকে মানুষ হিসেবে উন্নত করে তোলাটাই প্রধান পাঠ হওয়া উচিত।

কিন্তু বড়োকাকু এখন রেজাল্ট ভালো না করলে কেউ পাত্তা দেয় না। যদিও মা তোমার মতো কথাই বলে। কখনো প্রথম হতে বলে না। চাপও দেয় না কিছুর জন্য। তবে আমার মনে হয় এত বড়ো কলেজে পড়ছি, রেজাল্ট ভালো করা দরকার।

একটা ছুটির দিন ড্রইং-রুমে বসে কাকা-ভাইজিতে আড্ডা জমেছিল সকাল সকাল। ভুটির এই কাকু থাকে বহরমপুরে। সে ভুটির বাবার খুড়তুতো ভাই। তবে যৌথ পরিবারে কে, খুড়তুতো কে নিজের এই শব্দগুলোর সঙ্গে ভুট এখনো ঠিক পরিচিত নয়। তার কাছে বড়োকাকু মানে আপন বড়োকাকু। জন্ম থেকে এর কোলেই বলতে গেলে মানুষ হয়েছে সে। তাই সে একটু বেশি মাত্রাতেই বড়োকাকুর কোল ঘেঁষা, এত বড়ো হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও।

ভুটির কথা শুনে বড়োকাকু মানে সৌপ্তিক চৌধুরি হাসল। “ভুট তুই বেশ বড়ো হয়ে গেছিস! কোন ক্লাস হল তোর?”

সেকেন্ড ইয়ার শুনে বলল, “আরে-বাস! আমার অবাক লাগছে, এই সেদিন জন্মালি, তোকে কাঁধে তুলতে গিয়ে পড়ে গেলি। আমার তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছিল।”

“কেন বড়োকাকু?” ভুট ওরফে চাঁদনী জিজ্ঞেস করল।

প্রথমত তোর কতটা চোট লেগেছে বুঝতে পারছি না, তুই কাঁদছিস না, কথা বলছিস না। চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে। এমনিতেই ওই দেখে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এ কী হল আমার জন্য! আর তারপর বৌদি একটা কথাও বলল না—সামান্য বকাবকি, চিৎকার কিচ্ছু না। আমি এত বড়ো অন্যায় করার পরও কী করে বৌদি চুপ রয়েছে ভেবে পাচ্ছিলাম না। পাগল পাগল লাগছিল।

“মা অমনই বড়োকাকু। কোনো কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কাউকেই কোনো কিছুর জন্য দোষ দেয় না। বলে, কেউ ইচ্ছে করে কিছু ঘটায় না। মানুষ পরিস্থিতির শিকার। তাই সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। খালি একটা কথার উপরেই জোর দেয়—মিথ্যে বলবে না কখনো। যাই ঘটুক, যত বড়ো ঘটনাই ঘটুক, একটাও মিথ্যে বলবে না। মনে রাখবে, একটা মিথ্যা বললে অনেকগুলো মিথ্যে পরপর বলতে হয় প্রথম কথাটা জাস্টিফাই করার জন্য। আমি একদম মিথ্যে বলতে পারি না। কেউ মিথ্যা বললে প্রচণ্ড রেগে যাই।”

“ঠিক, অনাবশ্যক মিথ্যে না বলাই ভালো। তাতে সাময়িক মুক্তি পেতে পারিস, কিন্তু তা চক্রবৎ বাড়তে থাকে সুদের মতো। তখন দেখা যায় কীসের জন্য মিথ্যে বলা শুরু করেছিলি সেটা চাপা পড়ে গেছে, অন্যগুলোর পাকে জড়িয়ে গেছিস।”

“তুমি তো দেখছি মায়ের মতোই কথা বলছ। তুমিও কি আমার মতো মায়ের দ্বারা প্রভাবিত বড়োকাকু?”

কথাটা শুনে সৌপ্তিক কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “তোর মাকে চিনি সেই দুই-তিন বছর বয়স থেকে। তখন তো বৌদি হয়নি, আমাদের দিদি। তারপর দাদার সঙ্গে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এল বউ হয়ে। জানিস তো, বহুদিন পর্যন্ত আমার মাথায় ঢুকত না দিদি কী করে বৌদি হয়! তবে সেই বয়সে তো রক্ত, বংশ এসব বুঝতাম না। শুধু ভাবতাম একই পরিবার। সেরকমই সম্পর্ক ছিল আমাদের। তোর দাদু আর আমার বাবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বাবা অধিকাংশ সময়ই তাঁর বাড়িতেই থাকত। আমরাও প্রায়ই চলে আসতাম বাড়ি থেকে। কলকাতা বলে কথা। তখন ওটাই মজা ছিল। কলকাতা শহরটা মনে হত আকাশের কাছাকাছি। সেখানকার সবই সুন্দর। আসার পর তোর মা-ই মূলত দেখাশোনা করত। ফলে একটা প্রভাব তো পড়েছেই।

“আর এই মিথ্যা কথা বলা, অকারণে প্রতিযোগিতায় নামা বাবাও পছন্দ করত না। বলত, নিজের পায়ে আত্মসম্মান বজায় রেখে দাঁড়াতে হবে। অন্যায়ের সঙ্গে আপোস নয়। দিনের শেষে যেন নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে যেন না হয়।” একটানা কথাগুলো বলে থামল সৌপ্তিক।

চাঁদনী ওরফে ভুট বলল, “তোমাদের সময়টাই অন্যরকম ছিল, বড়োকাকু। আদর্শ মেনে চলার চেষ্টা করত বেশিরভাগ মানুষই। আর এখন তো কারোর মধ্যেই কোনো আদর্শ নেই, অনুপ্রেরণা পাবার মতো কিছু নেই। তবে মা ভীষণ স্ট্রিক্ট এসব বিষয়ে। আর আমিও এ ব্যাপারে একদম মাকে মেনে চলি। মা তো জীবনে কারোর দোষ খুঁজে পায় না। কারোর সঙ্গে বিবাদ করতে পছন্দ করে না। জানো, আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হলে মা বলে, ‘চাঁদনী, কারোর ভালোবাসা পেতে গেলে তার সমালোচনা করবে না। সে তোমাকে কষ্ট দিলে চুপ করে সরে আসবে। যদি তুমি কোনো অন্যায় না করে থাকো তবে সে তোমার কাছে এসে সরি বলবেই।”

সৌপ্তিক বলল, “শোন, তাহলে আজ একটা কথা তোর কাছে বলি। সত্যি ঘটনা। আমার জীবনের। একমাত্র বাবাকেই বলেছিলাম কথাটা। আর তারপর তোকে বলছি।”

চাঁদনী এতক্ষণ কানে হেড-ফোন দিয়ে মোবাইলে বন্ধুদের সঙ্গে টুকটাক চ্যাট করতে করতে কথা বলছিল। বড়োকাকুর জীবনের সত্য ঘটনা শোনার জন্য কান থেকে হেড-ফোন খুলে কাউকে না বলা গল্পটা শোনার প্রস্তুতি নিল।

গল্প শোনা অবশ্য তার কাছে নেশার মতো। মা-ঠাকুমার কোলে গা ঘেঁষে সে ছোটো থেকেই চোখ বড়ো বড়ো করে গল্প শোনে। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, রাজা-রানি, রাক্ষস-খোক্ষস, আবোলতাবোল, রামায়ণ-মহাভারত এভাবেই শোনা তার। ক্লাসে সবাই যখন বাংলায় শুধু মানে বইতে লেখা প্রশ্নের উত্তর দেয় তখন সে কিছু না কিছু রেফারেন্স যোগ করতে পারে শোনা গল্পের প্রেক্ষিতে। এখন সে বড়োকাকুর গোপন কথা গম্ভীর মুখ করে শুনতে বসল।

সৌপ্তিক শুরু করল। “তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার এক অভিন্নহৃদয় বন্ধু টিঙ্কা। স্কুলেও একসঙ্গে পড়ি, আবার পাড়াতেও দুটো বাড়ি পরেই সে থাকে। ফলে তার সঙ্গে খুব ভাব। বলতে পারিস আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

একটু থামল সে। তারপর বলল, “তখন তো বাড়ি থেকে টিফিন দিত না, কোনোদিন হয়তো দুই টাকা, কখনো পাঁচ টাকা দিত টিফিন কিনে খাবার জন্য। সেইসব টাকা তো পুরো খরচ হত না, থেকে যেত। এভাবে দশ টাকা জমেছিল। টিঙ্কার কাছেও সেভাবেই দশ টাকা ছিল।

“একদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে সে বলল, ‘চল, একটা জায়গায় যাব।’

“আমি ভাবলাম সিনেমা দেখতে যাবে বলছে। তখন তো বাড়িতে লুকিয়ে সিনেমা দেখার মজাই অন্যরকম। একটু ভয় করছে ঠিকই, কিন্তু আবার ভিতরে ভিতরে উত্তেজনাও হচ্ছে।

“তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সিনেমা রে?’

“সে কোনো উত্তর না দিয়ে তার সঙ্গে যেতে বলল।”

“তুমি গেলে?” চাঁদনীর চোখে কৌতূহলের ঝিলিক।

“হ্যাঁ। গেলাম। কিন্তু সিনেমা দেখতে নয়। সিনেমা হলের পাশে একটা জায়গায় দেখলাম তাস খেলা হচ্ছে। টিঙ্কা বলল, সে দশ টাকা জমা রেখে তাস খেলবে। জিতলে কুড়ি টাকা, হারলে দশ টাকা গেল। প্রথমবার খেলেই সে জিতে গেল। তখন আমারও খেলতে ইচ্ছে হল। আমিও দশ টাকা জমা দিয়ে খেললাম। প্রথমবার জিতলাম। এখন দুজনের হাতে কুড়ি টাকা করে। লোভ হল। সেই কুড়ি টাকা দিয়ে আবার খেললাম। এবার হেরে গেলাম। আমাদের পিছনে একজন ছিল, সে-ই আমাদের বলে দিচ্ছিল কীভাবে খেললে জিতব। এবার হেরে যাওয়ায় সে বলল, ‘আরেকবার খেলো। আমি একটা তাসের গা ছিঁড়ে দিচ্ছি, সেটাই ধরবে। তাহলে একশো টাকা জিতবে। তুমি একশো টাকা বাজি ধরো।”

চাঁদনী বলল, “তোমার কাছে এত টাকা ছিল? বললে যে দশ টাকা ছিল!”

“ছিল না তো। কিন্তু তখন সেটা মাথায় নেই। বলে দিলাম খেলব। জিতেও গেলাম। জেতার পর টাকা চাইলাম। দিল না। বলল, ‘তুমি বলেছিলে একশো টাকার খেলবে। কিন্তু টাকাটা জমা দাওনি। এখন দুশো টাকা দাও, তবেই যেতে পারবে এখান থেকে।’

“আমার তখন জেদ চেপে গেছে। বললাম, ঘড়ি বন্ধক দিয়ে খেলব। আমার হাতে তখন বাবার দেওয়া একদম নতুন একটা ঘড়ি। একশো পঁচাত্তর টাকা দাম। কিন্তু তখন আমি সে-সব ভুলে গেছি, খালি মনে হচ্ছে টাকাটা আমাকে তুলতেই হবে। আর পিছনের লোকটাও উসকাচ্ছে ‘খেলো খেলো’ বলে। আমি ঘড়িটাকে বাজি রাখলাম।”

“জিতলে?” চাঁদনী মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে তার বড়োকাকুর গল্প।

“না। হারালাম। ঘড়িটাও চলে গেল। কাকুতিমিনতি করলাম, ‘ঘড়িটা দিয়ে দাও, বাবা মারবে।’ কিছুতেই দিল না। বলল, ‘দুশো টাকা দাও, নিয়ে যাও।’

“আমি কোথায় পাব অত টাকা! তখন টিঙ্কা কারোর থেকে ধার করে টাকা এনে ঘড়িটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমাকে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এল।”

“তারপর?” চাঁদনী জানতে চাইল।

“তারপর আমি তো কিছুতেই ভুলতে পারছি না ঘটনাটা। ঠিক করলাম, আবার যাব, আর এবার শেষ দেখে ছাড়ব। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেদিকে যাচ্ছি, তখন দেখি টিঙ্কা নিজের বাবার থেকে টাকা নিয়ে যে লোকটার থেকে ধার নিয়ে ঘড়িটা ছাড়াল, তাকে দিতে যাচ্ছে। আমাকে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

“আমি বললাম, ‘সেখানে।’

“বলল, ‘যাবি না।’

আমি কি তখন তার কথা শোনার মতো অবস্থায় আছি! টিঙ্কা চলে যেতেই সেখানে গেলাম। দেখি মাত্র একজন লোক সেখানে। ভাবলাম যদি আমাকে ধরে মারে বা আটকে রাখে, তাই একটু এগিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে দেখি তারা আর নেই।”

“যাহ্‌! তাহলে তো পুরো টাকাটাই নষ্ট।”

“হ্যাঁ।”

“তুমি কি আর পরে খেলেছিলে?”

“না। তবে তখন বুঝতে পারছিলাম, পিছনের লোকটাই আসলে আমাকে পরিচালনা করছিল। আর সে তাদেরই লোক। এভাবেই সে সবাইকে উসকে দেয় খেলার জন্য। প্রথমে জিতিয়ে দেয়, তারপর একবার নেশা ধরে গেলে ছেড়ে আসা মুশকিল হয়ে যায়।”

“কী বদমাশ লোক গো!”

“হুম। বুঝতে পেরে আমার খুব মনখারাপ হয়ে গেছিল। মনে হল, আমি এত বোকা! রাগ হচ্ছিল নিজের উপর। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষ অবধি পুরো ঘটনাটা গিয়ে বাবাকে বললাম।”

“ছোটোদাদুকে? রেগে গেছিল নিশ্চয়ই?”

“না। সেটাই অবাক করেছিল আমাকে। বাবা বলল, ‘তুমি যদি জিতে আসতে আমি রাগ করতাম। কিন্তু তুমি হেরে এসেছ, আমি খুব খুশি।’

“তখন তো বুঝতে পারলাম না হেরে যাওয়ায় বাবা খুশি কেন! কিন্তু আজ বুঝি।”

চাঁদনী বড়োকাকুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল পরবর্তী অংশ শোনার জন্য।

একটু থেমে, জল খেয়ে সৌপ্তিক বলল, “সেদিন যদি জিততাম, তবে জুয়া খেলার নেশায় ক্রমে ডুবে যেতাম। কিন্তু হেরে যাওয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এই জেদটা এসে গেল।”

চাঁদনী বলল, “মাও তাই বলে, ফোকটে কিছু পাওয়া যায় না। পরিশ্রম করে যেটা পাওয়া যায় তার স্থায়ীত্ব বেশি।”

“ঠিক। নিজের কাছে সৎ থাকা খুব জরুরি। আর দরকার কাজ করার স্পৃহা, মনের জোর, অধ্যবসায়। ব্যস, তাহলে কোনো কিছুই তোকে আটকাতে পারবে না।” সৌপ্তিক বলল। “বুঝলাম।” বলে চাঁদনী আবার কানে হেড-ফোন গুঁজে নিল। এবার সে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট বন্ধ করে ইউ-টিউবে তার নোটসগুলো দেখতে লাগল।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s