গল্প -সুশোভন বাগচীর এক্সপেরিমেন্ট-ঋতা বসু বর্ষা ২০২১

ঋতা বসুর আরো গল্পঃ শিকার ও শিকারীমিষ্টিবুড়ির কাণ্ড, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি, মৌটুসীর বাসা, বিজু যা দেখে, আলো ছায়ার খেলা

golporeetabasu

আর দু-মাস বাদে ফাইনাল পরীক্ষা। সপ্তর্ষি পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য এখন থেকেই রাতে খাওয়ার পর রাস্তার ধারে তাদের একতলার বৈঠকখানা ঘরে বইখাতা নিয়ে পড়তে বসে। সপ্তর্ষির বোন শুকতারা তাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, “জানালার ধারে পড়তে বসিস, অত রাতে তোর ভয় করে না?”

“কীসের ভয়?”

“পাগল, মাতাল, ভূত, চোর-ডাকাত…”

সপ্তর্ষি বোনের অজ্ঞতায় হাসে। পাগল ও মাতালকে দেখে ভয় পাবার কী আছে? তারা রাস্তা দিয়ে আপন-মনে চলে যায়। হ্যাঁ, চোর-ডাকাতকে নিয়ে একটু ভাবনা হয় বৈকি! তবে সেদিক দিয়ে সপ্তর্ষিরা নিরাপদ। এই পাড়া পাহারা দেয় বিরাট এক কুকুর বাহিনী। তাদের চোখ এড়িয়ে অজানা অচেনা লোকের পাড়ায় ঢোকাই মুশকিল।

সাড়ে দশটা বাজে দেখে সপ্তর্ষি ভূগোল বই বন্ধ করে অঙ্কের খাতা খুলল। মন দিয়ে খান কুড়ি অঙ্ক করলেই ঘুম পালাবে।

আট নম্বর অঙ্কটা করতে গিয়ে সপ্তর্ষির খেয়াল হল পাড়াটা যেন বড্ড নিঝুম হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে কুকুরগুলো সারি সারি বসে আছে যেন বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে বসেছে। এক ভদ্রলোক হাতের ঝোলা থেকে কী যেন বার করে খেতে দিচ্ছেন। এত দূর থেকে অন্ধকারে খাদ্যবস্তুটা ভালো দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ল্যাম্প পোস্টের আলোয় কুকুরগুলোকে তো ভালোই দেখা যাচ্ছে।

সপ্তর্ষির খুব আশ্চর্য লাগল। রাস্তার কুকুরদের এত ভদ্র ব্যবহার করতে সে কোনোদিন দেখেনি। কোনো কাড়াকাড়ি মারামারি নেই, শান্তভাবে অপেক্ষা করছে। যখন খাবারটা পাচ্ছে তখনই খাচ্ছে। সপ্তর্ষি পরীক্ষার কথা ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ভদ্রলোক একদম শেষে বসা কুকুরটাকে খেতে দিয়ে এদিকে ফিরতেই সপ্তর্ষি চিনতে পারল ইনি তো সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, যিনি সপ্তর্ষিদের পাড়ায় প্রায় দুই সপ্তাহ হল এসেছেন।

সপ্তর্ষিরা এঁকে চিনত। বড়ো মামা সেদিন সন্ধেবেলা এসেছিলেন। কথায় কথায় বাবাকে বললেন, “তোমাদের পাড়ায় তো বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সুশোভন বাগচী বাসা নিয়েছেন, জানো কি?”

বাবা বললেন, “না তো। নামটা শোনা শোনা মনে হচ্ছে। কাগজে দেখেছি কি?”

“দেখতেই পারো। খুব বড়ো বৈজ্ঞানিক। বেঙ্গল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের মাথা ছিলেন। আমাদের কোম্পানি থেকে অনেক সাইন্টিফিক ইকুইপমেন্ট ওখানে একসময় সরবরাহ করা হয়েছিল। সেই সূত্রে তখন আলাপ হয়েছিল।”

“তা যাও না, আবার গিয়ে আলাপটা ঝালিয়ে এস।”

মামা লজ্জা পেয়ে বললেন, “না, না। অত ব্যস্ত লোক, ওঁর হয়তো মনেও নেই।”

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “উনি হঠাৎ এ-পাড়ায় এলেন কেন?”

মামা একটু ইতস্তত করে বললেন, “সেটাই তো ভাবছি। সেই সময় বেঙ্গল সায়েন্সের অফিসে কয়েকবার যাতায়াত করতে হয়েছিল। তখন তো ওখানেই বিরাট কোয়ার্টারে থাকতেন। পরে শুনেছিলাম খুব অসুস্থ, আর কাজ করছেন না। এখন তো দেখছি তোমাদের পাড়ায় বাড়ি নিয়েছেন। পারলে আলাপ করে নিও। খুব গুণী লোক।”

এইসব শুনে সপ্তর্ষির মনে খুবই কৌতূহল হয়েছিল। সুশোভন বাগচীর সঙ্গে আলাপ করবার ইচ্ছেও হয়েছিল। জলজ্যান্ত একজন বৈজ্ঞানিক বাড়ির কাছেই বাস করছেন, ভাবা যায় না। যাতায়াতের পথে বাড়িটা দেখে রেখেছে। কিন্তু বাড়ির দরজা-জানালা সবসময় এমন আঁটসাঁট করে বন্ধ থাকে যে সপ্তর্ষির আর সাহস হয়নি দরজার কড়া নাড়ে বা ঘণ্টি বাজায়।

পাশের বাড়ির নগেনবাবু এর মধ্যে একদিন উত্তেজিত হয়ে বাবাকে এসে বললেন, “শুনেছিলাম মস্ত বৈজ্ঞানিক। আলাপ করতে গিয়েছিলাম। কী অদ্ভুত লোক, কী বলব মশাই! একনাগাড়ে কথা বলে গেলাম। একটা কথারও জবাব দিলেন না। চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন। গা ছমছম করছিল। বাড়ির ভেতরটা একেবারে হ-য-ব-র-ল। চলে আসবার সময় জিজ্ঞেস করলেন, এই পাড়ায় ক’টা কুকুর আছে? ভাবুন একবার, রাস্তার কুকুরের সংখ্যাটা একটা জানার মতো বিষয়?”

সপ্তর্ষি তার পর থেকেই পাড়ায় ক’টা কুকুর আছে গুনবার চেষ্টা করেছিল। ব্যাপারটা বেশ শক্ত। প্রতিবারই গুলিয়ে যায় বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে। খাবার দেবার জন্যই তবে জিজ্ঞেস করেছিলেন ক’টা কুকুর! নগেনবাবুর বাড়াবাড়ি। ওই প্রশ্নের জন্য পাগল ভেবে ফেললেন।

পোশাকটা অবশ্য একটু অদ্ভুত লাগছে। ধুতিটা লুঙ্গির মতো করে পরা। তার ওপর একটা ফুল শার্ট। পায়ে আবার বুট জুতো। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। মাথায় চিনে চাষিদের ধরনে বেতের টোকা। সাধারণত রোদের থেকে মাথা বাঁচাতে হলে সবাই এই টুপিগুলো পরে। এই শীতের রাত্তিরে কেন যে উনি মাথায় টোকা পরে আছেন, সপ্তর্ষি বুঝতে পারল না। সপ্তর্ষি পড়া-টড়া ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। এ কী? সুশোভন বাগচী তার দিকেই এগিয়ে আসছেন যে!

জানালার সামনে এসে বললেন, “কী পড়ছ?”

“অঙ্ক করব ভাবছি।”

“খুব ভালো। অঙ্ক করলে লজিক্যাল মাইন্ড হয়, বুদ্ধি পাকে। দৃষ্টিশক্তি স্বচ্ছ হয়। বড়ো হয়ে কী হতে চাও?”

সপ্তর্ষির মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “বৈজ্ঞানিক।”

কেন যে বলল সে নিজেও জানে না। হয়তো সুশোভন বাগচীর সঙ্গে আরো একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। সবার কাছে শুনেছে, তিনি কারোর সঙ্গে কথা বলেন না অথচ সপ্তর্ষির সঙ্গে নিজের থেকে এত কথা বলছেন। ওঁর কথা শুনে তো সপ্তর্ষির যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

সুশোভন বাগচী বলেই চলেছেন, “অঙ্ক ছাড়া চলবে না। বুঝেছ? সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যাই করো তার মধ্যে অঙ্ক আছে।”

সপ্তর্ষির খুব মজা লাগল কথাটা শুনে। বলল, “সকালে উঠে দুধ খাই। খাবার খাই। তার মধ্যে অঙ্ক কোথায়?”

সুশোভন চোখ গোল গোল করে বললেন, “নেই? হাতটা কতটা উঠিয়ে মুখের কাছে নেবে, গেলাসটা কতটা বাঁকালে দুধটা তোমার ঠোঁট বেয়ে না গড়িয়ে সোজা মুখের মধ্যে যাবে, পাঁউরুটিটা কতবার চিবোলে সেটা গলে গিয়ে পেটের মধ্যে চলে যাবে, কোন সাইজের গেলাসে কতটা দুধ ধরবে—সমস্তর পেছনে একটা হিসেব কাজ করছে, বুঝেছ? তোমার অজান্তেই তুমি অঙ্ক করে চলেছ।” তারপর একটু থেমে ফিসফিস করে বললেন, “যে-কোনো অঙ্ক জলের মতো সোজা করে দিতে পারি। তুমি দেখতে চাও?”

সপ্তর্ষি কৌতূহলে ছটফট করে ওঠে, “হ্যাঁ, দেখতে চাই।”

“এসো তাহলে।”

“এত রাতে?” সপ্তর্ষি ইতস্তত করে। বাবা-মাকে বললে ওঁরা যে কিছুতেই রাজি হবেন না জানা কথা। না বলেও যেতে ইচ্ছে করল না। তাই সপ্তর্ষি বলল, “আমার তো এখন ছুটি। আমি কাল সকালে যাব।”

golporeetabasu (2)

সুশোভন বাগচী আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির রাস্তা ধরলেন। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় দেখা যাচ্ছে কুকুরগুলো ওইভাবেই শান্ত হয়ে বসে আছে। সপ্তর্ষি পড়ায় মন দিল।

পরদিন সকালবেলা খানিকটা পড়াশুনো করে চান-টান করে, ‘মা, একটু ঘুরে আসছি’ এই বলে সে সোজা চলে গেল ৫১-এ বাড়িটাতে। সুশোভন বাগচী একটা চশমার ডাঁটির স্ক্রু খুলে চশমাটাকে মুখের সামনে তুলে কী যেন দেখছেন খুব মনোযোগ দিয়ে। সপ্তর্ষি কাছে গিয়ে দেখল চশমার মতো দেখতে হলেও জিনিসটা ঠিক চশমা নয়, কারণ চশমার গ্লাসের উপরে ঘড়ির কাঁটার মতো দুটো ছোট্ট কাঁটা লাগানো আছে। সুশোভন খুব সরু একটা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে সেগুলোকে নাড়াচাড়া করতে করতে আপন-মনে বলছেন, “ইনভিসিবল করতে হবে।”

সপ্তর্ষি ঠিক বুঝতে পারল না কথাটা তাকেই বলা কি না।

খানিকটা বাদে সুশোভন কাজ থামালে পর সপ্তর্ষি জিজ্ঞেস করল, “কী ইনভিসিবল করতে হবে?”

“এই দুটো।”

“আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

“আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। তুমি কি চশমা পরো?”

“না।”

“তাহলে বুঝতে পারবে না। তোমার বন্ধুরা যারা চশমা পরে বৃষ্টিতে তাদের হাঁটতে কত অসুবিধা হয়। ওদের কথা ভেবে আমি ওয়াইপার দেওয়া চশমা বানিয়েছি। এই দেখো।”

সপ্তর্ষি অবাক হয়ে দেখল, চশমার ডাঁটির একটা অংশ টেনে দিতেই ফ্রেমের কাচের ওপর ঘড়ির কাঁটা দুটি গাড়ির ওয়াইপারের মতো চলতে শুরু করল। সুশোভন বাগচী সেটা দেখতে দেখতেই আপন-মনে বলে উঠলেন, “এই কাঁটা দুটো ইনভিসিবল করতে হবে, বুঝেছ? অদৃশ্য অবস্থায় ওরা যদি চশমার কাচের উপর থেকে জল মুছে দিতে পারে তাহলে কেমন হয়?”

এই বলে উনি হাসি হাসি মুখে সপ্তর্ষির দিকে চেয়ে রইলেন। এইরকম একটা জিনিস যে কেউ আবিষ্কার করতে পারে তা সপ্তর্ষির জানা ছিল না। সে কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।

সুশোভন সপ্তর্ষির দিকে চেয়ে থাকা অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলেন, “বড়ো হয়ে কী চালাবে, গাড়ি, না মোটর বাইক?”

এটার উত্তর দিতে সপ্তর্ষির এক মুহূর্ত দেরি হল না—মোটর বাইক। যদিও সে বুঝতে পারল না চশমা থেকে হঠাৎ উনি গাড়ি-মোটর বাইকে কেন চলে এলেন।

সুশোভন অবশ্য সপ্তর্ষিকে বেশিক্ষণ ধোঁয়াশার মধ্যে রাখলেন না। বললেন, “খুব ভালো। চার দেয়ালে ঘেরা গাড়ির মধ্যে কোনো মজা নেই। তোমাদের মতো যারা মোটর বাইক চালাতে ভালোবাসে তাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

এই বলে উনি উঠে কোথায় যেন গেলেন, বোধ হয় সেই সারপ্রাইজটা আনতে। সপ্তর্ষির তো ওঁর কথাবার্তা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। সবার যে কেন ওঁকে অদ্ভুত বলে মনে হয়! সাজপোশাকটা অবশ্য একটু অন্যরকম। যেমন, ঘরের মধ্যেও মাথায় সেই রোদ আড়াল করার টোকা। টোকা বাঁধার দড়িটাও খুব মজার। রামধনুর সাত রংয়ের সুতোর বিনুনি। মানুষটা যে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু পাগল নন। কথাবার্তায় যথেষ্ট চিন্তাভাবনার পরিচয় দিচ্ছেন।

সুশোভন ঘরে ঢুকলেন একখানা হেলমেট নিয়ে, বাইক চালাতে গেলে মাথায় যেটা পরা অবশ্য কর্তব্য। কাছে আসার পর এই হেলমেটের অসাধারণত্ব ধরা পড়ল। পেছন দিকে দু-তিনটে ছোটো ছোটো পাইপ দেখা যাচ্ছে। সেই পাইপগুলো আবার হেলমেটের ভেতরে একটা ছোট্ট বাক্সের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে। হেলমেটটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “দুই একটা ছোটোখাটো বদল করতে হবে। নয়তো জিনিসটা হয়েছে দারুণ। বুঝতে পারছ না তো? এটা হচ্ছে এয়ার কন্ডিশনার ফিট করা হেলমেট। বাইক তো চালাবে বলছ, গরমের মধ্যে এই জিনিসটা মাথায় চাপিয়ে চালাতে হলে অর্ধেক মজা মাটি। সেই জন্য এটা তৈরি করেছি। মাথায় চাপিয়ে মাইলের পর মাইল চালাও, কোনো অসুবিধে নেই। মাথাটি ঠান্ডা থাকলে সমস্ত শরীর আরাম পাবে। বৈশাখে মাঘের মজা।”

সপ্তর্ষি বলল, “আপনার এতরকম আবিষ্কার আপনি লুকিয়ে রেখেছেন কেন? সবাইকে ডেকে বলুন, কাগজে ছাপিয়ে দিন।”

হঠাৎ সুশোভন রেগে গেলেন। “একদম না। অনেক উপকার করেছি। আর নয়। যদি কখনো মানুষের স্বভাব বদলে দিতে পারি তাহলে বলব। সব বলব।”

“কী বলবেন?” সপ্তর্ষি কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে।

“বিজ্ঞানের জন্য স্যাক্রিফাইস করতে পারবে? যদি মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে চাও তো বলো। তবেই তোমাকে আমার গবেষণার শরিক করব।”

সপ্তর্ষির বুকের মধ্যে কী যেন লাফিয়ে ওঠে। বিজ্ঞানের অসাধ্য কিছুই নেই। এত বড়ো বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য তার হবে! তারও পরে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ—এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না। খুব সাহসের সঙ্গে সে বলল, “বিজ্ঞানের জন্য, মানুষের ভালোর জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি।”

“গুড। ভেরি গুড। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল তুমি পারবে। জোড়া ভুরু, আর বড়ো বড়ো কান ত্যাগ ও বীর্যের প্রতীক। তোমার তা আছে।”

“কবে থেকে কাজ শুরু করব?”

“এসো তোমার সময়মতো। এখন যাও। আমি ঘুমোব।”

বেলা এগারোটায় কি কেউ ঘুমোয়? সপ্তর্ষির একটু আশ্চর্য লাগলেও ভাবল হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাবে কাজ করেছেন, তাই ক্লান্ত লাগছে। হতেই পারে।

তারপর সপ্তর্ষি নিয়ম করে মাঝেমাঝেই হানা দিতে লাগল সুশোভন বাগচীর বাড়িতে। ওঁর গবেষণার কথা জানতে পারল ধীরে ধীরে। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে গবেষণা সম্বন্ধে নানা কথা আলোচনা হয়। বাইরের লোক এর বিন্দুবিসর্গ জানতে পারে না। সপ্তর্ষি প্রথম প্রথম বিশ্বাস করেনি সত্যি মানুষের স্বভাব বদল সম্ভব কি না। তারপর সুশোভনের সঙ্গে কয়েকদিন কথা বলে যা জানতে পারল তা সত্যিই খুব চমকপ্রদ। বিশ্বাসী, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান এইসব ভালো ভালো গুণের কথা ভাবলেই আমাদের চোখের সামনে যে প্রাণীর ছবি ভেসে ওঠে তা হল কুকুর। মানুষের সব থেকে প্রিয় জন্তু। অক্লান্ত গবেষণা করে কুকুরের হরমোন থেকে এই জাতীয় গুণ আলাদা করেন তিনি। একটি বিশেষ ওষুধ আবিষ্কার করেছেন যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে মানুষও ধীরে ধীরে এইসব সদগুণের অধিকারী হবে। মুশকিল হল, গবেষণার জন্য যেহেতু তিনি ভালো পেডিগ্রিওলা কুকুর পাননি, সবই নেড়ি, সেই জন্য প্রথমে নেড়িদের স্বভাব থেকে খেয়োখেয়ি, অযথা চিৎকার এইসব গুণগুলো দূর করতে হবে। তবেই স্বভাবের শুধু ভালো দিকগুলো নিয়ে সিরাম প্রস্তুত করা সম্ভব। নয়তো মানুষও যদি ওইরকম বিশ্বাসী পরিশ্রমী হবার সঙ্গে সঙ্গে খেয়োখেয়ি শুরু করে তবে মুশকিল।

সপ্তর্ষি উত্তেজিত হয়ে বলে, “আপনি কি নেড়ি কুকুরের স্বভাব বদলের কাজটা শুরু করেছেন?” তার মনে পড়ে যায় রাত্রিবেলা কুকুরদের শান্ত হয়ে বসে থাকার ভঙ্গি।

সুশোভন বাগচী বললেন, “কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, কুকুরগুলো আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে কি না জানি না, আমি কাছে গেলেই পালিয়ে যায়।”

সপ্তর্ষি আগ্রহ প্রকাশ করে বলে, “আমাকে বলুন কী করতে হবে।”

“বলব, বলব। আপাতত একজনকে দেবার মতো ওষুধ তৈরি হয়েছে। তুমি যদি রাজি থাকো, তোমার ওপরেই এক্সপেরিমেন্ট হয়ে যাক।”

সপ্তর্ষির বুক উত্তেজনায় গুড়গুড় করে ওঠে, কী সাংঘাতিক এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সে অংশীদার হতে চলেছে। সফল হলে ইতিহাসের পাতায় তার নাম লেখা থাকবে।

দু-দিন বাদে আর চেপে রাখতে না পেরে তার প্রাণের বন্ধু কিংশুককে সব খুলে বলল। সব শুনে কিংশুক খুব উত্তেজিত। সে বলল, “জিজ্ঞেস করিস তো ইঞ্জেকশন দেবার সময় আমাকেও থাকতে দেবে কি না।”

“ইঞ্জেকশনই যে দেবে তা কী করে জানলি?”

“তা ছাড়া ওষুধটা শরীরে ঢোকাবে কী করে?”

“খাইয়েও তো দিতে পারে।”

“তা অবশ্য পারে।”

খানিকটা বাদে কিংশুক একটু আমতা আমতা করে বলল, “যদি তোর স্বভাব বদলায়, তাহলে আমাকেও ওষুধ দিতে বলিস।”

“ভালোই হবে। খেলার মাঠে তোর এ-দল সে-দল করা বন্ধ হবে তাহলে।”

***

আজ সকাল থেকে সপ্তর্ষির কিছুতে মন নেই। আজই সেই দিন। দুপুরবেলা এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবে। উত্তেজনায় সপ্তর্ষির গলা শুকিয়ে উঠেছে। বইখাতা খুলে বসে আছে, কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এক্সপেরিমেন্ট সফল হলে ভালো কথা, কিন্তু যদি না হয়? যদি সে ওষুধের প্রভাবে অন্যরকম হয়ে যায়? আজ সকাল থেকে কেন জানি না একটু ভয় ভয় করছে।

কিংশুক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির বেলা এগারোটার সময়। সপ্তর্ষির মা বললেন, “কী রে কিংশুক, দৌড়ে দৌড়ে এসেছিস নাকি? গা দিয়ে ঘাম ঝরছে যে।”

কিংশুক ঢোঁক গিলে বলে, “হঠাৎ কতগুলো ভালো সাজেশন পেলাম। ভাবলাম সপ্তর্ষিকেও দিয়ে যাই।”

“যা, ও ঘরেই আছে। সকাল থেকে বইখাতা খুলে বসে আছে। কিন্তু ছটফটানি দেখে পড়ছে বলে তো মনে হয় না।”

কিংশুক সপ্তর্ষির পাশে ধপ করে বসে পড়ে গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ভাগ্যিস চলে যাসনি। গেলে সর্বনাশ হত।”

“কেন, কী হয়েছে?”

“আজ সকালে বাবাকে এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম সুশোভন বাগচীকে চেনে কি না, তোদের পাড়ায় নতুন এসেছেন, তোর সঙ্গে আলাপ হয়েছে এইসব। বাবা বললেন, ‘উনি তাহলে ছাড়া পেয়েছেন মেন্টাল হসপিটাল থেকে?’ কী না কী এক্সপেরিমেন্ট নিজের ওপর করে একদম পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তুই কি এটা শোনবার পরেও যাবি?”

সপ্তর্ষি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য, মানব কল্যাণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেও কোথায় যেন তার ভয় ভয় করছিল। কী যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল তার, কারণটা সে ঠিক ধরতে পারছিল না। এখন কিংশুকের কথায় মনে হল দু-তিনদিন ধরে তাদের পাড়ায় নেড়ি কুকুরগুলোকে দেখতে পাচ্ছে না। কোথায় গেল তারা?

কিংশুককে বিদায় করে সপ্তর্ষি চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মা ডাকাডাকি করায় সে উত্তর দিল, “একদম খিদে নেই। পেটটা ব্যথা করছে।”

মনখারাপের চোটে সপ্তর্ষির সত্যি সত্যি শরীর খারাপ লাগছিল। বহুদিন ধরে আজকের দিনটার জন্য সে আর সুশোভন বাগচী প্ল্যান করেছে। আর শেষমুহূর্তে সে পিছু হটে গেল। সপ্তর্ষি ছবির মতো পরিষ্কার দেখতে পেল তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মানুষ যে কত বড়ো বিশ্বাসঘাতক সেটা আবার তিনি অনুভব করলেন। তা সত্ত্বেও সপ্তর্ষি সুশোভন বাগচীর কাছে যাবার জন্য সাহস সংগ্রহ করতে পারল না।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সপ্তর্ষি স্বপ্ন দেখল, সে সুশোভন বাগচীর বাড়ি গিয়েছে। কেউ কোথাও নেই। চারদিক নিস্তব্ধ। যে টেবিলটাতে বসে সুশোভন কাজ করেন, তার পায়ের সঙ্গে একটা কুকুর বাঁধা। কুকুরটার মাথায় একটা টোকা।

পরদিন স্কুল থেকে ফিরে সপ্তর্ষি দেখে পাড়ায় হইহই কাণ্ড। সুশোভন বাগচী নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। যে বুড়িটা ঘর-টর ঝাঁট দেয়, সে গিয়ে দেখে দরজা খোলা, কেউ কোথাও নেই। বাড়িময় বোঁটকা গন্ধ। সে সবাইকে ডাকাডাকি করে। তারপর এখন পর্যন্ত সুশোভন বাগচীর আর পাত্তা পাওয়া যায়নি।

পরদিন স্কুলে যাবার সময় সপ্তর্ষি দেখল পাড়ার রক্ষীবাহিনী আবার ফিরে এসেছে। এই ক’দিন যে কেন দলটাকে দেখতে পায়নি কে জানে? আজ প্রথম ভালো করে লক্ষ করল এদের। আর করতে গিয়ে সে চমকে উঠল। দলের মাঝখানে একটা খয়েরি রঙের কুকুর। তার গলায় রামধনুর সাতরঙা সুতোর বিনুনি করা দড়ি বাঁধা।

অলঙ্করণ- তথাগত চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “গল্প -সুশোভন বাগচীর এক্সপেরিমেন্ট-ঋতা বসু বর্ষা ২০২১

  1. রামধনুর সাতরঙা ফিতেটা রয়ে গেল মনে। বেশ লাগল।

    Like

Leave a comment