গল্প-বলাইবাবু-সাগরিকা রায় -শরৎ ২০২২

সাগরিকা রায়ের আগের গল্পগুলোঃ যে কোনও দিন, ওরা ভূতপুরোহিতমশাই, ছবি তুলতে গিয়ে, নব মন্ডলের গল্প,জিকোর একটি রাত, ভয়ের সন্ধ্যা

golpoBalai Babu

বলাইবাবু ভারি ভালো মানুষ। কিন্তু বড্ড ভূতের ভয় তাঁর। বলাইবাবুর মা, সোনাপিসি সবাই মিলে বলে-বলেও বলাইবাবুর ভয় ভাঙাতে পারেনি আজ পর্যন্ত। নিজের ছায়াকে দেখেও ‘মা গো, ভূত!’ বলে সে কি কাঁপুনি!

সোনাপিসি কলার বড়ায় পুরে ভয়নিরোধী কী একটা ওষুধ খাইয়ে দিল। তবুও কি কাজ হল?

বলাইবাবু পলাশগাছের নীচে দাঁড়িয়ে ‘ওং জবাকুসুম সঙ্কাশং’ স্তব পাঠ করে সূর্যের পুজো করছেন, তাঁর মা ডেকে বললেন, “ও বলু, রোদে অতক্ষণ থাকিসনে বাপু। এমনিতেই মাথা নড়বড় করছে। গরমে না জানি কী হয়!”

বলাইবাবু মায়ের কথা শুনতে শুনতে সূর্যের তেজ নিয়ে ভাবলেন। এই জুন মাসের গরমে শরীর থেকে শোঁ শোঁ করে জল বেরিয়ে যাচ্ছিল। আর ছায়াটা কি আছে, না গেছে?

বলাইবাবু মাটির দিকে তাকিয়ে ছায়া দেখতে পেলেন না। এই গরমে টিকতে না পেরে ছায়া ভেগেছে? বাহ্‌, দারুণ তো! তাহলে আর ঘরে ঢুকে দরকার-বা কী? মা ফের ঘরে ঢুকতে বলতেই বলাইবাবু চেঁচিয়ে বললেন, “ছায়া ভেগেছে মা। আর ভয় নেইকো। যা গরম পড়েছে, সে-ব্যাটার সাধ্য কী আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে?”

বারান্দায় বসে তালপাতার পাখার বাতাস খেতে খেতে জগন্নাথদা বলল, “ও হরি, তুমি ভাবছ ছায়া গরমে টিকতে না পেরে ভেগেছে? সূর্য নাকি কৌণিক অবস্থানে রয়েছে, তাই ছায়া অদৃশ্য হয়েছে কিছু সময়ের জন্য। বলু, তুমি ভূগোল আর বিজ্ঞানটা একটু পোড়ো ভাই। শুধু কাব্য পড়লে হবে?”

বলাইবাবু এমনিতে বেশ ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। কিন্তু কাব্য নিয়ে ত্যাড়া-বেঁকা কথা তাঁর মোট্টে সয় না। তাছাড়া জগন্নাথ কাব্যের বোঝেই-বা কী? সে কি রবীন্দ্রনাথ পড়েছে?

“পড়িনি বলতেই পারব না। রবীন্দ্রনাথ কোথায় নেই তা আমাকে দেখাও। কিন্তু তুমি কি জগদীশচন্দ্র কি সত্যেন বোসের কিছু লেখা পড়েছ? হকিং?”

এটুকু শুনেই সোনাপিসি হাত তুলে বলল, “নেকচার ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের দাও গে। এদিকে যে কারো-কারো ছায়া মাটিতে পড়ছে না, সে খেয়াল আছে? ভূত নেই তাই-বা বলি কী করে? রাম রাম বলেও লাভ হচ্ছে না আজকাল। ভূতেরা অনেক কিছু শিখে গিয়েছে। ‘রাম নিরোধক’ পোশাক পরছে তারা, বলল তো গগন।”

বলাইবাবু সব অপমান ভুলে লাফিয়ে উঠলেন।—“গগন কে? গোপীর দাদা? যে আই.আই.টি-তে পড়ে? দেখলে তো? বিজ্ঞান পড়েও ভূতকে অস্বীকার করতে পারেনি।”

“আরে না রে। গগন মানে আমাদের দুধওলা গগনচাঁদ। যে হাই পাওয়ারের চশমা পরে। একটার জায়গায় দুটো গোরু দেখে। চিনেছিস এবারে? সে বলল। কিন্তু আমি নিজের ছায়া পস্টো দেখেছি খানিক আগেই। তাহলে কি কারো-কারো ছায়া কায়াটিকে ফেলে পালাচ্ছে? কেন? মনোমালিন্য হচ্ছে নাকি ছায়ার সঙ্গে কায়ার? বলু, কী মনে হচ্ছে তোর?”

বলাইবাবু ভারি আতান্তরে পড়ে গেলেন। তিনি একটি স্কুলে চাকরি করেন। বাংলা পড়ান। সেটা কথা নয়। কথাটা হল, সেই স্কুলের হেড-স্যারের যমজ মেয়ের নাম ছায়া আর কায়া। তারা নেহাতই বাচ্চা। তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হতে পারে এবং সেই কারণে একজন আরেকজনকে ছেড়ে চলে যেতে পারে, এটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হল না বলাইবাবুর। তিনি চট করে মাটিতে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। ওই তো তাঁর ছায়া ফের এসে সেঁটে গেছে তাঁর সঙ্গে। তাহলে এতক্ষণ সে ছিল কোথায়? পুরো ব্যাপারটা সন্দেহজনক। এমন হতে পারে না কি যে, আজ ছায়াদের কোথাও একটা সম্মেলন ছিল? কে বলতে পারে আসল কথাটা? কিন্তু ছায়া শুধু নয়, এর সঙ্গে কায়া আছে। সেটা নিয়েই চিন্তায় পড়লেন বলাইবাবু।

জগন্নাথের বিজ্ঞানচর্চায় যেটা বেরিয়ে এল, সেই সূর্যের কৌণিক অবস্থান নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। সমস্যা হল, হেড-মাস্টার খুব ভাল মানুষ। তিনি বলাইবাবুকে নিয়মিত বাড়ি থেকে আনা টিফিনের ভাগ দেন। বলাইবাবুও সোনাপিসির দেওয়া কালো ননিয়ার পায়েস, ময়দার ধপধপে সাদা লুচি, কালো জিরে দেওয়া সূর্যমুখী আলুর চচ্চড়ি অক্লেশে হেড-স্যারকে দিয়ে হেড-স্যারের রুটি, বেগুন ভাজা খান মহানন্দে। হোক না রুটিগুলো পোড়া পোড়া। হোক বেগুন ভাজা জলেই প্রায় সেদ্ধ করা। কিন্তু কয়জনকে হেড-স্যার নিজের কৌটোর টিফিন দেন?

তো তাঁর যমজ মেয়েদের মধ্যে মনোমালিন্য হচ্ছে শুনেও চুপ করে জগন্নাথের লেকচার শোনার মতো ইচ্ছে বা আনন্দ কিছু নেই বলাইবাবুর। ছাতা না নিয়েই হেড-স্যারের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন তিনি। পিছন থেকে সোনাপিসি ডেকে বলল, “ও বলু, যাস কোথায়? দুপুরে কিন্তু মাটন রান্না হবে। তাড়াতাড়ি করে চলে আসিস।”

(২)

ছায়া আর কায়া বাইরে দাঁড়িয়ে রাইম মুখস্থ করছিল। দূরে ওদের মা একটা বেত হাতে নিয়ে চেয়ার ঠেসে বসে আছে। এই ধরনের ছবি আগেও দেখেছেন বলাইবাবু। নিজের জীবনেও ঘটেছে। আজ ফের দেখে দেখে বলাইবাবু বুঝলেন গতিক সুবিধের নয়। হেড-স্যারের বাড়ির পরিবেশে সূর্যের জোরালো তাপ ছড়িয়ে আছে। তাপের প্রবাহে ছায়া-কায়া ঘামছে। মনোমালিন্য হল হল ভাব। কিন্তু বলাইবাবুকে দেখে ছায়া-কায়ার রাগী মা হেসে বলল, “আসুন আসুন, বলাইবাবু। এমন রোদে বেরিয়েছেন যে? শরবত খাবেন, আসুন ভিতরে।”

এমন হাসিচর্চার সময়ে যা হয় তাই হল। ছায়া-কায়ার ছুটি হয়ে গেল। সবাই মিলে আমপোড়া শরবত খেতে খেতে সূর্য, ছায়াচুরি বা ছায়ার কায়াকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া, মনোমালিন্য সব শব্দ হুড়হুড় করে কোথায় গেল কে জানে।

এরই মধ্যে হেড-স্যার এসে গেলেন। হাতে একগাদা লাল বাতাসা। পুজোয় চাই। হনুমানজি নাকি লাল বাতাসা খেতে ভারি ভালোবাসেন। আর গণেশজিও।

সবাই মিলে চমৎকার একটা রবিবার কেটে গেল। হেড-স্যার ছাড়লেন না—“আজ আর বাড়ি যাওয়া চলবে না এই দুপুরে। খাওয়াদাওয়া করে যাবেন। এখন দেখুন সাড়ে বারোটা বাজে। আপনার বাড়ি যেতে যেতে একটা বেজে যাবে। এই রোদে না খেয়ে যাবেন কেন? খেয়েদেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে যাবেন।”

হেড-স্যারের মুখের ওপর কেউ কখনও কথা বলতে পেরেছে? পারে? বাড়িতে মাটন হচ্ছে বটে, কিন্তু এমন আদর করে খেতে বললে অগ্রাহ্য করাটা কি ঠিক?

বলাইবাবু দুপুরে ছায়া, কায়া, ওদের বাবার সঙ্গে বসে কলাই ডাল, পোস্তর বড়া, কাতলা মাছের জিরে বাটা ঝোল দিয়ে বাঁশকাঠি চালের ভাত খেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোলেন। ঘুম যখন ভাঙল, চাঁদ উঠেছে আকাশে। ছায়া-কায়ার ঠাকুমা ধুনো ঘুরিয়ে গেল বলাইবাবুর সামনে থেকে। মুখে নীচু স্বরে ঠাকুরের গান, ‘হে গোবিন্দ, রাখো চরণে…’

বলাইবাবু দ্রুত উঠে পড়লেন। কী কাণ্ড! বাড়িতে একটা খবর পর্যন্ত দেওয়া হয়নি! মা, সোনাপিসি, জগন্নাথ কতই না ভাবছে!

হেড-স্যার চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আপনার বাড়িতে দুপুরেই খবর দিয়েছি। ওঁরা খুবই চিন্তা করছিলেন। খবর দিতে ওঁরা সবাই শান্ত হলেন। যাক, চা খান। তারপর আস্তে আস্তে বাড়িতে যান। খুব ভালো লাগল আপনি আজ আসাতে।”

মাঠের ওপর দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বলাইবাবু আনন্দে গান গেয়ে উঠলেন, “বলো বলো সবে/ শত বীণা বেণুরবে/ ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে…”

আবেশে চোখ বুজে এসেছে, এমন সময় বলাইবাবু খেয়াল করলেন একটা শব্দ হচ্ছে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ। দূরে মাঠের ওপর দিয়ে একটা সাইকেল চলে যাচ্ছে। বলাইবাবু ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। এসময়ে কে যাচ্ছে বাপু সাইকেল চেপে? অন্ধকার বেশ নেমেছে। দ্বিতীয়ার চাঁদের আলোতে জোর নেই। সাইকেলে একটা আলো লাগাতে পারিস তো!

না। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। সাইকেল নয়, একটা রিকশা যাচ্ছে মাঠের ওপর দিয়ে। আর, আর বলাইবাবু ভালো করে দেখে বুঝলেন, ওটা রিকশাই এবং যেটা সবচেয়ে সন্দেহজনক, রহস্যময়, তা হল রিকশা চালাচ্ছে লালপেড়ে শাড়ি পরা একটা বৌ!

বলাইবাবু কস্মিনকালে এমন দৃশ্য দেখেননি। ভাবতেও পারেন না যে শাড়ি পরে একটি বৌ রিকশা চালাবে। এটা কী ব্যাপার হল তাহলে?

চিন্তা করতে গিয়ে বলাইবাবু বুঝলেন, যা দেখছেন, তা সহজ নয়। তিনি অন্য ভুবনের প্রাণীকে দেখছেন। আর বলতে বলতে একটা আর্ত চিৎকার দিয়ে মাঠের ওপরে পড়ে গেলেন বলাইবাবু। জানতেও পারলেন না লালপেড়ে শাড়ি পরা রিকশাচালিকা চলে যাচ্ছে তার বাড়ির দিকে। কেন? বলাইবাবুকে খুঁজতে বেরিয়েছে কি? নাকি নিতে এসেছে অন্য দুনিয়ায়? বলাইবাবুকে সে নিয়ে যাবে পরলোকে?

হেড-স্যার লোকজন নিয়ে বলাইবাবুকে খুঁজতে বের হয়েছেন। তাঁর বাড়ি থেকে বলাইবাবু অনেকক্ষণ হল নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। কিন্তু বাড়ি থেকে ফোন করেছে বলাইবাবুর কাকা জগন্নাথবাবু। বলাইবাবু নাকি এখনও বাড়িতে পৌঁছননি! কেউ তাঁকে দেখেওনি। এমনকি বলাইবাবুর ফোন বেজে যাচ্ছে, বলাইবাবু রিসিভ করছেন না।

মাঠের ওপর দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে যাচ্ছেন সবাই—“ও বলাইবাবু-উ-উ-উ, ও বলাই-স্যার…” কেউ সাড়া দিচ্ছে না। কী হল বলাইবাবুর?

হেড-স্যারের দৃষ্টিতে ধরা পড়ল, মাঠের ওপরে কিছু একটা পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে আলো ফেলে দেখা গেল বলাইবাবু মাঠের ওপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তবে একটু একটু জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন যেন। সকলে মিলে ধরাধরি করে বলাইবাবুকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওদিকে বাড়িতে রীতিমতো হইচই চলছে। বলাইবাবুর মা, সোনাপিসি কেঁদেকেটে একাকার।

বলাইবাবু জ্ঞান ফিরে পেয়ে কেঁদে ফেললেন।—“কী ভয়ংকর জিনিস দেখেছি গো! মাঠের ওপর দিয়ে আর কেউ যাতায়াত কোরো না। দ্বিতীয়ার চাঁদের আলোতে সে বের হয়, জেনে রাখো।”

কে? কে বের হয়?

সবিস্তারে ঘটনা খুলে বলতে বলতে কেঁপে উঠলেন বলাইবাবু। সোনাপিসি তাড়াতাড়ি করে নিমপাতার জল খাইয়ে দিল। বলাইয়ের দিকে নজর পড়েছে অপদেবতাদের। নইলে এমন দৃশ্য দেখে কেউ?

চেঁচামেচি শুনে পাশের বাড়ির সাহসের মা এসে হাজির। সব শুনে সে বলল, “ও হরি! তোমাদের বাড়িতেই তো এসেছিল সে। লালপেড়ে শাড়ি পরে বৌ সেজে রিকশা চালিয়ে এসেছিল। আমি ভেবেছি, রঙ্গলালের বৌ বুঝি রিকশা চালানো শিখছে। তাই ঘোমটা দিয়েছে। তারপর দেখি, রঙ্গলালের বউ ছেলেকে পড়াচ্ছে। তাই তো বলি, সে প্রেশার কুকার নিয়ে ফের রিকশা চালিয়ে চলে গেল কেন! তোমাদের প্রেশার কুকার আছে নাকি দেখো তো!”

অমনি পা ছড়িয়ে কেঁদে উঠল সোনাপিসি—“ওরে, ওতে যে মাটন রেঁধে রেখেছিলাম! বলু দুপুরে খাবে না জেনে রাতের জন্য রেঁধে রেখেছিলাম। কে এসে নিয়ে গেল প্রেশার কুকারটা?”

সত্যি প্রেশার কুকার নেই রান্নাঘরে। চোর আছে এই অঞ্চলে। খুব চুরি হচ্ছিল বলে ক্লাবের ছেলেরা পাহারা দিয়েছে ক’টা দিন। চুরি বন্ধ হতে পাহারা তুলে দিয়েছে। আর চোর কিনা বৌ সেজে…

বলাইবাবু অবশ্য বিশ্বাস করেন, চোর নয়, ছায়াদের কেউ এসেছিল আজ। ছায়াজগৎ আছে। সেখান থেকে তাদেরই কেউ এসেছিল মাংস খেতে। কে না জানে সোনাপিসি দুর্দান্ত মাংস রাঁধে?

অলঙ্করণ- অংশুমান দাশ

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

3 thoughts on “গল্প-বলাইবাবু-সাগরিকা রায় -শরৎ ২০২২

  1. অনবদ্য গল্প। শেষমেশ মাটনের লোভে চোর বৌ সেজে রিকশা চালিয়ে চুরি করতে এসেছে। ছায়া-কায়া মিলেমিশে একাকার। চমৎকার ভাবনা। খুব ভালো লাগল।

    Like

  2. ভীষণই ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে । বেশ অন্যরকমের । দারুণ দারুণ ।

    Like

Leave a comment