গল্প-ভয়ের সন্ধ্যা -সাগরিকা রায় -শরৎ ২০২১

সাগরিকা রায়ের আগের গল্পগুলোঃ যে কোনও দিন, ওরা ভূতপুরোহিতমশাই, ছবি তুলতে গিয়ে, নব মন্ডলের গল্প, জিকোর একটি রাত

golpobhoyersondhya

গরমকাল বলে নীলুর ঠাম্মা রোজ সন্ধেবেলায় বাড়ির বারান্দায় মাদুর পেতে বসে। বাড়ির সামনের দেবদারু, নারকেল, আমলকি গাছ থেকে ঝিরঝিরে বাতাস বয়। এসময় বড্ড আরাম হয়। নীলু আর ঝিলু দুই বোন পড়াশোনা শেষ করে ঠাকুমার কাছে এসে বসে। ততক্ষণে ঠাকুমার জপ করা কমপ্লিট। আর একটি ঘণ্টা পরেই ডিনার। নীলুর মা হটপটে করে ঠাকুমার জন্য সরু চালের ভাত, সবজি-ডাল, ছোটো মাছের পাতলা ঝোল নিয়ে আসবে। তখন নীলু-ঝিলু মায়ের সঙ্গে নতুন বাড়িতে গিয়ে ডিনার সেরে ফের ঠাকুমার কাছে শুতে চলে আসে। বড়ো খাটে নরম বিছানায় তিনজনে ঘুমোয়। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদ উঁকি দিয়ে ওদের দেখে যায়। অন্যদিন যখন আকাশে চাঁদ থাকে না, সেদিন তারাভরা আকাশ থেকে দুয়েকটি তারা উঁকি দিয়ে দেখে নীলু-ঝিলু তাদের ঠাম্মার সঙ্গে কেমন সুন্দর ঘুমোচ্ছে। ঝিলুর মাঝে মাঝে মনে হয়, ওদের তিনজনের সঙ্গে আরও কেউ এসে ঘুমোয় কখনো-কখনো। ঘরে তো রাতে আলো থাকে না। আকাশের আলো একটু একটু করে ঘরের ভেতরে এসে পৌঁছায়। সেই আলোতে ঝিলু একদিন দেখেছে ওর পাশে কে শুয়ে আছে। সে নীলু নয়। সে ঠাম্মাও নয়। তাহলে? তার মুখের একটা পাশ অল্প অল্প দেখা গেলেও ঘরে ফকফকে আলো নেই বলে মুখটার যেটুকু দেখতে পাচ্ছে ঝিলু, সেটুকুও ভালো দেখতে পাচ্ছে না। সোজাসুজি বলতে গেলে বলতে হয় মুখের জায়গাটা যেন ধোঁয়াটে। ঘোর অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে মুখের জায়গায়। সে-সব কাউকে বলতে পারেনি ঝিলু। এমনিতেই ওকে ট্যালা বলে সুমনদা। সেদিন যখন ঝিলু-নীলু দুজনেই লটকা কিনতে নেতাজি পল্লির বাজারে গিয়েছিল, সুমনদা ওদের দেখে সাইকেল থেকে নেমে অবাক গলায় বলেছে, ‘আজ কি এই বাজারে ট্যালা সম্মেলন আছে? দুজনেই যোগ দিতে এসেছিস বুঝি?’ এসবের পরে কাকে কী বলবে ঝিলু? লোকে কেবল টিটকিরি দিতে জানে। তাই ফের চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল। পাশের সেই কার গা থেকে ধূপধুনোর গন্ধ আসছিল। মাইরি!

আরেকদিন রাতে ঘুম ভেঙে যেতেই ঝিলুর মনে হল, জল খেতে হবে। ঠাম্মার বেড-সাইড টেবিলে জলের জগ থাকে। তিনজনের তিনটে ভরা জলের গেলাস থাকে ঢাকা দেওয়া অবস্থায়। ঝিলু উঠে বসেছে। ওর পাশে ঠাম্মা। ঠাম্মার ও পাশে নীলু আর নীলুর ঠিক পাশেই কে যেন হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। ঝিলু প্রথমে অবাক হয়ে গেল। কী যে হচ্ছে, বুঝতে পারছিল না। তিনজনের জায়গায় চারজন কখন, কীভাবে হল, এটা জানতে ইচ্ছে করছিল বলে ও ঠাম্মাকে ডাকল, “ওঠো ঠাম্মা। দেখো কে এসে শুয়ে পড়েছে আমাদের সঙ্গে। না বলে এভাবে কেউ কি কারও বিছানায় শুতে পারে?”

ঝিলুর কথা ঘুমন্ত ঠাম্মার কানে গেল না। কিন্তু ঝিলুর মনে হল, খাট থেকে কেউ নেমে গেল যেন। খাট নড়ে ওঠেনি, কিন্তু নেমে যাওয়ার মতো একটা ইশারা দিয়ে গেল কেউ। ঝিলু তাকিয়ে দেখে খাটে এখন ঠিক তিনজন। নীলুর পাশে কেউ নেই। কিন্তু ঘর অন্ধকার হলেও কেউ যে নেমে গেল, কেউ যে রাতের ঘরের ভেতরের ছায়ার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, সেটা ঝিলু পরিষ্কার বুঝে ফেলল। যে চলে যাচ্ছে, তার জরিপাড় লাল শাড়ি অন্ধকারেও দেখেছে ঝিলু। দেখেই গা ঝিমঝিম।

নীলুদের বাড়িটা নতুন। দোতলা বাড়ি আইভরি কালার আর ডার্ক ব্রাউনের কম্বিনেশনে চোখ টানে। একেবারেই আধুনিক ফ্যাশনের বাড়ি। কিন্তু ওদের পুরোনো বাড়িটার খানিকটা অংশ রয়ে গিয়েছে পেছনের দিকে। সেটা ঠাকুমার অনুরোধে। ঠাম্মা নতুন বাড়িতে নয়, পুরোনো বাড়িতেই থাকতে ভালোবাসে। নাকি অনেক অনেক বছর আগে এই পুরোনো বাড়িতে ঠাম্মা নতুন বৌ হয়ে এসেছিল। এমনকি ঠাম্মার শাশুড়ি-মা (ঝিলু-নীলুদের যে উনি কী হন ঝিলু সেটা এখনও খুঁজে বের করতে পারেনি। সুমনদাকে বলেছিল। তো সুমনদা বলল, ‘ফেসবুকে পোস্ট দিলেই প্রচুর উত্তর পাওয়া যাবে। তার মধ্যে কোনটা ঠিক, সেটা তোকেই বেছে নিতে হবে। ঠিক আছে। পোস্ট দিয়ে দেব।’ আজও উত্তর পায়নি ঝিলু।)-ও নাকি নতুন বৌ হয়ে লাল টুকটুকে শাড়ি পরে এই পুরোনো বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। কত পুরোনো মানুষ ছিলেন এই বাড়িতে একটা সময়! এখানে থাকলে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় নাকি ঠাম্মার। তাঁরা এই বাড়িতে আসেন চাঁদ উঠলে। শুক্লপক্ষে।

ঝিলুর বাবা সব জানে। এই বিষয়টা নিয়ে বাবা কবিতা লিখেছে, ‘যাঁরা চলে যায় তাঁরা তো আবার ফেরে/ দেওয়ালের গায়ে পড়েছে কাদের ছায়া/ হেসে ওঠে চুন-সুরকির আলপনা/ এই ইহকালে আসলে সবই কি মায়া!’

মায়া! আছে আবার নেই! যা দেখছ সব মরীচিকা। যেন স্বপ্ন। ঝিলু-নীলু অল্প অল্প বুঝল। পুরোটা নয়।

বাড়িটা এখন পুরোনো। আগে তো বাড়িটা নতুন ছিল। পুরোনো তো আস্তে আস্তে হয়। নীলুর বাবা পুরোনো বাড়িতে অ্যাটাচড বাথ, ওয়াশ রুম, গিজার, রুম হিটার, এসি মেসিন—সব লাগিয়ে চমৎকার করে দিয়েছে। কিন্তু নীলুর ঠাম্মা বাথরুমে নয়, বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরে স্নান করতে যায়। শীতকালে হাতে থাকে সর্ষের তেলের বাটি। গরমকালে নারকেল তেলের শিশি নিয়ে যায়। গামছা। সাবান। ধুঁধুলের ছিবড়ে। ঘাটের সিঁড়িতে বসে মাথায় তেল মাখে। তারপর জলে নেমে স্নান করে। স্নান সেরে ‘হরি হরায়ে নবকৃষ্ণ যাদবায়ে নমঃ’ বলতে বলতে গামছা দিয়ে ভেজা চুল ঝাড়ে। ততক্ষণে শুভা এসে তাঁর ঘর মুছে, কাপড়চোপড় কেচে দিয়ে গিয়েছে। দুপুরটা বাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। গাছদের সঙ্গে গল্পগাছা করে। কোনও গাছের গোড়া খুঁড়ে দেয়। কারো গোড়ায় জল দেয়। বিকেলে নীলু-ঝিলু ফিরে এলে তারা খেয়ে, হোমওয়ার্ক করে নেয় মৃদুলা-মিসের কাছে বসে। তারপরে চলে আসে ঠাম্মার বারান্দায়। ঠাম্মা গল্প বলে, ‘আমার ঠাকুমা লম্বা লম্বা চুলে ঠেসে তেল মাখতেন। পুকুরের সিঁড়ির ধাপে বসে কাঁচা হলুদ মাখাতেন আমায়। আর ঘানির সরস সর্ষের তেল।’ শুনে নীলু-ঝিলু সরস সর্ষের তেল মাখবে বলে বায়না করেছিল। কিন্তু কাছাকাছি ঘানি নেই বলে সেটা আর হল না।

সেদিন খুব গরম পড়েছে। ঠাম্মা অন্ধকার হয়ে আসা বারান্দায় বসে আছে। বারান্দায়  একটা টেবিল ফ্যান রয়েছে, কিন্তু তার বাতাসে নাকি ঠান্ডা নেই। তাই ফ্যানটা অফ থাকে। গাছেরা একটুও বাতাস দিচ্ছে না। চারপাশ বড়ো বেশি চুপচাপ। নীলু-ঝিলু বইপত্র গুছিয়ে  রেখে, খাবার খেয়ে, হোমওয়ার্ক করে এসে দেখল ঠাম্মা বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে। অন্যদিন ওরা এলেই ‘ভালো করে পড়া করেছ? আজ স্কুলে কী কী পড়লে? এসো, দুটো লাড্ডু খাও। টিফিন খেয়েছিলে?’ ইত্যাদি প্রশ্ন করে। আজ কিন্তু ঠাম্মা একটিও কথা বলছে না। বারান্দায় অন্যদিন লো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে। আজ বারান্দাটা এমন ঝাপসা কেন? আজ ঠাম্মা আলো জ্বালেনি কেন? এদিকটা বাড়ির পেছনদিক বলে এবং গাছপালায় ঘেরা থাকায় এমনিতেই সবসময় ছায়াচ্ছন্ন ভাব নিয়ে থাকে। আলো না থাকায় ছায়াচ্ছন্ন ভাবটা ঘন হয়ে অন্যরকম চেহারা নিয়েছে। অন্ধকারে মাদুরে বসে থাকা ঠাম্মাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। একটা অন্ধকারের মূর্তি মাত্র। ঝিলুর ভয় করে উঠল। ও নীলুর হাতটা টেনে ধরল, “দাঁড়া, আগে ঠাম্মাকে ডাকতে হবে। ওখানে কি ঠাম্মাই বসে আছে? নাকি ঠাম্মার ছায়াটা আটকে রয়েছে? দেখ, একটু নড়ছে না ঠাম্মা! এসময় কত মশা থাকে। ডেঙ্গি হয় বলে মশার ধূপ জ্বেলে রাখে ঠাম্মা। আজ ধূপের গন্ধ পাচ্ছিস নীলু? আর ছায়াটাও খুব সন্দেহজনক। ওটাকে ছেড়ে ঠাম্মা কি ঘুরতে গেল মনিকাপিসির বাড়িতে? আজ মনিকাপিসিদের বাড়ির কালীমন্দিরে অমাবস্যার ভোগ দিতে যাবে বলেছিল ঠাম্মা। সেখানেই গেছে ঠিক।”

নীলু ভারি অবাক। ছায়া তো সবসময় সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ছায়া কি নিজে থেকে আলাদা হতে পারে? ছায়া আর কায়া একই সঙ্গে থাকে। তাহলে ঝিলু কী বলছে?

ঝিলু ধীরেসুস্থে ভাবতে ভালোবাসে, “ছায়া যদি শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে ঠাম্মা রহস্যজনক মানুষ। নয়তো ঠাম্মার শরীর খারাপ করেছে। আমি শুনেছি নিজের ছায়া যদি দেখা না যায়, তাহলে নাকি মানুষ মরে যায়। কিন্তু এখানে তো অন্যরকম হচ্ছে। ছায়াটাকেই দেখা যাচ্ছে। মানুষকে নয়।”

নীলু এমন করে ভাবতে পারে না। আর পারে না বলেই ও অপেক্ষা করল না। ঝিলুর হাত ছাড়িয়ে নিয়েই এক ছুট্টে বারান্দার দিকে গেল। ঝিলু এগিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিল। এই সন্ধেটা ঠিক যেন কেমন কেমন। ঠিক চেনা সন্ধে নয়। একটা ভয়ের সন্ধে। ওদের প্রিয় ভালোবাসার ঠাম্মা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে।

নীলু ছুটে গিয়ে দেখে মাদুরের একজায়গায়, ঠিক যেখানে ঠাম্মা বসে জপ করে, সেই  জায়গায় কেউ বসে আছে। অন্ধকার এই জায়গাটুকুতে জমাট বেঁধে আছে কেউ একজন মানুষের আকৃতি নিয়েই। ঝিলু ঠিক বলেছে। এই ছায়াটা কি ঠাম্মার ছায়া? সত্যি করে ঠাম্মা নয়? তাহলে এটা কী করে হল? রাত্রি যেন সব অন্ধকার জমা করে ঠাম্মার বসার জায়গায় এসে থেমে আছে। চুপচাপ বসে আছে। এটা কী করে হয়? নীলু বাড়িতে আছে। কিন্তু ওর ছায়া স্কুলে চলে গেল? নাহ্‌, মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় ভাই। এমন কি হতে পারে? না হয় কখনও?

ঝিলু বারান্দায় না উঠে আস্তে ডাকল, “ঠাম্মা!”

ছায়া নড়ল না। কোনও জবাব দিল না। ঝিলু ফের ডাকল, “ঠাম্মা!”

এবারেও সব নিশ্চুপ। এদিকে ক্রমেই অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। চারপাশ বড্ড ঝিমঝিমে, বড্ড নিঝুম, নিঃশব্দ হয়ে উঠেছে। বাগানের গাছগুলো ছায়া ছায়া শরীর নিয়ে আস্তে আস্তে অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছে। নীলু কী করবে বুঝতে না পেরে ঝিলুকে ডাকল, “মাকে ডেকে আনতে হবে রে ঝিলু। আমার ভয় করছে।”

নীলুকে একা একা এমন ছমছমে জায়গায় রেখে যেতে পারে না। আবার ঠাম্মার জন্যও মনখারাপ করছে। ঝিলু নীলুকে টেনে নিয়ে মাকে ডাকতে ছুটল। মা বাড়ির ভেতরে মাইক্রো-ওভেনে পিৎজা বানাচ্ছিল। ওদের ছুটে আসা দেখে ওভেন অফ করে সেও ছুটল। বুড়ো মানুষ! কী হল কে জানে!

গিয়ে তিনজনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বারান্দায় আরও জমাট হয়ে উঠেছে অন্ধকার। ঠাম্মার ছায়া আরও আরও ঘন। ভালো করে এখন আর ছায়াটাকেও দেখতে পাচ্ছে না ওরা। ওদের মা এগিয়ে গিয়ে ‘মা’ বলে ডেকে উঠেছে, অমনি ঘরের ভেতরের আলো জ্বলে উঠল। তারপরে বারান্দার আলোও। আশ্চর্য! বারান্দায় বসে আছে ঠাম্মা! ওদের দেখে বলল, “এসো, এসো। আজ পড়াশোনা কেমন হল?”

ওরা তো অবাক। ওদের মা জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে চুপ করে বসেছিলে দেখে ওরা ভয় পেয়ে আমাকে ডেকে আনল। কী হয়েছিল?”

“আমি চুপ করে বসেছিলাম? না তো! আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই-এইমাত্র এসে বসেছি। এখন জপ করব। দেরি হয়ে গেল আজ। ওরা কখন এসেছিল? আমায় ডাকল না কেন?”

নীলু বলল, “সে কি গো ঠাম্মা! কতবার যে ডেকেছি তোমাকে! তুমি জবাব দিচ্ছিলে না। এদিকে অন্ধকার হয়ে উঠল চারপাশ। আর দেখতে পাচ্ছিলাম না তোমাকে। তাই তো মাকে ডেকে আনতে হল।”

ঝিলু বলল, “আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। তোমার ছায়া বসে আছে, জবাব দিচ্ছে না।”

শুনেই ঠাম্মার মুখ কেমন কেমন হয়ে গেল। ওদের মাকে বলল, “রিয়া, তুমি কি এখানে এসে ছায়া দেখেছ?”

“ছায়া দেখাই যায়নি। আলো না জ্বললে ঘোর অন্ধকারে কিচ্ছু দেখতেই পাচ্ছিলাম না।”

সেদিন রাতে ঠাম্মি ওদের সঙ্গে দোতলা বাড়িতে এসে ধূপধুনো ঘুরিয়ে গেল। বলল, “আজ আমার ঠাকুমা শাশুড়ির মৃত্যুদিন। উনি বহুবছর আগে এইদিনে চলে গিয়েছেন। আমি প্রতিবছর এই দিনে তাঁর নামে পুজো দিই। আজ বডড ভুল হয়ে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যাক। এখন আমি একটু তাঁর নামে প্রার্থনা করব। তোমরাও এসো।”

নীলু-ঝিলু ওদের মা-বাবার সঙ্গে বসে কোন এক অনেকদিন আগের আপনজনের জন্য  প্রার্থনা করল। মা বলে, মরে গেলেও তিনি আমাদের একজন ছিলেন। সে-কথা ভুলতে হয় না। সত্যি। ঠাম্মার সেই বুড়ো শাশুড়ি-ঠাম্মার জন্য আজ কষ্ট হল নীলু-ঝিলুর। কে জানে তিনি কেমন ছিলেন। কোন এক স্বর্গে বসে সরস সরষের তেল মাখছেন হয়তো! আচ্ছা, স্বর্গে ঘানি আছে?

পুজো দিয়ে, রাতের খাবার খেয়ে ঠাম্মা ওদের নিয়ে নিজের পুরোনো বাড়িতে শুতে চলল। ছোটো বারান্দায় অল্প পাওয়ারের আলো জ্বলছে। এখন আর ছমছমে ভাবটা নেই। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। ঠাম্মা বলল, “শুক্লা ষষ্ঠীর চাঁদ। এই তিথিতেই উনি চলে গেলেন। খুব ভালোবাসতেন আমাকে। কী ভাবলেন আজ কে জানে! এমন দিনটি ভুলে গেলাম কী করে? উনি হয়তো কষ্ট পেলেন।” ঠাম্মা বড়ো করে শ্বাস ফেলল।

ঝিলু শ্বাসের শব্দে বুঝল আজ ঠাম্মার মনটা খারাপ হয়ে আছে। এই বাড়ির সবটুকুই ঝিলুর ভারি ভালো লাগে। ঠাম্মার ঠাম্মা-শাশুড়ি এই বাড়ির কথা ভুলে যাননি? তিনি কি ঝিলুকে চেনেন? নীলুকেও? আত্মা কেমন হয় দেখতে? কত দূর থেকে তিনি এই বাড়িটিকে মনে রেখে ফিরে আসেন!

কোথায় একটা হালকা শব্দ হল। জামগাছের পাতা পড়ল হয়তো বাইরের বারান্দার ওপরে। সকালে দেখা যায় শুকনো পাতা পড়ে আছে বারান্দায়। ঝিলু চোখ বন্ধ করে ছিল। কিন্তু হালকা ধূপধুনোর গন্ধ নাকে আসতেই উঠে বসল। কেউ কি এসেছে এই ঘরে? এখন তিনজন নেই আর। মনে হচ্ছে কারা হালকা পায়ে চলাফেরা করছে যেন। যদি তাঁরা ফিরে আসেন, ঝিলু দেখবে না? পা টিপে টিপে খাট থেকে নেমে একটু দাঁড়াল ঝিলু। ঘর অন্ধকার। পাশের ঘরে কেউ বা কারা আছে। ঝিলু আস্তে আস্তে পাশের ঘরে উঁকি দিল। বড্ড বেশি অন্ধকার এখানে। ঠাম্মার যত পুরোনো জিনিসে ঘর সাজিয়ে রাখা। আগের দিনের বড়ো বড়ো আলমারি, খাট, আরামকেদারা… ঝিলু এগিয়ে গেল অন্ধকারেই। এখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! ঝিলুর পাশ ঘেঁষে সে চলে যাচ্ছে যেন। ঝিলু দেখতে পাচ্ছে লম্বা লম্বা চুলে পিঠ ঢেকে থাকা একটি নারী শরীর অথবা নারীর ছায়া। সে যেন আছে, যেন নেই। ঝিলু তাকে ধরে ফেলতে পারবে না। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে যেন ঝিলুর উপস্থিতির কথা অনুভব করে চলে যাচ্ছে। ঝিলু তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেওয়ালের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল সে। লাল জরিপাড়ের শাড়ির খানিকটা চোখের সামনে দুলে উঠল মাত্র। বিমূঢ় ঝিলু দেওয়ালের ওপরে আবছা আলো ছায়ার কারিকুরি দেখছে। বাবার বলা কথাগুলো মনে পড়ল। আসলে সবই মায়া! দেওয়ালের গায়ে পড়েছে কাদের ছায়া/…এই ইহকালে আসলে সবই কি মায়া…

ঝিলু শুয়ে শুয়ে বুঝতে পারছে নীলু ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠাম্মাও। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলবে ঝিলু বড্ড পেকেছে—শুধু প্রশ্ন করে। কিন্তু প্রশ্ন না করে কী করবে ঝিলু? ওরা যখন মাকে নিয়ে এল, ঠাম্মা বারান্দায় এসে জপ করতে বসেই গিয়েছে। ঠাম্মা বলছে, তখনই এসেছে ঠাম্মা। তাহলে আগে বারান্দায় চুপ করে কে বসে ছিল?

পাশ থেকে নীলু ফিসফিস করে, “ঝিলু, ঠাম্মা বারান্দায় ছিল। তাহলে প্রথমে ঘরের আর পরে বারান্দার আলো জ্বালল কে?”

ঝিলু জানে। কিছু বলল না।

ছবি-শিমূল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s