জয়ঢাকি ট্রেক গল্প প্রতিযোগিতা ২০২২-তৃতীয় স্থান -আলিনগরের বিশ্বাসঘাতক রাজা-রঞ্জন পরামাণিক-শরৎ ২০২২

golpoalinagar

তিন্নির মনমেজাজ ইদানীং একেবারেই ভালো যাচ্ছে না। হতচ্ছাড়া করোনার জন্য চোখের সামনে দিয়ে জলজ্যান্ত দুটো বছর জলে চলে গেল। সেভাবে কোনও পরীক্ষা হল না; নতুন করে কোনও নিয়োগের খবরও ঘোষণা করছে না সরকার। ২০১৮-য় গ্র্যাজুয়েশন করার পর থেকেই সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিল সে। ছোটোখাটো একটা ইন্সটিটিউটে ভর্তিও হয়ে নিয়েছিল প্রস্তুতির জন্য। সিলেবাস তো কম নয়! কী আছে বলার থেকে কী নেই বলাই বেশি সহজ। তবু চাকরি পাচ্ছে তো লোকে। তিন্নির চেনাজানা কয়েকজন দাদা-দিদিই তো পেয়েছে। তাদের দেখে উৎসাহিত হয়ে তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল তিন্নি। দেড় বছরের মধ্যে নিজেকে সবে কিছুটা গুছিয়েছে; দু-একখানা পরীক্ষাতেও বসেছে; ইতিমধ্যে ওই শয়তান ভাইরাস এসে হাজির হল! দিল সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে। কতদিনে এখন সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হবে, তাই-বা কে জানে! এইসব নিয়ে ইদানীং মন বড়ো বিগড়ে থাকে তার। বাড়িতে মা-বাবা বকাবকি করেন। বলেন, এত চিন্তা করলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। কিন্তু তিন্নি ভাবে, সুস্থই-বা কে আছে এখন? গোটা পৃথিবীটাই তো অসুখের চিন্তায় অস্থির!

ইতিমধ্যে পুজো এল। বাইরে বেরোনো যাবে কি যাবে না, সেই নিয়েও এক সংশয় সকলের মনে। মা জোর করে তিন্নিকে পাঠিয়ে দিলেন মাসির বাড়ি। বললেন, “ঘুরে আয় ক’টা দিন। মনটা ভালো লাগবে।”

তিন্নির মাসির বাড়ি বেহালার কাছে বড়িশায়। ওদের বাড়ির পাশেই একটা পুজো হয়। পরিবারের সকলেই যোগ দেয় সেই পুজোতে। এর আগেও এখানে কয়েকবার এসেছে তিন্নি। মন্দ লাগে না। মেসোমশাই মন্টুবাবু ভারি আড্ডাপ্রিয় মানুষ। ছোটোবড়ো সবাইকে নিয়ে আসর জমিয়ে গল্প করতে ভালোবাসেন। তাছাড়া মাসির জায়ের মেয়ে বর্ষা তিন্নির থেকে একবছরের ছোটো। সেও তিন্নির পরের বছর গ্র্যাজুয়েশন চুকিয়ে শুরু করেছে চাকরির পড়াশুনা। একই পথের পথিক হওয়ায় তিন্নির সঙ্গে তার খুব ভাব। নিয়মিত কথা হয় ফোনে। মাসির বাড়ি এলে বর্ষা প্রায় সর্বক্ষণই তিন্নির সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।

সেদিন অষ্টমীর অঞ্জলি শেষ হবার পর মণ্ডপেই বসে ছিল সবাই। এটা-সেটা কথা হতে হতে বর্ষা হঠাৎ তিন্নিকে বলল, “সেদিন তোমায় ফোন করেছিলাম তিন্নিদি, প্রিভিয়াস ইয়ারের প্রশ্ন ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা প্রশ্ন পেলাম ইতিহাসের।”

“কী প্রশ্ন?” কান খাড়া করল তিন্নি।

“এঁদের মধ্যে কোনজন পলাশীর যুদ্ধের আগে সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িত ছিলেন? অপশনগুলো ছিল মোহনলাল, মীরমদন, মানিকচাঁদ আর উপরের কোনোটিই নয়। কী হবে বলো তো?”

তিন্নি ভ্রূ কুঁচকে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “আমার মনে হয় মানিকচাঁদ হবে।”

মন্টুমেসো ওদিক থেকে জোর দিয়ে বললেন, “অবশ্যই মানিকচাঁদ হবে।”

হঠাৎ করে মেসোকে এতখানি নিশ্চিত হতে দেখে তিন্নি-বর্ষা দুজনেই একটু অবাক হয়ে তাকাল ওঁর দিকে। উনি ওদের অবাক হবার ভাবটা লক্ষ করে বললেন, “তোরা ভাবছিস আমি এত নিশ্চিত হলাম কীভাবে? দেখ, আর যে দুজনের নাম বর্ষা বলল, তাঁদের সম্পর্কে আমি কিচ্ছু জানি না। তবে ছেলেবেলায় আমার দাদুর কাছে গল্প শুনেছিলাম, মানিকচাঁদের ষড়যন্ত্র না থাকলে নাকি পলাশীর যুদ্ধ হত না।”

যথারীতি বিষয়টা আকর্ষণীয় মনে হল ওদের দুজনের কাছে। যেহেতু ইদানীং এইসব পরীক্ষার ইত্যাদির কারণে ইতিহাস নিয়ে একটু গভীরেই খোঁজখবর রাখতে হচ্ছে। বর্ষা বলল, “মানিকচাঁদের সম্পর্কে কী গল্প শুনেছিলে?”

মন্টুমেসো বললেন, “সে শুনেছিলাম বহুবছর আগে। সব তো ঠিকঠাক মনে নেই। তাছাড়া সাল-তারিখ ওসব আমার মনে থাকেও না। তোরা দিনরাত পড়াশুনা করছিস, তোরা হয়তো আরও ভালো জানবি আমার থেকে।”

তিন্নি বলল, “কিন্তু আমরা যেগুলো পড়ি সেগুলো তো স্কুলপাঠ্য সিলেবাসেরই আর একটু ঝাড়াবাছা পয়েন্ট। মানিকচাঁদ সম্পর্কে তো কই, পাঠ্য সিলেবাসে তেমন কিছু ছিল বলে মনে পড়ছে না।”

মন্টুমেসো বললেন, “হ্যাঁ, আমার দাদুও সেই কথা বলতেন। বলতেন, ইতিহাসের এটা একটা অনুচ্চারিত অধ্যায়। আসলে বাস্তবে যা কিছু ঘটে, সময় পেরিয়ে সেটাই ইতিহাস বইতে স্থান পায়। কিন্তু যা ঘটতে পারত, তা নিয়ে তো আর কেউ চর্চা করে না।”

বর্ষা খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলল, “কী যে তুমি খাপছাড়া খাপছাড়া বলছ কাকুমণি, কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার দাদুর কাছে মানিকচাঁদ সম্পর্কে যে গল্পটা শুনেছিলে, সেটা যতটুকু মনে আছে বলো না।”

মৃদু একটু হাসলেন মন্টুমেসো। বললেন, “যতটুকু মনে আছে বলতে পারি। তবে সাল-তারিখের ব্যাপারে কিন্তু তোদের একটু খেই ধরিয়ে দিতে হবে।”

বর্ষা উৎসাহিত হয়ে বলল, “সেজন্য তো তিন্নিদি আছেই। তুমি শুরু করো।”

চেয়ারে বেশ আয়েশ করে বসে নাকে একটু নস্যি দিয়ে নিলেন মন্টুমেসো। তারপর মাস্টারি কেতায় শুরু করলেন একটা প্রশ্ন দিয়ে, “আচ্ছা বল তো, বাংলায় যে একসময় ভয়ংকর বর্গি আক্রমণ হয়েছিল, কোন নবাব সেই বর্গিদের প্রতিহত করেছিলেন?”

প্রশ্ন প্রায় শেষ হবার আগেই তিন্নি জবাব দিল, “নবাব আলিবর্দি খাঁ।”

মন্টুমেসো ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, “ঠিক। আর সেই আলিবর্দি খাঁয়েরই মেয়ের ঘরের ছোটো নাতি সিরাজদ্দৌলা। আলিবর্দি খাঁ নবাব হবার অনেক আগে থাকতেই কিন্তু ইংরেজরা ঢুকে পড়েছিল আমাদের দেশে। তখন অবশ্য তারা এসেছিল স্রেফ ব্যবসায়ী হিসেবে।”

তিন্নি যোগ করল, “হ্যাঁ, দিল্লির সিংহাসনে থাকাকালীন সম্রাট ফারুকশিয়র ১৭১৭ সালে বার্ষিক ৩০০০ টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিনা শুল্কে বাংলায় বাণিজ্য করবার ছাড়পত্র বা ‘দস্তক’ দিয়েছিলেন।”

মন্টুমেসো আবার ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, “ঠিক। কিন্তু নবাব আলিবর্দি খাঁ গোড়া থেকেই ইংরেজদের গতিবিধি খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। তিনি নাতি সিরাজকেও সাবধান করেছিলেন যেন ইংরেজদের বেশি বাড়তে দেওয়া না হয়। আলিবর্দি খাঁ মারা যাবার পর সিরাজদ্দৌলা মসনদে বসলেন। তিনি দেখলেন, নবাবের প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মোটেই অনুগত নয়। উলটে নবাবের আড়ালে যারা ষড়যন্ত্র করে বেড়ায়, ইংরেজরা আড়ালে তাদের মদত দিচ্ছে। ব্যস, লেগে গেল বিরোধ! এক ধাক্কায় তিনি কলকাতা থেকে সমস্ত ইংরেজদের উৎখাত করে দিলেন। সে-সময় নগরীর নাম ছিল ‘কোলকাতা’, তিনি নতুন নাম দিলেন ‘আলিনগর’।”

তিন্নি বলল, “দাদু আলিবর্দির নাম থেকে আলিনগর। এই জায়গাটা আমাদের সিলেবাসে আছে তো! নবাব সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদের তাড়িয়ে কলকাতা অধিকার করেছিলেন ১৭৫৬ সালের ২০শে জুন।”

মন্টুমেসো মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে বললেন, “নতুনভাবে আলিনগর প্রতিষ্ঠা করে নবাব সেই নতুন নগরের শাসক করে দিলেন মানিকচাঁদকে। মানিকচাঁদের আসল নাম ছিল মানিকরাম বসু। খাঁটি বাঙালি কিন্তু! পৈতৃক বসত হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ার কাছে। প্রথম জীবনে তিনি বর্ধমানের কোনও এক রাজার কর্মচারী ছিলেন। সেই রাজা তাঁকে ‘দেওয়ান’ উপাধি দেন। নবাব আলিবর্দি আবার তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। পরে অবশ্য আলিনগর শাসন করতে গিয়ে রাজা তিনি সত্যিই হয়েছিলেন। তবে বিশ্বাসঘাতক রাজা!”

তিন্নি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন বিশ্বাসঘাতক হলেন? এতক্ষণ যা বললে, তা থেকে তো বোঝা যায়, নবাবের সঙ্গে মানিকচাঁদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। তাহলে আবার খামোখা ষড়যন্ত্রের কী প্রয়োজন হল?”

মন্টুমেসো হেসে বললেন, “তা একপ্রকার মতিভ্রমই বলা যায়। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে…”

প্রবাদটা সমাপ্ত হতে না দিয়েই বর্ষা বলল, “আচ্ছা, কলকাতা দখল করার পর নবাব সিরাজদ্দৌলা নিজে কেন শাসন করলেন না? অন্য একজনকে শাসনের দায়িত্ব দিলেন কেন?”

মন্টুমেসো বললেন, “আরে, নবাবের আসল রাজধানী তো ছিল মুর্শিদাবাদে। এদিকে কলকাতা দখল করেছেন। একা মানুষ কোনদিক সামলাবেন? মানিকচাঁদকে খুব বিশ্বাস করতেন; তাই এখানকার দায়িত্ব তাঁকে দিয়ে নিজে ফিরে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে। এদিকে মানিকচাঁদ কলকাতার রাজা হলেও খাস কলকাতায় কিন্তু তিনি কখনও থাকেননি। তিনি কোথায় থাকতেন জানিস?”

বর্ষা-তিন্নি দুজনে একসঙ্গে বলল, “কোথায়?”

মন্টুমেসো একটু থেমে আরেক দফা নস্যি নিয়ে একটু হেসে যেন রহস্য উদ্ঘাটন করছেন, এমনভাবে বললেন, “আমাদের এই বেহালার কাছেই ডায়মন্ড হারবার রোডের উপর একটা প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি ছিল তাঁর। সেই বাড়িটাই ছিল রাজা মানিকচাঁদের রাজপ্রাসাদ।”

বর্ষা যেন আকাশ থেকে পড়ল শুনে—“আমাদের এখানে? কই, আগে কখনও শুনিনি তো কারও কাছে! সে-বাড়ি এখনও আছে?”

মন্টুমেসো পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক মুছতে মুছতে বললেন, “সে-সব আর এখন থাকে! এইসব ঘটনা সেই ১৭০০ – ১৮০০ সালের। আর এটা কোথায় ২০২১। তবে দাদুর কাছে শুনেছি, মানিকচাঁদ মারা যাবার পর নাকি সেই বাড়িতে এক অবাঙালি এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন। তিনি আবার ঘোড়দৌড়ের কেতায় কুকুরদৌড়ের খেলা চালু করেন। তারপর একসময় সেই জায়গা সরকার থেকে অধিগ্রহণ করা হয়। বড়ো বড়ো হাউসিং এস্টেট তৈরি করানো হয় সেখানে।”

তিন্নি বলল, “ছিঃ! অমন একটা ঐতিহাসিক জায়গায় তো মিউজিয়াম তৈরি হওয়া উচিত ছিল। সেখানে কুকুরদৌড়ের মাঠ হল?”

মন্টুমেসো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন, “তা ছিল বটে। তবে শুনেছি, সরকার মানিকচাঁদের কথা ভুলে গেলেও সেই অবাঙালির কীর্তির কথা কিন্তু ভোলেনি। যে হাউসিং এস্টেট ওই জায়গায় হয়েছিল, তার নাকি নাম রাখা হয়েছিল ‘পুরাতন কুকুরদৌড় মাঠের হাউসিং এস্টেট’।”

বর্ষা বলল, “বাবা! ভারি অদ্ভুত নাম তো!”

তিন্নি বলল, “আচ্ছা, এসব তো গেল মানিকচাঁদের নিজস্ব বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার। নবাবের বিরুদ্ধে তিনি কী ষড়যন্ত্র করলেন, সেটা তো জানা হল না।”

মন্টুমেসো বললেন, “ভালো কথা মনে করিয়েছিস। সে গল্পটাও দারুণ রোমাঞ্চকর। নবাব তো এদিকে কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দিলেন। বিতাড়িত ইংরেজদের তখন দিশেহারা অবস্থা। এখান থেকে পালিয়ে তারা গিয়ে উঠল সেই ফলতায়। সেখানে ডাচদের একটা পরিত্যক্ত কুঠি ছিল, সেটাই হল তাদের মাথা গোঁজবার ঠাঁই। খাবার পায় না। ভালো জল পায় না। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে থাকতে থাকতে অনেক ইংরেজ মরেই গেল। সে-সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হেড অফিস ছিল মাদ্রাজে। সাহায্যের জন্য খবর পাঠানো হয়েছিল সেখানে। কিছুদিন পর সৈন্যসামন্ত নিয়ে মাদ্রাজ থেকে দুজন সেনাপতিকে পাঠানো হল। তাদের মধ্যে একজন হলেন ক্লাইভ।”

তিন্নি বলল, “ক্লাইভ মানে লর্ড ক্লাইভ? যিনি পরে গভর্নর হয়েছিলেন?”

মন্টুমেসো বললেন, “হ্যাঁ, ওই ক্লাইভ। আরেকজনের নামটা ঠিক মনে নেই আমার।* তবে ওঁদের সঙ্গে হেস্টিংসও এসেছিলেন। তখন তিনি একজন সামান্য ক্লার্ক।”

তিন্নি বলল, “প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস?”

মন্টুমেসো বললেন, “হ্যাঁ। ওঁরা এসে দেখলেন ফলতায় যারা বাস করছেন, তাদের দশা খুবই করুণ। ওই জায়গা থেকে ওদের বাঁচাতে গেলে কলকাতা আবার দখল নিতে হবে। কিন্তু নবাবের সৈন্যবাহিনী তো বিশাল! তার সঙ্গে অল্প সৈন্য নিয়ে তারা পেরে উঠবে কীভাবে? কাজেই অন্যপথ ধরতে হল। চুপিচুপি তাঁরা আলিনগরের রাজা মানিকচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। যেভাবেই হোক মানিকচাঁদ কিন্তু টের পেয়েছিলেন, ইংরেজরা নবাব সিরাজদ্দৌলার থেকে বেশি ধুরন্ধর। অদূর ভবিষ্যতে তারাই হয়তো এই দেশের মাথায় বসবে। সুতরাং আগে থাকতেই তাদের ছাউনির নীচে চলে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। তলে তলে সব গড়াপেটা হয়ে গেল। ওদিকে নবাবকে খবর দেওয়া হল, ইংরেজ সেপাহিরা কলকাতা দখল নিতে এসেছে। নবাব হুকুম পাঠালেন, যুদ্ধ করে ওদের নিপাত করে দাও।”

তিন্নি জিজ্ঞেস করল, “এটা ঠিক কোন সময়ের ঘটনা?”

মন্টুমেসো বললেন, “ওই পলাশীর যুদ্ধের মাস ছ’-সাতেক আগে হবে। পলাশীর যুদ্ধ কখন হয়েছিল বল?”

এবার উত্তর দিল বর্ষা, “১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।”

সদ্য কিছুদিন আগেই এই জায়গাটা সে মুখস্থ করেছে।

মন্টুমেসো মনে মনে একটা যোগবিয়োগ করে নিয়ে বললেন, “তাহলে এটা ওই ১৭৫৬-র ডিসেম্বরের ঘটনা হবে। তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই।** ছোটোমতো একটা যুদ্ধ হয়েছিল। নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর।”

তিন্নি জিজ্ঞেস করল, “কোন জায়গায় হয়েছিল এটা?”

মন্টুমেসো বললেন, “এটা হয়েছিল বজবজ কেল্লার পাশে। তারাতলা দিয়ে সোজা রাস্তাটা ধরে গেলে ডাকঘর, বাটানগর পেরিয়ে বজবজ বলে একটা জায়গা আছে, জানিস নিশ্চয়ই?”

বর্ষা বলল, “জানি। ওখানে একটা নতুন আই.টি. কলেজ হয়েছে। সেখানে আমার এক বন্ধু পড়ে।”

মন্টুমেসো বললেন, “হ্যাঁ। ওই বজবজে রাজা প্রতাপাদিত্যের একটা কেল্লা ছিল। কেউ বলে কেল্লা, কেউ বলে নৌঘাঁটি। যাই হোক, সেই কেল্লার পাশে ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের সৈন্যবাহিনীর লড়াই বাধে। লড়াই মানে মানে তাকে একপ্রকার খণ্ডযুদ্ধই বলা যায়। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার।”

তিন্নি জিজ্ঞেস করল, “সেই যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলা নিজে এসেছিলেন?”

মন্টুমেসো বললেন, “না, না। ওই রাজা মানিকচাঁদকেই পাঠিয়েছিলেন সেনাপতি করে। যিনি আগে থাকতেই ইংরেজদের কাছে মাথা বিকিয়ে বসেছিলেন। শোনা যায়, যুদ্ধটা নাকি প্রথমদিকে ভালোই জমে উঠেছিল। হাতির উপর হাওদায় বসে যুদ্ধ করছিলেন মানিকচাঁদ। এমন সময় একটি কামানের গোলা হঠাৎ তাঁর পাগড়ির পাশ দিয়ে ছুটে চলে যায়। অমনি তিনি ভয়ে আঁতকে ওঠেন! সঙ্গে সঙ্গে মাহুতকে হুকুম দিলেন, হাতি ঘোরাও। দৌড় লাগালেন আলিনগরের দিকে। সেনাপতি পালিয়ে যেতে সৈন্যরাও দিশেহারা হয়ে রণে ভঙ্গ দিল। নামমাত্র চেষ্টায় বজবজ কেল্লা দখল করে নিল ক্লাইভের বাহিনী। অথচ কেল্লায় অস্ত্রশস্ত্র ভালোই মজুত ছিল। সেসব নিয়ে ঠিকমতো যুদ্ধ করলে হয়তো ব্রিটিশদের এখান থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে। পলাশীর যুদ্ধের আর দরকারই পড়ত না। কিন্তু মানিকচাঁদের বিশ্বাসঘাতকতায় সব গোলমাল হয়ে গেল।”

তিন্নি গভীর বিস্ময়ের স্বরে বলল, “কী ছেলেমানুষি ব্যাপার! মাত্র একটা লোকের দুরভিসন্ধির জন্য সমস্ত ওলটপালট হয়ে গেল?”

মন্টুমেসো ম্লান হেসে বললেন, “ভারতবর্ষের ইতিহাসটাই পালটে গেল।”

বর্ষা বলল, “তাহলে সবাই যে একা মীরজাফরকেই দায়ী করে! মানিকচাঁদও তো কিছু কম ছিল না, বলো?”

মন্টুমেসো বললেন, “তা তো বটেই! তবে কী জানিস, সেই বেদ-পুরাণের আমল থেকে পৃথিবীর সমস্ত দেশের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকদের ছড়াছাড়ি। মানিকচাঁদ তাদেরই একজন।”

তিন্নি বলল, “এই কুকর্মের জন্য মানিকচাঁদের কোনও শাস্তি হয়নি পরে?”

মন্টুমেসো বললেন, “সে বিষয়ে তো বিশেষ কিছু জানি না। ওটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব তোদেরকেই দিলাম। ইতিহাস তো শুধু মুখস্থ করলেই চলবে না! ইতিহাসকে ভালোবাসতে হবে। কত রহস্যই যে লুকিয়ে থাকে সময়ের গর্ভে, খুঁজে বের করা আর হয়ে ওঠে কোথায়? এই যেমন ধর, দাদুর কাছে সেই কোন ছেলেবেলায় শুনেছিলাম মানিকচাঁদের বাগানবাড়ি ছিল আমাদের এই বেহালারই কোনও একটা জায়গায়। তারপর থেকে এত বছর কেটে গেল; চুলে পাক ধরে গেল গেল; অথচ আজ অবধি সে-জায়গাটা খুঁজে বের করার কি চেষ্টা করেছি কখনও?”

বর্ষা বলল, “এখন তো সে-জায়গা খুঁজলে পাওয়াও যাবে না হয়তো। কারণ, সরকারি হাউসিং হয়ে গেছে, তাও তো অনেক বছর হল নিশ্চয়ই!”

মন্টুমেসো বললেন, “তা হয়েছে। তবু জায়গাটার লোকেশনটা চেষ্টা করলে খুঁজে বের করা গেলেও যেতে পারে।”

তিন্নি উদ্ভাসিত মুখে বলল, “যাবে মেসো খুঁজতে?”

মন্টুমেসো বললেন, “তা গেলেই হয়!”

বর্ষা বলল, “কবে যাবে?”

মন্টুমেসো বললেন, “আজই চলো। খেয়েদেয়ে বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়া যাক।”

তিন্নি-বর্ষা দুজনেই রীতিমতো উৎসাহিত। বলল, “দারুণ হবে কিন্তু জায়গাটা যদি খুঁজে পাওয়া যায়!”

সেই বিকেলেই দুই তরুণী আর এক বয়স্ক তরুণ বেরিয়ে পড়ল রাজা মানিকচাঁদের বাগানবাড়ি খুঁজতে। সত্যি সত্যি তারা খুঁজে পেয়েছিল কি না, সে আবার অন্য আরেকটা গল্প। সে গল্পটা না-হয় আরেকদিন করা যাবে।

পুনশ্চ:

গল্প বলার সময় মন্টুমেসো যে দুটো পয়েন্ট মনে করতে পারছিলেন না—

* ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজের হেড অফিস থেকে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য যে দুজন সেনাপতিকে পাঠানো হয়েছিল; তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ এবং অন্যজন অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসন। জাহাজে করে সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাঁরা ফলতায় এসে পৌঁছান ১৭৫৬ সালের ১৬ই অক্টোবর।

** বজবজ কেল্লার পাশে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর সংক্ষিপ্ত যুদ্ধটা হয়েছিল ১৭৫৬ সালের ২৯শে ডিসেম্বর। যুদ্ধ চলেছিল প্রায় আধঘণ্টার মতো। এতে ব্রিটিশদের একজন অফিসার (N. Shine Charles Ker) মারা যান। এছাড়া সৈন্যদের মধ্যে ৯ জন নিহত এবং ৮ জনের মতো আহত হন। অন্যদিকে, ইংরেজদের হাতে নবাব-বাহিনীর প্রায় ২০০ জনের মতো সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিলেন।

অলঙ্করণ- স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s