ভূত মানেই যে ভয় দেখায়। যে আগে ছিল এখন নেই। কিন্তু ভূত শুধু জীবন্ত প্রাণী মরেই হয় না। একটা বইও তো ভূত হতে পারে। যদি তার কোনো কাজ বাকি রয়ে যায় তাহলে।
এই রকম একটা ঘটনা হয়েছিল। সেই বইটি যাকে একটি মেয়ে একদিন পড়তে শুরু করেছিল। বইয়ের মধ্যের চরিত্রগুলো মেয়েটির মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল। চরিত্রগুলোকে সে জীবন্ত ভাবতে শুরু করেছিল। চরিত্রগুলো তাকে গল্প শোনাত। এমন সময় সেই বইটাকে মেয়েটি অর্ধেক পড়ে, তাকের এক কোণায় রেখে দিল। তারপর সে, সেই বইটা আর তার চরিত্রদের ভুলে গেল। আর বইয়ের চরিত্রগুলো ও বইটি অপেক্ষা করতে থাকল। বছরের পর বছর কেটে গেল। সেই বইটা ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরে গেল। কেউ বইটা খেয়ালই করল না। বই-এর চরিত্রগুলো প্রতিশোধ নেওয়ার সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।
মেয়েটির নাম ছিল ভূমিকা। সে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিল যে সেই বইটা ছিল ভূতের গল্পের বই। গল্পে সব ভয়ানক ভয়ানক ভূতের কথা লেখা ছিল।
একদিন ভূমিকার মা সেই বইয়ের তাকটা পরিষ্কার করেছিল। তার হাতে লেগে সেই ভূতের বইটা পড়ে গিয়ে তার পাতাগুলো খুলে গেলো। তার মা সেটা খেয়াল করল না। বইটা খোলাই রয়ে গেল। এই সময়ের জন্যই ভূতগুলো এতদিন অপেক্ষা করছিল।
সেই রাত্রে হঠাৎ ভূমিকার ঘুম ভেঙে গেল। তার আর কিছুতেই ঘুম এল না। প্রচন্ড ঘাম দিতে লাগল আর শরীরে কীরকম অস্বস্তি হতে লাগল। সে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দেখছিল। অমাবস্যার মাঝরাত ভীষণ জোরে বাতাস বইছে। বাতাসের মধ্যে এক খ্যাসখ্যাসে তৃষ্ণার্ত গলার ডাক। সবদিক ঘিরে আছে অন্ধকার ঝোপঝাড়। সরু সরু পাতার ফাঁকে অন্ধকারে মিশে থাকা কেউ যেন তীক্ষ্ণ চোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে। ভূমিকা দেখল এ রকম অনুভূতি শুধু যেন তার একারই হচ্ছে। বাড়ির সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
ওদিকে সেই বই-এর দুষ্টু ভূতগুলো বই থেকে একের পর এক বেড়িয়ে পড়েছিল। তাদের মুখে বিকট বিকট হাসি আর একটাই কথা এবার বদলা নেবার পালা।
ভূমিকার প্রচন্ড ভয় করছিল। হঠাৎ একটা জিনিস প্রচন্ড জোরে এসে ভূমিকার মাথায় লাগল। সে দেখল একটা মোটা কেঁদো বই। তার মাথায় খুব ব্যথা লেগেছে। বই খুলতে তার থেকে অনেক কটা মাকড়সা কিলবিল করে বেড়িয়ে এল। আর সেগুলো তার গায়ে উঠে এল। সে মাকড়সাগুলো ঝারতে ঝারতে বইয়ের ঘরে চলে গেল। তখন হাতের আঙুলের মতো ছোটো ছোটো শিংওলা ভূতগুলো তার পা দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধছিল। যখন ভূমিকা দড়িটা খুলতে যাবে অমনি সবচেয়ে দুষ্টু ভূতটা বইয়ের আলমারিটা ভূমিকার উপর ফেলে দিল। তার সারা শরীর বইয়ে ভরা ভারী আলমারির তলায় চাপা পড়ে গেল। শুধু মাথাটা চাপা পড়েনি।
সে ওঠার চেষ্টা করেও পারল না। তখনি তার জামায় ঢুকে থাকা মাকড়সা সুরসুরি দিতে লাগল। এক দিকে মাথায় ব্যথা অন্যদিকে ভারী বইয়ের আলমারির তলায় চাপা পড়া আর মাকড়সার অসহ্যকর সুরসুরি তো আছেই। আর সইতে না পেরে ভূমিকা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল। তখন বইয়ের সব ভূতগুলো সামনে এল। কী বিচ্ছিরি তাদের দেখতে। কোনোটার চোখ নেই, কোনোটার আবার মুন্ডুই নেই। কার বড়ো বড়ো ধারওয়ালা দাঁত। এসব দেখে ভূমিকা ভয়ে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। তাকে কাঁদতে দেখে ভূতগুলো হেসে কুটোপাটি খাচ্ছিল।
তখন ভূতগুলো বলল, “এঁই টঁকুঁ তেঁই কেঁদেঁ ফেঁললে! তাঁহলে বোঁঝোঁ আঁমাদেঁর এঁতদিঁন অঁর্ধেক পঁড়ে রেঁখে দিঁয়েছিঁলে। আঁমাদেঁর কঁত কঁষ্ট হঁয়েছিঁল!”
ভূমিকা বলল, “আমি আর কোনো বই অর্ধেক পড়ে রেখে দেব না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ছেড়ে দাও।”
তখন ব্রহ্মদত্যি বলল, “না না তা হবে না। এতদিন পর আমরা বেরিয়েছি। এখন উৎসব হবে।”
শাকচুন্নি বলল, “আঁমরা ওঁকে ভেঁজেঁ খাঁব। ওঁহো যাঁ খেঁতেঁ হঁবে নাঁ!”
ড্রাকুলা বলল, “নাহ, নাহ রক্ত চুষে বা তার সরবৎ বানিয়ে বরফ ঢেলে খাব।”
ব্রহ্মদত্যি বলল, “আমি সর্দার। আমার কথা মানতে হবে। আময়া ওকে সিদ্ধ করে, শুদ্ধ করে, সিদ্ধি দিয়ে খাব।”
বুড়ি ভূত বলল, “যাঁতায় পিঁষে পিঁষে ছোঁবড়া বেঁর কঁরে খাঁব।”
এক বুদ্ধিমান ভূত বলল, “সে যে ভাবেই খাও, স্যানিটাইজ করে চুন হলুদ মাখিয়ে খেতে হবে। নাহলে ঐ করোনা ভূতেদেরও রেহাই দেবে না।”
এই নিয়ে একটা তুমুল ঝগড়া আর মারপিট শুরু হলো। ভূমিকা বেচারি আর কি করে! তখন এক ভালো ভূত এসে বলল, “আমরা যদি ওকে মেরে ফেলি, তাহলে তো আমাদের কেউ কোনোদিনও পড়বে না।”
ব্রহ্মদত্যি ভেবে দেখল, ঠিকই বলেছে ভূতটি। কিন্তু শাস্তি ভূমিকাকে পেতেই হবে। শাস্তি হল, ও আরো যে বইগুলোকে অর্ধেক পরে রেখে দিয়েছে সেই বইগুলোর প্রত্যেকটাকে পড়ে শেষ করতে হবে। আর ভূমিকাকে ভূতের বইটাকে তিন বার পড়তে হবে। সামনে থেকে পিছন, পিছন থেকে সামনে আর মাঝখান থেকে দু’দিকে।
সে যাত্রায় ভূতেরা ভূমিকাকে ছেড়ে দিয়ে বইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ভূতেরা তাকে যতবার বইগুলো পড়তে বলেছে সে ততবার বইগুলোকে পড়তে লাগল। তোমরাও কিন্তু কোনোদিন বই অর্ধেক পড়ে রেখে দিওনা। তাহলে ভূতে এসে ধরবে।