স্মরণীয় যাঁরা-তুতু-ভূতুর স্রষ্টা ধীরেন বল-পৃথা বল-শীত ২০২০

তুতু-ভূতু নামটা শুনলে আজও ছোটোবড়ো সকলের চোখমুখ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বইটার রঙিন ছবিগুলো। লাল প্যান্ট পরা ভূতুকে শাড়ি পরা (মা বেড়াল) ভূতুর মা বকুনি দিচ্ছে, ‘ছি ছি ভূতু, এ কী বদ স্বভাব তোর!’ প্রায় ষাট বছর আগে সেকালের মা-বাবারা নিজেরা তো পড়েছেনই, ছেলেমেয়েদেরও পড়িয়েছেন। এখন তাঁদের নাতিনাতনিদেরও পড়া হয়ে গেছে। চারটে যুগ পার হয়ে গেছে। তুতু-ভূতু এখন সর্বকালের শিশুদের বইই নয়, বড়োরাও অসীম কৌতূহলে তাঁদের ছোটোবেলার প্রিয় বইটা সংগ্রহ করে পড়েন। বিদেশেও শিশুরা তাদের প্রচলিত ভাষাতেই তুতু-ভূতু পড়ে থাকে। এমন কী আছে এই বইতে? এই বইতে আছে এক অপূর্ব সাহিত্য রস। আর সেই সঙ্গে শিল্পী ধীরেন বলের সৃষ্টি অপরূপ ছবি।
বইটির লেখা ও আঁকা দুইই ধীরেন বলের। পশুপাখিদের জামাকাপড় পরিয়ে যে নতুন ধরনের ছবি তিনি সৃষ্টি করেছেন, এই তুতু-ভূতুতে তা তাঁরই প্রথম সৃষ্টি। আগে পশুপাখিদের যেমন দেখতে তেমন করেই আঁকা হত। ধীরেন বলই প্রথম পশুপাখিদের জামাকাপড় পরিয়ে ছবি সৃষ্টি করেন। এজন্য তিনি ‘বাংলার ওয়াল্ট ডিজনি’ উপাধি পান।
বিড়াল-কুকুর-হাঁস-মুরগি এদের নিয়ে গ্রাম্য পরিবেশে ঘরোয়া গল্প। ছোটোরা বিড়ালকে দেখছে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছে, কিন্তু আসলে বিড়াল তো মাছ চুরি করে খায়। ছবিতে ভূতুর মা শাড়ি পরে রান্না করছে। এমন সব ছবি ধীরেন বল তুতু-ভূতু বইতে এত সুন্দরভাবে তাঁর তুলির ছোঁয়া দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যা আজ ষাট বছর পরেও কোনো মানুষ ভুলতে পারছেন না তুতু-ভূতুর ছবিগুলোকে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাঁদের পড়া বইয়ের পাতাগুলো।
এই তুতু-ভূতু বইটা কে না পড়েছে? বাংলার শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পরিচালক সকলেই তাঁদের ছোটোবেলার প্রিয় বইটিকে মনে ধরে রেখেছেন এবং পারলে আজও তা খুঁজে সংগ্রহ করেন। এই সেদিনও একজন স্বনামধন্য পরিচালক তাঁর ছোটোবেলার তুতু-ভূতু বইটা চেয়ে পাঠালেন। লক-ডাউনে পাঠানো সম্ভব হয়নি, তাই পিডিএফ করে পাঠানো হয়েছে। কিছুদিন আগে দাদাগিরিতে সৌরভ প্রশ্ন করলেন, ‘তুতু-ভূতু বইটা কার লেখা-আঁকা?’ বলেও ফেললেন, ‘বইটা আমার ছোটোবেলার প্রিয় বই।’ অনেকেই বইটা পড়েছেন, কিন্তু স্রষ্টার নাম সঠিক বলতে পারছিলেন না। পরে অবশ্য সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন একজন প্রবীণ পাঠক। আসলে তুতু-ভূতুর ছবিগুলো এমন বিস্ময়কর যে শিল্পীর নামটা অনেকেরই চোখে পড়েনি। আজও অনেক পাঠকই জানেন না তুতু-ভূতু কার লেখা-আঁকা। স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি যে এত বড়ো হয়ে উঠেছে।
তাই তো আজ আমি আমার বাবা শ্রী ধীরেন বল সম্পর্কে সামান্য কিছু বলব।

তুতু-ভূতু সৃষ্টির পর শিল্পী নিজেই কি জেনেছিলেন, তিনি কী সৃষ্টি করলেন? কারণ, তিনি তো এরকম আরো অনেক বইতে ছবি এঁকেছেন, লিখেছেন। ‘চেঙাবেঙা’, ‘নাকাল নেংটি’, ‘ঠেকে হাবুল শেখে’, ‘কাড়াকাড়ি’, ‘জমজমাট’, ‘আটখানা’ এ সবই তাঁর লেখা-আঁকা।

পরবর্তীকালে প্রচুর ছড়ার বই লিখেছেন, এঁকেছেন। সারাজীবনে হাজার হাজার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। তাঁর হাতের আঁকা ছবি সে সময়ে সব পত্রপত্রিকাতে নিয়মিত ছাপা হত। তাঁর তুলির টান দেখেই সে সময়ের মানুষ চিনে ফেলতেন, এটা ধীরেন বলের ছবি। শিশুসাহিত্যিক লীলা মজুমদার বাপির আঁকা ছবি ভীষণ পছন্দ করতেন। একজায়গায় তিনি লিখেও গেছেন—

‘আমাদের বন্ধু ধীরেন বলের মতো চিত্রশিল্পী আমাদের দেশে কম জন্মেছেন। ছোটোদের জন্য আঁকা ছবি যেন লাফায়-ঝাঁপায়, মনকে নাড়া দেয়। ধন্য তাঁর তুলি-কলম। কেবলি আমার দাদা সুকুমার রায়ের ছবির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। নামকরা শিল্পী আমাদের চিত্র জগতে অনেকে দেখা দিয়েছেন। কিন্তু ছোটোদের মনের ছাড়পত্র পেয়েছেন মাত্র দু-চারজনা।
ধীরেন বলের দর্শন পেয়েছি, আমার বড় সৌভাগ্য। তাঁর মঙ্গল হোক। ইতি।

লীলা মজুমদার
২০.১২.৯১

এমন একজন নামকরা শিল্পীর বাল্যকাল কেটেছিল তখনকার বাংলার এক গ্রাম্য পরিবেশে। বগুড়া জেলার বারইল গ্রামে ১৯১২ সালের ২২শে জানুয়ারি তাঁর জন্ম হয়। ছোটো থেকেই তিনি ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। কখনো মাটির কুটিরে বসে, কখনো প্রকৃতির গাছপালা ঘেরা মাঠের মাঝখানে। খালি একটা কাগজ আর পেন্সিল দিয়েই তৈরি হত সুন্দর ছবি। এখনকার মতো রংপেন্সিল, জলরং কিছুই তাঁর হাতে এসে পৌঁছত না। গাছপালা, পুকুর যা দেখতেন মাঠে বসে বসে খালি পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতেন আপনমনে।

বগুড়া করোনেশন স্কুলে তাঁর ছাত্রজীবন কাটে। দশ বছর বয়সে বালক ধীরেন বলের হাতে এসে পৌঁছত ‘খোকাখুকু’, ‘সন্দেশ’, ‘শিশুসাথী’ এসব পত্রিকা। সন্দেশের পাতায় পাতায় থাকত সুকুমার রায়ের হাতের শিল্পকর্ম। তাই দেখেই বালক ধীরেন প্রথম প্রেরণা পেয়েছিলেন। এই প্রেরণাই তাঁকে তৈরি করেছিল এত বড়ো মাপের শিল্পী রূপে।

শুধু ছবি আঁকা নয়, ছোটো থেকেই ভালো কবিতা লিখতেন তিনি। দশ বছর বয়সে স্কুলের খাতাতে কবিতা লিখে এঁকে সাজিয়ে পত্রিকা বানাতেন। নাম দিয়েছিলেন ‘গাথা’। আজও আমি সে পত্রিকা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। লেখাপড়াতেও তিনি ভালো ছাত্র ছিলেন। মেট্রিক পাশ করার পরে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন ১৯৩১ সালে। এরপরে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন এবং কমার্শিয়াল আর্টে ডিগ্রি নেন। আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে আনন্দবাজারের ‘আনন্দমেলা’ বিভাগে যুক্ত হন।

সে সময়ে প্রদর্শনীর চল ছিল না। জীবনে একবারই তিনি প্রদর্শনীতে ছবি পাঠান। বার্মাশেল কর্তৃক আয়োজিত ‘আর্ট ইন্ডাস্ট্রি’তে সারা ভারত থেকে বাইশজন শিল্পী প্রতিযোগী হয়েছিলেন। এখানে ধীরেন বলের আঁকা তিনটি ছবি একসঙ্গে প্রথম পুরস্কার পায়। তারপর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে শিল্পী পদে চাকরি পান সিমলাতে। দু-বছর সেখানে কাজ করার পর চাকরিজীবন আর ভালো না লাগায় সেখানে ইস্তফা দিয়ে আবার ফিরে আসেন আনন্দবাজারের স্বাধীন শিল্পকর্মে।

সারাজীবনে তিনি লক্ষাধিক ছবি এঁকেছেন।

শেষজীবন অবধি বাপির পাশে থেকে দেখেছি, তাঁর নিরহংকারী নিশ্চুপ জীবনধারা। সবসময় লেখা আর আঁকা নিয়ে থাকতেন তাঁর ছবি আঁকার ঘরটিতে। আমাদের পড়াশুনা, শিক্ষাদীক্ষা সবই বাপির কাছে বসে বসেই। নিজের কোনো লেখা-আঁকা কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে বাপি বলতেন, ‘যাদের জন্য লিখেছ, তারাই হল বিচারক। তারা কেমনভাবে বইটা নেবে তখনই জানবে বইটা কেমন দড়ের হয়েছে।’

শিশুসাহিত্যে অনেক ভালো ভালো বই লেখা হয়েছে, কিন্তু তুতু-ভূতুর মতো এমন সৃষ্টি, এমন ছবি দ্বিতীয় আর একটিও নেই বাংলা সাহিত্যে।

১৯৯২ সালে শিল্পী ধীরেন বল সবকিছু ফেলে চিরতরে চলে যান আমাদের ছেড়ে। তবুও তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন তুতু-ভূতুর স্রষ্টা হয়ে।

ধীরেন বলের  রচিত একটি ছড়া রইল এই লিঙ্কে(~সম্পাদক)

স্মরণীয় যাঁরা সব এপিসোড একত্রে

                            

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s