জয়ঢাক ঘাটশিলা সাহিত্য ট্রেক ২০২০-র সেরা গল্প
তন্ময়বিশ্বাসের আরো গল্প- উৎসর্গপত্র, রূপকথার ভাঁজে, পর্দার আড়ালে, ক্যারন
“ওকে, দেন সমস্যাটা কী?” লোকটা ওদিক থেকে জিজ্ঞেস করল।
আচ্ছা, একটা থিওরি বোঝানো লোকের মুখ কেমন হওয়া উচিত? প্রোফেসর প্রোফেসর? মোটা মোটা ভুরু? কাটা কাটা চোখ, হরলিক্সের শিশি মার্কা চশমা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি? নাকি চাপ? টাক মাথা? বা থাকলেও হোয়াইট ওয়াশ করা চুল? মুখের থেকেও বেশি নড়েচড়ে বেড়ানো হাত-পা?
টেবিলের ওপারের লোকটা গুনে গুনে এই সবক’টারই ভাইস ভার্সা। ডার্ক ব্ল্যাক চুল, কামানো দাড়িগোঁফ, রিমলেস চশমা… মানে ওগুলোর উলটো করলে যা যা হয় আর কী।
ঘরের চেহারাখানাও তেমন কনসালট্যান্ট বা ডাক্তারখানা টাইপ নয়। কেমন একটা অন্ধকার-অন্ধকারমতো নীল আলো। ধীরে ধীরে সেটা কমবেশি হচ্ছে। রিমলেসের কাচে নীল আলো পড়ে ঢেকে যাচ্ছে একনম্বর কনসালট্যান্ট কাম রোবোটিক্স এক্সপার্টের চোখ।
আলোটার জন্য কিনা কে জানে, একটু শীত শীতও করছে। আমি স্যুটের বডি ওয়ার্মারটা অন করে দিলাম।
“কিছু সমস্যা হয়েছে?”
টেবিলের ওপার থেকে আবার জিজ্ঞেস করলেন আবদুল করিম। কেমন যেন পুরোনো দিনের এয়ার কন্ডিশনারের মতো শনশনে গলা। নীল আলোটা একটু ঘুরে গেল। চোখদুটো দেখতে পেলাম এবার। ঠান্ডা।
হ্যাঁ, শেষ অবধি সমস্যা হয়েছে। যার জন্য আমরা এতদিন ধরে দিন কাটিয়ে রাত গুনেছি, যার মোকাবিলার জন্য হাজারবার রিহার্সাল দিয়েছি মনে মনে কীভাবে শকারটা হাতে আনতে হবে, কীভাবে সেটা সুকৌশলে ঠিক ঠিক জায়গায় বসিয়ে অন করতে হবে, ‘লাইভ সেভার’ কলটা স্পিড ডায়ালে কীভাবে রাখতে হয়। কেউ মুখে না বললেও, মনে মনে কি ছকে নেয়নি? নাকি টিয়ার ভয় ওকে নিয়ে ভাবিয়ে তোলেনি?
কেনই বা ভাবব না? এগুলো তো নতুন নয়! কাজ করতে করতে হঠাৎ করে জিনিসটার থেমে যাওয়া, শরীরের হালকা কাঁপন, এঁকে-বেঁকে চলা স্পার্কের চিরচির শব্দ—তারপর দ্রুতগতিতে ছুটে এসে গলার টুঁটি সমেত তুলে ধরা… টিয়া বা আমার হাঁ মুখ, বাতাসে ছোড়া হাত-পা, চোখের সামনে নেমে আসা কালোর থেকেও কালো অন্ধকার… এইসব কি খুব নতুন? আমি এখুনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিনিমাম পঞ্চাশটা সাই-ফাই মুভির নাম বলতে পারি। সেই কোন ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি। টিয়াও দেখেছে। আরো ছোটোবেলা থেকে। অ্যাডভান্সড যুগের অ্যাডভান্সড মেয়ে। তবু বায়না করেছিল।
ক্রিসমাসের পার্ক স্ট্রিটের নকল ক্রিসমাস ট্রিগুলো ছুঁয়ে হাঁটতে হাঁটতে, সেকেন্ডের চেয়েও কমে বদলাতে থাকা আলোয়, চারদিকের বেকারি থেকে নিজের ভাগের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ভাগের গন্ধটুকুও টেনে নিতে নিতে বায়না করেছিল। বায়না অবশ্য ঠিক নয়। হাত-পাও ছোড়েনি, ঠোঁটও ফোলায়নি। আমাকে ঘোড়া হতে বলে, পনিটেল দুলিয়ে কানে কানে শুধু বলেছিল, “বাপি বাপি, আমাকে একটা অ্যান্ড্রয়েড কিনে দেবে? বেশ আমাদের বাড়িতে থাকবে!”
দু-হাজার সাতান্নর বাচ্চারা বোধ হয় সান্টাক্লজের ফান্ডা জেনেই জন্মায়। তাই বাবা-মাকে রাত জেগে চোরের মতো অত ফ্যাচাং করতে হয় না। আর তাদের চাহিদাগুলো ওই পুঁচকেমতো তিন নম্বর সাইজের মোজাতে আঁটেও না তেমন।
তা নিউ ইয়ার অফারেই সে এল। তেতাল্লিশ জন হার্ট অ্যাটাক করেছে জেনেও যেমন লোকে হরর মুভি দেখতে যায়, প্যাকেটের ওপর ফুটো ফুসফুস থাকা সত্ত্বেও যেমন মানুষ সিগারেট খায়, তেমনিভাবে সব জানা সত্ত্বেও সিলভা-৫ এল।
আসলে আমরা বোধ হয় নিজেরাই নিজেদের সাহসী দেখাতে চাই। আয়নার ওপারের লোকটা যেন ভুল করেও আমাকে নীচু চোখে না দেখে। আমরা বিপদ নিয়ে বাঁচতে চাই।
আমাদের ফ্ল্যাটটা সিক্তাই পছন্দ করেছিল। ওর খুব বাড়ির শখ। ওর শখ ছিল ছোটোখাটো, দোতলা, ব্যালকনি, বড়ো বড়ো জানালা, উড়ে বেড়ানো আকাশি রঙের পর্দা, সামনে বাগান, বাগানে ডেক-চেয়ার, টি-টেবল… আর আমার ছিল এক্সপায়ার্ড ক্রেডিট কার্ড, তলানির ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আর তিনশো টাকার দু-পিস শার্টের সঙ্গে ফ্রি পাওয়া একটা মানি ব্যাগ…
তখনো টিয়া আসেনি। সিক্তা ঠোঁট মুখ ফুলিয়ে এটাই পছন্দ করল। না, বাগান হল না। পর্দার জায়গায় হল একটা বিশাল আকাশ। বাগানের বদলে একটা শহর। যে-কোনো ক্ষতবিক্ষত জিনিসই দেখবেন দূর থেকে সুন্দর লাগে। আরে চাঁদকেই ধরুন না কেন! কলকাতাকেও লাগত। আমরা দেখতাম। দেখতাম কীভাবে চিলেরাও আমাদের নীচে ওড়ে। কীভাবে ধোঁয়া উঠে হাওয়ায় মেশে।
তারপর তো টিয়া এল। তারও পরে গেল সিক্তা। মানে চলে গেল। চিলগুলোরও ওপরে। ষাটতলার থেকে অনেক অনেক ওপরে। অতদূর থেকে কলকাতাটাকে কেমন লাগে কে জানে।
হ্যাঁ, তো যেটা বলছিলাম। ফ্ল্যাটে আমি আর টিয়াই থাকি। তিন নম্বর এল এই সিলভা-৫। ‘হিউম্যানয়েড জেনারেশন-৫’-এর লেটেস্ট মডেল।
জিজ্ঞেস করছিলেন না, সমস্যা আছে কি না? নো স্যার, যাকে বলে একদমই না। সিলভা-৫, ঠিকের চেয়েও অনেক বেশি ঠিক। সবকিছু মানুষের মতো। চলার সময় পায়ের তালে তালে দিব্যি হাত নাড়ে, কোনো গ্রিপিং প্রবলেম নেই। দিব্যি চাপড় মেরে মশা মারতে পারে। এমনকি মাঝে মাঝে… নিজেকে মানুষ মানুষ দেখাবার জন্যই কি না কে জানে, কয়েকটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ারও করে, মানে ইয়ে দিয়ে। বুঝলেন তো? না না, আমাদের অসুবিধা হয় না। ভ্যানিলা ফ্লেভারের গন্ধ কিনা!
কিন্তু অসুবিধাটা এসেছে আমাদের দিক থেকে। আই মিন, কী করে যে বোঝাই আপনাকে!
না, পরিষ্কার করে বলাই ভালো। তাতে আপনারই সুবিধা হবে। সঙ্গে আমারও।
টিয়া কোনোদিনই একা শুতে পারত না। ভয় পেত। কীসের ভয় জানি না। তবে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে কান্নাকাটি করত। তখন সিক্তাই ঠান্ডা করত হাত বুলিয়ে বুলিয়ে। ওর চলে যাওয়ার পর কাজটা আমিই করতাম। বোঝেনই তো, এ ব্যাপারে আমি নিতান্তই আনাড়ি। আর এও নিশ্চয় বোঝেন যে, দু-হাজার সাতান্নর একটা ক্লাস ফোরের মেয়ে এখনো একা শুতে ভয় পায়। এই ব্যাপারটা ওদের স্কুলে জানাজানি হলে কী হবে? টিয়ার ইমেজের কী হবে? তাই শেষের দিকে ও একাই শুত। কিছুটা জোর করেই।
সেদিন বোধ হয় সেকেন্ড জানুয়ারি ছিল। কলকাতায় সাধারণত এত ঠান্ডা পড়ে না। সেদিন পড়েছিল। মাল্টি-টাস্কিং ক্লকে রিডিং দেখাচ্ছিল পনেরো ডিগ্ৰি সেলসিয়াস। সাড়ে বারোটা। টিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি পা টিপে টিপে উঠেছিলাম। খুব আস্তে করে ওপেন করেছিলাম নাইট সার্ভিসে দিয়ে যাওয়া বাক্সটা। তারপর সেটাকে অন করে বসিয়ে দিয়েছিলাম টিয়ার পাশের সোফায়। প্রোগ্রামিং আমার অর্ডারমতো ওরা করেই পাঠিয়েছিল। থ্রি-এক্স মডেলরা নিজে নিজেই অনেক ডিসিশন নিতে পারে।
টিয়া আর একা নয় জেনে আমি ঘুমোতে গিয়েছিলাম। কিছুটা নিশ্চিন্ত মনেই। ঘুম যখন ভাঙল, তখনো টিয়া চিৎকার করছে। একটানা। আমি ভয় পেয়েছিলাম। অমন ভয় আগে কোনোদিন পাইনি। কেমন যেন পায়ের নীচে ঠান্ডা একটা ভাব। কনকনানি!
টিয়ার ঘরে ছুটে না যাওয়া অবধি ও চেঁচিয়ে গেল। আর সিলভা-৫ হাত-পা নেড়ে ওকে শান্ত করতে চাইছে। প্রাণপণ! কিন্তু এতে কাজ তো হচ্ছেই না, উলটে টিয়া আরো ভয় পাচ্ছে যেন। হ্যাঁ, ভয়ই। সেদিন ওর চোখেমুখে যেটা দেখেছিলাম তাকে ভয় ছাড়া আর কীই বা বলা যায়!
ওই শুরু। পরদিন টিয়া পরিষ্কার বলে দিল, ওই জিনিসটা যেন ওর ঘরে না ঢোকে। দরকার হলে যেন শাট-ডাউন করে রাখি। তেজটা ও মায়ের থেকেই পেয়েছে। ওই যে বলে না, ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা!
ওর কথাগুলো কেটে কেটে ঘুরছিল ঘরময়। আর সিলভা-৫ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হাঁটুর দিকে জড়ো করা দুটো হাত, থুতনির সঙ্গে ঠেকে যাওয়া বুক। আচ্ছা, আপনিই ভালো বলতে পারবেন। রোবটদের কি দুঃখ হয়? মান-অভিমান? আমি ঠিক বুঝি না। কী করে বুঝব বলুন, ওদের ক্রিস্টাল লেন্সে তো আর জল ধরে না।
আমি টিয়াকে বকাবকি করতে পারতাম। বলতে পারতাম, মেশিন তো প্রোগ্রামিং ছাড়া আর কিছু নয়। বরং আরো বেশি নিখুঁত। মানুষের ভুল হয়, মেশিনের নয়। তাই তাকে এত ভয় পাওয়ারও কিছু নেই।
কিন্তু না, বলতে পারিনি। কোন মুখে বলব বলতে পারেন? আমি নিজে কি ঠিক ছিলাম!
অফিস বেরোনোর আগে যখন নিঃশব্দে এসে আমার ব্যাগটা এগিয়ে দিত, তখন কি আমি চমকাতাম না? যখন ও মেঝেতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালাত, তখন কি আর একবারের জন্যও মনে হয়নি, এই বুঝি বিগড়ে গিয়ে ওটা দিয়েই আমার মাথা ফাটিয়ে বসবে? হয় তো! আমারও হয়, টিয়ারও হয়।
ওই যে বললাম সেই সিনেমাগুলো—ওগুলোই বোধ হয় যত নষ্টের গোড়া। তাই না?
***
বড়ো বাজারের যেদিকটা এখনো গলি গলি ভাব আছে, যেখানে আজও ফুচকাওয়ালারা আসে, জুতো সেলাই, বুট পালিশের ডাক দিয়ে যায় কয়েক ঘর মুচি। তারপর ঠিক তিন নম্বর গলিটা, যেখানে সন্ধের বাজারটা বসে, তার জাস্ট কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকের বাঁকটা নিতে পারলেই, আর চোখ-কানগুলো একটু খোলা রাখলেই চেম্বারটা দেখা যায়। কান এই জন্য খোলা রাখতে বলছি, কারণ এখানে এখনো পায়রার হাততালি মার্কা ডানার শব্দ পাওয়া যায়। গোলা পায়রা। পুরো কলকাতায় আমি অন্তত আর কোথাও দেখিনি।
আর চোখটা একটু কুঁচকোলেই মুছে মুছে যাওয়া সাইনবোর্ডটা এখনো পড়া যায়—ডঃ আবদুল করিম। সাইকোলজিস্ট কাম রোবোলজি এক্সপার্ট—রোবোলজিটা ব্র্যাকেটে লেখা হয়েছে।
গলির ভেতর বাজারের আওয়াজ তেমন আসে না, আর পুলিশি ড্রোনগুলো এখানে ঢুকতে ভয় পায়। যে-কোনো কারণেই হোক মানুষ এইসব জায়গায় লুকিয়ে আসতেই ভালোবাসে। নিজের দুর্বলতা কে-ই বা দেখাতে চায়? কেউ না!
দরজা ঠেলে ভেতরে পা দেওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর থেকে সব পরিষ্কার হতে থাকে। খুব অল্প পাওয়ারের নীল আলো। দরজায় সেন্সর আছে বোধ হয়। পেশেন্ট ঢুকলেই আলোটার ব্রাইটনেস বেড়ে গিয়ে ঘরটা আর একটু পরিষ্কার হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ম্যাগাজিন, বেরিয়ে থাকা স্পিকার ইত্যাদি অগোছালো ব্যাপারগুলো আরো বেশি করে ধরা দেয়।
তবে দশ সেকেন্ডের মধ্যে চোখটা সয়ে যাবে। তখন উলটোদিকের লোকটাকে দেখা যাবে পরিষ্কার। আপনি এদিকের চেয়ারে বসে পড়বেন। নরম ফোমের গদি। ওপর থেকে নীল আলো ডাইরেক্ট এসে পড়বে আপনার চোখে। ওই আলোয় কিছু একটা থাকে। আছে। অবশ্য তাকে কী বলা যায় আমার জানা নেই।
কুড়ি সেকেন্ড, তিরিশ সেকেন্ড… বড়ো জোর এক মিনিট। আপনার ঠোঁটটা একটু কাঁপবে। একবার, দু-বার, ব্যস! তারপর আপনি বলতে শুরু করবেন। সে অনেক কথা। যে কথাগুলো মনের ঝোপে-ঝাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আড্ডায়, ভিডিও চ্যাটে, অ্যাডভান্সড ফেসবুকের শেষ না হওয়া দেওয়ালে যাদের ছাপ পড়ে না। তারাই সব বেরিয়ে আসে একে একে। যেমন আমার এতক্ষণ এল। আমার আর টিয়ার গল্প, সিলভা-৫-এর গল্প। আর কোথাও একটা সিক্তার গল্পও।
গল্প শেষ হলে আবদুল করিম বসে থাকবেন চুপচাপ। টেবিলের ওপর কনুই, তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের খাঁজে আটকে পড়া থুতনি। ঘরজুড়ে ঘুরে বেড়ানো নীল আলোটা ঠিক পিছন থেকে পড়বে। রিমলেস কাচ নীলচে হয়ে গিয়ে চোখদুটো আর বোঝা যাবে না। বোঝা যাবে না সেগুলো বন্ধ, নাকি খোলা। লাল, নাকি ঠান্ডা।
“আনক্যানি ভ্যালি।”
আপনি যখন বসে থেকে থেকে প্রায় ধরেই নিয়েছেন, ওপারের পাবলিক ঘুম দিয়েছে, তখনই ওপার থেকে কেউ বলে উঠবে। আর আপনি চমকাবেন। মানে চমকানো উচিত। আমি তো চমকালাম। তারপর থতমত খেয়ে বললাম, “অ্যাঁ! ইয়ে, মানে…”
“আপনি আর আপনার মেয়ে দুজনেই আনক্যানি ভ্যালিতে পড়ে গেছেন। আজকাল আকছার হচ্ছে। প্রত্যেকটা যুগেরই একেকটা পেটেন্ট রোগ থাকে। ফেবু রোগ, সেলফি রোগ—শুনেছেন নিশ্চয়? রোবো যুগের প্রথম রোগ হচ্ছে এইটি। ওয়েট।”
আবদুল করিম ডানহাতের আঙুলগুলো হাওয়ায় একটু নাড়লেন। ম্যাজিশিয়ানরা যেভাবে হাত নেড়ে বাতাস থেকে কয়েন টেনে আনে, ঠিক সেভাবে। টেবিলের ওপর স্ক্রিন ভেসে উঠল। আমার আর করিমের মাঝে একটা ট্রান্সপারেন্ট দেওয়ালের মতো স্ক্রিন। স্ক্রিনের ওপর এক্স-ওয়াই অ্যাক্সিসের গ্রাফ।
“ওকে, লেটস স্টার্ট। মানুষের ব্রেনের অদ্ভুত এক ফাংশন এই আনক্যানি ভ্যালি। থিওরিটিক্যালি প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৭০-এ। মানে বলতে পারেন যখন অ্যান্ড্রয়েড নিয়ে সায়েন্স ফিকশন লেখা হত।”
পাশে রাখা গ্লাস থেকে একটু জল গলায় ঢেলে নিলেন করিম। নীল জল। তারপর সামনের দিকে একটু ঝুঁকে এলেন। “আপনি প্রোডাকশন ডিপার্টমেন্টে আছেন, রাইট?”
আমি ঘাড় নাড়লাম।
“আচ্ছা, ওখানে যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবো-হ্যান্ড বা মেশিনগুলো, তাদের প্যাকেজিং, কাটিং… এটসেট্রা এটসেট্রা, ওগুলো থেকে কোনোদিন কোনো অস্বস্তি হয়েছে আপনার?”
“প্রশ্নই ওঠে না। ওগুলোর সঙ্গে আমাকে ডিউটি করতে হয়, আর তাছাড়া…”
“ওকে ওকে।” হাত নেড়ে আমাকে থামিয়ে দিলেন উনি, “তাহলে ফার্স্ট হল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট।”
হাত বাড়িয়ে স্ক্রিনের দাগ বা অ্যাক্সিস দুটোর মিটিং পয়েন্টে টাচ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ওখানে একটা লাল ডট ফুটে উঠল।
“এখান থেকে শুরু করা যাক। এই ডটটা হয়ে গেল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট। মানে একদম প্রাইমারি স্টেজ।” একটু থেমে, বেশ নাটকীয়ভাবে করিম বললেন, “এবার আমরা উন্নতির পথে এগোব।” তারপর আঙুল দিয়ে লম্বালম্বি দাগটাকে দেখালেন, “ধরুন, এই দাগটা হচ্ছে আপনার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। আই মিন, আপনি কতটা ফ্যামিলিয়ার জিনিসগুলোর সঙ্গে। ওপরটা প্লাস, নীচেরটা মাইনাস। আর এই ভার্টিক্যাল দাগটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোবটগুলো আরো উন্নত হতে থাকবে। মানে আরো বেশি করে মানুষ বা বলা ভালো মানুষের মতো হয়ে উঠবে। নাউ, রেডি?”
আমি আবার ঘাড় নাড়লাম।
“আচ্ছা, এর পরের জন হল… উমমম… ওকে ধরা যাক কার ওয়াশিং রোবো। আপনারটা অটো-মোডের?”
“ইয়া।”
“তো ওটা যখন ইঁদুরের মতো ঘুরে ঘুরে উইন্ড স্ক্রিন, সিট, ক্লাচ সব সাফ করে, বাইরে গিয়ে টেনে নেওয়া ময়লাগুলো আনলোড করে, তখন কি আপনাদের ভয় বা ওরকম কিছু হয়?”
“একদমই না। বরং ওটার জন্য ঝাড়পোঁছের ঝামেলাগুলো বাঁচে। টিয়ার আবার মারাত্মক ডাস্ট অ্যালার্জি।”
“রাইট!”
আবদুল করিম সত্যি সত্যিই হাওয়াতে একটা বড়ো করে টিক দিলেন। বাইরে থেকে ভেসে এল পায়রার ডানার ফরফর শব্দ। এক সেকেন্ডের জন্য তো মনে হল যেন আমি একটা কুইজ শোতে বসে আছি! আর ফার্স্ট কোয়েশ্চেনের ঠিক উত্তর দেবার জন্যই বোধ হয় লাল ডটটা কোনাকুনিভাবে একটু উঠে এল। অর্থাৎ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ আর মানুষ-মানুষ বোধ দুটোর স্কোরই বেড়েছে। সমানে সমানে।
“নেক্সট।” কুইজ মাস্টার হাত নেড়ে পরের প্রশ্নে গেলেন, “লেটেস্ট যে ওয়াকিং ডলগুলো বেরিয়েছে, যেগুলো বেশ এক্সপ্রেশন বা মুভমেন্টও দিতে পারে, ওগুলো দেখেছেন?”
“হ্যাঁ, টিয়ার একসেট আছে।”
“তো সেটা থেকে আপনার বা টিয়ার কোনো…”
“নো, নেভার।”
“এবার ধরুন, পার্টির রিসেপশনের জোকার বা চ্যাপলিন রোবটগুলো? ওগুলোও বাচ্চারা বেশ এনজয় করে।”
দাগটা আরো দু-স্টেপ উঠে গেল।
“এবার আসছে ফার্স্ট জেনারেশন। বলতে পারেন প্রথম সাবালক রোবট। আপনি দেখেছেন?”
“আমাদের বাড়িতে একটা ওরকম সার্ভিস রোবো ছিল। এলিয়েন মার্কা চেহারা।”
“তাহলে ওটাও ওকে?”
“সেন্ট পার্সেন্ট।”
লাল ডটটা আরো একটু উঠে এল।
“এবার সেকেন্ড জেনারেশন। ফার্স্ট হিউম্যানয়েড বা অ্যান্ড্রয়েড যাই বলেন না কেন, এটাতেও মানুষের তেমন কোনো সমস্যা হল না।”
আর লাল গ্রাফ আরো ওপরে উঠে পড়ল।
“এইবার…” বলে একটু থামলেন আবদুল করিম। হাতদুটো ওপরে তুললেন। তারপর আবার কী ভেবে নামিয়ে নিলেন। “দেয়ার ওয়জ থার্ড জেনারেশন অলসো!” এবার গলাটা যেন একটু উত্তেজিত, “এক লাফে অনে-এ-কটা মানুষ-মানুষ ভাব। নাইলনের চুল, স্মার্ট প্লাস্টিকের চকচকে হাত-পা, ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরতে পারা মুণ্ডু। একটু আটকালেও মোটামুটি স্মুদ হাঁটাচলা। কিন্তু এতটা উন্নত হয়েও মানুষ এদের নিতে পারল না।” এবার গলাটা একটু নামিয়ে নিয়ে ডঃ করিম বললেন, “মানুষ ওদের ভয় পেতে লাগল!”
লাল ডটটা এবার ঘুরে গিয়ে নামতে লাগল মাইনাসের দিকে।
“একটা মলের হেল্প ডেস্কে এই রোবট ছিল একপিস। টিয়া দেখে তো খুব কান্নাকাটি করেছিল। ভয় পেয়েছিল বোধ হয়। তখন অবশ্য ও বেশ ছোটো।”
ওদিক থেকে আর কোনো উত্তর এল না। নীল আলোটা আবার শেড চেঞ্জ করেছে। বাইরে পায়রার ফরফরে শব্দ থেমে গিয়ে কেমন একটা নিস্তব্ধতা। ওদের ঘুমোবার সময় হয়েছে।
আমার একটু অস্বস্তি হল। কেন কে জানে! ওপারের মুখটার দিকে তাকালাম। অর্ধেকটা নীল। আর বাকি অর্ধেকটা অন্ধকার। পুরোপুরি অন্ধকার।
“কিন্তু এরকম হয় কেন?” নিজেকে সাহস দিতেই যেন জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো উন্নত হলে তো আমাদের খুশি হওয়া উচিত, তাই না?”
“কারণ, এটাই আনক্যানি ভ্যালির মেন থিওরি।” গলায় আবার সেই ঠান্ডা ভাব, “উন্নতি একটা নির্দিষ্ট লিমিট অবধি গিয়ে গ্রাফটা উলটে যাবে। তারপর থেকে রোবটগুলো যত উন্নত হবে, হিউম্যান লাইকনেস তত মুখ থুবড়ে পড়বে। মানুষ তত ভয় পাবে। ফোর্থ জেনারেশন, ফিফথ জেনারেশন, আরো আরো…”
ঘরের দমবন্ধ হাওয়ায় কথাগুলো ভাসছে। আর প্রত্যেকটা কথার সঙ্গে সঙ্গে লাল আলোটা একদম নীচে এসে থামল। মাইনাসের থেকেও নীচে।
পিছনের দিকে ঘাড়টাকে হেলিয়ে দিলেন করিম। “কী জানেন মিস্টার বোস,” কথার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটাকে একটু একটু দোলাতে লাগলেন ভদ্রলোক, “দোষটা রোবটের নয়। মানুষের। এটা আসলে হিউম্যান সাইকোলজির মধ্যে পড়ে। একটা গালভরা জার্মান নামও আছে, ডোপলগ্যাঙার। কোনো ভূতপ্রেত নিজের মতো দেখতে হলে তাকে ওরা ডোপলগ্যাঙার বলে। আপনাদের ভয়টা সেটাই। নিজের মতো দেখতে কাউকে দেখে ভয়। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের জিনে রয়ে গেছে এটা।”
এবার মাথা সোজা করে আমার দিকে তাকালেন। “কখনো ভেবে দেখেছেন, আমাদের ঠাকুরদেবতা ঠিক আমাদের মতোই দেখতে কেন? বা কোনো ট্রাইবদের দেবতা কেন তাদের মতো?”
আমি দু-দিকে মাথা নাড়লাম।
“কারণ, আমরা নিজেদেরই বেশি ভয় পাই। মূর্তিপুজোর মেন থিওরিই এটা। ভয় দেখাও, ভক্তি পাও। ডামি, পাপেট, জোম্বি… কোটি কোটি ভূতের গল্প হয়েছে এদের নিয়ে। হচ্ছেও। এমনকি আনক্যানি ভ্যালির থিওরিটা যখন জার্মান ভদ্রলোক পাবলিশ করেন, তখন ওই ডাউনওয়ার্ডস লাইনটা দেখানোর সময় পাপেট আর জোম্বির রেফারেন্স ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু আমাদের কাছে তার জায়গায় থার্ড জেনারেশন আছে। আছে ফোর্থ পেরিয়ে ফিফথ জেনারেশন।”
গ্রাফের একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকল লাল ডটটা। তারপর একটা ইউ টার্ন নিয়ে খুব অল্প একটু উঠে এল।
উনি সেদিকে আঙুল দেখালেন। “এটা থিওরির সেকেন্ড পোর্শন। উন্নতি হতে হতে একটা সময় গ্রাফটা আবার উলটে যাবে। রোবটদের ওপর আবার বিশ্বাস করবে মানুষ। তারাও যেমন রিয়েলিস্টিক হয়ে উঠবে তেমন এই বিশ্বাসও বাড়বে।”
লাল ডটটা এবার পজিটিভের দিকে অনেকটা উঠে এল।
“আলটিমেটলি এমন একটা ফেজ আসবে, যখন একটা ফিট হিউম্যান বিয়িংয়ের সঙ্গে একটা হিউম্যানয়েডের কোনো ফারাক থাকবে না। বলতে পারেন হান্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যান্ড্রয়েড!”
করিম থামলেন। নীল জলটা গলায় ঢেলে নিলেন আরো এক ঢোঁক।
“তো এর কোনো সলিউশন…” নিজেকে কোনোরকমে কুড়িয়ে বাড়িয়ে জড়ো করলাম আমি।
“আপনার মডেল নম্বর তিন তো? এটা বেশ আপডেটেড। ওই যে বললেন না হাঁটার সময় হাত-পা নাড়া, মশা মারা… রিয়েলিস্টিক করার জন্যই এই ফিচারগুলো অ্যাড করা হয়েছে। কিছুটা কাজও হয়েছে। আনক্যানি ভ্যালির খাদ থেকে কিছুটা উঠে এসেছে। কিন্তু আপনার এখানে আসা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা এখনো নেগেটিভের দিকে।
“আপনার কাছে এখন দুটো রাস্তা। সরি তিনটে। এক, ব্যাক গিয়ার মেরে ফার্স্ট জেনারেশনে ফিরে যাওয়া। যেটা কিনা প্র্যাকটিক্যালি আর সম্ভব নয়। ওগুলোর বডি শর্ট সার্কিট হয়ে দুজন মারা গিয়েছিল একবার। তারপর থেকে ওগুলো ব্যানড হয়ে গেছে।
“দুই, সিলভা-৫-কে আপগ্রেড করা। এটা পসিবল। কিন্তু খরচসাপেক্ষ।
“আর নম্বর থ্রি, নিজেদের আপগ্রেড করা।” চেয়ার ছেড়ে কিছুটা আমার দিকে ঝুঁকে এলেন রোবোলজিস্ট। মৃদু হেসে বললেন, “শরীরের মতো মানুষের মনও তাই। সওয়ালেই সইবে। স-ব। শুধু সওয়াতে জানতে হবে।”
ভদ্রলোক থামলেন। নীল আলো শেড চেঞ্জ করল শেষবারের জন্য। ক্যাশ-বোর্ডটা বেরিয়ে এসেছে। আমি কার্ড পাঞ্চ করে আরেকবার তাকালাম। এখন চোখদুটো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুটো মণিতে নীল আলোর খেলা। দু-টুকরো চাঁদ যেন জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে সারাঘরে। হয়তো ঘরের বাইরেও, যেখানে ষাটতলার ফ্ল্যাট আছে, যার জানালা দিয়ে চিল দেখা যায়।
***
রাতের কলকাতায় কেমন একটা হাই-তোলা ভাব থাকে। কেমন যেন বালিশ ছেঁড়া তুলোর মতো। যা হচ্ছে হোক, যা হওয়ার হবে। যেন আজকের মতো শো শেষ। খালি স্টেজ এখন রাতের দখলে। ফুচকাওয়ালা এবার মশলামাখা হাতে খুচরো বুঝে নেবে, পায়রা ঠোঁট গুঁজবে পিঠের পালকে, গলির পাগলিটা লেজকাটা ভুলোকে ডেকে নেবে নিজের কম্বলে। হাওয়ায় উড়ে আসা কাপড়ের মতো আকাশটা এসে আটকে যাবে গলির ছাদে। তারার খাতায় কেউ একমনে এঁকে যাবে ছায়াপথ, গ্যালাক্সি, নেবুলা। এভাবেই রাত বাড়বে। শুধু কেউ টের পায় না। হয়তো টের পাওয়ার কথা ভাবেও না।
এখানে গলি দিয়ে অনেকটা হাঁটতে হয়। তারপর মোড়ের মাথায় কপাল কুটলে, তবে গিয়ে ট্যাক্সি। গলিতে হাঁটার একটা বেশ মজা আছে। সোজা যেতে হয় না। ডানদিক, বাঁদিক, আবার বাঁদিকের পর ডানদিক। কেমন যেন জিগস পাজলের মতো। সলভ করো, বেরিয়ে যাও। কিন্তু বেরোতে পারে ক’জন? আমি তো বেরোতেই চেয়েছিলাম।
জানি ২০৫৭-য় মা মরা মেয়ে বলে কিছু হয় না। এখানে ফাঁকা সিট বলে কিছু নেই। সোশাল মিডিয়া, রিয়েলিস্টিক গেম, আরো হাজারটা প্রক্সি আছে। কিন্তু তাও… একা একা সন্ধেগুলোয় টিয়ার চোখে কি শুকতারা টলমল করে না? রাতের বাজে স্বপ্ন দেখে ও কি আর মা মা করে ডেকে ওঠে না? তাই তো সিলভা-৫-কে…
আসলে আমরা সবাই একটা জিগস পাজলের মধ্যে আটকে। বেরোনোর রাস্তা জানলেও যেন ভুলে গেছি। ওই আনক্যানি ভ্যালির গভীরে হারিয়ে গেছে একটা লাল ডট। প্রক্সি তো প্রক্সিই হয়!
কলকাতা ট্যাক্সি অ্যাপটা খুব রেয়ার কাজ করে। এই যেমন আজ করল। এক চান্সেই পেলাম। এতে বৌবাজার থেকে স্কাই ভিউ অ্যাপার্টমেন্ট এই কুড়ি মিনিটমতো। তারপর কেয়ারটেকারের জানালায় কার্ড পাঞ্চ করে, ক্যাপসুল লিফট, অটো স্ক্যানারের নীচে লেজারের স্নান।
অ্যাকচুয়ালি আমি জানি কিছু একটা আছে, যেটা আমাকে সব জায়গায় ঠিক সময়ের কিছুটা পরে পৌঁছে দেয়। যখন নাকের ডগা দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। যখন আর কিছু করার থাকে না।
এই যেমন এখন। সামনের কালো ধোঁয়াটা বলে দিচ্ছে আর কিছু করার নেই। ষাটতলার কমপ্লেক্সের ভিড়টা দেখিয়ে দিচ্ছে আমি আবার লেট।
ধোঁয়াটা বেরোচ্ছে সিক্তার লাকি নম্বর আশির দরজা থেকে। পাক খেতে খেতে উঠে যাচ্ছে ছাদের দিকে। তারপর আবার নেমে আসছে, যেখানে ধোঁয়ার সঙ্গেই পাক খাচ্ছে কথাগুলো। একটার পিঠে আর একটা জুড়ে যাচ্ছে ঠিক গল্পের মতো। ‘কমিউনিকেশন বার্স্ট… ভাগ্যিস রোবটটা ছিল… ঠিক সময়ে বের করে না আনলে তো…’ আরো অনেক কিছু। কিছু কানে যাচ্ছে, কিছু যাচ্ছে না। আমি শুধু দেখছি, ভিড়টা যেখানে খুব অল্প পাতলা, সেখানেই টিয়াকে নিয়ে সিক্তা দাঁড়িয়ে। না, সিক্তা তো নয়। সিলভা-৫। আমার স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানান কফি রঙের চুল, টেনে রাখা চোখ। অবিকল সিক্তার মতো কাত হয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গী। সিক্তার প্রক্সি। আনক্যানি ভ্যালির অতলে ডুবে যাওয়া সিলভা-৫, যার কোমরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে টিয়ার দুটো হাত। ঠিক যেভাবে ও ওর মাকে জড়িয়ে রাখত, ঠিক যেভাবে কোলে মাথা গুঁজে কাঁদত। অবিকল সেইরকম। আচ্ছা, সিলিকনের চামড়ায় কি কোলের গন্ধ থাকে? দারুচিনির থেকেও মিষ্টি মা-মা গন্ধ?
সবাই বোধ হয় বিনিপয়সার সার্কাস দেখতে ব্যস্ত। কেউ আর বুদ্ধি করে ভেন্টিলেটরগুলো খুলে দেয়নি। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে কমন স্পেসের আলো। যাক ঢেকে। সবকিছু ঢেকে যাক।
একটু পরেই তো ধোঁয়া কেটে যাবে। সব মিটে গিয়ে আরো একবার শান্ত হয়ে যাবে স্কাই ভিউ। শুধু ষাটতলার আকাশ দেখা ঘরটায় নকল গলায় সুর উঠবে ঘুমপাড়ানি গানের, কোনো এক টিয়া আবার ফিরে পাবে তার হারিয়ে যাওয়া ঘুম।
আমিও কি আর থাকব না সেই ঘরে? অনেক-অনেকদিন পর কি আবার দেখব না, কীভাবে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই সিক্তার মাথা বুকের কাছে এসে ঢুলে পড়ে? দেখব না একটু পরেই মা বাবুই পাখির মতো নিজের ডানায় ছানাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘুমিয়ে পড়া?
দেখতে দেখতেই হয়তো আবার বের করে আনব আমার ডায়েরিখানা। অনেকদিন পর ধুলো ঝেড়ে নিয়ে হয়তো একটু কাব্যই করব। লিখে ফেলব একদম সত্যি সত্যি একটা কবিতা। যে কবিতায় আজ আর কোনো ডানদিক নেই, নেই বাঁদিক। জিগস পাজলের সব দেওয়ালগুলো সোজা হয়।
আনক্যানির খাদ থেকে উঠে আসে লাল আলো। এসে মেশে কফি রঙের চুলে, চামড়ার নীচে লুকোনো গোলাপি আভায়।
অলঙ্করণ: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস