গল্প-স্বীকরোক্তি-পার্থ মন্ডল-শীত ২০২০

পার্থ মণ্ডলের আগের গল্প- রামনগরের খুনে

“আত্মা বা ভূত নিয়ে আপনাদের কী মত জানি না, তবে অনেক সময় এমনসব ঘটনা ঘটে যে, সাধারণ বুদ্ধিতে তার ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল।” মোহিতবাবু বললেন।

মোহিতরঞ্জন সাহা হলেন ‘খাইবার পাস’ বলে একটি ফিউশন রেস্তোঁরার মালিক; নরেন্দ্রপুরে এস.ভি.এফ মলের পেছনের রাস্তায় ওঁর রেস্তোঁরাটি। দীর্ঘদিন বিলেতের মাটিতে শেফ হিসেবে কাজ করেছেন, একটা সময় নিজে রেস্তোঁরা-পাব কিনে চালিয়েছেন। এখন মধ্য পঞ্চাশে দেশে ফিরে সোনারপুরে পৈতৃক বাড়িতে বাস করছেন। বিয়ে-থা করে সংসারী হননি। দেশে ফিরে বৃদ্ধ বাবা-মার দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিলিতি রান্না শিখে ওঁর মনের প্রবল ইচ্ছা ছিল একটা নতুন কিছু করবার যেখানে বিলিতি আর বাঙালি রান্নার মেলবন্ধন ঘটানো যেতে পারে। খাইবাস পাস সেই ভাবনারই ফসল। নামটা একটু মজা করে রাখা, এর সঙ্গে আফগানি খাবারদাবারের কোনো যোগ নেই।

আজ জয়ন্তবাবুর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে মোহিতবাবু আর সস্ত্রীক দেবাংশুবাবু নিমন্ত্রিত। ডাঃ জয়ন্ত বাগচী কলকাতা শহরের নামকরা অঙ্কোলজিস্ট। কলকাতায় টাটার নতুন হাসপাতালের ডাক্তার। থাকেন নরেন্দ্রপুরের পাইকপাড়া রোডে, চিন্তামণি কর বার্ড স্যাংচুয়ারির খুব কাছেই। ডঃ দেবাংশু মুখার্জী হলেন জয়ন্তবাবুর বাল্যবন্ধু, তাঁরা দুজনেই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র ছিলেন। দেবাংশুবাবু বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক। দুই বন্ধুর বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। বছর দুই আগে জয়ন্তবাবুর জন্মদিন উপলক্ষে দুই বন্ধু পরিবার নিয়ে যাবার জন্য নতুন কোনো রেস্তোঁরার সন্ধান করছিলেন। দেবাংশুবাবুর এক সহকর্মীর পরামর্শে খাইবার পাসে যান। ওখানে গিয়ে আলাপ মোহিতবাবুর সঙ্গে। মোহিতবাবুর নানা বিষয়ে জ্ঞান আর গল্প বলার ধরনে দুজনেই মোহিত হয়ে যান। তার ওপরে জয়ন্তবাবুও দীর্ঘদিন বিলেতে কাটিয়েছেন। তাই তিনজনের বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগেনি।

মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দুপুরে বাড়িতে পুজোর আয়োজন করেছিলেন জয়ন্তবাবু। আদ্যাপীঠ থেকে এক সন্ন্যাসী এসেছিলেন। সুললিত কণ্ঠে গীতা পাঠ করলেন, এই ঘণ্টা খানেক আগে তিনি ফিরে গেছেন। মধ্য জুলাই, একটু গরম, আর তার ওপর মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির শব্দ আসছে বাইরে থেকে। জয়ন্তবাবুর তিনতলা বাড়ির পুবমুখো জানালা দিয়ে ভালোই ঠান্ডা হাওয়া আসছে বসার ঘরে। একটু আগে কারেন্ট চলে গেছে, তার ওপর আজ সকালেই জয়ন্তবাবুদের ইনভার্টারটা গেছে খারাপ হয়ে। ঘরে দু-একটা টিমটিমে এমার্জেন্সি লাইট আছে, সেই দিয়ে কাজ চলছে। কাল সকালে ইলেক্ট্রিশিয়ান আসবে ইনভার্টারটা দেখতে। তবে আজ সকালেই জয়ন্তবাবুর স্ত্রী ওদের রান্নার লোকের সাহায্যে সমস্ত রান্না করে রেখেছেন। তাই পাশের ঘরে জয়ন্তবাবু ও দেবাংশুবাবুর স্ত্রী গল্প করছেন নিশ্চিন্তে। ঘড়িতে সবে সন্ধে সাতটা।

গীতা পাঠের সূত্র ধরে আলোচনায় এল আধ্যাত্মিকতা, সেখান থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণের জীবনের নানা ঘটনা, আর স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’; আর তারপরেই কান টানলে মাথা আসার মতো এসে পড়ল আত্মা বা ভূতের প্রসঙ্গ। মোহিতবাবু তাঁর কথার প্রসঙ্গ ধরে বললেন, “ইংল্যান্ডে থাকার সময়ে আমার জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছিল যে এই বয়সে এসে যখন চিন্তা করি, তখন কিছুতেই তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাই না।”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মোহিতবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন দেবাংশুবাবু আর জয়ন্তবাবু। মোহিতবাবু বলতে থাকলেন, “সালটা ১৯৯৬। লন্ডনের খুব কাছেই এপিং ফরেস্ট। শহরের এত কাছে ঘন জঙ্গল বলে লন্ডনের মানুষদের কাছে এই জায়গা খুব পপুলার। তার ওপরে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের কোনো অভাব হয় না এখানে। এই জঙ্গলের বুকে এপিং রোডের ওপরে মিলার অ্যান্ড কার্টার বলে একটা পাব কিনেছি বেশ কয়েকমাস আগে। স্থানীয়দের মধ্যে রেসিজমের একটা চোরা স্রোত মালুম হত বেশ। তাই আমার বেশিরভাগ স্টাফ ছিল সাদা। আমি কিচেনেই থাকতাম চিফ শেফের দায়িত্ব পালন করতে। থাকতাম ফরেস্টের দক্ষিণে লাফটন টিউব স্টেশনের ঠিক উলটোদিকে একটা ফ্ল্যাটে। ফেরবার সময় আমরা সব স্টাফেরা মিলে দুটো গাড়িতে করে ফিরতাম। আসলে এপিং ফরেস্ট নাকি ভূতুড়ে, এই দুর্নাম ছিল। সত্যি-মিথ্যে কী তা জানতাম না, তবে আমরা কোনো রিস্ক নিতাম না।

“এপিং ফরেস্টের বিভিন্ন গল্পের মধ্যে তিনটে খুব চালু গল্প আছে। আসলে সেভেন্টিনথ আর এইটিনথ সেঞ্চুরির সময়ে লন্ডন শহরের সব ডাকসাইটে অপরাধীদের লুকোনোর জায়গা ছিল এটা। তাদের নিজেদের মধ্যে মারপিট হত খুব, খুনখারাপি লেগেই থাকত। জঙ্গলটা খুব ঘন, মধ্যে মধ্যে প্রচুর ছোটো ছোটো ডোবা আছে। সেইরকম এক ডোবায় এক যুগলের ডুবে মৃত্যুর পর নাকি সেই ডোবার কাছে এলেই লোকজনের আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগত। সেই ডোবার কাছেই একটা পাহাড় আছে, যার নাম হ্যাংম্যান’স হিল। ওই পাহাড়ের নীচে গাড়ি পার্ক করা থাকলে দেখা যেত সেই গাড়ি অভিকর্ষ অগ্রাহ্য করে পাহাড় বেয়ে নিজে নিজেই গড়িয়ে ওপরে উঠছে! আর বাকহার্স্ট হিলের কসাই টার্পিন-এর তো নামেই মাংসের দোকান ছিল, আসলে সে ছিল ভাড়াটে খুনি। গভীর রাতে টার্পিন নাকি এখনো নিরাপরাধ মানুষদের তাড়া করে। প্রায় দু-হাজার বছর আগে কেলটিক উপজাতির রানি বুডিকার বাহিনীর সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল নাকি ওখানে। সেখানে কোনোভাবে আগুন লেগে বহু সৈন্যের মৃত্যু হয়। ওখানে গভীর জঙ্গলে এখনো ঘোড়ার পিঠে চেপে সেই সৈন্যদের পালিয়ে যেতে দেখা যায়। তো এইরকম নানান গল্পের রহস্যে মোড়া এপিং ফরেস্টের গভীরে নিঝুম দুপুরেও ভয় লাগে।

“আপনাদের মনে প্রশ্ন জগতে পারে, সব জেনেবুঝেও আমি ওখানে পাব কেন কিনতে গেলাম। আসলে তখন আমি পরের গোলামি করে ক্লান্ত, নিজে কিছু করবার খিদেটা চাগাড় দিচ্ছে। এদিকে রেস্তর অভাব। কম খরচের এই দুশো বছরের পুরোনো পাবটার বিজ্ঞাপন দেখে কিনে ফেললাম।

“যাক, এবারে আসল গল্পে আসি। কিচেনে আমাকে সাহায্য করত স্টিভন বলে একটা পোলিশ ছোকরা। আমরা ওকে স্টিভ বলে ডাকতাম। বছর আটেক আগে সে তার মাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে আসে জীবিকার প্রয়োজনে, পোল্যান্ডে তখন কম্যুনিস্ট শাসনের শেষদিক। স্টিভ ছিল কাজে খুব আন্তরিক, শেখার খুব আগ্রহ আর সময়ের ব্যাপারে খুব পাঙ্কচুয়াল। সে তার মাকে নিয়ে দু-মাইল দূরে গোল্ডিংস হিল গ্রামে থাকত।

“ক্রিসমাসের পর্ব চলছে তখন, নভেম্বরের শেষ আর ডিসেম্বরের শুরুর দিক। প্রতি সপ্তাহেই একটা দুটো পার্টির বরাত পাচ্ছি আমরা। তাই বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই কাটছে কিচেনে। তারিখটা আমার এখনো মনে আছে—পাঁচই ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার। কাছের একটা হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের পার্টি ছিল সেদিন। এদিকে ওয়েদারটা সেদিন একেবারেই অনুকূল ছিল না। সারাদিন বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। তবে ওই সন্ধেতে ঝড় মাথায় করেই সব অতিথিরা হাজির। তাই কিচেনে আমরা সবাই খুব ব্যস্ত। সন্ধে তখন সাড়ে আটটা হবে। পাবে একটা ফোন এল। স্টিভের প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে। স্টিভের মা স্ট্রোকে আক্রান্ত, ওঁরা হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তবে স্টিভকে অবিলম্বে যেতে হবে ওখানে। আমাদের সব স্টাফ প্রচণ্ড ব্যস্ত, তাই কারোর গাড়ি করে স্টিভকে বাড়ি ছেড়ে আসবার ফুরসত নেই। হয়তো-বা সেটাই ছিল নিয়তি।

“অনেক চেষ্টা করেও স্টিভ ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে পারল না। তারপর বলল, এই দু-আড়াই মাইল রাস্তা সে হেঁটেই চলে যাবে, তারপর গ্রামে পৌঁছে প্রতিবেশীর গাড়িতে করে হাসপাতালে যাবে। এদিকে ঝড়ের গতি তখন আরো বেড়েছে। পার্টি চলল সেই রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত।

“অতিথিরা সকলে ফিরে চলে গেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের কাজ সারতে সারতে আমাদের সকলের স্টিভের কথা মনে হল। তাড়াহুড়োয় স্টিভের কাছ থেকে ওর প্রতিবেশীর নম্বর নিতে ভুলে গেছিলাম। তখন সবে মোবাইল আসছে লোকজনের হাতে, আর বেশ খরচের ব্যাপার  ছিল মোবাইল রাখা। আমাদের কারোর কাছেই তখন মোবাইল ছিল না। তাই ইচ্ছে থাকলেও স্টিভের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় নেই।

“রাত বারোটা বেজে গেল কাজ সারতে। আমরা দশজন মিলে দুটো পুরোনো ফোর্ড গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম। আমি সামনের গাড়িটা চালাচ্ছি, আর পেছনের গাড়িটা চালাচ্ছে হেড বার টেন্ডার পল। মাইল খানেক রাস্তা পার হয়েছি সবে। জায়গায় জায়গায় দেখতে পাচ্ছি গাছের ডালপালা পড়ে আছে। সামনের হেড লাইটের আলোয় দেখতে পেলাম একটা ছোটো ডাল রাস্তার ওপরে পড়ে আছে। স্পিড কমিয়ে পার হয়ে যাব ভাবলাম। যেই স্পিড কমিয়েছি, দেখলাম এক্সেলারেটরে চাপ দেওয়া সত্ত্বেও গাড়ি আর এক পাও এগোচ্ছে না। রিয়ার ভিউ আয়নায় কিছুই চোখে পড়ছে না, পেছনে ঘন অন্ধকার। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম এইভাবে। এদিকের পলের গাড়ি একটু পিছিয়ে ছিল। তবে সাইড ভিউ আয়নায় আলোর রেখা দেখতে পেয়ে ভাবলাম, পলের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করি।

“অপেক্ষা বেশিক্ষণ করতে হল না। মিনিট খানেকের মধ্যেই আলোটা একটা দূরত্বে এসে থেমে গেল। আর এল হর্নের তীব্র আওয়াজ, থেকে থেকে। কী ব্যাপার বোঝার জন্যে গাড়ির জানালার কাচ নীচে নামাতেই কানে এল পলের গলার আওয়াজ পেছনের গাড়ি থেকে। ‘সাহা, ফর গড’স সেক, ডোন্ট কাম আউট অফ ইওর কার। স্টে ইনসাইড।’

“এবারে আমি চোখ রাখলাম রিয়ার ভিউ আয়নায়। দেখতে পেলাম আমার গাড়ির পেছনেই একটা লোক দাঁড়িয়ে, দেখতে অনেকটা স্টিভের মতোই। কিন্তু শরীরের আকার স্টিভের থেকে অনেক বড়ো আর দেখতে শক্তিশালী। তাহলে কি স্টিভ এখনো রাস্তায় আটকে পড়ে আছে? একটু দোনোমনা করে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পেছনের দিকে গেলাম। ‘স্টিভ, হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার?’ বলে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। মুখ তো পুরো স্টিভের মতোই, কিন্তু এর হাইট তো প্রায় সাত ফুট! স্টিভের হাইট তো মেরেকেটে পাঁচ ফুট হবে। আর শরীরের বহরও পেল্লায়, ডবলু.ডবলু.এফ কুস্তিগীরের মতো। পেছনের গাড়ি থেকে পল ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘সাহা, গো ব্যাক টু ইওর কার!’

“আমি চিত্রার্পিতের মতো স্টিভের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখতে পেলাম, স্টিভের মতো দেখতে লোকটা হাত দিয়ে গাড়ির পেছনটা তুলে ধরে রেখেছে। এতক্ষণে আমি গাড়ি না চলবার কারণটা বুঝলাম। আমি সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে বললাম, “হু-এভার ইউ আর? ফর গড’স সেক, লেট আস গো। দিজ স্টাফ হ্যাভ ফ্যামিলিজ, দে উইল বি ওয়ারিড।’

“ঘড়ঘড়ে ধাতব কণ্ঠে স্টিভের মতো দেখতে লোকটা বলে উঠল, ‘সাহা, আই কান্ট লেট ইউ গো। ইউ হ্যাভ টু স্টে হিয়ার দিস নাইট।’

“আমি একটু কঠিন স্বরে বললাম, ‘স্টিভ, দিস ইজ টু মাচ। ইউ কান্ট ডু দিস উইথ আস।’

হিসহিসিয়ে উঠল স্টিভ। বলল, ‘ইফ ইউ মুভ ইভন আ সিঙ্গল স্টেপ, আই উইল কিল ইউ।’

“আমাকে সাহায্য করবার জন্যে পল তখন গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল নিয়ে স্টিভের কাঁধে আঘাত হানল। স্টিভ আমার গাড়িটা নামিয়ে ওর দিকে ঘুরে একটা মোক্ষম ঘুসি চালাল। আমি স্টিভকে জাপটে ধরতে গেলাম। স্টিভ আমার মাথার পেছনে এমনভাবে মারল যে আমি জ্ঞান হারালাম।

“পরদিন ভোরে যখন জ্ঞান হল, তখন আমার অন্য স্টাফদের কাছে শুনলাম, স্টিভ জঙ্গলে অন্তর্হিত হবার আগে সকলকে শাসিয়ে গেছে যে ভোর হবার আগে কেউ জঙ্গল ছেড়ে যাবার চেষ্টা করলেই তাকে সে প্রাণে মেরে দেবে। পরে বেলার দিকে আমরা খবর পাই স্টিভ ওই রাতে গাড়িচাপা পড়ে মারা যায়। ঝড়ে একটা গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওকে ধাক্কা মারে, ওই দায়িত্বজ্ঞানহীন ড্রাইভার ওখানে না দাঁড়িয়ে পালিয়ে যায়। এছাড়া জঙ্গলের বহু জায়গায় গাছ ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। অনেক গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে, গাড়ির যাত্রীরা কেউ নিহত, কেউ গুরুতর আহত। বুঝতে পারলাম, স্টিভ প্রাণে মরে গিয়ে আমাদের সকলকে বাঁচাবার চেষ্টাই করেছিল ওই রাতে। পরে জেনেছিলাম, বেচারা স্টিভের মা পুত্রশোকে কয়েকমাসের মধ্যেই স্বর্গবাসী হন।”

এই পর্যন্ত বলে মোহিতবাবু উঠে একটা সিগারেট ধরালেন বারান্দায় গিয়ে। শ্রাবণের ঠান্ডা জোলো হাওয়ায় ধূমপানের আমেজ নিতে নিতে বললেন, “এই সময় এক কাপ চা হলে মন্দ হত না জয়ন্তবাবু।”

জয়ন্তবাবু আর স্ত্রীকে বিরক্ত না করে নিজেই কিচেনে গিয়ে পাঁচ কাপ চা বানিয়ে অন্য ঘরে দু-কাপ সাপ্লাই দিয়ে এই ঘরে তিন কাপ নিয়ে এলেন। ধূমপান শেষে মোহিতবাবু তাঁর কাপে লম্বা চুমুক দিলেন আরাম করে।

এই সময়ে দেবাংশুবাবু বললেন, “আচ্ছা জয়ন্ত, তুইও তো এককালে লন্ডনের স্ট্রাটফোর্ডে থাকতিস। তুই কখনো এপিং ফরেস্টে যাসনি?”

জয়ন্তবাবু সরাসরি কথাটার উত্তর না দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, “দেবাংশু, তুই তো জানিস, তবে মোহিতবাবুর জানার কথা নয়। তিন বছর আগে আমার মায়ের যে মৃত্যু হয়েছিল তা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। নাট্যপ্রেমী মা মহানায়ক উত্তম মঞ্চে গেছিলেন নাটক দেখতে। যাবার সময় আমাদের ড্রাইভার মাকে নামিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সে রাতে ও মায়ের জন্যে অপেক্ষা করতে পারেনি। কারণ, ওইদিন ওর ছেলের জন্মদিন ছিল। মাকে বহুবার বারণ করেছিলাম, কিন্তু শোনেননি কিছুতেই আমার কথা। খালি বললেন, হলের কাছেই যতীন দাস পার্ক থেকে মেট্রো ধরে গড়িয়া বাজারে নামবেন, সেখান থেকে অটোতে তো এইটুকু রাস্তা। দুর্ভাগ্য এমন, সারাদিন শুকনো আবহাওয়া সত্ত্বেও ওইদিন সন্ধে থেকে ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হয়। আমাকে ফোনে জানালেন যে ট্যাক্সি ধরে চলে আসবেন, কিন্তু কোনো ট্যাক্সি এতদূর আসতে রাজি হয়নি। অগত্যা মা মেট্রো ধরে গড়িয়া বাজারে আসেন। মেট্রো ধরবার আগেও ফোন করে জানিয়েছিলেন। কিন্তু মেট্রো থেকে নেমে আর আমাকে ফোন করেননি। হয়তো সিগন্যাল পাননি। এদিকে ওই রাতে তিনি হয়তো পুরো রাস্তার জন্যে অটো পাননি। অটো ড্রাইভার ওঁকে রথতলার মোড়ে নামিয়ে দেয়। ওখান থেকে রিকশা নিয়ে ফিরছিলেন। মাকে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কিছুতেই ফোনে পাচ্ছিলাম না। এদিকে হঠাৎ কাছে একটা গাছ ভাঙার আওয়াজ এল কানে। সঙ্গে অনেক লোকের শোরগোল। মনটা আমার কু গাইল। পাজামা পরা অবস্থায় বাড়ির দরজা খুলে দৌড় দিলাম ওইদিকে। দেখলাম, একটা রিকশার ওপরে একটা পুরোনো গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আছে। রিকশাওয়ালা প্রাণে বেঁচে গেছে। রাস্তার লোকেরা যাত্রীকে ধরাধরি করে নামাল—এক মহিলা, মাথা তাঁর রক্তাক্ত, বেঁচে থাকার আশা বেশ ক্ষীণ। কাছে গিয়ে দেখলাম, সেই মহিলা এই হতভাগারই মা।”

এই পর্যন্ত বলে জয়ন্তবাবু একটু থামলেন। দেবাংশুবাবু জয়ন্তবাবুর হাতটা একটু চেপে ধরলেন সমবেদনা জানাবার ভঙ্গিতে।

জয়ন্তবাবু আবার বলতে আরম্ভ করলেন, “তুই জিজ্ঞেস করছিলি না দেবাংশু, আমি এপিং ফরেস্টে কখনো গেছি কি না? হ্যাঁ, আমি গেছি একবার। একটা ক্রিসমাস পার্টি অ্যাটেন্ড করতে। আমি স্ট্রাটফোর্ডে থাকতাম, তবে হোয়াইট চ্যাপেলের একটা হাসপাতালে চাকরি করতাম। বড়ো হাসপাতাল, তাই ডিপার্টমেন্টের ভিত্তিতে ক্রিসমাস পার্টি হত। চন্দনা, মানে আমার স্ত্রীর শরীর খারাপ ছিল, তাই আমি ওকে বাড়িতে রেখে পার্টিতে গেছিলাম। সেদিন আবহাওয়া ছিল খুব দুর্যোগপূর্ণ। পাবে পৌঁছে সবেমাত্র একটা ড্রিঙ্ক নিয়েছি আর স্টার্টারে কামড় বসিয়েছি, পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। দেখলাম চন্দনা ফোন করছে বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে। ওর শরীর খারাপ, তাই সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরলাম। চন্দনা আমাকে অনুরোধ করল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবার জন্য। শরীরটা ওর মোটেই ভালো লাগছিল না। আমি কোনোরকমে স্টার্টারটা শেষ করেই পাবের পার্কিংয়ে দৌড় দিলাম। গাড়িটা নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটালাম জঙ্গলের রাস্তায়। তখন ঝড় চালু হয়েছে পুরোদমে। রাস্তা একটু আঁকাবাঁকা। হঠাৎ ঝড়ে একটা ডাল ভেঙে পড়ল রাস্তার ডানদিকে, আর আমি কোনোরকমে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরালাম বাঁদিকে, আর রাস্তাটা ওখানে বাঁদিকেই বেঁকে গেছে। সেই বাঁকে একটা লোক হাঁটছিল। আমি ভাবতেই পারিনি ওই দুর্যোগের রাতে ওখানে কেউ হাঁটবে। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে আমি ধাক্কা দিলাম লোকটাকে। লোকটা আর্তনাদ করে রাস্তার পাশে পড়ে গেল। ইতস্তত করে আমি একটু থামলাম। লোকটা চিৎকার করে উঠল, ‘হেল্প প্লিজ, আই কান্ট অ্যাফোর্ড টু ডাই নাও।’

“পরক্ষণেই মনে হল, বাড়িতে চন্দনা একা, অসুস্থ। এখন একে হেল্প করতে গেলে সারারাত হাসপাতাল-পুলিশের ঝামেলা পোয়াতে হবে। আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতা আমাকে ওই জায়গা থেকে তাড়িয়ে নিয়ে গেলো মোহিতবাবু। ওইদিনটাও ছিল পাঁচই ডিসেম্বর, সালটা ১৯৯৬। স্টিভের ঘাতক আমিই মোহিতবাবু। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে অপরাধ বোধে ভুগেছি আমি। খালি মনে হত, আমি যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করা খুব জরুরি ছিল। তাহলে হয়তো মাকে এইভাবে মরতে হত না। আমি তার পরের দিনেও তো পুলিশের কাছে যেতে পারতাম, স্টিভের মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারতাম! আপনি ঠিক বলেছেন মোহিতবাবু, আমি অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করেছি। আপনি ছিলেন স্টিভের এমপ্লয়ার, আপনার কাছেই তাই আমি ক্ষমা চাইছি।”

এই বলে জয়ন্তবাবু মোহিতবাবুর দুটো হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শিশুর মতো ফুলে ফুলে কেঁদে উঠলেন। দেবাংশুবাবু হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, পাশের ঘর থেকে দুই ভদ্রমহিলা কখন যে উঠে এসে এই ঘরে সোফায় বসেছিলেন তা তাঁরা টের পাননি। মোহিতবাবু আর দেবাংশুবাবুর হাত জয়ন্তবাবুর পিঠে। চন্দনাদেবী, জয়ন্তবাবুর স্ত্রীর চোখে জল। অস্ফুটে বলে উঠলেন, “একবারও বলোনি তুমি এই ঘটনার কথা।”

দমকা হাওয়ায় বারান্দার দরজাটা জোরে খুলে গেল। পাঁচজনে এমার্জেন্সি ল্যাম্পের মৃদু আলোয় বসে রইলেন পাথরের মতো।

অলঙ্করণ:শিমূল সরকার

জয়ঢাকের গল্পঘর

1 thought on “গল্প-স্বীকরোক্তি-পার্থ মন্ডল-শীত ২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s