টাইম মেশিন-মহামতি জীবক- সুদীপ ঘোষাল-শীত ২০২০

নানারঙের ইতিহাস

জীবক অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ভেষজ বিজ্ঞান অধ্যয়নের পর চিকিৎসক হিসেবে বিম্বিসারের সভায় যোগদান করেন এবং ভগবান বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু অজাতশত্রু রাজা হওয়ার পরে বৌদ্ধ বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। আজ রাজসভায় অজাতশত্রু বলছেন, “শোনো হে পারিষদবর্গ। আমার রাজ্যে বৌদ্ধগান বন্ধ করতে হবে। সেনাপতি কোথায়?”

“আজ্ঞে আমি হাজির। আদেশ করুন।”

“আমার রাজ্যে আমিই এক এবং একক। আর কেউ ধর্ম প্রচার করে বড়ো হবে এ আমি কিছুতেই সহ্য করব না।”

“তাই হবে রাজন। আজ থেকে আমি দেখব। আপনার আদেশ শিরোধার্য।”

“না, খুব কড়াকড়ি করার প্রয়োজন নেই। রাজার আদেশ তারা যেন পালন করে এবং কর ঠিকমতো দেয় তার ব্যবস্থা করুন। শুধু ধর্ম নিয়ে পেট ভরে না।”

রাজা অজাতশত্রু আদেশ দিলেন। তারপরও তিনি ভাবছেন বুদ্ধদেবকে সকলে ভগবান বলে মানে—কেন? তার মধ্যে কী এমন আছে যে রাজার থেকেও সাধু বড়ো হয়ে যায়?

তিনি রাজপুরোহিতের কাছে যান। রাজপুরোহিত বলেন, “বুদ্ধদেব বাল্যকালে রাজপাট ছেড়ে কঠোর সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। দীর্ঘ সময় সাধনা করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন। তিনি সাধারণ মানুষ নন। তিনি তাঁর ভক্তদের কাছে ভগবানস্বরূপ।”

রাজা বলেন, “হ্যাঁ, শুনেছি। রাজপুত্র বাইরে বেরিয়েছিলেন চারদিন। চারদিন তিনি মানুষের যৌবন, জ্বরা, ব্যাধি ও মৃত্যু দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মানুষের যদি শেষ পরিণতি মৃত্যু হয়, তাহলে এই যে সংসার জীবন—এর কোনো অর্থ হয় না।”

রাজপুরোহিত বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। তারপর তিনি এক গভীর রাতে রাজ্যপাট ছেড়ে, মাকে ছেড়ে, বাবাকে ছেড়ে, রাজ্যের লোভ ছেড়ে বাইরে ফিরছিলেন সন্ন্যাসী হবেন বলে। তারপর বটবৃক্ষের তলায় কঠিন সাধনা শুরু করেছিলেন। সেই সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তারপর সুজাতা নামে এক মহিলার হাতে পায়েস খেয়ে তিনি সেই সাধনা ভঙ্গ করেন। তিনি বুঝেছিলেন শরীরকে কষ্ট দিয়ে সাধনা করা যায় না। সাধনা করতে গেলে শরীরকে কষ্ট দিতে নেই।

“এখন তিনি ভগবান বুদ্ধ নামে পরিচিত। তাঁর কাছে অনেক মানুষ মনের অশান্তি, যন্ত্রণা নিয়ে আসেন এবং মনে সুন্দর এক ভাবনা নিয়ে ফিরে যান। একজন এসে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আমার ঘরে মৃত্যু বার বার প্রবেশ করছে? আমি মরতে চাই না। তিনি বলেছিলেন, ঠিক আছে, তুমি এমন কোনো বাড়ি থেকে আমাকে একমুঠো চাল এনে দাও যার ঘরে মৃত্যু প্রবেশ করেনি। সেই চাল খেলে তুমি অমর হয়ে যাবে। সেই ব্যক্তি বক্তব্যের সারাংশ বুঝে চলে গিয়েছিলেন খুশি মনে।

“কিন্তু বুদ্ধদেবের চিকিৎসা করেন এক চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি মস্ত বড়ো চিকিৎসক, তাঁর নাম জীবক। আমাদের রাজপরিবারের চিকিৎসক তিনি রাজা বিম্বিসারের আমল থেকে। তুমি এই জীবককে প্রাসাদে এনে রাখতে পার। তিনি তোমার চিকিৎসা করবেন। রাজপরিবারের চিকিৎসা করবেন।”

অজাতশত্রুর আগে মহারাজ বিম্বিসার সবরকম খোঁজখবর নিয়ে জীবককে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর রাজসভায়। জীবক এসেছিলেন। জীবক রাজি হয়েছিলেন রাজসভায় যোগদান করার জন্য। আবার বুদ্ধদেবের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জীবক। অজাতশত্রু বৌদ্ধ বিদ্বেষী হয়েও জীবককে মর্যাদার আসনে রেখেছিলেন। মহামতি জীবক রাজপরিবারের চিকিৎসা করতেন। আর যেখানে খবর পেতেন সেখানেই চিকিৎসা করতে চলে যেতেন পায়ে হেঁটে।

একবার এক গরিব মানুষ সপ্তপর্ণী গুহাপ্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজসভায় মহামতি জীবকের সন্ধান করেছিলেন। সেই দরিদ্র রাজপ্রাসাদের গেটের বাইরে অধীর আগ্রহে আশাবাদী হয়ে উঠলেন মহামতির দর্শন পাওয়ার জন্য। তিনি প্রহরীকে বললেন, “একবার মহামতি জীবকের কাছে যেতে চাই।”

প্রহরী বলল, “তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তুই সামন্য এক কৃষক হয়ে রাজার চিকিৎসকের সাহায্য চাইছিস? যা, পালা। তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না। তিনি এখন চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করছেন।”

লোকটি বললেন, “আমাকে বাঁচান। আমার স্ত্রী মরে যাবে।”

প্রহরী বলল, “তোর মরে যাওয়াই ভালো।”

গরিব কৃষক কান্নাকাটি শুরু করলেন।

গোলমাল শুনে মহামতি জীবক জানালা থেকে গোলমালের কারণ অনুধাবন করলেন। তারপর তাঁর চিকিৎসার থলে নিয়ে হাজির হলেন গেটের সামনে। মহামতি প্রহরীকে বললেন, “দরজা খোলো। আর কোনো লোকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে না। জীবনে কষ্ট পাবে খারাপ আচরণের ফলে।”

প্রহরী লজ্জিত হয়ে গেট খুলে দিল। জীবক গরিব কৃষকের হাত ধরে চলে গেলেন পায়ে হেঁটে দশ মাইল পথ। তাঁর চিকিৎসায় সেরে উঠেছিল কৃষকের স্ত্রী।

কোনোদিন কোনো গরিব মানুষ তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়নি। তিনি অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা করতেন না। তিনি চিকিৎসা করতেন মানুষকে ভালোবেসে। ভগবান বুদ্ধের বাণী তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল অনেকখানি।

রাজা অজাতশত্রু জীবকের কাছে ভগবান বুদ্ধের বাণী সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এবং জীবককে অবসর সময়ে রাজা নিভৃত কক্ষে ডেকে পাঠাতেন। তন্ময় হয়ে শুনতেন জীবকের কথা।

জীবক বলতেন, জীবে দয়া, ভালোবাসা আর শান্তি তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।

জীবক সময় কাটাচ্ছেন রাজার কক্ষে এবং বুদ্ধের বাণী শোনাতেন রাজাকে। জীবন শান্তি, ধর্ম আর ভালোবাসার জন্য। বৌদ্ধ ধর্মের মূলকথা, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। শান্তিই একমাত্র সমস্ত কিছুর সমাধান করতে পারে। ভালোবাসা আর শান্তি, এই হল বুদ্ধদেবের বাণীর মূলকথা।

অজাতশত্রু তাঁর বাবার কাছেও শুনেছিলেন জীবকের কথা। বিম্বিসার জানতেন, বৌদ্ধ যুগের ভারতবর্ষে বিজ্ঞানে, চিত্রকলায়, দর্শনে সর্বত্র নিয়োজিত হয়েছিল এক প্রতিবাদ এবং সেগুলি জগতের কাছে একটি বিস্ময়। মহারাজ বিম্বিসার বলতেন, মহামতি জীবককে পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী বলা যেতে পারে। কথিত আছে, ইনি বারবনিতার সন্তানরূপে জন্ম নিয়েছিলেন আবর্জনার স্তূপে। পরিণত করেছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়কে। চিকিৎসাশাস্ত্র এবং বিজ্ঞান চিকিৎসক মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন এবং ভগবান বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

অজাতশত্রু প্রচণ্ড বুদ্ধবিরোধী হলেও এবং পিতাকে বন্দি করলেও জীবকেকে চিকিৎসক পদে বহাল রেখেছিলেন জীবকের অসাধারণ চিকিৎসা নৈপুণ্যের জন্য।

সাধারণ জীবনযাপন করছেন জীবক। ধর্ম প্রচারের পরিবর্তে তাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। শেষে তাঁর আচরণ অজাতশত্রুকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে শত্রুতা করেও তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের পরামর্শে অজাতশত্রু প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছিলেন। পর্বতের গুহায় সম্মেলন হয়েছিল এবং ভগবান বুদ্ধের বাণীগুলিকে একত্রিত করা হয়েছিল।

অজাতশত্রু একদিন জীবককে বললেন, “আমি ভগবান বুদ্ধের শরণাপন্ন হতে চাই।”

জীবক বললেন, “চলুন, আমি আপনাকে ভগবানের কাছে নিয়ে যাই।”

ভগবান বুদ্ধের কথা শুনে অজাতশত্রুর জীবনে বিরাট এক পরিবর্তন আসে। তিনি বৌদ্ধ মহাসম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, ভগবান বুদ্ধের বাণীগুলি সংরক্ষণ করে রাখা হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য।

বৌদ্ধ গ্রন্থগুলি যুবকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গ্রন্থগুলি থেকে জানা গেছে, তিনি দু-দু’বার বুদ্ধকে কঠিন রোগ থেকে মুক্ত করেছিলেন। সংসার থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু একশো বছর বয়সে পদব্রজে বৌদ্ধবিহারগুলিতে যাওয়া আসা করতেন কেবলমাত্র চিকিৎসার কারণে। বহুদূর থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসতেন চিকিৎসার জন্য। কাউকে বিমুখ করতেন না।

জীবককে বলা হয় বেদোক্ত যুগের ধন্বন্তরি। রোগীকে না দেখেও কীরকম চিকিৎসা  করতেন তা শুনলে চমকিত হতে হয়। কথিত আছে, ভগবান বুদ্ধ একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওষুধগুলো পদ্মফুলে মিশিয়ে রেখেছিলেন। বুদ্ধদেব গ্রহণ না করায় তাঁর কাছে প্রেরণ করেছিলেন। ঘ্রাণ গ্রহণ করেই তাঁর রোগ ভালো হয়েছিল।

সেবার কাজে নিজেকে সতত নিয়োজিত রাখলেও বিজ্ঞানকে বঞ্চিত করেননি জীবক। চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি। সেগুলো পরের দিকে হারিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল তাঁর শেষ বয়সে শ্রেষ্ঠ রচনা। শিশুরোগ চিকিৎসা গ্রন্থ পৃথিবীর প্রথম শিশু চিকিৎসা সংক্রান্ত বই, অতি মূল্যবান গ্রন্থ যা পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসকদের শিশুরোগ সংক্রান্ত গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।

জীবক বলতেন, ‘শুধু ধর্মপ্রচার নয়, গরিব রোগীদের সেবা করতে হবে। তাদের সেবায় নিয়োজিত হতে চাই।’

ধর্ম প্রচারের পরিবর্তে দীনদরিদ্র, রোগগ্রস্তদের সেবায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। শেষে তাঁর আচরণ অজাতশত্রুকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে শত্রুতা ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে অজাতশত্রু প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলন আহ্বান জানিয়েছিলেন।

অজাতশত্রু বললেন, “আমি এক বড়ো বৌদ্ধ মহাসম্মেলন করতে চাই।”

জীবক বললেন, “কিন্তু এত বড়ো মহাসম্মেলন আপনি করবেন কোথায়? ভারতবর্ষের প্রত্যেক প্রদেশ থেকে বহু লোকের সমাগম হবে।”

অজাতশত্রু বললেন, “আমি স্থান নির্বাচন করেই রেখেছি। গৃধ্রকূট পর্বতে সপ্তপর্ণী গুহায় সম্মেলন করা হবে।”

রাজপুরোহিত বললেন, “তাঁর সমস্ত বাণী সংরক্ষণ করতে হবে।”

তারপর সমস্ত সেনাপতিদের সাহায্যে, সমস্ত নাগরিকদের সাহায্য নিয়ে সেই গৃধ্রকূট পর্বতে বিরাট বড়ো মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। সপ্তপর্ণী পর্বতের গুহায় সম্মেলন হয়েছিল এবং ভগবান বুদ্ধের বাণীগুলোকে একত্রিত করা হয়েছিল রাজার কথামতো।

একবার ভগবান বুদ্ধের শরীর অসুস্থ হয়ে উঠল চরম। জীবক বললেন, “আপনি ঔষধ সেবন করুন, তাহলেই সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

ভগবান বললেন, “আমি ঔষধ সেবন করব না। এবার তো বয়স হয়েছে। তোমরা বেশি চিন্তা কোরো না।”

তাঁকে কেউ রাজি করাতে পারল না। শেষে জীবক এক ফন্দি আঁটলেন। তিনি তাঁর এক বন্ধুকে বললেন, “তুমি আমার বাড়ি যাবে গোপনে, কেউ যেন জানতে না পারে। ওখানে আমি ভগবানের ঔষধ দিয়ে দেব এবং ভগবান সেই ঔষধে ঠিক হয়ে যাবেন।”

জীবকের বন্ধু জীবকের বাড়ি এলেন এবং বললেন, “আমি এসে গেছি। তুমি কী দেবে বলেছিলে দাও।”

তারপর জীবক করলেন কী, ভগবান বুদ্ধের প্রিয় শ্বেত পদ্ম ফুলের ভিতর ওষুধ দিলেন এবং তার মধ্যেই ওষুধের বিভিন্নরকম পদ্ধতিতে ওষুধ মিশ্রিত করলেন এবং বন্ধুর হাতে তুলে দিলেন।

তারপর মহামতি জীবকের বন্ধু ভগবান বুদ্ধের কাছে গেলেন। তিনি ভগবান বুদ্ধকে বললেন, “আপনার প্রিয় শ্বেত পদ্ম এনেছি।”

ভগবান বুদ্ধ প্রসন্ন চিত্তে তারপর শ্বেত পদ্ম গ্রহণ করলেন। তারপর নাকের কাছে নিয়ে সুগন্ধি পুষ্পের ঘ্রাণ গ্রহণ করলেন। কিছুদিন পরে ভগবান বুদ্ধ সুস্থ হয়ে উঠলেন।

সাধারণ এক ভিক্ষুক মতো জীবনযাপন করতেন মহামতি জীবক। ধর্মপ্রচারে পরিবর্তে দুঃখিত রোগগ্রস্তর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। শেষে তাঁর আচরণ অজাতশত্রুকে খুব মুগ্ধ করেছিল এবং তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

মহামতি জীবক একশো বছর বয়সেও পায়ে হেঁটে চিকিৎসা করে বেড়াতেন গ্রামে গ্রামে।

এবার অজাতশত্রু তাঁকে ডেকে বললেন, “আপনি চিকিৎসাশাস্ত্র রচনা করুন ভবিষ্যৎ দুনিয়ার জন্য।”

জীবক শেষ বয়সে শ্রেষ্ঠ রচনা শিশুরোগ চিকিৎসা গ্রন্থ রচনা করেন। পৃথিবীর প্রথম শিশু চিকিৎসা সংক্রান্ত বই। অতি মূল্যবান গ্রন্থ, বৃদ্ধ জীবক তন্ত্র। যা পরবর্তীকালে ভারতীয় চিকিৎসকদের শিশুরোগ সংক্রান্ত গবেষণা যুদ্ধে সাহায্য করেছিল।

মহামতি জীবক তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, রাজা বিম্বিসার বুদ্ধকে ধর্মগুরু হিসেবে মান্য করে প্রাসাদে নিয়ে যান। বুদ্ধ তাঁকে চতুরার্য সত্য সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করেন। এরপর বৌদ্ধ সংঘের সহস্রাধিক ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য বেণুবন নামক তাঁর প্রমোদ উদ্যানটি গৌতম বুদ্ধকে প্রদান করেন। পরে রাজা সেখানে একটি বিহার নির্মাণ করেন। এই বিহারটি বেণুবন বিহার নামে পরিচিতি পেয়েছিল। বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোবাস ব্রত পালনের বিধি প্রচলন করেন। কথিত আছে, বিম্বিসারের অনুরোধেই বুদ্ধ বর্ষাকালে পরিব্রাজন না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে সাধনার ‘বর্ষাবাস’ নামক রীতি প্রচলন করেন। ভিক্ষুদের বর্ষাবাসের সুবিধার জন্য কুটির নির্মাণ এবং বুদ্ধ ও ভিক্ষুদের চিকিৎসার জন্য রাজবৈদ্য জীবককে নিযুক্ত করেন। রাজার পত্নী পরবর্তীকালে ভিক্ষুণী সংঘে যোগদান করে অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

এরপর তিনি তাঁর পিতার অনুরোধে কপিলাবস্তুতে আসেন। এখানে এসে তিনি তাঁর পিতার শত অনুরোধেও প্রথমে গৃহে প্রবেশ করতে রাজি হলেন না। রাজবাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী গোপা পুত্র রাহুলকে ডেকে বললেন, “ওই তোমার পিতাকে ডেকে আনো।”

রাহুল নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরে যেতে বললেন। গৌতম সে আহ্বান অগ্রাহ্য করলেন। এরপর সকলের কাতর অনুরোধে ইনি বাড়িতে প্রবেশ করলেন, কিন্তু কোথাও দাঁড়ালেন না। রাজবাড়ি থেকে শেষবারের মতো বের হওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী বুদ্ধের সামনে তাঁর দীর্ঘ চুল বিছিয়ে অপেক্ষা করলেন। গৌতম বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সে চুল মাড়িয়ে রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। এই সময় ইনি তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই নন্দ এবং সাত বৎসরের পুত্র রাহুলকে দীক্ষিত করে রাজধানী ত্যাগ করলেন। এরপর ইনি তেরো বৎসর ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর ধর্মমত প্রচার করে বেড়ালেন। পিতার অসুস্থতার কথা শুনে ইনি কপিলাবস্তুতে আসেন এবং পিতার মৃত্যুকালে উপস্থিত হলেন। পিতার মৃত্যুর পর ইনি পুরনারীদের ভিক্ষু বানালেন। এই ভিক্ষুদলের নেত্রী বানালেন তাঁর স্ত্রী গোপাকে। এরপর ইনি তাঁর ধর্মমত প্রচারের জন্য আবার পথে বেরিয়ে পড়েন। আশি বছর বয়সে নেপালের কুশীনগরে ইনি দেহত্যাগ করেন। কথিত আছে, তাঁর জন্ম, বোধিত্ব লাভ ও মৃত্যু একই তারিখ ও সময়ে হয়েছিল।

বুদ্ধ বেণুবনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ উদযাপন করেন। শেষ বছরে সারিপুত্র ও মৌদগল্যায়ন বুদ্ধের শিষ্য হন। এই সময় রাজবৈদ্য জীবক তাঁর আম্রকাননে বুদ্ধ সংঘের জন্য একটি বিহার নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে এই বিহারটি ‘জীবকাম্রবন’ নামে পরিচিত।

জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s