উপন্যাস-তৃণার স্বপ্নপৃথিবী-মল্লিকা ধর শীত ২০২১

uponyastrinatitle

“তৃণা, তৃণা-আ, তৃণা-আ-আ, কোথায় তুমি?”

ব্যালকনিতে দাঁড়ানো তৃণা ভেতর থেকে মায়ের গলা পেয়েই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আস্তে করে সাড়া দেয়, “আসছি মা, আসছি।”

ভেতরে মা ওর মৃদু গলার সাড়া শুনতে পেয়েছেন বলে মনে হয় না, কারণ তৃণা শুনতে পায় মা বলে চলেছেন, “ওফ্, এই মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে জ্বালা। স্কুলের জন্য তৈরি হবার এই সময়টায় কোথায় যে গিয়ে বসে থাকে! তৃণা, টিফিন বক্সটা নিয়ে যাও এসে, মনে করে স্কুলের ব্যাগে ঢুকিও। তোমার দিদি কিন্তু স্কুলের জন্য তৈরি।”

তৃণা এবারে জোর গলায় উত্তর দেয়, “আমিও তৈরি মা। আসছি।” তারপরে ব্যালকনি থেকে চলে যেতে গিয়েও আবার পিছু ফিরে তাকায়। খুব নরম গলায় বলে, “আকাশ, যাই আজ। কাল আবার সকালে আসব।”

তারপরেই ব্যালকনির উপবৃত্তাকার দরজা ঠেলে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে যায় তৃণা।

তৃণা রোজ সকালে একবার করে এসে দাঁড়ায় এই আশ্চর্য ব্যালকনিটায়। খুব ছোটোবেলা থেকে। একেবারে পাঁচ বছর বয়স থেকে। রোজ সকালে বাইরেটা একবার করে না দেখলে ওর কেমন যেন খুব খালি খালি লাগে। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে, চুল আঁচড়ে ক্লিপ আটকে, স্কুল ইউনিফর্ম পরেই এই ব্যালকনিতে এসে না দাঁড়াতে পারলে সারাটা দিন কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে ওর।

স্বচ্ছ অর্ধগোলকাকার আবরণে পুরোটা ঢাকা এই ব্যালকনিটা। তবু তার মধ্য দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। বাইরেটায় দেখবার কী আছে? শুধু একটা ঝুল-কালো আকাশ আর কালচে একটা দিগন্ত। না সূর্য, না চাঁদ, না দুটো একটা পাখির ওড়াউড়ি, না একটা মধুর নীল আকাশ, সবুজ গাছের মাথা—কিচ্ছু না। সে-সব নাকি ছিল। অনেক আগে। কয়েকশো বছর আগে। তৃণা কোনোদিন দেখতে পায়নি, শুধু শুনেছে। শুনেছে আর ছবিতে, মুভিতে, হলোগ্রামে দেখেছে সেই পুরোনো দিনের পৃথিবীর ছবি।

কী আশ্চর্য সুন্দরই না ছিল তখন পৃথিবীটা! আহা, আবার কবে ফিরে আসবে সেই সুন্দর সবুজ পৃথিবী? এই সকালবেলাটায়, যখন এই ব্যালকনিটায় একা এসে দাঁড়ায় ও, তখন এইরকমভাবে তৃণা। কিন্তু কারও কাছে বলতে পারে না। মাকে না, দিদিকে না, অন্য কাউকে না। কেউ বোঝে না। কেউ বুঝবে না। ও জানে, ওর এইসব ভাবনার কথা জানলে সবাই ওকে অস্বাভাবিক ভাববে। তখন মা হয়তো নিয়ে যাবেন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তিনি তাঁর বহুরকমের প্রোব দিয়ে হয়তো ওর মগজ পরীক্ষা করবেন। তারপরে হয়তো ওষুধ দিয়ে সব ভুলিয়ে দেবেন, তৃণা তা চায় না। সে এই ভাবনা ভুলতে চায় না কিছুতেই।

এইরকম কাণ্ড হয়েছিল দিওতিমার সঙ্গে। দিওতিমা তৃণার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। এখন তারা ক্লাস সিক্সে। গতবছর যখন তারা ক্লাস ফাইভে, তখন হঠাৎ একদিন দিওতিমা অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্নের মধ্যে সমুদ্রের ধারে ফেনামাখা ভেজা বালির উপর দিয়ে দিওতিমা ছুটে যেতে দেখত একটা নীল ফ্রক পরা ছোট্টো মেয়েকে, সেই মেয়ের সঙ্গে একটা পোষা খরগোশ, ধবধবে সাদা রঙের। এই স্বপ্ন সে বারে বারে দেখত।

প্রতিদিন স্কুলে পাশাপাশি বসত তৃণা আর দিওতিমা। ক্লাসের মাঝে মাঝে যে ছোটো ব্রেক থাকত, তখন দিওতিমা তৃণাকে বলত ওর স্বপ্নের কথা। খুব ঘন ঘন ওই স্বপ্ন দেখত দিওতিমা। প্রত্যেকবারই যেন আর একটু বেশি চেনা যেত স্বপ্নের ওই মেয়েটাকে।

তৃণা খুব মন দিয়ে শুনত দিওতিমার কথা, মাঝে মাঝে প্রশ্ন করত। দিওতিমার মনে হয় খুব ভালো লাগত স্বপ্ন বলতে, সে প্রশ্নগুলো শুনে খুশি হত। যতটা মনে থাকত উত্তর দিত।

একদিন, তৃণার মনে আছে, সে জিজ্ঞেস করেছিল, “দিওতিমা, মেয়েটার যে নীল ফ্রক পরা দেখিস, ওকে কি খুব কাছ থেকে দেখতে পাস? কীরকম ওর চুলগুলো? কীরকম ওর চোখমুখ? ওর হাত? ওর পায়ে কি জুতো থাকে? নাকি খালি পা?”

দিওতিমা ভেবে ভেবে বলেছিল, “ওর চুল কালো, অল্প কোঁকড়ানো, কাঁধ পর্যন্ত চুল। মাথার একটু বাঁদিক ঘেঁষে সিঁথি, ডানদিকে একটা ছোট্টো ক্লিপ আটকানো, সেটা মাঝে মাঝেই ও খুলে হাতে নেয়, তখন চুলের গোছা কপালে এসে পড়ে আর ও হাসে। ওর চোখ বড়ো বড়ো সুন্দর চোখের মণি চকচকে কালো। ও হাসলে মনে হয় ওর চোখ দুটো হাসছে। ওর পায়ে… কী জানি জুতো আছে কি না দেখতে পাইনি, এর পরেরদিন দেখব।”

পরেরবার ওই স্বপ্ন দেখার পরেই দিওতিমা নিজে থেকেই বলেছিল, “তৃণা, মেয়েটার খালি পা, সমুদ্রের তীরের সাদা বালিতে মাখামাখি।”

তৃণার খুব অবাক লাগত দিওতিমার অমন স্পষ্ট স্বপ্নের কথা শুনে। মাঝে মাঝে মনে হত হয়তো ও কল্পনা করে করে বলে। কিন্তু তাও যদি হয়, তবু কেমন আশ্চর্য কল্পনা! তৃণা আর দিওতিমা দুজনেই সমুদ্রের কথা জানত কেবল বইতে পড়ে, ছবি দেখে আর মুভি দেখে। সত্যিকার সমুদ্র তো আর দেখার উপায় ছিল না ওদের।

সেই সমুদ্র অমন স্পষ্ট সুন্দর হয়ে ধরা দিত কী করে দিওতিমার কাছে? বন্ধুর কথা শুনতে শুনতে তৃণা নিজেও যেন দেখতে পেত নীল ফ্রক পরা একটা হাসিখুশি মেয়ে দৌড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের তীর ধরে, বাতাসে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়, আর শোনা যায় ঢেউগুলো বালিতে ভেঙে পড়ার শব্দ। মেয়েটা দৌড়ে যেতে যেতে ওদের দিকে ফিরে তাকায়, হাত নাড়ে আর সমুদ্রের হাওয়ার ঝাপটায় ওর চুলগুলো ওড়ে।

ক্রমে দিওতিমার স্বপ্নের মেয়েটি ওদের বন্ধু হয়ে উঠেছিল যেন। ঠিক যেন ওদের পাশাপাশি সেও থাকত, কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। ও যেন ছিল ওদের একটা লুকানো আনন্দ, একটা কেমন যেন পালিয়ে যাবার ঘর।

একদিন তৃণা ক্লাসে গিয়ে দিওতিমার পাশে বসতেই জ্বলজ্বলে হাসি নিয়ে দিওতিমা ফিসফিস করে বলেছিল, “জানিস তৃণা, আজকে মেয়েটার গলা শুনতে পেয়েছি। ও গান গাইছিল, সমুদ্রের শব্দ ছাপিয়ে সেই গান শুনতে পেয়েছি আমি।”

তৃণা উত্তেজনায় চোখ বড়ো বড়ো করে বলেছিল, “গান শুনেছিস! কী গান?”

দিওতিমার চোখ কেমন স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, “কী জানি কী গান, সেই গানের ভাষা আমার চেনা নয়। কিন্তু খুব সুরেলা ওর গলা। ও গান গাইতে গাইতে সমুদ্রতীর বরাবর হাঁটছিল, ওর পাশে পাশে চলছিল ওর পোষা সাদা খরগোশটা। এই লম্বা লম্বা কান দুটো, গলায় একটা গোলাপি নরম রিবন বাঁধা। হয়তো মেয়েটা নিজের রিবন ওর প্রিয় পোষা প্রাণীটার গলায় বেঁধে দিয়েছে আদর করে।”

আর একদিন, সেদিন ক্লাসে গিয়েই তৃণা দেখেছিল দিওতিমা খুব খুশি খুশি, কিছু বলবার জন্য যেন ছটফট করছে। তৃণা যখন গিয়ে পাশের জায়গায় বসল তক্ষুনি দিওতিমা ওর দিকে ফিরে বলল, “ওহ্‌ তৃণা, তোকে বলার জন্য যেন আর দেরি সইছে না আমার।” ঝলমল করছিল দিওতিমার চোখ।

তৃণা হেসেছিল। বলেছিল, “বল। তোর স্বপ্নটা তো? মেয়েটাকে আরও কাছ থেকে দেখেছিস?”

দিওতিমা বলেছিল, “হ্যাঁ। মেয়েটা আমার কাছে এসে আমাকে বলল ওর নাম রুবা। বলল কী জানিস? বলল, ‘আমার নাম রুবা। আমি জানি তুমি দিওতিমা। তুমি আমার বন্ধু হবে?’” গলাটা কেমন পালটে গিয়েছিল দিওতিমার ও যখন রুবার কথাগুলো কোট করছিল।

তৃণা খুব অবাক হয়ে বলল, “তোর সঙ্গে কথা বলল মানে? তোর স্বপ্নের ভিতরে সে তোকে কী করে দেখল?”

দিওতিমা হঠাৎ যেন থমকে গেল। ভাবলো একটু, তারপরে যেন নিজের মনেই বলল, “তাই তো!”

তারপরে আর একটু চুপ করে বসে রইল নীচের দিকে চেয়ে। তারপর চোখ তুলে বলল, “তৃণা, তাহলে কি এটা স্বপ্ন নয় পুরোপুরি? মেয়েটা… ওই রুবা… ও সত্যি করে কোথাও আছে?”

তৃণা আস্তে আস্তে বলেছিল, “থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। তাতে কী যায় আসে দিয়া? তুই ওকে দেখতে পাস স্বপ্নে, সে কথা বলে তোর সঙ্গে, সেটাই তো অনেক।”

দিওতিমা কিন্তু কেমন অভিমানী সুরে বলল, “সে আছে, সত্যি আছে কোথাও। আমি ওকে পরদিন জিজ্ঞেস করব সে কোথায় থাকে।”

সেদিন কথা আর এগোয়নি বিশেষ, ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বেজে উঠল তখনই। দিদিমণি এসে ক্লাসে ঢুকলেন; তৃণারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সুপ্রভাত জানাল। দিদিমণিও জানালেন।

তারপরে পরের পর ক্লাস, এমনকি টিফিনের সময়ও তৃণা আর দিওতিমা ওই স্বপ্নের কথা নিয়ে তোলাপড়া আর করতে পারেনি। এখন তৃণার মনে পড়ে দিওতিমা বেশ চুপচাপ ছিল সেইদিন টিফিনের সময়।

পরদিন দিওতিমা এল না ক্লাসে, তার পরদিনও এল না। তৃণা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল দিওতিমা ক্লিনিকে ভর্তি, হঠাৎ নাকি খুব জ্বর হয়েছিল ওর। ওই জ্বর থেকে সেরে উঠে দিওতিমা আবার যখন স্কুলে এল তখন তৃণাকে চুপিচুপি বলছিল সে রুবার সঙ্গে আশ্চর্য এক দেশে বেড়াচ্ছিল জ্বরের সময়। রোমাঞ্চকর সেই বেড়ানোর বর্ণনা শুনে তৃণারও চমৎকার লাগছিল।

সবই ভালো চলছিল, কিন্তু যেই না দিওতিমা ওর মাকে স্বপ্নের কথা বলেছে, অমনি ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে গেলেন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তিনি বহুরকমের প্রোব দিয়ে দিওতিমার মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে নানারকম ওষুধ দিয়ে আর থেরাপি চালিয়ে চিকিৎসা করলেন। চিকিৎসার পরে ওর ওই স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে গেল, স্মৃতিটুকুও রইল না রুবার বিষয়ে।

এখন দিওতিমা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। ক্লাসে আসে, পড়াশোনাও করে, কিন্তু আগে যে ওর মধ্যে একটা আনন্দিত ভাব ছিল, সেটা যেন আর নেই। ওর সেই জ্বলজ্বলে চোখ দুটো এখন কেমন যেন মেঘলা দেখায়। কিংবা কে জানে হয়তো সবই ঠিক আছে, তৃণারই কেবল ওরকম মনে হয়। বড়োরা ছোটোদের বুঝতে চান না কেন যে! কী ক্ষতি হত দিওতিমাকে ওর নিজের মতন থাকতে দিলে?

রুবার সঙ্গে বেড়ানোর গল্পগুলো মনে পড়ে যায় তৃণার, কী জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে দিওতিমা বলছিল সেই গল্প! যেন সত্যি সত্যি ঘুরেছে! দিওতিমা বলছিল, ওই জ্বরের সময় সে স্বপ্ন দেখত রুবা সমুদ্রতীরে দৌড়তে দৌড়তে সুরেলা গলায় ডাকছে, ‘দিওতিমা-আ-আ!’ দিওতিমা দৌড়ে যাচ্ছে রুবার দিকে, কিন্তু একটা বিরাট ঢেউ এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে; বালিতে জলে মাখামাখি হয়ে দিওতিমা ভাবছে রুবার কাছে পৌঁছে কী বলবে, এই ভিজে অবস্থা দেখলে কী জানি ভাববে রুবা। উঠে বসে সে দেখল আরেকটা বিরাট ঢেউ আসছে আছড়ে পড়তে। সে আর না উঠে বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল। ঢেউ ভেঙে পড়ল ওর উপর দিয়ে। তারপরে ফিরে যাচ্ছে ফেনামাখা জল। ও দেখল ভেজা বালির উপরে একটা সুন্দর ঝিনুক, উজ্জ্বল লাল লীল সবুজ রঙ ঝলকাচ্ছে সারা গায়ে। শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে সে তুলে নিল ওটা। এর পরেই সে দেখতে পেল উলটোদিক থেকে ছুটে আসছে রুবা, ওর মাথায় একটা রেশমি রুমাল তিনকোনা করে বাঁধা, রুমালটার হালকা নীল রঙের জমিনের উপরে লাল আর সবুজ ফুলের নকশা। দিওতিমার আবছা ছায়া ছায়া মনে পড়ে কোথায় যেন ওইরকম একটা রুমাল একদিন দেখেছিল ও। রুবা এসে দিওতিমাকে ধরে টেনে তুলল ভেজা বালি থেকে। তারপরে বলল, “ইস্‌, কী ভিজে গিয়েছ তুমি! চলো চলো, আমাদের বাড়ি চলো, সেখানে চুল্লির ধারে বসে সব শুকিয়ে নেবে।”

ওর সত্যিই ঠান্ডা লাগছিল, দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করছিল। রুবা ওর হাত ধরে দৌড়তে দৌড়তে ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ওর বাড়ির দিকে।

দিওতিমা দেখল ওরা দৌড়চ্ছে একটা চওড়া পাথরের রাস্তা দিয়ে, রাস্তার দু-পাশে লম্বা লম্বা সব গাছ। বইয়ে দেখছিল বলে সে চিনতে পারে যে ওগুলো ঝাউগাছ। সেইসব গাছে লাল রঙের পাখির ঝাঁক অপরূপ সুরেলা গলায় কত ডাক ডাকছে। সে থেমে যেতে চায়, শুনতে চায় আর একটু, কিন্তু রুবা ওকে টেনে নিয়ে চলে, বলে, “তাড়াতাড়ি চলো, নইলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।”

ওর খুব ঠান্ডা লাগছিল। সে ভাবল চুল্লির সামনে গরমে বসে ভেজা পোশাক শুকিয়ে নিতে কী ভালোই না লাগবে! ওরা ছুটতে লাগল রাস্তা দিয়ে।

কিছুক্ষণ দেখা গেল একটা বিরাট ফটক, মস্ত মস্ত চকচকে দুটো পাল্লার গেট, বন্ধ। রুবা গেটের একপাশে গিয়ে গেটের গায়ের একটা ছোট্টো চৌকো বাক্সের মতন জিনিসে কী যেন করতেই পাল্লা দুটো হালকা শব্দ করে খুলে গেল আর কোথা থেকে যেন গান ভেসে আসতে লাগল।

রুবা ওর হাত ধরে হেসে বলল, “এসো এসো, আমাদের বাড়িতে এসো। ভেতরে আছে আমার মা, বাবা, কাকু, দাদু, ঠাকুমা আর আমার ছোট্টো একটা ভাই। সবার সঙ্গে তোমার দেখা হবে। সব্বার আগে তোমায় নিয়ে যাব ফায়ার প্লেসের কাছে। চলো চলো।”

ফটক থেকে একটা সাদা পাথরের রাস্তা চলে গিয়েছে প্রাসাদোপম বাড়ির দিকে। সেইরকম বাড়ি দিওতিমা কেবল ছবির বইয়েই দেখেছিল। রাস্তার দু-পাশে সবুজ বাগান, ফুলের গাছ আর ফলের গাছে ভর্তি। রুবা এক থোকা আঙুর তুলে নিল পথের পাশের আঙুরলতা থেকে, তারপরে দিওতিমার হাত ধরে ওকে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতরে।

প্রথম যে ঘরটায় ওরা ঢুকল, সেই ঘরটার মেঝে জুড়ে গালিচা বিছানো, একপাশে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনের কাছে নিয়ে দিওতিমাকে বসিয়ে রুবা বলল, “তুমি বসো, আমি মাকে আর ঠাকুমাকে ডেকে আনি।”

এই পর্যন্ত বলে দিওতিমা থেমে গিয়েছিল। তৃণা সাগ্রহে প্রশ্ন করেছিল, “তারপরে? তারপরে কী হল দিয়া?”

দিওতিমা কেমন একটা ঝিলিক দেওয়া দুষ্টুমির হাসি হেসে বলেছিল, “তারপরে কী হল তা আগামীকাল বলবো। ওই দ্যাখ, দিদিমণি আসছেন।”

সত্যি সত্যিই তখন ওদের কেমিস্ট্রির টিচার মনোবীণাদি ক্লাসে ঢুকছিলেন। ক্লাস শুরু হয়ে গেল আর সেদিনের মতন দিওতিমার গল্প শেষ।

পরদিন দিওতিমা এল না স্কুলে, তার পরদিনও না। তার পরদিন স্কুলের পরে দিদিকে সঙ্গে নিয়ে দিওতিমাদের বাড়ি গেল তৃণা। সেখানে গিয়ে শুনল দিওতিমা বাড়ি নেই, সে কয়েক সপ্তাহের জন্য ভর্তি হয়েছে ক্লিনিকে। খুব উদ্বেগ ছিল তৃণার, কী হল আবার ওর? এই তো সেদিন অত ভুগে উঠল! কিন্তু দিওতিমার মা বললেন, তেমন কিছু হয়নি, এমনিতে ভালোই আছে, কিন্তু ডাক্তারবাবুর পরামর্শে কিছুদিন ক্লিনিকে থাকতে হবে।

দিওতিমা যেদিন ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরেছিল, তার পরদিন তৃণা গিয়েছিল ওকে দেখতে। ও চুপচাপ বসে বসে একটা গল্পের বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল অন্যমনস্কভাবে, বইটার পাতায় পাতায় মজার মজার ছবি ছিল। কিন্তু ও দেখছিল না, ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ও খুব অন্যমনস্ক।

তৃণা কাছে যেতে দিওতিমা মুখ তুলে হাসল। সেই হাসি দেখে তৃণার কেমন যেন বুকটা দমে গেল। ভারি শুকনো আর অনুজ্জ্বল হাসি। ওকে এমনিতেও শুকনো আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল, যেন আগের দিওতিমার জায়গায় ফিরে এসেছে একটা কাঠের মূর্তি। ওরা অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিল সেদিন, দিওতিমার মা ওদের খেতে দিয়ে নিজের কাজে অন্য ঘরে গেলেন। খেতে খেতে তৃণা স্কুলের কথা বলছিল, দিওতিমা শুনছিল।

তৃণা প্রতিটা মুহূর্তেই ভাবছিল, নিশ্চয়ই একসময়ে ও রুবার কথাটা তুলবে। সেই স্বপ্নের কথা তো পুরো শোনা হয়নি সেদিন ওর। আর এই ক’দিনে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু দেখেছে দিওতিমা। কিন্তু সে-সবের ধার দিয়েই গেল না ও। তৃণা আর থাকতে না পেরে শেষে জিজ্ঞেস করে বসল, “দিয়া, রুবাকে দেখেছিস স্বপ্নে আর?”

ও অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল তৃণার দিকে। সেই দৃষ্টি ভুলবে না তৃণা কোনোদিন। যেন কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া একটা রাস্তা। তৃণা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল যখন দিওতিমা বলল, “রুবা? কে সে?”

তৃণা বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেছিল রুবার কথা ওকে মনে করাতে, কিন্তু দিওতিমা কিছুই মনে করতে পারেনি। হতাশ ক্লান্ত গলায় কেবল বলেছে, “না, আমার কিছু মনে নেই।”

“তৃণা, তৃণা-আ, কোথায় গেলে?” আজও মায়ের ডাক ভিতর থেকে।

তৃণা সাড়া দেয়, “আসছি মা, আসছি।”

ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে এল তৃণা। আজকে সে পুরোপুরি তৈরি হয়নি এখনও স্কুলের জন্য। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গোছাতে হবে। দিদি নির্ঘাত এতক্ষণে তৈরি হয়ে গিয়েছে।

তৃণা চটপট ব্যাগ গোছাতে থাকে, ঢিলেঢালা ভাব দেখলে মা হয়তো রাগ করবে। এমনিতেই ওর ওই ব্যালকনিতে যাওয়া, অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণতা ইত্যাদি মায়ের বেশ অপছন্দের।

দিদি মায়ের মনের মতন। কল্পনা-টল্পনার ধার বিশেষ ধারে না, প্র্যাকটিকাল মেয়ে। মা মাঝে মাঝেই বলে, ‘তৃণা, বড়ো হচ্ছ, গুছিয়ে কাজ-টাজ করা শেখো। দিদিকে দেখেও তো একটু শিখে নিতে পারো। কেমন চটপট গুছিয়ে কাজ করে দিদি, দ্যাখো না?’

নেহাত স্কুলে তৃণার রেজাল্ট ভালো হয় বলে খানিকটা রক্ষা পায় সে। নইলে হয়তো আরও কত বকুনি শুনতে হত। মারধোর আজকাল বারণ হয়ে গিয়েছে, তাই। না-হলে হয়তো তাও জুটত তার।

যে উড়নযানে করে ওরা দু-বোনে স্কুলে যায়, তার ড্রাইভার একটি রোবট। নাম তার সুরথ। ফ্লাইং গাড়িটার কাছে ওরা এলেই সুরথ চালকের আসন থেকে নেমে দরজা খুলে ধরে দাঁড়ায় অল্প মাথা ঝুঁকিয়ে। তৃণা বা তৃষা ‘সুপ্রভাত সুরথ!’ বললেই সুরথ বলে, ‘সুপ্রভাত, মিস তৃণা বা সুপ্রভাত মিস তৃষা।’ ওইরকমই নাকি ওর প্রোগ্রামিং করা। সুরথ নাকি তৈরি হয়েছিল জাপানে। তারপরে রপ্তানি হয়ে গিয়েছিল ব্রাজিলে। তারপরে তৃণাদের দেশে আসে।

আজও উড়নযানে ওঠার সময় অন্যমনস্কভাবে সুরথের দিকে চেয়ে ছিল তৃণা। তারপরে ওর মনে পড়ল, আগের রাতে ঘুমের ভিতরে দিওতিমার সেই স্বপ্নটা কেমন করে যেন এসেছে ওর কাছে। ঠিক যেখানে দিওতিমা শেষ করেছিল স্বপ্নের গল্প, সেইখান থেকেই শুরু তৃণার স্বপ্ন। আসলে হয়তো ওর উৎসুক কল্পনা আগেই ওই ঘটনাগুলোকে তৈরি করে রেখেছিল ভিতর-মনে,  ক্লান্ত অভিমানী ঘুমের মধ্যে ভেসে উঠেছিল সে-সব ওর উপর-মনে। স্বপ্ন দেখার পর ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নের যতটুকু মনে থেকেছে সব সাংকেতিক ভাষায় লিখেছে নিজের ডায়েরিতে। এই সাংকেতিক ভাষা সম্পূর্ণ তার নিজের উদ্ভাবন, আর কেউ ও-ভাষা জানার সম্ভাবনা নেই ও নিজে না শিখিয়ে দিলে। ও ভাবে, একদিন দিওতিমাকে এ-ভাষা শিখিয়ে দেবে। তারপরে ওকে ডায়েরিটা পড়তে দেবে। আসলে তো স্বপ্নটা দিওতিমার কাছ থেকেই পাওয়া, তাই ওই স্বপ্নের কথা ওর জানার অধিকার আছে অবশ্যই। কিন্তু সে ঘটনা পরে। আগে তৃণার সঙ্গে ওদের ক্লাসে গিয়ে আমরা দেখি সেখানে ওরা কী করে লেখাপড়া করে।

ওদের স্কুল একটা বিরাট উঁচু বাড়ির একেবারে সর্বোচ্চ তলায়। পুরো বাড়িটাই একটা বিরাট আবরণের ভিতরে। আবরণটা ডুডেকাহেড্রনের গড়নের। মানে অনেকগুলো সমান পঞ্চভুজ জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে সেই মজবুত আবরণ। কিন্তু সেগুলো স্বচ্ছ নয়। সেগুলোতে অনেক কিছু ডিসপ্লে করে দেখানো হয়।

তৃণা ক্লাসে গিয়ে বসল নিজের জায়গায়, পাশেই দিওতিমা। তৃণা গিয়ে সিটে বসলে দিওতিমা ম্লান একটু হাসল ওর দিকে চেয়ে, তারপরেই চোখ নামিয়ে চেয়ে রইল নিজের হাতের দিকে। তৃণার বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে উঠে, কেমন একটা রাগও হয় কে জানে কার উপরে। মনে হয় তার প্রিয় বন্ধুকে কে যেন চুরি করে নিয়ে গিয়ে তার জায়গায় রেখে গিয়েছে এক নকল দিওতিমাকে।

ক্লাসের উপরে যে বিরাট পঞ্চভুজটা, তাতে আজ দেখানো হচ্ছিল আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র। এমনিতে তো আর তাদের দেখা যায় না কয়েকশো বছর। কিন্তু এই বিশাল স্ক্রিনে তাদের প্রোজেকশন কী সুন্দর! তাদের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষিকা বিপাশাদি খুব সুন্দর করে সব বোঝাচ্ছিলেন।

তৃণার সবচেয়ে ভালো লাগে সপ্তর্ষিমণ্ডল। সাতটা ঝকঝকে তারা আকাশে কেমন জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে জেগে ওঠে, কী সুন্দর! প্রথম দুটো তারা যোগ করে উত্তরদিকে বাড়িয়ে দিলে গিয়ে পৌঁছায় ধ্রুব নক্ষত্রের কাছে। এই নক্ষত্র আকাশের একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। পৃথিবী আবর্তন করে বলে অন্যসব নক্ষত্রেরা উদয় হয়, পুব থেকে পশ্চিমে সরতে থাকে, একসময়ে অস্ত যায়। কিন্তু ধ্রুব নক্ষত্র নড়ে না। দিদিমণি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেন এমন হয়। পৃথিবীর অক্ষরেখা, যেটাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী আবর্তন করে, সেটা ওই ধ্রুব নক্ষত্রের দিকে তাক করা। তাই ধ্রুবতারা স্থির। ওই নক্ষত্র দেখেই উত্তরদিকটা স্থির করা হয়েছে।

সপ্তর্ষিমণ্ডল ছাড়া আরেকটা নক্ষত্রমণ্ডলও তৃণার খুব প্রিয়। কালপুরুষ। ওরায়ন। ঝলমলে তিনটে তারা দিয়ে তৈরি তার কোমরের বেল্ট আর তা থেকে ঝোলে তরবারি।

সপ্তর্ষিমণ্ডল বা কালপুরুষ নয়, বিপাশাদি এখন এখন অ্যান্ড্রোমেডা নক্ষত্রমণ্ডল দেখাচ্ছেন। এই নক্ষত্রমণ্ডলের ভেতর দিয়ে দেখা যায় একটা হালকা সাদা ছোপের মতন জিনিস। ওটা আসলে বিশাল এক গ্যালাক্সি, পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ তার দূরত্ব। মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিশীল জিনিস হল আলো, যা আসলে তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ। এই আলো আজ এখান থেকে রওনা হলে ওই প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে ছুটতে অ্যান্দ্রোমেডা গ্যালাক্সিতে গিয়ে পৌঁছবে পঁচিশ লক্ষ বছর পরে। এইবারে দিদিমণি অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সির আসল চেহারা দেখাচ্ছেন, স্পেস টেলিস্কোপে তোলা ছবি। অপূর্ব সুন্দর স্পাইরাল গ্যালাক্সি, দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যায়।

বিপাশাদির প্রেজেন্টেশন শেষ হয়ে গেলে সিলিংয়ের আলো মিলিয়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বলে উঠল। আলো কোমল, সুন্দর। দিনের আলোর অনুভূতি দেয় নাকি এই আলো। কী জানি কেমন ছিল দিনের আলো।

এবার দিদিমণি প্রশ্ন করছেন তৃণাদের। ওরাও প্রশ্ন করতে পারে, কিছু যদি না বুঝতে পারে। তাহলে দিদিমণি আবার ভালো করে বুঝিয়ে দেন।

পরের ক্লাস সৌরমণ্ডলের ভূগোল। প্রথমে পৃথিবীর ভূ-প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভূগোল। পরে অন্য গ্রহ-উপগ্রহের উপনিবেশগুলো নিয়ে বলছেন দিদিমণি। এইসব উপনিবেশগুলোতে এখন মানুষ থাকে, যদিও সংখ্যায় তারা মুষ্টিমেয়। পৃথিবীর জনসংখ্যাই তো মাত্র চল্লিশ লক্ষ এখন। তিনশো বছর আগের সেই ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আগে তখনকার পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল সাতশো কোটি। বিপর্যয়ের পরে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র দশ লক্ষে। এইসব মানুষেরা আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল মাটির নীচের মজবুত কুঠুরিগুলোতে। এইগুলো তৈরি করা হয়েছিল বিধ্বংসী পরমাণু বোমা বা অ্যান্টিম্যাটার বোমার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কিন্তু সে-সব বিপদ হয়নি, হল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বছরের পর বছর খরা চলল। পৃথিবীতে গরম প্রচণ্ড বেড়ে গেল। তারপরে উঠতে লাগল একের পর এক বড়ো বড়ো ঝড়-তুফান। সাইক্লোন, টাইফুন, হারিকেন। ধ্বংস হয়ে যেতে লাগল উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। একসময় দেখা দিল ধূসর-কালো মেঘ। সেই মেঘ থেকে নামল কালান্তক অ্যাসিড-বর্ষণ। সমস্ত গাছপালা নষ্ট হয়ে গেল। বনের পর বন জ্বলে গেল। সমস্ত শস্যক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেল। নদীর জল অম্লতিক্ত হয়ে গেল। মাছেরা ও অন্যান্য জলচর জীবেরা মরে গেল। রক্ষা পাওয়া মানুষেরা নিজেদের জন্য ফার্ম তৈরি করল আবরণের ভিতরে। এখানে গাছপালারা কৃত্রিম আলোয় সালোকসংশ্লেষ করে। সেই আলো জ্বলে নিউক্লিয় শক্তিতে। এখানে বৃষ্টি কৃত্রিম। জল ক্রমাগত রিসাইকল করা হয়। বাইরের নদীর জল সরাসরি আনা যায় না, তা অম্লে বিষাক্ত। সেই জলকে বেশ অনেকবার করে নানা শুদ্ধিকরণের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে তবে সেই জল ব্যবহার করা চলে। মাংসের জন্য যেসব পশু ও পাখি পালন করা হত, তাদেরও রাখা হয়ছিল ইনডোর ফার্মে। কিন্তু বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করা যায়নি। কে জানে কত লক্ষ রকম পশুপাখি লোপ পেয়েছে। বহু বছর ধরে জনসংখ্যা প্রায় একই জায়গায় থমকে ছিল। কমে যাবারই বরং আশঙ্কা ছিল। তারপরে এই গত পঞ্চাশ বছর ধরে জনসংখ্যা বেড়েছে কিছুটা। এখন পৃথিবীতে এটা চল্লিশ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। বিপর্যয়ের আগেই চাঁদে, মঙ্গলে ও অন্যান্য বাসোপযোগী উপগ্রহে মানুষের উপনিবেশ ছিল। কিন্তু পৃথিবীতে অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের পর সেগুলোরও আর তেমন সম্প্রসারণ হয়নি, কারণ সেগুলো ছিল বহুলাংশেই পৃথিবীর প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ-নির্ভর।

শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে তৃণার মনটা অতীতে হারিয়ে গিয়েছিল। অনসূয়াদি ভূগোল পড়ান ওদের। উনি চাঁদের উপনিবেশ কেপলারে লেসার তির তাক করে বলছেন, ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার, তৃণা পাশে তাকিয়ে দেখল বন্ধুদের মধ্যে অনেকে ঘুমোচ্ছে। এই ক্লাসটা অনেকের কাছেই বেশ বোরিং। অনেকে এই ক্লাসটায় বেশ একঘুম দিয়ে নেয়। পরে বাড়িতে পড়ে ম্যানেজ করে নেবে। কিশোর বয়সে মানুষ বর্তমানে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে বাঁচতে চায়, তাই বোধ হয় সেই দূর অতীতের ঘটনা আর দূর গ্রহ-উপগ্রহের ডিটেল এই কিশোর-কিশোরীদের ভালো লাগে না।

পরের ক্লাসটা বেশ এনজয়েবল। প্রচুর মুভি দেখানো হয়। আসলে এই ক্লাসটা মুভি তৈরি কীভাবে হয় সেই কৌশল শেখার। স্পেশাল এফেক্টগুলো দেখার সময় সব ছেলেমেয়েরা একেবারে উৎসাহে টগবগ করতে থাকে। কী করে সেগুলো করা হয় সেটাও সকলের কাছে দারুণ একটা আনন্দের শিক্ষা।

তৃণার বেশ মজা লাগে ভাবলেই যে কী দ্রুত এই পরিবর্তন। মাত্র কয়েক মিনিট আগেই প্রায় সবাই ঘুমে ঢুলে পড়ছিল, আর এখন এই অন্ধকারেও সবাই বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে আছে। এবারের শিক্ষক তরুণ-স্যার, তাঁর এক-একটা জিনিস বোঝানো শেষ হতে না হতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে এমন প্রশ্নের ঝড় যে ভদ্রলোক উত্তর দিতে দিতে জেরবার। কিন্তু খুবই ধৈর্যশীল তরুণ-স্যার, একেবারেই রেগে যান না। বরং খুব চমৎকার করে বুঝিয়ে বুঝিয়ে উত্তর দেন। এই স্যারকে ভালো লাগে তৃণার।

ক্লাস শেষ হলে এবার সবাই দল বেঁধে চলেছে ল্যাবে। সেখানে হাতেকলমে কাজ। আজকের ক্লাসে তৃণারা শিখবে কেমন করে লেসার রশ্মি দিয়ে ক্রিস্টালের গঠন পর্যবেক্ষণ করা যায়। তারপরে শিখবে কেমন করে ইউ-ভি লাইট পড়লে অণু ঘুরে যায়।

করিডরে দেখা হল বিষাণের সঙ্গে। বিষাণ তৃণার থেকে মাস ছয়েকের বড়ো। একই ক্লাসে পড়ে। যদিও সেকশন আলাদা। বিষাণের মুখ কেন কে জানে প্রায় সবসময় খুব বিষণ্ণ। ওকে খুব কম হাসতে দেখেছে তৃণা। ওরা থাকে তৃণাদের বিল্ডিং থেকে বেশ কয়েক ব্লক দূরের এক বিল্ডিংয়ে। বিষাণ, বিষাণের ছোটো ভাই রোশন আর ওদের মা-বাবা। ওদের সঙ্গে পরিচয় আছে তৃণাদের। দুই-একমাস পরপর হয় তৃণারা যায় বিষাণদের ওখানে, নয়তো বিষাণরা সবাই আসে তৃণাদের ফ্ল্যাটে। তৃণার তো বিষাণদের বেশ সুখী পরিবার বলেই মনে হয়। কিন্তু ছেলেটার মুখ এমন গোমড়া কেন সর্বদা?

বিষাণের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটু হেসে ও বলল, “কী রে, কেমন আছিস?”

বিষাণ অন্যমনস্ক ছিল। চমকে মুখ তুলে বলল, “আরে, তৃণা! তুই কেমন? আমি তো ভালোই আছি।”

তৃণা জোরে হেসে ফেলল এবার। “ভালো তো মুখটা এমন তুম্বো কেন তোর?”

বিষাণ বিষণ্ণ একটা হাসি হেসে বলল, “আমার এরকমই। তোর ক্লাস কেমন হল?”

“ভালো। আচ্ছা বিষাণ, তোকে কি কেউ বকেছে নাকি রে?”

“না-নাহ্‌। এখন তো বকা-টকা বেআইনি রে।”

“বেআইনি তা জানি। কিন্তু ঘরের ভিতরে কে কী করছে তা তো আর কেউ দেখতে যায় না সবসময়! আমার কী মনে হয় জানিস? তোর মা-বাবা তোকে খুব মারেন আর ভীষণ বকেন।”

“কীসব বলছিস? না না, মিথ্যে কেন বলব বল? ওঁরা সাদাসিধে ভালো মানুষ, কিছু করেন না আমায়। এমনিই আমার ভালো লাগে না। আমি ওঁদের সঙ্গে বেশি কথাও বলি না।”

“কিন্তু তোর কেন ভালো লাগে না রে? কী হয়েছে তোর?” তৃণার গলায় সত্যি সত্যি সমবেদনার সুর।

বিষাণ অন্যদিকে তাকিয়ে উদাস সুরে বলে, “তেমন কিছু নয়। কেন জানি রাত্তিরে আমি উদ্ভট উদ্ভট স্বপ্ন দেখি। একদম অচেনা সব স্বপ্ন। অচেনা সব মানুষেরা, অচেনা সবকিছু। ওদের ভাষা এত আলাদা, তবু কেন যেন আমার মনে হয় ওরা যা বলছে তা আমি বুঝতে পারি। ঘুম ভেঙে আমার মনখারাপ হয়ে যায়।”

তৃণা কৌতূহলী হয়ে বলে, “কতদিন থেকে এরকম হচ্ছে তোর?”

“ছোটোবেলা থেকে। আমার মনেও নেই কবে প্রথম ওদের দেখা শুরু করেছিলাম। তুই কাউকে বলিস না কিন্তু তৃণা। তাহলে আমাকে ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যাবে মা-বাবা। বলবি না তো?”

তৃণা হাসে। প্রতিশ্রুতি দেয়, “না, কাউকে বলব না।”

ওর নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়ানোর কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ছিল সেই সময়ের ভাবনাগুলোর কথা। সে-কথাও তো ও কাউকে বলতে পারে না। ওর নিজের স্বপ্নগুলোর কথাও তো কোনোদিন কাউকে সে বলতে পারবে না।

তৃণা বিষাণকে বলে, “ঠিক আছে, এটা আমাদের সিক্রেট। আমারও এরকম একটা সিক্রেট আছে। কিন্তু তার জন্য তো আমি মুখ গোমড়া করে থাকি না!”

বিষাণের চোখে এই প্রথম কৌতূহলের একটা ঝিলিক জ্বলে ওঠে। ও জিজ্ঞাসা করে, “কী সিক্রেট রে? তুইও স্বপ্ন দেখিস? কীরকম স্বপ্ন? পাহাড়, বন, ঝরনা, নদীর স্বপ্ন? ময়ূরের স্বপ্ন? খুব সুন্দর দেখতে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ের স্বপ্ন? হলদে লাল-নীল-বেগুনি ফুলের স্বপ্ন? আমার মতন?” স্বভাবত মুখচোরা বিষাণ আজকে যেন প্রগলভ হয়ে গেছে।

তৃণা দূরের দিকে তাকিয়ে বলে, “তা একরকম স্বপ্নই বলতে পারিস। তবে রাতে ঘুমিয়ে নয়, জেগে জেগে। সক্কালে উঠে পুবের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, বিষাণ।” তৃণার মুখে একটা বিষাদের ছায়া ভেসে আসে।

বিষাণ কী বুঝল কে জানে, তাকিয়ে রইল তৃণার মুখের দিকে। তারপরে খুব আস্তে নরম গলায় বলল, “তৃণা, তোর বাবা কবে আসবেন রে?”

তৃণার বাবা বিজ্ঞানী। তিনি সারাবছরই পৃথিবীর ও অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজে ব্যস্ত থাকেন। তৃণা দূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে বিষাণের চোখে চোখ রাখে। বলে, “বাবা এ-বছর আসতে পারবেন না। খুব নাকি ব্যস্ত।”

বিষাণ এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলে, “তাই তোর মনখারাপ?”

তৃণা হেসে আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “বা রে, বেশ মজা তো! মনখারাপ বুঝি আমার আর তুম্বো মুখ করে ঘুরছিস তুই? না রে, বাবার জন্য মনকেমন করলেও আমি জানি বাবা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। আমার স্বপ্নটাকেই তো বাস্তব করবেন ওঁরা। পরিবেশ শুদ্ধ করে সেই আগের সুন্দর পৃথিবীটাকে ফিরিয়ে আনবেন। এর জন্য দু-তিন বছর বাড়িতে না আসতে পারা তো কিছুই নয়।” তারপরে কী মনে পড়েছে এইরকমভাবে বিষাণকে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, “তুই তোর স্বপ্নের কথা কী বলছিলি যেন? ময়ূর, লাল-নীল-হলদে-বেগুনি ফুল আর খুব সুন্দর দেখতে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে?”

বিষাণ আস্তে করে বলে, “হ্যাঁ, তাই তো দেখি প্রায়ই। স্বপ্নের মধ্যে ওদের সঙ্গে খেলি।”

তৃণা দুষ্টুমি করে বলে, “তুই স্বপ্নের মধ্যে ভবিষ্যৎ দেখতে পাস, তা জানিস? ওইসব বাচ্চারা সব ভবিষ্যতের ছেলেমেয়ে।”

বিষাণের চোখমুখ কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। আস্তে আস্তে ফিসফিস করে সে বলল, “ভবিষ্যৎ? আমাদের ভবিষ্যৎ ওরকম সুন্দর হবে?” তারপরে স্বপ্নের মধ্যে কথা বলার মতন কীসব বলতে বলতে নিজের ক্লাসের দিকে চলল তৃণার কাছে বিদায় নিয়ে। তৃণা নিজের ভাবনা ভাবতে ভাবতে ল্যাবের দিকে চলল।

ল্যাবের মধ্যে লাল আলো জ্বলছে শুধু। এখন রেবতীদি এক্সপেরিমেন্টের জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক করছেন, এক্সপেরিমেন্টের সময় ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করে দেওয়া হবে। ল্যাবে ছাত্রছাত্রীরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখন, রেবতী-দিদিমণি লেসার রশ্মির সোর্সগুলো একের পর এক সাবধানে অ্যালাইন করছেন, সব রেডি হলেই সবাইকে ডাকবেন। তখন সবাই সেফটি চশমা পরে অপটিক্যাল বেঞ্চ ঘিরে দাঁড়াবে।

তৃণা এদিক ওদিকে তাকিয়ে দিওতিমাকে খুঁজল। ডানদিকে তাভাম, তুরিন, সোমক, চিন্তনদের একটা ছোটো দল নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। এই ছেলেরা একটা ক্লোজ গ্রুপ, খেলাধুলায় উৎসাহী। এরা সবসময় ইনডোর গেমগুলো নিয়ে কথা বলে। অন্যদিকে টিয়া, হাসি, শিবানী, রুকসানা—এই মেয়েদের দলটা কী জানি বলতে বলতে হাসছে। ওরাও ক্লোজ গ্রুপ, ওরা একসঙ্গে ব্যালে শেখে।

তৃণা দেখতে দেখতে হঠাৎ অবাক হয়ে ভাবল লাল আলোয় সবার মুখ কেমন অন্যরকম লাগছে। আগেও তো এই ল্যাবে এইরকম আলোর মধ্যে এদের দেখেছে, তখন এভাবে কোনোদিন লক্ষ করেনি তো!

দিদিমণি অপটিক্যাল টেবলের উপরে ঝুঁকে পড়ে সেট করছেন ডিভাইসগুলো। ছাত্রছাত্রীরা সব নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। তৃণার চোখ পড়ল দিওতিমার উপরে, সকলের থেকে আলাদা হয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দিওতিমা। তৃণার মনে হল সে যেন এই অদ্ভুত লাল আলোতেও ওর মুখের হতাশা আর ক্লান্তি দেখতে পাচ্ছে। গুটি গুটি সে এগিয়ে যায় দিওতিমার দিকে। ওর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “কী রে দিয়া, তুই এভাবে দাঁড়িয়ে? শরীর ভালো নেই?”

দিওতিমার চোখে এতক্ষণ এমন একটা দৃষ্টি ছিল। যখন মানুষ চোখ খুলে রাখে কিন্তু সামনের কিছু দেখে না, তেমন। এইবারে তৃণার গলা শুনে ওর দিকে তাকাল স্বাভাবিক দৃষ্টিতে। হেসে বলল, “শরীর ভালো আছে। একটু ক্লান্ত। তুই আমার জন্য এত চিন্তা করিস কেন?”

তৃণা বলে, “না না, চিন্তা কেন করব? একলা হয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস দেখে… আচ্ছা দিয়া, তোর অসুখটার পরে তোকে কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হয়েছিল না? তখন তুই কী করতিস?”

দিওতিমা বলে, “কী করতাম? এই খেতাম-দেতাম, গল্পের বই পড়তাম, মুভি দেখতাম ঘুমোতাম, এইসব। কিছু স্পেশাল এক্সারসাইজ করতে হত ডাক্তার যেমন বলে দিয়েছিলেন, সে শুধু সন্ধেবেলা। তার জন্য ট্রেনার আসতেন সপ্তাহে চারদিন। এইসবই। কেন রে জিজ্ঞেস করছিস?”

তৃণা হাসে। বলে, “এমনি। আগের চেয়ে তোকে ক্লান্ত মনে হয় সবসময়, তাই ভাবলাম হয়তো তোর আরও বিশ্রাম লাগত স্কুলে আসা শুরু করার আগে।”

দিওতিমা বলে, “আমার মা-বাবা আরও কিছুদিন বিশ্রামে রাখতে চেয়েছিলেন আমায়, কিন্তু আমার নিজের আর ভালো লাগছিল না ওভাবে। ক্লাসে আসতে ইচ্ছে করত, তোদের সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করত। আবার মনে হচ্ছিল পড়াশোনাতেও হয়তো ঘাটতি পড়ে যাবে বেশিদিন বিশ্রামে থাকলে। তাই আমিই জোর করেছিলাম স্কুলে ফেরার জন্য। ডাক্তার-আঙ্কলকে খুব মিনতি করেছিলাম, উনি ভালো করে চেক-আপ করে বললেন সব ঠিক আছে, আমি স্কুলে ফিরতে পারি।” কথা শেষ করে হাসে দিওতিমা। লাল আলোতে সেই হাসিটাকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে তৃণার।

তৃণা ভাবে, সব ঠিক আছে? তাই? জোর করে একটা সুন্দর স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে তারপরে ওকে বলে দিল সব ঠিক আছে?

আর দিওতিমা? হৃত-স্বপ্ন দিওতিমা ফিরে এল যেন আগের দিওতিমার ত্রিমাত্রিক ছবি। স্বপ্ন হারানো এক মানুষ, স্বপ্নের স্মৃতিটুকুও ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে যার।

ফিসফিস করে তৃণা বলে, “দিওতিমা, রুবা বলে কারও কথা মনে পড়ে তোর?”

দিওতিমা চুপ করে থাকে। আস্তে আস্তে ব্যথার একটা চিহ্ন ফুটে ওঠে ওর মুখে। বলে, “নাহ্‌, মনে পড়ে না। শুধু মাঝে মাঝে… মাঝে মাঝে… স্মৃতির মধ্যে… যেন একটা ফাঁকা… যেন একটুকরো জায়গা ঢাকা দেওয়া…” বলতে বলতে জলে ডুবে যেতে থাকা মানুষের মতন দিশেহারা হয়ে থেমে যায় দিওতিমা। তারপরে কান্নাভেজা গলায় বলে, “আমার এ কী হল তৃণা?”

তৃণা ওর হাতে হালকা চাপ দিয়ে সাহস আর সমর্থন জোগায়। বলে, “তুই ভয় পাস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

এক্সপেরিমেন্টের সেট-আপ হয়ে গিয়েছিল দিদিমণির। তিনি এবারে নিজে সেফটি চশমা পরে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সবাইকে পরে নিতে বললেন। সবাই কোনার চশমা-বাক্স থেকে এক এক করে নিয়ে চশমা পরছে আর এক এক করে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে অপটিক্যাল বেঞ্চের পাশে।

তৃণা আর দিওতিমা পাশাপাশি দাঁড়ায় গিয়ে। রেবতীদি লেজার সোর্স সুইচ অন করার আগে জোর গলায় একবার বলে নিলেন যে এইবারে অন করছেন, তারপরেই একই সঙ্গে ঘরের লাল আলো নিভল আর শক্তিশালী লেসার রশ্মির উজ্জ্বল সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

এই এক্সপেরিমেন্টের কিছু অংশ আগেও করেছে তৃণারা, তাই জানে এটা দীর্ঘক্ষণের কাজ। পাঁচটা গ্রুপে ভাগ হয়ে গিয়ে সবাই কাজ শুরু করে দিল।

এই ল্যাবেই ঘণ্টা খানেক কাজ করার পরে অসুস্থ হয়ে পড়ল দিওতিমা, একেবারে হঠাৎ। চিৎকার করে উঠে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল মেঝেতে। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, “আহ্‌, আহ্‌, আর পারছি না। ক-ক্ক-কষ্ট, খুব কষ্ট।” এইটুকু বলেই মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল অজ্ঞান হয়ে।

তৃণা হতভম্বের মতন হয়ে গিয়েছিল। অচেতন দিওতিমার পাশে মেঝেতে বসে ছিল নির্বাক হয়ে। রেবতীদি ছুটে এলেন। দিওতিমার কপালে হাত রেখে শিউরে উঠে বললেন, “ইস্‌, জ্বরে গা একেবারে পুড়ে যাছে যে!” তারপর ফোন করলেন এমার্জেন্সি সার্ভিসে। প্যারামেডিক টিম এসে পড়ল ক’মিনিটের মধ্যে। ওরা দিওতিমাকে স্ট্রেচারে করে ক্লিনিকে নিয়ে গেল।

ল্যাবে তখন ছত্রভঙ্গ অবস্থা প্রায়। রেবতীদি দ্রুত লেজার অফ করে ঘরের স্বাভাবিক আলো আগেই জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন; সবাই সেফটি চশমা খুলে ফেলেছিল।

প্যারামেডিক টিম দিওতিমাকে নিয়ে যাবার পর দিদিমণি আধঘণ্টার জন্য ছুটি দিলেন সবাইকে। বলে দিলেন, আধঘণ্টা পরে আবার ল্যাবের কাজ শুরু হবে, তখন সবাই ঠিকঠাক যেন ফেরে।

প্রায় সবাই ডাইনিং হলে চলে গেল। তৃণা ততক্ষণে আকস্মিক আঘাত খানিকটা সামলে নিয়েছিল। সেও আস্তে আস্তে চলল ডাইনিং হলের দিকে। কিন্তু ডাইনিং হলে গিয়ে ব্যাগ থেকে টিফিন-বাক্স বের করে খেতে আর ইচ্ছে করছিল না। মা আজ টিফিনে ডিম-পাঁউরুটি দিয়েছিলেন, কিছুতেই মুখে তুলতে পারছিল না তৃণা। টিফিন বক্স সামনে নিয়ে চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে ছিল। একসময় চমক ভাঙল তাভামের গলা পেয়ে, “কী রে তৃণা, তুই ঠিক আছিস তো? এমনি করে বসে আছিস যে? ল্যাবে যাবি না? সময় হয়ে গেল যে!”

তৃণা চোখ মেলে ক্লান্তভাবে হাসল। বলল, “সময় হয়ে গেল, না? হ্যাঁ চল, ল্যাবে যাই। এখনও তো এক্সপেরিমেন্টের অর্ধেকই বাকি।” টিফিন বক্স বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে ও উঠে দাঁড়াল। তাভামকে তৃণা বুঝতে দিতে চায়নি যে সে কতটা বিচলিত। তাই সতর্ক হয়ে হাঁটছিল ল্যাবে ফেরার সময়।

তাভাম কিন্তু একটা আশ্চর্য কথা বলল। ‘‘ক্লাস, ল্যাব, অন্য কাজ সবই চলতে থাকে, কারও জন্য আটকায় না। শুধু যে অন্যরকম, সে হারিয়ে যায়। আমার একটা ছোট্টো ভাই ছিল, জানিস তৃণা? আমরা একসঙ্গে খেলতাম। একটা দুটো কথা বলতে পারত ভাইটা। ও বেশ দুর্বল ছিল, নানারকম অসুখে ভুগত খুব। তারপর একদিন আর ওকে দেখতে পেলাম না। অন্য সবাই রইল, সব কাজই চলতে থাকল, শুধু ও হারিয়ে গেল।”

তৃণা অবাক হয়ে শুনছিল। তাভামের গলার স্বরে এত দুঃখের ছাপ ছিল যে ও কী করবে ভেবে পেল না। একসময় নীরবে নিজের হাতটা রাখল ওর হাতের উপর। আস্তে আস্তে বলল, “কবে? কবে মারা গেল তোর ভাই?”

তাভাম মাথা নাড়ে। বলে, “মারা যায়নি। ওকে বাবা-মা স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। ডাক্তাররা ভাইকে পরীক্ষা করে নাকি সেইরকম নির্দেশই দিয়েছেন। ওই স্পেশাল স্কুলে পড়তে গেলে ওখানে থাকতে হয়। আবাসিক স্কুল। সেই যে গেল ভাই, আর কোনোদিন বাড়ি আসেনি। নিয়ম নেই। তিন বছর হয়ে গেল।”

তৃণা শুনতে শুনতে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। মনের চোখে ও দেখতে পাচ্ছিল একটা মস্ত বড়ো ঘর, সেই ঘরে ছোটো ছোটো অনেক বাচ্চা। তাদের চোখে জল, কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কেউ চুপ করে বসে আছে। কেউ তারা বাড়ি ফিরতে পারবে না।

ওর নিজের দু-চোখও ভরে উঠল জলে। তাভাম তা দেখে তো রীতি মতন অপ্রস্তুত। বলে, “তৃণা, কাঁদছিস? দ্যাখ তো কী করলাম, তোকে মিছিমিছি দুঃখ দিলাম। হয়তো ওরা ভালো আছে, হয়তো সত্যি ভালো করে পড়াশোনা খেলাধুলো সব শিখছে, একদিন সুস্থ সবল উজ্জ্বল হয়ে ফিরবে ঘরে। এরকম হতে পারে না? তুই বল?”

তৃণা চোখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, “তাই যেন হয়।”

ল্যাবে ফিরে ওরা আবার কাজ করছিল স্বাভাবিক ছন্দে। রেবতীদি সুপারভাইজ করছিলেন যেমন সবসময় করে থাকেন। সবই আগের মতন, শুধু দিওতিমার অনুপস্থিতি ছাড়া।

শুরুর দিকে এক্সপেরিমেন্টের কাজগুলো করতে করতে বারে বারেই তৃণার মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল দিওতিমার সেই অচেতন মুখ, ল্যাবের লাল আলোয় কী অদ্ভুত দেখাচ্ছিল! মনে পড়ছিল অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে ওর সেই চিৎকার। কী হল হঠাৎ ওর? অন্য ক্লাসগুলোতে তো সব ঠিক ছিল! ভাবতে ভাবতে কাজে ভুল হয়ে গেল একটা, অমনি রেবতীদির বকুনি। শুনেই সতর্ক হয়ে গেল তৃণা, ল্যাবের মধ্যে ভাবুক হয়ে পড়া কাজের কথা নয়। অসাবধানে কাজ করলে যে-কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সে ভাবনা-চিন্তা দূর করে সাবধানে কাজ করতে লাগল।

স্কুল থেকে ফিরে সামান্য খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে দিদি তৃষা চলে গেল ব্যালে নাচের ক্লাসে। তাকে নিয়ে গেল তার বন্ধু চিনুক নিজের উড়নযানে করে। তৃষা আর চিনুক একই সঙ্গে ব্যালে শেখে।

তৃণা ব্যালে শেখে না, সে বাড়িতেই যোগাসন করে ওই সময়টা। যোগাসন শেষ করে ম্যাট্রেসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তৃণা। আর স্বপ্ন দেখছিল। রুবার স্বপ্ন নয়, অন্য একটা স্বপ্ন। সে দেখছিল একটা বিরাট উড়নযানে চড়ে সে, দিদি, মা, দিওতিমা, দিওতিমার বাবা-মা, চিনুক, বিষাণ, বিষাণের মা বাবা ভাই—সবাই কোথায় চলেছে উড়ে। যানটা চালাচ্ছে হাসিমুখ সুরথ। সে আর ধাতব রোবট নেই, মানুষের মতন দেখতে হয়ে গেছে। আকাশ নীল, দূরে হালকা সাদা মেঘ শুধু। উড়নযানটা এরকম সবঢাকা দেওয়া নয়, উপরটা খোলা। হাওয়া এসে তৃণার লম্বা চুলগুলোকে ওড়াচ্ছে, সে মাথা তুলে হাওয়ার স্পর্শ নিচ্ছে। নীচে দেখা যাচ্ছে ছবির মতন সুন্দর, সবুজ, প্রাণময়ী পৃথিবী। দূরে একটা পাহাড়ে একটা সাদা রঙের বাড়ি, তার চারপাশ ঘিরে অপরূপ বাগান। সেখানে ঠিক বিষাণের স্বপ্নের মতন ময়ূরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাগানে দোলনায় কারা যেন দুলছে আর অনেকে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করছে। স্বপ্নের মধ্যেই তৃণার মনে হচ্ছিল, ওই বাড়িটার থেকে বাবা বেরিয়ে এসে হাত নাড়বেন আর সুরথ ওই বাগানে উড়নযানটা নামাবে। হঠাৎ কীসের যেন একটা ছায়া পড়ে ওদের উড়নযানের উপরে। অবাক হয়ে উপরদিকে তাকিয়েই ভয়ে, বিস্ময়ে যেন কাঠ হয়ে যায় তৃণা।

তারপরেই স্বপ্নটা ভেঙে যায় ওর। চোখ মেলে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে উপরে তাকিয়ে কী দেখেছিল সে? খুব ভয় পেয়েছিল সেটা মনে আছে, কিন্তু কী দেখে ভয় পেল সেটা মনে নেই। কিংবা কে জানে হয়তো সেই অংশটা দেখতেই পায়নি, তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল।

উঠে নিজের ঘরে গিয়ে বালিশের তলা থেকে ডায়েরিটা বার করে তৃণা। কিন্তু লিখতে গিয়ে থেমে যায়। আজ রুবাকে সে তো দেখতে পায়নি স্বপ্নে! যা আজ দেখেছে তা কি লেখা উচিত? একটু ভেবে সে ডায়েরির শেষের দিকের পৃষ্ঠায় চলে যায়। নিজস্ব সাংকেতিক ভাষায় লিখতে থাকে রাতের স্বপ্নটা। লেখা হয়ে গেলে আরেকটা পাতা খোলে, সেখানে সাংকেতিক ভাষাতেই লেখে – দিওতিমাকে দেখতে যেতে হবে কাল। ও এখন কোথায়?

তারপর আনমনে হিজিবিজি কাটতে থাকে ডায়েরির পাতায়। বুঝতেও পারে না হিজিবিজির মধ্য থেকে একটা অদ্ভুত ছবি ফুটে উঠছে, একটা কালো পাথরের দেওয়াল আর সেই দেওয়ালের অনেক উপরে একটা ছোট্টো বন্ধ জানালা। সেই জানালার থেকে গড়িয়ে নামছে জল, অম্লবৃষ্টির জল। যেন একটা অন্ধ চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। সেই ছবির পরে পাতার একেবারে শেষদিকে নিজের অজান্তেই লেখে, ‘তাভামের ভাই আর সেই ভাইয়ের মতন আরও অনেক অনেক ছেলেমেয়ে, ওরা কোথায় যায়? ওরা কি ভালো হয়ে ফিরে আসে? নাকি ফেরে না কোনোদিন?’

ঘোর ভেঙে বাস্তবে ফিরে তৃণা নিজের আঁকা ছবি আর লেখার দিকে চেয়ে থাকে। এ-ছবি সে আঁকল? এ-লেখা সে লিখল? কখন? কীভাবে?

দিওতিমা নিজেদের ফ্ল্যাটেই ছিল। ক্লিনিকে চিকিৎসার পর ওকে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।

স্কুলে পৌঁছেই তৃণা রেবতীদির কাছে গিয়েছিল দিওতিমার খোঁজ নিতে। ওঁর কাছেই সব জানতে পারল। তারপর ও স্কুল থেকেই ওর মাকে ফোন করেছিল স্কুল ছুটির পর দিওতিমাকে দেখতে যাবার অনুমতি চেয়ে। মা সহজে অনুমতি দেবেন বলে ওর মনে হয়নি, কিন্তু ও কাকুতিমিনতি করতে প্রস্তুত ছিল মনে মনে। তাই খুব অবাক হয়ে গেল যখন মা বললেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই যাবে। আমিও তোমার সঙ্গে যাব। আমার অফিস আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হবে। তুমি স্কুল থেকে ফিরে পোশাক পালটে হাতমুখ ধুয়ে খেয়েদেয়ে তৈরি থাকবে কিন্তু। আমি ফিরে একটু রেস্ট নিয়েই তোমাকে সঙ্গে নিয়ে দিওতিমাদের ওখানে যাব।”

সুরথ তৃণাকে আর ওর দিদিকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পরই দিদি চলে গেল ব্যালে ক্লাসে। তৃণা পোশাক পালটে হাতমুখ ধুয়ে খাবার গরম করে নিল। খেতে খেতে গল্পের বই পড়ছিল আর অপেক্ষা করছিল মায়ের অফিস থেকে ফেরার। খাওয়া হয়ে গেল একসময়। গল্পের বইটা ছোট্টো ছিল, সেও পড়া শেষ। আরেকটা বই টেনে নিল তৃণা।

মা এসে পড়লেন একসময়। বললেন, “ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে আসি, তারপরেই বেরোব। তুমি ফিরে এসে ঠিক মতন খেয়েছ তো?”

তৃণা মাথা হেলিয়ে শুধু জানায় সে খেয়েছে। তারপরে কী মনে হতে বলে, “খাবার গরম করেছিলাম, হট বক্সে কিছুটা আছে এখনও। তুমি খেয়ে নিতে পারো যদি ইচ্ছে হয়। একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও, না-হয় একটু পরেই যাব আমরা। সময় তো আছে অনেক।”

মা তৃণার দিকে চেয়ে এমন একটা সুন্দর হাসি হাসলেন যা আগে কখনও নিজের জন্য দেখতে পায়নি ও। আগে এমন সুন্দর হাসি মা শুধু হাসতেন দিদির দিকে চেয়ে। ওই হাসি দেখে ওর ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখতে। কিন্তু পারল না। সংকোচ যেন দড়ি হয়ে পেঁচিয়ে রাখল।

মা চলে গেলেন ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে আসতে। আর তৃণা নিঃশব্দে নিজের মনে নিজেকেই বলতে লাগল, ‘একদিন ঠিক পারব, ঠিক পারব।’

কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে ওঠে, ‘হুঁ, পারবেই তো, অবশ্যই পারবে।’

কে? চমকে ওঠে তৃণা। এ-পাশে ও-পাশে তাকায়। কেউ নেই। সবই মনের ভুল?

দিওতিমাদের ওখানে যাবার জন্য একটু ফিটফাট হয়ে নেয় তৃণা। হালকা রঙের একটা পোশাক পরে, মুখে সামান্য মেক-আপের ছোঁয়া লাগায়। মৃদু সুগন্ধী স্প্রে করে নেয় পোশাকে। একটা ব্যাগের মধ্যে স্কুলের কিছু বইখাতা নোটবুক নেয়, দিওতিমার দরকার হতে পারে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় যে ক্লাস ওয়ার্ক আর ল্যাব ওয়ার্কগুলো ও মিস করেছে গতকাল আর আজ, সেগুলোর হয়তো কপি রাখতে চাইবে। মনে করে করে সব ভরছিল তৃণা। শেষমুহূর্তে রুবার স্বপ্ন লেখা ডায়েরিটাও ব্যাগের মধ্যে পুরে নিল। আসলে তো এটা দিওতিমার স্বপ্নই, বলতে বলতে একদিন থেমে গিয়েছিল ও। কিন্তু স্বপ্নটা থামেনি, তৃণার কাছে এসে ধরা দিয়েছে।

মায়ের তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগল। সুরথ তৈরি ছিল উড়নযান নিয়ে। ও তো সবসময়ই তৈরি থাকে।

তৃণাকে নিয়ে উড়ন-গাড়িতে উঠে গুছিয়ে বসে মা বললেন, “দিওতিমার মাকে ফোন করেছিলাম অফিস থেকেই। উনি বাড়িতেই আছেন, অফিস থেকে বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়েছেন। জানিস, কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়ল, দিওতিমার মায়ের সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল আমার। অনেকদিন আগে। আমরা একই প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফোর অবধি। ভাবা যায়? কতদিনের পুরোনো বন্ধুকে এইভাবে ঘটনাচক্রে খুঁজে পাওয়া আবার।”

মায়ের মুখে কেমন এক অদ্ভুত আলো আলো ভাব দেখতে পায় তৃণা। গলাও কেমন অন্যরকম শোনায়, যেন সেই অনেকদিন আগের স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে হঠাৎ বদলে গিয়েছেন মা।

বেশ কয়েকটা ব্লক দূরে দিওতিমাদের বিল্ডিং। ওদের ফ্ল্যাট সতেরোতলায়। বেল বাজালে দিওতিমার মা দরজা খুলে আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেলেন ওদের। তৃণা দেখল, বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে ভদ্রমহিলার। মুখ শুকনো, চিন্তিত। চোখের তলায় কালচে রঙ। মাথার চুল উসকোখুসকো, আঁচড়ানো নেই। কালো চুলের মধ্য থেকে গোছা গোছা ধূসর আর সাদা উঁকি দিচ্ছে। একটা পুরোনো কাফতান পরা, কাঁধের কাছে অল্প একটু ছেঁড়া। এর আগে যতবার দিওতিমাদের বাড়ি এসেছে তৃণা, ওর মাকে সবসময় দারুণ ফিটফাট হয়ে থাকতে দেখেছে। আজকে এরকম দেখে মনটা কেমন করে উঠল তৃণার।

দিওতিমা ওর ঘরের বিছানায় শুয়ে ছিল চোখ বুজে, তবে ঘুমোচ্ছিল না। ওর গা হালকা একটা নীল চাদরে ঢাকা ছিল। তৃণা গিয়ে বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসতেই ও চোখ খুলল। ম্লান হেসে উঠে বসল। বলল, “তৃণা, তুই এসেছিস!”

তৃণা বলল, “এখন কেমন আছিস দিয়া?”

দিওতিমা হাসে। বলে, “এখন তো অনেকটাই ভালো। তবে ক্লান্ত লাগে খুব। ডাক্তার-আঙ্কেল আমাকে আরও দু-মাস ছুটিতে থাকতে বললেন।”

তৃণা বলে, “আর দু-সপ্তাহ পর থেকেই তো স্কুলে লম্বা ভ্যাকেশন, দেড় মাসের। ছুটি নিলেও তোর কিছু মিস হবে না তেমন।”

“তা হবে না। বিশ্রাম করানোর জন্য মা-বাবা আমায় ক’দিন পরে পাঠিয়ে দেবে চাঁদের এক উপনিবেশে। ‘খুশি-পাহাড়’ না কী যেন জায়গাটার নাম বললেন ডাক্তার-আঙ্কেল। উনিই রেকমেন্ড করলেন আমায় সেখানে পাঠাতে। সেখানে নাকি অনেক মজা হয়। আমার মতন অনেক ছেলেমেয়ে নাকি সেখানে ছুটি কাটাচ্ছে এখন।” দিওতিমা বলে, কিন্তু তেমন উৎসাহ ফোটে না ওর গলার স্বরে।

তৃণার ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠে অকারণে। তাভামের ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। দিওতিমাকে তেমন কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছেন না তো এঁরা? তাভামের ভাই এখন ঠিক কোথায়? পৃথিবীতেই, নাকি চাঁদ বা মঙ্গলের কোথাও?

একটু ঝুঁকে পড়ে মৃদু স্বরে তৃণা বলে, “ল্যাবে হঠাৎ কী হয়েছিল তোর?”

দিওতিমা বলে, “কী জানি, আমি ঠিক করে বুঝতেই পারলাম না কী থেকে কী হয়ে গেল। হঠাৎ মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা, যেন ছিঁড়ে যাবে মাথাটা। তারপরেই সব অন্ধকার হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরল ক্লিনিকের বিছানায়।”

তৃণা বলে, “আমি তোর পাশেই ছিলাম। তুই ওভাবে চিৎকার করে মেঝেয় পড়ে গেলি দেখে কী ভয় যে পেয়েছিলাম! কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে হতভম্ব। শুধু তোর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে রইলাম। কী করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তারপর রেবতীদি ছুটে এলেন, এমারজেন্সিতে ফোন করলেন, প্যারামেডিক টিম এল, তোকে নিয়ে গেল ক্লিনিকে।”

তৃণার মা আর দিওতিমার মা নিজেরা কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন এইসময়। তৃণার মা দিওতিমার কাছে এসে আলতো করে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, “তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠো। তোমার বন্ধু তো একেবারে ঘাবড়ে গেছে তোমায় অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে।”

দিওতিমা হাসে। বলে, “হ্যাঁ আন্টি, তৃণা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। সেইজন্যেই আমার জন্যে এত চিন্তা করে ও।”

তৃণার মা মিষ্টি হসে বলেন, “ছোটোবেলা তোমার মা আর আমি এক স্কুলে, এক ক্লাসে পড়তাম, জানো? তখন আমরাও খুব বন্ধু ছিলাম, গলায় গলায় বন্ধু।”

দিওতিমার চোখে আলো জ্বলে ওঠে। একবার তাকায় নিজের মায়ের মুখের দিকে, আরেকবার তাকায় তৃণার মায়ের মুখের দিকে। তারপরে খুশিভরা গলায় বলে, “আরে! তাই নাকি? তোমরা একসঙ্গে পড়তে ছোটোবেলা?”

দিওতিমার মা হেসে সম্মতিসূচক মাথা দোলাতে থাকেন। তাঁকে অনেকটা দুশ্চিন্তামুক্ত আর ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল।

তারপর এটা ওটা গল্প চলে। এর মধ্যেই দিওতিমার মা চট করে অতিথিদের জন্য আর নিজেদের জন্য চার প্লেট খাবার আর চার পেয়ালা গরম পানীয় সাজিয়ে আনলেন। খেতে খেতে কথাবার্তা চলল। খাওয়া-টাওয়া হয়ে গেলে তৃণার মা আর দিওতিমার মা গল্প করতে পাশের ঘরে গেলেন। তৃণা ততক্ষণে দিওতিমার যেসব ক্লাস মিস হয়েছিল, সে-সব ক্লাসের নোটগুলো বার করেছে। ঘরের একপাশেই ফটোকপির মেশিন, চট করে কপি করে দিল সেখান থেকে। কপিগুলো নিজের পড়ার টেবিলে গুছিয়ে রাখতে রাখতে দিওতিমা ধন্যবাদ দেয় বন্ধুকে। তারপরে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে সতর্ক গলায় ফিসফিস করে বলল, “জানিস তৃণা, অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে এক মুহূর্তের জন্য ফিরে এসেছিল ও।”

তৃণা সচকিত হয়ে বলল, “কে? কে ফিরে এসেছিল?”

দিওতিমা তেমনই ফিসফিস করে বলে, “চুপ চুপ, আস্তে। কেউ না শুনে ফেলে! ফিরে এসেছিল আমার সেই হারানো স্বপ্নটা। এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম সেই সমুদ্রটাকে আবার। তীরে বালি, তার উপরে ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছিল আর আছড়ে পড়ছিল। ভেজা বালির উপর দিয়ে ছুটছিলাম আমি, পাশে পাশে ছুটছিল রুবা।”

তৃণার চোখে আলো জ্বলে ওঠে। বলে, “সত্যি?”

দিওতিমা মিনতির সুরে বলে, “শুধু তোকে বললাম। আর কাউকে বলিনি, বলব না। মাকে নয়, বাবাকে নয়, ডাক্তার-আঙ্কেলকে নয়। তুই বলে দিস না যেন কাউকে।”

তৃণা হাসে। বলে, “না না না না, পাগল নাকি? এ-কথা কেউ জানবে না। শুধু তুই আর আমি। দিয়া, একটা জিনিস দেখবি?”

“কী জিনিস রে?”

তৃণা নিজের ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বার করে আনে। সেই সাংকেতিক ভাষায় লেখা ডায়েরি যার মধ্যে ও নিজের স্বপ্নবৃত্তান্তগুলো লিখে রাখে। আস্তে আস্তে দিওতিমাকে বলতে থাকে সংকেতগুলোর অর্থ। ততক্ষণে উৎসাহে দিওতিমার চোখ এই এতখানি বড়ো হয়ে গিয়েছে।

ডায়েরির কয়েকটা পাতা ফটোকপি করে দেয় তৃণা। তারপরে বলে, “ডিকোড করে পড়ে দেখিস ছুটিতে। পরে তুই ছুটির শেষে স্কুলে ফিরলে এই নিয়ে অনেক কথা হবে। স্কুল খুললেই আমাদের এ-বছরের মুভি বানানোর প্রোজেক্ট শুরু হবে হলোগ্রাম ল্যাবে। তখন আমরা এই রুবার গল্প নিয়ে কাজ করব।”

দিওতিমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে তখনই পড়তে পারলে বাঁচে। কিন্তু উপায় নেই, কপি করা পাতাগুলো সে সাবধানে ঢুকিয়ে রাখল তার স্কুল-ব্যাগের ভেতরের পকেটে।

দিওতিমাদের ওখান থেকে ফেরার পথে উড়নযানে তৃণার মা একদম নিঃশব্দ ছিলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল খুব চিন্তিত। তৃণা একবার মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তোমার কী হয়েছে, মা?”

মা বললেন, “কই, কিছু না তো!”

তৃণা বুঝেছিল কিছু একটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মা ওকে বলতে চান না। হয়তো দিওতিমার মায়ের সঙ্গে পাশের ঘরে আলোচনার সময় এমন কিছু শুনেছেন যা তাঁকে চিন্তায় ফেলেছে। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক সেটা তিনি তৃণাকে জানাতে চান না। যাই হোক, ও আর বেশি খোঁচাখুঁচি করল না। দরকার হলে মা নিজেই বলবেন নিশ্চয়ই।

তৃণা আর তৃষাকে ডেকে মা যখন রাতের খাবার দিলেন, তখনও তিনি খুব গম্ভীর। অন্যান্য দিন মা ওদের সঙ্গেই খেতে বসেন, তিনজনে গল্প করতে করতে খাওয়া হয়। কিন্তু আজ তিনি ওদের দু-বোনকে খাবার পরিবেশন করে নিজে রান্নাঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

তৃষা জিজ্ঞাসা করল, “মা, তুমি খেতে বসবে না আমাদের সঙ্গে?”

মা রান্নাঘর থেকেই উত্তর দিলেন, “তোমরা খেয়ে নাও, আমার কাজ আছে। আমি পরে খেয়ে নেব।”

খাওয়ার সময় তেমন কথাই হল না। দিদি তৃণাকে কয়েকটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করল ওর যোগাসন ক্লাসের ব্যাপারে, তৃণা সংক্ষেপে উত্তর দিল। তারপর আধঘণ্টার মধ্যেই ওরা দু-বোনে চটপট খেয়ে উঠে যার যার ঘরে চলে গেল। তৃণা আর তৃষার ঘর পাশাপাশি। মায়ের ঘর বসার ঘর পার হয়ে অন্য পাশে।

ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে শুয়ে শুয়েও তৃণার ঘুম আসছিল না। ভাবছিল, মা কেন এত চিন্তিত। চিন্তাটা কি দিওতিমার ব্যাপার নিয়ে? কী বলেছেন তাঁকে দিওতিমার মা? নিজের ঘর আর দিদির ঘরের মাঝের দেওয়ালের কাছে নিজের মুভেবল বেডটা চালিয়ে নিয়ে গেল ও প্রায় নিঃশব্দে। তারপরে দেওয়ালের কাছে বালিশ রেখে বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। প্যারাবোলিক রিসিভারটা রাখল কানের কাছে। তৃণাদের সায়েন্স প্রোজেক্টে প্যারাবোলিক রিসিভার তৈরি করতে হয়েছিল আগের বছর, সেটা নিজের কাছেই রেখেছে। এতে খুব হালকা শব্দও ধরা যায়, স্পষ্টতর শোনা যায়।

ও অবশ্য প্রথমে আশা করেনি কিছু শুনতে পাবে। কিন্তু মা দিদির সঙ্গে কথা বলে মনের ভার হালকা করবেনই একসময় না একসময়, সেটা ও জানত। দিওতিমার বিপদের ব্যাপার যদি হয় কিছু, সেটা ওর জানা দরকার খুব, তাই লুকিয়ে কথা শোনা এমনিতে অনুচিত জেনেও ও ওই রিসিভার নিয়ে শুয়েছিল। তার মাত্র বারো বছর বয়স বলে মা তাকে অনেক কিছু জানান না, দিদি মাত্র চার বছরের বড়ো ওর থেকে, তাকে সব বলেন, এটাও তৃণার ভালো লাগে না। অথচ তৃণা মানসিকভাবে ওর দিদির মতোই পরিণত।

তৃণার আশা প্রথম রাতেই পূরণ হয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে মা আর দিদির কথাবার্তা কানে আসছিল। ওরা মৃদু স্বরে কথা বলছিল। কিন্তু মায়ের গলার স্বরে বেশ উদ্বিগ্ন ভাব, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। মা বলছিলেন, “আজ তৃণাকে নিয়ে দিওতিমাদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। দু-দিন পর দিওতিমাকে চান্দ্রেয়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”

চান্দ্রেয়ী হল চন্দ্রপৃষ্ঠে স্থাপিত মানুষের একটি উপনিবেশের নাম। সেও স্বচ্ছ আবরণে ঢাকা জনপদ। সেখানে একটি বিখ্যাত মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র আছে। পৃথিবী আর সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের যেখানে যেখানে মানুষের উপনিবেশ আছে, সব জায়গা থেকেই মানসিক রোগীরা চান্দ্রেয়ীতে যায় চিকিৎসা নিতে। এখনকার প্রশাসন ব্যবস্থায় অবশ্য একবার ডাক্তার কোনও রোগীর জন্য ওই চান্দ্রেয়ীর চিকিৎসাকেন্দ্র নির্দেশ করলে সেখানে না গিয়ে রোগীর উপায় নেই। ডাক্তারও নিমিত্তমাত্র, সব ঠিক করা হয় সেন্ট্রাল মেন্টাল হেলথ অর্গানাইজেশন থেকে।

মায়ের কথা শুনে তৃষা কেমন চমকানো গলায় বলে, “চান্দ্রেয়ীতে? সেই রি-হ্যাবে? দিওতিমার অবস্থা কি এখন এতটাই খারাপ? সেরেই তো উঠেছিল শুনেছিলাম আগেরবারে অনেকদিন ক্লিনিকে থাকার পর।”

“হ্যাঁ, প্রায় সেরেই গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ ল্যাবে অজ্ঞান হয়ে যায় দিওতিমা। তারপরে ওকে আবার ক্লিনিকে নিয়ে যান ওর মা। ডাক্তার নতুন করে পরীক্ষা করে নাকি আবার সেই আগের সিম্পটমগুলোর দেখা পেয়েছেন ওর ব্রেনে। তাই আর রিস্ক নিতে চান না, যত দ্রুত সম্ভব চান্দ্রেয়ীতে পাঠিয়ে দিতে চান। চান্দ্রেয়ীতে এই অসুখের বিশেষজ্ঞরা আছেন, সেখানে সঠিক চিকিৎসা হবে ওর।”

শুনতে শুনতে কেঁপে উঠল তৃণা। তাহলে দিওতিমাকে চান্দ্রেয়ীর মেন্টাল রি-হ্যাবিলিটেশন সেন্টারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ওর বাবা-মা! ও ওখান থেকে আর ফিরবে না? তাভামের ভাইকেও কি ওইখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল? তৃণার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, কিন্তু কানের পাশ থেকে রিসিভার সরায় না। শুনতে পায় মা বলছেন, “আজকাল নাকি পাঁচ-ছ’বছর থেকে এগারো-বারো বছরের বাচ্চাদের মধ্যে অনেকেরই একরকম অদ্ভুত মানসিক অসুখ দেখা যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখার অসুখ। আমরা স্বাভাবিক মানুষেরা যেমন এক-একটা স্বপ্ন একবারই দেখি, তারপরে হয় সামান্য মনে থাকে বা পুরোটাই ভুলে যাই, ওদের তা নয়। এরা একই স্বপ্ন বারে বারে দেখতে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রতিবার আর একটু বেশি বেশি করে দেখতে থাকে স্বপ্নের মধ্যের ঘটনাগুলো। এই করতে করতে এরা মানসিকভাবে ওই স্বপ্নের জগতের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, আর বাস্তব জগতে ফিরতে পারে না। ওদের ব্রেইন-স্টেম আর লিম্বিক সিস্টেমের অ্যামিগডালার কিছু কিছু অংশে স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে যায়। আর কর্টেক্সের কিছু কিছু অংশেও পরিবর্তন হয়। দিওতিমার ব্রেনেও এইরকম অবস্থা শুরু হয়েছে। যদিও প্রথমবার যখন অসুখটা ধরা পড়ল, তখন দ্রুত ওষুধ দিয়ে পরিবর্তনগুলো থামানো হয়েছিল। কিন্তু আবার ফিরে আসছে সব।”

তৃণা ভাবে, সেও তো ওই রুবার স্বপ্ন ওইরকম ধারাবাহিক গল্পের মতন দেখতে পায়! কিন্তু কাউকে বলেনি বলে ওকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়নি, তাই এখনও ধরা পড়েনি। কিন্তু যদি কোনোদিন ধরা পড়ে যায়? তখন?

তৃণা দাঁতে দাঁত চাপে, কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। তারপর অসহায় হয়ে ভাবে, যদি হঠাৎ একদিন ও ল্যাবে বা ক্লাসে বা ঘরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় দিওতিমার মতো? তাহলে তো মা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেনই। আর ক্লিনিকে যন্ত্রপাতি দিয়ে স্ক্যান করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকবেই। মনে পড়ে বিষাণের কথা, সেও স্বপ্ন দ্যাখে, একই স্বপ্ন বার বার। কাউকে বলেনি আজও, এক তৃণাকে ছাড়া। যদি বিষাণও একদিন ধরা পড়ে যায়?

এইসব ভাবতে ভাবতে অস্থির একটা ছটফটানি হতে থাকে তৃণার ভেতরে। পাশের ঘরে মা আর দিদির কথা ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। হয়তো মা চলে গিয়েছেন নিজের ঘরে।

কানের পাশ থেকে প্যারাবোলিক রিসিভার সরিয়ে রাখে তৃণা। কানে ইয়ার ফোন গুঁজে হালকা একটা মিউজিক চালায়। সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ, বনের ভিতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাবার শব্দ, আর এসবের মধ্যে একটা কচি গলা অদ্ভুত একটা গান গাইছে। গানের কথাগুলো সব বুঝতে পারে না তৃণা, শুধু বারে বারে জ্যোৎস্না কথাটা ফিরে ফিরে আসে, সেটা চিনতে পারে। এটা খুব প্রিয় গান তৃণার। একবছর আগে স্কুলের লাইব্রেরির পুরোনো কিছু গান যখন বিক্রি হচ্ছিল, তখন সেখান থেকে কিনেছিল ও। সেই থেকে শুনে আসছে নিয়মিত।

এই গান শুনতে শুনতে ছটফটানি কমে আসছিল তৃণার। মনে হচ্ছিল হয়তো অতটা খারাপ নয় অবস্থা। হয়তো তৃণার মতো, বিষাণের মতো অনেক ছেলেমেয়েই ওরকম বারে বারে ফিরে ফিরে আসা স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তাতে স্বাভাবিকভাবে স্কুলে যাওয়া আসা, পড়াশোনা করা, খেলাধুলা করা ইত্যাদি কোনও কিছুতেই কোনও সমস্যা হয় না। শুধু বড়োদের কাছে কিছু না বললেই হল।

মন শান্ত হলে গান বন্ধ করে কানের ইয়ার ফোন খুলে বালিশের পাশে রেখে তৃণা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে রুবার স্বপ্ন আসে।

স্বপ্নে প্রথমেই আসে সমুদ্রতীর। ঢেউ ভেঙে পড়ছে, তার শব্দ। সাগর-সৈকতের পরেই যে ঝাউবন, সেই ঝাউবনের পাশ থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে আসে রুবা। ওর গলায় আজকে নীল স্কার্ফ, সমুদ্রের হাওয়ায় ওড়ে। ওর পরনে অনেক কুচি দেওয়া সাদা ফ্রক। ফ্রকের গলার কাছে, হাতার প্রান্তে, কোমরের কাছে, ঝুলের শেষে লাল ঝালর বসানো। রুবার এই জামাগুলো এত সুন্দর দেখতে লাগে তৃণার! ইচ্ছে করে ওরকম পোশাক পরতে। কিন্তু তৃণাদের আমলের পোশাক সব অন্যরকম, বড়োই সাদামাটা।

কাছে এসে রুবা বলে, “এসেছ তৃণা? চলো, আমাদের বাড়ি চলো। আজকে আমার বাবা বাড়ি আছেন, অনেক দিনের ছুটি পেয়েছেন। অসুখ করেছিল কিনা, তাই। হাসপাতালে ছিলেন। এখন ছাড়া পেয়েছেন, সেরে উঠছেন। তাই অনেক লম্বা ছুটি পেয়েছেন অফিস থেকে। চলো, বাবার কাছে আজকে দুজনে গল্প শুনব।”

ঝাউবনের পাশ দিয়ে অনেকটা পথ হাঁটা, তারপর রুবাদের বাড়ি। বিশাল ফটক পার হয়ে লম্বা সাদা পাথরের পথ, দু-পাশে সবুজ বাগান, ফুলের গাছ আর ফলের গাছের ভর্তি। তারপর প্রাসাদোপম বাড়ি, যেমন কিনা রূপকথায় পড়েছে তৃণা। রুবা গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে দরজা খুলে দিলেন একজন প্রৌঢ়া।

বাড়ির দক্ষিণের ঘরে খোলা জানালার ধারে মস্ত আরামকেদারায় শুয়ে ছিলেন একজন সুন্দর মানুষ। টকটকে ফর্সা রঙ, মাথার চুলগুলো এলেমেলো, মুখে একটু ক্লান্ত ভাব। চোখে সুন্দর ঝকমকে ফ্রেমের চশমা পরা। উনি একটা মোটাসোটা বই পড়ছিলেন আরামকেদারায় শুয়ে শুয়ে। খুব মন দিয়ে বই পড়ছিলেন, রুবা আর তৃণার ঘরে ঢোকা টের পেলেন না।

রুবা আস্তে আস্তে গিয়ে ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “বাবা, বাবা!”

উনি বই থেকে চোখ না তুলেই অন্যমনস্কভাবে বললেন, “উঁ?”

রুবা বললো, “বাবা, দ্যাখো আমার বন্ধু এসেছে যে!”

এইবারে ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকালেন। তৃণার দিকে তাকিয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তারপরে রুবার দিকে ফিরে বললেন, “তোর সেই বন্ধু, তৃণা, যার কথা আমায় চিঠিতে লিখেছিলি?”

রুবা খুশিতে কলকল করে ওঠে। বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এই হল সেই তৃণা। তুমি আমাদের একটা গল্প পড়ে শোনাবে, বাবা? আমরা এখানে মোড়া নিয়ে বসি?”

রুবার বাবা হাসেন। বলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। আর, বই থেকে কেন? এমনিই গল্প বলছি, তোরা শোন।”

ঘরের একপাশ থেকে দুটো সুন্দর কারুকাজ করা মোড়া নিয়ে আসে রুবা। ওর বাবার আরামকেদারার সমানেই পাশাপাশি পাতে মোড়া দুটো। একটায় তৃণাকে বসতে দেয়, আরেকটায় নিজে বসে।

রুবার বাবা গল্প শুরু করেন, “এক যে ছিল আশ্চর্য দেশ। সেই দেশভর্তি কেবল পাহাড় আর পাহাড়, আর পাহাড়গুলোর মাঝে উপত্যকা। পাহাড়ে আর উপত্যকায় মস্ত মস্ত গাছের জঙ্গল আর জঙ্গল। কোনো-কোনো উপত্যকায় সুন্দর সুন্দর নদী, সেই নদীর ধারে ছোটো ছোটো গ্রাম বানিয়ে থাকত সেই দেশের মানুষেরা।

“একটা পাহাড় ছিল খুব উঁচু, সেই পাহাড় জুড়ে সবুজ অরণ্য। সবাই সেই পাহাড়কে বলত সূর্যের পাহাড়। ওই পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় নাকি আছে সূর্যের প্রাসাদ, যেখানে হিরেমানিক ছড়াছড়ি যায়। কিন্তু ওই পাহাড়ে কেউ যেতে পারত না। পাহাড়টাকে ঘিরে ছিল এক অদ্ভুত জলাভূমি, আলেয়ার জলা। লোকে বলত, সেই জলায় গেলেই সবাই পথ হারায়। জলায় নাকি থাকে এক নীল জাদুকর। সে নাকি ওখানে যারা যায় তাদের পথ ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে পাথরের মূর্তি করে রাখে।”

এই পর্যন্ত বলে থামেন রুবার বাবা। তৃণা মনের চোখে দেখতে পায় অরণ্যময় এক দেশ, কী সবুজ, কী সবুজ! আহা। মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে আছে বিশাল বিশাল সব পাহাড়, তাদের গা জঙ্গলে ঢাকা। তৃণা হারিয়ে গিয়েছিল কল্পনার সেই সবুজ পৃথিবীতে। সম্বিৎ ফিরল রুবার কণ্ঠস্বরে। রুবা বলছিল, “তারপর কী হল, বাবা?”

গল্পের সূত্র তুলে নিয়ে রুবার বাবা বলতে শুরু করেন, “এক গ্রামে থাকত দুই সাহসী ভাইবোন, ইলম আর ইরা। ওরা ছিল যমজ ভাইবোন। কিন্তু ওদের মা-বাবা ওদের খুব ছোটোবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন। ওরা মানুষ হচ্ছিল ওদের এক দূরসম্পর্কীয় পিসি আর পিসেমশাইয়ের কাছে। ওদের যখন মাত্র বারো বছর বয়স, তখন হঠাৎ সেই পিসি আর পিসেমশাইও একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন রহস্যময়ভাবে। তারপর থেকে ওরা একা একাই থাকত। দিনের বেলা গ্রামের অন্যদের সঙ্গে জমিতে কাজ করত আর সন্ধেবেলা শস্য, মাছ-মাংস এইসব যখন যা পারিশ্রমিক পেত গ্রামের মোড়লের কাছ থেকে, তাই নিয়ে ঘরে ফিরে আসত। ঘরে এসে রেঁধে বেড়ে খেয়েদেয়ে ঘুমাত।” এখানে এসে আবার রুবার বাবা থামলেন।

তৃণার গল্প শুনতে শুনতে বুকের মধ্যেটা মুচড়ে উঠছিল, চোখে জল আসছিল। ছোটো ছোটো দুই ভাইবোন, আহা, তাদের বাবা-মা ছোটোবেলা মারা গিয়েছেন! তারা কত একলা! এক পিসি-পিসেমশাইয়ের কাছে মানুষ হচ্ছিল, তো তাঁরাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন! এরকম কি হওয়া উচিত? এইখানে কেন যেন তৃণার হঠাৎ মনে পড়ে মাকে, দিদি তৃষাকে, অনেকদিন পরপর তাদের কাছে আসা বাবাকে। মনে হয় গল্পের ওই একলা ভাইবোনের মতো যদি সে আর তৃষাও ওরকম একলা হয়ে যেত? যদি মা-বাবা হারিয়ে যেতেন? এই ভাবনা মনে আসতেই দু-চোখ জল ভরে ওঠে ওর। জলভরা চোখের চারপাশে ঝাপসা হয়ে আসে রুবা, ওর বাবা, যে ঘরে বসে তারা গল্প শুনছিল, সেই ঘর।

হঠাৎ সব মিলিয়ে যায়। তৃণা শুনতে পায় টুং টাং বাজনা, অ্যালার্মের। জেগে উঠে চোখ মেলে তাকায়।

ভাবা যায়, একটু আগেই ও ছিল একটা স্বপ্নের মধ্যে? কী স্পষ্ট ছিল স্বপ্নটা! ঊষাকালের স্বপ্ন। ঘড়ি অনুসারে এখন তো ঠিক সেই সময়, যাকে ঊষাকাল বলত আগের লোকেরা। রাত কেটেছে, একটু একটু আলো হয়েছে, কিন্তু সূর্যোদয় হয়নি, এরকম সময়কে ওরা বলত ঊষা।

স্বপ্নের ভিতরে শোনা গল্পের রেশ তখনও তৃণার মনের মধ্যে রুন-রুন করছিল। সেই আশ্চর্য রূপকথার দেশ, দেশভরা পাহাড়, জঙ্গল আর নদী। আহা। সেই দুই ভাইবোন ইলম আর ইরা। হয়তো এক ভোরবেলা ওরা রওনা হয়েছিল সূর্যের পাহাড়ের দিকে, নীল জাদুকরের আলেয়ার জলা পেরিয়ে যেখানে যেতে হয়। আহ্‌, রুবার বাবার বলা গল্পটা ঠিক করে শুরু হতে না হতেই স্বপ্ন ভেঙে গেল। কোনও মানে হয়? আবার কবে ফিরে আসবে এই স্বপ্ন কে জানে!

চোখ বন্ধ করে তৃণা কল্পনা করে নীল আকাশ, সবুজ গাছগাছালি, গাছে গাছে অসংখ্য পাখি ডাকছে। এসব তো সে নিজের চোখে দেখতে পায়নি কোনোদিন, কিন্তু মিউজিয়ামের পুরোনো মুভিতে সে দেখেছে অমন। এখন কল্পনার চোখে ও দেখতে পায় আকাশে পূর্ব দিগন্ত লাল হয়ে উঠছে। সূর্যোদয়ের সময় ঘনিয়ে এল।

কিন্তু বেশিক্ষণ কল্পনার জগতে থাকলে চলবে না। সামনে অনেক কাজ। বালিশের তলা থেকে ডায়েরিটা বার করে হাতে নেয় তৃণা। বিছানার পাশের সাইড টেবিল থেকে তুলে নেয়ে পেন্সিল। ডায়েরি খুলে সাংকেতিক ভাষায় খুব সংক্ষেপে স্বপ্ন-বিবরণ লিখে রাখে। তারপর গায়ের উপর থেকে হালকা চাদরটা সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে বড়ো টেবিলের উপরে রাখা স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে ডায়েরি। এই ডায়েরি তৃণা কাছছাড়া করে না কখনও। স্কুলে যাবার সময় সঙ্গে নেয়, এমনকি যোগাসন ক্লাসে যাবার সময়ও ব্যাকপ্যাকে নিয়ে নেয়। আর রাত্রে ঘুমোবার সময় বালিশের তলায় নিয়ে শোয়।

আবার একটা নতুন দিনের শুর । এখন মুখ-হাত ধুয়ে স্কুলের জন্য তৈরি হওয়া, তারপরেই টুক করে একবার ব্যালকনিতে গিয়ে সূর্যপ্রণাম করে আসা। না দেখা সূর্যকে ওর প্রতিদিনের প্রণাম।

সকালের প্রস্তুতি, উড়নযানে চড়ে দিদির সঙ্গে স্কুলে যাওয়া, স্কুলের একের পর এক ক্লাস, তারপর ল্যাব—সবই হয়ে চলেছিল ঠিকঠাক। কিন্তু এইসবের মধ্যে মধ্যে অকারণে তৃণার মনকেমন করতে থাকে। মনকেমন করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে একবার ক্লাসে, আরেকবার ল্যাবে বকুনিও খেল শিক্ষিকার কাছে। ক্লাসেরটা তেমন কিছু নয়, কিন্তু ল্যাবে অন্যমনস্ক হয়ে এমন একটা ভুল তৃণা করে ফেলল যে আর একটু হলেই দুর্ঘটনা হয়ে যাচ্ছিল আর কি। রেবতীদি সবার সামনে ওকে এমন প্রচণ্ড বকা দিলেন যে ওর চোখে জল এসে পড়ল। স্কুলে আগে কোনোদিন ওভাবে বকুনি খায়নি সে। ছাত্রী হিসেবে তৃণা সবচেয়ে ভালোদের মধ্যে পড়ে বলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেউ কোনোদিন ওকে কড়া কথা বলেননি আগে। অবশ্য আগে ওরকম ভুলও কোনোদিন করেনি ও।

সেখানেই হেনস্থার শেষ হলে এক কথা ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা এতটাই সিরিয়াস যে রেবতীদি ওকে নিয়ে চললেন প্রিন্সিপাল প্রজ্ঞাদির কাছে। সেখানে প্রচুর বকুনি খেতে হল ওকে, একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তির ব্যবস্থাও হল। তারপরও ওর অভিভাবকদের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে চাইছিলেন দিদিমণিরা। একেবারে ভেঙে পড়ে ও আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থনা করায় শেষপর্যন্ত ওঁরা নিরস্ত হলেন।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা এইসব ঝামেলায় দেহে মনে একেবারে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল তৃণা। ফেরার পথে উড়নযানে ছেঁড়া কাপড়ের মতন সিটে এলিয়ে পড়ে ছিল। এমনিতে ওর ব্যাপারে উদাসীন তৃষা পর্যন্ত কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। বলল, “তোর কী হয়েছে রে তৃণা?”

তৃণা ম্লান, মৃদু গলায় বলল, “কই, কিছু না তো! খুব ক্লান্ত শুধু।”

দিদি কপালে হাত দিয়ে উত্তাপ পরীক্ষা করে বলল, “জ্বর তো নেই। কিন্তু তোকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। বাড়ি ফিরে পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে দুটো খেয়ে নিয়ে একেবারে অনেকক্ষণ বিশ্রাম করবি, হ্যাঁ?”

তৃণা বলে, “হ্যাঁ, অবশ্যই।” কথা বলতে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না ওর, মাথাটা ব্যথায় ছিঁড়ে পড়ছিল।

ঘরে ফিরে কোনোক্রমে পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল ও। খেতে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না। দিদি তৃষা ব্যালে ক্লাসে চলে যাবার পর নিশ্চিন্ত হয়ে একা ঘরে কাঁদতে শুরু করল তৃণা। এতক্ষণের প্রাণপণ চেপে রাখা অশ্রুধারা ওর গাল, গলা সব ভিজিয়ে দিয়ে ঝরে পড়ছিল বালিশে। কাঁদতে কাঁদতে ওর বুকের মধ্যে জমাট হয়ে থাকা কষ্টটা কমে যাচ্ছিল।

অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে তারপরে শান্ত হয়ে উঠে আবার যখন চোখমুখ ধুয়ে সুস্থ হয়ে বসেছে তৃণা, তখন মায়ের ফোনটা এল। হলোগ্রাম সুইচ অন করতেই মায়ের চেহারা সামনে। মাকে ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন আর বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। চুল উসকোখুসকো, মুখ অন্ধকার। বুকটা ধক করে উঠল তৃণার। কী শুনবে সে? এইজন্যই কি সারাদিন ওরকম মনটা ছটফট করছিল ওর? কোনও অজানা আশঙ্কায়?

মা কিন্তু খুলে কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, “তৃণা, জরুরি দরকারে আমাকে অনেক দূর যেতে হচ্ছে এখনই। ফিরতে হয়তো দু-তিনদিন লাগতে পারে। তুমি একদম চিন্তা কোরো না। তৃষাকে ফোন করে সব জানিয়েছি। ও তোমাকে পরে সব জানাবে। দিদির কথা শুনো। আমি এই ক’দিন থাকব না বলে একদম চিন্তা কোরো না। লক্ষ্মী হয়ে থেকো, কেমন? রাখি তবে।”

মা ফোন বন্ধ করে দেন ওদিক থেকে, হলোগ্রাম মিলিয়ে যায়। আর এদিকে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে তৃণা। কেমন একটা অদ্ভুত হতভম্ব অবস্থা ওর। উদ্বেগ আর ছটফটানি চাপা পড়ে গেল অভিমানের নীচে। বারে বারে মনে হল, দিদিকে মা সব জানালেন, কিন্তু ওকে কিছু বললেন না। কেন? ও কি এতটাই ছোটো যে ওকে জরুরি কথাগুলোও জানানো যায় না?

আজকে যোগাসন করতে আর বসল না তৃণা। এক কাপ হট চকোলেট বানিয়ে চুমুক দিতে দিতে ঘুরে বেড়াতে লাগল ফ্ল্যাটের ঘর থেকে ঘরে। আজকে সুরথও নেই। দিদিকে ব্যালে ক্লাসে নিয়ে যেতে আজকে চিনুক আসেনি, সুরথই নিয়ে গিয়েছে।

তৃণার ঘরের জানালার পাশে টবে টবে সবুজ গাছ, কিছু ফুলও ফুটেছে। একটা ফুল-ফোটা গাছের পাশে গিয়ে চুপ করে বসে রইল সে। আহ্‌, মা কেন ওকে বললেন না কী হয়েছে? বাবার কিছু হয়নি তো? বাবা তো এখন পৃথিবীর এক গবেষণাকেন্দ্রেই কাজ করছেন। সেই গবেষণাকেন্দ্র অবশ্য ওদের শহর থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে। সেখানে কোনও গণ্ডগোল হল না তো?

ভাবনাটা আসতেই বন্যার মতন ছটফটানি ফিরে এল তৃণার, আর বসে থাকতে পারল না। কোনোরকমে হট চকোলেট শেষ করে আবার এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসছিল ওর। মাথার ব্যথাটাও আবার ফিরে আসছিল। ওই অবস্থাতেই উঠে গিয়ে কিচেনের একপাশের ওষুধের ক্যাবিনেট থেকে জ্বরের ওষুধ খেয়ে নিল ও। তারপর ফিরে এসে বিছানায় পড়ে রইল বালিশে মুখ গুঁজে। জ্বরের ঘোরে ও আধো জাগা অবস্থাতেই স্বপ্নের মতন দেখছিল কতসব চেনা অচেনা মুখের মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। একবার দেখতে পেল সাদা ল্যাব-কোট পরা বাবাকে, পাশে ঠিক ওরকম ল্যাব-কোট পরা আরেকজন অচেনা মানুষ। তারপর ওঁদের ছবি মিলিয়ে গেলে দেখতে পেল রেবতীদির রাগী মুখ, খুব বকছেন উনি তৃণাকে। তারপর এক পলকের জন্য দেখতে পেল বিষাণের বিষণ্ণ মুখ। তারপর দেখল দিওতিমারা চলে যাচ্ছে স্পেস-পোর্টের সিকিউরিটি লাইন পার হয়ে। যেতে যেতে দিওতিমা একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে হাত নাড়ল। জলভরা চোখে সেইদিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তৃণা, হঠাৎ ডানদিক থেকে হাত ধরে কে যেন নাড়া দিল।

পুরো জেগে উঠে তৃণা দেখল দিদি ফিরে এসেছে। ওকে ডাকছে, “তৃণা, তৃণা, এই ভর সন্ধেবেলা ঘুমোচ্ছিস যে? হ্যাঁ রে, শরীর ঠিক আছে তো?”

উঠে বসল তৃণা। মাথাব্যথা যদিও কম, কিন্তু জ্বরভাব ছিল তখনও। আস্তে করে বলল, “একটুখানি জ্বর-জ্বর মতন। ওষুধ খেয়েছি, কমে যাবে মনে হয়। তুই এইমাত্র ফিরলি?”

“হুঁ, এই তো একটু আগেই। ফিরে পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে এলাম। তোর কোনও সাড়াশব্দ নেই দেখে এখানে এসে দেখি তুই ঘুমোচ্ছিস।”

তৃণা ওর দিদির চোখে চোখ রেখে গভীর গলায় বলে, “মা ফোন করে শুধু বলল জরুরি দরকারে অনেক দূরে যাচ্ছে, কয়েকদিন ফিরতে পারবে না। আর বলল, তোকে বলেছে সব। আমাকে সব বলবি, প্লিজ? না জানতে পারলে টেনশনে অসুখ বেড়ে যাবে।”

তৃষা চুপ করে তৃণার দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর খুব নরম গলায় বলে, “না শুনে ছাড়বি না, না? আসলে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বাবাদের ল্যাবে। বিস্ফোরণে ল্যাবের একটা অংশ প্রায় পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বাবাদের প্রোজেক্টের অনেক কিছু ওইদিকেই ছিল। দুর্ঘটনার সময় ওঁদের প্রায় সবার ওইদিকেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তার মাত্র মিনিট দশ আগেই ওঁরা সবাই কী একটা চেক করে দেখার জন্য ল্যাবের অন্য অংশে চলে আসেন। তাই সকলেই প্রাণে বেঁচে যান। তা সত্ত্বেও বিস্ফোরণের প্রভাব কিছুটা পড়েছে। কেউ কেউ আহত হয়েছেন, তবে জীবনসংশয় হয়নি কারও। কিন্তু প্রায় সকলেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। বাবা এখন ওখানকার ক্লিনিকে। মা আজকের সন্ধের ফ্লাইটে চলে গিয়েছে ওখানে। সম্ভবত দু-তিনদিন পর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবে।”

তৃণা স্তব্ধ হয়ে শোনে। মনে পড়ে যায়, ফোনে বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল এই তো সেদিন। ওঁদের এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছিল, ওঁরা কিছুদিনের মধ্যেই ওঁদের কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর পরিবেশের উপর। পরিবেশ শুদ্ধ করার কাজ। তার মধ্যে কিনা এই দুর্ঘটনা!

দিদির কথা শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তৃণা একটাও কথা বলে না। পাথরের মতন বসে থাকে, একটুও নড়ে না নিজের জায়গা থেকে। দিদি ওকে আলতো করে নাড়া দিয়ে বলে, “কী হল তৃণা? আমি তোকে এইজন্যেই বলতে চাইনি। মা ও সেইজন্যেই শুধু আমাকে খবরটা দিয়েছিল। আমরা জানি বাবার ব্যাপারে তুই কী প্রচণ্ড সেন্সিটিভ। তৃণা, শোন, বোঝার চেষ্টা কর। ভেঙে পড়িস না। বাবা এখন ভালো আছে রে, পরে তোর সঙ্গে ফোনে কথাও বলবে।”

আস্তে আস্তে তৃণার স্তব্ধ চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ম্লান মৃদু গলায় ও বলে, “আমি ঠিক আছি রে দিদি, তুই ভয় পাস না। কিন্তু আজ রাতে কিছু খাব না রে। শুয়ে থাকি বরং, মাথাটা ঘুরছে।”

বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তৃণা, চাদর টেনে নেয় গায়ের উপরে। চোখ বন্ধ করে।

তৃষা বলে, “একেবারে কিছু না খেয়ে থাকবি? আমি বরং এক গেলাস গরম দুধ আর দুটো রুটি সেঁকে দিয়ে যাব এখানেই। একেবারে না খেয়ে থাকা ঠিক হবে না।”

চোখ বোজা অবস্থাতেই তৃণা বলে, “ঠিক আছে, তাই দিস তবে। খেতে পারলে খাব। যাবার সময় ঘরের আলোটা বন্ধ করে দিবি প্লিজ?”

তৃষা ওর মাথার চুলে আলতো একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় ঘর থেকে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে।

অন্ধকারে চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে তৃণা ভাবতে থাকে, একসঙ্গে এতরকম কষ্ট কেন আসে? কেন সবকিছুই আজ তৃণাকে এত দুঃখ দিচ্ছে? কেউ কি নেই কোথাও যে একটা আনন্দ-সংবাদ আনে?

পরদিন তৃণার এতটাই জ্বর হল যে স্কুলে যেতেই পারল না। তৃষা ওর জন্যে একজন রোবোট-নার্স আনিয়ে নিল পাবলিক হেলথ অর্গানাইজেশনে ফোন করে। এই রোবট-নার্স একদম মানুষের মতন। বছর ত্রিশ বয়সের এক হাসিখুশি মহিলার মতন দেখতে, সাদা পোশাক পরা। সে এসে তৃণার দেখাশোনার ভার নিতেই তৃষা স্কুলে চলে গেল সুরথ-চালিত উড়নযানে চড়ে।

তৃণা চুপ করে শুয়ে থাকে বিছানায়। জেগেই শুয়ে থাকে, চোখও খোলা। অদ্ভুত ব্যথা সর্বাঙ্গে, সারা গায়ে হাতে পায়ে ব্যথা, মাথায়ও ব্যথা। তেমন বেশিরকম ব্যথা নয়, কষ্টকরও নয় তেমন, শুধু ক্লান্তি আর অবসাদ এনে দেয়।

ওর অনুমতি নিয়ে ঘরে আসে নার্স, সঙ্গে করে নিয়ে আসে ঈষদুষ্ণ জল আর তোয়ালে। প্রথমে তৃণার টেম্পারেচার মাপে, দেখা যায় জ্বর সামান্যই। তারপর উষ্ণ জলে তোয়ালে ডুবিয়ে ওর মুখ মুছিয়ে দেয় সযত্নে। তৃণার ভালো লাগে খুব। সে নরম গলায় জানতে চায়, “আমি তৃণা। আপনার নামটা জানতে পারি?”

যান্ত্রিক নার্স কোমল গলায় বলে, “আমার নাম বসুমতী। ডক্টর রায়ান, যিনি আমায় প্রথম অ্যাক্টিভেট করেন, তিনি এই নাম দিয়েছেন। ভালো না নামটা?”

তৃণা হাসে। বলে, “খুব সুন্দর নাম।”

বসুমতী বলে, “তোমার নামও ভারি সুন্দর। তৃণা। খুব ভালো নাম। তোমার নাম কে দিয়েছেন?”

তৃণা বলে, “আমার নাম দিয়েছেন আমার বাবা।”

বলতে বলতে কেন জানি আবার ওর চোখে জল আসে। সেই জল লুকিয়ে মুছে নেয় হাতের পাতায়। তারপর আস্তে আস্তে ও উঠে বসে। নিজে নিজেই উঠে কলঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে। বসুমতী সাহায্য করতে চাইছিল, কিন্তু তৃণা বলে সে নিজেই পারবে। জ্বর তো খুবই কম।

মুখ ধুয়ে ঘরে এসে তৃণা দেখে বসুমতী ওর জন্য সকালের খাবার তৈরি করে এনেছে। গরম দুধ, দু-স্লাইস সেঁকা পাঁউরুটি, একটা কলা আর একটা ডিমসেদ্ধ। তৃণা আপত্তি করে না, বাধ্য মেয়ের মতন সব খেয়ে নেয়।

খাওয়ার পর সোফায় বসে বসে গল্পের বই পড়ে তৃণা। কিন্তু মন বসে না। স্কুলে এখন সহপাঠীরা কী করছে, ক্লাস না ল্যাব ওয়ার্ক এইসব কথা মনে পড়তে থাকে। একদিন কামাই করলে কিছু অসুবিধে হবার কথা নয়, বিশেষ করে দিদি যখন বলেছে সরাসরি প্রিন্সিপাল প্রজ্ঞাদিকেই  গিয়ে একদিনের ছুটির আবেদনের চিঠিটা দেবে। দিদি স্কুলে বেরোনোর আগে তৃণা নিজেই লিখে দিয়েছে চিঠিটা।

আগেরদিনের ঘটনার কথা ভাবতে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তৃণার। আচ্ছা, তৃণাকে রেবতীদি সহপাঠীদের সবার সামনে ওইরকম করলেন কেন? প্রথমবারের অপরাধ, তাও ভুল করে করা, সেটা কি মাফ করে দেওয়া যেত না? আর প্রজ্ঞাদি? তিনিও তো রেবতীদির কথাতেই শাস্তি দিলেন।

হঠাৎ তৃণা ভাবে, আচ্ছা স্কুলটা বদলানো যায় না? না-হয় অন্য কোথাও, অনেক দূরের কোনও স্কুলে ভর্তি হবে তৃণা। মা ফিরলে মাকে বুঝিয়ে বললে মা বুঝবেন না? কিন্তু কে কোন স্কুলে পড়বে সে তো শুধু বাবা-মা ঠিক করেন না, সেন্ট্রাল অ্যাকাডেমিক অর্গানাইজেশন থেকে ঠিক করা হয়। তাঁরাই ডেটাবেস থেকে সব তথ্য নিয়ে ছাত্র বা ছাত্রী কোন স্কুলে পড়বে সেটা জানিয়ে দেন বাবা-মাকে। সব বাবা-মা সেই নির্দেশ মানতে বাধ্য।

ভাবনার এই জায়গাতেই ফোন বেজে ওঠে। তুলে নিয়ে ভিসুয়াল অন করতেই সামনে তাভামের হলোগ্রাম। তাভাম বলে, “তৃণা তৃণা, তুই আজ স্কুলে আসিসনি, এদিকে বিশাল কাণ্ড! তাও আবার তোকে নিয়ে।”

তৃণার গলা কেঁপে ওঠে। কোনোক্রমে বলে, “ক-ক্কী হয়েছে?” আশঙ্কায় বুক শুকিয়ে ওঠে ওর। ভাবে, তাহলে কি রেবতীদিরা আরও শাস্তির ব্যবস্থা করছেন ওর? কালকেরটা যথেষ্ট মনে হয় না ওঁদের? এবারে কী করবেন ওঁরা? তৃণাকে স্কুলসুদ্ধু সকলের সামনে শাস্তি দেবেন?

তাভাম হাসে। বলে, “তোর মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? আরে, ভালো খবর রে। যাক, আর তোকে টেনশনে রাখব না, বলেই ফেলি। শোন, সেই গ্লোবাল ম্যাথ কম্পিটিশন হল না চার মাস আগে? আমাদের স্কুল থেকে যে বাছাইকরা কয়েকজন গিয়েছিল, তার মধ্যে তুই ছিলি। আজ তার রেজাল্ট নিয়ে এসেছেন ওদের লোক। আমাদের রিজিয়ন থেকে তুই টপার হয়েছিস। তুই জিতেছিস তৃণা, তুই জিতেছিস! বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা? ওঁরা তোকে আরও অনেকের সঙ্গে বিশেষ ট্রেনিংয়ে পাঠাবেন। সম্ভবত পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটে। ওহ্‌, কী দারুণ ব্যাপার বল?”

শেষদিকের কথাগুলো তৃণার কানে ঝাপসা হয়ে আসে, সামনে তাভামের হলোগ্রামও ঝাপসা। উষ্ণ অশ্রু ওর চোখ ছাপিয়ে অবাধে ঝরে পড়তে থাকে গাল বেয়ে। মোছার চেষ্টা করে না ও।

তাভাম একটু ঘাবড়ে যায়। বলে, “কী হল তৃণা? কী হল? ঠিক আছিস তো তুই?”

কান্নার মধ্য দিয়েই হেসে তৃণা বলে, “ঠিক আছি রে। ঠিক আছি। তোকে অনেক ধন্যবাদ খবরটা দেবার জন্য।”

তাভাম বলে, “না না, ধন্যবাদের কী আছে? এ তো আমাদের গর্বের ব্যাপার। তুই ভালো থাকিস। এখন রাখি রে, পরে কথা হবে।”

খুট করে ফোন অফ করে দেয় তাভাম, হলোগ্রাম মিলিয়ে যায়। তৃণা ফোন রেখে সোফায় এলিয়ে শুয়ে পড়ে। বসুমতী এসে আবার ওর টেম্পারেচার মাপে। জ্বর বাড়েনি একটুও, কিন্তু তৃণার চোখের জল থামে না।

বসুমতী করুণ গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে তোমার তৃণা? কেন এভাবে কাঁদছ? কোনও কষ্ট হচ্ছে? নাকি কোনও খারাপ খবর পেলে?”

তৃণা মাথা নেড়ে জানায়, “না, কষ্ট হচ্ছে না। কোনও খারাপ খবরও পাইনি, বরং ভালো খবরই পেলাম।”

বসুমতী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। বলে, “তাহলে কেন কাঁদছ?”

কেন যে সে কাঁদছে সেটা তৃণা নিজেই বুঝতে পারে না। খবরটা এতটাই আকস্মিক ছিল, যে তার জন্য কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু তাও এমন কত আকস্মিক খবরই তো সামলে নিয়েছে ও আগে। এই খবরটা পেয়ে কেন এমন বেসামাল হয়ে পড়ল? আনন্দে? আনন্দেও কি মানুষের কান্না পায়?

পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটের কথা বলল না তাভাম? সে তো বিখ্যাত জায়গা। ওই ইনস্টিটিউট চন্দ্রপৃষ্ঠে, চান্দ্রেয়ী উপনিবেশের খুব কাছেই। ওই পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটেই ট্রেনিংয়ে পাঠানো হবে ওকে? বিখ্যাত বিখ্যাত গণিতজ্ঞেরা আছেন ওখানে, পদার্থবিদরাও আছেন। ওহ্‌, কতদিন তৃণা স্বপ্ন দেখেছে ওখানে একটিবার যেতে পারার! শুধু দেখার জন্য। আর আজ ওখানে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগই এসে উপস্থিত। ওহ্‌, কালকের ওই অপমান, শাস্তি, মায়ের হঠাৎ দূরে যেতে হওয়া, পরে দিদির কাছ থেকে শোনা বাবার ল্যাবের দুর্ঘটনার সংবাদ—একসঙ্গে এতসব খারাপ ব্যাপার যেন আঘাতের পর আঘাতে সাড়হীন করে দিয়েছিল তৃণাকে। এখন এই অপ্রত্যাশিত শুভ সংবাদ এসে স্নিগ্ধ হাওয়ার মতন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কপালে। তাই কি মনে সাড় এসেছে আবার? তাই সব জমানো কান্না এভাবে বার হয়ে আসছে?

তৃণা ছোট্টো মেয়ের মতন মাথা নাড়তে নাড়তে সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বসুমতীকে বলে, “জানি না গো কেন কাঁদছি।”

বসুমতী বলে, “আমি তোমার জন্য স্যুপ বানিয়ে আনি? খেলেই দেখবে ভালো লাগছে।”

তৃণা বলে, “হ্যাঁ, স্যুপ বানিয়ে আনো। তোমায় অনেক ধন্যবাদ।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই ধোঁয়া ওঠা স্যুপ নিয়ে আসে বসুমতী। তৃণা তৃপ্তি করে স্যুপ খেতে থাকে। ততক্ষণে ওর কান্না বন্ধ হয়েছে। মনটাও অনেক হালকা লাগছে তখন ওর।

স্যুপ খাওয়া হয়ে গেলে যখন বাটি চামচ সব সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে বসুমতী, তখন আরেকটা ফোন আসে। তৃষার। ভিসুয়াল অন করতেই সামনে দিদির মুখ, আনন্দে ঝলমল করছে। তৃণা কিছু বলার আগেই ও-পাশ থেকে দিদি বলে, “খবর শুনেছিস, তৃণা?”

তৃণার ইচ্ছে ছিল একটু অভিনয় করে, বলে, ‘না তো, কী খবর?’ কিন্তু শেষমুহূর্তে পারল না। হেসে ফেলে বলল, “গ্লোবাল ম্যাথ কম্পিটিশনের রেজাল্টের খবর তো? হ্যাঁ, এই কিছুক্ষণ আগে আমার এক ক্লাসমেট ফোন করেছিল। সে বলল।”

তৃষা উৎফুল্ল। বলে, “ওহ্‌, কী কাণ্ড রে! কামাল করে দিয়েছিস। তোর জন্য বিশেষ সংবর্ধনার ব্যবস্থা হবে স্কুলে। তবে সেটা পরে। আর আজকে কী হবে শোন। স্কুলের পর রেবতীদি আর প্রজ্ঞাদি দুজনে আমার সঙ্গে যেতে চান তোর সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে আনব কি ওঁদের? তোর সঙ্গে নাকি জরুরি দরকার। তবে তুই হ্যাঁ বললেই তবে যাবেন বলেছেন। কী বলব ওঁদের?”

তৃণা মৃদু শান্ত গলায় বলে, “হ্যাঁ, অবশ্যই। ওঁরা নিজেরা যদি আসতে চান, আমি কি আপত্তি করতে পারি? নিয়ে আয় ওঁদের, দেখি কী বলেন।”

তৃষা হাসে। বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ। স্কুলের পর ওঁদের নিয়ে যাব সঙ্গে করে। তুই ফিটফাট হয়ে থাকবি কিন্তু। ঠিক আছে, রাখি এবারে।”

খুট করে বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ, মিলিয়ে যায় তৃষার হলোগ্রাম। আর তৃণা সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে যায় পোশাক বদলাতে। শিক্ষিকারা আসবেন, একটু ফিটফাট থাকা দরকার তো বটেই।

একটু পরেই এসে পড়লেন ওঁরা। তৃণা বসার ঘরে সেই সোফাতেই ছিল। শিক্ষিকারা আসতেই উঠে দাঁড়াল।

রেবতীদি আর কোনোদিকে দৃষ্টিপাত না করে সোজা এসে তৃণার দু-হাত ধরে এমন করে ক্ষমা চাইতে লাগলেন যে তৃণা রীতি মতন হতভম্ব। রেবতীদির চোখে জল। পাশেই প্রজ্ঞাদি এসে  দাঁড়িয়েছিলেন, ওঁর চোখেও জল। তৃণা কোনোক্রমে বলতে পারল, “আপনারা বসুন, প্লিজ।”

রেবতীদি বললেন, “তোমার এত জ্বর! সব আমার জন্য। ওইভাবে ক্লাসের সবার সামনে তোমাকে আমি… তোমার মনে আঘাত লেগে… ওহ্‌, কাল আমার কাজটা একদম অন্যায় হয়েছিল। আমায় মাফ করে দাও তৃণা।”

“আপনারা বসুন প্লিজ। এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে… না না, প্লিজ বসুন।”

তখন ওঁরা বসলেন। তৃণা বলল, “ক্ষমা চেয়ে লজ্জা দেবেন না। আমি আপনাদের ছাত্রী, মেয়ের মতন। আমি ভুল করলে শাস্তি দেওয়াই তো আপনাদের কর্তব্য। গতকাল ল্যাবে আমি যে ভুল করতে যাচ্ছিলাম তাতে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। সেটা যে হয়নি, সেটা নেহাতই আমাদের সৌভাগ্য। আপনারা যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। আর আমার জ্বর এমনিই হয়েছে, তার জন্য অন্য কারও কোনও দায় নেই।”

দিদিমণিরা বেশ সন্তুষ্ট হলেন তৃণার ব্যবহারে। প্রজ্ঞাদি হাত বাড়িয়ে তৃণার মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে আদর করে গাঢ় গলায় বললেন, “আমরা তোমার জন্য গর্বিত। আমাদের গোটা স্কুল গর্বিত। পরশুদিন স্কুলে বিশেষ অনুষ্ঠান। গ্লোবাল ম্যাথ কম্পিটিশনের বিজয়ীদের সংবর্ধনা ও পুরস্কার দেওয়া হবে। তোমার তো আসতেই হবে। আশা করি জ্বর সেরে যাবে তার আগেই।”

তৃণা বলে, “জ্বর এখনই প্রায় সেরে গিয়েছে। মনে হয় আগামীকাল একেবারে ভালো হয়ে যাব, স্কুলে যেতে পারব।”

তৃষা ততক্ষণে দিদিমণিদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছে। উষ্ণ পানীয় আর কিছু স্ন্যাক্স। দিদিমণিরা প্রথমে মৃদু আপত্তি করলেন, তারপরে খেলেন।

দিদিমণিরা আরও কিছুক্ষণ বসলেন, কথাবার্তা বললেন। তারপর তৃণাকে দ্রুত ভালো হয়ে ওঠার শুভেচ্ছা জানিয়ে দুজনে বিদায় নিলেন। বসুমতীরও যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল, সেও বিদায় নিল।

তৃষা এতক্ষণ পরে বোনকে একলা পেয়ে বলল, “কী হয়েছিল রে? রেবতীদি রীতি মতন কাঁদছিলেন, প্রজ্ঞাদিরও চোখে জল ছিল। ওঁরা কি তোর সঙ্গে কিছু কঠোর ব্যবহার করেছিলেন? বা আরও মারাত্মক কোনো কিছু? কোনও কড়া শাস্তি দিয়েছিলেন?”

তৃণা হালকা করে হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে, “না না, তেমন কিছু নয়। সামান্য ব্যাপার। তুই কি এখন ডিনার বানাবি? খুব খিদে পেয়েছে রে।”

তৃষা সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীল বড়দিদি হয়ে ওঠে। খাবার বানাতে রান্নাঘরে চলে যায়।

ঝটপট খাবার বানিয়ে চমৎকার সাজিয়ে গুছিয়ে বেড়ে তৃণাকে খেতে দেয় দিদি। তৃণা ধন্যবাদ দিয়েই খেতে শুরু করে দেয়, সত্যি খুব খিদে পেয়েছিল ওর। তৃষা নিজেরটাও বেড়ে এনেছে। পাশে বসে নিজেও খেতে খেতে হেসে বলে, “সারাদিন কি কিছু খাসনি?”

খেতে খেতেই তৃণা বলে, “সকালে অল্প ব্রেকফাস্ট আর দুপুরে শুধু স্যুপ। ব্যস। এখন যা খিদে পেয়েছে না! থ্যাঙ্ক ইউ দিদি, খুব ভালো বানিয়েছিস খাবারটা।”

তৃষা বলে, “তোর ভালো লাগছে? মা বানিয়ে ফ্রিজে রেখে গিয়েছে সব, আমি শুধু বের করে গরম করে দিলাম।”

খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলেই তৃণা নিজের ঘরে সেঁধিয়ে ঘুমোবার উদ্যোগ করে। না-হলে দিদি যদি গতকাল স্কুলে কী হয়েছিল জানতে চায়, এড়াবার পথ নেই। তৃণা গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে না। এদিকে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল সে-সব বলতে গেলে শুধু শুধু আরেকপ্রস্থ কষ্ট ডেকে আনা হবে। তার চেয়ে ঘুমের অজুহাত অনেক ভালো।

ঘুমের ভান করবে ভেবেছিল বটে, কিন্তু সত্যি সত্যিই ঘুম নেমে আসছিল ওর চোখে। গতকাল আর আজকের সারাটা দিন নানারকম অপ্রত্যাশিত চমকের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে সত্যিই মনটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ওর। আধো ঘুমের মধ্যে শুনল দিদি শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গেল দরজা ভেজিয়ে দিয়ে। পুরো ঘুমিয়ে পড়ার আগে বাবার মুখটা মনে পড়ল তৃণার। ফিসফিস করে সে প্রার্থনা করল, ‘তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে বাড়ি এসো বাবা। কতদিন যে তোমায় সামনে পাইনি! কত কথা যে বলার আছে তোমায়!”

এক ঘুমে রাত কাবার করে পরদিন ভোরে ঝরঝরে হয়ে ঘুম থেকে উঠল তৃণা। উঠেই মনে পড়ল আগের ভোরে সূর্যপ্রণাম হয়নি ওর। জ্বরের জন্য মাথা ঘোরাচ্ছিল বলে ব্যালকনিতে যেতে পারেনি আগেরদিন। স্মরণকালের মধ্যে ওটাই প্রথম সূর্যপ্রণাম বাদ পড়া।

ঝটপট সকালের কাজগুলো সেরে ফেলতে শুরু করল তৃণা। আজকের সূর্যপ্রণাম অনেকক্ষণ ধরে করতে হবে। সময়ও আছে বেশ কিছুটা। স্কুলে যাবার সময় হতে দেরি আছে।

তৃষা যখন উঠল তখন তৃণা একেবারে সব গুছিয়ে নিয়ে স্কুল ইউনিফর্ম পরে তৈরি হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে বসে টেক্সট বই পড়ছিল। দিদি তো এসে দেখে অবাক। “আরে! তোর হয়ে গেছে? আমার দেরি হয়ে গেল নাকি?”

দিদিকে আশ্বস্ত করে তৃণা, “না না, তোর দেরি হয়নি। আমার বরং একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে। স্কুলের সময় হতে দেরি আছে অনেক।”

দিদি ব্যস্ত হয়ে চলে গেল তৈরি হতে। তৃণা বই বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। বার করল একটা স্কেচ বুক। তার সাদা পাতায় এলেমেলো স্কেচ করতে করতে ভাবতে লাগল কী ঝটপট পুরো পরিস্থিতি বদলে গেল! মাত্র গতকালই সে ভাবছিল স্কুল বদল করে অনেক দূরের স্কুলে চলে যেতে পারলে ভালো হয়, আর আজ স্কুলে কতক্ষণে যাবে এইজন্য ছটফট করছে। নিজের মনেই একবার হাসল ও। ম্যাথ কম্পিটিশনের রেজাল্ট অন্যরকম হলে অবশ্য সবই অন্যরকম হতে পারত। ফলাফল তৃণার নিজের কাছেও খানিকটা অপ্রত্যাশিত। এতটা ও নিজেও আশা করেনি। বছরভর কত কম্পিটিশনই তো হয়। বেশিরভাগ সময়ই স্কুল থেকে নির্বাচিত দলের মধ্যে তৃণা থাকে। স্কুল থেকেই সমস্ত উদ্যোগ আয়োজন করে প্রতিযোগিতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় ওদের। তবে গ্লোবাল ম্যাথ কম্পিটিশনের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ছিল। প্রথমে নিকটবর্তী ম্যাথ টেস্টিং সেন্টারে হল একটা ছোটো লিখিত পরীক্ষা। তারপরে সেই পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী যারা নির্বাচিত হল, তাদের নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অংশে। সেখানে ওদের সমাধান না হওয়া গাণিতিক সমস্যার একটা তালিকা দেওয়া হল আর প্রত্যেককে বলা হল যে-কোনো একটা প্রবলেম বেছে নিয়ে সেই নিয়ে চিন্তা করতে। কোনও সমাধান বার করা যায় কি না সে নিয়ে নিজের নিজের মতন করে ভাবতে ও কষতে। সেই সময় লাইব্রেরির বইপত্র বা ডেটাবেসে থাকা গবেষণাপত্র ইত্যাদি সব রিসোর্সই ওরা ব্যবহার করতে পারবে এরকম ব্যাপারও বলা ছিল। যেহেতু প্রবলেমগুলোর সল্যুশন নেই, তাই কীভাবে সলভ করা হবে সেই বিষয়ে ধাপে ধাপে করা চিন্তাটাই আসল দামি। তার জন্য সময় বরাদ্দ ছিল গোটা একটা দিন ও রাত। পরদিন দুপুরে পরীক্ষকরা ওদের সমাধানের চিন্তাভাবনা ও কাজগুলো সংগ্রহ করলেন এক এক করে ইন্টারভিউ নিয়ে।

অন্যরকমের ওই প্রতিযোগিতাটা বেশ উপভোগ করেছিল তৃণা। বেশ একটা ক্যাম্পিংয়ের মতন ব্যাপার যেন। অঙ্ক নিয়ে ভাবতে ভাবতে, কাজ করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। তখন মধ্যাহ্নভোজের ডাক পড়ল। সবাই মিলে সেখানে যাওয়া। তারপর খেয়েদেয়ে ফিরে এসে আবার প্রবলেমটা নিয়ে লড়তে বসা।

বিকেলে আবার সবাইকে ছোট্টো একটা ব্রেক দেওয়া হল বিকেলের স্ন্যাকসের জন্য। তারপর আবার অঙ্ক। তারপরে রাতের খাওয়া। রাতের খাওয়ার পর ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে, এক এক রুমে দুজন করে। চমৎকার হোটেলের ডবল বেডেড রুমের মতন সেই ঘরগুলো। পরদিন সকালে আবার ফিটফাট হয়ে পরীক্ষাস্থলে ফিরে আসা, পাশেই ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা। তারপর আবারও কয়েক ঘণ্টার কাজ। তারপরে এক এক করে ইন্টারভিউ। সবার ইন্টারভিউ শেষ হতে হতে বিকেল। তারপর সবাইকে খাবারের প্যাকেট হাতে দিয়ে হাসিমুখে বিদায় দিলেন উদ্যোক্তারা। তাদের স্কুলের গ্রুপ একসঙ্গেই ফিরল স্কুলে, সেখান থেকে যে-যার বাড়িতে।

খুঁটিনাটি মনে পড়ছিল তৃণার। সত্যি খুব এনজয় করেছিল সে গোটা প্রতিযোগিতাটা। মানসিকভাবে কোনও চাপ নেয়নি, ভারহীন মনে ভেবে গিয়েছিল তার বেছে নেওয়া গাণিতিক সমস্যাটা নিয়ে। তারপরে নিজের মতন সমাধান সাজিয়েছিল ধাপে ধাপে।

স্মৃতির গলি থেকে বেরিয়ে এল তৃণা। তৃষা তৈরি হয়ে এসে পড়েছে।

তারপর স্কুল। স্কুলে নিজের ক্লাসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তো যাকে বলে তৃণার উপরে অভিনন্দনের বন্যা। প্রথমে সহপাঠী বন্ধুদের কাছ থেকে, তারপরে শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এসে এসে কনগ্রাচুলেট করে যেতে লাগলেন। আরও একটা সারপ্রাইজ ছিল, বিষাণও কম্পিটিশনে ভালো ফল করেছে। স্কুল থেকে তৃণা আর বিষাণ দুজনেই যাবে পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটে। সেটা কিছুদিনের মধ্যেই। ওদের আর দীর্ঘ প্রথাগত স্কুলশিক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটে একবছরের ট্রেনিংয়ের পরই ওরা সরাসরি কলেজে ঢুকে পড়তে পারবে নিজের নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার জন্য। ওহ্‌, ভাবা যায়?

বিষাণকে কনগ্রাচুলেট করতে করতে তৃণা ভাবছিল, কী আশ্চর্য একটা দিন! বিষাণের সদা বিষণ্ণ মুখে হাসির আলো। বিষাণও অভিনন্দন জানাল তৃণাকে। আরও জানাল, আর দশদিন পরেই রওনা হতে হবে পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটে। অবশ্য গ্লোবাল ম্যাথ কমিটি থেকেই সব ব্যবস্থা করা হবে, ওদের নিজেদের কোনও ভাবনা নেই।

ক্লাস করতে করতে একসময় হঠাৎ তৃণার মনে হয় দিওতিমাকে হয়তো আজই চান্দ্রেয়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাবার আগে ওর সঙ্গে আর দেখা হল না। কথা হল না। মনটা মেঘলা হয়ে যেতে চায় ওর, কিন্তু আজ মনখারাপকে প্রশ্রয় দেয় না। মনে মনে ভাবে, কে বলতে পারে হয়তো একেবারে চান্দ্রেয়ীতেই দেখা হবে দিওতিমার সঙ্গে?

স্কুল থেকে ফেরার পথে দিদি বলল, “একটা ভালো খবর আছে। আগামীকাল বিকেলে মা ফিরবে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। স্কুলে টিফিনের সময় মায়ের ফোন পেয়েছি।”

তৃণা ঝলমল করে ওঠে খুশিতে। আজকে আর অভিমানকে প্রশ্রয় দেয় না মা ওকে ফোন না করে শুধু দিদিকে করেছেন বলে। বাবা আসবেন, বাবা আসবেন, বাবা আসবেন… এই ব্যাপারটা আনন্দের গানের ফিরে ফিরে আসা সুরের মতন ওকে জড়িয়ে ধরতে থাকে। ওহ্‌, কতদিন পর বাবাকে সামনাসামনি দেখতে পাবে ও।

আজ তৃষার ব্যালে ক্লাসে যাওয়া নেই। বাড়ি ফিরে সে খাবার বানায় নিজের জন্য আর বোনের জন্য। তারপরে দুই বোনে খেতে খেতে গল্প করতে থাকে।

তৃষা বলে, “জানিস তৃণা, বাবাদের গবেষণাকেন্দ্রে দুর্ঘটনাটা নাকি আসলে অন্তর্ঘাত। তদন্ত কমিটি বসেছে। তাঁরা তদন্ত করে খুঁজে পেয়েছেন যে ভেতরের লোকেরাই ষড়যন্ত্র করে নাকি ওই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে তখন বাবা আর তাঁর সহকর্মীরা অন্য জায়গায় ছিলেন। নইলে ওই ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য সফল হয়ে যেত। ওরা শুধু কাজটাই পণ্ড করতে চাইছিল না, চাইছিল মূল গবেষকরাও সব দুর্ঘটনায় মারা যাক।”

তৃণা শিউরে ওঠে। হতভম্বের মতন তোতলাতে তোতলাতে বলে, “অ্যাঁ? ক্-ক্-ক্কি-কিন্তু কেন? কেন ওরা অমন করল? ওরা কি চায় না আমাদের পৃথিবীর পরিবেশ আবার ভালো হোক, এর জল বিশুদ্ধ হোক, এর বাতাস বিশুদ্ধ হোক? পৃথিবী আবার সবুজ হোক?”

তৃষা কেমন একটা অদ্ভুত হেসে বলে, “কে জানে কেন। কেন ওরা ভালো কাজে বাধা দিতে চায় সে ওরাই জানে। হয়তো ঈর্ষা। এই কাজ যারা সফলভাবে করতে পারবে তারা রাতারাতি গোটা পৃথিবীতে আর পৃথিবীর বাইরেও যেখানে যেখানে মানুষের উপনিবেশ আছে, সর্বত্র বিখ্যাত হয়ে যাবে, এই ব্যাপারটা হয়তো সহ্য হচ্ছে না অন্য গবেষকদের।”

তৃণা আস্তে আস্তে ম্লান গলায় বলে, “কী অদ্ভুত!”

ওর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, উঠে পড়ে। তারপর প্লেটটা ধুয়ে তাকে তুলে রেখে নিজের ঘরে চলে যায়। এখন ওর কিছু লেখালিখি করা দরকার।

***

রাত্রে ঘুমের মধ্যে তৃণা এলেমেলো স্বপ্ন দেখতে থাকে। ঘটনাগুলো পরপর সাজানো নয়, সব জড়িয়ে-মড়িয়ে একাকার। মাঝে মাঝে একটা অদ্ভুত ছায়া পড়তে থাকে ওর সামনে। স্বপ্নের মধ্যে সে চোখ তুলে কিছুতেই দেখতে পারে না কীসের ছায়া পড়ছে ওর সামনে। একবার  দেখতে পায়, কোথা থেকে যেন পড়ে যাচ্ছে ও। পড়ছে তো পড়ছেই, শূন্যের ভিতর দিয়ে হু হু করে পড়ছে। আর সেই ছায়াটা ওকে ঢেকে ফেলছে। তারপরে হঠাৎ কোথা থেকে একগোছা চকচকে রুপোলী দড়ি এসে জড়িয়ে নিল ওকে। কারা যেন ওকে তুলে নিচ্ছে উপরে, ছায়াটা সরে যাচ্ছে।

ঘুম ভেঙে উঠে চুপ করে বসে থাকে তৃণা। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় ওর। এই প্রথম স্বপ্ন লেখার ডায়রিতে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। কারণ, লেখার মতন ঘটনা কিছুই তো ছিল না ওই স্বপ্নে।

পরদিন স্কুলে অনুষ্ঠান। সাজো সাজো অবস্থা। ক্লাসগুলো আর ল্যাবগুলো সব ছুটি। ম্যাথ কম্পিটিশনে বিজয়ীদের সংবর্ধনা আর পুরস্কার দেওয়া হবে। অংশগ্রহকারীদেরও উৎসাহ পুরস্কার দেওয়া হবে। তারপর হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্লাস নাইনের একটা গ্রুপ তাদের নতুন হলোগ্রাফিক মুভি দেখাবে।

এই সাজো সাজো রবের মধ্যে কিন্তু তৃণার মন পড়ে থাকে অন্যত্র। বারে বারে মনে হয়, মা কি এসে গিয়েছেন বাবাকে নিয়ে? বাবা কেমন আছেন? গিয়েই বাবাকে দেখতে পাবে?

খুব সুন্দর করে মঞ্চ সাজানো হয়েছিল। গ্লোবাল ম্যাথ কমিটির পক্ষ থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা অনেক উৎসাহসূচক কথাবার্তাওয়ালা ভাষণ দিলেন একে একে। তারপরে পুরস্কার বিতরণী ইত্যাদি হয়ে যাবার পর সেই মুভি দেখানো হল। এই পুরো সময়টা উচাটন মন নিয়ে ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে গেল তৃণা। যেখানে যেখানে হাসতে হয়, যান্ত্রিকভাবে হাসছিল। যেখানে যেখানে ওকে কিছু বলতে হল, তাও বলল একেবারে নিয়ম মেনে।

মঞ্চে মুভি চলার সময় যখন ওরা দর্শকাসনে, পাশে ছিল বিষাণ। সে একবার একটু হেসে বলল, “তোর এত টেনশন কীসের আজ? সর্বক্ষণ কেমন শক্ত হয়ে ছিলি। আরে রিল্যাক্স কর। আজকে তো তোর আনন্দ করার দিন।”

তৃণা একটুখানি হাসল শুধু, কিছু বলতে পারল না। মুভিটাও ভালো মতন মন দিয়ে দেখতে পারছিল না, বারে বারে মন চলে যাচ্ছিল বাড়িতে। ওরই মধ্যে হঠাৎ একবার মনে হল ছুটির পর ওদেরও মুভি তৈরির প্রোজেক্ট নিতে হত। ও দিওতিমাকে বলেছিল রুবার গল্প নিয়ে মুভি বানাবে, ও আর দিওতিমা।

সব কেমন বদলে গেল কয়েকটা দিনের মধ্যে। দিওতিমা চলে গেল চান্দ্রেয়ীতে, কতদিনের জন্য কে জানে! সেও যাবে পিথাগোরাস ইন্সটিটিউটে, একবছরের জন্য। আর স্কুলে ফিরতে হবে না, সরাসরি কলেজে ঢুকবে ওই ট্রেনিংয়ের পর। সামান্য সময়ের মধ্যে কতই না পরিবর্তন হয়ে যেতে পরে মানুষের জীবনে!

বাড়ি ফিরে তৃণা যখন শুনল বাবাকে নিয়ে মা এসে গিয়েছেন, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারল না।

ওর বাবা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আরামকেদারায়। তৃণা একেবারে হাওয়ায় ওড়া কুটোর মতন গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার উপরে। বাবার হাঁটুর উপরে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ও কাঁদছিল একদম বাচ্চা মেয়ের মতন। যেন ও আর বারো বছরের তৃণা নেই, সেই সাত বছরের তৃণা হয়ে গিয়েছে আবার। বাবা ওর মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে আদর করতে করতে বলছিলেন, “আরে পাগলি, কী হল তোর? আমি এই তো, আমি এসেছি তো। আমার কিচ্ছু হয়নি রে সোনামণি, আমি ভালো আছি। আরে, কেন এত কাঁদছিস?”

তৃণার কান্না আরও বেড়ে যায়। সে আজ থামতে চায় না। কতদিনের জমানো কান্না, আজ এতদিন পরে সব ঝরিয়ে তবে সে শান্ত হবে।

অনেকক্ষণ ধরে তৃণা কাঁদতে থাকে আর ওর বাবা ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে যান আর কোমল গলায় নীচু স্বরে মাঝে মাঝে বলেন, “আর কাঁদে না, না, এত কাঁদতে নেই। আরে এখন তো তুই বড়ো হয়েছিস, এত্তটুকু বাচ্চার মতন এত কাঁদছিস কেন? আর কাঁদে না সোনামণি, আর কাঁদে না। তুই না আমার সাহসী মেয়ে?”

তৃণার মা ওকে সরিয়ে নিতে আসছিলেন, কিন্তু বাবা চোখের ইঙ্গিতে নিষেধ করেন।

একসময় বাবা আস্তে আস্তে বলেন, “আরে তুই না গ্লোবাল ম্যাথ কম্পিটিশনে জিতেছিস? আর না ক’দিনের মধ্যেই যাচ্ছিস পিথাগোরাস ইন্সটিটিউটে? সেই মেয়ে এরকম করে হাপুসনয়নে কাঁদছে দেখলে লোকে কী বলবে?”

তৃণা চোখের জল মুছে অবাক হয়ে তাকায়। বলে, “ত্-ত্-তুমি জানো? কী করে?”

তৃণার বাবা হাসেন। বলেন, “আরে এত বড়ো খবর জানব না? তৃষা ফোনেই তোর মাকে বলেছে তো! তারপর তোর মা আমায় জানায়।”

এরপর সারা বিকেল, সন্ধে, রাত্রিরও অনেকক্ষণ তৃণা রইল বাবার কাছে। বাবার গবেষণাকেন্দ্রে কী হয়েছে সেই নিয়ে বিস্তারিত শুনল। নিজের কথাও বলল। স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা, সব। কিছুতেই ওকে বাবার কাছ থেকে নড়ানো যাবে না জেনে খাবারদাবার মা ওদের দিলেন একসঙ্গেই। একসঙ্গে বিকেলের টিফিন আর রাতের খাওয়া খেল তৃণা আর বাবা।

অনেক গল্প-টল্প হয়ে যাবার পর শুভরাত্রি জানিয়ে যখন তৃণা নিজের ঘরে শুতে যাচ্ছে, তখন ওর মন কানায় কানায় ভরা। ও ভাবছিল, কতদিন পরে এমন এক আশ্চর্য সুন্দর সময় এল ওর জীবনে! বাবাকে এভাবে সামনে পাওয়া এত বিরল ঘটনা ওর জীবনে!

তৃণা সবচেয়ে খুশি যে বাবা এখন কিছুদিন ওদের সঙ্গে থাকবেন। প্রায় মাস খানেকের ছুটি পেয়েছেন বাবা। মানসিক ও দৈহিক বিশ্রামের জন্য। ওঁদের পরিবেশ বিশুদ্ধিকরণের প্রোজেক্টের নাম ‘অপারেশন রেইন’। সেই প্রোজেক্টের ল্যাবেই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ভাগ্যক্রমে কোনও বিজ্ঞানী দৈহিকভাবে মারাত্মক কোনও আঘাত পাননি। তবে প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে তাঁরা সকলেই বিপর্যস্ত। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে ওই প্রোজেক্টের প্রায় সব বিজ্ঞানীই এখন ছুটিতে। ওঁদের ল্যাবে অন্তর্ঘাতের জন্য যারা দায়ী, তারা প্রায় সবাই ধরা পড়েছে। কেউ কেউ নিজেরাই আত্মসমর্পণ করেছে পুলিশের কাছে। অন্তর্ঘাতী দলের নেতা নিজেই অত্যন্ত অনুতপ্ত। সে আত্মসমর্পণ করে সবার আগে। এখন ধরা পড়া ও ধরা দেওয়া সকলের মানসিক চিকিৎসা চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত ল্যাবে এখন মেরামতির কাজ চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সবাই।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে বাবার কাছে শোনা এই ব্যাপারগুলো সব মনে পড়ছিল তৃণার। মনের চোখে ভেসে উঠছিল অনেক দূরের অচেনা একটা বিশাল ল্যাব, সাদা ল্যাব-কোট পরা একদল ব্যস্তসমস্ত মানুষ, প্রত্যেকেই হয় কোনও যন্ত্র অপারেট করছেন নয়তো মন দিয়ে ল্যাব-বুকে নোট করছেন কিছু।

এই ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ আবার অন্য একটা জিনিসও মনে পড়ে গেল তৃণার। পিথাগোরাস ইনস্টিটিউট। সেখানে বড়ো বড়ো গণিতজ্ঞেরা আছেন। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই তাঁদের সামনাসামনি দেখতে পাবে তৃণা।

ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল ও। সেই রাত্রের স্বপ্নে আবার ফিরে আসে রুবা আর রুবার বাবা। ঠিক যেখানে আগের স্বপ্ন শেষ হয়েছিল, সেইখান থেকে শুরু হয়। রুবা আর তৃণা গল্প শুনছে আর রুবার বাবা গল্প বলছেন। ইলম আর ইরা নামের দুই যমজ ভাইবোনের গল্প।

রুবা বলছে, “তারপর কী হল, বাবা?”

রুবার বাবা বললেন, “তারপর? তারপর দিন যায়, রাত যায়। মাস যায়, বছর ঘুরে যায়। ইলম আর ইরার বয়স বাড়ে একবছর। তাদের আপন কেউ নেই, তারা একা। তাই তাদের মনে দুঃখ হয়, দুঃখ বাড়তে থাকে। অবশেষে একদিন ইলম ইরাকে বলে, ‘চল ইরা, কাল সকালে আমরা রওনা হই সূর্যের পাহাড়ের দিকে।’ ইরা বলে, ‘কিন্তু ও-পাহাড়ে যেতে গেলে যে আলেয়ার জলা পার হতে হয়! সেই জলায় যাওয়া বারণ যে! ওখানে আছে নীল জাদুকর, সবাইকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে পাথর করে দেয়।’ ইলম বলে, ‘তা হোক। তবু আমরা যাব। আমাদের তো কেউ নেই আপন, আমাদের ভয়টা কীসের? সূর্যের পাহাড়ে যদি পৌঁছতে পারি, আমাদের সব হারানো স্বজনদের তবে ফিরে পাব।’”

রুবার বাবা থামেন একটু। তারপরে আবার বলতে থাকেন, “ইরা রাজি হয় যেতে। খাবারদাবার, জলের পাত্র সব গুছিয়ে বোঝা বাঁধে দুটো। পরদিন খুব সকালে সূর্য না উঠতেই দুইজনে দুই বোঝা পিঠে নিয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে রওনা হয়। অত সকালে বেরোবার কারণ ছিল যাতে গ্রামের কেউ ওদের দেখতে না পায়। তাহলে হয়তো তারা যেতে দিত না।”

গল্পকথক থেমে যান। তৃণা এবার নিজেই বলে ওঠে, “তারপর কী হল?”

রুবার বাবা হাসেন একটু। তারপর গল্পের সূত্র তুলে নেন। বলেন, “সূর্যের পাহাড় সোজা পুবের দিকে। ইলম আর ইরা গ্রাম থেকে চলতে থাকে সোজা পুবে। গ্রামের সীমানা পার হয়ে বন, কিন্তু সেই বনে কাঠুরেরা আসাযাওয়া করে বলে চলাচলের রাস্তা আছে। ইরা আর ইলম বনের মধ্য দিয়ে পুবের দিকে চলে, চলে আর চলে। সূর্য উঠে পড়েছিল জঙ্গলে ঢোকার সময়ই। এখন জঙ্গলের গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দিয়ে রোদ্দুরের টুকরো পড়ে ওদের যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকে বনের পূর্বপ্রান্তে।

“বন শেষ হয় একসময়। দুপুর তখন গড়িয়ে গেছে বিকেলের দিকে। বনের পরেই বিশাল আলেয়ার জলা। দুই ভাইবোন চুপ করে দাঁড়ায় সেই জলার প্রান্তে। তারপরে ইরা বলে, ‘আজকের রাত্রিটা এখানে কাটিয়ে কাল ভোরে জলা পার হবার জন্য রওনা দিলে কেমন হয় ইলম?’ ইলম ঘাড় নেড়ে জানায় যে সেটাই ঠিক হবে।”

গল্পকথক আবার থামেন এখানে। রুবা বলে, “তারপর?”

উনি বলেন, “বনের প্রান্তের এক বিশাল গাছে উঠে সেই গাছের ডালে রাত কাটিয়ে দিল ইরা আর ইলম। পরদিন ভোরে সূর্যোদয় হলে দাঁড়াল এসে আলেয়ার জলার পাশে। নাম জলা হলেও শুকনো অংশ আছে অনেক, যদিও ডাইনে বাঁয়ে জলকাদায় ভরা বড়ো বড়ো অংশ। সেইসব ঘিরে লম্বা লম্বা সবুজ ঘাস আর সবুজ লতাগুল্মের প্রাচুর্য। ঝাঁকে ঝাঁকে জলের পাখি উড়ে উড়ে আসতে শুরু করেছে ভোর থেকেই। অনেক দূর পর্যন্ত এইরকমই দৃশ্য। আরও দূরে পূর্ব দিগন্তে ধোঁয়াটে ছবির মতন দেখা যায় সূর্যের পাহাড়ের আভাস।”

তৃণা শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করে। কল্পনায় দেখতে চেষ্টা করে দিগন্ত পর্যন্ত ছড়ানো এক রহস্যময় জলাভূমি, কিছু শুকনো মাটি আর বাকিটা জলকাদায় ভরা। আর চারদিকে হাজারে হাজারে সবুজ লতাগুল্ম, কী সতেজ, কী ঝলমলে! আর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। আহ্‌, যদি সত্যি এমন দেখা যেত!

শুনতে পায় গল্পকথক বলছেন, “ইরা আর ইলম সাহসে বুক বেঁধে জলায় নেমে পড়ল। শুকনো মাটির উপর দিয়ে জলকাদা ডাইনে বাঁয়ে রেখে ওরা চলতে শুরু করল ও-ও-ও-ই দূরের সূর্যের পাহাড়ের দিকে। পথ যাতে না হারায় তাই চলার পথের ধারের লম্বা ঘাসে দুই পাকের গিঁট দিয়ে দিয়ে যেতে লাগল একটু পরপর। চলে আর চলে। বেলা বেড়ে ওঠে। তারা ভাবে ঠিক তারা সন্ধের আগেই পৌঁছে যাবে সূর্যের পাহাড়ে। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এল নীল কুয়াশা, তাদের ঢেকে ফেলল।”

গল্পের এইখানে এসে ঘুম ভেঙে গেল তৃণার। বালিশ থেকে মাথা তুলে আস্তে আস্তে উঠে বসল বিছানায়। কোনও মানে হয়? এইখানে স্বপ্ন ভেঙে যাবার কোনও মানে হয়?

১০

ন’দিন পর। আজ তৃণাদের পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটে রওনা হওয়া। সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে পেপার ওয়ার্কগুলো সব শেষবারের মতন আরেকবার চেক করে স্পেস পোর্টে হাজির ওরা। তাদের বিদায় দিতে যার যার পরিবারের লোকেরা তো এসেছেনই, স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে অনেকে এসেছে, আর শিক্ষক-শিক্ষিকারাও অনেকে এসেছেন।

স্পেসে আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছে তৃণা আর বিষাণ, কিন্তু সেইসব বারে সঙ্গে বাবা-মায়েরা থাকতেন। এইবারে প্রথম একেবারে একা একা যাওয়া। ওদের মুখগুলো দেখে একটু একটু টেনশন বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু ওরা মোটেই সেটা প্রকাশ করতে চাইছিল না।

আউটার রিং-এ সিকিউরিটি চেকিং হয়ে যাবার পর স্বজনবন্ধুদের কাছে বিদায় নেবার পালা। তৃণা ওর বাবার কাছে এসে আস্তে করে বাবার হাতটা ধরল। কথা বললেই কান্না ধরা পড়ে যেতে পরে বলে ও চুপ। কিন্তু চোখ দুটো ছলছল করছে। ওর কেবল মনে হচ্ছিল, এতদিন পর বাবা এল এতদিনের ছুটি পেয়ে, তার কয়েকটা দিন মাত্র একসঙ্গে কাটাতে না কাটাতেই কিনা ওর নিজের চলে যাবার সময় এসে পড়ল?

বাবা ওর চুল ঘেঁটে দিয়ে বললেন, “পাগলি, মনখারাপ করছিস? আরে আমরা তো ক’দিন পরেই যাব তোকে দেখতে। তৃষার ছুটি পড়ার পাঁচদিন পরই আমরা তিনজন যাব চাঁদে। টিকিট তো করাই আছে। এই ক’টা দিন পরেই তো!”

পাশেই মা আর তৃষা দাঁড়িয়ে। মা বলেন, “হ্যাঁ, তাই তো। মনখারাপ করিস না। ক’দিন পরেই দেখা হবে আবার।”

তৃষা কিছু বলে না, নীরবে শুধু হাত রাখে তৃণার কাঁধে।

ঘিরে থাকা আপনজনদের মধ্যে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তৃণার মনে পড়ে সুরথের কথা। সে তো এইখানে আসতে পারে না, সে বসে আছে পার্কিং লটে পার্ক করে রাখা উড়নযানের মধ্যে। হঠাৎ ধাতব রোবটটিকেও খুব আপনজন বলে মনে হয় তৃণার। কতদিন পর আবার ওকে দেখতে পাবে? ছুটিতে বেড়াতে আসা কি আর হবে না একবছরের মধ্যে একবারও?

ওর চিন্তাজাল ছিঁড়ে যায়, শিক্ষক-শিক্ষিকারা কাছে এগিয়ে এসেছেন ওকে বিদায় জানাতে। অনেক উৎসাহসূচক ভালো ভালো কথা বলে তাঁরা সাহস সঞ্চার করে দিলেন ওর মধ্যে।

এইবারে গোটা দল থেকে বিদায় নিয়ে গেট পার হয়ে ঢুকে পড়ছে তৃণা আর বিষাণ, সঙ্গে ট্রলিতে যার যার লাগেজ। স্বচ্ছ দেয়ালের বাইরে থেকে সবাই হাত নাড়ছে। ওরাও হাত নাড়ল।

তারপরই আরেকটা দরজা দিয়ে লম্বা করিডরে পড়ল, সেই পথের শেষে ইনার সিকিউরিটি চেকিং-এর জায়গা। এখান থেকে আর বাইরের কাউকে দেখা যাবে না, চারদিকেই অস্বচ্ছ দেওয়াল।

তৃণার দিকে চেয়ে নার্ভাসভাবে হেসে বিষাণ বলে, “তাহলে সত্যি সত্যি যাচ্ছি আমরা?”

তৃণা হাসে। বলে, “এখনও তোর সন্দেহ আছে নাকি?”

সিকিউরিটির একজন কর্মী এসে জানান যে এখনই চেকিং হবে। ওরা সব নিয়ে ওঁর সঙ্গে যেন চলে। ওরা চলতে থাকে। চেকিং-এর পরে লাগেজ-টাগেজ সব যখন চলে গেল স্পেস শিপের মধ্যে, তখন বোর্ডিং কার্ড হাতে তৃণা আর বিষাণ গিয়ে বসল অপেক্ষা করার ঘরে। সেখানে প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের অপেক্ষা। আরামদায়ক সিটে বসে কেমন ঘুম পেয়ে যায় তৃণার। টেনশনের জন্য আগের রাতে ঘুমই হয়নি। কিন্তু ঘুমোলে চলবে না, সে জানে। এখানে রুবার স্বপ্ন এসে পড়লে মুশকিল।

রুবাকে মনে পড়তেই মনে পড়ে গেল সেই ইরা আর ইলমের গল্প। একটা স্বপ্নের শেষে ওরা নীল কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর আবার অন্য এক রাতের স্বপ্নে ওদের গল্পটা আরও কিছুটা শুনেছিল তৃণা। ওই নীল কুয়াশার মধ্যে পথ হারিয়ে ওরা যখন দিশেহারা, তখন ঝকমকে রুপোলী ডানার এক পাখি ওদের পথ দেখিয়ে দেখিয়ে বার করে এনেছিল কুয়াশার ভিতর থেকে। কুয়াশা থেকে বেরিয়ে ওরা দেখেছিল সামনেই রোদ্দুরে ঝলমল করছে সূর্যের পাহাড়। ওরা পর্বতারোহণ শুরু করেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তারপরে আর দেখতে পায়নি। কে জানে আবার কবে স্বপ্নে আসে ওরা।

পাশের সিট থেকে বিষাণ বলে, “কী রে তৃণা, ঘুম পাচ্ছে নাকি তোর?”

তৃণা হেসে বলে, “হ্যাঁ, ঘুম পাচ্ছে। স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর সেই ময়ূরের স্বপ্নটা।”

বিষাণও হাসে। এই কয়েকদিনের মধ্যেই সে অনেক বদলে গিয়েছে। মুখ থেকে বিষণ্ণতা মুছে গিয়ে হাসিখুশি হয়ে উঠেছে। বিষাণ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আর সেই ছোট্টো ছোট্টো ছেলেমেয়েরা? তাদের দেখবি না?”

তৃণা বলে, “তুই এখনও ওদের স্বপ্নে দেখিস নিয়মিত?”

বিষাণ মৃদু গলায় বলে, “হুঁ, দেখি। একদম চলতে থাকা ঘটনার মতন। ওই ছোট্টো ছোট্টো ছেলেমেয়েরা এখন একটু বড়ো হয়েছে। আর সেই ময়ূরের দলও অনেক বদলে গেছে। নতুন অনেক ময়ূরছানা জন্মেছে, ছানাগুলো ওদের মায়েদের সঙ্গে ঘোরে।”

তৃণা বলে, “আমিও দেখি, অন্য একটা স্বপ্ন। একেবারে গল্পের মতন। ভেবে দ্যাখ, সেই আমরাই গ্লোবাল ম্যাথ কম্পিটিশনে জিতে সোজা যাচ্ছি পিথাগোরাস ইনস্টিটিউটে। স্বপ্ন-গল্পের কথা বড়োরা জেনে ফেললে আর রক্ষা ছিল? হয়তো এতদিনে পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যেত আমাদের। হয়তো এখন কোথাও চিকিৎসা চলত। দিওতিমার ক্ষেত্রে যা হল।”

বিষাণ ফিসফিস করে বলে, “দিওতিমার সঙ্গে দেখা করতে হবে আমাদের। তুই তো বলেছিস ও চান্দ্রেয়ীতে। পিথাগোরাসে কিছুদিন কাটানোর পর সেখানকার সব অন্ধিসন্ধি নিয়মকানুন বুঝে নিয়ে তারপর একদিন যেতে হবে চান্দ্রেয়ীতে। উদ্ধার করতেই হবে ওকে আর ওদের মতন আরও অনেক ছেলেমেয়েকে।”

তৃণা দৃঢ় গলায় বলে, “হ্যাঁ, করতেই হবে। করতেই হবে। তাভামের ভাইও মনে হয় ওই রিহ্যাবেই আছে। ওদের মতন আরও অনেক ছেলেমেয়ে আছে ওখানে। ওদের স্বপ্নগুলো সব ধুয়েমুছে যাবার আগেই ওদের উদ্ধার করতে হবে। যদিও জানি না কীভাবে, কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে যে আমরা পারব।”

বিষাণ হাত বাড়িয়ে দেয়। তৃণাও হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের হাত দুটো দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে পরস্পরকে। তারা পরস্পরের দিকে চেয়ে নীরবে হাসে। নীরবতার মধ্যেই ওদের প্রতিজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়।

এদিকে সময় হয়ে গিয়েছিল। বোর্ডিং কার্ড হাতে আরেক লম্বা করিডরের মধ্য দিয়ে এবারে সোজা স্পেস শিপের ভেতরে।

তার কিছুক্ষণ পর তীব্রবেগে স্থায়ী, ঘন, পুরু মেঘ ভেদ করে যখন স্পেস শিপ সোজা উঠে যাচ্ছে মহাশূন্যের দিকে, তখন তৃণার মনে হচ্ছিল তারা সূর্যোদয়ের দিকে যাচ্ছে। অন্ধকার পার হয়ে আলোর দিকে যাচ্ছে। হতাশা পার হয়ে আশার দিকে। একদিন ফিরে আসবে সবুজ পৃথিবী, একদিন ফিরে আসবে নীল আকাশ। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরেও নয়। চোখ বন্ধ করে তৃণা প্রার্থনা করছিল, ‘অন্ধকার থেকে যেন আলোয় যেতে পারি আমরা সবাই। সব দুঃখ পার হয়ে যেন আনন্দভুবনে যেতে পারি আমরা সবাই।’

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a comment