উপন্যাস- বিষচক্র-শ্যামলী আচার্য -শরৎ ২০২২

uponyasbishachakratitle

“মাথাটা একটু সরা।”

রিমঝিমের কথায় মিনি ঘাড় হেলিয়ে দিল।

“আহ্‌, ওইদিকে নয়, ডানদিকে সরা।”

মিনি ডানদিকে সরে গেল একটু। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিমঝিম উশখুশ করতে লাগল,“মাথাটা একটু ঠিক করে রাখ না। এত নাড়াচ্ছিস, আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না!”

মিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রিমঝিমের দিকে। খুব বিরক্ত,“আমার মাথাটা খুলে এবার বিছানার পাশে রেখে দিই বরং। তুই ভালো করে দেখ। একবার আমাকে ডানদিকে সরাচ্ছিস, একবার বাঁদিক… কী আরম্ভ করেছিস তুই?”

বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে দুজন। ল্যাপটপ খোলা। দুজনেই গভীর মনোযোগ এবং প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছে। ইন্টারনেট থেকে আজকাল সামান্য আঙুলের ছোঁয়ায় বিশ্বসংসারের যাবতীয় ইনফো পাওয়া যায়। সেই কুটিকুটি করে লেখা পাতাগুলো একসঙ্গে পড়ছে দুজন। প্রবল আগ্রহের চোটে কে আগে পড়বে, কে আগে বুঝবে আর কে আগে পরের পাতায়, মানে স্ক্রোল করে পরের লাইনে যাবে তাই নিয়ে ঠেলাঠেলি।

মিনির বিরক্তিতে অন্য সময় মজা পায় রিমঝিম। মিনি অল্পতেই চটে যায়। আর ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে। আজ রিমঝিম ধুপ করে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে,“ধুস, এত তাড়াতাড়ি পড়তে পারছি না। পড়ে নে তুই আগে। আমাকে হোয়াটস-অ্যাপে লিঙ্কটা পাঠিয়ে রাখিস। পরে সময়মতো দেখে নেব।”

মিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। যে-কোনোরকম স্টাডি সে একা একা নিরিবিলিতে করতে পছন্দ করে। এটা নেহাত কমন ইন্টারেস্ট, তাই দুজনে একসঙ্গে বসেছিল,“তুই একটু গান শোন ততক্ষণ। কিন্তু প্লিজ ভাই, কানে হেডফোন গুঁজে শুনবি। আমি জাস্ট এক ঝলক পড়ে নিই দাঁড়া।”

মিনি কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে মন দেয়। অ্যাভেঞ্জার্স মুভি সিরিজ নিয়ে এখন ওদের জোরদার তথ্য জোগাড় করা চলছে। ক্যাপ্টেন আমেরিকা, আয়রন ম্যান আর অ্যান্ট ম্যান নিয়ে আপাতত প্রচুর পড়া বাকি। তাদের কী কেন কবে কোথায় নিয়ে একটু আপডেট করে ঝালিয়ে নেওয়া চলছে। বাইশটা মার্ভেল মুভিজ নিয়ে বিশদে না জানলে ওদের আর চলছে না। সবক’টা সিনেমা তো আর দেখা সম্ভব নয়। ওরা এখনও অবধি হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র দেখেছে। এতদিন পরীক্ষা আর পড়াশোনার ঠেলায় প্রাণ ওষ্ঠাগত ছিল। এখন এই ছুটিতে বসে যতটুকু যা জানা যায়, দেখা যায়। রিমঝিম হাল্ক, থর আর ব্ল্যাক প্যান্থার সম্পর্কে আগে জানতে চাইছিল। মিনি ওকে কোনোরকমে থামিয়ে ক্যাপ্টেন আমেরিকাকে নিয়েই সার্চ করে চলেছে। যে-কোনো বিষয় মিনি খুঁটিয়ে পড়তে চায়। এটা ওর চিরকালের স্বভাব।

মিনির বাবা ঘরে এসে ঢুকলেন,“মিনি, ওই যে সেই কচ্ছপগুলো, কী যেন নাম বলেছিলি, অলিভ অয়েল না কী যেন, ওরা কবে সমুদ্রের পাড়ে ডিম পাড়তে আসে রে? আমরা গিয়ে ওদের দেখতে পাব?”

মিনির বাবা সুরঞ্জনবাবু ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। কিন্তু রাশভারী অধ্যাপকসুলভ ব্যাপারটা ওঁর মধ্যে নেই। চরম রসিক মানুষ। ওঁর কথায় মিনি কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরায় না। কিন্তু রিমঝিম হেসে গড়িয়ে পড়ে,“ও কাকু, ওটা অলিভ অয়েল নয় গো। অলিভ রিডলে। অলিভ গ্রিন রঙের খোলস, তাই কচ্ছপগুলোর অমন নাম।”

“রিমঝিম, প্লিজ তোর কাকুকে বল, ওরা ডিম পেড়ে এতদিনে ছানাপোনা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। ওরা সাধারণত মার্চ মাসে আসে। এটা এপ্রিল চলছে। আর আমরা রুশিকুল্যা যাচ্ছি মে মাসে।”

মিনির গম্ভীর গলাকে পাত্তাই দিলেন না তার বাবা সুরঞ্জনবাবু,“এ বাবা! চলে গেল! হায় হায় হায়। সো স্যাড! তাহলে আর রুশিকুল্যা গিয়ে কী হবে? যাই দেখি উড়িষ্যার সমুদ্রে অন্য কোনও কিছু দেখার মতো পাওয়া যায় কি না।”

সুরঞ্জনবাবু আড়চোখে মিনির দিকে একবার দেখেন। মিনি অল্পেই চটে যায়, কিন্তু তার বাবা তাকে বন্ধুদের সামনে খেপিয়ে মজা পান, এটা মিনি একদম পছন্দ করে না,“বাবা শোনো, আমরা একটা প্রচণ্ড জরুরি পড়াশোনা করছি। আজ তোমার অফ-ডে বলে আমাদের প্লিজ জ্বালিও না।”

“এই রে! না না, আমি তোদের একদম বিরক্ত করছি না। তোদের তো সমস্ত পড়াশোনাই নোবেল লরিয়েটদের লেভেলে। আমি আসলে ওই বেড়ানোর প্ল্যানটা করছিলাম। তাই তোদের কাছে একটু জাস্ট জানতে এলাম। তাহলে অলিভ গ্রিন কচ্ছপরা এর মধ্যেই বাড়ি চলে গেছে বলছিস? ঠিক আছে, আমি বরং মে মাসে চাঁদিপুরের সমুদ্রে ডলফিনের ওয়াটার পোলো কিংবা গোপালপুর অন সিতে তিমির সান বাথ দেখা যাবে কি না একটু খোঁজ নিই।”

সুরঞ্জনবাবু মুচকি হেসে হাওয়াই চটিতে একটু বেশ জোরেই শব্দ করে পাশের ঘরে চলে গেলেন। শোনা গেল তিনি নিজস্ব সুরে গাইছেন, ‘সে যে চলে গেল, বলে গেল না’।

রিমঝিম তখনও শুয়ে শুয়ে হেসে চলেছে। মিনি গম্ভীর হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে অ্যান্ট ম্যানের ছবির দিকে।

মিনি আর রিমঝিম, দুজনেরই এখন অবসর। সবে ক্লাস টুয়েলভের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। কলকাতায় এখনও গরম পড়েনি তেমন। দুপুরগুলো বড্ড লম্বা। কাটতেই চায় না। একই হাউজিং কমপ্লেক্সে থাকে মিনি আর রিমঝিম। ছেলেবেলা থেকে একই স্কুলের একই ক্লাসেই পড়ে। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ অবধি একসঙ্গে স্কুলবাসে যাওয়া-আসা, একই অঙ্ক স্যারের কাছে অঙ্ক করা, একসঙ্গে সাঁতারের পুলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার শেখা, নাচের ক্লাসে যাওয়া… গভীর বন্ধুত্বের প্রায় সবক’টা শর্ত তারা পূরণ করে ফেলেছে। কিন্তু প্রচুর মিলের সঙ্গে তাদের আবার প্রচুর অমিলও বটে। আসলে সেটাও তো বন্ধুত্বের জন্য জরুরি। রিমঝিম যেমন ক্যারাটেতে ব্ল্যাক-বেল্ট, মিনি ওইসব মারপিটের ধারেপাশেই নেই। মিনি আবার অবিশ্বাস্যরকম গল্পের বই পড়ে; রিমঝিমের বইপত্র দেখলেই গায়ে জ্বর আসে। রিমঝিম পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়ে ঠিক উতরে দেয় শেষ মুহূর্তে; মিনি পড়াশোনায় ভীষণ সিরিয়াস, দারুণ রেজাল্ট করে। দুজনের ভারি বন্ধুত্ব।

অবশ্য বন্ধুত্ব শুধু ওদের দুজনের নয়। বন্ধুত্ব আসলে ছ’জনের। রিমঝিম, মিনি, কাজু, তিতাস, আরশি আর তিতলি। ডাকনামগুলো সহজ বলে ওরা নিজেরা নিজেদের ডাকনামে ডাকে। ওদের ভালো নামগুলো আসলে ভীষণ কঠিন। খুব বড়োসড়ো আর শক্ত খটোমটো বানান। তাই স্কুলের গণ্ডির মধ্যেও নিজেরা নিজেদের সহজ নামগুলোই চালু করে নিয়েছে। ক্লাস টেন অবধি সবাই একই সেকশনে পাশাপাশি কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকলেও ইলেভেনে উঠে সায়েন্স, আর্টস আর কমার্সে ভাগ হয়ে গেল ওরা। মিনি আর আরশি চলে গেল বিজ্ঞান পড়তে। বাকিরা পড়ল আর্টস। তাতে অবশ্য বন্ধুত্বের কিছুমাত্র কমতি হল না। এই বারো বছর ধরে ওদের বাবা-মায়েদের মধ্যেও এত গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে যে ওরাও আর নিজেদের আলাদা ভাবতে পারে না। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, হইচই, বেড়ানো, পিকনিক, জন্মদিনের হুল্লোড়—সবই দলবেঁধে।

এই ক’দিন পরেই যেমন সবাই মিলে গোপালপুর যাবার প্ল্যান করা হয়েছে। চাঁদিপুর, গোপালপুর, রম্ভা, চিল্কা যাওয়া হবে সদলবলে। সব মিলিয়ে প্রায় দিন দশেকের লম্বা ট্যুর। প্রায় দু-বছর পরে সকলে মিলে বেশ দূরে বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে। তাই নিয়েই এখন রোজ ফোনালাপ। বাবাদের গ্রুপ চ্যাটে ট্রেনের টিকিট কাটা, রুম বুক করা, খাওয়া আর ঘোরার প্ল্যান। কেজো কথাই বেশি। মায়েরা প্রচণ্ড ব্যস্ত কী কী ড্রাই ফুড নেওয়া হবে, তার ব্যবস্থায়। আর সিক্স মাস্কেটিয়ার্স মেতে আছে গান আর ফিল্মের স্টক বাড়াতে। কিছু তারা ফোনে ডাউনলোড করে নিয়ে যাবে। বাবা-মায়েরা পারমিশন দিয়েছেন বেড়াতে গিয়ে ওরা ছ’জন একটা ডবল রুমে সারাদিন থাকতে পারবে। রাত্তিরেও হোটেল থেকে পারমিশন দিলে ছয় কন্যা একসঙ্গেই ঘুমোবে না-হয়। সব মিলিয়ে একটা হইহই উত্তেজনা আর দিনরাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানান পরিকল্পনা।

এর মধ্যেই রিমঝিম আর মিনি আপাতত অ্যাভেঞ্জার নিয়ে রিসার্চে মশগুল।

বাড়ির সামনের সরু গলিটাতে কোনও গাড়ি ঢোকে না। ফলে বাড়িতে নিজেরা আর কোনও গ্যারাজ বানাননি জয়ন্ত। নিজেদের গাড়িটা তাঁরা গলির ঠিক বাইরে তৈরি হওয়া নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির নীচের গ্যারাজে রাখেন। সেখানে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের গাড়ি ছাড়াও পাড়ার আরও বেশ কয়েকজনের গাড়ি রয়েছে। ফ্ল্যাটে একজন কেয়ারটেকারও রয়েছে। একটা পুঁচকে ঘরে সে একাই থাকে। সে বলে, নেপালে তার বাবা-মা বৌ-ছেলে সবাই রয়েছে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে। এখানে একচিলতে ঘরে বন্দি থাকতে তার প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে।

মধ্যবিত্ত পাড়া। আগে অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল চারদিকে। ছোটো ছোটো বাড়ি। অনেক গাছপালা। ফাঁকা মাঠ। আসলে ঠিক মাঠ নয়, ফাঁকা ফাঁকা সব জমি বেওয়ারিশ পড়ে ছিল চারপাশে। বাড়ি হয়নি তখনও। ওই জমিগুলোতে ছুটোছুটি খেলাধুলো চলত। ওগুলোকে আরশি, পুশ আর দীপু মাঠ বলেই জানত। দোলের আগের দিন শুকনো ডালপালা জড়ো করে ওরা ন্যাড়া পোড়াত। দোলের দিন পাড়ার অলিগলি ঘোরা ছাড়াও ওই ফাঁকা জমিগুলোতে দলবেঁধে হুটোপাটি চলত অনেকক্ষণ। বিকেলে ছুটোছুটি, ব্যাডমিন্টন, শীতের দুপুরে রুমাল-চোর, ওদের সাইকেল শেখা… ওই খোলা জায়গাগুলো ছিল ওদের নিশ্বাস নেবার জানালা। ওরাও বড়ো হয়ে যেতে লাগল। একটু একটু করে ফাঁকা জমির অনেকগুলোই কখন যেন হারিয়ে গেল। বড়ো বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি ফাঁকা জায়গাগুলো টপ করে কবে গিলে খেয়ে নিয়েছে। তবু দু-চারটে ফাঁকা জায়গা এখনও এদিক-সেদিকে অবশিষ্ট আছে। তার মধ্যে একটা টুকরো জয়ন্তবাবুর বাড়ির ঠিক পিছন দিকটায়। সেখানে এখন কতগুলো উটকো ছেলেপুলে এসে বসে সন্ধে হলেই। অচেনা। তারা কেউ এই পাড়ার নয়। কয়েকদিন জয়ন্তবাবু দেখেছেন। কিন্তু কিছু বলেননি। ছেলেপুলেরা এসে বসে আড্ডা মারতেই পারে। এটা মোটেই দোষের কিছু নয়।

সমস্যা হল কয়েকদিন পরে। অফিস যাবার সময় গাড়ি বের করতে গিয়ে দেখলেন গাড়ির কাচে স্ক্র্যাচ পড়েছে। খটকা লাগল। এমন তো হবার কথা নয়। গ্যারাজে গাড়ির ওপর কভার লাগানো। গ্রিলের বড়ো গেটে তালা। গ্রিল টপকে কেউ ভেতরে ঢুকবে, সেই উপায় নেই। ভেতরে কেয়ারটেকার রয়েছে। সে যথেষ্ট সজাগ। তাহলে কাচে এমন দাগ পড়বে কেন? কেউ যেন কাচটা ভেঙে ফেলতে চেয়েছে, এমন একটা ঠোকার দাগ। অবশ্য মনের ভুলও হতে পারে। গতকাল অফিসে সামনে কার পার্কিংয়ে হয়তো কোথাও হয়েছে। তখন সেভাবে চোখে পড়েনি। নানারকম সম্ভাবনা ভেবেও অফিসের তাড়াহুড়োতে আর বেশিক্ষণ সব কার্যকারণ গুছিয়ে মাথায় রাখতে পারলেন না জয়ন্তবাবু।

আরশির স্কুল ছুটি। বাড়িতে বসে তার কাজ স্কেচ করা। এটা তার ভীষণ পছন্দের নেশা। এখন এই বিরাট অবসরের সে চুটিয়ে সদ্ব্যবহার করছে। বাড়ির পুরোনো অ্যালবাম ঘেঁটে সাদা-কালো ছবি দেখে দেখে খাতায় আঁকছে। মূলত পেনসিলেই স্কেচ করে সে। কখনও ল্যান্ডস্কেপ, কখনও ফিগার। দেখে দেখেই আঁকে। আজ যেমন সকাল থেকে বাবার একটা ছেলেবেলার ছবি দেখে দেখে আঁকছিল। এবার বাবার জন্মদিনে এটা বাবাকে দেখিয়ে চমকে দেবে সে।

মা স্কুলে বেরোনোর সময় ওর ঘরে ঢুকলেন একবার,“আরশি, দুপুরের খাবার রেখে গেলাম। টেবিলে সব ঢাকা আছে। খাওয়ার আগে একবার মাইক্রোওভেনে গরম করে নিস কিন্তু।”

আরশি অন্যমনস্কভাবে বলে, “হুম।”

“জানিস, গ্যারাজে অভ্রদের গাড়ির কাচটা ভাঙা। কী করে যে হল, ওরা বুঝতেই পারছে না।”

সকালবেলায় অফিস যাওয়ার সময় বাবা গাড়ি নিয়ে কী যেন বলছিলেন। আরশি নিজের ঘরে বসে ছবি আঁকছিল। মন দেয়নি। মায়ের কথায় ছবি থেকে মুখ তুলে তাকাল,“তুমি কী করে জানলে মা?”

“একটু আগে অভ্রর মা ফোন করেছিলেন। উনি খুব ভয় পেয়ে গেছেন। সকালে গাড়ি বের করতে গিয়ে দেখেন এই কাণ্ড।”

“বাবাও তখন কী একটা বলছিল না?”

“হ্যাঁ। আমাদের গাড়ির কাচেও একটা বড়ো স্ক্র্যাচ পড়েছে। অভ্রর মায়ের ফোন পেয়ে তারপরেই তোমার বাবাকে অফিসে ফোন করলাম। খুবই চিন্তার ব্যাপার। কেয়ারটেকার বলছে, সে কিছুই জানে না। তাহলে ফ্ল্যাটের তলায় গ্যারাজে ঢুকে কে এসব করল? আর কেউই কিচ্ছু টের পেল না? অদ্ভুত ব্যাপার!”

আরশি মায়ের সঙ্গে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল। একতলা ছোট্ট বাড়িটিতে সারা দুপুর এখন একাই থাকবে সে। মা স্কুল থেকে না ফেরা পর্যন্ত গ্রিলের গেটে তালা দিয়ে, কোলাপসিবল গেট টেনে বন্ধ করে তাতেও তালা লাগিয়ে রাখে আরশি। সদর দরজা চেপে বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে ঘরে চলে যায়। এখন বহুক্ষণ সে একা এবং স্বাধীন। ছবিটা মন দিয়ে শেষ করে ফেলবে।

কালির পেন দিয়ে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি একটা সাদা কাগজে বসে বসে উড়োজাহাজের প্রাথমিক মডেল এঁকে রাখছেন। ভবিষ্যতে ওটা দেখেই তৈরি হবে আকাশে ওড়ার যন্ত্র—এরোপ্লেন। আরশি বাবার ছেলেবেলার ছবিটা দেখে কাগজে পেনসিলের হালকা শেড দিতে দিতে ভাবছিল বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে এইরকম মডেল যদি সে একটা বানাতে পারত!

জানালার বাইরে বাড়ির পিছনের জমিটা এখনও ফাঁকা। পাঁচিল নেই। এলোমেলো ঝোপঝাড় জন্মেছে। একটা বিরাট বড়ো জামগাছ। জামগুলো বড্ড ছোটো আর কষাটে বলে পাখিরা ছাড়া কেউ খায় না। আরশিদের বাড়ির চারদিকেও অনেক গাছপালা। তার মধ্যেই ছোট্ট গাঢ় হলুদ একটা বেনেবউ পাখি মাথায় একটা কুচকুচে কালো টুপি এঁটে বসে তীব্র শিস দিচ্ছে। ওটাই ইষ্টিকুটুম সুরে ডাকে। এই ছবিটা স্কেচ করতে গেলে শুধু পেনসিলে হবে না। সেই এফেক্টই আসবে না। সবুজ গাছের ঝুপসি আঁধারে ঝলমলে হলুদ পাখির কম্বিনেশনের জন্য রঙ চাই। প্যাস্টেল, ক্রেয়ন, জলরঙ, তেলরঙ—এতগুলোর মধ্যে কোন মিডিয়মে ছবিটা ভালো খুলবে ভাবতে-ভাবতেই লোকটাকে দেখতে পেল আরশি। একদম ভবঘুরে প্যাটার্নের। উলোঝুলো জট পড়া চুল। গায়ে একটা শতচ্ছিন্ন নোংরা জামা। জামাটা দূর থেকে দেখেই বিটকেল গন্ধ নাকে আসছিল যেন। কাঁধে একটা ঝোলা। সাধারণত ডাস্টবিন ঘেঁটে অনেক কিছু কুড়িয়ে বেড়ায় এরা। কিন্তু এই ফাঁকা জমিতে তো শুধু বড়ো বড়ো ঘাস, আগাছা আর বুনো ঝোপ। এর মধ্যে কী খুঁজছে লোকটা? দেখে মনে হচ্ছে যেন আতিপাতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছে কোনও হারিয়ে যাওয়া অমূল্য বস্তু।

সাদা আর্ট পেপারে বাবার ছবি সরিয়ে লোকটাকে স্কেচ করতে শুরু করল আরশি। রাফ স্কেচ। লোকটাকে একবার পিছন থেকে, একবার পাশ থেকে। এক ঝলক সামনে থেকে দেখে একমুখ দাড়িগোঁফের আড়ালে উসকোখুসকো চুল ছাড়া অবশ্য তেমন আর কিছু বোঝা গেল না। কিন্তু লোকটা অত কী খুঁজছে? আরশি জানালার পর্দার আড়ালে চলে গেল চট করে। ও যেন ঠিক পাগলাটে নয়, ভবঘুরে তো নয়ই। ময়লা খোঁজার ভান করে যেন অন্য কীসের অনুসন্ধান করছে। আরশি ওর দিকে তাকিয়েই মাথার মধ্যে গেঁথে নিতে থাকল ওর শরীরের সবক’টা বৈশিষ্ট্য—একটা ছবি আঁকতে গেলে যেগুলো একটা মানুষকে নিখুঁত করে গড়ে তোলে। ছবিটাকে একদম সেই মানুষ বলেই চেনা যায়।

অস্বস্তি ছিলই। লোকটা অনেকক্ষণ ছিল ওই জায়গাটায়। ঝোপঝাড় সরিয়ে কেবল দেখছিল। তারপর একবার বসল জামগাছের ছায়ায়। এদিক সেদিক অলসভাবে তাকাচ্ছিল। যেন ভীষণ উদাসীন দৃষ্টি। কিন্তু ওই চোখে আরশি তৎপরতা দেখেছে। চট করে চোখ বুলিয়ে লোকটা চারপাশ দেখে নেয়। আরশিদের বাড়ির দিকেও তাকিয়েছে। জানালা খোলা ঠিকই, কিন্তু পর্দা টানা। আরশি ঘরের ফ্যান বন্ধ করে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। ওর কৌতূহলী মন বলে দেয়, লোকটা দু-একবার অসাবধান হবেই। আর ঘটলও তাই। লোকটা ভালো করে চারদিকে তাকিয়ে পকেট থেকে বিড়ি বের করে ধরাল। আরশি স্পষ্ট দেখল, ওর বিড়ির প্যাকেটটা নতুন। আর লোকটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে লাইটার দিয়েই বিড়িটা ধরাল। চট করে লাইটারটা আবার চালান করে দিল পকেটের মধ্যে। লোকটা হয়তো রোজ বিড়ি খায় না, কিন্তু নেশা করে। তাই ওর কাছে লাইটার রয়েছে। সিগারেট ধরালে লোকে হয়তো সন্দেহ করবে, তাই বিড়ির নতুন বান্ডিল কিনে নিয়ে এসেছে।

আরশি প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দেখল লোকটা চুপ করে বসে আছে। ওর আরও খানিকক্ষণ লোকটাকে দেখার ইচ্ছে ছিল। ইতিমধ্যে জানালার সামনে পর্দার আড়ালে পড়ার টেবিলের কোনায় চেয়ার নিয়ে বসে সে লোকটার গোটা তিনেক রাফ পোর্ট্রেট এঁকে ফেলেছে। মোবাইলে মায়ের ফোন আসায় স্নান-খাওয়ার জন্য জানালার কাছ থেকে সরতেই হল। সেই সময়ের মধ্যেই লোকটা কখন যেন চলে গেছে। আরশি স্কেচগুলো যত্ন করে গুছিয়ে রাখল ডেস্কের মধ্যে।

***

“আরশি, একটা ব্যাড নিউজ আছে রে!” সন্ধেবেলাতেই কাজুর ফোন।

“কী হয়েছে রে?”

“বান্টা মিসিং।”

“মিসিং মানে?”

“আরে, মিসিং মানে মিসিং। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ নীনা-আন্টি ফোন করেছিলেন মাকে। এই তো একটু আগে। মা আমায় বলল। আমি ফোন করছি সকলকে। তোকেই জানালাম আগে।”

“আরে ডিটেলে তো বল।”

“আরে ডিটেলস জানলে তো বলব! দাঁড়া আগে তিতাস, মিনি, রিমঝিমদের বলি। আফটার অল, আমরা বান্টাকে এখনও এত মিস করি। কী যে হল ওর! এই, রাখছি। পরে কথা বলছি। বাই।”

টুক করে ফোনটা কেটে দিল কাজু। এই ওর দোষ। বড্ড তড়বড় করে। আরে বাবা, তুই পুরো খবরটা নিজেই জানিস না যখন, তখন সেটা জনে জনে আগ বাড়িয়ে ফোন করে জানিয়ে কী হবে? আরশির মনে হল, এইভাবেই আসলে গুজব ছড়ায়।

এই জায়গাটা রুমেলার একদম পছন্দ হয়নি। গত পরশু থেকে ওকে এই বাড়িটার মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে। এখন কিছুদিন ওকে নাকি এখানেই থাকতে হবে। ঘরে রঙচটা দেওয়াল—চুন-বালি খসে পড়ছে। পুরোনো বাড়ি রুমেলা এর আগেও অনেক দেখেছে। ওদের নিজেদের ভাড়াবাড়ির একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরটাও পচা, একটুও ভালো নয় ঠিকই, কিন্তু এই বাড়িটা তার চেয়েও খারাপ।

এই বাড়িটাতে অনেক ঘর। আরও অনেক মেয়েরা আছে। নানান বয়সের। কাল সন্ধেবেলা সবাই প্রার্থনা-সংগীত গাইছিল। রুমেলা চুপ করে বসে ছিল একপাশে। গানের শুরুর শব্দে ওরা বলছে আনন্দলোকে। ওই গানটা ও জানে না। শোনেইনি কখনও। ওদের ইস্কুলে গান হত না কখনও। গত সপ্তাহে শেষ যেদিন স্কুলে গিয়েছিল, সেদিন দুপুরে সয়াবিন, আলু আর ডিম দিয়ে ঝোল রান্না হয়েছিল। মনে পড়ল আজ। এখানেও দুপুরে ওইরকম একটা রান্না হয়েছিল। কিন্তু স্কুলে মালতীমাসিরা অনেক ভালো রান্না করত। রুমেলারা খেয়ে উঠে হাত চাটত রোজ।

রুমেলা বসে বসে মায়ের কথা ভাবছিল। মা নিশ্চয়ই কাঁদছে খুব। হয়তো পিসির বাড়িতে চলে গেছে। পিসি, পিসেমশাই আর ছোট্টুদা মিলে খুব দুঃখ পাচ্ছে। রুমেলার হঠাৎ গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে মরে যাওয়া বাবার কথা মনে করে সকলে মিলে খুব কষ্টও পাচ্ছে। রুমেলার মনে হল স্কুলের পাশে আলুকাবলিওলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাকুটার সঙ্গে সেদিন কথা না বললেই ভালো হত।

রুমেলা ছেলেবেলা থেকেই রোজ নিয়ম করে স্কুলে যায়। ওর বাবা তখন পল্টনকাকুর গ্যারাজে মোটর মেকানিক। খুব হাতযশ। পল্টনকাকু বলত, ‘শম্ভুদার হাতে জাদু আছে। বিগড়ে যাওয়া যে-কোনো গাড়ি জ্যান্ত হয়ে লাফিয়ে ওঠে।’ বড়ো রাস্তা পেরিয়ে পল্টনকাকুর গ্যারাজ ছাড়িয়ে তিনটে গলি বাদ দিয়ে গেলে তবে ওদের বুনিয়াদি মাধ্যমিক স্কুল। অনেক মেয়েরা আসে। পড়াশোনাতে কারোরই তেমন মন নেই। তবু তার মধ্যেও কেউ কেউ ক্লাসে চুপ করে পড়া শোনে, পড়া বলে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে চেষ্টা করে। দিদিমণিরা তাদের দিকে লক্ষ রাখেন। স্কুলের পরে কাছে ডাকেন; বলেন, ‘ভালো করে পড়। ভালো নম্বর পেতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। যেখানে আটকাবে বলবি, জিজ্ঞেস করবি, বুঝতে না পারলে আবার বুঝিয়ে দেব।’

রুমেলা ওইরকম মেয়েদের মধ্যে একজন। যাকে মিলিদিদিমণি, সাথীদিদিমণি আর তনিমাদিদিমণি খুব ভালোবাসে। ভালোবাসে নয়, ভালোবাসত। ও যখন রোজ স্কুলে যেত, তখন ভালোবাসত। অনেকদিন ধরে ও ঠিকঠাক স্কুলে যায় না। বাড়িতে কেউ জানত না দিদিমণিরা ওকে মাঝে মাঝে ডেকে বকত, কিন্তু ও কোনও উত্তর দিত না। দিদিমণিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, বাবা মরে গিয়ে মেয়েটার জীবনটা কেমন অগোছালো হয়ে গেল। মা সকালে জয়ন্তকাকুর বাড়িতে রান্না করতে যায়। জয়ন্তকাকুর মেয়ে আরশি ওর থেকে বছর কয়েকের বড়ো। বরাবর আরশির ছোটো হয়ে যাওয়া জামা-জুতো পরে রুমেলা। কী সুন্দর সব জামা! রুমেলাকে দেখলে তখন অবাক হয়ে তাকায় সবাই। রুমেলার মা রান্না শেষ করে সেখান থেকে বড়ো রাস্তার মোড়ে টেইলরিংয়ের দোকানে যায়। অনেক সেলাইয়ের কাজ বোঝা করে নিয়ে বাড়ি আসে। রুমেলা ততক্ষণে ইস্কুলে। বিকেলে মায়ের দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে রোজ ইস্কুলে যাচ্ছিল না রুমেলা। গত বছর ডিসেম্বর থেকেই চলছে। স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষাও ভালো করে দেয়নি। কোনোরকমে টায়ে টায়ে পাশ। মা কিছুই জানে না। কেউ টের পায়নি। রুমেলা কেবল স্কুলের সময় স্কুলের জামা পরে বড়ো রাস্তায় যায়। তারপর একেকদিন একেক জায়গায় যেতে হয় ওকে। কখনও পানের দোকানে, কখনও বস্তির মধ্যে খুপরি ঘরে, কখনও বড়ো ফ্ল্যাটবাড়িতে। ছোটো ছোটো প্যাকেট ব্যাগে ভরা। স্কুলের ব্যাগ থেকে সেই কাগজে মোড়া প্যাকেট ওকে পৌঁছে দিতে হয় নানান জায়গায়।

জুতোটা সেদিন একদম ছিঁড়ে গিয়েছিল রুমেলার। হাওয়াই চটিতে সেফটিপিন গাঁথা। কোনোরকমে স্কুলে এসে ভাত খেয়েছে। সকালে সেই রোজকার মতো জল আর মুড়ি। বাড়ি ফিরেও কী জুটবে, কে জানে। বড়ো রাস্তায় বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। তাতে কী সুন্দর সব হাসিমুখের বাচ্চা! ওদের কোনও চিন্তা নেই। রুমেলা নিজে তবু আধপেটা খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ওর ন্যাড়া-ভুলো-ফুচকা-কালু-জিতু? ওরা পেট ভরে না খেলে বুক ফেটে যায় রুমেলার। ওরা সবাই এই পাড়ার কুকুর। সকলেই ডাস্টবিনে ঘুরে এঁটোকাঁটা খায়। কিন্তু রুমেলার পাশে সকাল থেকে ওরা ঘুরঘুর করে।

রুমেলা ছেঁড়া চটি টেনে টেনে বাড়ি ফেরার সময় হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ে পানের দোকানের সামনে। একটা বড়ো পোস্টারে একটা ছোট্ট মেয়ে দুটো কুকুরছানার গলা জড়িয়ে বসে আছে। রুমেলা আনমনা হয়ে যায়। ওরা পেট ভরে খায় বলেই ওদের গায়ে অমন জেল্লা!

সেই প্রথমদিন লোকটা ওকে ডেকে বলেছিল, “ও খুকি, একটা আইসক্রিম খাবে?”

রুমেলা তো শুনেই ভয়ে কাঁটা। সে খুব ভালো করে জানে, ছেলেধরা লোকেরা খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে ছোটোদের চুরি করে ধরে নিয়ে যায়। সে ভয়ে ভয়ে জোরে হাঁটা লাগায়।

লোকটা কিন্তু প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকে দোকানটার সামনে। রোজ তাকায় ওর দিকে। রুমেলা চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। আবার একদিন লোকটা ওকে ডাকল,“ও খুকি, শোনো শোনো, আমি কিন্তু ছেলেধরা নই।”

দেখেছ কাণ্ড! তাহলে তো নিশ্চয়ই ছেলেধরাই হবে। ওরকম সরাসরি বলছে মানে, ঠিক বুঝতে পেরেছে রুমেলা কী ভবছে। রুমেলা সেদিনও জোরে জোরে হেঁটে রাস্তা পেরোয়।

পরদিন আর পানের দোকানের সামনে নয়। ওদের স্কুলের গেটের বাইরে যেখানে আলুকাবলিওলা বসে, সেখানে দাঁড়িয়ে আলুকাবলি খাচ্ছিল লোকটা। হুশহাশ শব্দ করে আরও ঝাল দিতে বলছিল। ওর পাশে রুমেলার ক্লাসের তপতী, লক্ষ্মী, কাবেরী, সুস্মিতারাও দাঁড়িয়ে খাচ্ছিল। রুমেলা দেখে অবাক হয়। ওদের কাছে তো সবসময় পয়সা থাকে না। যেদিন কেউ একজন পয়সা আনে, বাকিরা তার ঠোঙা থেকে চেয়ে খায়। অল্প অল্প ভাগ করে খেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। আজ ওরা সকলেই পয়সা এনেছে?

রুমেলাকে দেখেই চেঁচিয়ে ওকে ডাকে কাবেরী, “এই রুমেলা, আলুকাবলি খাবি?”

আলুকাবলির নাম শুনেই রুমেলার জিভে জল আসে। অনেকদিন খাওয়া হয় না। টক আর ঝাল মিলিয়ে মনটা আনচান করে ওঠে। কিন্তু লোকটা দাঁড়িয়ে আছে দেখে খুব অস্বস্তি হয়। লোকটা ওকে দেখে একগাল হাসে,“খুকি, এই দেখো, তোমার বন্ধুরা কিন্তু সবাই খাচ্ছে। ভয় কীসের? খাও না তুমি।”

রুমেলার জবাবের অপেক্ষা না করেই আলুকাবলিওলাকে বলে, “আরেকটা বানাও দেখি চটপট। ছোলা দেবে বেশি করে। আর টক-ঝাল এই একইরকম।”

রুমেলা দাঁড়িয়ে পড়ে। আহা, ওর বন্ধুরাও খাচ্ছে। ওদের সবার সামনেই দাঁড়িয়ে বানাচ্ছে। তার মধ্যে ওষুধ মেশাবে কখন? না না, কাকুটা ভালোই। আহা, নিশ্চয়ই ন্যাড়া-ভুলো-ফুচকা-কালু-জিতুকে যেমন রুমেলা রোজ আদর করে খাওয়ায়, এই কাকুটাও তেমনই ওদের ভালোবেসে…

দীপকাকু। লোকটাই বলেছিল, ওর নাম দীপনারায়ণ। বাড়ি নাকি অনেক দূরে। কলকাতার বাইরে। ও এখানে ভাড়ার গাড়ি চালায়। আর অনেক মাল সাপ্লাই করে। ওর গাড়িতে মাল যায়, ও মাল নিয়ে আসে। কী মাল, তা জেনে রুমেলা কী করবে? ও কি অতশত বোঝে? শুধু দীপকাকু ওকে বলে, রোজ রোজ স্কুলে না গিয়ে যদি দীপকাকুর কিছু মাল ও নিয়ে গিয়ে জায়গামতো পৌঁছে দেয়, তাহলে দীপকাকু ওকে পয়সা দেবে। সেই পয়সা দিয়ে ও আলুকাবলি খাবে, ফুচকা খাবে, দুপুরে খিদে পেলে ফুটপাথের হোটেলে বসে গরগরে লাল ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খাবে। আর রোজ ন্যাড়া-ভুলো-ফুচকা-কালু-জিতুদের অনেক বিস্কুট আর পাঁউরুটি কিনে দিতে পারবে।

এই শেষের প্রস্তাবটিতেই গলে গেল রুমেলা। স্কুল কামাই করে এদিক ওদিক চলে যেতে লাগল মাল নিয়ে। হালকা ছোটো ছোটো প্যাকেট। পৌঁছে দিলে দীপকাকু ওকে কুড়ি-তিরিশ টাকা করে দেয়, দুপুরে এটা-সেটা খেয়ে ওর হাতে বেশ কিছু পয়সা থাকে। দু-একবার পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে। সেদিন ওর ন্যাড়া-ভুলো-ফুচকা-কালু-জিতুদের ভারি মজা।

রুমেলা থানাতে একরাত ছিল। কোনও হাজতে বা জাল দেওয়া গরাদের মধ্যে নয়। একটা বেঞ্চিতে ও শুয়ে ছিল সারারাত। একজন মেয়ে-পুলিশ পাহারা দিল ওকে। পাশে বসে ছিল গোমড়া মুখে। পুলিশকাকুরা খুব রাগী চোখে বকল ওকে।

uponyasbishochkra01

ট্রাফিক সিগন্যালে ভরদুপুরে স্কুলের পোশাক পরা রুমেলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট ওকে খুব জেরা করে। তারপর জিপে করে থানায় নিয়ে যায়। রুমেলা প্রথমে তেমন ভয় পায়নি। ভেবেছিল, স্কুলে না গিয়ে রাস্তায় ঘুরলে বোধহয় ট্রাফিক পুলিশে ধরে। পুলিশকাকুরা জিজ্ঞেস করল, কেন দাঁড়িয়ে ছিল ওই মোড়ের কাছে? ওর ব্যাগে কী আছে? কোথায় থাকে? কোথায় কোথায় ওইসব প্যাকেট নিয়ে দিয়ে এসেছে—অনেক প্রশ্ন। দীপকাকুর নাম বলেছে ও। কিন্তু দীপকাকুর সঙ্গে আর কে কে ছিল, জিজ্ঞেস করছিল থানার মোটা বড়োবাবু। রুমেলা কোনোদিন দেখেইনি কাউকে। কিছুই জানে না। সেসবই বলল। ন্যাড়া-ভুলো-ফুচকা-কালু-জিতুদের কথাও বলল। ওরা গম্ভীর হয়ে শুনল সব। মাকে ফোন করে থানায় ডাকল। পরদিন সকালে থানার কালো ভ্যানে করে কোর্টে নিয়ে গেল। ও গাড়িতেই বসে ছিল। শুনল, আর থানায় নয়, ওকে একটা হোমে পাঠানো হচ্ছে।

মায়ের সঙ্গে সামনাসামনি তার পরে আর দেখা হয়নি রুমেলার। রুমেলা জানে, মা খুব কাঁদছে। খুব।

সকালবেলাতেই ইপ্সিতা পোস্ট করলেন মায়েদের ‘সিক্স মাদার্স’ হোয়াটস-অ্যাপ গ্রুপে,‘বান্টা মিসিং। কোনও খবর পেলে কেউ? নীনাকে ফোন করেছি অনেকবার। ও ধরছে না।’

বান্টা ছেলেবেলা থেকেই আরশি-তিতলি-রিমঝিম-মিনি-কাজু-তিতাসদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়েছে একদম ক্লাস টেন পর্যন্ত। দারুণ নাচত বাণ্টা। খুব হাসিখুশি ছটফটে মেয়ে। ক্লাস টেনে পড়াকালীনই ওর বাবার বদলি হল মুম্বই। ব্যাজার মুখ করে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে মুম্বইতে গিয়ে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হল। যোগাযোগ বলতে ফোন আর মায়েদের গ্রুপে বিভিন্ন সময়ে চ্যাট। নীনা-আন্টি ওখানে গিয়ে একটা অ্যাড এজেন্সিতে কাজ পেয়ে গেছে। ফলে সে একটু অনিয়মিত হয়ে পড়ছিল। বান্টার বাবা রোশন-আঙ্কলও ব্যস্ত কর্পোরেট। দেশের মধ্যে, দেশের বাইরে তিনি সর্বক্ষণ ছুটে বেড়াচ্ছেন।

মুম্বইতে গিয়ে প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ হয়েছিল বান্টার। পুরোনো বন্ধু, পুরোনো স্কুল, পুরোনো শহর, আত্মীয়স্বজন… হঠাৎ যেন অনেক দূরে সরে গেল সবাই। পড়াশোনাতেও ঠিকঠাক মন দিতে পারেনি। নীনা-আন্টি অনুযোগ করতেন, বান্টা রেজাল্ট খারাপ করছে। ক্লাস টুয়েলভের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে ওদের একবার কলকাতায় আসার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে নীনা-আন্টির অফিসের কোনও প্রজেক্ট চলে আসাতে প্ল্যানটা বানচাল হয়ে যায়। বান্টার তাই নিয়ে মনখারাপ ছিল খুব। কিন্তু তার জন্য কেউ ভরদুপুরে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে না।

রিমঝিমের মা ইপ্সিতাই মাঝে-মধ্যে ওদের ফোন করতেন। বান্টা আর রিমঝিম ক্যারাটে শিখত একসঙ্গে। দুজনেই একদম ছেলেবেলা থেকে ক্যারাটের নানান কম্পিটিশনে গিয়ে প্রাইজ নিয়ে আসত। নাচতেও ভীষণ ভালোবাসত বান্টা। মুম্বইতে গিয়ে বান্টার ক্যারাটে আর নাচ বন্ধ হয়ে গেল একসঙ্গে।

বিকেলের সাঁতারের ক্লাসে দেখা হয় রিমঝিম, আরশি আর তিতলির। মিনিরও আসার কথা। মিনি এই ব্যাপারে চূড়ান্ত ফাঁকি দেয়। ঠিক বিকেলবেলাতেই রোজ ঘুমিয়ে পড়ে। আর সাঁতারের ক্লাসে আসে না। কাজু আর তিতাস ওদের সঙ্গে এই ক্লাবে সাঁতার কাটে না। ওদের দুজনের বাড়ি খুব কাছাকাছি। ওরা বিকেলে জিমে যায়।

আজও ওদের দেখা হল। সুইমিং পুলে নামার আগেই তিনজনে ঠিক করে নিল আজ তাড়াতাড়ি জল থেকে উঠে পড়বে। যেমন কথা, তেমন কাজ। কুড়ি মিনিট টানা ফ্রি স্টাইল এ-পার ও-পার করল ছোট্ট সুইমিং পুলটা। তারপর একে একে টুক করে উঠে পড়ল তিনজনেই। ট্রেনারকাকুরা ওদের সেই ছোট্টবেলা থেকে চেনেন, কিচ্ছু বলেন না। ওরা তিনজনেই জল থেকে ওঠার আগে শুধু একবার চেঁচিয়ে পারমিশন নিয়ে নিল।

“এবার বল, বান্টার কী খবর পেলি।”

তিতলি একটু দম নেয়,“বান্টা নাকি মাঝখানে খুব মনখারাপ করে বাড়িতে বসে থাকত। স্কুলে যেত না। ঘরে বসে কাঁদত। নীনা-আন্টি অফিসে চলে যেত, রোশন-আঙ্কল তো বাড়িতেই থাকেন না। ওকে বার বার বুঝিয়েছেন। ও শোনেনি।”

“কিন্তু এটা সেই প্রথমদিকে।” আরশি অধৈর্য হয়ে বলে, “তখন আমরাও ওকে রেগুলার ফোন করছি, মনে নেই?”

“ঠিকই। কিন্তু ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার সময় ওর রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছিল, ও তারপরে আরও ভেঙে পড়ে। আর সেই সময়েই ও নাকি ড্রাগ নিতে শুরু করে।”

“অ্যাঁ! ড্রাগ! কী বলছিস তিতলি?”

তিতলি জোর দিয়ে বলে, “হ্যাঁ, ড্রাগ। গতকাল রাতে বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে রোশন-আঙ্কলের। স্কুলের বাইরেই ওরা দু-চারজন ড্রাগ পেডলারের খপ্পরে পড়ে। অনেক বড়ো স্কুল। এইসব খবর ওরা গার্জিয়ানদের জানিয়ে ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। আর বাবা-মায়েরা এদের কাউন্সেলিং করে, রিহ্যাবিলিটেশন করে আবার সুস্থ করেন। বান্টার কাউন্সেলিং চলছিল। আমরাই কিচ্ছু জানতাম না।”

তিতলির কথায় স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে রিমঝিম আর আরশি। স্কুলের বইতে ‘ড্রাগের কুফল’ নামের রচনার বাইরে ওদের কাছে এই শব্দটা পুরো অচেনা। ড্রাগ যে কী আর কোথায় কার কাছে পাওয়া যায়, কীভাবে যে সেসব খেতে হয়, তার সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই ওদের।

“বান্টা ড্রাগ খেত? কী বলছিস?”

“কী খেত রে?”

“সবথেকে বড়ো কথা, কখন করত এইসব?”

“আরে দূর, এতকিছু আমি জানি না। কাল রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবা মায়ের সঙ্গে আলোচনা করছিল। আমি তখন ওদের কাছেই শুনলাম। বান্টা কী খেত জানার চেয়েও জরুরি, বান্টা কোথায় গেল—ও কি বাড়ি থেকে পালিয়েছে? নাকি হারিয়ে গেছে? নাকি ড্রাগ পেডলারদের খপ্পরে পড়েছে? জানিস, আমার ভেবেই খুব রাগ হচ্ছে। কেন নীনা-আন্টি বান্টাকে জোর করে মুম্বই নিয়ে চলে গেল? এখানে কলকাতায় ওর দিদার বাড়ি। বান্টা দাদু-দিদার কাছেই থাকতে পারত। তাহলে কিন্তু এইসব ঘটত না।”

“তিতলি, বড়োরা কিন্তু আমাদের সব কথা বুঝতে পারে না রে।”

“যা বলেছিস। শোন আরশি, নেহাত মুম্বই অনেক দূর, তা না-হলে একবার গিয়ে খুঁজে দেখা যেত, বল?”

“ঠিক বলেছিস। খুব হেল্পলেস লাগছে। আমরা কি কিছুই করতে পারব না?”

“রিম, চল আমরা শান্তজেঠুর কাছে যাই একবার।”

তিতলির প্রস্তাবে আলো জ্বলে ওঠে রিমঝিমের চোখে। শান্তশীল মৈত্র সরকারি কোনও উচ্চপদে চাকরি করেন। খুব পরোপকারী। যে-কোনো মানুষের যে-কোনো দরকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য করেন। ওদের হাউজিংয়েই থাকেন। রিমঝিমের ক্যারাটে ট্রেনিংয়ের সাফল্যে খুব প্রশংসা করতেন। প্রত্যেকবার ক্যারাটে কম্পিটিশনে কোনও প্রাইজ পেলেই রিমঝিম আর বান্টা ছুটে গিয়ে দেখিয়ে আসত শান্তজেঠুকে। সত্যিই শান্ত মানুষ, ধীরস্থির। ওদের সিক্স মাস্কেটিয়ার্সকে খুবই স্নেহ করেন। ওঁর কাছে গেলে নিশ্চয়ই কিছু সাহায্য করতে পারবেন।

“আজই যাবি?”

“নাহ্‌। আজ হবে না। সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে। মাকে বলে আসিনি। চিন্তা করবে। দু-দিন ধরে রান্নামাসি আসছে না। তার মেয়েটাকেও নাকি পুলিশে ধরে কোন হোমে নিয়ে গেছে। ও নাকি স্কুলে যাচ্ছিল না। স্কুলের ব্যাগ নিয়ে কীসব পাচার করত। পরশু রান্নামাসি রাতে এসে বাবার কাছে কী প্রচণ্ড কাঁদছিল।” কথা বলতে বলতে আরশি ওর সাইকেল বের করে। ওকে এখান থেকে বেশ খানিকটা পথ সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। রিমঝিম আর তিতলির পাশাপাশি পাড়া। ওরা দুজনে হেঁটেই চলে যাবে।

“আর বলিস না, কী যে সব হচ্ছে চারপাশে, আমাদের গাড়িটাতেও উইন্ড-স্ক্রিনে বিরাট একটা স্ক্র্যাচ। গ্যারেজে গাড়ি থাকে, কেয়ারটেকার রয়েছে। কী করে যে এসব হল!”

আরশির কথায় অবাক হয় তিতলি,“নির্ঘাত পাতি চোরের কাণ্ড। কিন্তু বান্টার জন্য বড্ড মনখারাপ লাগছে রে।”

রিমঝিম বলে, “তাহলে কাল শান্তজেঠুর সঙ্গে সকালে কথা বলে রাখব। দেখি, উনি কখন ফ্রি। উনি যখন যেতে বলবেন সেইমতো জানিয়ে দেব তোদের। আমি, তিতলি আর মিনি তো যেতেই পারব। আরশি, তুই আসবি তো?”

“আসব রে। পাক্কা।”

তিতলি আর রিমঝিম এগিয়ে যায়। আরশি ভেজা চুলগুলোকে একটা ক্লাচ দিয়ে আটকে নেয়। সাইকেল চালানোর সময় মুখের ওপর পড়লে বড়ো অস্বস্তি হয়। সাইকেলের হ্যান্ডল ধরে সব গুছিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ একটা লোকের দিকে চোখ পড়ে ওর। সুইমিং ক্লাবের বাইরের গেটে দাঁড়ানো। গম্ভীরভাবে হাতের ঘড়ি দেখছে। মোবাইলে খুটখাট করছে সমানে। কাউকে ফোন করছে, পাচ্ছে না, অস্থির হয়ে উঠেছে। আরশির চোখ ভুল করে না। ওই ভুরু, চোখ, চোয়াল আর চিবুকের গড়ন ওর খুব চেনা। চেহারার উচ্চতা, দাঁড়ানোর ভঙ্গি—সেই লোকটা। আজ দুপুরেই ভবঘুরের পোশাকে যে ওদের বাড়ির পিছনের মাঠে কী যেন খুঁজছিল। লোকটার এখনকার স্মার্ট চেহারাটা মনে মনে আঁকতে শুরু করল আরশি।

সাঁতারের ক্লাস থেকে ফিরেই রিমঝিম চলে যায় মিনিদের বাড়ি। তিতলিকে ডাকে একবার,“তিতলি, তুই আমার সঙ্গে এখন একবার মিনিদের বাড়িতে আসবি?”

তিতলির বাড়ি ওদের ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে সামান্য একটু দূরে।

“না রে। তুই শান্তজেঠুকে আগে জিজ্ঞেস কর কবে উনি সময় দেবেন। সেদিন ঠিক আসব। আজ এখন ওদের বাড়ি গেলে মা খুব চিন্তা করবেন।”

“ওকে রে। তাহলে পরে কথা হচ্ছে। কাজু আর তিতাসকে রাতে একবার যোগাযোগ করতে হবে।”

রিমঝিম মিনির ঘরে ঢুকে দেখল যথারীতি মিনি ঘুমোচ্ছে। বিছানায় ল্যাপটপ খোলা পড়ে রয়েছে। তাতে বেশ জোরে বি.টি.এস-এর কোরিয়ান ভাষায় গান চলছে।

“কী আশ্চর্য মিনি! এই ভরসন্ধেবেলা তুই ঘুমোচ্ছিস? কী আলসে মেয়ে রে বাবা! ওঠ, ওঠ বলছি শিগগির!” রিমঝিম জোরে জোরে ধাক্কাতে শুরু করে মিনিকে।

কাঁচা ঘুম ভেঙে লাল চোখে খুব বিরক্তি নিয়ে মিনি ওর দিকে তাকায়,“উফ্‌! হয়েছেটা কী? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি? এত চেঁচামেচি কীসের? দিলি তো আমার সাধের ঘুমটা ভাঙিয়ে!”

“বেশ করেছি ঘুম ভাঙিয়েছি। গাঁক গাঁক করে গান চালিয়ে ঘুমোচ্ছে! আগে বল, আজ তুই সাঁতারে যাসনি কেন?” রিমিঝিম মিনিকে ঝাঁকিয়ে দেয় আবার।

মিনি লাজুক মুখ করে বলে, “একদম ইচ্ছে করছিল না রে। বিশ্বাস কর। কিন্তু তাই বলে তুই ডাকাতের মতো এসে বাড়িতে চড়াও হবি?”

মিনির বাবা সুরঞ্জনবাবু কোন ফাঁকে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছেন,“আহা-হা বাড়িতে ডাকাত পড়বে কেন? রঘু ডাকাত, হীরু ডাকাত এরা সব পুরোনো দিনের গল্পের বইতে থাকত সেই কোন যুগে। এখন তারা লজ্জায় কোথায় লুকিয়ে-টুকিয়ে পড়েছে। আজকাল যতদূর জানি এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল জীবেরা অন্য গ্রহ থেকে হুড়মুড় করে ঘাড়ে এসে পড়ে। মাকড়সা কিংবা পিঁপড়ের মতো দেখতে সব মানুষ, মার্ভেল মুভিজে যেমন দেখায়।”

মিনির বাবার রসিক মন্তব্যে রিমঝিম হেসে ফেলে। মিনি একবার করুণ চোখে তাকায় বাবার দিকে,“তোমাকে এখন আবার মার্ভেল মুভিজ নিয়েও কথা বলতে হবে বাবা? কেবল তো আমাদের সব গুলিয়ে দেবে। তার চেয়ে খুব কড়া যে কফিটা তুমি খাও, সেটা আমাদের দুজনকে বানিয়ে দাও না! প্লিজ…”

“আমাকে এত ব্যাকডেটেড ভাবিস তোরা? আমি কি তোদের হালফিল জগতের কিছুই জানি না? জানিস, হরি পাত্রকে নিয়ে আমি কতদূর পড়ে ফেলেছিলাম? সবক’টা খণ্ড। তোরা ওকে ছেড়ে দিলি বলে আমিও আর এগোলাম না।”

“এই হরি পাত্রটা আবার কে?”

রিমঝিমের অবাক প্রশ্নে চেঁচিয়ে ওঠে মিনি, “উফ! মনে নেই, বাবা হ্যারি পটারকে হরি পাত্র বানিয়ে দিয়েছিল। সে কী জ্বালাতন!”

দুজনেই হেসে গড়িয়ে পড়ে এবার।

“বাবা, এবার অন্তত কফি বানিয়ে দাও আমাদের। প্লিজ। আমার ঘুম কাটবে, আর রিমঝিম সাঁতার কেটে ফিরেছে—ওকেও কিছু-মিছু দিও।”

সুরঞ্জনবাবু হেসে ফেলেন,“দাঁড়া, এক্ষুনি বানিয়ে আনছি। কিন্তু রিমঝিমের মুখ দেখছি খুব গম্ভীর। কী হল আবার?”

“কী আবার হবে কাকু? জানো তো সব। বান্টার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমাদের।”

সুরঞ্জনবাবু এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন রিমঝিমের,“এত ভাবিস না। সকালে ওদের বাড়িতে আমি ফোন করেছিলাম। মুম্বই পুলিশে মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে। কলকাতায় বান্টার দিদা-দাদু সকলকে জানিয়ে এখানেও পুলিশকে ইনফর্ম করা হয়েছে। যদি বান্টা বাবা-মার ওপর রাগ করে একা একা কলকাতায় চলে আসে… সবই জানিয়ে রাখা হয়েছে। ঠিক একটা কিছু হবে। আরে বাবা, বান্টা যথেষ্ট ব্রেভ গার্ল। ওর কোনও বিপদ হবে না দেখিস। দাঁড়া, আমি কফি বানিয়ে আনি তোদের জন্য। তারপর আমারও আজ কলেজের পরীক্ষার প্রচুর খাতা দেখার চাপ।”

সুরঞ্জনবাবু রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবেন, চিন্তা কি তাঁর কিছু কম হচ্ছে? ওদেরই বয়সি একটা মেয়ে হঠাৎ না বলে-কয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে ভয় করে রীতিমতো।

“শোন মিনি, আমরা একবার শান্তজেঠুর কাছে যাই চল।”

“এক্ষুনি?”

“না না, ঠিক এক্ষুনি না। এখন তো সবে সাড়ে ছ’টা। আর একটু পরে। উনি আমাদের একটু গাইড করতে পারবেন নিশ্চয়ই।”

কথা বলতে-বলতেই কলিং বেল বাজল। রিমঝিম সোজা হয়ে বসে। সুরঞ্জনবাবু দরজা খুলে জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন, “আরে কাজুবাদাম আর চিনেবাদাম একসঙ্গে হাজির যে! এসো এসো এসো।”

কাজু আর তিতাসকে সুরঞ্জনবাবু ছেলেবেলা থেকেই একসঙ্গে কাজুবাদাম আর চিনেবাদাম বলে ডাকেন। রিমঝিম আর মিনি ঘর থেকে হাঁক পাড়ে, “ওরে আয় আয়। কদ্দিন দেখিনি তোদের।”

জিম থেকে ফিরে দরদর করে ঘামছে দুজন। কাজু হাঁফাচ্ছে বেশ। তিতাস বলে ওঠে, “একটু আগে একটা মেসেজ এসেছে আমার মোবাইলে। অচেনা নম্বর। কিন্তু তাতে কী লেখা আছে দেখ।”

ওদের দুজনের উত্তেজনা দেখে মিনি লাফিয়ে উঠে বসে খাটে। রিমঝিম হাত বাড়িয়ে কাজুর মোবাইলটা নেয়। মোবাইলের মেসেজের ইনবক্সে লেখা, ‘আই লাইক দ্য ড্রাগ। ইট গেভ মি নিয়ারলি টুয়েলভ আওয়ার হাই।’

“এই মেসেজটা কার? এর মানে কী?” রিমঝিমের প্রশ্নে কাজু হাঁফায়। উত্তর দিতে পারে না।

তিতাস বলে, “সেটা জানলে তো হয়েই যেত। কিন্তু এই নম্বরটা দেখে তো পুলিশ খুঁজে বের করতেই পারবে, কোন নম্বর, কোথা থেকে এসেছে।”

“সেটা পরের ব্যাপার। আগে বল, এই টুয়েলভ আওয়ার হাই ব্যাপারটা কী?”

“কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এই মেসেজটা তোর মোবাইলেই-বা কেন এল?”

কাজু বলে ওঠে, “আচ্ছা, এই মেসেজটা বান্টার নয় তো?”

“বান্টা?” তিতাস চমকে ওঠে,“সেটা কেমন করে হবে? বান্টার মোবাইল নম্বর তো আমরা জানি। আর ও হঠাৎ এমন একটা অদ্ভুত মেসেজ তোকেই-বা করবে কেন?”

“আমার অন্য একটা জিনিস মনে হচ্ছে।” মিনির গম্ভীর গলায় ফিরে তাকায় সকলে,“হয় বান্টা অন্য কোনও নম্বর থেকে মেসেজ করেছে, আর নয়তো বান্টার মেসেজ কেউ তিতাসকে ফরোয়ার্ড করেছে।”

“কোনোটাই অসম্ভব নয়।” রিমঝিম বলে, “শোন, ভালোই হয়েছে তোরা এসেছিস। চল, শান্তজেঠুর কাছে একবার যাই সকলে মিলে। বান্টার কেসটা আমাদের সলভ করতেই হবে।”

“ঠিক বলেছিস। নির্ঘাত ও কোনও বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছে। শান্তজেঠু কী বলেন দেখি।”

কাজু আর তিতাস ঘরে পা ছড়িয়ে বসে। রিমঝিম রান্নাঘরের দিকে যায় কফি আনতে। কফি নিয়ে ফিরে এসে দেখে মিনি গুগলে টাইপ করছে ‘টুয়েলভ আওয়ার হাই’।

uponyasbishachakra02

শান্তশীল মৈত্র সরকারি দপ্তরে ঠিক কোন হায়ারার্কিতে আছেন, তাঁর পোস্ট বা তিনি কী করেন রিমঝিমরা জানে না। অনেকেই বলে উনি ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টে রয়েছেন। কিন্তু সঠিক তথ্য কেউ জানে না। হয়তো উনিও বলতে চান না। সবাই শুধু দেখে রোজ উনি একটা বড়োসড়ো সরকারি গাড়ি চড়ে সকালে বেরিয়ে যান। বাড়ি ফেরার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। খুব শান্ত মানুষ, কিন্তু খুবই হাসিমুখে থাকেন। ক্যাম্পাসে সকলের সঙ্গেই দারুণ ভাব। রিমঝিম, কাজু, বান্টা, তিতলি, মিনি, আরশি, তিতাস ওদের এই সবক’টা মেয়েকেই উনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন। বছর কয়েক আগে পর্যন্ত শান্তজেঠুর বাড়ি গিয়ে মাঝে-মধ্যে উৎপাত করে আসত ওরা। ইলেভেনের পড়ার চাপে অনেকদিন আর তেমন হুটহাট করে যেতে পারছে না।

বান্টার খবরটা দেওয়া তো বটেই, ওদের পরবর্তী লাইন অফ অ্যাকশন নিয়েও ভাবতে হবে। শান্তজেঠু ছাড়া আর কেউ নেই এই ব্যাপারে সাহায্য করার মতো। বাবা-মায়েদের জানালে তো বকে-ঝকে একাকার করবে।

সবকিছু শুনে পরের দিন সন্ধের পরেই ওদের সকলকে বাড়িতে চলে আসতে বললেন শান্তজেঠু।

রিমঝিম আর মিনি তো একই হাউজিংয়ে থাকে। তিতলি পাশের পাড়া থেকে হেঁটেই এল। কাজু আর তিতাস এল রিকশা করে। আরশি সাইকেলে এসেছে।

“বলো সিক্স মাস্কেটিয়ার্স। অনেকদিন তোমাদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা হয় না। কেমন আছ বলো।”

শান্তজেঠুর ড্রয়িং রুমে ধূপের মিষ্টি গন্ধ। গরমকাল বলেই জেঠিমা আমপোড়া শরবত রেখে গেছেন সকলের জন্য। মুখ টিপে হেসে ইশারায় জানিয়েছেন এরপরে কুচো চিংড়ির স্পেশাল পকোড়া আসছে। তিতাস তো শুনেই জিভ দিয়ে ঝোল টেনে নিল একবার। মিনি কটমটিয়ে তাকিয়ে দেখল ওর দিকে। ভাবখানা এমন, বেশি খাই খাই করলেই ওর গলা চেপে ধরবে। মিনি নিজেই কথা শুরু করে দিল,“বান্টা আমাদের খুব বন্ধু ছিল। ওকে তোমার মনে আছে জেঠু? ওর জন্যই এলাম তোমার কাছে। ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না গো।”

“বান্টা? মানে তোদের সেই সেই ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন?”

শান্তজেঠুর প্রশ্নে করুণ মুখে রিমঝিম বলে, “হ্যাঁ জেঠু, সেই বান্টা। তুমি ওকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসতে জেঠু। আমি জানি। ও খুব ভালো ক্যারাটে শিখেছিল। কত তাড়াতাড়ি ব্ল্যাক-বেল্ট হয়ে গেল। জুডো শিখবে ঠিক করেছিল।”

শান্তশীলের গম্ভীর মুখে চিন্তার ছায়া,“বান্টা মুম্বইতে চলে গিয়েছিল না? ওখানে কী হয়েছিল ওর? আমাকে একটু খুলে বল দেখি।”

মিনি বলতে শুরু করে। বান্টার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে যা যা বা যতটুকু তথ্য ওরা জানতে পেরেছে, সবটাই গুছিয়ে বলে। যদিও পুরোটাই বাবা-মায়েদের আলোচনা থেকে শোনা, তাও কোনও কথাই বাদ দেয় না। আর তার মধ্যেই উঠে আসে বান্টার ড্রাগ নেওয়ার প্রসঙ্গ।

নিছক হারিয়ে যাওয়ার গল্পে যতটা মন দিচ্ছিলেন, ড্রাগের প্রসঙ্গ আসামাত্র চট করে যেন অনেকটা সতর্ক হয়ে গেলেন শান্তশীল। তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে এতটাই বদল, যে তাঁর সামনে বসে মিনিরাও বুঝে ফেলল শান্তজেঠু এবার খুব সিরিয়াস।

“বান্টা ড্রাগ নিচ্ছিল, তোমরা জানলে কী করে?”

“বাবাকে নীনা-আন্টি আর রোশন-আঙ্কল বলেছেন। আসলে আমাদের বাবা-মায়েদের ওঁরা যেমন বলেছেন আর কি।”

“কী ড্রাগ, সেই ব্যাপারে জেনেছ কিছু?”

“না জেঠু। তবে সিগারেটের মধ্যে ভরে ওরা খেত। কী খেত জানি না।”

আরশি উশখুশ করে ওঠে। ওদের বাড়ির রান্নার মাসির মেয়ে রুমেলা কয়েকদিন আগেই ধরা পড়েছে বড়ো রাস্তার মোড়ে। স্কুল-ড্রেস পরা একটা মেয়েকে ভরদুপুরে এদিক ওদিক যেতে দেখে ট্র্যাফিক সার্জেন্টের সন্দেহ হয়। তিনি ওকে ধরে থানায় নিয়ে যান। ওর ব্যাগের মধ্যে কতগুলো প্যাকেট পাওয়া গেছে। সেগুলোতে নাকি অনেক টাকার ড্রাগ ছিল,“জানো জেঠু, রুমেলা বলে একটা মেয়ে, আমার চেয়ে বছর কয়েকের ছোটো, আমাদের বাড়িতে রান্না করে রেখামাসি, তার মেয়ে। সে কয়েকদিন আগে ড্রাগ পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। অথচ সে বেচারি কিছুই জানত না। ওকে নাকি একটা লোক কতগুলো প্যাকেট দিয়ে বলত, একেকদিন একেক জায়গায় একেকটা ঠিকানায় পৌঁছে দিতে হবে। তার জন্য পয়সা দিত। আর ও সেই পয়সা দিয়ে ওর পাড়ার একগাদা পোষা কুকুরদের পেট ভরে খাওয়াত। ওর কিছুই তেমন মনে হয়নি। ওর বাড়িতেও ও কিছু জানায়নি। যথারীতি স্কুলে রোজ যেত না। আর এখন তো পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটা হোমে রেখে দিয়েছে। যতদিন না সব প্রমাণ হবে, ছাড়া পাচ্ছে না। রেখামাসির কী কান্না!”

আরশির কথা শুনে সকলেই নড়েচড়ে বসে।

শান্তশীল বলেন, “আসলে ড্রাগ নিয়ে কেউ ধরা পড়লে তার জামিন হওয়া মুশকিল। জামিন হয় না। এটা একেবারে স্ট্রিক্টলি নন-বেলেবল অফেন্স। জুভেনাইলদের ক্ষেত্রে মানে, আঠারো বছরের কমবয়সিদের ক্ষেত্রে জেল হাজতে না রেখে হোমে পাঠানো হয়। তারপর কেস চলতে থাকে। তোমরা জানো না, বলি তোমাদের, দিল্লিতে একটা পাড়া আছে। সেখানে নাইজিরিয়ানদের বাস। সেখানে দিল্লি পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী ভিসা এক্সপায়ার হয়ে যাওয়া প্রায় আড়াই হাজার মানুষ রয়েছেন। কিন্তু নার্কোটিক্স ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী এই সংখ্যাটা প্রায় আট হাজার। এরা মূলত আফগানিস্তান, পাকিস্তানের বর্ডার বা এইদিকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এইসব জায়গার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে। এরা কাজ করে একদম কুরিয়ার সার্ভিসের প্যাটার্নে। মানে ধরো, কোনও একটা ভুল ঠিকানায় কোনও একটি মেয়েকে একটি বড়ো প্যাকেট বা খাম পৌঁছে দিতে হবে। ব্যস। তার বিনিময়ে সে প্রচুর টাকা পাবে।”

“ভুল ঠিকানা মানে? ভুল ঠিকানায় কুরিয়ার যাবে কী করে?” তিতির অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

“ওটাই তো আসল প্যাঁচ। আসলে তো কোনও ঠিকানা দরকার নেই। প্যাকেটের ওপর একটা ভুয়ো ঠিকানা লেখা হল। কুরিয়ার করার মতো করে প্যাকেট সাজানো। কেউ বাইরে থেকে দেখে সন্দেহ করবে না। আর এই অছিলায় আসলে প্রচুর মাদক বা ড্রাগ প্যাকিং করে বের করে দেওয়া হল। পৌঁছানোর জন্য তো কোনও সঠিক ঠিকানার দরকার নেই। কাছাকাছি লোকেশনে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে দাঁড়ালেই হবে। কোনও একজন এসে বলবে, এই প্যাকেটটা আসলে আমার। আমিই এখন অন্য ঠিকানায় থাকি। কুরিয়ার কোম্পানির ফোন পেয়ে এইখানে দাঁড়িয়ে আছি। আসলে কোনও কোম্পানিও নেই, ঠিকানাও নেই। অনেক টাকার ড্রাগ হাতবদল হল। মাঝখানে ওই কিছু এজেন্ট কাজ করল, যারা অনেকেই না জেনে জড়িয়ে পড়ে। আর একবার চক্করে পড়লে আর তারা সেখান থেকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না। বেরোতে দেওয়াও হয় না। সব খবর ফাঁস হয়ে যাবে যে।”

“কী ভয়ংকর!” রিমঝিম আঁতকে উঠে বলে। বাকিরাও চোখমুখ কুঁচকে শুনছে মন দিয়ে।

“কিন্তু সবসময় কুরিয়ার করে পাঠানো হলে তো সন্দেহ হবেই।” আরশি বলে।

“নার্কো-কন্ট্রোল বলে একটি জার্নাল আছে। তাতে আমরা দেখেছি, ছবির ফ্রেমের মধ্যে করে কোকেন পাচার হচ্ছে। আর খবরের কাগজে তোমরা দেখবে এয়ারপোর্টে অদ্ভুত সব ঘটনা ধরা পড়ে। মাদক পাচারের অনেক টেকনিক রয়েছে। পাচারকারীরাও মাথা খাটায়। পুলিশও কম যায় না। তুমি চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়—অনেকটা সেইরকম আর কি।”

“কিন্তু জেঠু, ড্রাগ মানে তো অনেকরকম নেশা করার বস্তু জাতীয় কিছু, তাই না?”

রিমঝিমের প্রশ্নে শান্তশীল বলেন, “ড্রাগ শব্দটা আমি তোমাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে বলব। তার আগে তোমরা আমাকে নিজেরা বলো, ড্রাগ মানে কী।”

মিনি বলে, “আমি তো জানি, ড্রাগ মানে ওষুধ।”

তিতাস বলে ওঠে, “আমার কিন্তু মনে হয়, ড্রাগ মানে নেশার জিনিস। মানে, যা খেলে নেশা হয়।”

বাকিদের মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হাতের চায়ের কাপে চুমুক দেন শান্তজেঠু,“দু-বেলা তোমাদের জেঠিমার বানানো এই এক কাপ চা না খেলে আমার ভীষণ অস্বস্তি হয়। এটা আমার একটা নেশা। তাহলে এই চা কি ড্রাগ?”

কাজু বলে, “না না, চা কফি সিগারেট পান এগুলো ড্রাগ নয়। বরং ড্রাগ হল যা খেলে নেশাও হয়, ক্ষতিও হয়।”

তিতাস পাশ থেকে বলে, “সিগারেটে ক্ষতি নেই বলছিস? লাংস ক্যানসারটা কি তাহলে তোর মতে কোনও সিরিয়াস অসুখ নয়?”

তিতির হাঁ হাঁ করে ওঠে—“আর আমার ঠাম্মার তো পান ছাড়া চলেই না। তার মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে জর্দা দেয় আর মা কত রাগ করে। সেটাও তো নেশা।”

নিজেদের কথার মধ্যেই সব পরস্পরবিরোধী কথায় বেশ গুলিয়ে গেল ওরা। এবার সমাধান করল রিমঝিম,“জেঠু, তুমি একটু গুছিয়ে বুঝিয়ে দাও প্লিজ। ড্রাগ নিয়ে আমাদের এত জানা নেই।”

“শোনো তবে।” শান্তশীল টান টান হয়ে বসলেন। ছ’জোড়া চোখ তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে,“সব ওষুধই ড্রাগ। কিন্তু সব ড্রাগ কখনোই ওষুধ নয়। খুব সহজ কথায় বললাম হয়তো। কিন্তু বিষয়টা আরও একটু ঘোরালো। তোমরা মনে রেখো, ‘নার্কোটিক্স’ একটা গ্রিক শব্দ। এর অর্থ হল বিষ। এখানে থেকেই নার্কোটিক ড্রাগ আর সাইকোট্রপিক বস্তুর উৎপত্তি। এই বিষয়টা নিয়ে গোড়া থেকেই একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার। ফার্মাসিউটিক্যাল ড্রাগ বা অসুখের জন্য ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ ছাড়াও সাইকো-অ্যাক্টিভ বা সাইকোট্রপিক ড্রাগ হল সেই বিষ, যে বিষ কোনও না কোনোভাবে আমার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত, উদ্দীপিত, আবার কখনও নিষ্ক্রিয় করে দেয়।”

“মানে আমাদের ব্রেন আর স্পাইনাল কর্ড।” বলে ওঠে মিনি।

শান্তশীল বলে চলেন, “একদম ঠিক। এরা কেউ স্টিম্যুল্যান্ট, মানে এদের নিলে তোমার স্নায়ুতন্ত্র তরতাজা হয়ে উঠবে, কিন্তু তোমার ওজন কমে যাবে, খিদে কমে যাবে। এইরকম একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক স্টিম্যুল্যান্ট হল কোকেন। কেউ ডিপ্রেসেন্ট, সেই ড্রাগ নেওয়া মানেই তুমি তক্ষুনি ঝিমিয়ে পড়বে। তোমার তাৎক্ষণিক রিফ্লেক্স কমিয়ে দেবে। এই ডিপ্রেসেন্ট সঠিক মাত্রায় খেলে চাপমুক্ত থাকা যায়, ভালো ঘুম হয়। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া আর নির্দিষ্ট ডোজের বাইরে কক্ষনও নয়। অ্যানালজেসিক জাতীয় ড্রাগ ব্যথা কমায়। কিন্তু অজ্ঞান বা অচেতন করে না। এর মধ্যে নার্কোটিক আর নন-নার্কোটিক দুরকম ড্রাগই থাকতে পারে। আর কিছু রয়েছে হ্যালুসিনোজেন। যার প্রভাবে তুমি ঘুরে বেড়াবে একটা অবাস্তব স্বপ্নরাজ্যে। এছাড়াও আরও অনেক ভাগ রয়েছে। সব তোমাদের জন্য বলছি না। কিন্তু মোটামুটি বিষয়টা হল, ড্রাগ যখন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে, তখন সে নির্দিষ্ট মাত্রায় তোমার শরীরে ঢুকে প্রাণ বাঁচাচ্ছে। আর আইনের ফাঁক গলে গিয়ে নিষিদ্ধ যে জিনিস রোজ রোজ তোমার ক্ষতি করছে, সেটাই এখন এই সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো শত্রু।”

“জেঠু, তাহলে অ্যালকোহল, পান-জর্দা, চা-কফি—এগুলোতেও তো আমাদের নার্ভাস সিস্টেম বেশ চনমনে হয়ে ওঠে। এগুলো ড্রাগ নয়?”

“ভালো বলেছ কাজু। এগুলোও ড্রাগ। এগুলোকে বলে রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ। এগুলো আইনগতভাবে বৈধ। তবে একেক দেশের একেকরকম আইন। যেমন, আমাদের দেশে ১৯৮৫ সালে একটা আইন প্রণয়ন হয়। এনডিপিএস অ্যাক্ট। পুরো নাম হল ‘নার্কোটিক্স ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রোপিক সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্ট অব ইন্ডিয়া’। তাতে এনডিপিএস-এর ভাষায় বলা হয়, একজন মাদকে আসক্ত হল সেই ব্যক্তি, যে নেশার ওষুধ অথবা সাইকোট্রোপিক সাবস্ট্যান্সের উপরে নির্ভরশীল। এনডিপিএস মাদক বিক্রি, উৎপাদন, ব্যবহার এবং হেফাজতে রাখাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। ১৯৮৬ সালে এই আইনের দ্বারাই এনসিবি গঠিত হয়। যার পুরো নাম নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো। যার কাজ এনডিপিএস আইনের প্রয়োগ এবং মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলিকে তুলে ধরা।”

জেঠিমার হাতে একটা বিরাট ট্রে। তাতে কুচো চিংড়ির কাটলেট ছাড়াও ফিশ ফ্রাই থেকে গরম ধোঁয়া উঠতে দেখে তিতাস উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে,“ওই যে আমাদের জন্য রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ এসে গেছে!”

uponyasbishachakra03

শান্তশীলের আইনি কচকচির চেয়ে জেঠিমার হাতের লা-জবাব স্ন্যাক্সের দিকে সকলের মনোযোগ ঘুরে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তিতাসের মতো পেটুক প্রাণীর এহেন একটি সময়োচিত মোক্ষম ডায়ালগে ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠেন শান্তশীল।

“তোমরা খেতে-খেতেই শোনো বরং। ওই সব হাশিশ, কোকেন, মারিজুয়ানা, হেরোইন, গাঁজা, চরস সম্বন্ধে তোমাদের আমি কিচ্ছু বলব না। ওগুলোর সম্বন্ধে তোমরা ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পেয়ে যাবে। শুধু বলি, গাঁজা-চরসের দিন কিন্তু শেষ। জেন ওয়াইয়ের নয়া সেনসেশন এখন কেমিক্যাল ড্রাগ। আকারে ছোটো ট্যাবলেটের মতো, কিন্তু নেশা জবরদস্ত। শুনলে অবাক হবে, গত কয়েক বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে এই কেমিক্যাল ড্রাগেরই রমরমা। তবে কলকাতাকে এখন মাদক পাচারের রুট হিসাবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। তার মূল কারণ কী জানো? প্রথমত, আমাদের রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান। এ-রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটানের সীমান্ত রয়েছে। নেপালের ঠিক পাশেই চিন। ভারতীয় উপমহাদেশে ড্রাগ ঢোকানোর সবচেয়ে সহজ রুট তাই এ রাজ্য। দ্বিতীয়ত, এইসব কেমিক্যাল ড্রাগ তৈরির প্রচুর খরচ। বিরাট উন্নত পরিকাঠামো দরকার। তাই আমাদের দেশে এই ধরনের ড্রাগ তৈরি হয় না। কেমিক্যাল ড্রাগ মূলত তৈরি হয় মায়ানমার, থাইল্যান্ড আর চিনে। আর সেইসব ড্রাগই বিভিন্ন সীমান্ত পার করে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এ রাজ্যে। একবার শুধু এই রাজ্যে ঢোকার অপেক্ষা, তার পরেই এইসব ড্রাগ ছড়িয়ে পড়ছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। অত্যন্ত দামি হওয়ায় এলিট সোসাইটিতে বা আরও সহজ করে বললে মূলত খুব ধনী হাই সোসাইটির পার্টি সার্কিটেই এর ব্যবহার বেশি। আগে কিন্তু মাদক পাচারের জন্য সমুদ্রপথ ব্যবহার করত পাচারকারীরা। বঙ্গোপসাগর-আরব সাগর হয়ে মাদক ছড়িয়ে পড়ত উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে। এখন সেই রুটের বদলে অবস্থানগত সুবিধার জন্য এই রাজ্যকে ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারীরা। আর কলকাতা হয়ে উঠছে ট্রানজিট পয়েন্ট। আর এটাই এখন উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।”

শান্তশীল কথা বলতে-বলতেই দেখেন, তিতাস আর কাজুর মধ্যে খাবারের প্লেটের দিকে একটা অস্বাভাবিক মনোযোগ। আপাতত নিজেদের ডানহাত এবং মুখের সঠিক ব্যবহারে যাবতীয় সুখাদ্য তারা নিজেদের পেটে চালান করতে ব্যস্ত। ড্রাগ নিয়ে আলোচনায় তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আরশি খুব গম্ভীর। মিনি অস্থির। দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, অনেক প্রশ্ন ওর মাথার মধ্যে বুড়বুড়ি কাটছে।

আরশি বলে ওঠে, “আমাদের রান্নার রেখামাসির মেয়ে তো ড্রাগ খেত না, বা খায় না। ও কী করে এর মধ্যে ঢুকে পড়ল?”

শান্তশীল মৃদু হাসলেন,“ড্রাগ পাচারকারীদের অনেকরকম ক্যারিয়ার দরকার হয়। কেউ সরল, সাদাসিধে ভোলাভালা টাইপ। এইরকম গরিব বাচ্চা ছেলেমেয়েদের অল্প পয়সা দিয়ে কাজে লাগায় হয়তো। চারপাশে কেউ সন্দেহ করবে না। এদের বাবা-মায়েরাও অধিকাংশ সময়ে খোঁজ রাখে না বা টের পেলেও তারাও সাধারণত কোনও প্রশ্ন করবে না। সামান্য ক’টা কাঁচা টাকা হাতে পেলেই তারা খুশি। আর আরেকটা চক্র চেষ্টা করে বান্টাদের মতো ছেলেমেয়েদের ফাঁদে ফেলতে। আগে ড্রাগের নেশা ধরিয়ে দেয়, তারপর সেই নেশার জিনিস জোগাড় করতে যেই টাকা দরকার হয়, অমনি তাদের দিয়েই মাল পাচারের কাজটা করিয়ে নেয়। সেইজন্যেই তোমাদের জিজ্ঞেস করছিলাম, বান্টা…” কথা বলতে বলতে হঠাৎ চুপ করে যান শান্তশীল। কী ভেবে বলেন, “বান্টার ভালো নাম, ওর মুম্বই আর কলকাতার বাড়ির ঠিকানা, ওর ইস্কুলের নাম, ফোন নম্বর—যা যা তোরা জানিস চটপট আমাকে একটা কাগজে লিখে দে।”

শান্তশীল একটা সাদা কাগজ আর কলম নিয়ে আসার জন্য পাশের ঘরে উঠে যান।

রিমঝিম হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে, “এ কি! তোরা আমাদের ভাগের পকোড়াগুলোও খেয়ে নিলি?”

সত্যিই প্লেট প্রায় ফাঁকা। রিমঝিম, মিনি আর আরশি যখন কাজু আর তিতাসকে কান মলে, কাতুকুতু দিয়ে সাতদিনের ফাঁসি আর একঘণ্টার দ্বীপান্তর দেবে ঠিক করে ফেলেছে, ঠিক তখনই আরও কয়েকটি ধোঁয়া ওঠা প্লেটে উপচে পড়া চিংড়ির পকোড়া নিয়ে জেঠিমা পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন। জেঠিমা মজার মুখে বললেন, “এর থেকে ভালো নেশা আর হয় না। কী বলিস?”

ওরা সকলে মিলে ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল।

শিউচরণ ওরফে যাদবচন্দ্র ওরফে দীপনারায়ণ যখন কলকাতা এয়ারপোর্টে পৌঁছায়, তখন ভরদুপুর। কিছুক্ষণ আগেই খবর এসেছে, রুমেলা ধরা পড়েছে ট্র্যাফিক সার্জেন্টের হাতে। এইসব ক্ষেত্রে খুব প্রস্তুত থাকতে হয়। তখনই মুম্বইয়ের ফ্লাইটের টাইম জেনে অনলাইনে টিকিট কাটা, গোপন আস্তানা থেকে গোছানো ব্যাগ নিয়ে টুক করে বেরিয়ে পড়া। যত দ্রুত কলকাতা থেকে পালানো যায়। যদিও রুমেলার মতো আরও অন্তত জনা দশেক বাচ্চা রয়েছে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে, আর তারা কেউই ওর আসল নাম জানে না, তবুও পুলিশের জালে একবার ধরা পড়লেই দফারফা। বাচ্চাগুলো ওর নাম ঠিকঠাক না বলতে পারলেও পুলিশের পক্ষে সব সম্ভব। আর একবার কলকাতার ঘাঁটিতে রেইড হলেই দুম করে কয়েক কোটি টাকার লস। ওর কলকাতা আর মুম্বইয়ের ঘাঁটি ওকে এত দ্রুত বদলাতে হয়, ও নিজেও মাঝে-মধ্যে ঠান্ডা মাথায় সব পরিকল্পনা গুছিয়ে নেয় মাথার মধ্যে। একটু এদিক-ওদিক হলেই প্রচুর টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। ওরা জানে, পুলিশের থেকেও দ্রুত কাজ করে নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো। ওদের নেটওয়ার্ক আলাদা। ভীষণ স্ট্রং। আগে থেকে কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না। আর এই বছর কয়েক হল এনসিবি ইস্টার্ন জোন হেড-কোয়ার্টারে এক দুঁদে অফিসার এসেছেন, একেবারে নাজেহাল করে ছেড়ে দিচ্ছেন ওদের। এই ট্র্যাফিক সিগন্যালে আজ রুমেলার ধরা পড়াটাই যেমন অপ্রত্যাশিত। ওকে দেখে কারও সন্দেহ হবারই কথা নয়। সরল চেহারা। রাস্তার কুকুরদের ভাত খাওয়ায় বসে বসে। মেয়েটার ব্যাগে কিছু পাওয়া না গেলে আর তেমন দুশ্চিন্তা হত না। ব্যাগের মধ্যে প্যাকেট দুটো নিয়েই হল যত গোলমাল। যাক গে। এই পাড়ায় এখন আপাতত কিছুদিন ধান্দা বন্ধ। মুম্বইতে ওর ইমিডিয়েট বসকে কোড ল্যাঙ্গুয়েজে সব জানিয়ে দিয়েছে দুপুরেই।

কলকাতা আর মুম্বইয়ের এয়ারপোর্টটা ও নিজের হাতের তালুর থেকেও ভালো চেনে। কোন খাঁজে কী আছে, কোন প্রান্তে কে দাঁড়ালে কোথা থেকে কাকে লক্ষ করা যায়, সব ওর নখদর্পণে। নিজের ছোট্ট স্যুটকেসটা হ্যান্ড লাগেজের জন্য নিজের জিম্মায় রেখে একটু দূরের কোনায় বসল সে। আসার সময় কলকাতার সিম কার্ডটা পাড়ার ময়লার ভ্যাটে ফেলে দিয়ে মুম্বইয়ের সিমটা ভরে নিয়েছে। মুম্বইয়ে আবার ছোট্ট একটা মেসেজ করতেই হবে।

***

পকেট থেকে একটা খেজুরের প্যাকেট বের করে লোকটা। খবরের কাগজের ঠোঙায় স্বচ্ছ প্লাস্টিকে মোড়া। সিল করা। পাড়ার স্টেশনারি দোকান থেকে কেনা পাতি খেজুর। তল্লাশির সময় এয়ারপোর্টের লোকজন পকেট থেকে বের করে টিপে-টুপে দেখল। তারপর ছেড়েও দিল। সেই প্যাকেট থেকেই একটা খেজুর বের করে টপ করে গালে পুরল লোকটা। চিবোতে-চিবোতেই মেসেজ করল—‘মিঠা নহি হ্যায়।’ খেজুরের মধ্যেকার বীজটা মুখ থেকে ফেলতে-ফেলতেই সেই সময়টুকুর মধ্যেই অপর প্রান্ত থেকে উত্তর ঢুকল—‘উসে তিখা বনাও।’

উত্তর দেখে দুটি মেসেজই ফোন থেকে মুছে দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা খেজুর বের করে আনে লোকটা। খেজুরটাকে চোখের সামনে এনে এক ঝলক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে। কয়েক সেকেন্ডের অন্যমনস্ক মেজাজ মুহূর্তে ছিঁড়ে যায় একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে—“ও মা, ককরোচ ককরোচ! ওই দেখো ককরোচ, ও ককরোচ খাচ্ছে!”

সামনেই একটি বছর তিনেকের বাচ্চা তার দিকে আঙুল তুলে বিস্ফারিত চোখে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা-মা দুজনে দৃশ্যতই অপ্রস্তুত। ঝকঝকে এয়ারপোর্টে ‘ককরোচ’ দেখে ছেলের চেঁচিয়ে ওঠাকে আপাতত সামলাতে চাইছেন।

“কোথায় ককরোচ দেখতে পেলে তুমি?” তার মা তাকে কোলে তুলে নেন।

বাচ্চাটি লোকটার দিকে দেখিয়ে বলে, “ওই যে, ওই যে। ওই আঙ্কল বের করল। তুমি একদিন দিয়েছিলে টিফিন বক্সে। সেই ককরোচ।”

মা মুখ টিপে হাসেন। বাবা একটু বিরক্ত,“কী যে সব শেখাও বাচ্চাদের। ওটা ককরোচ কেন হবে বাবা, ককরোচ কেউ খায়, না খেতে পারে? ওটা ড্রাই ফ্রুট।”

লোকটি ততক্ষণে সতর্ক। অবিশ্বাস্য তৎপরতায় তার খেজুরের প্যাকেট সে চালান করে দিয়েছে হাতের স্যুটকেসের মধ্যে। একবার চেকিং হয়ে গিয়েছে। ফ্লাইটে ওঠার আগে সে আর কোনও বাড়তি ছেলেমানুষির মধ্যে জড়িয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে মা একটু অপ্রস্তুত হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এগিয়ে এসে খেজুরে আলাপ করতে শুরু করুক, এটা একদম চাইছে না লোকটা। এরাও কি একই ফ্লাইটে? কে জানে! খুব বিরক্তি দেখিয়ে কোনও রিস্ক না নিয়ে অত্যন্ত রাগী আর গম্ভীর মুখে তাদের এড়িয়ে লোকটি এগিয়ে যায় টয়লেটের দিকে। একটু আড়াল দরকার। ফ্লাইটের ডাক পড়লে সেখান থেকে চট করে বেরিয়ে আসা যাবে। আপাতত খেজুর বনাম আরশোলা জাতীয় কোনও বিতর্কের মধ্যে সে থাকতেই চায় না। আজকালকার বাচ্চাগুলোও মহা ডেঁপো। খেজুর দেখে তাদের আরশোলা মনে হয়? কল্পনাশক্তির বলিহারি!

পিছন ফিরে একবার আড়চোখে লক্ষ করে বাবা-মা দুজনে মিলে তিন বছরের খোকাকে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে আরশোলা আর খেজুরের মৌলিক পার্থক্য বোঝাচ্ছেন।

***

ঘরটা প্রচণ্ড অন্ধকার। চোখ সয়ে গেলেও বোঝা যায় না ঘরে কোথায় কী রয়েছে। সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে। মাথার মধ্যেটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হাতের নাগালে কোথাও কিছু আছে বলে মনে হল না। বান্টা বেশ বুঝতে পারে, এটা ওর বাড়ি নয়। এটা ওর কোনও পরিচিত বাড়িই নয়। একটা বিচ্ছিরি গন্ধওলা নোংরা ঘর। ও মেঝেতে শুয়ে ছিল এতক্ষণ। খুব ধুলো চারপাশে। গাটা ঘিনঘিন করে বান্টার। এত নোংরা ধুলো আর বাজে গন্ধওলা ঘরে ও কোথা থেকে কীভাবে এল, কিছুতেই বুঝতে পারে না। কিন্তু মাথাটা খাটাতে হবে। এখান থেকেও বেরোতে হবে। খুব আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো করে পিছিয়ে গিয়ে ভাবতে শুরু করে বান্টা।

খুব মনকেমন করত ওর। পুরোনো বন্ধুদের জন্য, কলকাতা শহরের জন্য, দাদু-দিদান-ঠাম্মি সবার জন্য। পুরোনো ইস্কুলকে তো ও পাগলের মতো মিস করে। প্রথম প্রথম এই মুম্বই শহরটাকে ওর খারাপ লাগেনি। এখানে খুব ফাস্ট লাইফ। কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলায় না। সবাই কমবেশি ব্যস্ত। নিজেদের কাজ নিয়ে ছুটোছুটি করে। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীও সবসময় ফিরে তাকানোর ফুরসত পান না। লিফটে বা সিঁড়িতে দেখা হলে বড়োজোর হাই-হ্যালো—ওই পর্যন্তই। কেউ কারও ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে চান না। একদিকে হয়তো ভালোই। অনেক অবাঞ্ছিত সমস্যা এড়ানো যায়। কিন্তু বান্টা ভেবে দেখেছে, এইভাবে ব্যস্ত জীবনে ক্রমশ একা হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাস্থ্যকর নয়। পড়াশোনা, স্কুলের ক্লাস, টিউশন সব নিয়েই ও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিল, কিন্তু ক্রমশ বান্টার খুব ফাঁকা লাগতে শুরু করল। ও ঠিক মিশতে পারছিল না সকলের সঙ্গে। ক্লাসে তেমন বন্ধুত্ব হয়নি। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার চাপ থাকে, ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিক্যালের জন্য সবাই ঘাড় গুঁজে পড়াশোনা করছে; বান্টাও শুরুতে সেইভাবেই মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু বিকেলগুলোতে ওর কষ্ট হতে থাকে। স্কুলের পুলকার থেকে নেমে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় রিমঝিমের কথা মনে পড়ে। সেই ক্যারাটে ক্লাসের ঢোলা সাদা পোশাকে লেগে থাকা ধুলো আর ঘামের গন্ধ জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তিতিরের সঙ্গে ডাইভ দিতে ইচ্ছে করে সুইমিং পুলের জলে। আরশির সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বোঁ বোঁ করে স্পিড তুলে বাড়ি ফেরা। মিনির ল্যাপটপে বিটিএস ব্যান্ডের কোরিয়ান ভাষার দুর্বোধ্য গান শোনা, আর তাদের গানের লিরিক দেখে দেখে মুখস্থ করা। এখানে বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত। ফাঁকা ফ্ল্যাটে ফিরে এক-একদিন বান্টার খুব কান্না পায়। বন্ধুদের ফোন করত শুরুতে। ওরাও করত। আস্তে আস্তে ফোন করা কমে গেল। ওরাও তো ওদের পড়াশোনা নিয়ে জেরবার। যখন ওরা ফোন করে, বান্টা হয়তো টিউশন ক্লাসে। আবার যখন বান্টা ওদের সঙ্গে কথা বলতে চায়, ওদের ততটা সময় হয় না। অল্পস্বল্প কথা বলে ছেড়ে দিতে হয়। আর তাছাড়া ওদের সবার স্মার্টফোন নেই। কাজেই হোয়াটস-অ্যাপ করা যায় না। কাজু, তিতাস, আরশিকে তো রেজাল্ট বেরোলে তারপর ভালো ফোন কিনে দেওয়ার কথা। কাজেই মাঝে মাঝে শুধু কথা বলেই কাটত ওদের।

সেদিন পুলকার আসেনি। সকালে বান্টা একাই স্কুলে গেছে। ফেরার সময়ও নিজে ফিরবে। বান্টা ভাবল, মাত্র তো তিনটে বাস স্টপ। হেঁটে-হেঁটেই তো ফেরা যায়। ব্যস্ত শহরের রাস্তাঘাট চেনা হবে, একটু হাঁটাও হবে। এখানে এসে তো ক্যারাটে, সাঁতার, সাইকেল সবই বন্ধ। ওয়াকিং ইজ দ্য বেস্ট এক্সারসাইজ ভেবে হাঁটতে শুরু করে বান্টা।

স্কুল থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে এলে বড়ো রাস্তার মোড়ে একটা ডোমিনোজ পিৎজা। পাশেই ছোট্ট একটা সুপার মার্কেট। ছোটোবড়ো অনেক দোকান। সেখানে ওদের স্কুলের ক্লাস টুয়েলভের কয়েকটি ছেলেমেয়ে জটলা করে গল্প করে রোজ। ওদের সঙ্গে মুখচেনা। ওরা অন্য স্ট্রিমে। কেউ কমার্স, কেউ হিউম্যানিটিজ। তেমন ভালো আলাপ নেই। তবুও ওদের মধ্যেই একজন চেঁচিয়ে ডাকল বান্টাকে,“হাই স্নেহা! হোয়াটস আপ?”

বান্টা, যার স্কুলের পোশাকি নাম স্নেহা, সে হাসিমুখে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ওদের দলটাকে তেমন না চিনলেও ওদের হাবভাব চালচলন দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। সেই অস্বস্তির কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই।

“আয় না আমাদের সঙ্গে! তুই বাড়ি ফিরবি তো? আমরাও ফিরব।”

বান্টা এগিয়ে যায় ওদের দিকে। ওদের মধ্যে একজনের হাতে কোকের বোতল, একটি ছেলে সিগারেট ধরিয়েছে। দুটি মেয়েই খুব স্মার্ট, বান্টা ওদের স্কুলের ফেস্টে ওয়েস্টার্ন ভোকাল গাইতে শুনেছে। আর একজন ডিবেট করে। তুখোড় কথা বলে। ওরা একে একে হাত বাড়িয়ে দেয় বান্টার দিকে। অ্যানা, রেশমি, পলক তিনটি মেয়ে। আর ছেলে দুটি জয় আর রাকেশ। বান্টার সঙ্গে খুব হইহই করে গল্প করে ওরা। অনেকদিন পরে একটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিকেলে কোল্ড ড্রিঙ্ক খেতে খেতে এটা-সেটা গল্প করে মনটা হালকা হয়। যদিও জয় আর রাকেশের স্মোক করার ধরনটা ওর ভালো লাগেনি। কিন্তু বান্টা কিচ্ছু বলেনি। এখন সবাই হঠাৎ বড়ো হতে চাইছে। কিন্তু সিগারেট খেয়ে এইভাবে বড়ো হবার কোনও মানে হয় না। বান্টা জানে, রেগুলার স্মোকিং লাংস আর ট্র্যাকিয়ার কী মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। হয়তো ওরাও জানে। জেনেবুঝেই যে করছে, তাকে গায়ে পড়ে বোঝাতে গেলে সে ভাববে অহেতুক জ্ঞান দিচ্ছে। কী দরকার বাবা!

পরদিন থেকে স্কুলের শেষে আর পুলকারে ফিরত না বান্টা। ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা মারত। দেরি করে ফিরত। ক্লাস টুয়েলভে মাঝে-মধ্যেই স্টাডি লিভ নেয় কেউ কেউ। ক্লাস বাঙ্ক করে।

একদিন পলক বলল, “আয় না আমাদের ফ্ল্যাটে। উই উইল হ্যাভ ফান। গান শুনব, সারাদিন থাকবি, খুব মজা হবে।”

বান্টার ক্যাম্পাস থেকে পলকদের ফ্ল্যাট খুব দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায়। বান্টা যেই বলল, ‘দাঁড়া, মাকে জিজ্ঞেস করি’, শুনে ওরা সকলে মিলে এত হাসল যে বলার নয়। এটা নাকি মাকে বলার মতো কোনও ব্যাপারই নয়। দুপুরে অনেকেই এইভাবে বন্ধুর বাড়ি যায়, গ্রুপ স্টাডি করে, আড্ডা দেয়। সময়মতো বাড়ি ফিরলেই তো হল। এত জানাজানির কী দরকার? আর তো একবছরের মধ্যেই অফিশিয়ালি সব অ্যাডাল্ট।

তাও বান্টা প্রথমদিন মাকে জানিয়েই পলকদের বাড়িতে এসেছিল। মাকে চিন্তায় ফেলার কোনও মানে হয় না।

পলকদের ফ্ল্যাটটা বিশাল বড়ো। পলকের নিজের ঘরটাতে বান্টাদের আস্ত ফ্ল্যাটের অর্ধেকটাই ঢুকে যাবে। দুপুরে গান চালিয়ে আড্ডা চলতে-চলতেই আরও অনেকে চলে এল। বান্টা দেখল, আড্ডার মধ্যে তাদের থেকে ছোটো বা বড়োরাও আছে। সবাই সবাইকে চেনে না। কেউ হয়তো ডেকে এনেছে, তার সঙ্গেই চলে এসেছে। আর এসেই তারা সিগারেটের প্যাকেট খুলে বসে। ঠিক সাধারণ সিগারেট নয়। তামাক ছাড়াও যেন অন্য কিছু আছে। একটা পিকিউলিয়র ধোঁয়া হয়। সাদা মোমের মতো। আর তেমন ঝাঁঝালো গন্ধ। সিগারেট না খেলেও মাথা ঝিমঝিম করে।

পলক প্রথমদিন বান্টাকে কিছু বলেনি। পরদিন বান্টা ঢোকামাত্র পলক একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল,“ট্রাই করে দেখ।”

বান্টা খুব নার্ভাস হয়ে যায়। অন্য সবাই যে যা করছে করুক, বান্টা এইসব নেশার চক্করে পড়লে বাবা-মা তো বকবে বটেই, জানাজানি হয়ে গেলে কলকাতায় গিয়ে ঠাম্মা-দিদান—কারও সামনে আর মুখ দেখাতে পারবে না সে।

পলক, রিয়া, রেশমি, অ্যানা সবাই জোর করে বান্টাকে। বার বার বোঝায়, সব স্ট্রেস কেটে যাবে, দারুণ ফুর্তি হয়, শুধু আনন্দ ছাড়া আর কিছুই থাকে না জীবনে। একবার শুধু টেস্ট করে দেখার অপেক্ষা। একদিনের তো ব্যাপার। একবার তো এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাই যায়।

পলকদের ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে আসে মাঝে মাঝে। মেয়ে ঠিক বলা যায় না। মহিলা। ওদের থেকে অনেকটাই বড়ো। পলক বান্টার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়—“শি ইজ জ্যানেট।”

জ্যানেট পলকের দিকে তাকিয়ে বলে, “পারসুয়েশন অফ প্লেজার… হিয়ার ইজ সাম মোর!”

জ্যানেটের হাত থেকে পলকের হাতে চলে আসে পাঁচটা ছোট্ট সাদা প্যাকেট। কয়েকটা ক্যাপসুল।

বান্টা একটু একটু করে কখন যেন ঢুকে পড়ে একটা মাকড়সার জালের মধ্যে।

ক্লাস টুয়েলভের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট চরম খারাপ হতেই খোঁজ পড়ল। বান্টা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে খোঁজ নিতে গিয়ে তার বাবা-মায়ের চক্ষু চড়কগাছ। বখে যাওয়া কিছু ছেলেমেয়ের পাল্লায় পড়া এক জিনিস আর তাদের সঙ্গে বসে চরস, কোকেন, গাঁজা খাওয়া! কী সর্বনাশ! স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে বান্টার কাউন্সেলিং শুরু হয়। মা ওর সঙ্গে বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু এক-একদিন দুপুর হলেই কী অবিশ্বাস্য এক চোরাটান টানতে থাকে বান্টাকে। সাইকোলজিস্ট ওকে বলেছিলেন, এটা ড্রাগের প্রভাব। নার্ভাস সিস্টেমকে একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছিল ওরা। ওইটাই এখন আসল লড়াই। ওদের মাথায় চড়তে দেওয়া যাবে না। নিজেকে বোঝাতে হবে, ওই খারাপ জিনিসগুলো তোমার সব গুণ কেড়ে নেবে। প্রতিদিন নিজেকে নিজে বলতে হবে, ওই পচা জিনিসগুলো আমার জন্য নয়। আনন্দ পাওয়ার জন্য গান আছে, ছবি আছে, গল্প আছে, সিনেমা আছে। সিগারেটের মধ্যে ভরা কোকেন, চরস আর কী কী ছিল কে জানে, বান্টা তেমন গুছিয়ে বলতেও পারেনি। শুধু মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি আমার বন্ধুদের কাউকে এসব কিছু বলোনি তো? আরশি, মিনি, রিমঝিম—ওরা কেউ কিছু জানে না তো?”

মা ওকে আশ্বস্ত করেন। কেউ কিচ্ছু জানে না। বান্টা তো না জেনেই একটা ফাঁদে পড়ে যাচ্ছিল। এখন নিজের মনের জোরেই ওকে নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে। পড়াশোনায় মন দিতে হবে। বান্টা কাউন্সেলিংয়ের সাহায্যে মনের জোরে সেইভাবেই তৈরি হয়।

কিন্তু সব পরিস্থিতি ওর হাতের নাগালে ছিল না। মাস খানেক পরে টেস্ট, তারপরে তো ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি। সেই ক’দিন বান্টা মা কিংবা বাবার সঙ্গে স্কুলে গেছে, পরীক্ষা দিয়েছে। যতটা পেরেছে পড়াশোনা করেছে মন দিয়ে। পরীক্ষা শেষ হবার পরে মা যথারীতি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজের কাজে। বাবাও আবার ট্যুর নিয়ে বাইরে। বান্টা যথারীতি বাড়িতে একা। দু-একবার কথা হল, বান্টাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কলকাতায় দাদু-দিদান-ঠাম্মা ওদের কাছে। কিন্তু একেবারে একা একা ফ্লাইটের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেওয়ার ভরসা পাচ্ছিলেন না নীনা। বরং ভাবলেন, একটু ফ্রি হয়ে নিজেই টুক করে ওকে পৌঁছে দেবেন কলকাতায়।

তার মধ্যেই ঘটল অঘটন।

পরীক্ষার জন্য বান্টার মোবাইলটা মা নিয়ে রেখে দিয়েছিলেন নিজের কাছে। ফোনটা একদম অফ করাই থাকত। পরীক্ষা শেষ। নীনা আবার কাজে যাবেন। কাজেই বান্টাকে আবার ফোনটা বের করে দেওয়া হল। কয়েকদিনের মধ্যেই বান্টার ফোনে একের পর এক মিসড কল। অচেনা নম্বর। প্রথমে ও ধরছিল না। কী মনে হতে একদিন বান্টা রিং-ব্যাক করতেই পলকের গলা—“কী রে, আমাদের একদম ভুলে গেলি?”

বান্টা একটু ভয় পায়, কিন্তু ঘাবড়ায় না,“ধুস, ভুলে যাব কেন? ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম যে! পরীক্ষার প্রিপারেশন ছিল না? তোদের পরীক্ষা কেমন হল রে?”

“ফোনটা কী হয়েছিল তোর?”

“মায়ের কাছে ছিল রে!”

“ও মাই গড! তোর মা তোর ফোন অ্যাক্সেস করেন? আমাদের নম্বর দিয়েছিস নাকি?”

বান্টা এই প্রশ্নটাতে একটু খটকা লাগে। একই স্কুলে পড়ে ওরা। ওদের কথা তো মা সবই জানেন। কিন্তু বান্টা এটাও জানে, বাবা-মা ওদের কথা কাউকে কখনও বলেননি, স্কুলেও কিচ্ছু জানাননি। শুধু বান্টাকে বুঝিয়েছিলেন, ওদের বাড়ির আড্ডায় আর না যাওয়াই ভালো। ঝগড়া করে নয়, খুব বুদ্ধি খাটিয়ে ওদের এড়িয়ে যেতে হবে।

বান্টা সায়েন্সের স্টুডেন্ট। পলক, রেশমি, জয় সবাই কমার্স। কেউ কেউ আর্টসও হতে পারে, বান্টা জানে না। ওদের ফ্ল্যাটের আড্ডার গ্রুপে অবশ্য বেশ কয়েকজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিক্যালের স্টুডেন্ট থাকত। তাদের সবার নাম জানে না বান্টা। ওখানে কেউ কাউকে ভালো চিনত না। সবাই যে-যার মতো সিগারেট খেত। খুব জোরে গান চলত। আর বেশ কয়েকবার ওই ধোঁয়া ইনহেল করলেই কেমন যেন একটা তন্দ্রা জড়ানো আবেশ ঘিরে ধরত। তখন আর কারও সঙ্গে কথা বলতে ভালোও লাগত না।

“পরীক্ষা যেমন হয়, ভালোই। শুধু মার্কস খারাপ হয়।” খিলখিল করে হেসে ওঠে পলক—“এবার আয় একদিন। অনেকদিন আসিস না তো। এখন তো ফ্রি।”

বান্টা প্রমাদ গোনে। মা পইপই করে বারণ করেছে ওকে। ওর সাইকিয়াট্রিস্টের ওষুধ এখনও ওকে মাঝে-মধ্যে খেতে হচ্ছে। ফোনে কাউন্সেলিং চলে প্রায়ই। এর মধ্যে আবার ওই ফ্ল্যাটের আড্ডায় যাওয়া কি ঠিক হবে?

ভীষণ দোনোমনা করে রাজি হয়ে যায় বান্টা। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ চলে। একবার তো। মাত্র একবার। কী হয় গেলে? ও তো আর খাবে না ওসব। শুধু ওদের সঙ্গে একবার দেখা করেই চলে আসবে। বরং ওদেরকেও বুঝিয়ে বলবে, এগুলো কত হার্মফুল। রেগুলার ওগুলো খেয়ে ওইভাবে নার্ভাস সিস্টেমের ক্ষতি করা ঠিক নয়। পরের সপ্তাহেই হয়তো কলকাতায় চলে যাবে বান্টা। তার আগে একবার না-হয় ওদের ফর্ম্যালি বাই বাই করে আসবে।

অন্ধকার নোংরা ঘরটায় শুয়ে শুয়ে বান্টার মনে পড়ে সেদিনের কথা।

ও ঘরে ঢোকামাত্রই কয়েকজন কেমন যেন অন্য চোখে তাকায়। ফিসফিস করে কথা বলে। অ্যানার কথা কানে আসে—“না না, ও কাউকে কিচ্ছু বলেনি।”

“আরে আজ বলেনি, কাল বলতে কতক্ষণ? আর ইউ শিওর অ্যাবাউট ইট?”

“ইট উইল বি ডেঞ্জারাস ফর আস। রেড-ফেড হলে বহুত প্রবলেম। আমাদের ঠেক বন্ধ হয়ে যাবে। পলক, ইউ উইল বি সোললি রেসপনসিবল। শি নোজ এভরিথিং।”

“আহ্‌-হা, চাপ নিস না প্লিজ। আমি আছি তো।” পলক বাকিদের আশ্বস্ত করে।

বান্টা দেখে, তিনটে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ পড়ে আছে একটা উপচে পড়া অ্যাশ-ট্রের পাশে। ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিক্যাল পড়ে বলে যে-দাদাদের মুখ চেনে পলক, তারা কেমন ঘোলাটে চোখে চুপ করে বসে আছে। একজন তো ঝিমোচ্ছে রীতিমতো। বান্টা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারে, এখানে শুধু নির্দোষ আনন্দ নয়, অনেক বেআইনি কারবারের গল্প আছে। কয়েক মাস ধরে বাবা-মা আর সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিং সেশনে ও অনেকটাই জেনেছে। দে আর ডেঞ্জারাস। নিজেদের ক্ষতি করছে, সেই সঙ্গে অন্যদেরও। ওদের শুধরোনো যাবে না। কিন্তু এখান থেকে যে করে হোক বেরোতেই হবে।

বান্টার চোখমুখ দেখে ওদেরও সন্দেহ হয়েছিল। বান্টা বার বার বাড়ি ফিরতে চাইছে, আর ওরা কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না। প্লিজ আর একটু বোস, বলে ওকে কেবল আটকে রাখছে। ঘরে ঢুকে অবধি সিগারেটে একবারও হাত ছোঁয়ায়নি বান্টা। ওরা খুব চাপাচাপি করলে বলেছে, গলাব্যথা, কাশি, জ্বর জ্বর।

“লেটস এনজয় ইয়ার!” পলক আর অ্যানা দু-দিকে এসে দাঁড়ায়,“হোয়াই আর ইউ সো স্কেয়ার্ড? এত ভয় পাচ্ছিস কেন? জানিস তো, ইট উইল গিভ জাস্ট টুয়েলভ আওয়ার হাই। তোর ভালো লাগেনি কখনও?”

বান্টা গম্ভীর হয়ে যায়,“তোরা যেটা করছিস, এটা খারাপ কাজ। এইভাবে ড্রাগ নিতে থাকলে নিজেদের শরীর তো খারাপ হবেই, ইটস রুইনিং আওয়ার সোসাইটি। কেন খাচ্ছিস এভাবে? হোয়াই আর ইউ রুইনিং ইয়োরসেলফ?”

“ও মাই গড! শি ইজ আওয়ার নিউ গডেস! মা গো মা, একটু ব্লেসিংস…” একটা ছেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বান্টার পায়ের ওপর।

বান্টা একবার ভাবে ছুটে বেরিয়ে যাবে ঘর থেকে। কিন্তু ততক্ষণে আরও একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে। সে নেশা করেনি। তাকে দেখে মনে হল নাইজেরিয়ান। পলক ব্যাপারটা সহজ করে—“কাম অন সুইট হার্ট, নো হার্ড ফিলিংস প্লিজ। চল বোস। কথা আছে তোর সঙ্গে। রিগার্ডিং ফিউচার প্ল্যান। কী পড়বি ঠিক করলি কিছু?”

নাইজেরিয়ান লোকটা পলকের সামনে এসে হাত পাতে। পলক একটা চাবি বের করে দেয় লোকটাকে।

“আজ তিখা কুছ হ্যায়?”

পলকের প্রশ্নে লোকটা ঠান্ডা চোখে তাকায় একবার। তারপর বান্টার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে, “ফ্রেন্ড?”

“ইয়া।”

“টুডে উই হ্যাভ টু আনলোড আ লট। বি কেয়ারফুল।” বলেই লোকটা বান্টার দিকে তাকায়।

বান্টা ভাবে, মোবাইলে লোকগুলোর ছবি তুলে নেওয়া দরকার। এরা খুব বেআইনি কাজ করে চলেছে। কিন্তু যতবার ও মোবাইল হাতে নিচ্ছে, পলক বা অ্যানা হাত থেকে টেবিলের ওপর সরিয়ে রাখছে ওর মোবাইল।

কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত পলকের ফ্ল্যাটে যে কোল্ড ড্রিঙ্কটা বান্টাকে ওরা প্রায় জোর করেই খেতে দিয়েছিল, সেটা সাধারণ চেনা স্বাদের নয়। তেতো, ঝাঁঝালো, বিশ্রী গন্ধ। সেটা এক ঢোঁক খাওয়া মাত্র ঘুম পেয়েছিল, প্রচণ্ড ঘুম। আর কিচ্ছু মনে নেই ওর। কিচ্ছু না।

নোংরা ঘরটায় শুয়ে শুয়ে শুধু ওর মনে হল, এটা কিছুতেই পলকদের ফ্ল্যাট হতে পারে না। উঠে বসার চেষ্টা করতেই বুঝল, মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।

তাহলে ও কোথায়?

“আমাদের কিন্তু মুম্বই যাওয়া খুব দরকার।” তিতাস শুয়ে-শুয়েই বলে। ও তাকিয়ে আছে ঘরের ফ্যানের ব্লেডের দিকে। যেটা ঘুরে চলেছে ফুল স্পিডে।

“যেতে চাইলেই-বা যেতে দিচ্ছে কে?” কাজুর উত্তরে যুক্তি আছে।

মিনি বলে, “বান্টাকে বাঁচাতে হলে, খুঁজে পেতে হলে মুম্বই আমাদের যেতেই হবে। নীনা-আন্টি ভীষণ আপসেট। এই অবস্থায় তাঁর পাশে থাকাটা একটা মরাল সাপোর্ট। তোরা কী বলিস?”

“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু মুম্বইতে আমরা কী আর এমন চিনি যে সেখানে গিয়ে বান্টাকে খুঁজব?”

“চাইলে অনেক কানেকশন বেরোবে ঠিকই। একটু চেষ্টা করতে হবে।”

“আরে নীনা-আন্টিকে তো চিনি রে বাবা। সেখানে গিয়ে কোনও হেল্প পাব না?”

রিমঝিম শুয়ে শুয়ে টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চার পড়ছিল বুঁদ হয়ে। ফারাওয়ের চুরুট। ইস, টিনটিন শুধু কুট্টুসের মতো একটা বুদ্ধিমান পোষ্যকে নিয়ে কী না করে বেড়িয়েছে! ফারাওয়ের চুরুট তো সেই ড্রাগের পাচারকারীদের নিয়েই লেখা। মজা আর উত্তেজনায় ভরপুর। পারফেক্ট অ্যাডভেঞ্চার। বার বার পড়লেও পুরোনো হয় না। অনেকগুলো কমিকসের মধ্যে আজ এক চান্সে এটাই হাতে এল। একেই বোধহয় সমাপতন বলে। রিমঝিম বই ফেলে চোখ কচলে পাশ ফেরে,“একমাত্র শান্তশীলজেঠু যদি আমাদের হেল্প করেন, তাহলে বাবা-মা মুম্বই ছাড়তেও পারেন। তবে ওই বান্টার খবর নিতে যাওয়া অবধি ঠিক আছে। ড্রাগের গল্প বাড়িতে ডিটেলে বলতে গেলে কপালে গভীর দুঃখ আছে।”

“রিম, তুই না ক্যারাটে জানিস? তুই ভয় পাচ্ছিস?”

কাজুর ক্যাজুয়াল মন্তব্যে চিড়বিড় করে ওঠে রিমঝিম,“এর সঙ্গে ক্যারাটের কী সম্পর্ক? বান্টাও দুরন্ত ক্যারাটে জানত। আমার তো মনে হয়, ওকে যদি কেউ কোথাও আটকে রাখে, ও ঠিক নিজেকে ছাড়িয়ে পালিয়ে আসতে পারবে। ওর ফিটনেস লেভেল সাংঘাতিক। আমি শিওর।”

মিনি তার ল্যাপটপে ড্রাগের নানারকম নেশা আর ড্রাগ পাচারের খবর খুঁজে খুঁজে পড়ছিল। হাই তুলে বলল, “এখানে শুয়ে গুলতানি মেরে সময় নষ্ট করছি আমরা। হয় মুম্বই যেতে হবে, আর নয়তো এখানে বসে নখ খেতে খেতে টেনশন করতে হবে। কোনটা করবি ভাব চটপট। সময় নষ্ট হচ্ছে।”

দুপুরবেলায় মিনিদের ফ্ল্যাটে তিতাস, রিমঝিম, কাজু আর তিতির হাজির। আরশির চলে আসার কথা। আসেনি এখনও। সাইকেল নিয়ে সে একটু দূর থেকেই আসে। ঠিক হল, আরশি এলে সবাই মিলে ফাইনাল প্ল্যান করবে। প্রথম কাজ শান্তশীলজেঠুর সাহায্য নেওয়া, তারপর বাবা-মায়েদের বোঝানো।

এইসব ভাবতে ভাবতেই কলিং-বেল। ছুটে গিয়ে কাজুই প্রথম দরজা খোলে। আরশি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

“তোর এত দেরি হল কেন রে? কখন থেকে অপেক্ষা করছি আমরা।”

আরশি থরথর করে কাঁপছে। হাঁফাচ্ছে ভীষণ,“জল দে আগে। বলছি। রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে একটা।”

ছুটে জল নিয়ে আসে তিতাস। মিনি, রিমঝিম বিছানার একপাশে বইখাতা ল্যাপটপ সব ঝড়ের গতিতে সরিয়ে বসতে দেয় আরশিকে। আরশি একটু দম নিয়ে বলতে থাকে পুরো ঘটনাটা।

ওদের পাড়ার গ্যারাজে বেশ কয়েকটা গাড়ির কাচ ভাঙা জাতীয় টুকটাক হুজ্জতি চলছিল। তিন-চারদিন ধরেও কোনও সুরাহা হয়নি। কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করলে সে কিচ্ছু বলতে পারে না। কেবল বলে, ‘টের পাইনি, ঘুমোচ্ছিলাম, জানি না…’ সবাই তিতিবিরক্ত। এ আবার কী! রোজ গ্যারাজে কারও না কারও গাড়িতে স্ক্র্যাচ পড়ছে, মনে হচ্ছে কেউ কোনও পার্টস খুলে নিতে চাইছে—ছিঁচকে চুরি হলেও চুরির চেষ্টা তো। বড়ো কিছু হতে কতক্ষণ? গাড়ির ক্ষতি কেউ বরদাস্ত করবে না। সকালে তিন-চারজন মিলে তাই লোকাল থানায় গিয়েছিলেন। আরশির বাবা জয়ন্তবাবুও ছিলেন সঙ্গে। থানার বড়োবাবু খুবই গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন ওঁদের কথা। তিনি বার বার বলেছেন, ‘খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমরা নজর রাখব। আমাদের কাছে নানান রকম খবর আসছে। তার মধ্যে এই গ্যারাজে মাঝরাতে বাইরের লোক ঢুকে পড়াটা সুবিধেজনক ব্যাপার নয়।’ থানা থেকে রাতে ওই রাস্তায় পুলিশের টহলদারি চলবে বলে আশ্বাস দিলেন বড়োবাবু। উনি গ্যারাজের কেয়ারটেকারের ওপরেও সকলকে নজর রাখতে বললেন। আসলে কোনও প্রমাণ ছাড়া এই নেপালি দারোয়ানটিকে কিছু বলা যাচ্ছে না। আবার প্রমাণের জন্য যা যা করা দরকার, মানে একটা ক্লোজড সার্কিট টিভি বসানো, এইরকমও চট করে করা যাচ্ছে না। মাঝরাতে কেয়ারটেকারের ওপরেই-বা কে আবার আলাদা করে নজরদারি করবে? কিন্তু এটাও অদ্ভুত ব্যাপার, রাতে কেয়ারটেকার এত ঘুমোচ্ছে, যে গ্যারাজে ঢুকে কেউ একের পর এক গাড়িতে হাত দিলে সে টেরই পাচ্ছে না। ভীষণ সন্দেহজনক না?

জয়ন্তবাবু বাড়ি ফিরে গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন,“এমন চললে গ্যারাজ বদলাতে হবে। কিন্তু কাছাকাছি ফাঁকা গ্যারাজই-বা পাব কোথায়?”

“আচ্ছা বাবা, নর্মালি কেউ এত ঘুমোতে পারে? হয় সে ঘুমের ওষুধ খায়, নয় তাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। আর তা না হলে ঘুমের ভান করে। আমার তো তাই মনে হচ্ছে। পুলিশ কী বলল?”

আরশির কথায় তেমন পাত্তা দিলেন না জয়ন্তবাবু। দেবার কথাও নয়। সকালের অনেকটা সময় থানায় গিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। এখন অফিসের তাড়া। একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “তুই ভাবিস সারাদিন এইসব বসে বসে। আমি এখন দৌড়লাম। অফিসে লেট হয়ে যাব।”

আরশি কথা বাড়ায় না। মা স্কুলে বেরিয়ে গেলে ও নিজেও মিনিদের বাড়িতে যাবে আজ। সবার ওখানে আসার কথা। বান্টা হারিয়ে গেছে দু-দিন হয়ে গেল। কোনও ক্লু নেই, ওরা এতদূরে বসে থেকে কিচ্ছু করতে পারছে না। খুব অস্বস্তি লাগছে।

বাবা আর মা বেরিয়ে গেলেন পরপর দুজনেই। সদর দরজায় তালা দিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে আরশি। সব গুছিয়ে-গাছিয়ে বেরোতে হবে। অগোছালো পড়ার টেবিলটা ঠিক করতে গিয়েই ছবিগুলো হাতে এল। পেনসিল স্কেচ। সেই ভবঘুরে গোছের লোকটার ছবি, যে ওদের বাড়ির পিছনের পোড়ো জমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেদিন, কী যেন খুঁজছিল। ও পাগল নয় মোটেই। বরং আরশি নিশ্চিত, ওকেই দেখেছে সেদিন বিকেলে সুইমিং পুলের বাইরে।

চটপট লোকটার ছবিগুলো ব্যাগে ভরে ফেলল আরশি। বন্ধুদের দেখাতে হবে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। ব্যাগ গুছিয়ে ঘরের জানালাটা বন্ধ করতে যেতেই প্রচণ্ড চমকে গেল আরশি। সেই লোকটা না? আজ ও ভবঘুরে পোশাক পরেনি! লোকটা দাঁড়িয়ে আছে একটা বাইক নিয়ে। নীচু হয়ে বাইকটা কী যেন খুটখাট করছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ভাবখানা এমন, যেন বাইকটা বিগড়ে গেছে, ও সেটা ঠিক করতে পারছে না। ও যেন খুব অসহায়। কিন্তু আরশি স্পষ্ট বুঝতে পারে ওই বাইক নিয়ে অপেক্ষা করার অছিলায় ওই লোকটা অন্য কোনও কাজের জন্য ওইখানে একা দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই পোড়ো জমি, চারপাশে আবর্জনা, অনেক দূর অবধি খোলা মাঠ, এদিক সেদিকে খুব ধীরে ধীরে মাথা তুলছে কিছু ফ্ল্যাটবাড়ি… এইরকম একটা জায়গায় এই লোকটা কী খুঁজতে আসে? এই নিয়ে পরপর দু-দিন ওকে দেখল না?

ঘরের জানালা বন্ধ করার সময় উত্তেজনায় হয়তো একটু বেশিই শব্দ হয়ে থাকবে। লোকটা এইদিকেই ফিরে তাকাল। আরশির বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে উত্তেজনায়।

লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে আরশিদের বাড়ির পিছন দিকটায়। বাড়ির সামনের গেটে তালা লাগানোর সময় অসম্ভব হাত কাঁপছিল আরশির। সাইকেল বের করে বড়ো রাস্তায় যেতে হবে। এই গলি পেরোলে মোড়ের মাথায় লোকজন আছে। এইদিকটা বরং দুপুরে একটু নির্জন। সাইকেল বের করেই তাতে উঠে পড়ে না আরশি। চারদিকে চোখ রেখে খুব আনমনা ভঙ্গিতে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে থাকে। দুটো গলি পরপর পেরোলে তারপর ওদের সেই গ্যারাজ। দূর থেকে চারপাশ দেখেই এগোয় আরশি।

ওদের গ্যারাজের সামনে কেয়ারটেকারকাকু দাঁড়ানো। আরে! সামনে বাইক নিয়ে সেই লোকটা না? ওকেই কী যেন জিজ্ঞেস করছে! আরশির কৌতূহলের সঙ্গে মিশে যায় ভয়। এই লোকটাই কি তাহলে গাড়ির পার্টস চুরি করতে আসে? কেয়ারটেকারের কি সাঁট রয়েছে ওর সঙ্গে? তাহলে তো একদম সর্ষের মধ্যেই ভূত! এই লোকটা নিশ্চয়ই ভবঘুরে সেজে পাড়ার খবরাখবর নেয়, আর রাতে কেয়ারটেকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করছে। শুধুই ছিঁচকে চুরি নাও হতে পারে। আরও বড়ো কোনও প্ল্যান আছে কি না কে জানে। ভাবতে-ভাবতেই আরশি দেখে কেয়ারটেকার লোকটার সঙ্গে আলগোছে কীসব কথা বলে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে গেল বড়ো রাস্তার দিকে। লোকটা এবার বাইকে স্টার্ট দিচ্ছে। আরশিও আর দেরি না করে সাইকেলে চেপে বসে প্যাডেলে চাপ দেয়।

আরশি বড়ো রাস্তায় পৌঁছানোর আগেই ঘটনাটা ঘটল। একটা বড়ো কোয়ালিস গাড়ি গলির মোড় থেকে হঠাৎ দৈত্যের মতো বেরিয়ে কেয়ারটেকারকাকুকে খুব জোরে ধাক্কা মেরে চোখের পলকে উঠে পড়ল বড়ো রাস্তায়। ঘটনাটা এতটাই আকস্মিক, আরশি চোখের পলক ফেলার আগেই দেখছে অবিশ্বাস্য টার্ন নিয়ে কোয়ালিস গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে, আর কেয়ারটেকারকাকুর মুখ থুবড়ে পড়া উলটোনো শরীরের পাশে হুড়মুড় করে এসে দাঁড়াল সেই বাইকওলা লোকটা। কোয়ালিস গাড়িটার নম্বর নেওয়ার জন্যই বোধহয় কিছুটা ছুটতে গিয়েও লোকটা থেমে যায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কেয়ারটেকারের পাশে দাঁড়িয়ে ফোন করতে থাকে। আরশির গলা অবধি আতঙ্ক। এত কাছ থেকে এইরকম অ্যাকসিডেন্ট আগে কখনও দেখেনি ও। গাড়িটা যেন এই গলির মধ্যে ওকে ধাক্কা মারবে বলেই দাঁড়িয়ে ছিল। কোনও হর্ন পর্যন্ত দেয়নি। এই গলির মধ্যে যেটা খুব অস্বাভাবিক।

চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে চলে আসার আগেই সাইকেলে স্পিড বাড়িয়ে বড়ো রাস্তায় এসে পড়ে আরশি। কোনোদিকে কোয়ালিস গাড়িটার চিহ্নমাত্র নেই।

মিনিদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পুরো ঘটনাটা বলতে বলতে খুব হাঁফাচ্ছিল আরশি। বাইক নিয়ে ওই লোকটা, তার সঙ্গে ওই কেয়ারটেকারের কথাবার্তা, তারপরেই ওই অ্যাকসিডেন্ট, কোথায় যেন সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে।

রিমঝিম পিঠে হাত রাখে আরশির,“প্লিজ একটু শান্ত হ। আমাদের প্রায়োরিটি ভেবে কাজ করতে হবে। প্রথমে আমাদের বান্টাকে খুঁজে বের করতেই হবে। মুম্বই যেতে হবে আমাদের। প্রথম কাজ শান্তশীলজেঠুর সঙ্গে কথা বলা, তারপর বাবা-মায়েদের রাজি করানো। কালকের মধ্যে আমাদের রওনা হতেই হবে। আমি জানি ফ্লাইটে টিকিট কাটা খুব সহজ। বাবাকে বলছি টিকিট কাটতে। নীনা-আন্টিকেও ফোন করে জানাতে হবে সব।”

“যত সহজে ভাবছি, ততটা সহজ নাও হতে পারে। তবে চেষ্টা করতেই হবে রে।” কাজুর কথায় সায় দেয় তিতাস।

“তবে আরশি আমার মনে হয়, তোদের ওই কেয়ারটেকার আর গাড়ি ভাঙার প্রবলেমটা পুলিশ ইজিলি সলভ করে ফেলতে পারবে। ওটা নিয়ে আর ভাবিস না। ওই কেয়ারটেকার নিশ্চয়ই গ্যারাজে চুরি করা সমর্থন করছিল না, তাও হতে পারে। আবার নিছক অ্যাকসিডেন্টও হতে পারে। আজকের ঘটনাটা মাথা থেকে বের করে দে। এইসব চক্করে আমরা ঢুকে কী করব বল?”

নিজেরা কথা বলতে-বলতেই শান্তশীল মৈত্রের বাড়ির ল্যান্ড-লাইন ফোনে ফোন করে রিমঝিম। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফোনটা ছেড়েই বলে, “জেঠু এখন বাড়িতে, অফিসে যায়নি। এক্ষুনি আমাদের জেঠুর ফ্ল্যাটে যেতে বলল। শিগগির চল।”

দুদ্দাড় করে উঠে পড়ে সকলে।

ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সকাল ন’টা দশে কলকাতা থেকে স্পাইস জেটের ফ্লাইট মুম্বই এয়ারপোর্টে ওদের পৌঁছে দিল ঠিক দুপুর বারোটায়। রিমঝিম, মিনি আর আরশি। তিনজন তাদের হালকা একটা করে ব্যাগ পিঠে নিয়ে এসে দাঁড়ায় মুম্বইতে। খুব বেশি জিনিসপত্র সঙ্গে আনেনি তারা। তিতাস, তিতির আর কাজু থেকে গেছে কলকাতায়। তারা মুম্বই আসার ছাড়পত্র পায়নি। শান্তশীলজেঠু অবশ্য কলকাতাতেই তাদের অন্য কিছু কাজ দিয়েছেন। কলকাতা-মুম্বই নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কাজ করবে ওরা প্রত্যেকে।

গতকাল দুপুরে শান্তশীলজেঠু খুব সিরিয়াস ছিলেন। দু-একবার বললেন, চারপাশে একটা ড্রাগের র‍্যাকেট খুব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সবদিকে জাল বিছিয়েছে এরা।

শুকনো খেজুরের প্যাকেটের মধ্যে করে পাচার হচ্ছিল চরসের গুলি। গত পরশু রাতে এমনই একটা মাদক পাচার চক্রের হদিশ পাওয়া গেছে। চক্রের চাঁই উধাও। সে কলকাতা থেকে পালিয়েছে। কিন্তু আন্দাজ করা হচ্ছে প্রায় কোটি টাকার চরস প্রথমে এখান থেকে পাচার করা হত চিনে, সেখান থেকে হংকং। আন্তর্জাতিক এই মাদক পাচার চক্রের শিকড় অনেক গভীরে। অনেক বড়ো মাপের ড্রাগ মাফিয়ারা এর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছেন বলে সকলে মনে করছেন।

খেজুর আর চরসের মধ্যে মিল বা অমিল কোনোটাই বুঝতে পারছিল না রিমঝিমেরা। ওদের বুঝিয়ে বলেন শান্তশীল,“সাধারণত শুকনো খেজুরের প্যাকেটের মধ্যে চরসের গুলিকে খেজুরের আকার দিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হত খেজুরের সঙ্গে। বাইরে থেকে বোঝাই যাবে না ওই প্যাকেটে খেজুর ছাড়া অন্য কিছু আছে বলে। কারণ, শুকনো খেজুরও একটু কালচে রঙের হয়, চরসের গুলিও কালচে। এরপর সেই খেজুরভর্তি প্যাকেট সুটকেসে ভরে নিয়ে যাত্রী সেজে মাদক পাচারকারীরা পাড়ি দিতেন চিনের কুনমিংয়ে। গতকাল সকালেই কুনমিংয়ের বিমান ধরার কথা ছিল এই দলের মাথার। তার আসল নাম জানা যায়নি। কিশোর মালহোত্রা নামে ঘরভাড়া নিয়েছিল। তার ডেরায় হানা দিয়ে চিনের বিমানের টিকিটও হাতে পেয়েছেন গোয়েন্দারা। কিন্তু সে চিনের দিকে যায়নি। দিল্লির ফ্লাইটও ধরেনি। কুনমিং-এ পৌঁছানোর পর সেখান থেকে চরস নিয়ে হংকং রওনা দিত অন্য একটি দল। আরশিদের বাড়ির রান্নামাসির মেয়ে রুমেলাও সম্ভবত এদের খপ্পরে পড়েছিল।”

চমকে ওঠে আরশি। ঠিক তাই। রুমেলার মা এসে বলেছে, রুমেলা বার বার কেঁদে কেঁদে বলেছিল, ওই প্যাকেটে খাবার ছিল। শুকনো খাবার। ও তো জানত না, ওর মধ্যে ড্রাগ রয়েছে। ইস, বেচারি রুমেলা হোমে আটকে রয়েছে। কবে যে ও ছাড়া পাবে!

মিনি জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা জেঠু, এই চরস আসে কোথা থেকে?”

শান্তশীল বলেন, “খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে নেপাল থেকে বীরগঞ্জ হয়ে বিহারের রক্সৌল সীমান্ত দিয়ে সড়কপথে ভারতে এসে পৌঁছায় ওই চরস। এরপর সেই চরস ট্রেনে করে নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। শহরে ওই মাদক আনার পর খেজুরের প্যাকেটে ভরে সেগুলো পাচার করা হত। চরসের সঙ্গে সমান পরিমাণ খেজুর মেশানো হত, যাতে বোঝা না যায় যে খেজুরের প্যাকেটে অন্য কিছু আছে বলে।”

কাজু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “এই চরস কি খেজুরের মতো চিবিয়ে খায়?”

শান্তশীল হাসেন,“সেই গানটা শুনেছ তোমরা? মা আমাদের পাগলিনী/ পাগলা বাবা গাঁজাখোর? পাগলা বাবা এখানে স্বয়ং শিবঠাকুর। আমাদের হিন্দুধর্মে তো বটেই, অথর্ববেদেও স্বীকৃতি রয়েছে গাঁজা বা গঞ্জিকা সেবনের। বৈষ্ণব থেকে শাক্ত যিনিই হোন, গাঁজার ছিলিমে টান দেবার ব্যাপারে সকলের একরকম টান। সবাই একজোট। গাঁজা হল আসলে একরকম পাহাড়ি গাছ, তার বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানাবিস স্যাটাইভা। তার শুকনো পাতাকে বলা হয় ভাং বা সিদ্ধি। এই শুকনো পাতা বেটেই কিন্তু সিদ্ধির শরবত খাওয়া হয়। তার প্রভাবও তেমন।  দুর্গাপুজোর ভাসানের পর অনেক বাড়িতেই সিদ্ধির শরবত খাওয়ার প্রচলন আছে। আর এই গাঁজা গাছেরই কাঁচা পাতা আর ফুলের রস থেকে তৈরি হয় চরস। চরসের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা হচ্ছে হাশিশ আর মারিজুয়ানা। কিন্তু মোটামুটি এই গাঁজা, ভাং, সিদ্ধি, চরস সবই কাছাকাছি।”

“এই চরসের দাম কত?”

“এক কেজি চরস ভারতীয় টাকায় প্রায় লাখ তিনেক টাকা তো বটেই। আর সেই জন্যেই তার নিষিদ্ধ পাচারে এত বিপদ, এত সতর্কতা।”

“বান্টা যে কোন ড্রাগের পাল্লায় পড়েছিল, সেটা নীনা-আন্টির কাছে গিয়ে জানতে হবে।”

“এক সেকেন্ড জেঠু, এই লোকটা আমাদের বাড়ির চারপাশে কয়েকদিন ধরে খুব ঘুরছে। আমি কয়েকটা স্কেচ করেছি ওর। একটু দেখবে?”

আরশির কথায় রিমঝিমের ভুরু কুঁচকে যায়, মিনিও একটু অধৈর্য। এর মধ্যেও আরশি লোকটাকে ভুলতে পারছে না? কিন্তু শান্তশীল ছবিগুলো দেখে চমকে ওঠেন। ওদের তেমন কিছু বুঝতে না দিয়েই বলেন, “অসাধারণ স্কেচ আরশি। জাস্ট অসাধারণ। মনে রেখো, তোমার এই অভিযানে কিন্তু একটাই জরুরি কাজ, যেখানে যত সন্দেহভাজন লোক দেখবে, তাদের স্কেচ করে রেখো। খুব কাজে লাগবে আমাদের। মাথার মধ্যে চেহারাটা গেঁথে ফেলবে। যেটা তুমি খুব ভালো পারো। আর জানোই তো, কাগজে ছবি আঁকলে কেউ তেমন সন্দেহ করে না। কিন্তু সবসময় সব জায়গায় ক্যামেরা বের করে ছবি তোলা যায় না, সেটা বোকামি।” এই বলে শান্তশীল আরশির দেওয়া ছবিগুলোর মধ্যে থেকে একটা পেনসিল স্কেচ নিজের সেন্টার টেবিলে রাখেন,“এটা আমি নিলাম। বাকিগুলো তুমি রাখো।”

শান্তশীলের কথায় মিনি, আরশি আর রিমঝিমের বাবা-মা তাদের মুম্বই যাবার অনুমতি দিলেও কাজু, তিতাস আর তিতির একটু মনমরা হয়ে যায়। শান্তশীল ওদের আশ্বস্ত করেন। বান্টার খোঁজ নিতে তিনজন মুম্বই যাচ্ছে যাক, এদিকেও চোখ রাখা খুব জরুরি। ওদের চটপট কিছু কাজ বুঝিয়ে দেন শান্তশীল।

মুম্বই এয়ারপোর্টের দিনরাত সব সমান। অবিশ্বাস্য ব্যস্ততা। নীনা-আন্টিকে ফোন করে সব বলা ছিল। এয়ারপোর্ট থেকেই নীনা-আন্টির অফিসের ড্রাইভার ওদের তিনজনকে সোজা নিয়ে যায় বান্দ্রার বিনায়ক অ্যাপার্টমেন্টে। নীনা-আন্টিকে চেনা যাচ্ছে না। চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন কেঁদে কেঁদে। মিনি, আরশি আর রিমঝিমকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেন নীনা,“তোরাই বান্টাকে ফিরিয়ে আন। তোরা ঠিক পারবি।”

“তুমি একদম চিন্তা কোরো না আন্টি। আমাদের হাতে সময় কম। খুব চটপট কাজ গোছাতে হবে আমাদের।”

রিমঝিমের কথায় সায় দেয় মিনি।

হাতমুখ ধুয়ে চটপট খেতে বসে পড়ে ওরা তিনজন। সেই কোন ভোরে এয়ারপোর্টে পৌঁছেছে। ভালো করে স্নানও হয়নি। কিন্তু আপাতত খিদেয় পেট জ্বলছে বলে আগে সবাই খেয়ে নেবে বলে ঠিক করল। খাওয়ার টেবিলে বসেই কথা বলতে শুরু করে ওরা।

“এইখানে বান্টার বন্ধু কারা ছিল আন্টি? আমাদের তাদের সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলতে হবে।”

নীনা চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। গুছিয়ে নেন নিজেকে,“বান্টার তেমন কোনও বন্ধু ছিল না এখানে। কলকাতা থেকে আসার পর খুব মিস করত তোদের। আমারও এখানে খুব কাজের প্রেশার ছিল। আমিও তেমন সময় দিতে পারিনি ওকে। ও নিজের পড়াশোনা নিয়ে থাকত…”

“জানি আন্টি। আমাদের সঙ্গেও পরের দিকে তেমন বেশি কথা হত না। কিন্তু এখানে কারও সঙ্গেই কি ও কথা বলত না? কারও বাড়িতে যেত না?”

মিনির প্রশ্নে ওর দিকে তাকান নীনা,“যেত। মানে ক্লাস টুয়েলভের ক্লাস শুরুর সময় থেকে ওর কয়েকজন বন্ধু হয়েছিল। তারাও ওর স্কুলে একই ব্যাচের। কিন্তু অন্য স্ট্রিমের। তাদের মধ্যে একজনের নাম পলক, একজন অ্যানা। এদের দুজনের নাম আমি জানি। এই পলকের বাড়িতেই ও হুটহাট করে দুপুরবেলা চলে যেত।”

“বান্টা নিখোঁজ হবার পর তুমি এদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলে?”

“আমি কাউকে নিজে থেকে যোগাযোগ করিনি। আমি এখানে সেইভাবে কাউকে চিনি না। আমার কাছে এদের কারও ফোন নম্বর নেই। আর মুম্বই ইজ নট কলকাতা। এখানে খুব প্রফেশনাল সকলে, কেউ কারও পার্সোনাল ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করে না।”

“পুলিশকে বলোনি কিছু?”

“সব বলেছি। পুলিশ খুব ওপর ওপর কেসটা নিয়েছে। খুব লাইটলি। তাদের বক্তব্য, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কোথাও অ্যাডভেঞ্চারে গেছে। এই বয়সে এই সময়ে ইটস কোয়ায়েট ন্যাচরাল। কিন্তু আমি জানি, আমার মেয়ে আমাকে না বলে কক্ষনও কোথাও যায়নি, যাবে না।”

“পুলিশ কি এই পলক বা অ্যানার বাড়িতে গেছে?”

“তা আমি জানি না রে। পুলিশ আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে, সেইদিন বান্টা কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। আমি যতটুকু জানি, আমি রোজ অফিসে বেরিয়ে যাই সকাল ন’টায়। সেদিনও তেমনই বেরিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরতে আমার রাত আটটা হয়েই যায়। বান্টা কিন্তু সারাদিনে একবারও ফোন করেনি আমায়। ও যে বাড়ি থেকে বেরোবে, আমি তাও জানতাম না; ও কোথায় যেতে পারে তা নিয়েও একদম ক্লুলেস আমি। পুলিশকে কেবল বলেছিলাম, এই শহরে ও তেমন কাউকে চেনে না, ওই পলকদের ফ্ল্যাটেই যা একসময়ে যেত।”

রিমঝিম, মিনি আর আরশি চুপ করে থাকে খানিকক্ষণ।

“আন্টি, পলকের ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে?”

“এটাই মুশকিল। পলকের ফোন নম্বর তো নেই। পুলিশ হয়তো স্কুলে খোঁজ করে পেয়ে যেতে পারে। সেটা করেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু থানা থেকে কালও আমাদের বলেছে, বান্টা কোথায় গেছে ওর স্কুলের বন্ধুরা কেউ কিচ্ছু জানে না।”

“রিডিকিউলাস। কোনও মানুষ এভাবে ভ্যানিশ হয়ে যায় নাকি? যত্তসব।” মিনি রেগেমেগে বলে ওঠে।

“যত দ্রুত সম্ভব এই পলক, অ্যানা এদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করতে হবে। অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। আর এদের একদম বলা যাবে না আমরা বান্টার বন্ধু।”

রিমঝিমের কথায় লাফিয়ে ওঠে আরশি আর মিনি,“ঠিক বলেছিস। আন্টি, পলকের বাড়ির লোকেশন বা অ্যাড্রেসটা দাও তো। আমরা বাকিটা বুঝে নিচ্ছি।”

মিনি গম্ভীর গলায় বলে, “এক মিনিট দাঁড়া। ওদের স্কুলের ওয়েবসাইটে স্টুডেন্ট প্রোফাইল চেক করলে বোঝা যাবে। আর এই কাজটা গার্জিয়ান হিসেবে তুমি করতেই পারো আন্টি। তুমি স্কুলের ওয়েবসাইটে লগ ইন করো। আমরা বাকিটা বুঝে নিচ্ছি।”

নীনা ছুটে গিয়ে ডেস্কটপ অন করেন। সব ঠিকঠাক করতে করতে একবার বলেন, “আমি যতদূর জানি, পলকদের ফ্ল্যাট খুব দূরে নয়। স্কুল থেকে ফেরার পথে দুটো বাস স্টপ। বান্টা ওদের বাড়িতে বরাবর হেঁটে-হেঁটেই যেত।”

“আচ্ছা আন্টি, প্লিজ তোমাকে একটা প্রশ্ন করব, ডোন্ট মাইন্ড।”

মিনির কথায় ফিরে তাকান নীনা। স্কুলের ওয়েবসাইট খুলে গেছে ততক্ষণে। স্টুডেন্ট প্রোফাইল চেক করার জন্য পাসওয়ার্ড টাইপ করছেন নীনা,“বল মিনি।”

“বান্টা যে ড্রাগের নেশায় পড়েছিল, পুলিশকে তুমি জানিয়েছিলে?”

নীনা বাঁহাত দিয়ে কপালের দু-পাশের শিরা দুটো চেপে ধরেন,“অনেকবার বলতে চেয়েছি রে, অনেকবার। তোদের আঙ্কল বাধা দিয়েছেন আমায়; বলেছেন ও তো রেগুলার ড্রাগ খেত না, দু-একবার মাঝে-মধ্যে গিয়ে ভুল করে খেয়ে ফেলেছিল—শি ইজ নট অ্যান অ্যাডিক্ট। রিহ্যাবিলিটেশন না হলেও বহুদিন ধরে সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং হয়েছে ওর, অ্যান্ড আলটিমেটলি শি ওয়জ ফাইন। কেন পুলিশকে এসব বলতে যাব? এসব বলা মানেই তো খবরটা ছড়িয়ে যাবে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সব জেনে যাবে… ছ’সাত মাস আগে থেকে বান্টা যে ড্রাগের নেশার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল, এ-কথা পুলিশ কেন, ওর স্কুলেও কেউ জানে না। কাউকে কিচ্ছু বলিনি আমরা। ইন ফ্যাক্ট, বান্টা তোদেরও এইসব কথা বলতে বারণ করে দিয়েছিল।”

“এটা একদিকে যেমন সুবিধের, আবার একদিকে খুব অসুবিধের। দেখি।”

মিনি ততক্ষণে ক্লাস টুয়েলভের সমস্ত স্টুডেন্টদের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করে নিয়েছে দুটো নাম—অ্যানা নিকলসন আর পলক জয়সওয়াল।

“অ্যানার বাবা বিদেশি, দেখ।”

“হ্যাঁ। তাই তো দেখছি। সারনেম দেখে এত কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে ছবিটা… মেয়েটিকে কিন্তু ঠিক ইউরোপিয়ান মনে হচ্ছে না।”

আরশি ততক্ষণে অ্যানা আর পলকের ছবি স্কেচ করতে শুরু করেছে খাতায়।

“চল, আমাদের চটপট বেরোতে হবে। হাতে সময় কম। জেঠুকে ফোন করি একটা। তারপর নেক্সট ডেস্টিনেশন পলকদের ফ্ল্যাট।”

স্টুডেন্ট প্রোফাইলে বাড়ির ঠিকানা দেওয়া রয়েছে। গজরাজ অ্যাপার্টমেন্ট। গুগল ম্যাপে ফেলামাত্রই লোকেশন পাওয়া গেল। বান্টাদের বাড়ি থেকে হার্ডলি আধঘণ্টার রাস্তা। ওরা ঠিক করল প্রথমে বান্টাদের স্কুলের দিকের রাস্তায় যাবে। তারপর সেখান থেকে এই গজরাজ অ্যাপার্টমেন্ট। পুরো রাস্তা ওরা হেঁটেই যাবে।

১০

“এনজিওর নামটা ঠিকঠাক বলতে পারবি তো?”

“আরে, হ্যাঁ রে বাবা!”

“স্কুলের স্ট্যাম্প দেওয়া চিঠি আর আমাদের আইডেন্টিটি কার্ড এনেছিস?”

“আরে এই তো রয়েছে, দেখ না।”

“বলছি, কী কী প্রশ্ন করবি গুছিয়ে নিয়েছিস?”

কাজুর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় তিতাস। কটমট করে তাকায় এবার,“তুই কি আদৌ ভেতরে যাবি, না এইসব বেআক্কেলে প্রশ্ন করে যাবি আমাকে?”

সরকারি জুভেনাইল জাস্টিস হোমে রুমেলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তিতাস আর কাজু। শান্তশীল নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরে কথা বলে ওদের হোমে ঢোকার পারমিশন করিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, হঠাৎ হোমে ঢুকে কী করবে ওরা, তার পথও বাতলে দিয়েছেন তিনি।

সোশিওলজির ছাত্রী হিসেবে একটা এনজিওর জন্য প্রোজেক্ট করছে ওরা। সেই এনজিও টিন-এজ কিশোরীদের অপরাধ মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছে। কাজুর কম্বিনেশনে সোশিওলজি আর তিতাসের সাইকোলজি থাকায় দুজন মিলে এই প্রোজেক্টটা করছে। বেসরকারি একটি এনজিওর হয়ে তারা বিভিন্ন জুভেনাইল জাস্টিস হোমে যাচ্ছে মেয়েদের ইন্টারভিউ নিতে। প্ল্যানটা এইরকমভাবেই সাজানো হয়েছে। হোমের সুপার এবং ওয়ার্ডেনকে ফোন করে সকালবেলাতেই হোমের গেটে এসে হাজির দুই বন্ধু। আসল উদ্দেশ্য রুমেলার সঙ্গে দেখা করে ওই ড্রাগের পাচারকারী সম্বন্ধে যতটা সম্ভব বিস্তারিত জেনে নেওয়া।

আইনের জালে জড়িয়ে পড়া নাবালক, যাদের বলা হয় চাইল্ড কনফ্লিক্টেড ইন ল’, তাদের থাকার জন্য খোলা জায়গার মধ্যে একটা হোস্টেলের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। বাগান রয়েছে। একটা ছোটো লাইব্রেরি। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই বড়ো অবসাদ। চারপাশে অগোছালো ভাব।

সুপারের ঘরে গিয়ে বসল ওরা। খুব ভারিক্কি রাশভারী চেহারার সুপার অভিজিৎবাবু ওদের খুব একটা পাত্তা দিলেন না। হাতের কাগজপত্র দেখে আলগোছে বললেন, “আমরা সাধারণত কাউকে ভেতরে অ্যালাউ করি না। তোমরা খুব ভারী ভারী রেফারেন্স নিয়ে এসেছ, তাই ঢুকতে দিচ্ছি। কিন্তু আধঘণ্টার বেশি নয়। সঙ্গে একজন ওয়ার্ডেনকে দিচ্ছি। সব বাচ্চারা তোমাদের সঙ্গে কথাও বলবে না হয়তো। দেখো, তোমরা কতদূর কী করতে পারো।”

“স্যার, অনেক ধন্যবাদ। আপনি যে এভাবে হেল্প করবেন… আমরা যত তাড়াতাড়ি পারব… জাস্ট কয়েকজনের সঙ্গে… ওই আর কি।” কাজু স্মার্টলি বলে।

দুজনে আর সময় নষ্ট করে না। চটপট রুমেলার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আরশির কাছ থেকে রুমেলার একটা স্কেচ নিয়ে এসেছে ওরা। এতজনের মধ্যে থেকে রুমেলাকে চিনে নিতে একদম অসুবিধে হবে না। দাঁত বের করে হেসে সুপারের সঙ্গে হ্যান্ড-শেক করে ভেতরে চলে যায় তিতাস আর কাজু।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অনেকেই। কেউ ঘরে, কেউ খোলা বাগানে। একজন ওয়ার্ডেন সঙ্গে করে নিয়ে যান ওদের।

“কার সঙ্গে কথা বলবে তোমরা?”

“আচ্ছা, একদম রিসেন্টলি এখানে কেউ এসেছে? মানে সে তো একদম নভিস, খুব পোড়খাওয়া অপরাধী নয়, আমরা তাহলে তাকে দিয়েই শুরু করতাম।”

তিতাসের উপস্থিত বুদ্ধিকে মনে মনে তারিফ করে কাজু।

“হ্যাঁ। কয়েকদিন আগে এসেছে একটা বাচ্চা মেয়ে। সে তো বসে বসে কাঁদে কেবল। ট্রাফিক ওকে ধরেছিল। ব্যাগে করে কীসব হাবিজাবি পাচার করছিল নাকি। তার কাছে যাবে? সে তো কথাই বলে না কারও সঙ্গে।”

ওয়ার্ডেনের কথায় ভীষণ উৎসাহিত হয় দুজনে। এক চান্সে রুমেলার খোঁজ পেয়ে যাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, যে কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না, তার সাইকোলজিটা তো আমাদের বুঝতেই হবে! তার সঙ্গেই আগে কথা বলি বরং।”

ওয়ার্ডেনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কোনার একটা বড়ো ঘরে গিয়ে পৌঁছায় দুজন। একটা বড়ো জানালার সামনে একটা চৌকিতে পিছন ফিরে বসে আছে একটা মেয়ে। কাঁধ ছাপানো কোঁকড়ানো চুল এলোমেলো। রোগা চেহারা। তার কাছে গিয়ে ওয়ার্ডেন জোরে হাঁক দেন, “রুমেলা!”

রুমেলা চমকে তাকায়। তার দুই গালে জলের ধারা শুকিয়ে রয়েছে। ওয়ার্ডেনের ডাকে ভয় পেলেও সঙ্গে দুটি কিশোরীকে দেখে অবাক হয়। কাজু বুঝে নেয়, এর সঙ্গে একা কথা বলতে হলে ওয়ার্ডেনকে কিছুক্ষণ এর সামনে থেকে সরাতেই হবে। চটপট চোখে চোখে ইশারা বিনিময় হয়ে যায় কাজু আর তিতাসের। তিতাস রুমেলার সামনে গিয়ে বসে, আর কাজু বলে, “আচ্ছা ম্যাডাম, ড্রাগের সঙ্গে জড়িয়ে আর কেউ কি এখানে কখনও ধরা পড়েছে?”

ওয়ার্ডেন একটু ভেবে বলেন, “হুম। একজন এর পাশের ঘরেই আছে। চন্দা। ও আগে শিয়ালদার দিকে একটা ঝুপড়িতে থাকত। নেশা করত শুনেছি। টুকটাক ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে। ওকে ডাকব?”

তিতাস বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো হয়। একসঙ্গে কথা বলে নেব।”

কাজু তাড়াতাড়ি বলে, “আমিই বরং যাচ্ছি ম্যাডাম আপনার সঙ্গে। চলুন না। ও যদি এখানে না আসতে চায়। তিতাস তুই ততক্ষণ…”

তিতাসকে ইশারা করে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে পাশের ঘরে চলে যায় কাজু।

এক সেকেন্ডের মধ্যে রুমেলার হাত ধরে তিতাস বলে, “রুমি, একদম ভয় পেও না। আমরা আরশিদিদির বন্ধু। তুমি শিগগিরি বলো কে তোমাকে ওই প্যাকেটগুলো দিত।”

‘আরশিদিদির বন্ধু’ কথাটা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। রুমেলার চোখে আলো জ্বলে ওঠে যেন। এক মুহূর্তের মধ্যে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে সে,“আমার কুকুরছানাগুলো… ওদের কী হবে দিদি? কে খেতে দেবে ওদের?”

“একদম চিন্তা কোরো না, এখান থেকে বেরিয়ে আগে আমরা ওদের খেতে দেব। রোজ গিয়ে দিয়ে আসব। ওদের সব দায়িত্ব এখন আমাদের। তুমি কেবল বলো, ওই লোকটাকে কেমন করে চিনলে তুমি?”

চোখ মুছে রুমেলা বলে সব ঘটনা। কেমন করে ইস্কুলের সামনে লোকটা রোজ দাঁড়িয়ে থাকত। ওদের ডেকে ডেকে আলুকাবলি খাওয়াত। আর ওর কুকুরছানাদের খাওয়ানোর পয়সা দেবার লোভ দেখিয়ে নানান ঠিকানায় সাদা কাগজের প্যাকেট পৌঁছে দিতে বলত,“জানো দিদি, আমি প্রথম দিন কিছু নিতেই চাইনি। বলেছি, আগে তুমি নিজে খুলে দেখাও ওই প্যাকেটে কী আছে, তারপরে ধরব। কাকুটা আমাকে খুলে দেখাল প্যাকেটের মধ্যে একগাদা খেজুর। আমাকে খেতে দিল। নিজেও খেল আমার সামনে। তারপর বলল, এগুলো রোগীদের খাওয়ার জিনিস। আমি এগুলো অর্ডার পাই আর ডেলিভারি করি। একা একা আর পারছি না রে। তোকে পঞ্চাশ টাকা করে দেব, আমার প্যাকেটগুলো একটু পৌঁছে দিবি? বিশ্বাস করো দিদি, ওর মধ্যে তো আমি খেজুর দেখেছি। আমি নিজে প্রথমদিন খেয়েছি। ওগুলো খারাপ জিনিস কেন হবে? পুলিশকাকুরা আমায় শুধুমুধু ধরল। ও দিদি গো, আমি বাড়ি যাব, মার কাছে যাব, আমি আর কক্ষনও কোনও অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলব না, তোমরা আমায় বাড়ি নিয়ে চলো।” কথা বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলে রুমেলা।

তিতাস ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,“আমরা সবাই তোকে খুব শিগগিরি বাড়ি নিয়ে যাব রে। একদম ভাবিস না। পুলিশকাকুরা ঠিক তোকে এবার বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। তুই কেবল দেখে বল, এই লোকটাই কি তোকে প্যাকেট দিত?”

আরশির আঁকা পেন্সিল স্কেচটা তিতাস বের করে দেখায় রুমেলাকে। রুমেলা চোখ মুছে তাকায়। খুব ভালো করে দেখে ছবিটা। তারপর বলে, “এই লোকটা তো সেই দীপকাকু নয় গো দিদি। কিন্তু এই লোকটা… এই লোকটাকে আমি একবার অনেকক্ষণ দেখেছি গো, মনে আছে আমার।”

“কোথায় দেখেছিস ওকে রুমেলা বল শিগগিরি!”

“যেদিন ট্রাফিক পুলিশকাকু আমায় ধরল, সেইদিন যখন একটা প্যাকেট পৌঁছে দিতে যাচ্ছি, এই লোকটা বাইক নিয়ে সেই গলির মোড়েই দাঁড়িয়ে ছিল।”

“কোন গলির মোড়ে?”

“তপসিয়ার কাছে একটা বাড়িতে প্যাকেট দিতে যাচ্ছিলাম। আমাকে ঠিকানা বলেনি, শুধু বড়ো রাস্তার ধারে গলিটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর সেই গলির মোড়ে ভরদুপুরে এই কাকুটা বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখেই বলল, ও খুকি, পঁয়ত্রিশ নম্বর বাড়িটা চেনো? আমি বললাম, আমি এই পাড়ায় কিচ্ছু চিনি না। সে বলল, আমার ওই বাড়িটাতে যাওয়া খুব দরকার। আমার এক বন্ধুর খুব অসুখ করেছে। কাকে জিজ্ঞেস করি বলো তো? আমি বললাম, তুমি তোমার বন্ধুকে ফোন করো। সে বলল, করছি তো, নম্বরে পাচ্ছি না। ও ধরছেই না। নিশ্চয়ই ওর খুব বিপদ। আমি ওকে বললাম, তুমি তাহলে কোনও দোকানে জিজ্ঞেস করো। তখন ও আমাকে বলল, তুমি এখানে কোথায় যাচ্ছ? এখানে কি তোমার ইস্কুল? আমি বলেছি, না এখানে আমার ইস্কুল না। তখন বলল, তবে তুমি ইস্কুলের জামা পরে এই অচেনা পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? জানো দিদি, আমার তখন খুব ভয় করল। আমার মনে হল, এই লোকটা নিশ্চয়ই ছেলেধরা, আমাকে যদি ধরে নিয়ে যায়? ভয়ে আমি এক জোরে ছুট দিলাম। লোকটা কিন্তু আমার পেছনে এল না। বাইক নিয়ে ওখানেই বসে বসে কাকে তখন ফোন করতে লাগল। আর তার খানিকক্ষণ পরেই আমি সোজা বড়ো রাস্তায় বেরিয়ে এসেছি। পেছন থেকে একটা ট্রাফিককাকু ঘ্যাঁচ করে এসে বাইক থামাল, আর বকতে শুরু করল আমাকে। জিজ্ঞেস করল, ব্যাগে কী আছে? ব্যাগ দাও এক্ষুনি। তারপর পুলিশের একটা জিপ গাড়িতে করে ওরা আমায় থানায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু ছবির এই লোকটাকে আমার পষ্ট মনে আছে গো দিদি।”

“আচ্ছা রুমেলা, তুই যাদের হাতে প্যাকেট দিতিস, তাদের কারও সম্পর্কে কিছু মনে আছে, এমন কিছু, যেটা একবার দেখলেই মনে থাকে?”

“হ্যাঁ গো, দু-তিনবার আমি যাদের প্যাকেট দিয়েছি, তারা সব খুব কালো লম্বা আর কোঁকড়ানো চুল। বাংলা বুঝত না। প্যাকেট হাতে নিয়ে ত্যাঙ্কু ত্যাঙ্কু বলত। তারা আমাদের মতো দেখতে নয়, অন্যরকম দেখতে। আর বাকি সময় বাইক নিয়ে কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে থাকত। তারাই নিজেরা ডাকত আমায়। বলত, দীপকাকু আমাদের খাবার পাঠিয়েছে? শিগগির দে।”

রুমেলার কথা শেষ হতে না হতেই ওয়ার্ডেনের সঙ্গে কাজু এসে ঘরে ঢুকে পড়ে।

“একটা এক্সক্লুসিভ স্টোরি পেয়েছি। আমাদের প্রোজেক্টে খুব ভালো ইনপুট হবে।” কাজুর হাসিমুখের ইশারা দেখে তিতাস বোঝে এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।

রুমেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিতাস বলে, “ভয় পাস না রে। আর একদম মনখারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার আসব। আর তোর কুকুরছানাদের সব দায়িত্ব আজ থেকে আমাদের। তুই কোনও চিন্তা করিস না।”

রুমেলা ছলছল চোখে তাকায়। তিতাস সব গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে।

বাইরে এসে দম ছাড়ে ওরা। সেইভাবে কিছু কাজ এগোল কি? কে জানে! মাথার মধ্যে আরও সব গুলিয়ে গেল যেন। কে ওই লোকটা যে রুমেলাকে ড্রাগের প্যাকেট দিত, তা তো ভালো করে জানাই গেল না। আর এই যে লোকটার ছবি এঁকেছে আরশি, সেও কি ড্রাগের চালানে জড়িয়ে আছে? অন্য দল, না এই দলেরই কেউ? তার সঙ্গে কেন দেখা হল রুমেলার?

“বুঝলি কাজু, একটা জিনিস পরিষ্কার, রুমেলা যাদের হাতে প্যাকেট পাচার করত, তারা অনেকেই বিদেশি। তারা রুমেলার কাছ থেকে প্যাকেট নিয়ে নিশ্চয়ই কলকাতার বাইরে চলে যেত, আই মিন, দেশের বাইরে।”

“এটা ভালো ইনফো। শান্তশীলজেঠুকে আজই জানাচ্ছি। তবে ওই পাশের ঘরের চন্দা মেয়েটি কিন্তু বেশ চৌকস। সে নিজে ড্রাগ খেত, বেশ বোঝা গেল। আর সে ড্রাগ খেত বলেই এই কাজটায় তার এখনও তেমন অপরাধবোধ নেই।”

কাজুর ফোনে রিং হচ্ছে। তিতিরের ফোন। পিজি হসপিটালে রয়েছে তিতির। অ্যাকসিডেন্টে আরশিদের গ্যারাজের সেই কেয়ারটেকারের অবস্থা খুবই খারাপ। বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এইটুকু খবর দিয়েই তিতির ফোন কেটে দেয়।

কাজু বলে, “চল তিতাস, আমরা একবার রুমেলাদের পাড়ায় যাই। ওদের বাড়ি থেকে স্কুলে যাবার রাস্তাটা ভালো করে দেখতে হবে একটু। যদি কিছু ক্লু পাওয়া যায়।”

১১

একটু সন্ধের দিকে শিউচরণ ওরফে যাদবচন্দ্র ওরফে দীপনারায়ণ যখন হুড়মুড় করে এসে ঢুকছে, তখন ঘরের ভেতরে প্যাকিং বাক্সগুলোর কাছে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে এক নাইজেরিয়ান লোক। যাকে এখানে সবাই ওলগা নামে চেনে। ওলগার পাশে আরেকজন মহিলা দাঁড়ানো। সেও নাইজেরিয়ান। জ্যানেট নিকলসন। জ্যানেট তার পিঠে ব্যাগ নিয়ে একদম রেডি। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে কয়েকটি ক্যাপসুল পরপর জল দিয়ে গিলে ফেলল সে।

ওলগা ওকে জিজ্ঞেস করে, “হোয়াট অ্যাবাউট দ্য আদার থিংস?”

“কেপ্ট ইন সিক্রেট স্যার।”

“সার্জারি ডান?”

“ইয়া।”

“ওকে, মুভ অন। বি ভেরি কেয়ারফুল।”

ওলগা বলামাত্র জ্যানেট ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

“স্যার, উই আর ইন ডিপ ট্রাবল।” হাঁসফাঁস করতে থাকে দীপনারায়ণ।

“জাস্ট টেক ইট ইজি।”

নাইজেরিয়ান লোকটা ওর দিকে একবারও না তাকিয়েই একের পর এক ফোন করতে থাকে। তার বিজাতীয় উচ্চারণের জড়ানো ইংরেজি থেকে স্পষ্ট, সে এবার চটপট ব্যাঙ্ককে পালানোর প্ল্যান করছে। দীপনারায়ণ বোঝে, এবার তাকেও নিজের পথ খুঁজে নিতে হবে। পুলিশের রেইড হলে বড়ো পাখিরা ঠিক উড়ে পালাবে, গাড্ডায় পড়বে ওর মতো চুনোপুঁটি।

এই ঠেকটার নাগাল পাওয়া যদিও পুলিশের পক্ষে মুশকিল। এটা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। এখানে চট করে পুলিশ ঢুকে খানাতল্লাশি করবে না। তবু একটা কোথাও অসুবিধে লাগছে তার। কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে মুম্বই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনো মাত্র একটা গাড়ি ওকে ফলো করতে থাকে। অভিজ্ঞ চোখ দীপের। সে চট করে বুঝতে পারে, নিশ্চয়ই পুলিশ এবার ওর পিছনে। ওলগার কাছে ওকে একবার আসতেই হত। এই অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে ও তুলনায় অনেক বেশি সেফ। পিছনের কালো গাড়িটাকে দেখতে-দেখতেই হঠাৎ একটা গলির মধ্যে ট্যাক্সি ঢুকিয়ে দিতে বলে দীপনারায়ণ। মুহূর্তে ভাড়া মিটিয়ে পিছনের কালো গাড়িটার নজরদারি থেকে বাঁচার জন্য চট করে ঢুকে পড়ে একটা শপিং মলে। জামাকাপড় পালটে, নিজের চুলের সিঁথি বদলে, নকল চাপদাড়ি লাগিয়ে বেশ ধীরেসুস্থে চারপাশ দেখেশুনে আবার এসে বসে আরেকটা ক্যাবে। এবার সোজা এই অ্যাপার্টমেন্টে। এখন বরং ওলগার সাহায্য পেলে সেও এক্ষুনি হংকং কিংবা ব্যাঙ্ককের দিকে সরে পড়তে পারে।

“উই হ্যাভ টু লিভ আ গার্ল হিয়ার, কিপ ওয়াচ অন হার। আই অ্যাম মুভিং। জাস্ট আফটার ওয়ান ওর টু আওয়ার ইউ লিভ দিস প্লেস, মিট মি ইন এয়ারপোর্ট।” বলেই ওর হাতে একগোছা টাকা ধরিয়ে দেয় ওলগা।

দীপের কাছে ব্যাপারটা একটু স্পষ্ট হয়। ওলগা আর জ্যানেট প্রচুর মাল নিজেদের সঙ্গে সরিয়ে ফেলেছে। এবার এখানকার পাট গুটিয়ে কিছুদিন গা-ঢাকা দেওয়া। কিন্তু কোন মেয়েকে আটকে রাখল ওরা? ফালতু ঝামেলা বাড়ল একটা। ওলগা ওর হাতে একটা চাবি দেয়। পাশের ঘরের চাবি। চারতলা ফ্ল্যাটের ওই ঘরে কিছু প্যাকিং বাক্স ছাড়া এখন আর তেমন কিছু নেই। এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেওয়া আছে জয়সওয়াল নামের এক ভদ্রলোকের নামে। এই অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর আরও একটা ফ্ল্যাট রয়েছে। এটি মেয়ের নামে কিনে ভাড়া দিয়েছেন। ফ্ল্যাটে একটা অ্যাটাচড বাথওয়ালা পুঁচকে বেডরুম রয়েছে। ফাঁকাই পড়ে থাকে। সেখানে কাকে আটকে রাখল ওলগারা? কিন্তু ওরা সবাই বেরিয়ে চলে গেলে মেয়েটার কী হবে?

দীপের প্রশ্নটা স্পষ্ট পড়ে ফেলতে পারল ওলগা। তার ভাঙা ইংরেজিতে জানিয়ে দিল, মেয়েটাকে বেশ খানিকটা সময় ধরে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ফ্ল্যাট থেকে চুপচাপ তালা দিয়ে বেরিয়ে গেলেই তো হল। ইতিমধ্যেই সে ঘুমোচ্ছে। কোল্ড ড্রিঙ্কের মধ্যে কেটামাইন ট্যাবলেট মিশিয়ে খাইয়ে দিলে ও আর আগের কোনও ঘটনা মনেই করতে পারবে না। তারপর যা হয় হোক। মেয়েটা মরল কি বাঁচল, তা নিয়ে ওদের কীসের মাথাব্যথা? পুলিশ যদি ওকে খুঁজেও পায়, ও তো কিছুই ঠিকঠাক বলতে পারবে না।

ওলগা বেরিয়ে যায়।

দীপ চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ফ্ল্যাটের কোনার একচিলতে বেডরুমেই মেয়েটাকে রাখা হয়েছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক কিছু জেনে ফেলেছিল। ড্রাগ খেতে এসে সব জেনে ফেলা সহজ নয়। একবার নেশার ঘোরে থাকলে তারা আর অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাহলে কি এই মেয়েটা রেগুলার ড্রাগ খেত না? তা না হলে ওকে খামোখা ওলগা আটকে রাখল কেন?

জ্ঞান ফিরে আসার পর বান্টা স্পষ্ট বুঝতে পারে, এই ঘরটাতে ও একদম একা। বেশ কয়েকবার জোরে ডাকাডাকি করেছে ও। কেউ কোনও সাড়া দেয়নি। যে করে হোক এই ঘরটা থেকে ওকে বেরোতেই হবে। জিনসের পকেটে হাত দিয়ে দেখে মোবাইলটা নেই। তার মানে মোবাইলটা ওরা নিয়ে নিয়েছে। পার্সটাও নেই। ওরা কিছু একটা সন্দেহ করছিল বান্টাকে। ওদের বোধহয় মনে হয়েছিল বান্টা ওদের এই আড্ডার খবর পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন জানাতে যাবে বান্টা? এইরকম সিগারেটে পুরে গাঁজা খেলে কে আর কাকে ধরতে আসছে? কিন্তু ওরা শুধু গাঁজা খায় না। বান্টা স্পষ্ট দেখেছে ওখানে অন্যান্য জিনিসপত্রের আমদানি হয়। ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ, ক্যাপসুল, সাদা গুঁড়ো কীসব পাউডারের প্যাকেট সেদিন হাতে হাতে ঘুরছিল।

ভাবতে-ভাবতেই একটা আওয়াজ হয়। কোথাও দরজা খুলছে কেউ। এই ঘরের? তা তো নয়। এই ঘরটা একদম অন্ধকার। এখন দিন না রাত, তাই-বা কে জানে? কোনদিকে জানালা, কোনদিকে যে দরজা, তাও বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বান্টা স্পষ্ট শুনেছে কেউ একটা আসছে এই ঘরের দিকে। নিজের সমস্ত স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে বান্টা। কে আসছে, ক’জন আসছে, কী তাদের মতলব—না বুঝে সাড়া দেওয়া বোকামি। তার চেয়ে অজ্ঞানের ভান করে চুপচাপ শুয়ে থাকাই ভালো।

দীপনারায়ণ ঘরে ঢুকে আলো জ্বালায়। একটা মেয়ে শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। দেখেই মনে হচ্ছে একেবারে অচৈতন্য। ওলগার কথামতো একে কোনও ড্রিঙ্কের সঙ্গে ওই ড্রাগটা মিশিয়ে খাইয়ে দিতে হবে। তারপর মেয়েটা পড়ে থাক এখানে। তালা লাগিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। কিন্তু মেয়েটা যদি এমনিই অজ্ঞান থাকে, তাকে আবার এখন বাড়তি কিছু করার দরকার কী? ধুস। ফালতু যত কাজ দেয় ওই ওলগা। মাথামোটা একটা। খামোখা একে আটকেই-বা রেখেছে কেন কে জানে! দীপ ঠিক করে, মেয়েটাকে ওইভাবে এই ফ্ল্যাটের ঘরে ফেলে রেখে চুপচাপ কেটে পড়বে। আরে ভাই, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। কলকাতা থেকে একবার প্রাণ হাতে করে পালিয়েছে। এবার মুম্বই থেকে আর একটু দূরে না সরলে চলছে না।

ঘর থেকে বেরিয়ে দীপনারায়ণ আনমনা হয়েই দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। ওর পক্ষে বোঝা সম্ভবই নয় বান্টা ক্যারাটেতে ভীষণ তুখোড়, আচমকা যে-কোনো প্রতিপক্ষকে ও কাটা কলাগাছের মতো শুইয়ে দিতে পারে। বান্টা সমস্ত শক্তি জড়ো করে একটা স্ন্যাপ কিকে অপ্রস্তুত লোকটাকে সপাটে মেঝেতে আছড়ে ফেলল ঠিকই, কিন্তু লোকটা তো আর ছেলেমানুষ নয়, সেও পালটা প্রতিরোধ করতেই পারে। তার চেয়েও জানা জরুরি, এই একটা লোকের পিছনে আর কে বা ক’জন আছে। বান্টা আত্মরক্ষার কৌশলে যাকে ধরাশায়ী করেছিল, তার ঘাড়ে একটা জোরদার দ্বিতীয় রদ্দায় তাকে মোটামুটি শুইয়ে ফেলল। অন্তত ঘণ্টা খানেকের জন্য নিশ্চিন্ত। ঘরের আলোটা চট করে নিভিয়ে দেয় বান্টা। ফ্ল্যাটের বাইরের দরজাটা এখান দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। বেরোতে হবে এখান থেকে। কিন্তু এই লোকটার পিছনে বা এর সঙ্গে কে বা কারা আছে, এটা নিয়েই অস্বস্তি। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা যাবে না। লোকটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ও চট করে বের করে নেয় তার মোবাইল আর পার্স। খুব জরুরি। রাস্তায় বেরিয়ে দরকার হবেই। অন্তত পুলিশকে তো দিতেই হবে। কিন্তু পলকদের ফ্ল্যাট থেকে এই জায়গাটাতে কেন আর কীভাবে এল, এই লোকটাই-বা কে, সেটা নিয়ে খচখচ করছে মাথার ভেতরটা।

বান্টা পা টিপে টিপে ফ্ল্যাটের দরজা খোলে। নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে দরজার পাশে। নিশ্চিত হয়, কেউ কোত্থাও নেই। খুব স্মার্টলি এক ঝটকায় দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখে সামনে লিফট। লিফটের বোতামে হাত দিয়েই ওর মনে হয়, ওই লোকটার সঙ্গে যদি কেউ থাকে তাহলে সে লিফটে এই ফ্লোরে এসেই নামবে। অতএব এই ফ্লোর থেকে লিফটে ওঠা যাবে না। ছুটে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে পরের দুটো তলা হুড়মুড় করে নেমে যায় বান্টা।

নামতে-নামতেই দেখে গ্রাউন্ড ফ্লোর তো খুব দূরে নয়। আর দুটো রাউন্ড। তার মানে ও চারতলার কোনও ফ্ল্যাটে ছিল। আর এই ফ্ল্যাটের মধ্যে ওর খুব চেনা একটা ফিলিং হচ্ছে। বান্টা ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়েই নামে। আর বিদ্যুৎচমকের মতো ওর মাথায় খেলে যায়, এটাই পলকদের অ্যাপার্টমেন্ট। যদিও বরাবর লিফটে উঠেছে ও, কিন্তু ফ্ল্যাটের গড়নগুলো একরকম। পলকদের ফ্ল্যাট সাতাশ তলায়, এটা বোধহয় চারতলার একটা ফাঁকা ফ্ল্যাট।

বাকি প্রশ্ন মাথার মধ্যে রেখে শরীরের যাবতীয় শক্তি জড়ো করে ও খুব দ্রুত বেরিয়ে যায় অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে। সন্ধে হয়েছে। পলকরা ওকে কেউ দেখে ফেলার আগেই ওকে এই চত্বর থেকে সরে যেতে হবে।

বড়ো রাস্তায় বেরিয়ে একটা ফার্নিচার শপ। সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত হাঁফায় বান্টা। এবার কী করবে সে? এখনই বাড়ি ফিরবে, না এখান থেকে সোজা থানায় যাবে?

একটা কালো স্করপিও গাড়ি আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ায় দোকানটার কাছে। বান্টা দেখে, একজন ভদ্রলোক খুব অন্যমনস্ক হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। হয়তো খুঁজছেন কিছু। গাড়িটা দাঁড়ানো, স্টার্ট দেওয়াই রয়েছে। ভদ্রলোকের পাশ দিয়ে যাবার সময় বান্টার ফোনটা, যে ফোনটা আসলে বান্টার নিজের নয়, সেই ফোনটা খুব জোরে বেজে ওঠে। ভিডিও কল। একটা নাইজেরিয়ান লোকের মুখ ভেসে উঠছে, লেখা রয়েছে ‘ওলগা কলিং’। লোকটাকে দেখে আঁতকে ওঠে বান্টা। পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, “আঙ্কল, নিয়ারেস্ট পুলিস স্টেশন যানা হ্যায় মুঝে, ক্যান ইউ হেল্প মি?”

“হোয়াট হ্যাপেন্ড? এনি প্রবলেম?” ভদ্রলোক ওর দিকে ভালো করে তাকান।

বান্টা বলে, “অ্যাকচুয়ালি আই… আই হ্যাভ লস্ট মাই পার্স। উসমে মেরা সব ডকুমেন্টস হ্যায়।”

“পুলিশ স্টেশন ইজ কোয়ায়েট ফার। ইউ হ্যাভ টু গো বাই কার অর সামথিং এলস।”

বান্টার নার্ভাস লাগতে থাকে। অনেক দূর হলে সেখানে এখন পৌঁছানো মুশকিল। তার চেয়ে এখান থেকে বাড়ি যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। বাড়িতে গিয়ে তারপর না-হয় পুলিশে কমপ্লেন করা যাবে।

ফোনটা বেজেই চলেছে। ওলগা কলিং। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ফোনটা ধরছ না যে?”

“ওকে, ওকে, আঙ্কল। নো প্রবলেম। আই উইল ম্যানেজ। থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং।” বলতে-বলতেই বান্টা জোরে হাঁটতে শুরু করে। এই লোকটাও ওদের ড্রাগের দলের হতে পারে! কে জানে। তার চেয়ে সোজা বাড়ি যাওয়াই বেটার।

পা চালিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একবার পিছন ফিরে তাকায় বান্টা। দেখে, লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে স্করপিও গাড়ির মধ্যে উঠে বসল। কিন্তু গাড়িটা দাঁড়িয়েই রইল ওখানে।

১২

“আপাতত ফিরে যাই চল। এখন আর ওই ফ্ল্যাট অবধি গিয়ে কাজ নেই।”

আরশির কথায় একটু চটেই যায় রিমঝিম,“ভয় পাস না ভাই। সবসময় মনে রাখবি আমরা হলাম ট্যুরিস্ট। বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। শহর দেখতে বেরিয়েছি। অত চাপ নিস না।”

মিনি বলে, “আরে বাবা, পলকদের ফ্ল্যাটে তো আর এখন এই সময় গিয়ে ঢুকছি না। ওই অ্যাপার্টমেন্ট অবধি জাস্ট এগোব। রাস্তাটা ভালো করে লক্ষ করে রাখ। কাল সকালে পলকদের ফ্ল্যাটে কোনও একটা প্ল্যান করে নিয়ে তারপর ঢুকতে হবে। এমনি এমনি যাওয়ামাত্র আমাদের ঢুকতে দেবে নাকি?”

আরশি চুপ করে যায়।

চারপাশটা তেমন অসাধারণ সুন্দর কিছু নয়। ব্যস্ত শহর যেমন হয়। ভারতের বাণিজ্যনগরী বলে কথা। তার রঙই আলাদা। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান। লোকজনের চোখমুখ খুব শক্ত। উদাসীন। সবাই খুব ছুটছে যেন। আরশি একের পর এক ছবি খোঁজে। মাথার মধ্যে তেমন নতুন কিছু তৈরি হয় না।

বান্টাদের বাড়ি থেকে পলকদের অ্যাপার্টমেন্ট অবধি আগে না গিয়ে অন্যদিকে বান্টাদের স্কুল পর্যন্ত একটা দীর্ঘ রাস্তা হেঁটে হেঁটে হাঁফ ধরে যায় কেমন। তেমন কিছুই চোখে পড়ে না। হতাশ লাগে। কেমন করে এই বিরাট শহরে ওরা খুঁজে পাবে ওদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে? সে কোথায় আছে, কীভাবে আছে… সবথেকে বড়ো কথা বান্টা সেদিন দুপুরে যে কোথায় গিয়েছিল কিছুই জানে না কেউ। খুব সামান্য কিছু সন্দেহ আর ধারণা সূত্র নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়াচ্ছে ওরা। এখানকার পুলিশের কাছে গেলেও তেমন সাহায্য পাবার আশা নেই। আরশির মাথার মধ্যে যে হতাশাটা কুটকুট করে কামড়াচ্ছে, সেটা হয়তো কিছুটা মিনির মধ্যেও। শুধু রিমঝিমের চোখমুখ ভীষণ শক্ত। কী যেন একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা করে এসেছে সে, বান্টাকে না নিয়ে সে বাড়ি ফিরবে না।

সন্ধের অন্ধকারে আরও ঝলমলে মুম্বই। আরশি একটু পিছিয়ে পড়ছিল। রাস্তার ধারে অনেকরকম ঝাঁ-চকচকে দোকানে বিভিন্ন রঙিন জিনিস ঝোলানো থাকতে দেখলে ওর মাথার মধ্যে একটা কালার প্যালেট তৈরি হয়। ও তখন রঙ হাতড়ায় আর মনের মধ্যেকার সাদা ইজেলে একের পর এক রঙ চাপায়।

মিনি একটা ছোট্ট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবি রে?”

আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার সামনে ঘ্যাঁচ করে একটা কালো গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে আসে একটা ভীষণ চেনা লোক। অসম্ভব পরিচিত। আরশি একটু পিছন থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার চেহারার আদল। খুব চেনা। কিন্তু ওর চোখটা দেখা দরকার। মানুষের সব পরিচয় লুকিয়ে থাকে দুটো চোখের তারায়। হাজার ছদ্মবেশ নিলেও চোখের ভাষা পালটে ফেলা খুব মুশকিল। লোকটাও চট করে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক তুলে নেয় দোকান থেকে। ছিপি খুলে মুখে ঢালতে ঢালতেই পিছনে ফেরে সে। এবার গাড়িতে উঠবে। আরশি ঠিক দু-হাত দূরে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কেঁপে ওঠে। সেই লোকটা এখানেও? ওদের পাড়ার মধ্যে ঘুরে বেড়ানো সেই ভবঘুরে, স্মার্ট পোশাকে বিকেলে সুইমিং ক্লাবের সামনে, আবার তাদের পাড়ার গ্যারাজের পাশে কেয়ারটেকারের ভয়ংকর অ্যাকসিডেন্টের সময়… সেই লোকটা এখন এই মুহূর্তে এই মুম্বইতে? কী করছে ও?

আরশি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে যায়। মিনি তিনটে বোতল নিয়ে ডাকে, “ওরে, এদিকে।”

আরশি দেখতে পায় লোকটা উঠে গেল গাড়িতে আর ওর গাড়িটার আড়ালে হেঁটে আসছে আরও একটা ভীষণ চেনা চেহারা। উসকোখুসকো চুল, অপ্রকৃতিস্থ চেহারা, অগোছালো জামাকাপড়… কে ও? রাস্তার আলোতেও যেন চেনা যায় না, এতটাই অচেনা চেহারা।

“বান্টা-আ-আ-আ!”

আরশির গলার স্বর ওর নিজের কাছেই অস্বাভাবিক লাগে। গলা চিরে যায় উত্তেজনায়। ছিটকে ফিরে তাকিয়েছে রিমঝিম। তিনটে কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল হাত থেকে পড়ে যায় মিনির। তিনজনে মিলে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বন্ধুর ওপর।

বান্টা স্পষ্টই হতচকিত। আনন্দে যেমন হয়, হঠাৎ একটা ভীষণ ভালোলাগার মুহূর্তে যেমন হয়, অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যাওয়ার সময় যেমন হয়, চার বন্ধুর হাসি কান্না আনন্দ উত্তেজনা উচ্ছ্বাস সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সেইরকমই ঘটল ব্যস্ত মুম্বই শহরের সন্ধের রাজপথে।

“তোরা এখানে?”

বান্টার প্রশ্নে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মিনি,“তুই যে হারিয়ে গিয়েছিলি!”

রিমঝিম ঝাঁকাতে থাকে ওকে,“কোথায় গিয়েছিলি, শিগগির বল। কী হয়েছিল তোর?”

“সব বলছি রে। আগে আমি একটু জল খাব। খিদেও পেয়েছে খুব। একটু বসি চল কোথাও। খুব বিপদ ঘটছে চারপাশে।”

বান্টার কথায় সামলে নেয় ওরা নিজেদের। চটপট ঠিক করে নেয় আপাতত বাড়ি ফেরা নয়, বরং বান্টাকে সুস্থ করে তবে বাড়ি ফেরা জরুরি।

“এই দাঁড়া, আমাদের তিনটে পেট বটল পড়ে গেছে হাত থেকে। নে, আগে কোল্ড ড্রিঙ্ক খা। আমি একটা কেক-পেস্ট্রি দেখি কী পাই তোর জন্য।”

আরশির বাড়িয়ে দেওয়া কোল্ড ড্রিঙ্ক হাতে নিয়েই কেঁপে ওঠে বান্টা। মনে পড়ে যায় পলকদের ফ্ল্যাটের সেই কোল্ড ড্রিঙ্কটার কথা।

রাস্তার ধারে কোনও জায়গায় বসতে চায় না বান্টা,“এখানে বসব না রে। ওরা তো আটকে রেখেছিল আমায়। পালিয়ে এসেছি টের পেলে এই রাস্তাতেই ট্রেস করবে। চল ওই পাশে মোড় ঘুরলে একটা কফি শপ আছে, ওখানে গিয়ে একটু বসি।”

রাস্তার চারপাশে সতর্ক চোখ রেখে চারজন দ্রুতপায়ে গিয়ে ঢোকে একটা ছিমছাম কফি শপে।

“এবার ধীরেসুস্থে বল।”

“খুব দেরি করতে পারব না। থানায় যেতেই হবে। শুধু বলি, পলকদের ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা খুব বড়ো ড্রাগ ডেন রয়েছে। খুব বড়ো চক্র। বাইরে থেকে ওখানে প্রচুর মাল আসে। শুধু সাধারণ গাঁজা-কোকেন নয়। আরও বড়োসড়ো বিপজ্জনক কিছু। যে-লোকটা ঢুকেছিল, তার মোবাইল আর পার্স আমার কাছে। লোকটা এখন চারতলার ফ্ল্যাটে চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু আমার কেবল মনে হচ্ছে, খুব বেশিক্ষণ তো আর ও ওখানে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে থাকবে না। আর তার চেয়েও বড়ো কথা, যারা আমাকে আটকে রেখেছিল, তাদের মধ্যে একজন সমানে ফোন করে যাচ্ছে এই মোবাইলটাতে। ফোনে না পেলে সে আবার হয়তো ফ্ল্যাটে ফিরে আসবে।”

“বান্টা, লেটস গো।”

রিমঝিমের কথায় চমকে ওঠে মিনি আর আরশি,“লেটস গো মানে? কোথায় যাবি এই রাতে?”

“কেন, ওই ফ্ল্যাটে!”

মিনি চেঁচিয়ে ওঠে, “তুই কি পাগল? ক্ষেপে গেছিস? ওরা ড্রাগের কারবার করে। খুন করে একসঙ্গে চারজনের লাশ গুম করে দেবে। অ্যাডভেঞ্চারে বোকামি চলে না। আর ওইসব পাগলামি ফিল্মে আর গল্পে হয়। বাস্তবে কোনও মানেই হয় না ওই ঝুঁকি নেবার।”

“মিনি ঠিকই বলেছে। আমরা সোজা থানায় চলে যাই চল। ইটস হাই টাইম। সব জমা দিয়ে খুলে বললে সবাইকেই সময়মতো ধরা যাবে।”

আরশির ঠান্ডা গলায় বলা কথার যুক্তিতে রিমঝিমের উত্তেজনা একটু থিতিয়ে যায়।

***

বান্টাকে ঘিরেই গোল হয়ে বসেছে সবাই। রান্নাঘর থেকে বসার ঘর অবধি ভেসে আসছে জেঠিমার হাতের পকোড়া আর ফিশ ফ্রাইয়ের সুবাস। তিতাস থেকে থেকেই আনচান করে উঠছে। আর সেটা লক্ষ করেই মিনি বলে উঠল, “জেঠু, তুমি একটু আগে কার কথা বলেছিলে, কে একজন স্পেশাল গেস্ট, তিনি আজ আসবেন না?”

“ওর জন্যই আজ একটু অপেক্ষা করছি। এলে তোদের অবাক লাগবে খুব। তারপর, বান্টা, ব্রেভ গার্ল, তুমি বলো হায়ার স্টাডিতে কলকাতাতেই থাকবে, না মুম্বইতে ফিরে যাবে?”

বান্টা সোজা হয়ে বসে সোফায়,“এখনও কিছু ডিসাইড করিনি জেঠু, দেখি বাবা-মা কী বলেন। তবে আমি তো আমার বন্ধুদের সঙ্গেই থাকতে চাই।”

“ইয়েস-স!” বলে খুব জোরে চেঁচিয়ে ওঠে সিক্স মাস্কেটিয়ার্স আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বাইরে বেজে ওঠে কলিং-বেল।

শান্তশীল নিজেই ধীরেসুস্থে গিয়ে দরজা খোলেন আর বলে ওঠেন, “আরে এসো এসো ব্রাদার, তোমার জন্যই আজ আমরা সকলে মিলে অপেক্ষা করছি। এই দেখো, আরশি, বান্টা, রিমঝিম, একে কি চেনো তোমরা?”

ড্রয়িংরুমের পর্দা সরিয়ে শান্তশীলের পিছনে যে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন তাঁকে দেখে সবার প্রথমে হকচকিয়ে যায় আরশি। বাকিরাও রীতিমতো চমকে গেছে। কিন্তু আরশির প্রতিক্রিয়া দেখার মতো। সেই লোকটা! কখনও বাড়ির পিছনে ভবঘুরে সেজে, কখনও সুইমিং ক্লাবের বাইরে, পাড়ার মোড়ে গ্যারাজের সামনে অ্যাকসিডেন্টের সময়, এমনকি মুম্বইয়ের রাস্তাতেও তো দেখেছে ওকে। একেক সময় একেকরকম পোশাকে। কিন্তু নিজে স্কেচ করত বলেই প্রত্যেকবার ওর চোখ দুটো আর গড়নের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে ওকে চট করে চিনে ফেলত আরশি। উত্তেজনায় ছিটকে দাঁড়িয়ে পড়ে আরশি।

শান্তশীল বলেন, “নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো যে-সমস্ত বিশ্বস্ত মানুষদের নিয়ে কাজ করে, তাদের মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে এই অভিরূপ। শুধু সোর্স লাগিয়ে নয়, বহু জায়গায় ও নিজেই ঝুঁকি নিয়ে চলে যায় কাজ করতে। কলকাতা-মুম্বই-হংকং মিলিয়ে এই র‍্যাকেটটাকে ও বহুদিন ধরে নজরে রেখেছিল। জালটা শেষ পর্যন্ত ও নিজেই গুটিয়ে এনেছে। আর সেই জন্যেই তোমরাও ওকে অনেকবার অনেক জায়গায় দেখতে পেয়েছ। আরশিদের পাড়ায় একটা ছোট্ট আড্ডা শুরু হতে চলেছিল, দীপনারায়ণের পাল্লায় পড়ে বেশ কিছু বাচ্চা জড়িয়ে পড়ছিল এই ট্র্যাপে। অভিরূপ একে একে সূত্রগুলো মেলায়। তবে আরশির চোখের তারিফ করতেই হয়। কোনোবারই অভিরূপ কিন্তু ওর চোখ এড়াতে পারেনি।”

বান্টা তাকিয়ে বলে, “এ বাবা! সেদিন যদি আপনাকে রাস্তায় চিনতে পারতাম! ইস!”

অভিরূপ বলেন, “বান্টা, তুমি ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোনো মাত্র সন্দেহ হয়েছিল আমার। মনে হল, ওই গ্যাঙের মধ্যে তুমিও রয়েছ যারা ওই দলে বসে রোজ ড্রাগ খায়, নেশা করে। কিন্তু আমরা তখন দীপনারায়ণকে ফলো করে ঢুকেছি, অতএব তাকে নজরে রাখতেই হত। তাই তোমাকে তখন ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর সবথেকে বড়ো কথা, তুমি নিজেই থানায় যেতে চাইছিলে। একমাত্র বিপদে পড়লেই লোকে থানায় যেতে চায়, কাজেই সেই যুক্তিতে তোমাকে তখন ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার সোর্স তোমাকে নজরে রাখছিল, অবশ্য সেটা তোমার টের পাওয়ার কথা নয়। তবে ওই মোবাইল আর পার্সটা সেদিন রাতে থানায় জমা না পড়লে… উফ্‌! এটা ব্রিলিয়ান্ট জব।”

অভিরূপ এবার হাসিমুখে তাকায় আরশির দিকে,“তোমার আঁকা স্কেচ দেখেছি আমি। দুর্ধর্ষ। এত নিখুঁত ছবি দেখে খুব সহজে অপরাধী শনাক্ত করা যায়। ইটস অ্যামেজিং। ইউ আর রিয়েলি জিনিয়াস। আমি ড্রাগ পেডলারদের ফাঁকি দিতে পেরেছি, তোমার চোখ ফাঁকি দিতে পারিনি।”

আরশি একটু লাজুক চোখে তাকায়। ওর একমাত্র প্যাশন ছবি আঁকা। সায়েন্স নিয়ে পড়তে-পড়তেই সবরকম স্কেচ আর ড্রয়িংয়ে ও হাত পাকিয়ে ফেলেছে। বাকি বন্ধুরাও হাসি হাসি মুখে তাকায়।

“বান্টার পালিয়ে আসার পর্বটা কিন্তু মারাত্মক ছিল, ভীষণ ঝুঁকি নিয়েছে ও।” অভিরূপ বলেন, “ঠিক ওই সময় নাইজেরিয়ান ছেলেটা ওকে দেখতে পায়নি ভাগ্যিস। ও কিন্তু কাছাকাছিই ছিল। দীপনারায়ণকে অবজার্ভ করছিল। দীপনারায়ণ সময়মতো না আসাতে ও ফোন করতে থাকে। মোবাইলটা তখন বান্টার পকেটে। বান্টাকে দেখলে ও কিন্তু অবধারিত শুট করত। ওরা খুব নৃশংস হয়। ড্রাগ মাফিয়াদের মায়া-মমতা থাকে না। তারপর অতগুলো প্যাকিং বাক্স ভর্তি চরস, হেরোইন, গুচ্ছের কেমিক্যাল ড্রাগ… ওরা এত সহজে ছেড়ে দেবে? আর ওই জ্যানেট কী করেছিল জানো? অধিকাংশ ড্রাগের প্যাকেট তার ইউটেরাসের মধ্যে ভরে নিয়ে গিয়ে বসেছিল এয়ারপোর্টে।”

“ইউটেরাস? মানে? পেটের মধ্যে?”

তিতাসের হাঁ করা প্রশ্নের উত্তরে একটু হেসে শান্তশীল বলেন, “ড্রাগের পাচারকারীরা এখন নিত্যনতুন পথ ভেবে বের করছে। সার্জারি করে পেটের মধ্যে প্যাকেট লুকিয়ে নিয়ে আসার রাস্তাও বের করে ফেলেছে ওরা। তবে ওই দীপনারায়ণ এক্কেবারে চুনোপুঁটি। রুমেলার মতো বাচ্চাদের ও টুকটাক কাজে লাগায়। ও আপাতত হাজতে। ছাড়া পাওয়া সহজ নয়। তবে দলের বড়ো চাঁই ওই ওলগা পালিয়েছে। সেদিন তোমরা থানায় গিয়ে সব জমা দেওয়াতে তখনই এয়ারপোর্টে গিয়ে ধরা গেছে জ্যানেটকে। ভাগ্যিস চট করে থানায় গিয়েছিলে তোমরা।”

মিনি বলে, “হ্যাঁ। আর থানা থেকেই আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিল যত্ন করে। তবে রাতে তুমি ফোন করে আমাদের কলকাতায় চলে আসতে না বললে আমরা আরও কয়েকদিন মুম্বইতে বেড়াতে পারতাম। নীনা-আন্টি তো কিছুতেই আমাদের ছাড়তে চাইছিলেন না।”

শান্তশীল বলেন, “আমি রিস্ক নিতে চাইনি। মুম্বই পুলিশ যেই জানায় দীপনারায়ণ আর জ্যানেট ধরা পড়ে গেছে, আমার মনে হয় বান্টার খোঁজে এবার পলকদের গ্রুপের কেউ খুব অ্যাক্টিভ হয়ে উঠতে পারে। হয়তো পলক নিজে না এলেও তার বন্ধুবান্ধব কেউ। সেই ঝামেলায় জড়িয়ে গেলে আসল লোকগুলো হাত ফসকে যেতে পারে। অবশ্য ওলগা লোকটাকে এখনও হাতে পাইনি আমরা। কিন্তু তোমরা নিজেরাও জানো না, এই অভিরূপ এবং তার টিম কিন্তু পুরো নেটওয়ার্কের খবর বের করে ফেলেছে।”

“আচ্ছা জেঠু, আরশিদের পাড়ার ওই কেয়ারটেকারের কেসটা কী?”

“সে-বেচারা নিরীহ মানুষ। নেপালের লোক। তার কাছেও টোপ ফেলা হয়েছিল রক্সৌল থেকে মাল পাচারের। কিন্তু এই সৎ ছেলেটা রাজি হয়নি। ফলে ওকে হালকা ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে প্রথমে গাড়িগুলোর ক্ষতি করে ওর ওপর সন্দেহ তৈরি করা হল, তারপর বেচারা যেই পুলিশের ভয় দেখাতে গেল, অমনি গাড়ির ধাক্কায় নিরীহ লোকটাকে ইনজিয়োর করা হল। সে এখনও হাসপাতালে লড়ছে। দেখা যাক। ওর কাছ থেকেও কিছু তথ্য হয়তো পরে পাওয়া যাবে। আগে প্রাণে বাঁচুক।”

“কিন্তু জেঠু, তুমি যে আমাদের এত হেল্প করলে, আমরা এখনও জানিই না তুমি কি পুলিশ?”

কাজুর প্রশ্নে হো হো করে হেসে ওঠেন শান্তশীল।

অভিরূপ হাসতে হাসতে বলেন, “সে কি হে! নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোর ইস্টার্ন জোনের এই দুঁদে বড়োকর্তাটিকেই তোমরা চেনো না?”

হাঁ করে শান্তশীল মৈত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে সকলে।

“ও, এইবার বুঝেছি! সেইজন্য তুমি ড্রাগ নিয়ে গড়গড় করে অত কিছু বলে যাও!”

মিনির কথায় হেসে ফেলেন শান্তশীল।

রিমঝিম ছটফট করে বলে ওঠে, “আমার একটা প্রশ্ন আছে জেঠু।”

শান্তশীল সস্নেহে তাকান,“বলে ফেল চটপট।”

“পলকদের গ্রুপটার এবার কী হবে?”

“সেই অর্থে কিছুই হবে না। কারণ ওদের ফ্ল্যাটে ড্রাগ খাওয়া হত, কিন্তু ড্রাগ পাওয়া যায়নি। ড্রাগ ওরা রাখত চারতলায় ওদের আরেকটা ফাঁকা ফ্ল্যাটে। মজার ব্যাপার হল, ওর বাবা জয়সওয়াল থাকেন বিদেশে, তিনি এসবের কিছুই জানেন না। মাও মেয়ের তেমন খোঁজখবর রাখতেন বলে মনে হয় না। এই ওলগা, জ্যানেট এদের সঙ্গে পলকের যোগাযোগ ছিল। পলক ছিল ওদের রেগুলার কাস্টমার। তবে ব্যাপারটা খুব মারাত্মক। কারণ, পলকের সূত্রেই বহু ছেলেমেয়ে ক্রমশ জালে জড়িয়ে পড়ছিল। কলকাতায় রেইড হওয়া মাত্র দীপনারায়ণ পালায়, আর ঘটনাচক্রে বান্টাও সেইদিন ওদের ফ্ল্যাটে। ওদের কেমন সন্দেহ ছিল, বান্টা যেহেতু অনেকদিন এই আড্ডা থেকে বিচ্ছিন্ন, ও নিশ্চয়ই ওদের সব খবর পুলিশকে দিয়ে দেবে। ওরা একটু বাজিয়ে দেখতে চাইছিল বান্টাকে। খুব বেশি ক্ষতি ওরা করেনি, স্রেফ অজ্ঞান করে ফ্ল্যাটে আটকে রেখে পালিয়ে যেত। তবে একটা বিষয়ে খটকা আছে আমার—সাধারণত ওরা কেটামাইন বলে একটা ড্রাগ ড্রিঙ্কের মধ্যে মিশিয়ে খাইয়ে দেবার চেষ্টা করে, আমরা অনেকগুলো কেস এমন পেয়েছি।”

আরশি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সেটা কী, জেঠু?”

“আমি বলছি।” অভিরূপ বলেন, “কেটামাইন হচ্ছে একটা কেমিক্যাল। মূলত ভেটেরিনারি সায়েন্স মানে পশুপাখির চিকিৎসায় এটা ব্যবহার হয়। দু-হাজার দশ সাল থেকে ভারত সরকার এটিকে সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্স হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এটার কোনও রঙ নেই, গন্ধ নেই। একদম বড়ির মতো চেহারা। কোল্ড ড্রিঙ্ক বা অ্যালকোহলে মিশিয়ে খাইয়ে দিলে অজ্ঞান করে ফেলা সহজ। বেশ কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরবে, কিন্তু ওই অচেতন অবস্থার সমস্ত ঘটনার স্মৃতি একদম হারিয়ে যাবে।”

“আমি এইটা নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। বান্টাকে ওরা আগেই এইরকম কোনও কিছু খাইয়ে দিলে ও কিন্তু ফিরে এসেও আমাদের কাউকে কিচ্ছু বলতে পারত না।”

শান্তশীলের কথায় কেঁপে ওঠে সকলে। রিমঝিম শক্ত করে বান্টার হাত চেপে ধরে।

“কিন্তু আর একটা কথা,” কাজু ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, “ওই মেসেজটা তবে কে পাঠাল? ওই যে সেই টুয়েলভ আওয়ার হাই?”

বেশ ধাঁধায় পড়ে যায় সকলে। সেই মেসেজটার কোনও সমাধান হল না তো!

“ওটা খুব চাপের ব্যাপার নয়। যে নম্বর থেকে মোবাইলে মেসেজ এসেছিল, সেটা দিও তো আমাকে, আমি দেখে নেব।” অভিরূপ বলে ওঠেন।

জেঠিমা পকোড়ার প্লেট হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে বলেন, “আপাতত এই পকোড়াটা কী দিয়ে তৈরি স্রেফ গন্ধ শুঁকে বলো দেখি।”

ঘরের সবাই হাসতে থাকে। বাইরে রোদের আঁচ থাকলেও শান্তশীলের ড্রয়িংরুমে সাতজন বন্ধুর হাসিমুখের স্নিগ্ধতায় কী এক আশ্চর্য নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে।

অলঙ্করণ- মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s