সম্পূর্ণ উপন্যাস-বাড়ি ফেরার তাড়া-রিমি মুৎসুদ্দি-বসন্ত ২০২৩

uponyas84 (1)

এক

“না। এবার আর হবে না।”

কথাটা শুনে ওরা দুজনেই চমকে উঠল। দুজনেই নির্মল ভট্টাচার্যের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু উনি কোনও কথা না বলে সোজা ঠাকুরদালানে মা কালীর মূর্তির সামনে বসে পড়লেন।

নির্মল ভটচাজ পুজো করছেন, না ধ্যান করছেন, না কোনও বিষয়ে গভীরভাবে ভাবছেন তা ওঁকে ওই অবস্থায় দেখে কেউই বলতে পারবে না। ওঁর সামনে পেতলের পঞ্চপ্রদীপখানা জ্বলছে। প্রদীপ থেকে ঘিয়ের গন্ধ ছড়িয়ে জায়গাটা বেশ মায়াময় লাগছিল।

স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার আগে পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে এটা ওদের শেষ ক্লাস। সিঁড়ি দিয়ে নেমে শুভম প্রতিবারই খুব ভক্তিভরে নির্মলজেঠুকে প্রণাম করে। শুভমের সঙ্গেই সিঁড়ি দিয়ে নামে বলে বিশালকেও প্রণাম করতেই হয় মাঝে মাঝে। প্রায় দিনই উনি কোনও কথা বলেন না। আজ প্রণাম করার পর এ কীরকম কথা কেন বললেন উনি? কী হবে না এবার?

পেতলের পঞ্চপ্রদীপের সামনে রাখা একটা বইয়ের পাতা ওলটালেন তিনি। তারপর প্রদীপটা মাটিতে রেখে কেমন যেন উদাসভাবে বাড়ির পেছনের বটগাছটার ঝুরির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রইল খোলা বইয়ের পাতা। পঞ্চপ্রদীপের সলতেগুলো কয়েকটা নিভে গেল। তবুও তাঁর যেন ধ্যানভঙ্গই হয় না। অবশ্য বিশাল আর শুভম বুঝতে পারল না উনি ধ্যান করছেন কি না। কারণ, ধ্যান বলতে ওরা বোঝে চোখ বন্ধ করে মনোনিবেশ করা। উনি তো চোখ খুলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই রয়েছেন। ওরা দুজনেই নির্মল ভটচাজের দৃষ্টি অনুসরণ করে বটগাছটার দিকে তাকাল। দুজনের সাইকেলই তো ওখানেই রাখা আছে। তাহলে কি উনি ওদের সাইকেল দুটো দেখছেন?

পরিমল-স্যারের কোচিং শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে। স্যারের বাড়ির পেছনে একটা বিশাল মাঠ আর সেই মাঠের শেষে একটা গ্রাম। গ্রামের নামটা ভারি সুন্দর—চন্দ্রকোনা গ্রাম। সেই গ্রামেই থাকে শুভম। পড়াশোনায় খুব খারাপ নয়, তবে স্কুলে ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় এবার ও অঙ্ক আর ইংরাজিতে ফেল করতে করতে এক-দু’নম্বরের জন্য পাশ করে গেছে। খুব একটা এইজন্য ওর যে মনখারাপ তা নয় অবশ্য।

বিশালের বাড়ি শহরের মধ্যেই। বিশাল পড়াশোনায় খুব ভালো। ক্লাসের সেরা ছাত্রই বলা যায়। প্রায় প্রতিবারই ফার্স্ট হয়। যেবার পরীক্ষায় ও প্রথম হতে পারে না, দ্বিতীয় হয়, সেবার ওর খুব মনখারাপ হয়। কারও সঙ্গেই তখন বেশ কয়েকদিন কথা বলে না ও। কেমন যেন একটা কষ্ট হতে থাকে ওর। আর সেই কষ্টটাই ক্রমে জেদে পরিণত হয়। আরও অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে। খেলাধুলোর সময় কমিয়ে পড়ায় মন দেয় যাতে পরের বার ও প্রথম হতেই পারে। আবার খেলাধুলোয়ও বিশাল খুবই ভালো। স্কুলের ফুটবল ম্যাচে ও ফরোয়ার্ডে খেলে। খেলার মাঠে যেদিন ও আসতে পারে না, ওরা বন্ধুদের সেদিন মনখারাপ হয়ে যায়। গেমস-স্যার বিনয়বাবু তো রীতিমতো বকাঝকা করে ওকে মাঠে নিয়ে আসেন।—‘তোমার মতো একটা প্লেয়ার মাঠে না এলে হয়? তোমার জায়গা মাঠ। সারাক্ষণ বই মুখে করে বসে থাকলে চলবে না। খেলতে হবে। খেলায় মনঃসংযোগ বাড়ে।’

ওদিকে শুভম খেলাধুলাতেও সেই মাঝারি মানের। ফরোওয়ার্ডে ও কখনও খেলেনি। ডিফেন্সেই থাকে। ডিফেন্সেও যে খুব সুবিধা করতে পারে তা নয়। শুভম খেলার মাঠে না এলে কেউ ওর আলাদা করে খোঁজ নেয় না। ও নিজেই অনেক সময় মাঠে না নেমে একজায়গায় বসে বসে শুধু খেলা দেখে। বল মাঠের বাইরে গেলে কুড়িয়ে এনে দেয়। আসলে ওর নিজেরও খুব একটা খেলতে ভালো লাগে না। বরং মাঠের মধ্যে যখন ওর বন্ধুরা দৌড়ায় আর ও একটু তফাতে থেকে ওদের দৌড়াতে দেখে, ওর মনে সে-সময় অদ্ভুত সব ছবি এসে জড়ো হয়। গোল-পোস্টটাকে একটা বড়ো গাছের মতো মনে হয়। সেই গাছের নীচেই রয়েছে সাদা সাদা পুরুষ্ট অদ্ভুত এক ঘাস। ঘাস কি সাদা হয়? সে-কথা আর খেয়াল থাকে না ওর। কারণ, ততক্ষণে আরও অনেক অদ্ভুত সব দৃশ্য এমনভাবে ওর মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে যে তখন ওর সেগুলোই সত্যি মনে হয়। ও হয়তো দেখছে একপাল মোষ এসেছে সেই ঘাসগুলো খেতে। সেইসব মোষদের রঙগুলোও অদ্ভুত। সাদা-কালো যেমন মোষ সচারচর ওদের গ্রামে দেখতে পায়, ঠিক তেমন নয়। রঙবেরঙের মোষ। তাদের মধ্যে আবার প্রতিযোগিতা—কে আগে যাবে ওই একটুকরো অদ্ভুত সাদা ঘাসের কাছে। মোষের পাল দৌড়ে হারিয়ে দিতে চাইছে একে অপরকে। ঠিক যেন স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতা। কে আগে পৌঁছবে লক্ষ্যে? আর বিরাট সেই গাছের নীচে সাদা সাদা সব ঘাস নিশ্চিন্তে বাতাসের দোলায় একটু একটু করে দোল খাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় ও কখনও দর্শক, আবার কখনো-বা ও হয়তো গাছটার মাথায় বসে হুইসেল দিয়ে মোষেদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা থামাতে চেষ্টা করছে।

“কী রে? ঘুমালি নাকি? বলটা আজ আবার মাঠ ছাড়িয়ে বড়ো রাস্তার ধারে ওই ড্রেনে পড়ে গেল। কত ডাকলাম তোকে, সাড়াই দিলি না।”

শুভম চোখ কচলে দেখল মাঠের ও-পারে বকুলগাছটার মাথা পেরিয়ে সূর্যটা অনেক দূরে চলে গেছে। ডুবে যাওয়ার আগেও কী অদ্ভুত আলো! কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে খেয়ালও ওর নেই। বিশাল ওকে ডেকে বললে, “যা, আমার সাইকেলটায় একটু নাড়ুদার দোকান থেকে হাওয়া ভরিয়ে আন তো। কী যে হল সাইকেলটায়! প্রতিদিন হাওয়া চলে যায়। মনে হচ্ছে টায়ারটাই বদলাতে হবে এবার।”

শুভম বিশালের সাইকেল নিয়ে হাওয়া ভরাতে যায়। বিশালকে শুভম খুবই সমীহ করে। শুধু সমীহ বললে একটু কম বলা হয়। বরং বিশালকে ও মনে মনে বেশ ভক্তিই করে। ওরা একই বয়সি। তাও বিশাল পড়াশোনায়, খেলাধুলোয়—সবেতেই খুব ভালো। শুধু ভালো নয়, সেরা। তার ওপর কত কী জানে ও! মোবাইল গেম থেকে মহাকাশ বিদ্যা—সবেতেই কত জ্ঞান ওর। শুভমের বাড়িতে ওর বাবার মোবাইলটা স্মার্টফোন হলেও ওকে ছুঁতেও দেয় না বাবা। গেম খেলা তো অনেক দূরের ব্যাপার। বাবা বলেন, ‘এখন এই বয়স হল প্রকৃতিকে জানার। চারপাশটা তো ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। যেটুকু গাছপালা, পুকুর, খাল-বিল-ডোবা দেখতে পাচ্ছ, সব এখনই দেখে নাও। তোমরা বড়ো হতে হতে আর এসব কিচ্ছু থাকবে না। গ্রামই থাকবে না। আর কয়েকদিন বাদে দেখার মতো কিচ্ছু পাবে না। যত ইচ্ছে তখন ওই মোবাইল নিয়ে পড়ে থেকো। এখন শুধু দেখো। দু-চোখ যতটা পারে সবকিছু দেখে নাও। আর নিজের মধ্যে রেখে দাও। এইসব দেখাই দেখবে একদিন তোমার সঞ্চয়।’

শুভমেরও বাবাকে উত্তর দিতে ইচ্ছে করে— ‘মোবাইলও তো দেখারই। স্কুলে সেদিন সিদ্ধার্থ লুকিয়ে মোবাইল এনেছিল। ছুটির পর সবাইকে দেখিয়েছিল। কী যেন ভিডিও আপলোড করে ও—হরর হসপিটাল, ফ্রি ফায়ার, মাইন ক্র্যাফট গেম—আরও কত কী নাম! ক্লাসের ভালো রেজাল্ট করা ছাত্ররাও সব মনোযোগ দিয়ে ঝুঁকে ওর মোবাইলটাই দেখছিল।’ পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার পরও দেখেছে। যে ক’জন ছেলেমেয়ে মোবাইল নিয়ে আসে, কী মন দিয়ে সবাই মোবাইলটাকেই দেখতে থাকে। ওর বাবা ছেলের হাতে মোবাইল দেওয়ার খুবই বিরোধী। বাবাকে কথাগুলো বলে কোনও লাভ হবে না জেনেই ও চুপ করে থাকে। তাছাড়া পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে বন্ধুরা মোবাইল আনে আর ও সেই বন্ধুদের মোবাইলে অনেকরকম গেম খেলা দেখে যে কিছুটা শিখেও গেছে এর মধ্যেই, এ-কথা বাবা জানতে পারলে হয়তো ওর কোচিংয়ে আসাই বন্ধ করে দেবে। না-হয় স্যারের কাছে গিয়ে বন্ধুদের মোবাইল নিয়ে আসার কথা বলে ওর সঙ্গে বন্ধুদের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবে।

মায়ের সঙ্গেই কেবল আবদার, তর্ক সবই করতে পারে শুভম। এই যেমন, হেড-স্যারের নিয়ম অনুযায়ী ও বিশালের পাশে ক্লাসে এবার বসতে পেরে জানতে পেরেছিল পরিমল-স্যারের কোচিংয়ের কথা। বিশাল ক্লাস সিক্স থেকে এই কোচিংয়ে পড়ছে। আর ও এখন এই টেস্টের সময় এসে ভর্তি হল। তাও কোচিং ক্লাসের কথা মায়ের কাছেই বলেছিল। কোচিংয়ে এবার ভর্তি হতেই হবে। ওই দীপক-স্যারের কাছে বাড়িতে সব সাবজেক্ট হলেও অঙ্ক মোটেই হয় না। ইংরাজিতেও যদি আর-একজন কাউকে পেত। বাবা তো ওকে বলেন, ‘নিজে পড়ো। সেলফ স্টাডি ইজ দ্যা বেস্ট স্টাডি।’

স্কুলের হেড-স্যারের কাছেও এইজন্য কৃতজ্ঞ শুভম। হেড-স্যার রেজাল্টের পর প্রতি ক্লাসে নিজে এসে বলেন, ‘ফার্স্ট আর লাস্ট বলে কোনও পার্থক্য নেই। আজ যে লাস্ট কাল সে ফার্স্ট। হয়তো একজন পরীক্ষায় একটু কম নম্বর পেয়েছে, কিন্তু হতেই পারে সে অন্য কোনও বিষয়ে খুব ভালো। সেখানে সে অন্য অনেককে হারিয়ে দিতে পারে। তা সে খেলাধুলো, সমাজসেবা বা অন্য যা কিছু ভালো কাজই হোক না কেন। তাই ক্লাসে তোমরা বন্ধুদের মধ্যে কোনও বিভেদ রেখো না।’

হেড-স্যারের কথা অনুযায়ী, প্রতিটা ক্লাসেই সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তের পাশে বসবে সব থেকে কম নম্বর পাওয়া ছেলেটি। সেই ক্রম অনুযায়ী, এবার শুভম আর বিশাল ক্লাসে পাশাপাশি বসেছে। শুভম বিশালকে খুবই পচ্ছন্দ করে। বিশাল শুধু পড়াশোনায় বা খেলাধুলোয় যে ভালো তা নয়, ওর মনটাও খুব উদার। একবার ক্লাসে ওরা বন্ধুরা গল্প করছিল, কার কোন বিষয় সবথেকে বেশি ভালো লাগে। বিশাল বলেছিল, “অঙ্ক।”

শুনে শুভম বলেছিল, “আরে আমার তো সবচেয়ে খারাপ লাগে ওই অঙ্ককেই। কিছুতেই বুঝতে পারি না—কোন ফর্মুলা ঠিক কোন অঙ্কের জন্য প্রয়োজন।”

“তোর খারাপ লাগে কারণ তুই অঙ্ক ভালোবাসিস না, তাই বুঝিসও না।”

বিশালের এই কথা শুনে শুভম খুবই অবাক হয়েছিল।—“অ্যাঁ! অঙ্ক কি ভালোবাসার জিনিস? অঙ্ক তো কষার জিনিস।”

“এইটাই তো ভুল! অঙ্ক শুধু কষলেই হয় না, অঙ্ককে ভালোবাসতে হয়। তাহলেই অঙ্ক আর কঠিন লাগে না। কারণ, ততক্ষণে অঙ্কও দেখবি তোকে ভালোবেসে ফেলেছে।”

“না মানে, অঙ্ক ভালোবাসবে আমাকে? সেও কি সম্ভব?”

“কেন সম্ভব নয়? রোজ সময় দিতে হবে অঙ্কের জন্য।”

“আমি যে সময় দিই না, তা নয়। কিন্তু ভুল হয় খুব আমার।”

“কেন ভুল হয়, এইটাই তো বুঝতে হবে।”

“এখন আর সময় কোথায় ভাই? সামনে টেস্ট পরীক্ষা। কী করে যে উতরাব তাই শুধু ভাবছি।”

শুভমের কথা শুনে ওর ওপর বিশালের একটু মায়াই হল। ওর অঙ্কভীতির সমাধান দিতেই ও বলল, “সময় যদিও খুবই কম তবুও চেষ্টা করতে হবে।”

বিশালের এই কথায় শুভম সেদিন মনে একটু জোর পেয়েছিল।—“তুই ভাই একটু আমাকে সাহায্য করবি?”

“আমি? না না, আমার সময় হবে না। তুই পরিমল-স্যারের সঙ্গে কথা বল। তিনি তোকে সাহায্য করতে পারবেন। অবশ্য যদি রাজি হন।”

“পরিমল-স্যার?”

“আচ্ছা, আজ স্কুলের পর যাস আমার সঙ্গে। আমি পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে পড়ি। স্যার যদি তোকে ওঁর কোচিংয়ে ভর্তি নিয়ে নেন, খুব ভালো হবে তোর। স্যারের হাতে পড়লে অঙ্ক নিয়ে তোর আর কোনও চিন্তা নেই।”

সেই থেকেই শুভম বিশালের সঙ্গে পরিমল স্যারের কোচিংয়ে পড়ছে। ওর বাবা অবশ্য প্রথমটায় রাজি হননি। এইবার কিন্তু ওর মা একরকম জোর করেই ছেলেকে এই কোচিংয়ে ভর্তি করে দেন।

দুই

সোনাডাঙা নামেই শহর, আসলে একটা টাউন বলা যায়। নগর-সভ্যতার ছোঁয়া পেলেও সোনাডাঙায় এখনও খুব সামান্য কিছু সবুজ অবশিষ্ট রয়েছে। তুলনামূলকভাবে জমির দাম এখানে কম বলে কংক্রিটের ভিড় অবশ্য বাড়ছে ক্রমশ। আগের মতো তাই এখন সোনাডাঙায় একটু চোখ বোলালেই কোথাও কলাবাগান, কোথাও বাঁশবাগান, কোথাও-বা সুপুরিবাগান অথবা যত্রতত্র আম-কাঁঠালের গাছ দেখতে পাওয়া যাবে না। খুঁজেপেতে দেখতে পারলে অবশ্য সামান্য হলেও এখনও সেসবই দেখা যাবে। পরিমল-স্যারের কোচিং এই শহরেরই এক প্রান্তে। ভালো, মাঝারি সবরকম ছাত্রই আসে ওঁর কাছে পড়তে। ওঁর কাছে পড়তে এসে অঙ্কে ফেল কেউই আজ পর্যন্ত করেনি। কিন্তু কোচিং বলেই যে-কোনো ছাত্র এসে হুড়মুড় করে ভরতি হয়ে যাবে তা হওয়ার নয়। রীতিমতো পরীক্ষা নিয়ে তিনি ছাত্র ভরতি করেন। শুভমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কী করে যে সেই পরীক্ষায় ও পাশ করল, তা অবশ্য নিজেই বুঝতে পারল না। বোধহয় বিশালের কারণেই ওকে ভর্তি করে নিলেন পরিমল-স্যার।

পরিমল-স্যারের কোচিং ওঁর পৈতৃক বাড়িতেই। বাড়িটা বেশ পুরোনো আমলের। বাড়ির সদর দরজা ছাত্রদের জন্য সবসময়ই খোলা থাকে। বাড়িতে ঢুকতেই একটা উঠোন। উঠোন পেরিয়ে একদিকে একটা ঠাকুরদালান আর তার লাগোয়াই একটা ঘর। স্যারের দাদা নির্মল ভটচাজ থাকেন সেই ঘরে। ছাত্ররা অবশ্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে স্যারের পড়ানোর ঘরে চলে যায়। অনেকে আবার সকাল-সন্ধে দু-বেলাই তাঁকে ঠাকুরদালানে বসে থাকতে দেখে। সেখানে একটা প্রায় তিন-সাড়ে তিন ফুট উঁচু পাথরের মা কালীর মূর্তি রয়েছে। তার সামনে বসে স্যারের দাদা প্রতিদিন সকাল-সন্ধে দু-বেলা পুজো করেন। ছাত্ররা স্যারের বাড়িতে ওই সময় গেলে তাঁকে পুজো করতেই দেখে। কেউ কোনও গোলমাল করে না সে-সময়। বাইরে সাইকেলটা রেখে ওরা চুপচাপ ভেতরের বাড়িতে চলে যায়। কখনও আবার ওই মূর্তির সামনে আসন পেতে ওঁকে চুপচাপ বসে থাকতেও দেখা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপ করে বসে থাকেন। বসার ভঙ্গিটা ঠিক পুজো করা মতো নয়। কেমন এক আশ্চর্য উদাস ভঙ্গি, যেন গভীর কোনও চিন্তায় মগ্ন। ওঁর সামনে দিয়েই ছাত্ররা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠ যাচ্ছে, নামছে। অথচ কিছুই খেয়াল করছেন না উনি।

uponyas84 (2)

আবার কখনও আর-একটু বেলা হলে স্যারের দাদা ঠাকুরদালানে বসেই কখনও কারও হাত দেখেন, কখনো-বা কারও কোষ্ঠী গণনা করেন। আবার সেই একই জায়গায় বসে অনেক সময় তাঁকে হোমিওপ্যাথির পুরিয়া দিতেও দেখতে পায় ছাত্ররা। কথা খুব বেশি বলেন না। মাঝে মাঝে ‘মা মা’ বলে ডাকেন। কেউ কেউ বলে, প্রতিবার অমাবস্যায় ভর হয় ওঁর ওপর। কিন্তু কখনও কোনও ছাত্রেরই কালীপুজোর সময় বা অন্য কোনও পুজোর সময় এখানে নিমন্ত্রণ থাকে না। তাই এই ভরে পড়া অবশ্য কারোরই নিজের চোখে দেখা হয়নি।

তবে একটা বিষয়ে সবাই কমবেশি বিশ্বাস করে। বিশেষ করে ছাত্ররা। সেটা হল, নির্মল ভটচাজের মুখের কথা নাকি অব্যর্থ। দূরদূরান্ত থেকে অনেক লোক আসে তাঁর কাছে। মাসে একটা দিন মাত্রই তিনি হাত দেখেন। তাঁর নিজের ইচ্ছে না হলে ভক্ত সমাবেশ যত বিপুলই হোক তিনি কিছুতেই জ্যোতিষচর্চা করবেন না। মায়ের প্রসাদী ফুল ও হোমিওপ্যাথির ওষুধ অবশ্য রোজই বিতরণ করেন। স্যারের দাদা সম্পর্কে ওখানে আরও অনেক গুজব রয়েছে। তিনি ডাক্তারি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং কিছু একটা পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে হঠাৎ হিমালয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে নাকি কোনও এক  সাধুবাবার কাছে দীক্ষাও নিয়েছেন। সাধুবাবার কাছ থেকেই তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র শিখেছেন। আবার কেউ বলে, নির্মল ভটচাজের মাথার ব্যামো। বিদেশে কোথায় যেন অধ্যাপনা করতেন। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কই ছিল না তাঁর প্রথম চাকরি জীবনে। এখন মাথার ব্যামোর কারণেই সব ছেড়েছুড়ে অনেক বছর পর ফিরে এসেছেন বাড়িতে। এসবই ওদের সবার শোনা কথা।

পরিমলবাবুর ছাত্ররা বাড়ির মধ্যে ঢুকে ওরকম একটা বিশালদর্শন কপালে রক্তচন্দন তিলক পরিহিত মাঝবয়সি পুরুষকে এক-একসময় এক-একভাবে দেখে থাকে। কখনও গম্ভীর মুখে রোগী দেখতে অথবা কখনও খুব উদাসীনভাবে চুপ করে বসে থাকতে, আবার কখনও মায়ের পুজো করতে। প্রতিবারই ওদের মনে হয় যেন কোনও কাপালিক বসে আছেন। আর সেই বজ্রকণ্ঠে যখন ‘মা মা’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়, ওদের অন্তরাত্মার একটু আধটু না কেঁপে আর উপায় থাকে না। পরীক্ষার আগে প্রত্যেকেরই একবার জানতে ইচ্ছে করে এবারে পাশ করবে তো? কিন্তু ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করা একদম নিষেধ। উনি কতবার ভক্তদেরই ফিরিয়ে দেন। পরীক্ষার আগে ছাত্ররা শুধু ওঁর পায়ের ধুলো নিয়ে চলে যায়। উনি কোনও কথা বলেন না।

একবার অবশ্য ক্লাস নাইনের শান্তনুকে বলেছিলেন, ‘একদম দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি পারো বাড়ি চলে যাও।’ ব্যস, এই একটাই কথা। শান্তনুর মায়ের সে-বার খুব শরীর খারাপ। প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে ও দেখে ওদের বাড়ির সামনে বেশ ভিড়। মায়ের জন্য ওর বুকটা ধুকপুক করে উঠল তখুনি। তাহলে কি ওর মা… কেঁদে ফেলে ও। কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকে মাকে দেখেই ওর মনটা ভালো হয়ে গেল। মাকে জড়িয়ে ধরল। ওর মা কিন্তু ছেলেকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। শহর থেকে ফেরার পথে ওর বাবার বাইকে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, সদর হাসপাতালে ভরতি ওর বাবা। ওর মা এতটাই অসুস্থ যে ঠিকমতন চলাফেরাই করতে পারছেন না। ওকেই তাই হাসপাতালে যেতে হবে পাড়ার রবিকাকুর সঙ্গে। হাসপাতাল থেকে শান্তনুর আবার স্যারের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছিল। একবার নির্মলজেঠুকে জিজ্ঞেস করতে চায় ও—বাবা ভালো হয়ে যাবে তো? সেদিনই না হলেও পরে একবার গিয়েছিল ও। কিন্তু উনি আর কোনও কথাই বলেননি।

বিশাল অবশ্য এই ঘটনার একটা যুক্তি নিজের মনেই তৈরি করেছিল। ওঁর কাছে অনেক মানুষ আসেন। তাঁদেরই কেউ দুর্ঘটনার খবর জানিয়েছিল হয়তো তাঁকে। আর তাই উনি শান্তনুকে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে বলেছিলেন। শান্তনুর বাবা কিন্তু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। আরও আশ্চর্যের, শান্তনুর রোগে ভোগা মাকেও সেদিন টাউনের মেলায় বিশাল দেখেছে। তাহলে উনি চুপ করে থাকলেন কেন? কারণ, উনি এর পরেরটা জানেনই না? নাকি ওই যে বলে না, ওঁর ভর হঠাৎ হলেই উনি বলতে পারেন? না-হলে নয়? এরকম নানা প্রশ্ন বিশালের মনে আসে। ও যদিও কোনও বার পরীক্ষার সময় সবার মতো লাইন দিয়ে পায়ের ধুলো নেয়নি।

সেদিন টেস্ট পরীক্ষার জন্য স্কুলে ছটি পড়ে যাওয়ার আগের দিন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি দুর্যোগের মধ্যে স্কুলে হাতেগোনা কয়েকজন ছেলে এসেছিল। প্রশান্ত-স্যারের কোচিংয়ে ক্লাশও ছিল স্কুলের পর। ছাত্ররা স্কুলেও আসেনি, কোচিংয়েও যায়নি বিশেষ। বিশাল স্কুলে এসেছিল তাই ফেরার পথে কোচিংয়ে ইংরাজির জন্য কতগুলো নোট নেবে বলে গিয়েছিল। শুভমও যথারীতি ওর সঙ্গে গেল। স্যার বেশিক্ষণ পড়াননি। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে ছেলে দুটো এসেছে বলে বেশ কয়েকটা নোটস ও একটা বিদেশি গ্রামার বই ওদেরকে দিয়ে কয়েকটা এক্সারসাইজ সলভ করতে বললেন। ওদের প্রথম পরীক্ষাই ইংরাজি।

বিশাল বইটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে কয়েকদিন রাখবার আবদার করতে স্যার রাজিও হয়ে গেলেন। বৃষ্টি থামলেও আকাশের মুখ ভার তখনও। স্যার দুজনকেই বাড়ি চলে যেতে বললেন।

আজ ঠাকুর দালান একেবারেই ফাঁকা। মাঝে-মাঝেই নির্মলজেঠু কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যান। নিরুদ্দেশ বলতে কোথায় যে যান তা বাড়ির কেউই জানে না। আগে সবাই দুশ্চিন্তা করত। কিন্তু এখন বাড়ির লোকের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। হয়তো কখনও মাসের পর মাস কোনও খবর নেই। কখনও আবার এক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসেন। সেরকমই কোথাও গিয়েছেন ভেবে ওরা দুজনেই ফাঁকা মন্দির দালানে কালীমূর্তির দিকে তাকিয়ে প্রণাম সেরে সাইকেল দুটো নিতে যাবে এমন সময় একটা গলা খাঁকারি মতো শুনতে পেল। ওদের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন জেঠু। কপালে রক্তচন্দনের তিলকটা যেন জ্বলজ্বল করছে, এত উজ্জ্বল। এক মুহূর্ত ওরা দুজনেই একটু ভয় পেল। শুভমকে প্রণাম করতে দেখে বিশালও প্রণাম করল তাঁকে। জেঠু কেমন একটা উদাস স্বরে ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে বললেন, “নাহ্‌, এবার আর হবে না।”

তিন

দুজনে সাইকেলে উঠতে না উঠতেই বৃষ্টির ফোঁটা এসে ওদের গায়ে পড়ল। শুভম চাইছিল এই বৃষ্টির মধ্যে একটু দাঁড়িয়ে যেতে, কিন্তু বিশাল কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির পথ ধরল। অগত্যা শুভমকেও বাড়ির পথেই সাইকেল ঘোরাতে হল। স্যারের জ্যোতিষদাদাকে ওরা যে ঠিক ভয় পায় তা নয়, কিন্তু হঠাৎ করে বলা কথাটা দুজনেরই মনখারাপ করে দিল। দুজনেই ওরা ভাবতে থাকে কী না হওয়ার কথা বললেন উনি? বিশাল ভাবল, ওর যা প্রস্তুতি তাতে টেস্ট পরীক্ষায় ও প্রথম হবে এমনটা আশা করা যেতেই পারে। স্যারের দাদা একেবারে ওর দিকে তাকিয়েই বলেছেন ‘এবার আর হবে না।’ তাহলে কি এবার আর ওর পরীক্ষায় প্রথম হওয়া হবে না?

শুভম ভাবে, ওর দিকে তাকিয়ে জেঠু বললেন ‘হবে না।’ তাহলে কি ওর পাশ করা হবে না?

স্কুলে টেস্ট পরীক্ষার আগে পড়াশোনার জন্য ছুটি দিয়েছে। বিশালের কখনও মনঃসংযোগের অভাব হয়নি। কিন্তু এবার ওর মন শুধু স্যারের জ্যোতিষদাদার ওই না হওয়ার আগামবার্তার পেছনেই ছুটে বেড়াচ্ছে। একবার ভাবল, স্যারের বাড়ি গিয়ে সরারাসরি ওঁকে জিজ্ঞেস করবে—‘কী না হওয়ার কথা বললেন আপনি?’ কিন্তু উনি তো ঠিক স্বাভাবিক নন। এমনিতেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কত দূরদূরান্তের ভক্তদের ফেরত পাঠিয়েছেন। স্যারকে ফোন করতেও সাহস হচ্ছে না। স্যার ওর বাবার মতোই প্রবল যুক্তিবাদী। তিনি নিজে দাদার এইসব কর্মকাণ্ডকে মানসিক রোগ মনে করেন। যদিও দাদাকে অসম্মান কোনোদিন করেননি। বাড়িতেও কাউকে বলতে পারছে না বিশাল ওর মনের কথা। কিন্তু এই ‘হবে না’ কথাটা কিছুতেই ওর মন থেকে সরছে না। পড়াশোনাতেও মন বসছে না ওর। এইভাবে টেস্ট পরীক্ষার আগের ছুটির ক’টা দিন ও একদম মন দিতে পারেনি। যেন পড়তে বসলেই মনে হচ্ছে, কী হবে আর? সেই তো প্রথম হতে পারব না।

আর মাত্র দু-দিন বাকি টেস্ট পরীক্ষার। সেদিন সন্ধেবেলায় ঝড়বৃষ্টি আবার আরম্ভ হল। বিশাল পড়তে বসেছে। কিন্তু অন্যমনস্ক, পড়ায় মন নেই ওর। হঠাৎ লোডশেডিং। ও চুপ করে বসেই আছে। দরজায় একটা ছায়া যেন। কেউ কী দাঁড়িয়ে?

“কে?”

দরজা ঠেলে শুভম ভেতরে এল।

“তুই? এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কী মনে করে? আমার কাছে কোনও সাজেশন হবে না কিন্তু। সবই পড়তে হবে।”

“না, সাজেশন নিতে আসিনি তো। কাল নিলয়ের কাছে এই সাজেশনটা পেলাম। এর মধ্যে টেস্টের জন্য সব ইম্পরট্যান্ট প্রশ্ন আছে।”

“নিলয়? মানে আমাদের ফিজিক্সের অম্লান-স্যারের ছেলে?”

“হ্যাঁ। সে দিলে। আমি পাশ করতেও পারব না। তাই কেঁদেকেটে ওকে একদিন বললাম, ওর বাবা যদি একবার ফিজিক্স আর অঙ্কটা দেখিয়ে দেয়। বললে, ‘বাবা প্রাইভেট টিউশানি করান না। আমি বরং তোকে সাহায্য করতে পারি। এই সাজেশনটা নিয়ে যা। এখানে যে চ্যাপ্টারগুলো লেখা আছে সেগুলো মন দিয়ে পড়। প্রশ্ন সেখান থেকেই আসবে।’”

“তোকে নিলয় দিল?”

“হ্যাঁ। দিল তো। আর আমি তোর কাজে লাগবে ভেবে নিয়ে এলাম।”

বিশাল একেবারে ছোঁ মেরে শুভমের হাত থেকে সাজেশন লেখা কাগজটা ছিনিয়ে নিল। তারপর দ্রুত রান্নাঘরে মায়ের কাছে আলো চাইতে গেল। ও ফিরে আসার পরে শুভম যে ঘরে নেই, চলে গেছে, এটুকুও খেয়াল করল না। মন দিয়ে সাজেশনের কাগজটা দেখল। দেখতে দেখতে খুব মাথা গরম হয়ে গেল ওর। এ কী? এ তো পুরো সিলেবাসটাই রয়েছে। শুধু চ্যাপ্টারগুলো সাব-চ্যাপ্টারে প্রশ্নের আকারে লেখা। কোনও প্রশ্নই বাদ নেই তো! মুহূর্তে শুভমের ওপর খুব রাগ হল ওর। তবুও আলো ফিরে এলে আবার সাজেশন পেপারটা নিয়ে বসল ও। যেমনভাবে প্রতিটা চ্যাপ্টার থেকে সম্ভাব্য সবক’টা প্রশ্ন লেখা আছে, সেভাবেই প্রশ্নের উত্তর ধরে ধরে পড়া শুরু করল। একবার করে পুরো চ্যাপ্টারটাও পড়ে নিল। এইভাবে আবার ওর পড়ায় মনোযোগ ফিরে এল। টেস্টের সবক’টা পরীক্ষাই ওর খুব ভালো হল।

পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন অবশ্য ফেরার পথে স্কুলের পেছনে কাঁঠালগাছটার নীচে শুভমের সঙ্গে দেখা হল ওর। শুভমকে দেখে ও প্রচণ্ড রেগে গেল। ওর সঙ্গে এরকম অদ্ভুত বাজে মশকরা করার জন্য যাচ্ছেতাই বলল ওকে।

রেজাল্ট প্রকাশিত হলে যথারীতি বিশাল প্রথম স্থান পেল। এইবার ওর শুভমের কথা মনে পড়ল। আশ্চর্য, শুভমের নাম নেই তো! মনে মনে এবার যেন ও প্রথম হওয়ার আনন্দ খুব বেশিমাত্রায় অনুভব করল। আর নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হেসে উঠল। স্যারের দাদা তাহলে শুভমের পরীক্ষায় পাশ করা হবে না বলেছেন? ওকে নয়?

চার

টেস্টের রেজাল্ট বেরোনোর পর বিশাল বেশ ফুরফুরে। বেশ কয়েকদিন খেলা বন্ধ ছিল ওর। এখন এই মাস তিনেকের ছুটিতে ও একটা রুটিন তৈরি করে ফেলল। সেই অনুযায়ী বিকেলে খেলতেও গেল ওদের পাড়ায় আগামী ক্লাবের মাঠে। আজ খেলতে গিয়ে বলটা আবার হাইড্রেনে পড়ে যাওয়ায় ওর শুভমের কথা মনে পড়ল। এখানে স্কুলের ভালো ছাত্র বলে ওর আলাদা কোনও বাড়তি খাতির নেই। এই বল ওকেই আনতে হবে, নয়তো ক্লাবের জন্য একটা ফুটবল কিনে দিতে হবে। শুভম ওর পাশে বসলেও ও শুভমকে বন্ধু কোনোদিনই মনে করেনি। আর পরীক্ষার সাজেশনের বদলে পুরো সিলেবাস টুকে আনার মতো জঘন্য রসিকতা ও মেনে নিতেও পারেনি কিছুতেই। আজও মনে পড়লে শুভমের ওপর খুব রাগই হয় ওর। সেদিন হাইড্রেন থেকে বলটা তুলতে গিয়ে শুভমের কথা যদিও ওর বার বার মনে পড়ছিল। স্কুলের মাঠ হলে শুভমকে বলতেও হত না। যদি না ও ঘুমিয়ে পড়ে তো ঠিক বল কুড়িয়ে এনে দেবে। তা সে বল যেখানেই পড়ুক না কেন।

শুভম বোধহয় এবার পরীক্ষা দিতে পারবে না। টেস্টের লিস্টে তো ওর নাম ছিল না। বিশাল খুব একটা শুভমের কথা আর ভাবতে চাইল না। কিন্তু আবার এও মনে হল, একবার শুভমের বাড়ি গিয়ে ওর সঙ্গে এইরকম রসিকতা করার জন্য বেশ দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে আসে। পরশু সকালে ওর পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে ক্লাস আছে। শুভম তো এখন আর স্যারের ক্লাসেও আসছে না। ও তাই ভাবল, ক্লাসের পর সেদিন একবার শুভমের বাড়ি যাবে।

পাঁচ

পরিমল-স্যারের কোচিং থেকে বাড়ি ফেরার পথে সেদিন কী বৃষ্টি! শুভম বলল, “একটু দাঁড়িয়ে যাই চল। বৃষ্টিটা ধরুক।”

বিশাল কোনও উত্তরই দিল না। সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়েছে ওর বাড়ির পথে। ওইটুকু সময়ে বিশালের মুখটা যে শুকিয়ে কালো হয়ে এসেছে তা শুভম তখনই বুঝতে পেরেছিল। বাড়ি গিয়ে শুভমেরও শান্তি নেই। স্যারের দাদার কথা নাকি অব্যর্থ। কিন্তু বিশাল তো এসবে বিশ্বাসই করে না। ও নিজেই বলে, ‘যুক্তি ছাড়া কোনও কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তাহলে ওর মতো ছেলেই-বা এত ভয় পেল কেন কথাটা শুনে? মুখে না বললেও বিশালের মুখ দেখে শুভম কিছুটা অনুমান করেছে। বিশাল তো আর ফেল করবে না। ফেল করার ছেলেই ও নয়। তাহলে? কথাটি কি শুভমকে বলেছে? শুভম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঠিক করে একবার আবার স্যারের বাড়িতে যাবে। অবশ্য গেলেই কি স্যারের দাদাকে দেখতে পাবে? আর যদি দেখতে পায়ও, উনি কি শুভমকে ‘হবে না’-র বিষয়টা খুলে বলবেন?

সেদিন মুদি দোকানে সরষের তেল আনতে পাঠিয়েছিলেন শুভমের মা। মায়ের কথামতো তেল কিনে বাজারের পথেও ওকে একবার যেতে হয়েছিল কাঁচা লংকা কিনতে। বাজারেই নিলয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল ওর। নিলয়কে দেখে ও খুব খুশি। মনের মধ্যে পরীক্ষা বিষয়ে এমন একটা ভয় ওর চেপে বসেছিল যে দেখা হতেই নিলয়কে কত করে বলল, ওর বাবা যদি একবার একটু ফিজিক্সটা দেখিয়ে দেন। তা ওর অবশ্য এতে কিছুই করার নেই। অম্লান-স্যার যে প্রাইভেট টিউশন করেন না! যা কিছু প্রশ্ন স্কুলেই করতে হবে তাঁকে। বাড়িতে কোনও ছাত্র বা তাদের বাবা-মায়েদের বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেন না তিনি।

নিলয় চলেই যাচ্ছিল। আবার ফিরেও এল।—“শোন, বাবা কিছুতেই বাড়িতে পড়া দেখাতে রাজি হবেন না। তবে আমি তোকে একটা সাজেশন দিতে পারি।”

“সাজেশন? পরীক্ষার?”

“আরে নামেই সাজেশন। আসলে পুরো সিলেবাস। খুব একটা লাভ কি তোর হবে? বাবা অবশ্য বলেন এইভাবে প্রশ্নের আকারে পড়লে নাকি পড়া তাড়াতাড়ি তৈরি হয়। মনেও থাকে।”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আর-একটু খুলে বল।”

নিলয় শুভমের কথা শুনে একটু বিরক্ত হল।—“উফ্‌! এতে না বোঝার কী আছে? আমার বাবা প্রতিটা চ্যাপ্টারকেই সম্ভাব্য প্রশ্নের আকারে লিখে দিয়েছেন। বড়ো প্রশ্ন, ছোটো প্রশ্ন, এমনকি এককথায় প্রশ্নের আকারেও। তবে আগে অবশ্য পুরো অধ্যায়টা পড়তে হবে। তারপর প্রশ্নের উত্তর লিখতে লিখতে পড়লেই পড়া তৈরি খুব সহজেই হবে।”

“তুই ভাই যা আছে তাই দে আমায়। আমিও চেষ্টা করে দেখি।”

নিলয়ের কাছ থেকে প্রশ্নের সাজেশনটা নিয়ে শুভম এক কপি জেরক্স করাল। সোনাডাঙা অনেক দূর। তবুও এই সাজেশন বিশাল পেলে ওর নিশ্চয়ই উপকার হবে। আর নির্মলজেঠু ‘হবে না’ যাকে নিয়েই বলে থাকুন, কারও ক্ষেত্রেই যেন সত্যি না হয়। এই ভেবে ও বিশালের বাড়ি গিয়ে সাজেশনের কাগজটা দিয়ে এল। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর তো ও একা পারছে না। একবার পরিমল-স্যারের কাছে যাবে ঠিক করল। সবার মাঝে নয়, একদিন যদি একা ও প্রশ্নগুলো নিয়ে যেতে পারত, তাহলে কথায় কথায় সেদিনের ‘হবে না’ বিষয়ও জিজ্ঞাসা করতে পারত। এইসব ভেবে পকেটে প্রশ্নের কাগজটা নিয়ে সাইকেলটা বার করল।

“পরীক্ষার আর কয়েকদিন বাকি। এই ভরদুপুরে সাইকেল নিয়ে কোথায় চললি?”

মায়ের ডাকে একটু দাঁড়িয়ে পড়ল।—“মা, এই যাব আর আসব।”

“কোথায় যাবি বলে যাবি তো?”

“পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে।”

“তা বইখাতা কোথায়? আর ওঁর কোচিং তো আবার শনিবার। আজ যে বৃহস্পতিবার।”

“না না, উনি এখন টেস্টের আগে যে-কোনো সময়েই অসুবিধা হলে যেতে বলেছেন।”

“আহা! অসুবিধাটা কোথায়? কোন সাবজেক্টে? বইখাতাই-বা কোথায়?”

“উফ্‌! তুমি এত জেরা করছ কেন?”

“না, জেরা করব না! বাবা এলে আমি কী বলব? তাছাড়া পরীক্ষার সময় বাজে সময় কি নষ্ট করতে হয় বাবা?”

“মা, বিশ্বাস করো, আমি স্যারের কোচিংয়ে যাচ্ছি। অন্য কোথাও নয়।”

“আচ্ছা। সে না-হয় বিশ্বাস করলাম। কিন্তু দেখিস, সন্ধে না হয় যেন। সন্ধেবেলায় বাবার সঙ্গে যেতে হবে তোকে।”

“কেন? বাবার আবার সন্ধেবেলায় আমাকে প্রয়োজন কেন?”

“তাও জানিস না? এই তো কাল হারান মোদকের কাছে গোরু বিক্রি করতে আসে যে ছেলেটা জগা না কী যেন নাম, বছর সতেরো হবে। তা হারানের কথামতো একটা ভালো জাতের কালো দুধেল গাই নিয়ে ওর আসার কথা ছিল। জগার বাপ বলছে সে গোরু নিয়ে এদিকে এসেছে। আর ওর বাবা নিজে ওকে এ-পার করে দিয়ে তবে কাজে গেছে। সেই ছেলে আর তার গোরু না হারানের কাছে এসেছে, না বাড়ি ফিরে গেছে। সে কী হুলুস্থুল কাণ্ড!”

“আচ্ছা বি.এস.এফ-এর কাছে খোঁজ নিয়েছিল? এভাবে বর্ডার পার করে গোরু পাচার তো বেআইনি। সেই কারণেই হয়তো গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ!”

“না রে। ব্যাপারটা অত সোজা হিসাবের নয়। আজ থেকে নয়, সেই কবে থেকেই তো ওরা এ-কাজ করছে। বি.এস.এফ-এর কাছেও খোঁজ নিয়েছে ওর বাড়ির লোকেরা। ওদের কাছে নাকি কাগজপত্রও থাকে। বি.এস.এফ-এর কেউই ওকে গ্রেপ্তার করেনি। বরং দুজন পুলিশ জানিয়েছে, ওরা ওকে আমাদের এই চন্দ্রকোনা গ্রামের দিকে আসতে দেখেছে। পুলিশরা ওকে জিজ্ঞেসও করেছিল কোথায় যাচ্ছে ও, ও উত্তরও দিয়েছিল, হারান মোদকের কাছে গোরু বিক্রি করতে যাচ্ছে।”

“আশ্চর্য! এভাবে গোরু বিক্রি করা যায়? কী জানি। বাবা এসব আইনকানুন জানবেন ভালো।”

“হ্যাঁ। আমিও অত ভালো জানি না। তবে দু-দিন ধরে সতুর ঠাকুমাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধেবেলা ঘোষেদের বাড়ি হরিসভায় যেতে শেষ দেখেছে গোপালের মা। তারপর থেকে আজ তিনদিন হল, কোথায় গেছে কেউ জানে না।”

“আরে জানবে কী করে? তিনকুলে কেউ আছে ওই বুড়ির? সতুরা সেই কবে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেল। তারপর শুধু শহর নয়, দেশও ছেড়ে সবাইকে নিয়ে সতুর বাবা বিদেশে চলে গেলেন। আর ওই বুড়ি মাকে সতুর বাবা নিয়ে গেলেন না। মনের দুঃখে কোথাও গেছে হয়তো। চলে আসবে আবার।”

“আরে না। সতুর ঠাকমা কিন্তু তেমন ধারার মানুষ ছিল না। এখনও এই প্রায় নব্বই বছর বয়সে বুড়ি ডাল বেটে বড়ি দেয়। আমড়ার আচার শুকায় রোদে। ঠায় লাঠি হাতে পাহারা দেয়। মানুষ তো দূর, কাকপক্ষীরও সাহস নেই ওই আচারের বয়াম বা ডালের বড়ির দিকে নজর দেয়। অমন হিসেবি একটা মানুষ—ঘরদোর সব খোলা রেখে শুধু দরজাখানা ভেজিয়েই কোথাও চলে যাবে? কেমন বিশ্বাস হয় না রে।”

“আচ্ছা, ফিরে এসে কথা বলব। এবার আমি যাই। না-হলে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। এরপর তো বলবে, ‘সন্ধে হয়ে যাবে। আর যেতে হবে না তোকে।’”

“যেতে কি হবেই বাবা?”

“হ্যাঁ, মা। একটা প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন। যাব আর আসব। তুমি আর দেরি করিও না।”

“আচ্ছা, আয় বাবা। তাড়াতাড়ি সন্ধে নামার আগে ফিরিস কিন্তু।”

সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে শুভম হেসে মাকে বলে, “যে তিলগুলো সকালে কুটে রেখেছ ওগুলো দিয়ে ক’টা নাড়ু করে রেখো তো। এসে খাব।”

স্যারের বাড়িতে আজও সদর দরজা খোলাই। যদিও আজ একটাও সাইকেল বাইরে রাখা নেই। তার মানে আজ বোধহয় কেউ পড়তে আসবে না। বা এলেও পরে আসবে। বিকেলের মরা আলোয় স্যারের বাড়িটা যেন অনেক পুরোনো কোনও সময়ের বাড়ি মনে হচ্ছে। বটগাছটার পাশে সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে শুভম বাড়ির ভেতর ঢুকল। আজ দালান চত্বর একদম ফাঁকা। কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে গোটা বাড়িটাই। শুভমের একটু যে গা ছমছম করছে না তা নয়। অথচ ওরা সবাই যখন এখানে পড়তে আসে, এই নীচটুকু পেরিয়ে উপরের ঘরে এসেই ওদের হাহা হোহো মজা-হাসি-ঠাট্টা। এ-ওকে ঘাড়ে রদ্দা মারছে, এ-ওকে ঘুষি মারছে, না-হলে নভনীল ছেলেটা বেশ গোবেচারা, সবাই মিলে ওর পিছনে লাগছে। এইসব আর কী। স্যার যতক্ষণ না পড়াতে আসছেন ততক্ষণই। একবার পরিমল-স্যার ঘরে ঢুকলে অবশ্য পিন ড্রপ সাইলেন্স। সবাই যে-যার খাতায় মনোযোগ।

স্যার নিশ্চয়ই আজও ওপরে নিজের ঘরেই রয়েছেন। দরজা খোলা যখন স্যার বাড়িতেই আছেন। শুভম একবার ভাবল স্যারের কাছে গিয়েই অনুরোধ করবে। স্যারের দাদা ওরকম ‘হবে না’ বলায় মনের মধ্যে যেন কীরকম করছে। কী হবে না? উনি কী বলতে চাইছিলেন? ফাঁকা ঠাকুরদালান সংলগ্ন নির্মল ভটচাজের ঘরের দিকে একবার তাকাল শুভম। দরজাটা ভেজানো। হয়তো ঘরের ভেতর নির্মলজেঠু বিশ্রাম নিচ্ছেন। চোখ সরিয়ে নিতে যাবে, এমন সময় মা কালীর মূর্তির হাতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে এমন একটা দৃশ্য শুভম দেখতে পেল যে ওর একেবারে ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। অজ্ঞান হতে হতে নিজেকে সামলে নিল ও। এত ভিতু তো ও নয়। তাছাড়া বিশালের সঙ্গে থাকতে থাকতে ওর মনও একটু একটু যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছে এখন। যে-কোনো কিছুর পেছনেই আছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই নেই। মা কালীর হাতে যে কাটা মুণ্ডু রয়েছে তা সাধারণত কোনও অসুরের বলেই ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছে ও। মা কালীর হাতে সেই মুণ্ডুর চুল ধরা রয়েছে। আর মুণ্ডুর চোখ দুটো ক্রমাগত খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। ঠিক যেন চোখ-বন্ধ পুতুল একটা। প্রথমে ভয় পেলেও পরে বেশ অবাক হল শুভম। ভালো করে দেখবে বলে ঠাকুরদালানে উঠে মুণ্ডুটার কাছে যেতেই কী একটা যেন ওই মুণ্ডুটার চুলের মধ্যে চকচক করছে দেখতে পেল। ঠিক যেখানে মা কালীর হাতে মুণ্ডুটার চুল ধরা আছে সেই জায়গায় ধাতব কিছু একটা চুলের সঙ্গে জড়িয়ে রাখা আছে। সেদিকে চোখ যেতেই ও ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। আর ঠিক এরকম সময় বাইরে কাদের পায়ের শব্দ শুনতে পেল। কারা যেন এই বাড়ির দিকেই আসছে। স্যারের ছাত্ররা? কিন্তু ওকে এভাবে ঠাকুরদালানে দেখতে পেলে সবাই স্যারকে বলে দেবে। বড়ো লজ্জার হবে তা। কী করবে? কোথায় লুকাবে স্থির করতে না পেরে ও তাড়াতাড়ি নির্মলজেঠুর ভেজানো দরজায় ধাক্কা দিল। দরজাটা খোলাই ছিল। ও ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে তো উনি নেই!

uponyas84 (6)

ওদিকে পায়ের শব্দগুলো খুব কাছে চলে এসেছে। এ কী? শব্দগুলো শুনে বুঝতে পেল কারা যেন ঠাকুরদালানে উঠে পড়েছে। অনেকগুলো পায়ের শব্দ। এই রে, ডাকাত পড়ল নাকি? স্যার কোথায়? জেঠুই-বা কোথায়? ঘরে তো কেউ নেই। যে-কোনো মুহূর্তে যারা ঠাকুরদালানে আছে তারা এই ঘরে চলে আসতে পারে। দরজায় কি হুড়কোটা লাগিয়ে দেবে? কিন্তু কেমন যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল ওই মুহূর্তে। কী করবে স্থির করতে না পেরে ওই ঘরে রাখা একটা চৌকির তলায় লুকিয়ে পড়ল। দুটো ইটের পায়া দিয়ে চৌকির তলা বেশ উঁচু করা। কয়েকটা ট্রাঙ্ক রাখা আছে চৌকির তলায়। তার মধ্যে ও একটুখানি জায়গা পেয়ে সিঁটিয়ে রইল। যারা এ-বাড়িতে এসেছে তারা ঘরের দরজা খুলে ঘরেও ঢুকেছে। কী যেন খুঁজছে। টেবিলে রাখা বইপত্তর ঘাঁটছে, এমনকি আলনার সমস্ত জামাকাপড় উলটেপালটে খুঁজছে। শুভম এবার বেশ ভয়ই পেয়ে গেল। এরা তো এখন চৌকির তলাও খুঁজবে। কী করবে ভাবতে ভাবতে খেয়াল করল ও যেখানে বসেছে সেখানে একটা গোল চাকতি মতো লোহার ঢাকনা। এরকম ঢাকনা সাধারণত ড্রেনের মুখে হয়। তাহলে এই ঘরের তলায় ড্রেন আছে?

আর সময় নেই। ওরা চৌকির ওপর থেকে একটা তক্তপোশ ছুড়ে নীচে ফেলল। বালিশের ঢাকনাগুলো খুলে ফেলছে। কী এত খুঁজছে ওরা? কারা? নির্ঘাত ডাকাত। না-হলে এত খোঁজে? এখন ওকে চৌকির তলায় পেলেই গলা কেটে ফেলবে নিশ্চিত। হঠাৎ মাথায় এল, এমনিও মরতেই হবে। একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। লোহার ঢাকনাটা খুলতে পারে যদি? কিন্তু ড্রেনের মধ্যে একবার ঢুকলে তো গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে পচে মরতে হবে। নিজেকে নিজের ওর মারতে ইচ্ছে করছিল। কেন যে স্যারের দাদার ‘হবে না’-র মানে খুঁজতে এখানে এল ও? কেনই-বা ঠাকুরদালানে উঠতে গেল? হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরার পরিবর্তে নিজের অজান্তেই লোহার ঢাকনাটাতে একটু চাপ দিয়ে ফেলল। আর যেই না চাপ দেওয়া, সঙ্গে সঙ্গে ঢাকনাটা একটা শাটারের মতো সরে গেল। আর ও সামনে একটা সিঁড়ি দেখতে পেল। ঘরে যারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের কথাও শুনতে পাচ্ছে ও।

“এবার চৌকির তলা থেকে ট্রাঙ্কগুলো বের করে দেখতে হবে।”

“হ্যাঁ। তার আগে দুটো ট্রাঙ্ক ওই আলনার পাশে রয়েছে, খুলতে পারছি না। শাবলটা দিয়ে একটা বাড়ি মার তো। ওটা ভেঙে দেখে নিই আগে।”

“কাজটা না করতে পারলে হাজতবাস কেউই রুখতে পারবে না কিন্তু।”

কথাগুলো কানে আসতেই শুভম আর সময় নষ্ট না করে সামনের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল। মাটির তলার গুপ্ত ঘর। অন্ধকার তো হবেই। তবে অব্যবহৃত নয় মনে হয় ঘরটা। যতটা ঠান্ডা আর স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটা হওয়া উচিত ততটা নয়। ওর মনে পড়ল পকেটে একটা দেশলাই কাঠির বাক্স আছে। ও তখনই একটা দেশলাই কাঠি জ্বালতেই ঘরটা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল। একটা লম্বা সরু টেবিলের ওপর একটা ছোট্ট স্টোভমতো রাখা আছে। মাটির তলায় স্টোভ? কয়েকটা কাচের জার। সেই জারগুলোর মধ্যে নানা রঙের তরল। আবার কয়েকটা ফাঁকা জারও রয়েছে। একটা জার আবার বেশ কয়েকটা ছোটো ছোটো পাতায় ভরা। স্টোভটার দিকে তাকিয়ে দেখল আরও একবার। এইবার ও চিনতে পারল, এটাই তো বুনসেন বার্নার! ওদের স্কুলের ল্যাবরেটরিতে আছে। আর এই বুনসেন বার্নারের পাশেই রাখা একটা বেশ বড়ো মাপের লাল ডায়েরি। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেল শুভম। ডায়েরিতে ঝুলছে একটা তালা। খুব ছোট্ট একটা তালা। কিন্তু ওজন আছে বেশ। হালকা নয়। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে তালাটা নেড়েচেড়ে দেখছে, এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল ও। আর বোধহয় শেষ রক্ষা হল না।

uponyas84 (3)

ভয়ে সিঁটিয়ে ঘরটার দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল ও। কিন্তু অদ্ভুত কাণ্ড হল তারপরই! দাঁড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গেই দেওয়ালটা ঘুরে গেল। আর ও নিজেও দেওয়ালের সঙ্গে সেই একই অভিমুখে ঘুরল।

দেওয়ালটা আসলে একটা ট্র্যাপ ডোর। এই দরজার বাইরেই একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা উপরের দিকে উঠে গেছে। আর চিন্তাভাবনা করার সময় ওর নেই। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল। উপরে উঠতেই ও একেবারে এসে পড়ল বটগাছটার সামনে। যেখানে সাইকেলটা রেখে ও এ-বাড়িতে ঢুকেছিল। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ও দৌড়ে গিয়ে সাইকেলে চড়ে বসল।

সেই চাবি লাগানো ডায়েরিটা রেখে আসার সময় পায়নি। ওর হাতেই ছিল ডায়েরিটা। এরকম একটা ডায়েরি ফেলে দিতে মন চাইছিল না। যদিও ডায়েরিটা ওর নয়। অন্যের জিনিস না বলে নেওয়ার মতো শিক্ষাও ওর নেই। কিন্তু ডায়েরিটা যদি ওখানে ফেলে আসে তাহলে ওই যারা নির্মলজেঠুর ঘর তছনছ করছে, যাদের ওর মোটেই ভালো মানুষ মনে হচ্ছে না, তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ডায়েরিটাকে ঠিক সাধারণ ডায়েরি তো মনে হয় না। তার চেয়ে এখন ওর কাছে রেখে পরে পরিমল-স্যার বা নির্মলজেঠুর হাতেই তুলে দেবে ভেবে ও ডায়েরিটাকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে রাখল। এবার খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে একেবারে বাড়িতে এসে তবেই থামল। এতক্ষণ ও নিশ্বাস নিয়েছে কি না তাও মনে করতে পারল না।

“কী রে? এত দেরি হল কেন? কোথায় গিয়েছিলি? আর এই শীতের সন্ধেয় এরকম ঘামছিসই-বা কেন?”

মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতাই ওর আর নেই। খুব ভালো করে দম নিল ও। তারপর কোনোমতে মাকে বলল, “একটু জল দাও তো।”

“হ্যাঁ, দিচ্ছি। কিন্তু তিলের নাড়ু আজ বানাতে পারিনি। কাল বানিয়ে দেব। আজ কমলাদের বাড়িতে পূর্ণিমার কীর্তনে গিয়েছিলাম। তুই আসবি বলে তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এই নে, প্রসাদ খা।”

একটা বাটিতে দুধ-ঘি-মধু-চাল-কলা মাখা প্রসাদ শুভমের সামনে রেখে ওর মা বললেন, “নে, তোর জন্য মধুপর্ক নিয়ে এসেছি। তুই যে এটা খেতে ভালোবাসিস তা আমি জানি।”

শুভমের আজ কোনও কথা বলার মন নেই।

ওর মা রান্নাঘরে গেলেন ওর বাবার জন্য চা করতে।

শুভম আর ওর বাবার জন্য চা নিয়ে এসে দীপশিখা দেখলেন, প্রসাদের বাটিটা যেমন রেখে গেছিলেন তেমনই আছে। ছেলে ছুঁয়েও দেখেনি। অবাক হলেন খুবই। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মনে হল ওঁর। তাড়াতাড়ি কাপ দুটো নামিয়ে ছেলের কপালে হাত ছোঁয়ালেন।—“এ কি! গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। শিগগির থার্মোমিটারটা দাও তো।”

বাবা আর মা দুজনেই চিন্তিত মুখে ওর মাথার কাছে বসে রইলেন। বাবা থার্মোমিটারখানা চোখের সামনে ভালো করে ধরে খুব গম্ভীর মুখে বললেন, “একশো দুই ছুঁয়েছে।”

“সর্বনাশ! আমি না করলুম, আজ বেরোস না বাবা, তা শুনবে কেন আমার কথা?”

“সে কি? এই পরীক্ষার আগে আবার কোথায় গিয়েছিল? খেলতে?”

শুভম কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। দীপশিখাই স্বামীকে উত্তর দিলেন, “না। খেলতে নয়। পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে।”

“আমি বলেছিলাম। দীপক এসে পড়িয়ে যাচ্ছে, তা তোমরা যদি আমার কোনও কথা শুনবে!” উদ্বেগ আর অভিমান দুই মিশে আছে শুভমের বাবার গলায়।

বাবা-মার এইসব কথোপকথন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল শুভম। ঘুমের মধ্যে ও অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল। একটা কাচের জারে অসংখ্য পাতা। আর সেই জারের ঢাকনাটা ও খুলতেই পাতাগুলো সব কেমন যেন নিজে-নিজেই বেরোতে থাকল। হকচকিয়ে গেল শুভম। একটু সরে দাঁড়াল ও। আর অসংখ্য পাতা একের পর এক বেরোতেই লাগল। তারপর সেই পাতাগুলো একটা ছোটো ছেলের মতো আকার নিল। ছেলেটার শুধুমাত্র চোখ দেখতে পেল ও। ছেলেটার সারা শরীর পাতায় ঢাকা। ছেলেটা ওকে বলছে, ‘শুভম, চাবিটা কি তুমি খুঁজে পেয়েছ?’

uponyas84 (4)

ছয়

স্কুল ছুটি বলে পরিমল-স্যার এখন সকালেই পড়ান। সেদিন ছুটি হতে প্রায় বারোটা বেজে গেল। বিশাল ভেবেছিল শুভমের বাড়ি যাবে। পরে ভাবল, ধুর! শুভম আমার বন্ধু নাকি? ক্লাসে পাশে বসলেই কি বন্ধু হওয়া যায়?

শুভম ওকে খুবই সমীহ করে, ওর সবকথা শোনেও। সে তো ও পড়াশোনায় ভালো বলে ক্লাসের অনেকেই ওকে সমীহ করে। কিন্তু ক্লাসের সবাই কি ওর বন্ধু? সেই অর্থে বিশালের বন্ধু বিশেষ নেই। এই সোনাডাঙায় এমন একজনও নেই যে ওর বন্ধু। না স্কুলে, না কোচিংয়ে, না ওর পাড়ায়। কিন্তু তা বলে শুভমকে ও কী করে বন্ধু ভাবে? ওর বন্ধু হতে গেলে পড়াশোনায় ভালো হতে হবে তার কোনও মানে নেই। কিন্তু শুভমকে এমন অদ্ভুত অযৌক্তিক কিছু কথা বলতে শুনে ও একবার খুব রেগে বলেছিল, ‘তুই এখনও এসব বিশ্বাস করিস? পৃথিবীতে বিজ্ঞানই শেষ কথা। বিজ্ঞান সবকিছু জয় করেছে।’

সাধারণত শুভম ওর সবকথা মেনেই নেয়। কিন্তু সেদিন অদ্ভুত একটা উত্তর দিয়েছিল যার কোনও প্রতি-উত্তর ও দিতে পারেনি।

“বিজ্ঞান আবার অনেক কিছু ধ্বংসও করে।”

“তাই বলে তোর সব গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করতে হবে? সাদাকে লাল দেখতে হবে? আর তুই সত্যিই সাদা ঘাস দেখিস? সারা পৃথিবীর কোথাওই সাদা ঘাস নেই। ঘাসমাত্রই সবুজ।”

“হ্যাঁ। তুই ঠিক বলেছিস। ঘাস মাত্রই সবুজ। কিন্তু শরৎকালে যখন থোকা থোকা কাশফুল ফুটে থাকে তখন মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় না একগোছা সাদা ঘাস যেন হাওয়ায় দুলছে!”

“উফ্‌, অদ্ভুত সব কথা তোর। কাশফুলকে সাদা ঘাস ভাবতে যাব কেন খামোকা?”

“সে তো আমরা সবাই জানি ক্রিসমাসের আগের রাতে মোজার ভেতর চকলেটটা বাবাই রাখে। সান্তাক্লস বলে কিছুই হয় না। কিন্তু যেদিন থেকে সান্তাক্লসের সত্যিটা জানলাম ও বিশ্বাস করতে আরম্ভ করলাম সেদিন থেকে একটা আনন্দ থেকেও কি বঞ্চিত হলাম না? চকলেট পাওয়ার আনন্দ নয়। আকাশ থেকে এক সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো এসে চকোলেট দিয়ে যায়, এই মজাটাই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল। এই হারিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা কীভাবে তুই বিজ্ঞান দিয়ে দিবি?”

“তাহলে মজা পেতে গেলে তো সারাজীবন বিজ্ঞান আর লজিককে দূরে ঠেলে ফেলে দিতে হয়। আর কল্পনা রাজ্যে গা ভাসিয়ে দিলেই হবে? শুধু মজা আর মজা?”

“বাহ্‌! এইটা দারুণ বললি। মন্দ হয় না কিন্তু তাহলে। শুধু মজা আর মজা।”

বিশাল যে আগের কথাটা রেগে গিয়ে বলেছে সেটুকুও বুঝতে পারেনি শুভম? কী করে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে?

এইসব ভাবতে ভাবতে বিশাল কখন যে মাঠ পেরিয়ে চন্দ্রকোনায় ঢুকে পড়েছে নিজেই খেয়াল করেনি। শুভমের বাড়ি কি ও চিনতে পারবে? শুভমের বাবার নাম একবার বলেছিল। কী যেন নাম ওঁর? গণেন্দ্রনাথ মুখার্জী। মনে পড়ল ওর।

গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা বেশ মনোরম গ্রাম। ছবির মতো একটা পুকুর। তার পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা। আগে ওদের সোনাডাঙাও এরকমই সুন্দর ছিল। এখন শুধুই ফাঁকা জমি, পুকুর বুজিয়ে বাড়ি আর বাড়ি। ফ্ল্যাটও উঠছে কয়েকটা। সব বড়ো বড়ো প্রজেক্ট। হাই রাইজার, কমপ্লেক্স ওদের সোনাডাঙাতেও হবে এবার।

সাইকেলে করে কিছুটা এগিয়ে যেতেই ওর পাশ দিয়ে একটা লোক ঝুড়িভরতি ডিম নিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেল। লোকটাকে জিজ্ঞেস করবে ভেবে সাইকেলটা থামাল ও। কিন্তু লোকটা এমন হনহন করে এগিয়ে গেল যে আর ডাকা হল না। সাইকেল দ্রুত চালিয়ে লোকটার কাছে আবার গিয়ে জিজ্ঞেস করবে ভেবে প্যাডেলে চাপ দিল। কিন্তু ও যত জোরেই এগোয়, লোকটা যেন আরও অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছে ওর থেকে। খুব অবাক হল ও। সাইকেলের থেকেও এত দ্রুত কেউ হাঁটতে পারে? কিন্তু গ্রামের মানুষেরা বোধহয় পারে। তাছাড়া লোকটার পেছনে ছুটতে গিয়ে গ্রামটাকে ভালো করে দেখাই হচ্ছে না। তার চেয়ে ধীরে ধীরে এগোতেই ভালো লাগল ওর। না-হয় অন্য কাউকেই জিজ্ঞেস করে নেবে শুভমের বাড়ির রাস্তা। সাইকেলের গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল ও। কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা মুদি দোকান দেখতে পেল। সেখানে গিয়ে শুভমের বাবার নাম করতেই দোকানি এক বস্তা লাল মুড়ি ওজন করতে করতে পথনির্দেশ বলে দিলেন। সেই অনুযায়ী এগোতে এগোতে শুভম কাঁটাপুকুর, আনন্দম প্রাথমিক বিদ্যালয়, পদ্মমণির মাঠ পেরিয়ে হারান মোদকের মিষ্টির দোকানের সামনে এসে থামল। এখান থেকে বাঁদিকে যেতে হবে আরও আধমাইল প্রায়। একটা ছোটো পুলও পেরোতে হবে। তারপর আরও কিছুটা সোজা গেলে শুভমদের বাড়ি।

হরি মোদক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ডানদিকের রাস্তাটা কাঁচা। এত বড়ো বড়ো গাছ যেন জড়াজড়ি করে রয়েছে সেই পথে। এই দিনের বেলাতেও কেরকম অন্ধকার লাগছে। মুদি দোকানের লোকটা বলে দিয়েছিল—“খবরদার! ওই ডানদিকের রাস্তায় মোটেও যাবে না খোকা। ওটা বাঁশবাগানের রাস্তা। দিনের বেলাতেও ও-পথ ভালো নয়।”

uponyas84 (5)

এই গ্রামে ঢোকার মুখে যে লোকটাকে এক ঝুড়ি ডিম নিয়ে হনহন করে চলে যেতে দেখেছিল, সেই লোকটাই এখন মিষ্টির দোকানের সামনের একটা বেঞ্চিতে বসে একটা শালপাতার ঠোঙায় রেখে কয়েকটা নিকুতি খাচ্ছে। দেখে মন হয় নিকুতিগুলো গরম। সদ্য ভেজেছে। নীচে ঝুড়ির মধ্যে ডিমগুলো রাখা আছে। বিশাল দেখে বুঝল এগুলো সব হাঁসের ডিম। সেই কখন বেরিয়েছে সকালে। খুব খিদে পেয়ে গেল। এখনও আরও কতটা গিয়ে তবে শুভমের বাড়ি।

“খোকা, কী নাম? গণেনদার বাড়ি যাচ্ছ বুঝি?”

চমকে উঠল বিশাল। লোকটা কী করে জানল? লোকটা তো ছিল না ওই মুদি দোকানে।

“না না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ছোটো জায়গা, এখানে আমরা সবাই সবার কথা জানি। এমনকি মনও পড়তে পারি।”

“মন পড়তে পারেন? থট রিডিং? আশ্চর্য!”

“বিশ্বাস হচ্ছে না তো? তোমাকে দেখেই এখন আমি বলতে পারব যে তোমার খুব খিদে পেয়েছে। ঠিক বলছি?”

বিশাল অবাক হল খুব প্রথমে। আবার ভাবল, ওর মুখ দেখে হয়তো ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত লাগছে তাই বলতে পারলেন। সত্যিটা ও বলল না।—“না। খিদে পায়নি। আমার একটু তাড়া আছে। আমি এগোলাম।”

“আচ্ছা, বেশ। তোমার নামটা কী বললে না তো বাবা?”

“বিশাল। আমি সোনাডাঙা উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস টেনের ছাত্র। এবার মাধ্যমিক দেব। শুভম আমার স্কুলে পড়ে।”

“ও, তোমার বন্ধু শুভম?”

“না না, আমরা এক স্কুলে পড়ি। বন্ধু নয়। কিন্তু আপনি আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি তো আমাকে শুভমের বাড়ির রাস্তাটাও বলে দেননি।”

“হে হে। সে আমার তখন একটু তাড়া ছিল। তা তুমি একটু যদি দাঁড়াও তো আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি। আমি ওইদিকেই যাব কিনা। ক’টা গরম নিকুতি খাবে খোকা?”

ওর নামটা জেনেও খোকা বলে ডাকছে। আর যখন প্রয়োজন ছিল প্রশ্নটা না শুনেই চলে গেলেন আর এখন এমন যেচে এত কথা বলা ও মিষ্টি খাওয়ার অনুরোধ বিশালের কেমন যেন সন্দেহ হল। যদিও লোকটাকে এত নিরীহ দেখতে যে সন্দেহ হওয়ার কোনও কারণই নেই।

“না। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি এগোই। আপনি খেয়ে নিন। ধীরেসুস্থে আসুন। আমার সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। বেশি দেরি করতে পারব না। বাড়ি ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।”

বিশাল আর উত্তরের অপেক্ষা না করেই সাইকেলে চেপে দ্রুত শুভমের বাড়ির দিকে চলে গেল। যেতে যেতে ও শুনতে পেল লোকটা ওকে বলছে, “ঠিক আছে, সাবধানে ফিরো। ফেরার সময় এই বাঁশবাগানের সামনে দিয়ে সাবধানে এসো কিন্তু।”

সাত

রোগী দেখতে দেখতে নার্সকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন মশাপুর মহকুমা হাসপাতালের ডাক্তার নীলকান্ত রায়। নার্স মধুরিমাদেবী ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী থার্মোমিটার রোগীর মুখে পুরে জ্বর মাপছিলেন। তারপর বিছানায় শোওয়া সেই রোগী, ডাক্তার নীলকান্ত রায়, হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডভরতি রোগী ও তাদের বাড়ির লোকেদের ভিড়ের মধ্যেই মধুরিমাদেবী অদৃশ্য হয়ে গেলেন। থার্মোমিটার, ওঁর পেন, রোগীর ফাইল সব রাখা রয়েছে। শুধু উনিই ওই জায়গা থেকে অদ্ভুতভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।

একদম না থেমেই গণেন্দ্রবাবু খবরটা পড়লেন। জ্বর একটু কম হলেও শুভম আজও বেশ দুর্বল। বিশাল ওদের বাড়ি আসায় ভালোই লাগছে শুভমের। বকফুলের বড়া ধনেপাতার চাটনিতে ডুবিয়ে এক কামড় দিয়ে বিশাল বলল, “কাকু, এরকমই একটা খবর ক’দিন আগেই পড়েছিলাম। সেও আমাদের এদিকেই কোথায় যেন। বাস-স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিল দুই বন্ধু। কথা বলতে বলতে দুজনে বাসেও ওঠে। তারপর টিকিট কাটতে গিয়ে একজন দেখে আর-একজন পাশে নেই। হয়তো কথা বলতে-বলতেই নেমে গেছে, এইভেবে দ্বিতীয়জন বাড়ি চলে যায়। কিন্তু বন্ধুটা বাড়ি ফেরেনি। কোথাও তার কোনও খবরও পাওয়া যায়নি। এই খবরটা আমার সাধারণ নিরুদ্দেশ মনে হলেও একটু যেন কেমন কেমন লেগেছে। বাস থেকে নিখোঁজ? হঠাৎ কি চেনা কেউ ডেকে নিয়ে গেল বা কোথাও প্রয়োজনে নেমে পড়েছিল ছেলেটা? কিন্তু পাশের জন কি এতই মোবাইলে ব্যস্ত ছিল যে জানতেও পারল না বন্ধু কখন নেমে গেছে?”

কথাটা বলেই বিশাল খুব লজ্জা পেল। শুভম ওর বাড়িতে যেদিন সাজেশন পেপারটা নিয়ে এসেছিল, সেদিন ওই সাজেশনটা পেয়েই ও যে শুভমের সঙ্গে একটাও কথা না বলে একছুটে আলোটা আনতে গেল। আর আলো নিয়ে ঘরে আসার পর শুভম যে ঘরে নেই তা তখন ওর একবারও খেয়াল হয়নি। শুভম সেই ঝড়জলের মধ্যে কখন কীভাবে বাড়ি গেল?

কতগুলো গরম বকফুল ভাজা আর বেশ মোটা গরম দুটো ডিমের মামলেট একটা প্লেটে বিশালের সামনে নামিয়ে শুভমের মা বললেন, “অদৃশ্য হওয়ার কথা আর বোলো না তো! কাল বিকেল থেকে একটা হাঁসও আমার ঘরে ফেরেনি।”

“সে কি! আমার ছোটোপুঁটি, বড়োপুঁটি?” শুভমের মুখটা কালো হয়ে গেল যন্ত্রণায়।

“না রে। একটাও ঘরে ফেরেনি। প্রতিদিনকার মতো ওই চানকিদের পুকুরে গেঁড়ি-গুগলি খাচ্ছিল। ওখানেই শেষবার আমি ওদের দেখেছি। এত মনখারাপ লাগছে। কোত্থাও খুঁজে পেলাম না। অতগুলো হাঁস আমাদের!”

কিছুটা উদ্বেগ ও অনেকটা বিষাদ লেগে রয়েছে দীপশিখার কথায়। উপস্থিত সবার মনখারাপ হয়ে গেল। বিশালেরও কেমন যেন মনখারাপ লাগল। ও যদিও হাঁসগুলোকে দেখেইনি কখনও।

শুভমের মা বিশালের দিকে ঘুরে বললেন, “তুমি খাও বাবা। দুটো ভাত খেয়ে যেও এখানেই।”

“না না, বাড়িতে বলে আসিনি। সকালে পড়তে বেরিয়েছি। এমনিই দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে চিন্তা করবে খুব। আমি আসি কাকিমা।”

“তাহলে তো সত্যি দেরি করা উচিত নয় আর। তুমি সাবধানে এসো বাবা। তোমার বাড়িতে হয়তো চিন্তা করছে। পরীক্ষার পর আবার এসো একবার। বাড়িতে বলে এসো তখন।” শুভমের বাবা যুক্তিযুক্ত কথাই বলেছেন।

বিশাল আর দেরি করল না। বাড়ির পথে রওনা দিল।

কাঠের পুলটা পেরোবার সময় কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর। কেউ যেন ওর ওপর নজর রাখছে। পেছন পেছন আসছে ওর। একবার পেছন ফিরে তাকাল। কেউ কি সত্যিই আসছে ওর পেছনে?

নাহ্‌, কেউ তো নেই। তবুও মনে হচ্ছে কেউ যেন আসছে। এইভাবেই পুলটা পার হল ও। তারপর পদ্মমণির মাঠে এসেও সেই একই অস্বস্তি। ডিমের ঝুড়ি নিয়ে যে লোকটা মিষ্টি খাচ্ছিল সে নয় তো? খুব রেগে গেল এবার ও। পিছন ফিরে বললে, “আমি কিন্তু জানি আপনি কেন আমার পিছু নিয়েছেন।”

আন্দাজেই বলল কথাটা। একটা লম্বা তেঁতুলগাছের পেছন থেকে বেরিয়ে এল একটা বাচ্চা। সমস্ত গায়ে তার পাতার পোশাক। জামাকাপড়ের অভাবে বা অতিরিক্ত গরমে অনেকেই খালি গায়ে থাকে। কিন্তু এরকম অদ্ভুত পাতার পোশাকে কাউকে দেখেনি ও। এই শীতে এরকম অদ্ভুত পোশাক ওকে আশ্চর্য করল খুব।—“কে তুমি? আমার পিছু নিয়েছ কেন? আর এরকম অদ্ভুত পোশাকই-বা পরেছ কেন?”

পাতার আড়াল থেকে এবার ছেলেটা কথা বলল।—“তোমার সঙ্গে বেশ কিছু জরুরি কথা আছে আমার। এই বেলা বলে নিই।”

গলার স্বর শুনে বুঝতে পারল যার সঙ্গে কথা বলল, সে বাচ্চা নয়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের গলা।

“কে আপনি? আমি তো চিনি না আপনাকে।”

“কেই-বা কাকে চেনে? কিন্তু একসঙ্গে থাকতে থাকতে সবাই সবাইকে চিনে নেয়। চিনে নিতে হয়। এই যেমন শুভম যদি তোমার স্কুলে না পড়ত, তাহলে কি তুমি ওকে চিনতে? আবার যেমন ধরো ক্লাসে তোমার পাশে যদি ও না বসত? তাহলে কি এতটা বন্ধু হতে ওর?”

“বন্ধু? কিন্তু ও তো আমার ঠিক বন্ধু নয়।”

“নিশ্চয়ই বন্ধু। না-হলে তুমি ওর বাড়িতে এতদূর আসো?”

“সে তো ও সেদিন যে রসিকতাটা আমার সঙ্গে করেছিল তার একটা জবাব দিতে আজ ওর বাড়ি এসেছিলাম।”

“তাহলে সেদিনের কথা একবারও বললে না কেন?”

“না, বলিনি। ওর এরকম জ্বর। তার ওপর ওদের হাঁসগুলো সব কোথায় হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে আমি আবার আঘাত করে কথা বলব ওকে?”

“দেখলে তো! তাহলেই বোঝো। শুভম তোমার বন্ধু বলেই না তুমি ওর জন্য এত ভাবছ?”

“না, ঠিক তা নয়।” নিজের মধ্যেই সংশয় হয় বিশালের। তাই বলে, “হবে হয়তো। কিন্তু আপনি কে? আপনি এত কথা জানলেনই-বা কী করে?”

“সব জানবে তুমি। তার আগে বলো তো তোমার বন্ধু তোমাকে কোনও চাবি দিয়েছে?”

“চাবি? না তো। আর দিলেই-বা আপনাকে বলব কেন?”

“ওই চাবিগুলো না পেলে হাঁসগুলো শুভমরা ফেরত পাবে না যে।”

“আশ্চর্য! চাবি, হাঁস… আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“সে কি? তুমি তো ক্লাসের সেরা ছাত্র। তা পড়াশোনায় শুধু ভালো হলে হয়? এত সোজা একটা অঙ্ক তুমি বুঝতে পারছ না?”

বিশাল এবার খুব রেগে যায়। অঙ্ক নিয়ে ওকে কেউ কিছু বললে একদম সহ্য করতে পারে না। ক্লাসে অঙ্কে ও সেরা ছাত্র। একটু রেগেই ও বলল, “এর মধ্যে অঙ্কের কী আছে? কোনও চাবির কথা আমাকে কেউ বলেনি।”

“তা বেশ। বলেনি যখন, চলো একসঙ্গে চাবির খোঁজ করি।”

“না না, আমার সময় হবে না একদমই। আমি বাড়ি যাব। মা ভাবছে নিশ্চয়ই।”

“আমাদেরও তো ফিরতে হবে। আমাদের জন্যও আমাদের প্রিয়জনরা সবাই অপেক্ষা করছে। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে?”

এইবার বিশাল খুব অবাক হল। অনেক অদ্ভুতুড়ে কথাই শুভমের কাছে শুনেছে ও। কিন্তু এই লোকটার কথার মাথামুণ্ডু ঘিলু কিচ্ছু বুঝতে পারল না আজ। কথা বলতে বলতে ও খেয়াল করল, যে তেঁতুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ওরা কথা বলছিল সেখানে ওরা নেই। উঁচু উঁচু ঘন গাছপালায় ঘেরা এ কোন জায়গা? আসার সময় তো এই রাস্তা দিয়ে আসেনি ও! উঁচু গাছগুলো এমনভাবে গায়ে গায়ে রয়েছে যে পাতার ফাঁক দিয়ে একটুও আলো এসে পৌঁছচ্ছে না।

আট

আজ শুভমের জ্বরটা আসেনি। কাল সারাদিনও জ্বর ছিল না। আরও একদিন দেখে মা ভাত দেবে বলেছে। বাবা অবশ্য অনেকবার বলেছে, ‘এখন ডাক্তার জ্বর হলে ভাত বন্ধ করতে বলে না। তাছাড়া রক্ত পরীক্ষায় যখন খারাপ কিছু আসেনি ওকে দুটো ভাত একবেলা অন্তত দিও।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা? আজও দুটো হাত রুটি দিয়েছে মা। শুভম দুধের বাটিতে রুটি চুবিয়ে খাচ্ছে। যদিও খুব একটা রুচি নেই খাওয়ায়। কিন্তু ওষুধগুলো বেশ কড়া। খালি পেটে খেলে চলবে না। আর-এক গরাস মুখে দিয়েছে আর কে যেন বাড়ির সামনে হাঁক দিচ্ছে—“হাঁসের ডিম নেবে মা? সাত টাকা পিস।”

হাঁসের ডিম শুনে খুব মনখারাপ হয়ে গেল ওর। অতগুলো হাঁস ওদের! আর ছোটোপুঁটি বড়োপুঁটি তো ওর প্রাণ। সে-বার পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ও তো ওদের প্রণাম করেও গিয়েছিল। ওদের বাড়িতে ডাব পাড়তে আসে ভোলা সেই দেখে হেসে কুটোপাটি। তা ভোলা যতই হাসুক, হাঁস হল গিয়ে মা সরস্বতীর বাহন।

“এই খোকা, হাঁসের ডিম নেবে?”

জানালা থেকে কথাগুলো বলছে কেউ। শুভম জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল একটা লোকের মাথায় মস্ত ঝুড়ি। সে ঝুড়িটা মাথায় নিয়েই হাঁক দিচ্ছে। শুভম জানলার দিকে তাকাতেই শুভমের সঙ্গে চোখাচোখি হল লোকটার। হাতের ইশারায় শুভমকে ডাকল লোকটা। হাতের রুটিটা মুখে পুরে শুভম জানালার কাছে গেল। লোকটা ফিসফিস করে বলল, “চাবিটা দাও।”

হকচকিয়ে গেল শুভম। চোর না ডাকাত, চাবি চাইছে? চিৎকার করে মাকে ডাকতে যাবে, তার আগেই লোকটা বলল, “চিৎকার কোরো না। তোমাদের বাড়ির হাঁসেরাই শুধু গায়েব হয়নি, তোমার বন্ধু বিশালও গায়েব।”

কথাটা শুনে শুভম যেন কিছুক্ষণের জন্য চুপ মেরে গেল। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হল না ওর। ‘বিশাল গায়েব’ এই কথাটা মাথার ভেতর ঢুকতেও যেন সময় লাগল। এই তো দু-দিন আগেই বিশাল ওদের বাড়ি এসে মায়ের কাছে ওর জ্বর সারছে না শুনে বলেছিল, “রক্ত পরীক্ষা করিয়েছেন?”

জ্বরক্লান্ত শরীরে ও বেশি কথা বলতে পারেনি সেদিন। মা উত্তর দিয়েছিল—“সব টেস্ট হয়েছে। কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।”

শুভমের ইচ্ছা করছিল বিশালকে একটা গল্প বলে—আমাদের পাড়ায় শান্তিদাদু ভুড়িপুকুরে ডুব দিয়ে নাকি তিনদিন জলের মধ্যে ছিল। তারপর একটা সোনার লাঠি পেয়েছিল। ওই লাঠি দাদু যাকে একবার ছুঁয়ে দিত সে তক্ষুনি সুস্থ হয়ে উঠত। কত অসুখ যে সারিয়েছে এভাবে! দাদু মারা যাওয়ার পর পুষ্পপিসি চোখের জল মুছতে মুছতে বলছিল এই কথাগুলো। অবশ্য ওখানে উপস্থিত কেউ কেউ বলেছিল, পুষ্পটার মাথার ব্যামোটা আবার বেড়েছে।

ও কিন্তু বিশ্বাস করেছিল। ওরকম কোনও লাঠির ছোঁয়া পেলে ওর জ্বরও সেরে যেত। আর রক্ত পরীক্ষা করতে হত না। বিশালকে কথাগুলো বললে বিশ্বাস করবে না। তবুও এই গল্পটা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। অনেক কিছুই খুব সহজে বিশ্বাস করে শুভম, কিন্তু ‘বিশাল গায়েব’ কথাটা এবার বিশ্বাস করল না ও।

“মিথ্যে কথা। আমি এখুনি মাকে ডাকছি। কে আপনি? আমাদের পাড়ায় আগে দেখিনি তো!”

তারপর মা মা বলে চিৎকার করতেই লোকটা একছুটে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু যাওয়ার আগে বলে গেল, “বিশ্বাস না হয় আজকের খবরের কাগজটাই খুলে দেখো না।”

অবাক হওয়ার তখনও বাকি ছিল শুভমের। খবরের কাগজের পাতা খোলার আগেই বাড়িতে দুজন পুলিশ ও তাদের সঙ্গে যিনি এলেন বিশালের মুখের সঙ্গে বেশ মিল তাঁর। মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন ওঁরা। শুভম গিয়ে দাঁড়াল ওখানে। মা বলল, “কী আশ্চর্য! এও হতে পারে?”

বিশালের মতো দেখতে যিনি তিনি শুভমের দিকে তাকিয়ে ভেঙে পড়লেন।—“আমি বিশালের বাবা। ঠিক করে বলো তো বাবা, বিশাল কেন এসেছিল তোমার বাড়ি? এই এত দূর উজিয়ে ছেলেটা এল কেন? আর এলই যখন কোথায় গেল? ফিরল না কেন?”

শুভম উত্তর দেবে কী করে? খবরটা সত্যি শুনে ওর হাত-পা সমস্ত কাঁপতে শুরু করেছে। এমনিতেই দুর্বল শরীর ওর। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।

একজন পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, “শুনে যদি তোমার এই অবস্থা হয় তাহলে ওঁদের কী হচ্ছে বুঝতে পারছ তো? একটা ওরকম টগবগে ছেলে গেলই-বা কোথায়? তোমাকে যা জিজ্ঞেস করব সব ঠিক করে উত্তর দাও। কেমন?”

শুভম মাথা নাড়ল। ওর মা বললেন, “সে না-হয় উত্তর দেবে ও। কিন্তু আমাদের এখানে এসে আপনার ছেলে বিশেষ কিছু বলেনি তো! আমার ছেলেটা তো তখন জ্বরের ঘোরে কাহিল। এই দু-দিন হল ছেলেটা একটু উঠে বসছে। আমি আর ওর বাবাই তো কথা বললাম বিশালের সঙ্গে।”

পুলিশ অফিসারটি বললেন, “ঠিক আছে, বুঝলাম। কিন্তু এরকম হঠাৎ ও কেন এখানে এল তার তো কোনও কারণ থাকতে পারে। শুভম কি জানে না?”

শুভম কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। গলার কাছটায় একটা কান্না জমে আছে। বিশাল কেন এসেছিল সত্যিই তো ও জানে না।

“এই যে খোকা, কী যেন নাম তোমার?” খুব নরম করে পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।

“শুভম।” শুভমের মা উত্তর দিলেন।

“তা শুভম, ঠিক করে মনে করে বলো তো তোমার সঙ্গে বিশালের কি কোনও ঝগড়া মনোমালিন্য হয়েছিল?”

শুভম কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। টেস্টের পরীক্ষার সময় একবার মাত্রই দেখা হয়েছিল বিশালের সঙ্গে। কোনোমতে প্রথম দুটো পরীক্ষা জ্বর নিয়েই দিতে এসেছিল। ওকে দেখামাত্র বিশাল কী অসম্ভব রেগে গেল! সাজেশনের নামে পুরো সিলেবাস প্রশ্নের আকারে দিয়ে কেন রসিকতা করতে এসেছিল ও? কথাটা কি ওদের বলবে? এই রেগে যাওয়ার সঙ্গে বিশাল হারিয়ে যাওয়ার কি কোনও সম্পর্ক আছে? বিশাল হারিয়ে গেছে মনে হওয়াতে মনটা কেমন হু হু করে উঠল। কেঁদে ফেলল ও।

ওকে কাঁদতে দেখে বিশালের বাবাও ভেঙে পড়লেন।—“বাবা, ওর মা ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তুমি যেটুকু জানো সবটা খুলে বলো। হারিয়ে যাওয়ার আগে ও কেন এখানে এসেছিল?”

শুভম তো কিছুই জানে না। শুধু মনে পড়ল, বিশাল বলেছিল, ‘এসেছিলাম তোর সঙ্গে ঝগড়া করতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোকে ধন্যবাদ দেওয়াই উচিত। তুই অমনভাবে পুরো সিলেবাসটা প্রশ্নের আকারে না আনলে তো আমার এবারের পরীক্ষা ভালো হতই না। কেন জানি না মন বসাতেই পারছিলাম না।’ বিশাল আরও বলেছিল, ‘আরও একটা কারণে ধন্যবাদ তোকে। তোর বাড়ি আসতে গিয়ে এমন সুন্দর একটা ছবির মতো গ্রাম দেখলাম। মাঝে মাঝে আসব। পরীক্ষা শেষ হলে জমিয়ে একটা পিকনিক হোক এখানে।’

খুবই অল্প সময়ের জন্য বিশাল ছিল, কিন্তু ওইটুকু সময় যেন ওদের বাড়িতে একটা অদ্ভুত আনন্দের রেশ বয়ে যাচ্ছিল। জ্বরের ঘোরে থাকলেও আর-একটু গল্প করতে ইচ্ছে করছিল ওর। বাবা-মা দুজনেই সামনে থাকায় ওরা মোবাইল গেম নিয়েও কোনও কথা বলতে পারেনি সেদিন। শুভম নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।

যে পুলিশ অফিসারটা ওকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলেন, তাঁকেই ও বলল, “কাকু, যেভাবেই হোক বিশালকে বাড়ি ফিরিয়ে আনুন। যেভাবেই হোক।”

নয়

“ক্যাপ্টেন, ভেঙে পড়বেন না। কিছু একটা উপায় ঠিক হবে।”

“আর কী উপায় হবে বলতে পারো? হয় জেল নয় মৃত্যু।”

“এত মারলাম তবুও কোনও কথা বলানো গেল না? কোডটা কি সত্যিই পার্মানেন্টলি ডিলিট হয়ে গেছে?”

“আমি বিশ্বাস করি না। নাসার রিসার্চ সেলের পাঁচজন বিজ্ঞানী একসঙ্গেই একটা কোড পার্মানেন্টলি হারিয়ে ফেলবে তা হয় না। কিন্তু এক এক করে সবাই মরেছে। এখন একেও মেরে ফেলতে বাকি রাখছি না। কিন্তু এরপর? আমাদের মতো মানুষের সাধ্য কি ওই কোডটা ভেঙে ফেলে?”

“তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও নোটপ্যাডখানা পেলাম না। রাশিয়ান মাফিয়ারা কি আমাদের ছাড়বে?”

“না। টাকা না পেলে পাতাল ফুঁড়েও খুঁজে বার করবে আমাদের। আর দেখামাত্রই গুলি চালাবে। কোনও কথা বলার সুযোগ দেবে না।”

“এটাই তো ওদের নিয়ম। এবার খুব বড়ো রিস্ক হয়ে গেল আমাদের।”

“প্রতিবারই এইরকম ঝুঁকি নিয়েই এগোই আমি। কিন্তু এরকম অসফল কখনও হইনি। আমাকে একটু একা থাকতে দাও মার্ক।”

মার্ক চলে গেল। ক্যাপ্টেন একা বারান্দায় বসে রইল। বাড়িটার সামনের রাস্তা পলাশ ফুলে ঢাকা। সেদিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন নিজের মনে বলল, ‘ডায়েরির রঙটা ছিল লাল। ডায়েরিটা ঘরে নেই। তাহলে কে ডায়েরিটা নিয়েছে? প্রফেসর নিজেই কি ডায়েরিটা সরিয়েছেন কোথাও?’

কথাটা ভাবতে ভাবতে ক্যাপ্টেন ভেতরে যে-ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একজন বন্দি আছে সেই ঘরের দিকে তাকাল। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তৎক্ষণাৎ ঘরে গিয়ে লোকটার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল।—“মি. ভট্টাচার্য, আমার একটা প্রস্তাব আছে আপনার কাছে।”

কথা শেষ না হতেই নাকে এসে পড়ল এক ঘুসি। কিন্তু ওই এক ঘুসিতে ক্যাপ্টেনের মতো দুর্ধর্ষ ফাইটারকে ঘায়েল করা সম্ভব নয়। ক্যাপ্টেন তক্ষুনি সামলে নিয়ে বাঁ কাঁধ লক্ষ্য করে প্রতিপক্ষকে একটা ঘুসি মারল। যন্ত্রণায় প্রতিপক্ষ পড়ে গেলে শক্ত করে তার গলা পিছন থেকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে বলল, “পালাবার চেষ্টা বা কোনোরকম চালাকি করলে রক্ষা পাবেন না। বিপদে আমিও পড়েছি। তাই চলুন সঙ্গী হওয়া যাক। একে অপরকে উদ্ধার করার চেষ্টাই না-হয় করি? তারপর আপনিও ঘরে ফিরে যাবেন। আমিও আমার ঘরে ফিরে যাব।”

যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেও নির্মল ভট্টাচার্য উত্তর দেন, “আর ওরা? ওরা ঘরে ফিরবে না? সেই কবে থেকে ওরা ঘরে ফেরার চেষ্টা করছে। এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই এই অবস্থা। এক এক করে মানুষ, পশু, পাখি সব গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এরপর একদিন সব কিছু শেষ হয়ে যাবে।”

“আহা! অতদূর যেতে দেবেন কেন পরিস্থিতি? আপনি কোডটা ভেঙে ফেলুন। ওদের দুজনকে ধরে আমরা উপযুক্ত হাতে তুলে দিই। আপনি নিজেও ওদের নিতে পারেন। আপনার ভবিষ্যতে গবেষণার কোনও কাজে যদি লাগে? অন্তত কিছু জানা তো যাবে!”

“হ্যাঁ, জানার জন্য ওদের মেরে ফেলব?”

“বিজ্ঞানের প্রয়োজনে এরকম বলি অনেকেই হয়েছে। আপনি না বিজ্ঞানী? নাসার স্পেশাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন ফর সার্চিং লাইফ ইন একস্ট্রা টেরেস্টেরিয়াল আর্থ-এর অন্যতম সদস্য আপনি।”

“হ্যাঁ। তুমি এই টিমের বাকি চারজনকে খুন করেছ। কারা তোমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছে? রাশিয়া? কেজিবি?”

খুব জোরে হেসে ওঠে ক্যাপ্টেন।—“আপনাদের কথায় কথায় হয় অ্যামেরিকা, নয় রাশিয়া। হ্যাঁ, রাশিয়ান একটা সংস্থা থেকে আমি লোন নিয়েছি। কিন্তু আপনারা যে ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধান পেয়েছিলেন এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আপনি প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন। এত টাকা আমি এখন ফেরত দিতে পারব না। তার বদলে আপনার কাজটুকু তুলে দিলে আমার প্রাণ বাঁচত। আমিও বহুদিন ঘরছাড়া। এখানে আমার টিমমেটরাও সবাই অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সবাই হতাশ। প্রফেসর, আপনি এই শেষ মুহূর্তে বাঁচান আমাদের।”

“এটা কি প্রাণের ভিক্ষা, না ভয় দেখাচ্ছ? এভাবে অত্যাচার করে প্রাণভিক্ষা চাইছ? তোমরা সত্যিই অবাক করলে।”

“এখনই অবাক হচ্ছ ভটচাজ! রাশিয়ান মাফিয়ারা তোমাকেও ছাড়বে না। আমরা তোমাকেই আমাদের চিফ সায়েন্টিস্ট দেখিয়েছি। খাতায় কলমে তুমিই আমাদের ক্যাপ্টেন।”

আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে ক্যাপ্টেন। খুব জোরে নির্মল ভটচাজের গলাটা চেপে ধরেছে। তারপর কী মনে হতে হাতের ফাঁসটা একটু আলগা করে বলে, “আমি কিন্তু প্রাণভিক্ষা চাইছিলাম। শুধু প্রাণভিক্ষাই।”

“এগুলো সব মিথ্যে কথা। তুমি আমার রুমমেট ছিলে। তোমাকে আশ্রয় না দিলেও চলত। রিসেশনের সময় চাকরি হারিয়ে ছেলেমেয়ে-বউকে ডেট্রয়টে রেখে তুমি আমার কাছে সাহায্য ভিক্ষা চাইতে এসেছিলে। বলেছিলাম কোনও একটা ক্লারিক্যাল কাজে তোমাকে ঢুকিয়ে দেব। তার আগে তুমি আমার এখানেই থাকো। আমারই কাছে আশ্রয় পেয়ে আমার গবেষণা তুমি নিজে পয়সা রোজগারের জন্য ব্যবহার করতে চাও?” হাঁপাতে হাঁপাতে নির্মল ভটচাজ কথাগুলো বলেন।

“শুধু চাই না। আমি তো তোমার কাজ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করছিলাম। ওটাই আমার টার্গেট। চাওয়া-চাওয়ির কিছু নেই এখানে। কিন্তু নাসা যে তোমাদের কাজটা মাঝপথে থামিয়ে দেবে তা বুঝতে পারিনি। অনেক ক্ষতি হয়ে গেল আমার।”

“ক্ষতি? তুমি কী চুরি করতে যাচ্ছিলে নিজেই জানো না। ছেলেমেয়েদের মুখ দেখাতে পারতে? তুমি কক্ষনো সফল হতে না।”

“আচ্ছা, তোমাদের কাজটা বন্ধ হয়ে গেল কেন? তোমরা তো ফরেন মাস অবসার্ভ করেছিলে?”

“মূর্খের মতো কথা বলছ তুমি। আমরা কিছুই দেখতে পাইনি। আমি তো রিপোর্ট দিয়েছি। মুনের ম্যাগনেটিক ফিল্ডে এমন একটা পরিবর্তন হচ্ছে যে তার ফলে সমস্ত স্যাটেলাইট ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে। অলরেডি আমাদের গবেষণায় ব্যবহৃত ট্রান্সমিটারগুলোও অকেজো হতে শুরু করেছিল। এই প্রজেক্টটা সম্ভবপরই ছিল না।”

“না না, আমি বিশ্বাস করি না। এগুলো সব গল্পকথা। কিছু একটা তোমরা পাঁচজনেই একসঙ্গে লুকাতে চেয়েছ। কী তা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তোমার বন্ধুরা শহিদ হল, তবুও কেউ মুখ খুলল না?”

‘আমাকে মেরে ফেললেও তুমি এর বেশি আর কিছুই জানতে পারবে না।”

“আশ্চর্য! মেরে ফেলব কেন? তুমিই আমাদের মরে যাওয়া থেকে বাঁচাও। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে দু-বছরের দেখে আমি ঘর ছেড়েছি। সেই থেকে আর ফিরে যাওয়া হয়নি। এখন তার বাইশ বছর হয়তো। তুমি কোড ভেঙে ফেলো প্লিজ।”

“না। কারণ, আমার কাছে কিছুই নেই।”

“তুমি বলবে না তাহলে? আমার কথা ছেড়েই দাও, বিজ্ঞানের উন্নতিতেও তুমি কোনও কনট্রিবিউশন করবে না আর? কত কিছু গবেষণা, আমাদের উন্নতির রাস্তা তুমি বন্ধ করে দিচ্ছ মি. ভট্টাচার্য!”

“সব গবেষণায় উন্নতি হয় না। এভারেস্টের চূড়ায় যদি কেউ আজও না উঠত তাহলে ক্ষতি কী হত বলতে পার? কিন্তু এভারেস্টকে জয় করার নেশায় মানুষ কীভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে তা জানো? পাহাড়ে উষ্ণায়ন, সমস্ত প্রকৃতি যেন উলটেপালটে গেছে। মাঝে মাঝে বিধ্বংসী রূপ নিমেষে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মানুষের ঔদ্ধত্য।”

“এসব শোনার সময় আমার নেই। বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন হলে অনেক কিছুই বলি দিতে হয়। আর তা আজকের নয়। বহু যুগের। তুমি লাইকার কথা জানো তো? সেই রাশিয়ান কুকুর? খুব শান্ত বাধ্য ছিল। ওকে যখন মহাকাশে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হচ্ছে, ও তখনও একদম স্থির নিশ্চিন্তে যেরকম করে ওর প্রভু বলেছে ঠিক সেরকমভাবেই বসেছিল।”

“হ্যাঁ। জানি সেই নিষ্ঠুর ঘটনা। আমি মানতে পারি না। আর তুমি নিজে তো বিজ্ঞানী নও। তুমি বিজ্ঞান বিষয়ে এত বড়ো বড়ো কথা বলছ কী করে?”

ক্যাপ্টেন রেগে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই নির্মল ভটচাজ নিমেষে পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়া কেমিক্যাল ওর চোখে ছুড়ে দিয়েই এক লাফে বারন্দায় চলে এলেন। কেউ কোত্থাও নেই। ক্যাপ্টেন এই আঘাতের আকস্মিকতায় প্রথমে একটু বিস্মিত হয়ে গেছিল। চোখে অসহ্য জ্বালা নিয়েই ছুটে বাইরে এসে মার্ক, পিটার, রাহুল—সবাইকে চিৎকার করে ডাকে। নিজেও ছুটতে থাকে নির্মল ভটচাজের পিছনে।

“মি. ভট্টাচার্য, দাঁড়ান! আমি কিন্তু গুলি চালাব। আর আমার কাছ থেকে বাঁচলেও আপনাকে ওরা মেরে ফেলবে। এই সংস্থার খাতায় কলমে মালিক আপনি। পুলিশও আপনাকে ছাড়বে না।”

নির্মল ভটচাজ ততক্ষণে গেট পেরিয়ে অনেক দূর চলে গেছেন।

দশ

তেঁতুলগাছটার তলায় চুপচাপ বসে শুভম ভাবছে, যে ছেলেটার এত বাড়ি ফেরার তাড়া সে বাড়ি না ফিরে কোথায় যেতে পারে? বিশালের হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে ওই লাল ডায়েরিটার কোনও সম্পর্ক নেই তো? ডায়েরির মধ্যে একটা তালাই-বা কেন? ডায়েরিতে তালা ও আগে তো দেখেনি কখনও। পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে যেতে মন চাইছে না ওর একটুও। পড়াশোনাতেও একদমই মন দিতে পারছে না। সেদিন খিরিশতলায় পীরের মাজারে সিন্নি মানত করে এসেছে। হরিসভাতেও বাতাসার লুট দেবে মানত করেছেন ওর মা। বিশাল ফিরে আসুক। শুধু ও নয়, ওর বাড়ির সকলেই সেই জন্য প্রার্থনা করছে। ওর বাবাও খবরটা শুনে ইস্তক কেমন যেন মুষড়ে পড়েছেন। শুভমকে বাড়ির বাইরে বেরোতে বারণ করেছিলেন প্রথমে। তারপর নিজেই বললেন, “এভাবে কতদিনই-বা আর বাড়ির মধ্যে আটকে থাকবে? চলাফেরা, কাজকর্ম সব করতে তো হবেই।”

বিশালকে কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সে চেষ্টা ওকে করতেই হবে। কিন্তু ঠিক কী করলে যে ও পারবে, কোন পথে যে এগোবে সে বিষয়ে একদম অন্ধকারে। কতগুলো কাঁচা তেঁতুল পড়ে আছে নীচে। আগে হলে কুড়িয়ে নিত। কাঁচা তেঁতুলের টক ও খুব ভালোবাসে। কিন্তু মন এত খারাপ ওর যে ওসব আর ইচ্ছেই করল না। সাইকেলের স্ট্যান্ডটা সরাতে গিয়ে দেখল খুব শক্ত। কীসে যেন আটকে রয়েছে। হাত দিয়ে স্ট্যান্ডটা তুলতে গিয়ে দেখল ঘোড়ার খুরের মতো একটা ছোটো লোহার খণ্ড আটকে রয়েছে স্ট্যান্ডটার গায়ে। শুভম টেনে লোহার টুকরোটা স্ট্যান্ডের গা থেকে আলাদা করল।

এটা তো একটা চুম্বক। অশ্বখুরের মতো দেখতে একটা চুম্বকখণ্ড। এখানে কী করে এল? কেউ ফেলে গেছে?

বেশ শক্তিশালী এইটুকু চুম্বক। সাইকেলের লোহার স্ট্যান্ডের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আটকে রয়েছে। নীচে কতগুলো আধখাওয়া তেঁতুলও পড়ে রয়েছে। চুম্বকটা ও পকেটে রেখে দিল।

স্যারের বাড়িতে এসে শুনল স্যারের দাদাও আজ কয়েকদিন নিরুদ্দেশ। তা এরকম নিরুদ্দেশ উনি মাঝে-মাঝেই হন। এ নিয়ে বাড়ির লোকের তেমন উদ্বেগ থাকে না। বরাবরই উনি কাউকে কিছু বলে-কয়ে যান না। স্যার বিমর্ষ বিশালের কারণেই। এখানেও পুলিশ এসেছিল। বিশাল পরিমল-স্যারের কোচিংয়ে যাচ্ছে বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। পড়তেও তো ও এসেছিল, কিন্তু এখান থেকে যে ও শুভমের বাড়ি যাবে তা কাউকে বলে যায়নি। এটাই সবাইকে ভাবাচ্ছে। কেনই-বা ছেলেটা হঠাৎ করে ওখানে গেল? যে-ছেলের সবসময় বাড়ি ফেরার তাড়া, সে কোনও কারণ ছাড়া কি কোথাও যাবে? কী সেই কারণ? এই আলোচনাই কোচিংয়ে করছে সবাই।

বিশাল যে চন্দ্রকোনা গ্রাম থেকেই নিখোঁজ, এটা মোটামুটি সবারই জানা হয়ে গেছে। অনেক অনেক পুলিশের দল মাঝে-মাঝেই শুভমদের গ্রামে টহল দিয়ে যাচ্ছে। শুভমের বাড়ির সামনেও পুলিশ পাহারা। বিশালের কারণে নয়, ওরা শুভমদের সন্দেহ করছে—এ বিষয়ে অবশ্য শুভমের কোনও ধারণা নেই। এভাবে ভাবেওনি। কিন্তু আজ এখানে সবার আলোচনা শুনে ওর মনে হল, ওরাই যেন অপরাধী। শুভম ওদের বাড়ি থেকে ফেরার পথেই তো নিখোঁজ।

পড়ায় একদম মন দিতে পারল না শুভম। আজ স্যার বা অন্য কেউও যে পড়ায় মন দিতে পারেছে তা নয়। সবারই মুখে-চোখে আতঙ্ক। ছাত্রছাত্রী এসেছেও খুবই কম। ওদের এই অঞ্চলেই এরকম অকস্মাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ার আরও কয়েকটা ঘটনা কাগজে বেরিয়েছে। খুবই দুশ্চিন্তায় সবাই। বিশেষ পুলিশ ফোর্স এসেছে এখানে। সব জায়গায় খানাতল্লাশি চলছে। কোনও কিছুরই হদিস পাওয়া যায়নি এখনও।

ছুটি হয়ে গেলে সবাই যে-যার বাড়ি চলে গেল। শুভমও সাইকেলে করে বাড়ির দিকেই রওনা দিল। কিছুদূর যাওয়ার পর সেদিনের কথা মনে পড়ল। নির্মলজেঠুর ‘হবে না’ বলা, ওরা দুজনেই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়ল কথাটা শুনে। তারপর যা যা ঘটেছে সব একবার মনের মধ্যে সাজিয়ে নিল। কী মনে হতে স্যারের বাড়ির দিকে ফিরে এল ও।

এগারো

এই এতগুলো ডিম ফেলে দিতেও মায়া লাগছে। কিন্তু ডিমের ঝুড়িটাই আড়াল এখন। এটা রেখে চলাফেরা করাও নিরাপদ নয়। এরই মধ্যে যন্ত্রটা রেখেছি। কিন্তু অচল এই যন্ত্রটা নিয়ে আর কতদিন চলব? সেই কবে এসেছি। ফিরে যেতে পারব বলে আর মনে হচ্ছে না। অথচ আমরা দুজনেই একইভাবে ভাবছি না আর। ওর ভাবনা-চিন্তা এখন সম্পূর্ণ আলাদা। ও বিশ্বাস করে ফিরে যেতে পারবে। আমার মতো এতটা হতাশা ওকে কাবু করেনি।

কাঁধে একটা চেনা ছোঁয়া পেল ও।—“হতাশ হয়ো না। ফিরে আমরা যাবই।”

“তোমার এখনও এই বিশ্বাস?”

“আজ কত ঘণ্টা হয়ে গেল আমরা চেষ্টা করেই যাচ্ছি। কিন্তু পারছি কি?”

“ঘণ্টা? তুমিও সময় ভুল করলে? এখানে সময় অনুযায়ী বছর। কুড়ি বছর হয়ে গেল। ওই লোকটার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আমি ওকে সাহায্য করতে পারলে দ্রুত কাজটা হত। কিন্তু যেখানেই ট্রান্সমিটারে সিগন্যাল দেওয়ার চেষ্টা করছি সেখানে কী ফল হচ্ছে দেখতেই তো পাচ্ছ। ওই লোকটাও যদি হাইপার স্লিপে চলে যায় তাহলে আমাদের এই কোয়ান্টাম টেলিপোর্টারের কোড ব্রেক করবে কে?”

“কিন্তু যদি দুষ্টু লোকগুলোর কাছে কোড ব্রেক করে ও? তাহলে কী অবস্থা হবে ভেবেছ একবার?”

“আমার সিস্টেম বলছে ওই লোকটা কোড ব্রেক করবে না অন্য কারও কাছেই। ও আমাদের বাঁচাতেই চাইছে।”

“তুমি একটা র‍্যান্ডম ভেরিয়েবলের ওপর বিশ্বাস করছ?”

“হ্যাঁ। বিশ্বাস করা আর বিশ্বাস ভাঙা—এগুলোর মূলে কী আছে জানো?”

“কী? লোভ? আকাঙ্ক্ষা?”

“না। ভাষা। আমাদের মধ্যে যেহেতু ভাষা নেই কোনও, সবটাই থট ওয়েভে কমিউনিকেশন তাই আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করি না আবার বিশ্বাস ভাঙিও না। কারণ, আমাদের মধ্যে কোনও আড়াল নেই। সবাই আমরা একে অপরের মনের কথা জানতে পারি।”

“সেইজন্যই আমরা নিজেরা একে অপরের ক্ষতি করতে পারি না। একে অপরকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাই না। একে অপরকে হত্যা করি না।”

“আবার আমরা একে অপরকে ভালোবাসতেও পারি না তাই।”

“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?”

“এই দেখো, হোমো-সেপিয়েন্সদের মতো তুমি আমাকে জানতে চাইছ। আমি কী বলছি তা বোঝার চেষ্টা করছ। কারণ, আমাদের কমিউনিকেটর খারাপ হয়ে গেছে। আমরা এখন আর পরস্পরের মাইন্ড রিড করতে পারি না। আমরা ভাষায় কমিউনিকেট করছি। এই কারণেই ভাষা এই গ্রহে সর্বশক্তিমান।”

“ভাষা সর্বশক্তিমান? এই গ্রহে অনেকে তো কথা বলতেও পারে না। পশুপাখিদের কি ভাষা আছে? ভাষা তো শুধু মানুষের জন্য।”

“না না, ভাষা বলতে মানুষের নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন নয়, যারা কথা বলতে পারে না তাদেরও বিভিন্ন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রয়েছে। পশুপাখিরাও নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তুমি সবার ডাক ও তাদের রেসপন্সগুলো লক্ষ করেছ?”

“সেই সে-বার শেয়ালডাঙার মাঠ পেরোতেই একটা কুকুর প্রথমে আমাকে দেখে চিৎকার করল। তারপর আর-একটা কুকুর গলা মেলাল, তারপর আরও একটা। তারপর কোথা থেকে যে আরও কুকুরগুলো এসে জড়ো হল, আমি পালিয়ে বাঁচি না। কুকুরগুলো সব আশেপাশেই ছিল। কেউ বন্ধ উনুনের ভিতর আঁচ পোহাচ্ছিল, কেউ ছাইয়ের গাদায়, কেউ-বা অন্যত্র।”

“তুমি অচানা অজানা বাইরের লোক। তোমাকে ওদের পাড়ায় দেখেই একজন ডেকে অন্যদের সতর্ক করল, অন্যেরা আবার চিৎকার করে ডাক ছেড়ে আরও অন্যদের—হয়তো মানুষদেরও সতর্ক করল।”

“তাহলেই দেখো! এইভাবেই ওরা একে অপরের সঙ্গে কমিউনিকেট করল। এই ডাকটাই তো ওদের ভাষা।”

“এইটা ঠিক বলেছ তুমি। এই গ্রহে সমস্ত প্রাণীদের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। এমনকি সেদিন খিরিশতলার পুকুরে দেখলাম একটা চিল পুকুরপাড়ের হরিতকি গাছের ওপর থেকে ছোঁ মেরে এসে বার বার কয়েকটা মাছের চারা নিয়ে যাচ্ছে। একবার একটা বড়ো মাছও নিয়ে গেল। ওই বড়ো মাছটা নিয়ে যেতেই আর-একটা মাছ ঘাই দিয়ে উঠল একবার। তারপর হুশ করে ডুবে গেল। এটা হয়তো মাছেদের ভাষা। অবশ্য বুঝতে পারলাম না। কেন ঘাই মারল আর-একটা মাছ? ভয়ে? বিপদের আশঙ্কায়? না সঙ্গী হারানোর যন্ত্রণায়?”

“তাহলেই দেখছ তো, মাছেদের বিপদ আমাদের থেকেও অনেক বেশি ও ঘনঘন। কিন্তু সঙ্গী হারানোর যন্ত্রণা আমাদের দুজনের যে কাউকেই একেবারে শেষ করে দেবে। আমার মধ্যে প্রাণশক্তি কমে আসছে। আমার অ্যাডাপ্টরটাও বিকলের দিকে। কাল আবার এর একটা স্ক্রু খুলে কোথায় যে পড়ল!”

“সে কি! তাহলে তো আর বেশিক্ষণ এর সার্কিট ঠিক থাকবে না। কোথায় ফেললে?”

“এই গাছটার নীচেই তো কাল এসেছিলাম। তাছাড়া যেখানে যেখানে কাল গিয়েছি, সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না।”

“সর্বনাশ! আমি কিন্তু সঙ্গী হারিয়ে আর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকব না।”

“তোমার এই অনুভূতিটাই আমাকে শক্তি দেবে।”

“কিন্তু এখন তো আগে অ্যাডাপ্টরটা ঠিক করতে হবে। আমি দেখি কিছু জোগাড় করতে পারি কি না।”

“যাই করবে একটু বুঝেশুনে। অনেক ক্ষতি আমাদেরও হয়েছে আর ওদেরও হচ্ছে। কোথাও কোনও ক্ষতি না করে যদি কিছু করতে পারো।”

বারো

আজও সদর দরজাটা সেদিনের মতোই খোলা। শুভম ঢুকবে কি না ইতস্তত করছে। সাইকেলটা রেখে ঢুকেই পড়ল। ঠাকুরদালান কেমন খাঁ খাঁ করছে আজও। স্যারের দাদা নিখোঁজের সঙ্গে বিশাল হারিয়ে যাওয়ার কোনও রহস্য নেই তো? ওর মন যেন বলছে, আছে। কিছু মিল আছে নিশ্চয়ই। মা কালীর মূর্তির দিকে তাকাল। মূর্তির গলায় ঝুলছে মুণ্ডমালা। খুব সাধারণ। যেমন যে-কোনো কালীমূর্তির থাকে। কিন্তু হাতে ধরা মুণ্ডটার চোখ আজও উঠছে নামছে। চোখ খোলা-বন্ধ হওয়া পুতুলের মতো।

কে ওর প্রশ্নের উত্তর দেবে? স্যারের কাছে গিয়ে সব খুলে বলবে? স্যারকেই জিজ্ঞেস করবে? আজ স্যার বিশেষ না পড়ালেও একটা কম্পাস হাতে নিয়ে ক্লাসে এসেছিলেন। টেবিলের ওপর রাখতেই কম্পাসটা যখন স্যারের টেবিল থেকে ওর পকেটে চলে এল, ও তখনও ওর কাছে যে ম্যাগনেট রয়েছে সে-কথা স্যারকে বলতে পারেনি। কী শক্তিশালী চুম্বকই না ওর হাতে এসেছে। প্রায় কয়েক ফুট দূরত্ব থেকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। স্যারের টেবিল থেকে ক’ফুট দূরে ও বসেছিল? সঠিক মাপও জানে না ও।

লাল ডায়েরিটা ওর বইয়ের তাকেই রয়েছে। সেটা আজ এখানে নিয়ে এলে কি ভালো করত? কিন্তু সেদিন ওই লোকগুলো কেমন ঘর তছনছ করে খুঁজছিল। কী খুঁজছিল ওই লোকগুলো? ডায়েরি? স্যারের ঘরে কি কেউ ঢোকেনি তারপর থেকে? তাহলে ওরকম লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখেও কেন পুলিশে ডায়েরি করল না কেউ? কীসের সঙ্গে কীসের যে যোগ, তা পুলিশই বলে দিতে পারে একমাত্র। এসব কি সাধারণ মানুষের কাজ? ও নিজেই একবার পুলিশের কাছে যাবে ঠিক করল। ওর কাছে রাখা নির্মলজেঠুর ডায়েরিটা পুলিশের হাতে তুলে দেবে।

চলে যেতে গিয়েও মুণ্ডটার দিকে আবার চোখ গেল। চুলের কাছে চকচকে ওই জিনিসটা কি আজও রয়েছে? দেখবে ভেবে এগিয়ে গেল ও কালীমূর্তির দিকে। আশ্চর্য! একটা চাবি যেন ওই মুণ্ডুটার চুলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে ওর পকেটে এসে চুম্বকটার গায়ে লেগে গেল। কীসের চাবি এটা? ডায়েরির? ভাবতেই ঘাড়ের ওপর একটা ঠান্ডা হাত।

তেরো

‘যতক্ষণ না আসে ততক্ষণ দুশ্চিন্তা বাবা। উফ্‌! কী যে হচ্ছে চারদিকে! বাড়ির বাইরে পুলিশ। যেন আমরাই অপরাধী। অথচ ছেলেটা এখানে এল, এত গল্প করল, বাড়ি ফিরে গেল না। এতে আমাদের কী দোষ?’—নিজের মনেই এসব ভাবতে ভাবতে দীপশিখা শুকনো কাচা জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে আলনায় তুলে রাখছেন। আবার এও ওঁর মনে হল, ছেলেটা তো বলেছিল বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। তাহলে বাড়ি না গিয়ে গেল কোথায়? এত পুলিশ চারদিকে, কেউ খুঁজে বার করতে পারছে না? এটুকু রাস্তায় কী বিপদ হতে পারে? বর্ডার পেরিয়ে বাংলাদেশে কেউ নিয়ে যায়নি তো? না না, তাই-বা হবে কী করে?

ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে দুজন পুলিশ ঢুকে পড়ল।—“আমরা এই বাড়ির তল্লাশি নেব।”

“সে কী? এরকম হঠাৎ? এর মানে কী?”

“আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। এই দেখুন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সই। সরকারি কাজে বাধা দেবেন না ম্যাডাম।”

“সরকারি কাজ? আমাদের অপমান করা, হেনস্থা করাই কি সরকারি কাজ?”

মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে দীপশিখার। শুভমের বয়সি একটা ছেলে যে ওঁর ছেলের সঙ্গে একই ইস্কুলে পড়ে। আর ছেলেটা ওঁর অসুস্থ ছেলেকেই দেখতে এসেছিল। এরকম একটা ফুটফুটে ওঁর নিজের ছেলের মতো ছেলে হারিয়ে গেছে শুনে থেকে মন অসম্ভব খারাপ। শুধু ওঁর নয়, শুভমের বাবারও। আর শুভম তো জ্বরের সময় ভাত ভাত করে হেঁদিয়ে যাচ্ছিল। এখন ভাতের থালা পড়েই থাকে। ছেলেটা আনমনে কী যে ভাবে? ভেবেই চলে ছেলেটা আমার। তার ওপর পুলিশের জেরার অত্যাচার। আজ সার্চ ওয়ারেন্ট দিয়ে বাড়ি সার্চ করবে? এত বড়ো অপমান! আর সহ্য হল না দীপশিখার।

“মানি না আমি সার্চ ওয়ারেন্ট। আমাকে অ্যারেস্ট না করে আমার বাড়ি সার্চ করতে পারবেন না। যান, এইবার আমার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে আসুন।”

“ম্যাডাম, সরকারি কাজে বাধা দিলে কোনও ওয়ারেন্টরই প্রয়োজন নেই। আমরা ওয়ারেন্ট ছাড়াই অ্যারেস্ট করতে পারি আপনাকে।” খুব ঠান্ডা অথচ কড়া গলায় বললেন একজন পুলিশ।

দীপশিখা কিন্তু ভয় পেলেন না। ভেঙেও পড়লেন না।—“আমি মানহানির মামলা করব। অকারণে এভাবে অপমান অত্যাচার করা যায় সাধারণ নাগরিককে?”

“ম্যাডাম, সাধারণ নাগরিক অপরাধ করলে তখন প্রশাসন কড়া হয় বইকি। আইনকানুন তৈরিই হয়েছে তো এই কারণে।”

“কী কারণে? আমরা কী অপরাধ করেছি?”

“ম্যাডাম, আপনারা কী অপরাধ করেছেন সেটা তো পরের বিষয়। ইন ফ্যাক্ট সেটা বিষয়ই নয়। এখানে একটা বাচ্চা ছেলের কিডন্যাপিংয়ের কেস।”

“কিডন্যাপ? কে কিডন্যাপ করেছে?”

যে পুলিশ অফিসার কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন তিনি এবার হেসে উঠলেন।—“কে কিডন্যাপ করেছে জানতে পারলে তো আমরা এতক্ষণে উদ্ধারই করে দিতাম ছেলেটাকে। সেইজন্যই তো তদন্ত চলছে আমাদের।”

“তা আপনাদের কী মনে হয়, আমরা কিডন্যাপ করেছি? আমার ছেলের বয়সি একটা ছেলেকে আমি কিডন্যাপ করেছি? আমার জ্বরে রোগাক্রান্ত রোগা ছেলেটা তার বন্ধুকে কিডন্যাপ করেছে? আমার স্বামী একটা কলেজের সংস্কৃত অধ্যাপক। তিনি কিডন্যাপ করেছেন? তাঁর ছেলের বন্ধুকে? কী আমাদের উদ্দেশ্য? কেনই-বা করব এ-কাজ?”

“না না, বিষয়টা তা নয়। হয়তো বিশাল এমন কিছু বলেছে বা কিছু একটা দিয়েছে ওর বন্ধুকে। হয়তো কিছু একটা রাখতে এসেছিল। আর সেই ছোট্ট ক্লু আপনার ছেলে মনে করতে পারছে না। সেই কারণেই আমরা একটু শুভমের বইখাতা, পড়ার জায়গা ও কোথায় ওর বল, লাটাই, ঘুড়ি ও অন্যান্য খেলার জিনিস রাখে এগুলো দেখতে চাই শুধু। আর কিচ্ছু নয়। একটু সহযোগিতা করুন প্লিজ!”

এই অনুরোধের পর দীপশিখা আর কিছু বলতে পারেন না।

ওরা শুভমের বইখাতা সব তন্নতন্ন করে খুঁজছে। কিন্তু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দিচ্ছে না কিছুই। এর মধ্যে বাইরে কীসের জন্য হইচই শুনতে পেল। শুভমের বাবা আর দারোগাবাবু বাড়ির মধ্যে একসঙ্গে ঢুকলেন। থানার বড়বাবু ঢুকতেই পুলিশ দুটো প্রায় একছুটে গেটের বাইরে বেরিয়ে গেল। ওরা সকলেই হকচকিয়ে গেল।

“এ কী হল শিখা? কারা এরা? বাড়ির মধ্যে কী করছিল?”

“পুলিশ। বলল যে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে ওদের কাছে।”

চন্দ্রকোনা থানার দারাগোবাবু রাইচরণ মজুমদার বেশ অবাক হলেন।—“সে কি কাণ্ড? সার্চ ওয়ারেন্ট? আমি তো আপনার বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ পোস্টিংও তুলে নিয়েছি আজ সকালেই। গণেন্দ্রবাবু কাল থানায় এসে আমাকে যা বললেন, আমি নিজেও একমত। এইভাবে বাড়ির বাইরে পুলিশ থাকলে একটা ছোটো বাচ্চার ওপর অকারণ প্রেশার ক্রিয়েট করা হয়। আপনার ছেলে এমনিই তো ভেঙে পড়েছে। আপনারা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। এখনও কিছুই করতে পারলাম না—এ আমাদেরই ব্যর্থতা। আর পুলিশ পোস্টিং আপনাদের সন্দেহ করে নয়, আমার কেন জানি না মনে হচ্ছিল শুভমেরও নিরাপত্তার প্রয়োজন। সেই কারণেই তো বাইরে পুলিশ পোস্টিং রেখেছিলাম। কিন্তু আপনাদের সকলের যখন মানসিক অস্বস্তি হচ্ছে তখন তো এর কোনও প্রয়োজন নেই ভেবেই তুলে নিয়েছি।”

“সে ঠিক আছে। কিন্তু সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে কারা এসেছিল তাহলে? বলল যে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সই করা ওয়ারেন্ট আছে!”

“ডি.এম.-স্যার তো ছুটিতে এখন। অতিরিক্ত, ডেপুটি দুজনেই আমার সঙ্গে একটা মিটিংয়ে ছিলেন। এমন কোনও তো ওয়ারেন্ট বার হয়নি! আর ওয়ারেন্ট তো আমার থানাতেই আসবে।”

“তাহলে কারা ওরা? ওদের অ্যারেস্ট করা প্রয়োজন।” গণেন্দ্রবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

“কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। ওরা ধরা পড়বেই। আমার কাছে মেসেজ এল। এই দেখুন আমার ওয়াকিটকিতে।” রাইচরণবাবু ওয়াকিটকিটা মুখের কাছে এনে কী যেন বললেন। তারপর খুব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “ধরা পড়েছে বাছাধন। যাবে কোথায়? বাড়ির সামনে পুলিশ পোস্টিং আর সেইজন্য আপনাদের অপমানিত বোধ হওয়ার কারণে আমি বাড়ির সামনে থেকে পুলিশ তুলে নিলেও বাড়ির এক গজের মধ্যেই ফোর্স রেখেছিলাম। আমি আন্দাজ করেছিলাম কিছু একটা হতে পারে শুভমের ওপর অথবা এ-বাড়ির ওপর।”

রাইচরণবাবু বেরিয়ে গেলে গণেন্দ্রবাবু শুভমের খোঁজ করলেন। দীপশিখাও অবাক হলেন।—“সে তো পড়তে গেছে।”

“আশ্চর্য! বিকেল হতে চলল, এখনও ফিরল না কেন ছেলেটা?”

দুজনেই উৎকণ্ঠা আর দুশ্চিন্তার ভারে নুয়ে পড়লেন।

“এখুনি খুঁজতে বের হব আমি। কিছুতেই শুভমকে হারিয়ে যেতে দেব না।”

গণেন্দ্রবাবু তাঁর হাতের মোবাইলটায় তড়িঘড়ি রাইচরণবাবুর ফোন নম্বর খুঁজতে লাগলেন।

দীপশিখা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন। চোখের নিমেষে গণেন্দ্রবাবু উধাও হয়ে গেলেন। দীপশিখা ছুটে গেলেন বাইরে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। গোপালের মা নাতির হাত ধরে কোথা থেকে যেন ফিরছে। দীপশিখা জিজ্ঞেস করলেন, “ওঁকে যেতে দেখলেন পিসিমা?”

“কাকে? কাউকে তো রাস্তায় দেখলাম না। একটা ডিমওয়ালাকে দেখলাম। আগে কখনও দেখিনি এ-পাড়ায়।”

“আপনার ভাইপোকে দেখেননি? এদিক দিয়েই তো গেল!”

“গণা? না তো। গণাকে তো দেখলাম না। গণা ফেরেনি এখনও? সবে তো পাঁচটা বাজে। হয়তো সাড়ে পাঁচটার ট্রেনে ফিরবে। তুমি চিন্তা কোরো না বউমা। তা যা দিনকাল পড়েছে, কোথায় যে সব হারিয়ে যাচ্ছে, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।”

দীপশিখা চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। তাও কোনোমতে শক্তি সঞ্চয় করে গোপালের ছেলে পার্থকে জিজ্ঞেস করেন, “বাবু, তুমি জেঠুকে যেতে দেখেছ? এই রাস্তা দিয়ে? খুব জোরে দৌড়ে? হন্তদন্ত হয়ে?”

শেষ আশা ছিল দীপশিখার। বুঝি পার্থ ঠিক দেখে থাকবে ওঁকে। কিন্তু পার্থও যখন দেখিনি বলল, উনি যেন দপ করে নিভে গেলেন। কিন্তু নিভলে তো চলবে না। একশো গজের মধ্যে পুলিশ আছে। ওঁকে এখন পুলিশের কাছেই যেতে হবে। সবাইকে হারিয়ে ফেললে থাকবেন কী নিয়ে? বুকের মধ্যেটা হু হু করে উঠল। কিছুতেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারলেন না যে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হারাবে না। কিচ্ছু হারায়নি। এখুনি শুভম আর ওর বাবা দুজনেই একসঙ্গে এসে পড়বে বাড়িতে। একটু পরেই উনি শাঁখ বাজাবেন। তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বেলে প্রণাম করবেন। তারপর চায়ের কাপ আর বাটিভরতি ঘানির তেল দিয়ে মাখা-মুড়ি নিয়ে ছেলে আর বাবার সামনে রাখবেন।

ভেতরটা ফাঁকা লাগছে দীপিশিখার। নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না উনি। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন।

“মা, কী হয়েছে? এখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছ কেন?”

দীপশিখা যেন স্বপ্ন দেখছেন। শুভমকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকলেন ওর কপালে, গালে।—“বাবা আমার। মানিক আমার। আর কোথাও যেতে দেব না তোকে। কোথাও না। দেখি আমার বুকের মধ্যে থেকে কে অদৃশ্য করে দেয় তোকে, কার এত সাহস।”

এত জোরে জড়িয়ে ধরেছিল মা যে শুভমের দমবন্ধ লাগছিল। তাছাড়া এরকম সবার সামনে চুমু দেওয়ায় একটু লজ্জাও পাচ্ছিল ও। তবে অনেকদিন পর মা এমন আদর করল ওকে। কিন্তু মা অমন করছে কেন?

“আর কোনও চিন্তা নেই। কেউ অদৃশ্য হবে না আর। যারা অদৃশ্য হয়েছে তারা সবাই ফিরে আসবে।”

কথাগুলো নির্মলজেঠু বললেন ওর মাকে। মা কিন্তু কোনও কথা শুনতেই রাজি নন। মা খেয়াল পর্যন্ত করলেন না শুভমের সঙ্গে নির্মলজেঠু আর দুজন লোক এসেছেন।

“না না, আমি বিশ্বাস করি না। কাউকে বিশ্বাস করি না। এইমাত্র কথা বলতে বলতে উনি কোথায় চলে গেলেন?”

আবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল দীপিশিখা। সেই দুপুর থেকে পুলিশের বেশে দুটো লোক ওঁদের বাড়ি এসে সার্চ ওয়ারেন্ট, কিডন্যাপ কেস—কত কী বলে গেল। ছেলের বইখাতা উলটেপালটে দেখল। চোখের সামনে থেকে স্বামীর উধাও হয়ে যাওয়া। আর নিতে পারলেন না দীপশিখা। শুভমকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

চোদ্দ

“আচ্ছা, চলে এলি কেন বল তো? আর-একটু অপেক্ষা করে শুভমের মাকে শান্ত হতে সময় দেওয়া উচিত ছিল আমাদের। এইভাবে ডায়েরিটা না নিয়ে চলে আসে?”

“না রে। ঠিকই করেছি।”

“কীসের ঠিক? এদিকে তো আমাদের দুটো অ্যাডাপ্টরই খারাপের দিকে। চাবিটা পেয়েও ডায়েরিটা নিলি না?”

“আমাদের বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। সব্বার তাড়া আছে। কিন্তু আগে ওই মায়ের মন শান্ত হতে সময় দিতে হবে।”

“সময়? সময়কে এখন আর বিশ্বাস করতে পারি না। সময় একটা ধারণামাত্র। আর এ আমাদের থেকে ভালো কেউ কি জানে?”

“জানি। কিন্তু নির্মলবাবুর ওপর আমি এখনও বিশ্বাস রাখি। উনি চাইলে আমাদের যদি ধরিয়ে দিতেন। যে-কোনো গবেষণা সংস্থা, যে-কোনো ধনী রাষ্ট্র অনেক টাকা দিয়ে কিনে নিত আমাদের। নির্মলবাবুর ভাগ্যে এই গ্রহের সেরা বিজ্ঞানীর তকমা জুটত নিশ্চয়ই। উনি কিন্তু সব ছেড়ে এমনকি চাঁদের চুম্বকক্ষেত্রের দোহাই দিয়ে গবেষণাটাই বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা ভুলি কী করে?”

“এই পৃথিবীতে এসে ভাষা শিক্ষাটা তাহলে তোর কাজে লেগেছে বল? তুইও হোমো-সেপিয়েন্সদের মতো ভালোবাসতে শিখেছিস।”

“হ্যাঁ। তা ঠিক। নির্মলবাবুর আমাদের ওপর মায়া না জন্মালে এতক্ষণে ল্যাবরেটরিতে আমাদের কেটেকুটে পরীক্ষা করত হয়তো কোনও গবেষণা সংস্থা।”

“কত কী হতে পারত, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।”

“সেই জন্যেই তো। ছেলেটাকে জড়িয়ে ওর মা ওরকমভাবে কাঁদছে, ওই দৃশ্যের সামনে আমি একবারে চুপ মেরে গেছিলাম। তারপর নির্মলবাবুও যখন ফিরে এলেন একটাও কথা বললেন না। আমারও মনে হল আমাদের যাওয়াই উচিত ওখান থেকে।”

“কিন্তু গণেন্দ্রবাবুর উধাও হওয়াটা জরুরি ছিল না।”

“সেটা তো বটেই। আমি আসলে একবার সিগন্যাল দিয়ে দেখতে চাইছিলাম ডায়েরির লোকেশন। উনি তক্ষুনি মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করতে গেলেন।”

“তাহলে দুটো জিনিস এখান থেকে শিখলাম।”

“কী কী? এক তো ভাষা, শব্দ।”

“হ্যাঁ। তবে ভাষা মানে শুধু শব্দই নয়। সমস্তরকম আবেগ বোঝাতে পারবে এমন জোর শব্দের নেই। শুভমকে জড়িয়ে ধরে ওর মা যখন কাঁদছিল, সেটাও একটা ভাষা। ভালোবাসার ভাষা। উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার ভাষা। আমাদের ভাষা নেই তাই আমাদের নিজস্ব বলেও কিছুই নেই। সবাই সবার মন পড়তে পারি। তাহলে মনের মধ্যে রাগ আছে, নাকি ভালোবাসা আছে, নাকি উদাসীনতা আছে সবটাই খোলা বই যেন। এখানে এসে বুঝতে পারলাম বাঁচার মজা কিন্তু খোলা বইতে নেই। বরং বইয়ের পাতা একটু একটু করে খুলে পড়াতেই আনন্দ। বেঁচে থাকার সার্থকতা।”

“ঠিকই বলেছিস। আর-একটা কী শিখলি?”

“যন্ত্রকে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করতে হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অহেতুক অবশ্য শুধু যন্ত্র নয়, কোনও কিছুরই ব্যবহার করা উচিত নয়।”

“সেই তো যত গণ্ডগোল যে মোবাইল রেডিয়েশন সে কি আর এদের সকলকে বোঝাতে পারব? আমাদের কমিউনিকেশন ট্রান্সমিটার আর টেলিপোর্টারটা যে বিগড়ে গেল তা তো ওই রেডিয়েশনের জন্যই।”

“আমরা যখন গ্রহটাকে দেখেছিলাম তখন কত পাখি, কত গাছ, পাহাড়-নদী সব ছিল।”

“আরে সেটা তো স্টোন এজের পরের সময়কেই দেখেছিলাম। তারপর গবেষণাগারে মহাকাশযান তৈরি করে ও আমাদের নিজেদেরও তৈরি হয়ে আসতে আসতে এত সময় লেগে গেল। সময়? আমাদের ওখানে কয়েক ঘণ্টা এদের এক-এক যুগের সমান।”

“আচ্ছা, তোর এখানে ঘুম পায়? তুই তো ডিমওয়ালার বেশে অনেক কিছু খেয়েও নিলি।”

“আর তুই পাতার পোশাকের বাইরে বেরোতেই পারলি না।”

দুজনের খুনসুটিতে রাত নেমে পড়ে। আর রাতের আকাশে দূরের কোনও এক তারা জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে। অনন্তকাল ধরে কীসের যেন অপেক্ষা। কেউ কি ফিরবে এই গ্রহ থেকে? একটা নতুন প্রাণের দিশা কি এই পুরো মহাকাশে আর কোথাও আছে? যদি থাকেও, কোনও আদানপ্রদান কি সত্যিই সম্ভব? না এই ব্রহ্মাণ্ডে সমস্ত গ্রহ নক্ষত্রের একাকী যাপনই একমাত্র ধ্রুবক।

পনেরো

মাকে কীভাবে শান্ত করবে বুঝতে পারে না ও। মা কিছু শুনতেই চাইছে না। কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে মাকে ওর। ও যত বলছে, ‘বাবাকে আমি ফিরিয়ে আনব মা। তুমি শুধু বিশ্বাস রাখো আমার ওপর।’—মা কিছু শুনতে রাজি নয়। ওকে বুকে চেপে ধরে শুধু বলে যাচ্ছে, “কোথাও যেতে দেব না তোকে। চোখের সামনে থেকে কিছুতেই আর চলে যেতে দেব না তোকে।”

“মা, প্লিজ! শান্ত হও। আমার কিচ্ছু হয়নি। এই দেখো। আমি তোমার চোখের সামনেই।”

“কিচ্ছু হয়নি মানে? এই এত ভুগলি, এত হেনস্থা। যে-কোনো মুহূর্তে আরও বড়ো কিছু হতে পারে। আমি হতে দেব না। আমি আগলে রাখব আমার ছেলেকে। কোথাও যেতে দেব না। কোথাও না।”

“মা, আমি কোথাও যাচ্ছি না এখন। কিন্তু তুমি শান্ত হও। কতগুলো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন খুব।”

“প্রশ্ন? তুইও আর প্রশ্ন করিস না বাবা আমাকে। আমি আর পারব না কোনও জেরার উত্তর দিতে। সকাল থেকে জেরার উত্তর দিয়েই যাচ্ছি। উত্তর দিয়েই যাচ্ছি।”

একই কথা পরপর দু-বার বলল শুভমের মা। শুভম বুঝতে পারল, মা কেমন যেন অসংলগ্ন কথা বলছে। কী করে এবার ও? কীভাবেই-বা লাল ডায়েরিটার কথা জিজ্ঞেস করবে মাকে? আগে তো শান্ত স্বাভাবিক করতে হবে মাকে। বাবা যদি এখন থাকত, তাহলে মাকে শান্ত করতে এত কষ্ট ওকে পেতে হত না। যত দেরি হবে তত ক্ষতি। কিন্তু কী করবে তা বুঝে উঠতে পারল না।

মা হঠাৎ বলল, “সকাল থেকে কী যে যাচ্ছে আমার! নকল পুলিশ এসে বাড়ি সার্চ করে গেল। তারপর…”

মাকে আর কথা শেষ করতে দিল না ও—“কী? নকল পুলিশ? আমাদের বাড়িতে সার্চ করতে এসেছিল?”

“হ্যাঁ। আমি তো আর বুঝিনি নকল পুলিশ। তা তোর বাবা রাইচরণবাবুকে নিয়ে ভাগ্যিস ঢুকলেন বাড়িতে। না-হলে কী যে সব্বনাশ হত!”

“মানে? কিছু নিয়ে গেছে ওরা? আমার লাল ডায়েরিটা?”

শুভম একছুটে ওর বইয়ের টেবিলে চলে গেল। সমস্ত খাতাপত্তর নামিয়ে নামিয়ে দেখছে। পুরোনো একটা টেস্ট পেপারের তলায় রেখেছিল ডায়েরিটা। সেটাই তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল।

ওকে এমন হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে খুঁজতে দেখে দীপশিখা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী খুঁজছিস বাবা? লাল ডায়েরি?”

“হ্যাঁ, লাল ডায়েরি। খুব প্রয়োজন। ওই ডায়েরি ছাড়া ওরা ফিরতে পারবে না। বাবা, বিশাল, সদর হাসপাতালের নার্স, জগা আর তার গোরু, আমাদের বড়োপুঁটি ছোটোপুঁটি সহ সবক’টা হাঁস—কাউকে ফেরাতে পারব না। ওরা সবাই এই পৃথিবীর মধ্যেই আর-একটা পৃথিবীতে থেকে যাবে। মা, ডায়েরিটা খুব প্রয়োজন।”

“তুই কী বলছিস আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা! পৃথিবীর মধ্যেই আর-একটা পৃথিবী?”

“হ্যাঁ মা, সব তোমাকে আমি বুঝিয়ে বলব। আগে বলো ডায়েরিটা কোথায়। তুমি ডায়েরিটা দাও আমাকে। নির্মলজেঠুকে দিতে হবে ডায়েরিটা।”

“কিন্তু ডায়েরিটা তো সাধারণ ডায়েরি নয়। অত মোটা, তার ওপর তালা ঝুলছে। বেশ শক্ত একটা তালা। ওরকম তালা আমি কোনও বাড়ির দরজাতেও দেখিনি। আচ্ছা, ডায়েরিতে তালা কেন?”

“আমি পরে সব উত্তর দেব। আগে প্লিজ বলো ডায়েরিটা কোথায়। এখানে পাচ্ছি না কেন? কারা এসেছিল সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে?”

“দুজন পুলিশ এসে বলল, বিশালের হারিয়ে যাওয়া কিডন্যাপের কেস। আমরা কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নই। তাই বাড়ির তল্লাশি করবে। আমি খুব অপমানিত বোধ করলাম। কিছুতেই রাজি হলাম না। তখন নরম করে বললে, শুধু তোর পড়ার বই, খেলার জায়গা, বল, লাটাই কোথায় কী রাখিস সেইটুকুই খুঁজে দেখবে—কোথাও কিছু ক্লু পাওয়া যায় কি না।”

“উফ্‌, মা! ওরা কি লাল ডায়েরি পেয়েছে? ওরা আমার জিনিসপত্র খুঁজবে কেন বলল?”

“আরে, ওরা তো নকল পুলিশ। তোর বাবা দারোগাবাবুকে নিয়ে ঢুকতেই একছুটে পালিয়ে গেল। আবার ধরাও পড়েছে পালাতে গিয়ে।”

“সে না-হয় হল। কিন্তু আমার লাল ডায়েরি কোথাও নেই কেন? আমি তো এখানেই রেখেছিলাম। একদিনও বার করিনি। জ্বর সারলে স্যারের বাড়ি গিয়ে নির্মলজেঠুর ঘরে চুপিচুপি রেখে আসব ঠিক করেছিলাম। তখন অবশ্য জানতাম না ওই ডায়েরিই আসলে সব রহস্যের চাবিকাঠি।”

কথাটা বলে বিশাল একবার পকেটে হাত দিয়ে দেখে চাবিটা তো পকেটেই আছে। জেঠু বোধহয় ডায়েরি আর চাবি একসঙ্গে নেবেন বলে তখন চাবিটা ওর থেকে নেননি। খুব লজ্জা হল ওর। এখন ডায়েরি হারানোর কথা কোন মুখে বলে?

“ওরা কি আমার লাল ডায়েরিটা পেয়েছে?”

“আমার আমার করছিস কেন? ওটা তো তোর নয়। আমি প্রথমে বড়ো একটা ট্যাব ফোন ভেবেছিলাম। তারপর ভালো করে দেখলাম ফোন নয়। ডায়েরি। তোর বাবা তখনও বেরোয়নি। তোর বাবার হাতেই ডায়েরিটা দিলাম।”

“কী? বাবার হাতে? বাবা কোথায় রেখেছেন ডায়েরিটা?”

বাবার কথা শুভম বলতেই দীপশিখা কেঁপে উঠলেন। চোখের সামনে লোকটা ফোন হাতে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ঠিক তখুনি বাড়ির টেলিফোনটা বেজে উঠল। দীপশিখা কিছুতেই ছেলেকে টেলিফোন ধরতে দেবেন না।—“না না, যত গণ্ডগোল ওই ফোন। ফোন করতে-করতেই তোর বাবা…”

“না মা, সবাই ফোন করতে করতে হারিয়ে যায়নি। বিশাল সেদিন ফোন আনেইনি। ওর কাছে ফোন থাকলে আমাকে একবার মাইন্ড ক্র্যাফট খেলাত।”

“সেটা কী?”

“মোবাইল গেম।”

ফোনটা আবার বাজছে। এবার শুভম ছুটে গিয়ে ফোন ধরল।

“আমি নির্মলজেঠু বলছি। ডায়েরিটা আমি থানাতে পেলাম। রাইচরণবাবু কিছুতেই আমার হাতে দেবেন না। বলছেন প্রমাণ কই? গণেন্দ্রবাবু নিজে এসে নাকি এই ডায়েরি ওঁকে রাখতে দিয়েছিলেন। এখন গণেন্দ্রবাবু না আসা পর্যন্ত এই ডায়েরি কাউকে দেবেন না উনি। তুমি প্লিজ বলো ও-ডায়েরি কোথায় পেয়েছ।”

শুভম কিছুটা শান্তি পেল। বাবা যদি ডায়েরিটা নিয়েই অদৃশ্য হয়ে যেতেন, তাহলে কী করেই-বা বাবাকে ফেরাতে পারত ও? বাকিরাই-বা ফিরত কী করে?

শুভম কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই ও-প্রান্ত থেকে শুনতে পেল—“হ্যালো, আমি চন্দ্রকোনা থানার বড়বাবু রাইচরণ বলছি। কোনও ভয় নেই খোকা। ও-ডায়েরি তুমি কোথায় পেয়েছ? আমাদের ওপর ভরসা রাখো। কোনও চাপ নেই। একদম ভয় পাবে না। এর মধ্যেই দুজন আন্তর্জাতিক দুষ্কৃতীকে ও তাদের টিম লিডারকে অ্যারেস্ট করেছি। ওদের ওপর আমাদের দেশের তিনজন বিজ্ঞানীর খুনের চার্জ রয়েছে। দেশের সমস্ত সিক্রেট একটা কোডের মধ্যে দিয়ে পাচার করত বাইরে। বিশাল চক্রের একটা অংশমাত্র অবশ্য ধরেছি এতক্ষণে। কিন্তু তুমি আমাদের ওপর আস্থা রাখো। ওই ডায়েরি সম্বন্ধে যা জানো বলো আমাদের। ডায়েরির তালা ভাঙা কোনও ব্যাপার নয়। ও আমি এখনই ভেঙে ফেলব।”

শুভম আঁতকে ওঠে।—“না না! ভাঙবেন না, ভাঙবেন না প্লিজ! আমার কাছে চাবি আছে। তবে ওই ডায়েরির আসল মালিক নির্মলজেঠু। ওঁকেই দিয়ে দিলে ভালো হয়।”

“তুমি কোনও চাপ থেকে বলছ না তো বাবা? আমার ওপর ভরসা রাখো। তোমার বাবাও ভরসা করেন বলেই তো আমাকে ডায়েরিটা দিয়ে গেছেন সকালে। আচ্ছা, তোমার বাবা কোথায়? টেলিফোনটা একবার ওঁকে দাও তো।”

শুভম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ওদিক থেকে বারকতক হ্যালো বললে খুব ধীরে ধীরে বলে, “বাবা আপনাকে ফোন করতে গিয়ে আজ উধাও হয়ে গেছেন।”

“কী?” আঁতকে ওঠেন রাইচরণবাবু।—“আমি এখুনি ফোর্স নিয়ে আসছি। তোমরা কোনও চিন্তা কোরো না। মগের মুলুক নাকি? এভাবে উধাও হয়ে যেতে চাইলেই যাওয়া যায় নাকি? আমি আসছি।”

শুভম বলতে চাইল, ইচ্ছে করে কেউ গায়েব হয়ে যায় না। আর আপনি এসেও কি কিছু করতে পারবেন? কিন্তু কথাগুলো বললে উনি যদি অপমানিত হন? কীভাবে যে ওঁকে বোঝাবে? কিছুই ঠিক করতে পারল না শুভম। বুদ্ধি করে শুধু বলল, “নির্মলজেঠুকেও ডায়েরিটা নিয়ে আসতে বলুন আমাদের বাড়িতে। আপনিই বরং সঙ্গে করে নিয়ে আসুন ওঁকে।”

ষোলো

পুলিশের গাড়িতে নির্মলজেঠুও এলেন। হাতে লাল ডায়েরিটা। রাইচরণবাবু একগাদা পুলিশ নিয়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিলেন। সমস্ত চন্দ্রকোনা এমনকি ভূতুড়ে বাঁশবাগানেও পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গেল। শুভম এই গোলমালের মধ্যে পকেট থেকে চাবিটা নির্মলজেঠুর হাতে দিয়ে দিয়েছে। রাইচরণবাবুকে শেষ পর্যন্ত ও বোঝাতে পেরেছে ডায়েরিটা নির্মলজেঠুরই। ও জেঠুর ঘর থেকেই ডায়েরিটা নিয়ে এসেছিল। এ-কথা শুনেও রাইচরণবাবু শুভমের ওপর রাগ করলেন না। বরং নির্মলজেঠুকেই সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন। কত কী প্রশ্ন করলেন। ডায়েরিতে তালা কেন বার বার জিজ্ঞেস করলেন। এমনকি উনি কোথায় উধাও হয়েছিলেন এ-ক’দিন সে বিষয়েও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন। নির্মলজেঠু বললেন, উত্তরের এক পাহাড়ে ওঁর চেনা এক সাধু এসেছেন, তাঁর কাছেই যাচ্ছিলেন। কিন্তু রাস্তায় আচমকা পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। তাই বাড়ি ফিরে আসেন। যাওয়া এবার আর হল না ওঁর। পরেরবার অবশ্যই যাবেন ওই সন্ন্যাসীবাবার কাছে।

এইসব উত্তরে রাইচরণবাবু মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। ওঁকে থানায় রোজ হাজিরা দিতে বললেন। তল্লাশি তখনও চলছিল।

শুভম খুব ক্লান্ত বোধ করে। ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। যদিও ঘুম এল না ওর। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, ওই দুষ্টু লোকগুলো জানল কী করে ওর কাছেই ডায়েরিটা রয়েছে? ভাগ্যিস কাটামুণ্ডুর কাছে ও তখন গিয়েছিল আর পকেটে ওই শক্তিশালী চুম্বকটার জন্য ক্লাসে যেমন হেনস্থা হতে হয়েছিল তেমনিই এখানেও মা কালীর হাতে ধরা কাটা মুণ্ডুর চুলের মধ্যেই যে চাবিটা লুকিয়ে আছে তা জানতেই পারত না। যদি না চুম্বকটা ওর পকেটে থাকত।

কাঁধে ঠান্ডা হাতটা সেদিন আসলে নির্মলজেঠুরই ছিল। মুখ-মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কে এমন বিশ্রী করে মেরেছে ওঁকে? কিছু জিজ্ঞেস করতে আগে বললেন, “ডায়েরিটা দাও। তারপর সব জেনো।”

নিজেই ঘরে ঢুকে ফার্স্ট-এইড বক্স থেকে দ্রুত ওষুধ বার করে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে নিলেন। তারপর সেই চৌকির নীচে ট্র্যাপ ডোর খুলে বেসমেন্টে নিয়ে গেলেন শুভমকে। ওটাই যে ওঁর ল্যাবরেটরি। গবেষণার জায়গা। শুভমকে তা বললেন। ওখানেই দুজন অদ্ভুতদর্শন মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। ওরা সবাই ডায়েরির খোঁজ করছিল। শুভম কিছুই বুঝতে পারেনি। অথচ পুরো বিষয়টা জানা ওর প্রয়োজন। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে ওর।

নির্মলজেঠু বললেন, “সময় আমাদের হাতে খুব কম। এর অ্যাডাপ্টরটা খারাপ হয়ে গেছে। কত কী খুলে পড়েছে। আসলে বনে-বাদাড়ে ঘোরা তো ওদের অভ্যেস নয়। কখনও অমুক গাছে, কখনও তমুক গাছে ঘুরতে ঘুরতে আজ ওর এই অবস্থা।”

পাতার পোশাকে সমস্ত শরীর ঢাকা একটা বেঁটেমতো লোক বলল, “তোমরা এই গ্রহের মানুষরা ভাগ্যবান। তোমাদের গ্রহে শুধু তোমরাই নেই, কত ভিন্ন ধরনের প্রাণ আছে এখানে। জলে-স্থলে কত প্রকারের প্রাণী! আর সবাই কেমন একটা শৃঙ্খলে বাঁধা। একে অপরের উপর নির্ভরশীল।”

শুভমের মনে পড়ল, এই ধরনের শৃঙ্খলের কথা তো ওদের বায়োলজির সিলেবাসেও আছে।

“এরকম জড়িয়ে-মড়িয়ে বাঁচার মধ্যে যে কী অদ্ভুত আনন্দ এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না। কিন্তু ওর অ্যাডাপ্টর খারাপ হয়ে যাওয়া মানে ও ফুরিয়ে যাবে। ও ফুরিয়ে গেলে আমি একা কিচ্ছু করতে পারব না।”

এবার শুভম কথা বলল।—“কী পারবে না? কী করবে তোমরা? আর জেঠু, আপনাকে এভাবে মেরেছেই-বা কে?”

নির্মলজেঠু তাঁর স্বভাব অনুযায়ী এখনও গম্ভীরই আছেন। তবে ওঁর গলায় আর সেই গাম্ভীর্য নেই। বেশ কোমল স্বরেই বলেছিলেন, “আগে ওদের সবকথা মন দিয়ে শোনো। জিরো, ওয়ান, তোমরা দুজনে এই ছেলেটাকে সংক্ষেপে বিষয়টা বুঝিয়ে দাও।”

জিরো? ওয়ান? এ কেমন নাম? এ তো পরীক্ষার নম্বর হতে পারে। তবে জিরো আর ওয়ান পেলে সেই ছাত্রের কপালে যে কি অশেষ দুঃখ!

শুভমকে অবাক হতে দেখে পাতার পোশাক পরা বেঁটে মানুষ, যার দিকে তাকিয়ে জেঠু জিরো বললেন, সে বলল, “জিরো আর ওয়ান তোমাদের কম্পিউটারের বাইনারি সিস্টেম। আমরা অবশ্য এই বাইনারি সিস্টেম ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়েছি। আর ওই লাল ডায়েরির নোটপ্যাডে যে সংকেতগুলো আছে সেগুলো ডিকোড করতে পারলেই আমাদের কোয়ান্টাম টেলিপোর্টারটাও ঠিক হয়ে যাবে।”

বাইনারি সিস্টেম কথাটা শুভম শুনেছে। কিন্তু কোয়ান্টাম টেলিপোর্টার কী শুভম তা জানে না।

জেঠু যে-লোকটার নাম ওয়ান বলেছিলেন, সেই লোকটা বলল, “আহ্‌! ও একটা ক্লাস টেনের বাচ্চা। তায় সব বিষয়ে দুর্বল। ও এত কিছু বুঝতে পারবে না। সহজ করে বলতে হবে ওকে।”

কথাটা শুনে মনখারাপ হয়ে গেল শুভমের। সত্যিই তো ওসব বিষয়ে কাঁচা। বিশাল থাকলে এইসব টেকনিক্যাল টার্ম ঠিক বুঝতে পারত।

“না, বিশালও বুঝতে পারত না। বুঝতে পারেনি। তার জন্য লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তোমাদের এখানে বিজ্ঞান অত উন্নত নয়। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনে তোমরা শুধু তথ্য পাঠাতে পারো। কোনও ভরকে নাড়ানোর সাধ্য নেই তোমাদের টেলিপোর্টারের। কিন্তু আমাদের আছে। সে যাক, আমাদের উন্নত প্রযুক্তির কথা পরে হবে। আগে বিষয়টা পরিষ্কার করে বলি।

“নাসা একটা প্রজেক্ট শুরু করেছিল। এলিয়েন সার্চিং। ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধান। প্রফেসর নির্মল ভট্টাচার্য সেই প্রজেক্টের একজন অন্যতম বিজ্ঞানী। এলিয়েনের সন্ধান উনি পেয়েছিলেন কি না কেউ জানে না। কিন্তু মুনের ম্যাগনেটিক ফিল্ডে এমন পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে যার ফলে এখানকার সমস্ত স্যাটেলাইটগুলো অচল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। নির্মল ভট্টাচার্য এই মর্মে আবেদন করে ওই প্রজেক্টের কাজ স্থগিত করিয়ে দেন। ওই প্রজেক্টের চারজন বিজ্ঞানীই মারা যান। নির্মল ভট্টাচার্য বিপদ আঁচ করেই পালিয়ে যান। তারপর ঘুরতে ঘুরতে নিজের পৈতৃক ভিটেতে এসে পড়েন।”

“কিন্তু কেন? প্রোজেক্ট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে বিজ্ঞানী খুনের সম্পর্ক কী?”

“একদল দুষ্কৃতী একটা প্রাইভেট সংস্থা থেকে ওদের নিজেদের কিছু বিজ্ঞানী দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে একটা আনইভেন ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্পেসে পেয়েছিল। এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড শুধু মুনে নয়, মার্সের কাছাকাছি আরও একটা। আর কিছুদিন পর সেই ফিল্ড পৃথিবীর বেশ কাছ থেকেই অনুভূত হতে থাকে। কিন্তু এর জন্য স্যাটেলাইটের যেটুকু পরিবর্তন তা খুবই নেগলিজেবল। হয়তো একদিন ইন্টারনেট পরিষেবা চালু রইল না। একদিন হয়তো ফেসবুক, হোয়াটস-অ্যাপ, গুগল ঠিকমতো কাজ করল না। তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যায়। আর সেই নতুন ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কোনও অস্তিত্ব আর পান না ওই বিজ্ঞানীরা। কিছু একটা পৃথিবীতে ল্যান্ড করেছে, যার সঙ্গে ওঁরা যোগাযোগ করতে পারছেন না। ওদের ধারণা হয়, নাসার পাঁচ বিজ্ঞানী ওই ফরেন মাসের সঙ্গে টেলিপোর্টে বার্তা আদানপ্রদান করেছেন।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে শুভমের মুখটা হাঁ হয়ে গিয়েছিল।—কী আশ্চর্য! এলিয়েন? ওর সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা এলিয়েন? ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওর।

“অত চমকিও না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।”

ওয়ানের ওই কথাটা শুনে শুভম একেবারে কেঁপে উঠেছিল।

“আহ্‌! চমকালে শুনবে কী করে?” নির্মলজেঠু একবার ধমক দিয়েছিলেন।

শুভম কাঁচুমাচু স্বরে বলেছিল, “আমি যা ভাবছি অবিকল কী করে ওরা বলতে পারছে? একবার নয়, এই নিয়ে দু-বার। যা ভাবছি একেবারে হুবহু সেই কথাই বলছে।”

এবার জিরো উত্তর দিয়েছিল, “আমাদের মধ্যে কোনও ভাষা ছিল না। এখনও নেই। পৃথিবীতে এসে ভাষা শিখেছি আমরা।”

“সে কি? তাহলে তোমরা কথা বলো কী করে?”

“পৃথিবীতে আসার আগে কথা বলতাম না তো। যা কিছু প্রয়োজন মন পড়ে নিতাম একে অপরের। থট রিডিং বা মাইন্ড রিডিং বলতে পারো। তাই তুমি কী ভাবছ তা আমাদের ট্রান্সমিটারে চলে আসছে। তবে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে হলেই। না-হলে আমরা কিছুই রিসিভ করতে পারি না। এখন আর ক’দিন এটুকু পারব তাও সন্দেহ।”

“কেন? পারবে না কেন?”

“আমার অ্যাডাপ্টরটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কত জরুরি কলকব্জা যে খুলে যাচ্ছে। এই দেখো না এখানে একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড ছিল—খুব শক্তিশালী একটা চুম্বক। সেরকম চুম্বক এখানে পাওয়াও যায় না।”

শুভম পকেট থেকে ওর কুড়িয়ে পাওয়া চুম্বকটা বার করতেই সেটা গিয়ে জিরোর শরীরে আটকে গেল। জিরো, ওয়ান দুজনেই খুশি হয়েছিল খুব।—“যাক, তুমি এটা কুড়িয়ে পেয়েছ ভাগ্যিস! আরও কত যে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে!”

“এবার বাকিটা আমি বলছি।” ওয়ান বলল কথাটা।—“আমরা আসলে এই পৃথিবীকে যখন আমাদের টেলিস্কোপে খুঁজে পেয়েছিলাম তখন আমাদের গবেষণাগারে যে মহাকাশ যন্ত্র তৈরি হয়েছে ওতে চেপে আমরা দুজন পৃথিবীতে আসি। মি. ভট্টাচার্যের স্যাটেলাইটে ধরাও পড়েছিলাম আমরা। কিন্তু আমাদের কিছু হিসাবে ভুল ছিল। ওখানে কয়েক ঘণ্টা তোমাদের এখানে কয়েক যুগ। তাই আমরা পৃথিবীকে যে-সময় প্রথম দেখে এখানে আসব স্থির করেছিলাম, আর এই এখনের পৃথিবী একেবারেই আলাদা। দূষণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আমাদের বিজ্ঞানীদের কল্পনাতেও ছিল না যে তোমাদের এখানে মোবাইল রেডিয়েশনে আমাদের কমিউনিকেটর খারাপ হয়ে যেতে পারে। আমরা কোনও সিগন্যাল দিতে পারলাম না আমাদের গ্রহে। ধীরে ধীরে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টারটা খারাপ হয়ে গেল। যতবার সারাতে চাইলাম এমন ভুলভাল সিগন্যাল চলে গেল যে যেখানে যেখানে সিগন্যাল গেল সেখান থেকে কোনও মানুষ বা যে-কোনো প্রাণী টেলিপোর্ট হয়ে প্যারালাল ইউনিভার্সে রাখা আমাদের মহাকাশযানের ভেতর হাইপার স্লিপে চলে গেল।”

জিরো শুভমকে বলল, “তোমাদের বাড়ির হাঁসগুলোকে তো শুধু দেখছিলাম আমি। আর ওয়ান আমাকে সিগন্যাল পাঠাতে গিয়ে সবক’টা হাঁস একেবারে গভীর ঘুমে অন্তরীক্ষে অদৃশ্য হয়ে গেল। এই ডিমগুলো তবে থেকে সামলাচ্ছি আমি।”

“এগুলো আমাদের বড়োপুঁটি ছোটোপুঁটিদের ডিম?” শুভমের চোখ ফেটে জল এল। ও কেঁদে বলল, “আর কি কারও ঘুম ভাঙবে না? কেন, কেন তোমরা এ-কাজ করলে? কেন সিগন্যাল পাঠাতে গেলে? কেন? কেন?”

নির্মলজেঠু এবার কথা বললেন আবার।—“তোমার যেমন বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। তাড়া না থাক নিদেনপক্ষে ইচ্ছে তো থাকে? ওদেরও তো বাড়ি ফিরতে হবে। তাই না?”

শুভম এবার কান্না থামিয়ে বলল, “আচ্ছা, ওরা বাড়ি ফিরে যাক। কিন্তু আমিও সবাইকে ফেরত চাই। বাবা, বিশাল, বড়োপুঁটি, ছোটোপুঁটি, জগা, সতুর ঠাকমা সবাইকে।”

“হ্যাঁ, সেই জন্যই তো এই নতুন নোটপ্যাডে আমি কিছু কোডিং করেছি। যেটা ভাঙতে পারলে ওদের কমিউনিকেটরটা ঠিক হয়ে যাবে।”

“আর একবার আমাদের কমিউনিকেটর ঠিক করতে পারলে আমরা টেলিপোর্টারটা নিজেরাই দ্রুত ঠিক করে নিতে পারব।” জিরো বলেছিল কথাগুলো।

শুভম জেঠুকেই জিজ্ঞাসা করেছিল, “জেঠু, তাহলেই সবাইকে ফেরত পাব?” শুভম মরিয়া খুবই।

“আমরাও চাই সবাই ফেরত আসুক। অত ভর নিয়ে তো যন্ত্রটাকে নিয়ে যেতেই পারব না। আমাদের কোয়ান্টাম বিজ্ঞান তোমাদের থেকে উন্নত অনেক। আমরা সবাইকে হাইপার স্লিপ থেকে টেলিপোর্ট করে এখানে পাঠিয়ে দেব।”

“সেক্ষেত্রে কি অনেক সময় লাগবে? আমি শুনেছি অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে এক-একটা গ্রহ-নক্ষত্র।”

“না। ওদের এখানে আসতে সময় লাগবে না। আমাদের নিজেদের বাড়ি পৌঁছতে সময় লাগবে। ওরা তো কোনও দূর গ্রহে নেই। এই পৃথিবীর কাছেই আছে ওরা।”

“শুধু কাছে নয়, পৃথিবীর মধ্যেই আছে ওরা।”

“তাহলে এই যে পুলিশ-দারোগা সমস্ত চন্দ্রকোনা, সোনাডাঙা সব তন্নতন্ন করে খুঁজছে। ওরা পায়নি কেন?”

“ওরে অন্তরীক্ষে কি পুলিশে খুঁজে পাবে? বরং ভালো হল ওই ক্যাপ্টেন লোকটা ও তার দলবল ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। ওদের ইচ্ছে ছিল এলিয়েন দুটোকে ধরে কোনও গবেষণা সংস্থাকে বেচে দেয়। আমার প্রাণ থাকতে তা হতে দেব না আমি।”

“এখানে এসে আরও একটা অনুভূতি হল আমাদের।” জিরো বলেছিল।

“কী?”

“ঋণী হওয়ার অনুভূতি। আপনি আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আপনার কাছে ঋণী আমরা।”

ওদের কথা শুনে শুভমের ইচ্ছে হল একটা প্রণাম করে নির্মলজেঠুকে। ও প্রণাম করলও।

“থাক, থাক। এসব পরে হবে। ওই অ্যাডাপ্টর পুরো খারাপ হয়ে গেলে জিরোকে বাঁচানো যাবে না। আর ওয়ান একা ওই টেলিপোর্টার ঠিক করতে পারবে না। এক ছুটে বাড়ি গিয়ে ডায়েরিটা এনে দাও তো আমাকে।”

শুভম বেরোতে যাবে এমন সময় নির্মলজেঠু বলল, “নাহ্‌! চলো একসঙ্গেই সবাই যাই। তোমার বাড়ি গিয়ে ওখান থেকে ডায়েরিটা নিয়েই আসি।”

সতেরো

শুভমের বাড়ি থেকে চাবিটা এনে ড. নির্মল ভট্টাচার্য সোজা তাঁর ল্যাবে চলে গেলেন। ওদিকে জিরোর অবস্থা শোচনীয়। ফ্যালফ্যাল চোখে ওয়ান তাকিয়ে রয়েছে। আর এদিকে রাইচরণবাবু নির্মলজেঠুর খোঁজে আবার সমস্ত বাহিনীসহ পরিমল-স্যারের বাড়িতে এসেছেন। পরিমলস্যার নিজে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে সাহায্য করছেন। কিন্তু কিচ্ছু পায়নি এখনও পুলিশ সন্দেহ করার মতো। শুভমও স্যারের বাড়িতেই আছে। ওর তীক্ষ্ম দৃষ্টি যাতে মাটির তলায় বেসমেন্টের সন্ধান ওঁরা কেউ না পান।

রাইচরণবাবু ঠাকুরদালানে উঠতে গেলে শুভম বলে, “কাকাবাবু, মায়ের মন্দির এখানে। জুতো পরে ওঠা কি ঠিক হবে?”

আসলে ওর ইচ্ছে ছিল না একদমই কেউ নির্মলজেঠুর ঘরে ঢোকে। রাইচরণবাবু একটু থমকে দাঁড়ালেন।—“কথাটা ঠিকই বলেছ। কিন্তু পুলিশ জুতো খুলে তো সার্চ করতে ঢোকে না। এমন নিয়ম নেই বাবু।”

“তাহলে মায়ের মন্দিরে জুতো পরে উঠবেন?”

“হুঁ! বিষয়টা ভাবার। কিন্তু ওই ঘর না খুঁজে যাই কী করে?”

শুভম মনে মনে হাসে। ওই ঘরে কি যারা অদৃশ্য হয়ে গেছে তারা আছে? কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য গম্ভীর হয়ে যায় ও। অন্তরীক্ষ মানে কী? সেটা তো এখানেও হতে পারে। ওই ঘরেও। মহাশূন্যের যে-কোনো জায়গাই কি অন্তরীক্ষ?

বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না। রাইচরণবাবু বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “পরিমলবাবু, অন্য কোনও দরজা আছে কি? বাইরের দিক থেকে? ওই ঘরে ঢোকার?”

শুভম এবার ভয় পেল। সেই ট্র্যাপ ডোর দিয়ে বেরিয়েছিল ও। একেবারে বটগাছের সামনে এসে পড়েছিল। ওরা সেই দরজা দিয়ে সটান নীচে চলে যাবে না তো? হয়তো সবে কোডগুলো ভাঙা শুরু হয়েছে। এখন পুলিশ গিয়ে সমস্ত কিছু তছনছ করে দেবে নিশ্চিত। ও মনে মনে মা কালীর কাছে প্রার্থনা করল।

কিছুক্ষণ পরে নির্মলজেঠুর ঘরে জুতোর মশমশ শব্দ পেয়ে একছুটে বাইরে বেরিয়ে দেখল, ওই ঘরটার আরও একটা দরজা বাইরের দিকেই আছে। শুভম আগে কখনও খেয়াল করেনি এই দরজাটা।

দরজার বাইরেই ও দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে পুলিশ খানাতল্লাশি করছে। ঠিক যেরকম সেদিন ওই দুষ্ট লোকগুলো করেছিল। তবে এক্ষেত্রে ওদের উদ্দেশ্য ভালো। হারিয়ে যাওয়া সবাইকে খুঁজে বার করা। কিন্তু আসল কাজ ঘরের নীচে হচ্ছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল। ঘর থেকে ওরা বেরোচ্ছে না কেন? উঁকি দেবে কি না ভাবছে ও। এর মধ্যেই খুব গম্ভীর মুখ করে এক এক করে সবাই বেরোতে লাগলেন। সব শেষে রাইচরণবাবু। খুব ক্লান্ত-বিধ্বস্ত তিনি। শুভমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাও, ভেতরে যাও তুমি। নিজে চোখেই দেখো। কী আশ্চর্য!”

ভারী বুটের আওয়াজ ওর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ও ভেতরে ঢুকে দেখল বাবা লেপে মুড়ি দিয়ে বসে চোখ কচলাচ্ছেন। ওকে দেখেই একগাল হেসে বলল, “আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। তোমার মা বলল, অনেকক্ষণ পড়তে গেছ তুমি। তা আমি কি তোমাকে খুঁজতে এখানে এসেছি? ঘুমিয়েই-বা পড়লাম কী করে এখানে? আশ্চর্য তো!”

আঠারো

uponyas84 (7)

অবাক হওয়ার আরও অনেকটাই বাকি ছিল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ভোর হয়ে গেল প্রায়। বাড়িতে এসে দেখল উঠোনে হাঁসগুলো সব চরে বেড়াচ্ছে। বড়োপুঁটি, ছোটোপুঁটিও রয়েছে ওদের মধ্যে। সতুর ঠাকুমা এই ভোর রাত্তিরে মায়ের কাছে নারকোল কুড়াবে বলে একটা কুড়ুল ধার চাইতে এসেছে।

শুভম এবার প্রাণ খুলে হাসল। সব ঠিক হয়ে গেছে তাহলে? সবাই অন্তরীক্ষ থেকে ফিরে এসেছে? আর জিরো, ওয়ান? ওরা কি ফিরে যেতে পেরেছে? ওরা কি এখন বাড়ির দিকে?

ওর বন্ধু বিশাল? ও নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে এসেছে। শুভম একবার ভাবল বাবার মোবাইল থেকে ফোন করবে বিশালের বাড়িতে। তারপর ভাবল, বিশালের বাড়ি গিয়ে নিজে চোখেই বন্ধুকে দেখে আসবে। এখন আর বিশালের প্রতি সেই সমীহ ভাবটা নেই। বিশাল তো ওর বন্ধু। বন্ধুদের ভালোবাসা যায়, সমীহ করার প্রয়োজন আছে কি? বিশালের বাড়ি যাবে বলেই সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ও। মা-বাবাও কেমন নিশ্চিন্ত। কেউ বাধা দিল না ওকে।

যদিও ভোর হয়ে এসেছে তবুও আকাশের দিকে তাকিয়ে শুভমের মনে হল, রাতের আকাশের সবক’টা তারা এখনও মিলিয়ে যায়নি। আচ্ছা, অন্তরীক্ষ তো ওই আকাশেও থাকতে পারে। জিরো আর ওয়ান কি এখন নিজেরাই অন্তরীক্ষে? ওখান থেকেই কি ওদের বাড়ি ফেরার পথ? বিশালের বাড়ি থেকে ফেরার পথে ও আর-একবার নির্মলজেঠুর বাড়িতে যাবে। ওর সব প্রশ্নের উত্তর কি জেঠু ওকে দেবেন?

uponyas84 (8)

অলঙ্করণ- মৌসুমী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s