ভ্রমণ-হল্যান্ডে খ্রিস্টমাস-শ্রাবণী চক্রবর্তী-বর্ষা ২০২২

এই লেখকের আগের ভ্রমণপ্যাংগং-এ কিছুক্ষণ

bhromonHolland E Christmas01

আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগেকার কথা। তখন আমরা হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে থাকতাম। নভেম্বরের মাঝামাঝি, ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। শনিবারের সকালবেলা। নিয়মমতো আমরা তিনজনে সাপ্তাহিক বাজার করতে যাচ্ছি। এমন সময় রাস্তায় দেখি কিছু লোক কুচকুচে কালো রঙ গায়ে মেখে, মাথায় লাল অথবা হলুদ টুপি পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরনে তাদের সাদা লেসের কলার দেওয়া নীল-হলুদ বা লাল-কালো ডোরাকাটা জমকালো জামা। টুপির সঙ্গে রঙ মিলিয়ে মোজা। কালো জুতো, টুকটুকে লাল ঠোঁট আর কানে ইয়া বড়ো বড়ো গোল গোল রিংয়ের মতো দুল। দুলগুলোর সাইজ দেখে মনে হয় হাতের বালা। কাঁধে তাদের বিরাট এক ঝোলা। একটু অবাক হয়ে গেলাম। তারপরই ভাবলাম, এরা তো উৎসবের দিনে মাঝেমধ্যেই রঙচঙ মেখে নানারকম সাজগোজ করে, তারই কিছু একটা হবে বোধহয়। কিন্তু কী উৎসব? বড়দিন তো এখন অনেক দেরি। তাহলে? এমন সময় দেখি বাচ্চারা রাস্তায় এই লোকগুলোকে দেখে হইহই করে উঠছে। আর লোকগুলোও ততোধিক খুশি হয়ে ঝোলা থেকে চকোলেট, লজেন্স বিস্কুট বের করে দিচ্ছে। বাচ্চাগুলো সেগুলো নিয়ে কলরব করতে করতে চলে যাচ্ছে। সোমককেও একজন ডাকল। কিন্তু ও কিছুতেই যাবে না। লোকটা তখন নিজেই কাছে এসে ক’টা বিস্কুট, লজেন্স ওর হাতে গুঁজে দিয়ে চলে গেল। মজা লাগল বেশ। এর মধ্যে একটা দোকানে ঢুকলাম কিছু জিনিস কিনব বলে। ও বাবা, এ কী! দোকানের ভোলই পালটে গেছে। এখানেও দেখি ওই কালো লোকগুলো। সোমককে দেখেই একজন কোলে বসিয়ে একটা ছবি তুলে নিল। হাতে আবার কিছু লজেন্স, চকোলেট দিল। পরের দিন এসে ছবিটা নিয়ে যেতে বলল।

দোকান থেকে বেরিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে এগোচ্ছি। হঠাৎ ‘হ্যালো, হ্যালো’ ডাকে ফিরে দেখি আমাদের প্রতিবেশী এক মহিলা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমাদের ডাকছে। সে সোমককে ডেকে নিয়ে গেল তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। সেই কালো লোকদের সঙ্গে বসিয়ে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলল। সুযোগ বুঝে ওকেই জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপারটা কী হচ্ছে বলো তো?”

আমার প্রতিবেশী বলল, “এটা হচ্ছে সিনটারক্লাস উৎসবের শুরু। বলতে পারো এটা আমাদের ক্রিসমাস উৎসবও। বাচ্চাদের উপহার দেবার সময় এটা।”

অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করি, “তাহলে ২৫শে ডিসেম্বর কী করো তোমরা?”

সে বলল, “২৫শে ডিসেম্বর চার্চে যাবার দিন। বছরে ওই একদিনই। আর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হবার সময়ও সেদিনটা।”

নিজে থেকেই বলল সিনটারক্লাসের গল্পটা এইরকম—

৫ই ডিসেম্বর নিজের জন্মদিনে দক্ষিণের স্পেন দেশ থেকে নৌকা করে হল্যান্ডে আসেন সিনটারক্লাস। যে-সমস্ত বাচ্চারা সারাবছর খুব ভালো হয়ে থাকে, দুষ্টুমি করে না, পড়াশোনা করে—তাদের তিনি উপহার দেন নিজের জন্মদিন উপলক্ষে। রাত্রে শোবার সময় রান্নাঘরে চিমনির গোড়ায় একটা জুতো, একটা গাজর এবং এক গ্লাস জল রেখে দিতে হবে। সিনটারক্লাস ঘোড়ায় চড়ে রাত্রে ঘুরবেন; রাতের অন্ধকারে চিমনি দিয়ে এসে জুতোর মধ্যে উপহারটা রেখে দেবেন আর সিনটারক্লাসের ঘোড়া কিছুটা জিরিয়ে নেবে গাজর আর জল খেয়ে। এই যে কালো লোকজন, এদেরকে বলা হয় সোয়ার্তে পিট (Zwarte Piet)—সিনটারক্লাসের অনুচরের দল। এরা সিনটারক্লাসের আগমনবার্তা আগাম নিয়ে চলে এসেছে। ৫ই ডিসেম্বর সারাটা দিন ঘুরে-টুরে ৬ই ডিসেম্বর আবার স্পেনে ফিরে যাবেন অনুচরবর্গ সহ।

এদিকে কর্তা অফিস থেকে ফিরে এসে বলল, ওদের অফিসেও সিনটারক্লাস উৎসব হবে তার এক কলিগ রেনে ফান রোই-এর বাড়িতে। লটারি করে ঠিক হয়েছে আমরা দুজন অন্য দুজনের জন্য দুটো গিফট কিনব। যাদের দেব তাদের সম্বন্ধে ছড়া লিখে নিজের নাম না দিয়ে গিফটের প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিতে হবে। সব নিয়ে রেনের বাড়িতে ৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যাবেলায় যেতে হবে।

পরের দিন সেন্ট্রাল মার্কেটের দোকানে গেলাম গিফট কিনতে। আবার চমক। প্রতিটি দোকানে দেখি ভিড়ে থিকথিক করছে। বিশেষত খেলনার দোকানগুলোতে প্রায় সমস্ত খেলনার দাম অর্ধেক হয়ে গেছে। কোনো-কোনো দোকানে আবার সিন্ট ও পিটদের মডেল করে দেখানো হয়েছে কী করে বাচ্চারা চিমনির ভিতর দিয়ে গিফট পায়। বাচ্চারা ভিড় করে অত্যুৎসাহে সে-সব দেখছে। মনে পড়ছে কলকাতার দুর্গাপুজোর কথা। যাই হোক, ফিরে এসে সেই রাতেই বসলাম নিজেদের কবিত্ব জাহির করতে। দিন নেই, রাত নেই কবিতার ছন্দ মেলানো চলছে। কিছু একটা খাড়া হল শেষে।

৫ই ডিসেম্বর সোমককে নিয়ে স্কুলে গেলাম। গিয়ে দেখি রীতিমতো হইচই কাণ্ড। ছাত্রছাত্রী, তাদের বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেই লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে স্কুলে ঢোকার মুখে বিশাল হল-ঘরে। আমিও খুঁজে নিয়ে আমার কয়েকজন পরিচিত বন্ধুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনলাম, সিনটার আজ স্কুলে আসছেন। দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফিরে ক্যামেরা নিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোয়ার্তে পিটরা এসে গেল লজেন্স ও বিস্কুটের হরির লুট দিতে দিতে।

bhromonholland02

সিনটারক্লাস এলেন কিছুক্ষণ পরে—দুধে-আলতায় গায়ের রঙ, সাদা ধবধবে চুল, লম্বা সাদা দাড়ি, মাথায় লাল টুপি ও তাতে সোনালি রঙের ক্রস। এক হাতে সোনালি দণ্ড, আরেক হাতে বাইবেল। পরনে সাদা আলখাল্লার ওপর লাল আলোয়ান।

সিনটারক্লাস উৎসব উপলক্ষে বাচ্চারা স্কুলে বসেই দিন ছয়-সাতেক আগে থেকে টুপি, ফ্ল্যাগ, কাগজের সিনটারক্লাস তৈরি করে রেখেছিল। সিনটারক্লাসের বিভিন্ন গান শেখানো হয়েছিল। বাচ্চারা সেইসব গান গেয়ে শোনাল। তিনিও বাচ্চাদের গল্প শোনালেন। এতক্ষণ ক্লাস রুমের দরজাগুলো বন্ধ ছিল। এরপর প্রত্যেক ক্লাসের শিক্ষক বা শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ক্লাস রুমের দিকে গেলেন। আমরাও পেছন পেছন গেলাম। গিয়ে দেখি অন্ধকার ঘরের কোণে চিমনি আর তাতে মিটমিটে আগুন জ্বলছে আর সামনে তাদের জুতোর সারি। আধখানা গাজর ও একটা খালি গামলা পড়ে রয়েছে। টেবিল-চেয়ারগুলো সাজিয়ে নৌকার মতো করা। সারা ঘরে হল্যান্ডের ও স্পেনের পতাকায় ভরা। আগেরদিন বাচ্চাদের দিয়েই সমস্ত কিছু সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। এদিকে আধখানা গাজর আর খালি গামলা দেখে বাচ্চারা নিশ্চিত যে সিনটার এসেছিলেন রাত্রে। এবার জুতোর ভেতর দেখতে গিয়েই দেখে ঠিক তাই—গিফট রয়েছে। ওদের আর আনন্দ ধরে না। সবাই মিলে গান ধরল, ‘Dank u Sinterklaas’—ধন্যবাদ সিনটারক্লাস। অঙ্গীকার করল সামনের বছরও ভালো হয়ে থাকার। সিনটারও বললেন, সবাই ভালো হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই আবার এসে সবাইকে উপহার দেবেন। সিনটারকে এরপর সবাই মিলে বিদায় সম্ভাষণ জানাল, ‘Dag Sinterklaas’—‘বিদায় সিনটার’ গান গেয়ে। সেদিন আর কিছু হল না। বাড়ি ফিরে এসে সব ঘটনা জানালাম। সবাই উপভোগ করল। এরকম অভিজ্ঞতা তো এই প্রথম।

bhromonholland04

সন্ধ্যাবেলা আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে, রেনেদের বাড়ি। ওরাও সিনটারক্লাস উৎসব পালন করবে। একটু অবাক হয়ে ভাবছিলাম কী হবে ওখানে।

সন্ধ্যাবেলা আমরা পৌঁছলাম। অনেকেই ততক্ষণে পৌঁছে গেছে। বেশ হইচই চলছে, গুলতানি হচ্ছে, বাচ্চারাও নিজেদের মতো খেলায় মত্ত। শুনলাম ট্র্যাডিশনাল ডাচ খাবারের আয়োজন হয়েছে। এদিকে রেনের বাড়িতে ঢোকার মুখেই দরজার পাশে দুটো বড়ো বড়ো ঝোলা রাখা ছিল। সেখানে সবাই ঢুকেই গিফটগুলো ফেলে দিচ্ছিল, কাউকে কিছু না জানিয়েই।

খাওয়াদাওয়ার পর সিনটারক্লাসের ঝোলা নিয়ে বসা হল। বাচ্চারা এবার ঝোলা থেকে প্যাকেটগুলো বের করে একে একে নাম ধরে ডাকছে; যার নামে গিফট সে প্যাকেট খুলে কবিতাটা সর্বসমক্ষে পড়ে শোনাচ্ছে। কবিতাগুলো বেশিরভাগই সারাবছরের কাজকর্ম নিয়ে ক্যারিকেচার করা। অতএব বোঝাই যায়, কবিতাগুলো পড়তে পড়তে হাসির ফোয়ারা উঠছে। যাই হোক, খুব আনন্দ করে রাতে ফিরলাম।

bhromonholland03

ফিরে কিন্তু আরও একটা কাজ বাকি আমাদের। চিমনির কাছে সোমক একপাটি জুতো, একটা গাজর এবং এক গামলা জল রেখে শুতে গেল।

পরের দিন সকালে উঠে আমরা সকলেই অবাক—সিনটার সত্যিই একটা দারুণ গিফট রেখে গেছেন। আসলে সোমক তো খুব ভালো ছেলে এবং সারাবছর খুবই ভালো হয়ে ছিল। সবার কথা শুনেছে, পড়া করেছে, তাই সিনটার খুব খুশি হয়ে বাড়িতেও গিফট দিয়েছেন।

 ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s