ভ্রমণ-প্যাংগং-এ কিছুক্ষণ-শ্রাবণী চক্রবর্তী-বসন্ত ২০২২

SAMSUNG
SAMSUNG

কিছুদিন আগে খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেল খুললে যে খবরটা সবার নজর কাড়ত, তা হল লাদাখ, প্যাংগং লেক, ভারতীয় সেনা, চিনা আগ্রাসন ইত্যাদি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, লাদাখ বা প্যাংগং লেকের সঙ্গে যুদ্ধ, গোলাবারুদ কেমন যেন বড়োই বেমানান। আচ্ছা, আপনাদের মনে আছে, ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমার কথা? একটু ধরিয়ে দিই, সিনেমাটার প্রায় শেষের দিকে করিনা কাপুর ছুটে চলেছে রাস্তা দিয়ে, তার একপাশে সুদীর্ঘ অতল জলরাশি। হ্যাঁ, এবার ঠিক ধরেছেন, এটিই লাদাখের সেই বিখ্যাত প্যাংগং লেক।

লেহ শহর থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে এই লেক। পাহাড়ি রাস্তা, তাই যেতে সময় লাগে প্রায় সাত-আট ঘণ্টা। তার ওপর বেলা বেড়ে গেলে বরফ গলতে থাকে। ফলে বরফগলা জলে পুষ্ট ঝোরাগুলো তখন ভয়ংকর রূপ ধরে রাস্তার ওপর নেমে এসে রাস্তার দুর্গমতাও বাড়িয়ে দেয়। তাই আমরা ঠিক করলাম ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ব। সময় ঠিক হল পরেরদিন সকাল ছ’টা। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ও গাইড গালশান আগেরদিনই দেখা করে কিছু নির্দেশ দিয়ে গেল। রাস্তায় কোনও খাবার পাওয়া যাবে না, তাই হোটেল থেকেই সবার জলখাবার প্যাক করে নেওয়া হল।

পরেরদিন ঠিক ছ’টায় আমরা রওনা হলাম। অন্ধকার ঘুটঘুট করছে চারদিক। সেই সঙ্গে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠান্ডা। কে বলবে আগস্টের মাঝামাঝি এটা? গাড়ির সব কাচ তুলে দিয়ে আমরা লেহ-মানালির রাস্তা দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। সেই আলো-আঁধারির মধ্যে দিয়ে সিন্ধু উপত্যকা অতিক্রম করে পৌঁছলাম কারু গ্রামে। পাহারে ঘেরা ছোটো জনপদ এটা। মিলিটারি কিছু অফিস, ক্যাম্প আছে এখানে। আর এটাকে ঘিরেই এই জনপদ। এখান থেকেই মিলিটারির অনুমতি নিয়ে প্যাংগংয়ের রাস্তা ধরতে হল। গাড়ি হু হু করে এগিয়ে চলেছে। একের পর এক ছোটো ছোটো পাহাড়ি জনপদ অতিক্রম করে যাচ্ছি। এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল বেশ কম। মাঝে মাঝে শুধু বিকট আওয়াজ করে মিলিটারি ট্রাক ও এক-আধটা পর্যটকের গাড়ি ছাড়া আর কোনও গাড়ি চোখে পড়ছে না।

ক্রমে পৌঁছলাম চাংলা পাসে। প্রসঙ্গত বলে নিই, এই পাসটা হচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ গাড়ি যাবার রাস্তা। সময় সকাল আটটা। অল্প অল্প আলো ফুটেছে, কিন্তু রোদ্দুর ওঠেনি। বরং হালকা কুয়াশার চাদর চারদিকে বিছানো রয়েছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং শনশন করে বাতাস বইছে। সোয়েটার, মোটা জ্যাকেট পরেও কাঁপুনি থামানো যাচ্ছে না।

bhromonpangong02

পাসের ওপর একটামাত্র দোকান। সবেমাত্র খুলছে। আমরা তারই ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। দোকানের জানালা দিয়ে সামনেই দেখা যাচ্ছে চাংলা বাবার মন্দির। ইতিউতি বরফের চাঙড় পড়ে রয়েছে। যেদিকে তাকাই, পাহাড়ের চূড়া।

bhromonpangong03

এখানকার পাহাড় সব ন্যাড়া। গাছপালার কোনও চিহ্নমাত্র নেই। শুধু এদিক ওদিক কিছু ছড়ানো বরফ। কিছু দূরে দেখি একজন লাদাখি লোক গাধার পিঠে চামড়ার ব্যাগে করে জল বয়ে কাছাকাছি মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। গরম গরম চা খেয়ে আমরা আবার রওনা হলাম।

কিছু দূর এগোবার পরই হঠাৎ গালশানের কথায় বাইরে দেখি রাস্তার পাশের জমিতে শ’য়ে শ’য়ে বাদামি রঙের প্রাণী। প্রায় সবাই জোড়ায় জোড়ায় দাঁড়িয়ে। লম্বায় প্রায় দেড় থেকে দু-ফুট। প্রত্যেকেই একটা গর্তের কাছে দাঁড়িয়ে। আমাদের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম সবাই গর্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। গালশানের কাছে জানলাম প্রাণীটার নাম মারমট। লাদাখের বিভিন্ন অঞ্চলেই এদের দেখা যায়। এদের আচরণ নাকি খুব মজার। গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে দু-পাশে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়, পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আর কোনও বিজাতীয় শব্দ পেলেই সোজা গর্তের ভিতর ঢুকে যায়। আমরা একটিমাত্র মারমটকেই পেয়েছিলাম ফটো তোলার জন্য। বাকিরা সবাই তখন গর্তের ভিতর।

bhromonpangong04

এখানে পাহাড়গুলো ন্যাড়া ঠিকই, কিন্তু দুটো পাহাড়ের মাঝে অনেক সময়ই সবুজ উপত্যকা দেখা যায়। আর সেই সবুজ তৃণভূমিতে চরে বেড়ায় বিশাল আকৃতির চমরীগাই। কুচকুচে কাল এদের গায়ের রঙ, লোমশ চামড়া। আর মাথায় বড়ো বড়ো দুটো শিং। এরা সাধারণত দলে থাকে এবং তার সদস্য সংখ্যা প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ। এমনিতে এরা বেশ শান্ত প্রাণী। কিন্তু ক্ষেপে গেলে মারাত্মক রূপ ধারণ করে।

bhromonpangong05

এভাবে চলতে চলতে কখন যে আরও দু-ঘণ্টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। আলথাক লেক, টাংসা জনপদ পেরিয়ে প্রায় বারোটা নাগাদ পৌঁছলাম প্যাংগং লেকের ধারে। বিস্ময়াবিষ্ট আমরা। পলক পড়ছে না কারোরই। চোদ্দ হাজার চব্বিশ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই লেক দেড়শো কিলোমিটার লম্বা ও তিন থেকে ছয় কিলোমিটার চওড়া। এই লেকের অর্ধেকটাই আমাদের দেশের সীমার বাইরে। রোদ ঝলমলে দিনে এর জলের রঙ উজ্জ্বল নীল। আকাশের নীল তখন জলের সঙ্গে মিশে যায়।

bhromonpangong06

লেকের একদিকে শুধুই পাহাড়। পাহাড়গুলো সম্পূর্ণভাবে ন্যাড়া, কোনও গাছপালার চিহ্নমাত্র নেই। বেশিরভাগ পাহাড়গুলোর গা মসৃণ। এরা আবার নানা রঙের। কোনোটা তামাটে, কোনোটা কালো, আবার কোনোটা ছাই রঙের। তার ওপর জলের ধারা যেন নানারকম আল্পনা এঁকেছে। সেই আল্পনা সমেত পাহাড় যখন লেকের জলে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে, তার সঙ্গে ঝকঝকে নীলাকাশ, তাতে সাদা তুলোর মতো পেঁজা মেঘ ও লেকের জলে ছায়া ফেলছে, তখন এক অপরূপ রূপের সৃষ্টি হচ্ছে।

bhromonpangong07

মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরির সঙ্গে জলের রঙের তারতম্য ঘটছে। কখনও তা ধূসর নীল, কখনও তা সবুজাভ নীল, কখনো-বা তা তুঁতে নীল। ক্ষণে ক্ষণে জলের এই রঙ-রূপ বদল নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছে সৌন্দর্যের। অকৃপণ হাতে প্রকৃতি তার রঙ-রূপ দান করেছে এখানে।

bhromonpangong08

হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ যেতেই দেখি রামধনু। কী অসাধারণ ব্যাপার! প্রকৃতির রঙ তখন আকাশেও ছড়িয়ে পড়েছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে একবার আকাশ, একবার জল, একবার পাহাড় দেখছি। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, আমরা যে রামধনু কলকাতার আকাশে দেখি সাধারণভাবে, এটা তার উলটো। তার মানে কলকাতার রামধনুর বাইরের দিকটা লাল আর ভেতরের দিকটা বেগুনি। লেকের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি তার ঠিক উলটো। বাইরে বেগুনি, ভেতরে লাল। কী বিচিত্র প্রকৃতির লীলা! এখানকার পাথুরে জমিতে যেহেতু গাছপালা বিশেষ হয় না, ফুল-ফল ইত্যাদিও কিছু নেই। পাখি নেই, পাখির কলরবও নেই। চারদিক নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ। যেন আলপিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। নিজেদের মধ্যেও কথা বলতে লজ্জা করছে তখন। মনে হচ্ছে শব্দ দূষণ করছি আমরা। গালশনকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম আমরা লেকের তীর বরাবর। কিলোমিটার খানেক হাঁটার পর মনে হল দূরে জলে কালোমতো যেন কিছু। গালশানকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল যে, জুন মাস নাগাদ কিছু পরিযায়ী পাখি আসে। তাদেরই দুয়েকটা এখনও আছে। কিন্তু এত দূরে তারা যে ভালো করে দেখার কোনও উপায় নেই। আরও এগোতে দেখলাম তীরের কাছে কে যেন বেগুনি-সাদা ভেলভেটের চাদর পেতে রেখেছে। কাছে গিয়ে দেখি তীরের ওই পাথুরে জমিতে একদম জমির সঙ্গে লাগোয়া ছোটো ছোটো গাছে বেগুনি রঙের গোত্রহীন ফুল ফুটে রয়েছে। পাহাড়, লেক, ফুল একসঙ্গে তখন এক মনোরম দৃশ্য। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এটাই ভাবছিলাম যে স্বর্গ বলে কিছু থেকে থাকে তাহলে নিশ্চিত এটা এখানেই।

গালশানের কাছে শুনছিলাম যে পুরাকালে এই সরোবরের একটা বহির্মুখী ধারা-রেখ ছিল বলে কথিত আছে। তখন জল ছিল আরও স্বচ্ছ, আরও পবিত্র। লাদাখি লোকজন অবশ্য এখনও বিশ্বাস করেন যে ওই ধারা-রেখ আজও বর্তমান, তবে অন্তঃসলিলা হয়ে। আমরা অবশ্য এটা দেখিনি। কিন্তু যা দেখেছি, তা কোনোদিনই ভুলতে পারব না। ভাষায় পুরোপুরি প্রকাশ করাও হয়তো সম্ভব নয়। লেকের ধারে বসে বসে গালশানের সঙ্গে গল্প করতে করতে শুনছিলাম জ্যোৎস্না রাতে প্যাংগং লেকের স্নিগ্ধ অথচ মোহময়ী রূপের কথা। কল্পনা করছিলাম শীতের পূর্ণিমার রাতে বরফে ঢাকা প্যাংগং লেকের চোখ ঠিকরানো দ্যুতির।

দেখতে দেখতে ঘণ্টা চারেক সময় কোথা দিয়ে কাটিয়ে ফেললাম বুঝতেই পারলাম না। ফেরার পথে ভারাক্রান্ত মনে বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিকে। ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম তার সৃষ্টিকর্তাকে। মনে মনে বলছিলাম, আহা, কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।

ক্রমশ পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে গেল সেই সৌন্দর্য। ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’। আজও তাই প্রায় দশ বছর পরেও চোখ বুঝলেই দেখতে পাই সেই আল্পনা দেওয়া পাহাড়ে ঘেরা স্বচ্ছ নীল জলরাশি।

যেখানে প্রকৃতির এই অপার বিস্ময় সৌন্দর্য পিপাসুর মনের আরাম, প্রাণের শান্তি, সেখানে কি সত্যিই গোলাবারুদের ধোঁয়া, ঝাঁঝালো গন্ধ, মৃত্যুর হাহা-রব প্রকৃতির শান্তিকে বিঘ্নিত করে না? হোক না এটা একটা শান্তির প্রতীক, শান্তির মুক্তাঞ্চল।

ফটোগ্রাফি- লেখক

শীর্ষচিত্র- দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

 ভ্রমণ সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s