নিলাম তত্ত্ব ঠিক কি করে বুঝতে হলে প্রথমে বোঝা দরকার এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি কী। মজার ব্যাপার হল, এই তত্ত্বটা আবার দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা বিখ্যাত তত্ত্বের ওপর, তার নাম গেম থিওরি বা গেম-এর তত্ত্ব । সত্যি বলতে কি নিলাম তত্ত্ব হল গেম তত্ত্বের এক বিশেষ শাখার প্রয়োগ।
এবার যে অবধারিত প্রশ্নটি এসে পড়ে তা হল, এই গেম-তত্ত্ব বিষয়টা আবার কি? এ তো এক তত্ত্ব কী তা বোঝাতে আরেক তত্ত্বের ব্যাখ্যান! মানেটা কি বাপু?
গেম তত্ত্ব ও পারস্পরিক নির্ভরতা
এক মহা দুষ্টু বাচ্চা আছে। বাড়িতে বাপ-মায়ের সঙ্গে যখন থাকে তখন হাজারো বায়না করে অতিষ্ঠ করে দেয়। গল্প বলো, আইসক্রিম এনে দাও, ফ্রিজের জল খাবো এমন হরেক বায়না তার। আবার ইশকুলে গেলেও তার দুষ্টুমিতে সবাই অস্থির। এর খাতা ছিঁড়ে দিচ্ছে তো ওর বইয়ে হিজিবিজি কাটছে তো আর কারুর চুল ধরে টানছে। কিন্তু ওর মা বাবা, এবং স্কুলের দিদিমণি মাস্টারমশাইরা এমনকি ওর বন্ধুরাও বুঝে গেছে ওর হাত থেকে বাঁচার উপায় কি! ও মাথা খাটিয়ে যে কোনও রকম ধাঁধা সমাধান করতে অসম্ভব ভালোবাসে – তা সে কথার ধাঁধা, অঙ্কের ধাঁধা, ছবির ধাঁধা যাই হোক না কেন, বুদ্ধি খাটানোর খেলাও তার ভারি পছন্দের, আর সেগুলো এত মন দিয়ে করে যে যতক্ষণ সমাধান না হচ্ছে ততক্ষণ শুধু ওগুলোর মধ্যেই ডুবে থাকে। ওর সব বুদ্ধি তখন কেবল ওগুলোতেই ভিড় করে, দুষ্টুমি করবার দিকে আর যায় না। সে ভালোবাসে শব্দজব্দ, ভালোবাসে সুদোকু, ট্যানগ্রাম, অরিগ্যামি, জিগস, আবার সে কাটাকুটি, দাবা, চাইনিজ চেকার, লুডো এসব খেলতেও পিছপা নয়। তাই ওর দুষ্টুমির হাত থেকে রেহাই পেতে ওকে যেকোন একটা ধাঁধা বা খেলা দিয়ে বসিয়ে দিলেই হল, যতক্ষণ ধাঁধার সমাধান বা খেলার শেষ না হচ্ছে, একেবারে নিশ্চিন্ত থাকা যেতে পারে।
একটু লক্ষ করে দেখ, এই যে দুষ্টুটা যা যা ভালোবাসে তাদেরকে দুটো আলাদা গোত্রে ভাগ করা যেতে পারে। শব্দজব্দ, সুদোকু, ট্যানগ্রাম, অরিগ্যামি, জিগস এগুলো নিয়ে খেলার জন্য আর কাউকে দরকার পড়ে না, ঠিকঠাক ভাবনাচিন্তা করে সঠিক পদ্ধতিতে এগোলে নিজে নিজেই এগুলোর সমাধান করা যায়, অর্থাৎ কেউ কী করছে কেবল সেটা দিয়েই সে এই খেলাগুলোতে জিতবে কি না স্থির হয়। কিন্তু বাকি খেলাগুলো – কাটাকুটি, দাবা, চাইনিজ চেকার, লুডো এগুলোতে অন্তত একজন প্রতিপক্ষ না থাকলে খেলাই হবে না। কাটাকুটি আর দাবাতে একজন করে প্রতিপক্ষ, লুডোতে তিনজন পর্যন্ত আর চাইনিজ চেকারে পাঁচজন পর্যন্ত প্রতিপক্ষ থাকা সম্ভব। আর এই খেলাগুলোতে শুধু তুমি কি করছ সেটা দিয়ে ঠিক হবে না তুমি জিতবে কি না, তোমার জেতা হারা নির্ভর করছে তুমি কি করছ এবং তোমার প্রতিপক্ষরা কী কী করছে এই সবটার ওপর। এটা ঐ খেলায় যারা খেলতে বসেছে তাদের সবার জন্যই এটা সত্যি, যে কারুর জেতা হারা নির্ভরশীল সবার চালের ওপর – তার নিজের এবং বাকিদের। এখানেই আসছে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার গল্প। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা না থাকলে কোনও খেলা গেম তত্ত্বের সংজ্ঞা অনুযায়ী গেম বলে গণ্য হয় না। সুতরাং, গেম তত্ত্ব অনুযায়ী লুডো, দাবা, চাইনিজ চেকার, কাটাকুটি এরা সকলেই গেম, কিন্তু শব্দজব্দ, অরিগ্যামি, ট্যানগ্রাম, সুদোকু এরা কেউই গেম নয়।
গেম তত্ত্বকে যদি কেবল খেলার তত্ত্ব ভাব তাহলে কিন্তু ভুল হবে। আমাদের রোজকার জীবনে আমরা অনেক সময়েই গেম এর অংশ হচ্ছি, বুঝে অথবা না বুঝে। এই ধরো তোমার পাড়ার বাজার, সেখানে অনেক লোকজন আসে, কেউ কিনতে আসে, কেউ বেচতে আসে, আবার কেউ তক্ষুণি না কিনে জিনিসের দাম, দ্রব্যগুণ এইসব নিয়ে খবর জোগাড় করতে আসে, যে খবরগুলো কাজে লাগিয়ে সে পরে কখনও কেনা বেচা কিছু একটা করবে, তবে এই তৃতীয় প্রকারের লোকের সংখ্যা তুলনায় কম। যারা কিনতে আসছে তারা প্রত্যেকেই চায় যতটা সম্ভব কম দামে জিনিস কিনতে, আর উল্টোদিকে যারা বেচতে আসছে তারা চাইছে বেশি দামে বেচতে।
ধরো সুজাতা কাকিমা এসেছেন পাড়ার বাজারে সব্জী কিনতে। পাপু সব্জীওয়ালার কাছে গিয়ে তিনি শশার দাম জিজ্ঞেস করলেন। পাড়ার বাজার তো আর শপিং মলের ফিক্সড প্রাইস শপ নয়, যে সেখানে আগে থেকে লেখা এক দামে ছাড়া বিক্রী হবে না! ক্রেতা জানে বিক্রেতা দাম বাড়াতে চায়, তাই সে যা দাম দেবে ভাবছে তার থেকে বেশ খানিক কম দাম হাঁকল। অন্যদিকে বিক্রেতাও ক্রেতার এই চাল বোঝে, তাই সে একটু বেশিই বাড়িয়ে দর হাঁকল। এই ভাবে ক্রেতা একটু একটু করে ওপরে উঠতে আর বিক্রেতা একটু একটু করে নীচে নামতে থাকবে। এরকম দরাদরি করে ক্রেতা এবং বিক্রেতা দু’জনে একদম উল্টো উদ্দেশ্যে একে অপরের সঙ্গে দাম নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করবে আর তাদের টানাহ্যাঁচড়ার শেষে একটা দামে এসে তারা দু’জন একসঙ্গে রাজি হলে তবেই জিনিসটা সেই দামে হাতবদল করবে। যদি কখনই দাম নিয়ে ঐকমত্য না হয়, তাহলে বিক্রীই হবে না। তাই সুজাতা কাকিমা যদি পাপুকে ২০ টাকা প্রতি কেজি শশার জন্য দিতে রাজি হয়ে যান তাহলে পাপু খুশি খুশি তাঁকে শশা বিক্রী করবে, যদিও প্রতি কেজি শশার জন্য সুজাতা কাকিমা শুরুতে ১০ টাকা আর পাপু ৩০ টাকা হেঁকেছিল। এই যে দু’ধরণের লোকের দরদাম করার মধ্যে দিয়ে দাম ঠিক হল, এও তো পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বই কিছু নয়।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। ধরো মহাশূন্যে একটা হাইড্রোজেনের পরমাণু একলাটি রয়েছে। সে একেবারে নট নড়ণচড়ণ নট কিচ্ছু। এইবারে ধরো সেখানে আরো ক’টা পরমাণু চলে এল কাছাকাছি। ওমনি এর টানে ও ছুট দিল তো তার টানে সে ছুট দিলো। ছুটতে গিয়ে কেউ কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে রাস্তা বদলাল, বদলাতে গিয়ে কেউ কারো থেকে দূরে যায় তো কেউ কারো কাছে এসে যায়। তাদের প্রত্যেকের আচরণ, অন্যেরা কী আচরণ করছে তার ওপর নির্ভরশীল; এটাকে কি গেম বলা হবে? উত্তর হল – না; কারণ এই পরমাণুগুলো নিজেরা ভেবেচিন্তে অন্যের চালচলন দেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না, তাদের ছোটাছুটি, পরস্পরের কাছে আসা বা তাদের থেকে দূরে সরে যাওয়া এই সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়ম দিয়ে। সুতরাং এটা বোঝা গেল যে গেমে যারা অংশ নেবে তাদের ভাবনা চিন্তা প্রসূত সিদ্ধান্তের সঙ্গে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা মিলে তবেই গেম তৈরি হবে, নতুবা নয়।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, যেখানেই একের বেশি মানুষ-টানুষ থাকে যাদের পাওয়া বা না পাওয়ার হিসেব পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, সেখানেই তাদের আচরণগুলো একে অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হয়। তা ঐ খুদে বিচ্ছুটার কাটাকুটি, দাবা, লুডো বা চাইনিজ চেকার খেলার সময়, কিংবা পাড়ার বাজারের সুজাতা কাকিমা বা পাপুর আচরণকে কোনো বিজ্ঞানী যদি বিশ্লেষণ করতে বসে তবে, পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপস্থিতিতে আচরণের সেই রকমফেরটাকে বিশ্লেষণ করতে হবে তাকে। এই বিশ্লেষণটারই কেতাবি নাম হল গেম তত্ত্ব।
পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কথাটা থেকে স্পষ্টই এটা বোঝা যায় যে গেম-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য অন্তত দুজনকে থাকতে হবে যারা ঐ গেমে অংশ নেবে । এই অংশগ্রহণকারীদের দুজনের চেয়ে বেশি হলেও কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু দুজনের কম হলে চলবে না মোটেই, কারণ দুজনের কম হলে কে কার ওপর নির্ভর করবে? সেক্ষেত্রে “পারস্পরিক নির্ভরশীলতা” কথাটারই তো কোনও মানে হয় না ! এই অংশগ্রহণকারীরা কোনও ব্যক্তি বা দেশ এমনকি সংস্থাও হতে পারে ।
আরেকটা গল্প বলি এখানে। ধরো পুরো দুনিয়ায় একটাই মোটে দেশ আছে। তার নাম ভারতবর্ষ। সে চলবে একেবারেই নিজের খেয়ালে। আর কোনো দেশের কথা তাকে ভাবতেই হবে না। কিন্তু সত্যি সত্যি তাই হয় কি? ভারত আছে, তাকে ঘিরে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, চীনের মত প্রতিবেশী দেশরা আছে, বিলেত আমেরিকা আছে। আজ চীন কী করল, পাকিস্তান, আমেরিকা বিলেত কী করল তার ওপর নির্ভর করে ভারতকেও নিজের কর্মপদ্ধতি সাজাতে হয়। আর শুধু ভারতই কেন? দুনিয়ার প্রত্যেকটা দেশের কার্যকলাপই কিন্তু অন্য দেশরা কী করছে তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে দুটো ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় – এক, আক্রমণের সম্ভাবনা আর দুই, বাণিজ্য। চীন আর পাকিস্তান বন্দুক তুলে আমাদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে ভেবেই না আমাদের এত কোটি কোটি টাকার অস্ত্র কিনতে হয় ফি বছর! কিংবা ধরো ভারত মিসাইল বানালে পাকিস্তানকেও যেন তেন প্রকারেণ ধারকর্জ করে মিসাইল বানিয়ে ফেলতে হয়। আবার তাদের এই আচরণগুলো যার যার দেশের মানুষের আচরণে ছাপ ফেলে।
যে কোনও গেমে অংশগ্রহণকারীদেরকে গেম-তত্ত্বের পরিভাষায় এজেন্ট বলা হয়ে থাকে (যেমন ভারত-পাকিস্তান-চীন-আমেরিকা কিংবা পাপু-সুজাতা কাকিমা)। এই এজেন্টরা ঠিক কি করবে বা করতে চায় সে বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সব এজেন্টদের সিদ্ধান্তের মিলিত প্রভাবেই কোনও গেমের ফলাফল কি হবে তা স্থির হয় ।
সুতরাং এখান থেকে একটা বিষয় বেরিয়ে আসছে যে কোনও একটা গেমে একজন এজেন্টের সঙ্গে ঠিক কী ঘটবে তা শুধুমাত্র সেই এজেন্ট কী করছে তার ওপরেই নির্ভর করে না, বাকি এজেন্টরা কী কী করছে তাও এক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ প্রত্যেক এজেন্টের সিদ্ধান্ত বা আচরণ বাকিদের ওপর প্রভাব ফেলে, তাই প্রত্যেক এজেন্ট কী পেতে চলেছে তা অন্যান্য এজেন্টরা কী করছে তার ওপর নির্ভরশীল- অর্থাৎ পারস্পরিক নির্ভরশীলতা।
এইবারে এতক্ষণের গল্পগাছাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়া যাক-
কোনও গেমে ঠিক কী কী ঘটে তা ধাপে ধাপে বললে ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম দাঁড়ায়: প্রথমে এজেন্টরা কী করবে সে-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রশ্ন হল, কীভাবে? তাদের কাছে কী তথ্য আছে তার ওপর ভিত্তি করে, মানে তাঁদের হাতে করণীয় ঠিক কী কী রয়েছে, তারা অন্যান্য এজেন্টদের বিষয়ে কী জানে, তাদের যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসছে তখন গেমে বাকি অংশগ্রহণকারীরা কে কী করেছে সে বিষয়ে তারা কতটা ওয়াকিবহাল এইসব ভাবনাচিন্তা করে । সুতরাং গেমে অংশ নেওয়া সব এজেন্টদের মধ্যে কে কী জানে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । এর পর তারা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করে, আর সেই কাজগুলোর মিলিত প্রভাবে গেমের শেষে কে কী পাবে তা ঠিক হয়, যেটাকে আমরা বলি গেমের ফলাফল।
ধরো রুকু আর মুকুল কাটাকুটি খেলতে বসেছে। রুকু কাটা দেবে আর মুকুল দেবে গোল্লা। খেলার নিয়ম অনুযায়ী রুকু শুরু করবে কাটা দিয়ে। রুকু কোথায় কাটা দিল, সেটা গোল্লা দেওয়ার আগে মুকুল দেখতে পাচ্ছে। আবার মুকুল গোল্লা দেওয়ার পর রুকুও দেখতে পেল মুকুলের দেওয়া গোল্লাটা কোন ঘরে বসল। দু’জনেই চায় অন্যজনকে হারাতে, সেটা একান্ত না পারলে অন্তত ড্র করতে, কেউই হারতে চায় না। সুতরাং রুকু আর মুকুল প্রত্যেকেই পরস্পরের চাল দেখে এমন ভাবেই চাল দেবে যাতে সে হেরে না যায়।এবার কে কতটা বিচক্ষণতার সঙ্গে খেলল তাই দিয়ে ঠিক হবে খেলাটা ড্র হবে না কি কোনও একজন জিতবে আর অন্যজন হারবে।
এটা শুধু ব্যক্তি খেলোয়াড়রাই করে থাকে এমন নয়, দলভিত্তিক খেলার সময়ও প্রত্যেক দল তার প্রতিপক্ষ কি কি করতে পারে ভেবে সেই অনুযায়ী খেলোয়াড় নির্বাচন করে, কাকে কখন মাঠে নামাবে ঠিক করে। মনে কর ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলে ব্রাজিল-জার্মানির ম্যাচ আসছে। তার ঠিক আগে দু’দলের কোচ আর খেলোয়াড়রা, প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়ার, কোচ কে কী করছে, কেমন প্র্যাকটিশ করছে, কে অসুখে পড়েছে এইসব খবর নেবে আর সেইমত ম্যাচের স্ট্র্যাটেজি সাজাবে। আর দুই দলের সেইসব স্ট্র্যাটেজির মিলিত প্রভাবে ম্যাচের শেষে কেউ জিতবে, কেউ হারবে বা ড্র হবে। সেই হল তার ফলাফল।
গেমে এজেন্টদের কাছে কতখানি তথ্য আছে সেই অনুযায়ী গেমগুলোকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায় – সম্পূর্ণ তথ্যের গেম (complete information game) এবং অসম্পূর্ণ তথ্যের গেম (incomplete information game) ।
সম্পূর্ণ তথ্যের গেমে প্রত্যেক এজেন্ট অন্যান্য এজেন্টদের ধরণ (type) সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল । কাটাকুটি, দাবা, লুডো, চাইনিজ চেকার এই সবকটাই এই রকম গেমের উদাহরণ।
অন্যদিকে অসম্পূর্ণ তথ্যের গেমে এজেন্টরা পরস্পরের ধরণ সম্পর্কে কিছু সম্ভাব্য ধারণা (probabilistic notion) রাখে মাত্র । আরেকটু ভেঙে বলি, অসম্পূর্ণ তথ্যের গেমের ক্ষেত্রে কোন এজেন্টের ধরণ কী তা কেবলমাত্র সেই বিশেষ এজেন্টই পুরোপুরি ভাবে জানে, বাকিরা জানে সেই এজেন্ট কী কী ধরণের হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং প্রতিটি ধরণের সম্ভাব্যতা (probability) কত । যেমন ধর কনট্র্যাক্ট ব্রিজ খেলা, কোন খেলোয়াড় শুরুতে কোন কোন তাস পেয়েছে সেটা কেবলমাত্র সে নিজে জানে, এবং তার ভিত্তিতে সে বিড করে।
সম্পূর্ণ এবং অসম্পূর্ণ – এই দুই ধরণের তথ্যের গেমই স্থিতিশীল (static) অথবা গতিশীল (dynamic) হতে পারে । স্থিতিশীল গেম একবারেই শেষ হয়ে যায়, অর্থাৎ এক্ষেত্রে এজেন্টদের কেবলমাত্র একবারই সিদ্ধান্ত নিয়ে যা করণীয় করে ফেলতে হয়। অন্যদিকে গতিশীল গেমে অন্তত একজন এজেন্টকে আলাদা আলাদা সময় একাধিক বার সিদ্ধান্ত নিতে হয় করণীয় তা করবার জন্য ।
একটা মজার উদাহরণ দিলে এই স্থিতিশীল আর গতিশীল গেম-এর ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
ধরো শ্যামবাজারের রথীনবাবু কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন যে তাঁর পুরনো বইয়ের যে বিশাল সংগ্রহ তা তিনি নিলামে বিক্রী করবেন। আসলে বিনা পয়সায় দিলে লোকে হয়তো তেমন যত্ন করবে না, সহজে পাওয়া জিনিসগুলোকে বেশিরভাগ মানুষই বড় হেলাফেলা করে। আজীবন বই অনুরাগী রথীনবাবু তাই চান বইগুলো যার বা যাদের হাতে পড়বে, তারা যেন বইগুলোর সঠিক যত্ন নেয়। এবার কারা কারা সত্যিই যত্নবান হবে তা তিনি আগে থেকে বুঝবেন কি করে? তাই জন্যই তিনি এই নিলামটা ডেকেছেন। বইগুলোকে ভাষা অনুযায়ী এবং ভাষার মধ্যেও আবার বিষয় অনুযায়ী আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করেছেন – বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ইত্যাদি এবং তাদের মধ্যে গল্পের বই, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভূগোল, প্রবন্ধ, জীবনী, ভ্রমণ কাহিনী এরকম নানান কিছু। আলাদা আলাদা লটে বইগুলো ভাগ করে রাখা রয়েছে। এই নিলামটা তিনি বিভিন্নভাবে করতে পারেন। সব বইগুলোর জন্য কোনও একজনকে দর হাঁকতে বলবেন এবং সবচেয়ে বেশি দর যে দেবে তাকে তিনি বইগুলো বিক্রী করবেন। অথবা আলাদা আলাদা লোককে বলবেন বইয়ের লটগুলোর জন্য দর হাঁকতে। সব দর পেয়ে গেলে প্রত্যেকটা লটের সবচেয়ে বেশি দরগুলো যে বা যারা হেঁকেছে তাদের সেই লটগুলো বিক্রী করবেন। এক্ষেত্রে কোনও একজন সব লট কিনে নিতে পারে যদি প্রত্যেকটা লটের জন্যই সে সবচেয়ে বেশি দর দিয়ে থাকে। অন্যথায় একাধিক জনের মধ্যেও লটগুলো ভাগ হয়ে যেতে পারে বিক্রীর সময়, যদি সর্বোচ্চ দর আলাদা আলাদা লোকের কাছ থেকে এসে থাকে। এবার এই আলাদা আলাদা লটগুলোর জন্য একই সঙ্গে রথীনবাবু দর চাইতে পারেন, আবার একবারে কেবল একটা লটের জন্যও দর চাইতে পারেন, যাতে করে একটা একটা করে লট এক এক ধাপে বিক্রী হয়। যখন সব বই একসঙ্গে একবারে নিলাম হচ্ছে কিংবা সব কটা লট একধাপেই বিক্রী হচ্ছে তখন এটা স্থিতিশীল গেম আর যখন এক একটা লট আলাদা আলাদা এক এক ধাপে বিক্রী হচ্ছে তখন সেটা গতিশীল গেম।
সে না হয় হল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নিলাম গেম কিভাবে হচ্ছে? আর নিলাম তত্ত্বের গেম তত্ত্বের সঙ্গেই বা কী সম্পর্ক? নিলাম তত্ত্ব হল মূলত অসম্পূর্ণ তথ্যের গেমের এক সরাসরি প্রয়োগ। রথীনবাবুর বইয়ের নিলামের অল্পে দেখলাম নিলাম যদি এক ধাপেই শেষ হয়ে যায় তাহলে তা স্থিতিশীল আর যদি তা পরপর কিছু ধাপে ধাপে চলে তখন তা গতিশীল নিলাম । স্থিতিশীল ও গতিশীল নিলামকে যথাক্রমে একধাপ নিলাম (single stage auction) ও বহুধাপ বা পর্যায়ক্রমিক নিলাম (multi-stage or sequential auction) নামেও ডাকা হয়ে থাকে । বলাই বাহুল্য পর্যায়ক্রমিক নিলাম অবশ্যই নিলামযোগ্য একাধিক বস্তুর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে । তবে একাধিক বস্তু থাকলেই যে একাধিক ধাপে অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে নিলাম করতে হবে ব্যাপারটা মোটেই এরকম নয়, একাধিক বস্তুকে একই সঙ্গে একটি মাত্র ধাপেই নিলাম করা চলতে পারে, আর শুধু চলতে পারেই বা বলি কেন, বিভিন্ন সময় করা হয়েও থাকে।
একধাপ নিলাম এবং বহুধাপ নিলাম পরিচালনা করার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে , তা সে নিলাম একটিমাত্র বস্তুরই হোক বা একাধিকের । সেই নিয়ে বিশদ আলোচনার আগে একটু বুঝে নেওয়া যাক নিলামকে ঠিক কোন অর্থে অসম্পূর্ণ তথ্যের গেম বলা যেতে পারে । যেকোন গেম সম্পর্কে বলতে হলে যেগুলো বলা অবশ্যই জরুরি তা হল,
ক) গেমে অংশগ্রহণকারী এজেন্ট কারা কারা,
খ) তারা ঠিক কী কী করতে পারে অর্থাৎ কী কী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে,
গ) কোন কোন সময় তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে,
ঘ) সেই সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্নভাবে মিলেমিশে ঠিক কী কী ধরণের ফলাফল দিতে পারে,
ঙ) সেই ফলাফল প্রত্যেক এজেন্টের জন্য ব্যক্তিগতভাবে কেমন;
এগুলো জানলে বুঝতে পারা যায় গেমের ‘ভারসাম্য ফলাফল’ কী।
কোনো গেম-এ তার এজেন্টরা যেসব বিবিধ সিদ্ধান্ত নেন, সেই সমস্ত সিদ্ধান্ত একত্র হয়ে যে গড় সিদ্ধান্তটায় পৌঁছোনো যায় তাকে বলে ‘ভারসাম্য ফলাফল’। এ হল সেই অবস্থা যা থেকে, কোনো এজেন্ট কোনো তাঁর কোনো সিদ্ধান্তকে না বদলে, কেবল ইচ্ছে হল বলে মানলাম না এমনটা করেন না।
যেমন ধরো, আন্তর্জাতিক কোনো পরিবেশ চুক্তি। কয়লা, তেল এসব পোড়ালে পরিবেশ দূষণ বাড়ে। আবার না পোড়ালে শিল্প, অর্থনীতি চলে না। কাজেই কোন দেশ তা কতখানি পোড়াবে, কে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করবার জন্য কত খরচাপাতি করবে সে নিয়ে দেশে দেশে মহা টানাপোড়েন। প্রত্যেক এজেন্টই চায় এমন কিছু সিদ্ধান্ত হোক যাতে তার লাভ সবচাইতে বেশি হয়। এই করতে করতে, কিছু পাওয়া কিছু ছাড়া চলতে চলতে একসময় সবাই মিলে প্রত্যেকের স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রেখে যে মিলিত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়, তা হল সকলের লাভলোকসানের একটা মিলিত হিসেব যে সিদ্ধান্তগুলো সবাই মেনে চললে কেউ একজন হঠাৎ সেগুলো থেকে সরে আসতে চাইবে না – একেই আমরা বলছি ‘ভারসাম্য ফলাফল।’ এইটে কাগজে লিখে সব দেশ সই করে চুক্তি বানায়। উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে সিদ্ধান্তকে সরকারিভাবে না বদলে, ‘ইচ্ছে হল তাই চুক্তি ভাঙলাম’ তেমনটা কোনো সদস্য দেশ (বা, গেম থিওরির ভাষায় ‘এজেন্ট’) করে না।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ভারসাম্যের এই নীতিটির ধারণা দিয়েছিলেন স্বয়ং জন ন্যাশ, তাই তাঁর নামানুসারে এটিকে ন্যাশ ভারসাম্য (Nash Equilibrium) বলা হয়ে থাকে।
ওপরে বলা গেমের এই পাঁচ স্তম্ভের বর্ণনার মধ্যে কোনও একটাও বাদ গেলে গেমটাকে ঠিকমত বোঝা সম্ভব নয়, অর্থাৎ কোন এজেন্ট কী আচরণ করবে আর কেন ঠিক সেইভাবেই আচরণ করবে, অন্য কোনও ভাবে নয়, এবং সবচেয়ে বড় কথা গেমের ভারসাম্যে চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে তা কষে বের করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে ।
ফেরৎ আসি নিলামের কথায়, আবার সেই প্রশ্নটায় – নিলাম কোন অর্থে অসম্পূর্ণ তথ্যের গেম?
নিলামে অংশগ্রহণকারী এজেন্টরা মূলত দুই প্রকার, এক যারা নিলাম পরিচালনা করছে আর দুই যারা নিলামে অংশগ্রহণ করছে, অর্থাৎ যারা দর হাঁকছে- এদেরকে আমরা দরদাতা বলতে পারি।
সাধারণ নিলামে বিক্রেতা নিজেই নিলাম পরিচালক হতে পারে বা তার হয়ে নিলাম পরিচালনার দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে পারে আর ক্রেতারা হল দরদাতা।
ঠিক উল্টোটা ঘটে বিপরীত নিলামে, এখানে ক্রেতা নিজে নিলাম পরিচালক হয় অথবা কাউকে তার হয়ে নিলাম পরিচালনার ভার দেয় আর বিক্রেতারা হয়ে যায় দরদাতা। এ তো গেল এজেন্টদের বর্ণনা, প্রশ্ন হচ্ছে এরা কী কী করতে পারে?
এককথায় উত্তর হল, দরদাতারা দর হাঁকতে পারে আর নিলাম পরিচালক সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় বস্তুটি বেচবে অথবা কিনবে কিনা (নিলামটি সাধারণ না বিপরীত তার ওপর নির্ভর করে)। দর দেখে বিজয়ী দরদাতাকে নির্বাচন করা হয়।
প্রথমে সাধারণ নিলামের কথাই বলা যাক যেখানে ক্রেতারা দরদাতা, আর ধরে নিচ্ছি বিক্রেতাই নিলাম পরিচালক; কারণ এতে আলোচনার ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ পার্থক্য হয় না। বিজয়ী ক্রেতা বা ক্রেতারা কিছু নির্দিষ্ট মূল্য দিলে তবেই বস্তুটি বা বস্তুগুলি পেতে পারে। এখান থেকে পরপর কয়েকটা প্রশ্ন উঠে আসছে । প্রথম প্রশ্ন, বিজয়ী ক্রেতা কে হবে সেটা কিভাবে ঠিক হবে? উত্তর হল, বিক্রেতা সব দরগুলো দেখে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর যে হেঁকেছে সেই ক্রেতাকেই বিজয়ী বলে ঠিক করে।
এবারে উঠে আসবে দ্বিতীয় প্রশ্ন, কোন ক্রেতা কত দর হাঁকবেন সেটা কী করে ঠিক হচ্ছে?
এই প্রশ্নটার উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর, সেটা হল নিলাম কোনদিক থেকে অসম্পূর্ণ তথ্যের গেম।
যে-জিনিসটা নিলামে বিক্রি হচ্ছে অর্থাৎ যেটা তারা কিনতে উৎসাহী সেই বস্তুটার যে মূল্যায়ন (valuation), মানে সেই বস্তুটার দাম তাদের হিসেবমত কত হওয়া উচিত তার ওপর নিলামে দরদাতারা দর ঠিক করে। এবার এই মূল্যায়নটা ঠিক কত সেটা কেবলমাত্র যে দামটা নির্ধারণ করছে সে-ই জানে, বাকিরা নয়।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে – ধরা যাক অবন ঠাকুরের হাতে আঁকা একটা ছবি বিক্রি হবে। এই ছবিটার জন্য একজন ক্রেতা দশ হাজার টাকা দিতে ইচ্ছুক, আরেকজন বারো হাজার, অন্য আরেকজন পনের হাজার, এই ভাবে হয়তো একজন ক্রেতাকে পাওয়া যাবে যে পাঁচ লাখ টাকা দিতে ইচ্ছুক, এবং তার চেয়ে বেশি দিতে ইচ্ছে কোনও ক্রেতার নেই।
তাহলে প্রত্যেক ক্রেতাই এটা জানে যে ঐ ক্রেতাদের দলে প্রত্যেকেই কম করে দশ হাজার আর সবচেয়ে বেশি পাঁচ লাখ টাকা দিতে উৎসাহী, কিন্তু কে ঠিক কত দিতে চায় সেটা কেবল যে দরটা যে দিচ্ছে সে নিজেই জানে। জানে।
এই ইচ্ছেটা আবার নির্ভর করে ঐ বস্তুটা পেলে ক্রেতা তার থেকে কত উপযোগিতা পাচ্ছে তার ওপর – এই উপযোগিতা ব্যবহারিকও হতে পারে আবার নিছক আনন্দলাভও হতে পারে।
যেমন একটা সাইকেল নিলামে কিনলে সেটা চালিয়ে যাতায়াতের যে সুবিধে পাওয়া যাবে তা একটা উপযোগিতা দেয়, আবার অন্যদিকে নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি বা রামকিঙ্কর বেজের তৈরি মূর্তি বাড়িতে সাজিয়ে রাখলে সেগুলোকে বারবার দেখে যে আনন্দ তাও আরেক ধরণের উপযোগিতার জন্ম দেয়।
উপযোগিতা যাই হোক না কেন, একটা ব্যাপার তো পরিষ্কার যে ঐ ক্রেতাদের দলে ছবির মূল্যায়ন দশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে আর প্রত্যেকটা মূল্যায়নের একটা করে নির্দিষ্ট সম্ভাব্যতা আছে।
ধরা যাক ক, খ, গ, ঘ এই চারজন ক্রেতা আছে। তারা দশ হাজার, বারো হাজার, পনের হাজার এবং পাঁচ লাখ টাকা দিতে ইচ্ছুক। প্রত্যেকেই এটা জানে যে এই চারটে দরের প্রত্যেকটার সম্ভাব্যতা এক চতুর্থাংশ বা ২৫ শতাংশ। কিন্তু ক/খ/গ/ঘ বাবুর প্রত্যেকেই কেবল নিজে কোন দরটা দিচ্ছেন সেটা জানেন, অন্যদের কে কোন দর দিচ্ছে তা জানেন না।
প্রসঙ্গত বলে রাখি এই সম্ভাব্যতার মান কিন্তু সব সময় সব ক’টি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একই হবে এমন নাও হতে পারে। যেমন ধরো দশজন দর দিচ্ছেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে তিনজন দিয়েছেন দশ হাজার টাকা করে দর। দুজন দিয়েছেন পনের হাজার দর। চারজন দিয়েছেন বারো হাজার দর আর একজন দিয়েছেন পাঁচ লাখ দর। কাজেই এক্ষেত্রে দশ হাজার এর যে দর সেটার সম্ভাব্যতা দশ ভাগের তিন ভাগ মানে তিরিশ শতাংশ, বারোহাজারের জন্য সেটা দশ ভাগের চার ভাগ বা চল্লিশ শতাংশ, পনেরো হাজারের কুড়ি শতাংশ এবং পাঁচ লাখের সম্ভাব্যতা দশ শতাংশ।
তবে একমাত্র জরুরি বিষয় হল সবকটি মূল্যায়নের সম্ভাব্যতার যোগফলের মান এক (বা একশো শতাংশ) হতে হবে। সুতরাং মূল্যায়নের সবচেয়ে কম আর সবচেয়ে বেশি মানের পরিসর (ওপরের উদাহরণের ক্ষেত্রে দশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ হল এই পরিসর) আর সেই পরিসরে প্রত্যেক মানের যে সম্ভাব্যতা সেগুলো সবাই জানে। সেগুলো যে সবাই জানে এই খবরটাও সবাই জানে। সেগুলো যে সবাই জানে, এ খবর যে সবার জানা সেটাও সবাই জানে… এই গতি অনন্ত।
পোশাকি ভাষায় একে বলা হয় কমন নলেজ। যে-যার নিজের মূল্যায়নের মান এবং বাকি ক্রেতাদের মূল্যায়নের পরিসর ও সেই পরিসরে বিভিন্ন মূল্যায়নের মানের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে নিলামের সময় কে কত কত দর হাঁকবে সেই সিদ্ধান্ত নেয় ।
সুতরাং কোনও একজন ক্রেতা কত দর হাঁকবে সেই সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র, সে নিজে জিনিসটার মূল্যায়ন যা করেছে তার ওপরেই নির্ভর করে না, বাকি ক্রেতাদের সম্পর্কে কী জানা আছে সেটাও এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে। আসল নীলামের আসরে এসে দর তাকে এমনভাবেই হাঁকতে হবে যাতে সে জিততে পারে, আবার জিততে হলে বাকিরা কী দর হাঁকছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
অতএব যে কোনও ক্রেতার নিলামে দর হাঁকা, জেতা বা হারাটা বাকি ক্রেতাদের হাঁকা দরের ওপরেও নির্ভরশীল। আর এভাবেই চলে এল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। ওদিকে আবার বিভিন্ন এজেন্টের কে ঠিক কত দর দিয়েছে সেটাও কারো সম্পূর্ণভাবে জানা নেই। কেবল কোনো একজন ক্রেতার মূল্যায়ন কত হতে পারে তার একটা সম্ভাব্য হিসেবই আছে প্রত্যেকের হাতে।
অর্থাৎ , পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, আর অসম্পূর্ণ জ্ঞান এই দুটো শর্তই পূরণ করছে নিলাম। ফলে তা হল একটা অসম্পূর্ণ তথ্যের গেম। এক্ষেত্রে ক্রেতার মূল্যায়নই হল তার ধরণ (valuation constitutes type) ।
এদিকে আবার জিতলে তো কিছু দামও দিতে হবে । সুতরাং কত দাম দিতে হবে এটাও কিন্তু দর হাঁকার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা পালন করে । এ থেকেই বেরিয়ে আসছে তৃতীয় প্রশ্ন – বিজয়ী ক্রেতা মূল্য বাবদ কত দেবে?
উত্তর, সেটা নিলামের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। মজার ব্যাপার হল নিলামের পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে অনেক সময় হেরে যাওয়া ক্রেতাদেরও কিছু মূল্য দিতে হতে পারে।
তবে নিলামের সে-সব পদ্ধতি নিয়ে বিশদ আলোচনায় পরে আসছি। নিলাম তত্ত্ব দরদাতাদের এই দর হাঁকার ব্যাপারটা নিয়েই গবেষণা করে, কোন পরিস্থিতিতে ক্রেতারা কত দর হাঁকতে পারে সেটাই অঙ্ক কষে বের করার চেষ্টা করে।
এবার যে মোক্ষম প্রশ্নটা অবধারিত ভাবে উঠে আসছে সেটা হল, এত আঁক কষাকষির দরকার কী বাপু? যার যা ইচ্ছে দর পেশ করবে, জিতলে জিতবে, হারলে হারবে, তাদের মাথাব্যথা! নিলামের তত্ত্ব তৈরি করে একগাদা অঙ্ক কষে কার কী লাভ হবে?
হবে বাপু হবে, আসলে নিলাম তো কেবল ক্রেতাদের নিয়ে নয়, বিক্রেতারও নিলাম থেকে কিছু পাওয়ার আছে। তা হল বিক্রয়লব্ধ আয়; কিন্তু এই আয় ঠিক কত হবে সেটা কিন্তু বিক্রেতা আগে থেকে জানে না যেহেতু ক্রেতাদের মূল্যায়ন কেবলমাত্র ক্রেতাদেরই জানা।
সুতরাং নিলাম করার আগে সে কেবল আন্দাজ করতে পারবে প্রত্যাশিত বিক্রয়লব্ধ আয় কত হতে পারে। এবং সেজন্যই এত অঙ্ক কষাকষি, কারণ, এসব অঙ্কটঙ্ক কষে, সঠিক নিলাম পদ্ধতি বেছে নিয়ে এই প্রত্যাশিত বিক্রয়লব্ধ আয় ক্ষেত্রবিশেষে বাড়ানো সম্ভব।
বিক্রয়লব্ধ আয় ছাড়াও আরেকটা বিষয় অনেক সময়ই বিক্রেতাকে ভাবায়, সেটা হল নিলামযোগ্য বস্তুটি কি সত্যিই সেই ক্রেতার হাতে পৌঁছচ্ছে যার ঐ বস্তুর প্রতি মূল্যায়ন সবচেয়ে বেশি? নিলামযোগ্য বস্তুটা যদি সত্যিই এমন কারো হাতে পৌঁছয় অর্থাৎ এমন ক্রেতার কাছে বন্টিত হয় যার ঐ বস্তুর প্রতি মূল্যায়ন সকলের চেয়ে বেশি, তাহলে সেই বন্টনকে বলা হয় সুদক্ষ বন্টন।
এখন প্রত্যাশিত বিক্রয়লব্ধ আয় বাড়ানোই হোক বা সুদক্ষ বন্টন নিশ্চিত করাই হোক, এই পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে কিছু প্রত্যাশার ওপর, কারণ ক্রেতাদের সঠিক ধরণ কেবলমাত্র তারাই নিজেরা জানে, আর সেইজন্য বিক্রেতার পক্ষে আগে থেকে সঠিক জানা সম্ভব নয় যে নিলামের শেষে সে ঠিক কী পেতে চলেছে। অথচ নিলামটা সে আদৌ করবে কি না, বা করলে কেমনভাবে করবে এই সমস্ত বোঝার জন্য তার তো কী পাবে সেই নিয়ে কিছু ধারণা দরকার! এই ধারণা পেতেই তাকে শরণ নিতে হয় অঙ্কের, যা তথ্য হাতে আছে সেগুলোকে মিলিয়ে কিছু অঙ্ক কষে অন্তত এটুকু বের করা যায় যে সে কী পাবার আশা রাখতে পারে, অর্থাৎ তার প্রত্যাশিত বিক্রয়লব্ধ আয় (expected revenue) কত হতে পারে । এটা বের করতে পারলেও তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটা বেশ খানিকটা সহজ হয়ে যায় ।
কোন ধরণের পদ্ধতিতে নিলাম করা সবচেয়ে সুবিধে সেটা বের করতে হলে ক্রেতাদের মূল্যায়ন ঠিক কেমন সেটাও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মূল্যায়ন বেশ কয়েক রকম হতে পারে। প্রধানত তিন রকম মূল্যায়নের কথা আমরা ভাবতে পারি – ব্যক্তিগত মূল্যায়ন, সাধারণ মূল্যায়ন এবং আন্তর্নির্ভরশীল মূল্যায়ন।
ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হল সেই ধরণের মূল্যায়ন যেখানে ক্রেতা কেবলমাত্র নিজের কাছে থাকা তথ্য বা ধারণার ভিত্তিতে স্থির করে সবচেয়ে বেশি ঠিক কতখানি মূল্য সে দিতে ইচ্ছুক। সাধারণ জিনিসপত্র, যেমন খাট, আলমারি ইত্যাদির নিলামের ক্ষেত্রে এই ধরণের মূল্যায়ন থাকে বলে ধরা যেতে পারে যদি না সেই বস্তুর কোনও আলাদা বিশেষত্ব অর্থাৎ ঐতিহাসিক মূল্য, বিশেষ শিল্পীর হাতের কাজ এই জাতীয় কোনও গুণ থাকে।
সাধারণ মূল্যায়নের ব্যাপারটা আবার একটু অন্যরকম – এক্ষেত্রে প্রত্যেক ক্রেতাই নিলামযোগ্য বস্তুটার মূল্য কত হতে পারে তাই নিয়ে কিছুটা ওয়াকিবহাল কিন্তু সম্পূর্ণরূপে নয়, কিন্তু যেই সেই নিলামে জিতুক না কেন, শেষে বস্তুর মূল্য সবার জন্য একই হবে ক্রেতা নির্বিশেষে, অর্থাৎ যে ক্রেতাই জিতুক সে ঐ বস্তু থেকে সমমূল্যের উপকার পাবে।
উদাহরণ হিসেবে তেলের খনির কথা ভাবে যেতে পারে; ধরা যাক কোথাও হঠাৎ মাটির নীচে তেলের সন্ধান পাওয়া গেল, এই খনিজ তেল তুলে যারা ব্যাবসা করতে ইচ্ছুক তারা ঐ খনি থেকে তৈল উত্তোলনের অধিকারের ছাড়পত্রের জন্য দরপত্র জমা দেবে। এই ক্রেতারা কেউই কিন্তু জানে না ঠিক কত পরিমাণ তেল ওখানে মজুত আছে, কিন্তু যেই জিতুক তার জন্য তেলের পরিমাণ একই থাকবে, ক্রেতা বিশেষে তা কম বা বেশি হবে না। রথীনবাবুর বইয়ের নিলামের ক্ষেত্রেও সাধারণ মূল্যায়নের গল্প আসতে পারে। কী কী বই আছে রথীনবাবু আগে থেকে জানালেন না, কিন্তু রথীনবাবু যেমন বিদগ্ধ, অনুসন্ধিতসু মনের পণ্ডিত মানুষ তাতে তাঁর বইয়ের সংগ্রহ যে একটা দারুণ কিছু তাই নিয়ে বইপ্রেমীদের কোনও সন্দেহ নেই। কেউ যদি সব বই কেনে বা কোনও একটা বা একাধিক লট কেনে, তাহলে তাদের পরিচয় নির্বিশেষে তারা একই ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হবে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের লটটা কৈলাস চৌধুরীই কিনুন বা উমানাথ ঘোষাল, বইয়ের তো কোনও রকমফের হবে না, বইয়ের লট যা থাকার তাইই থাকবে।
মিলগ্রম আর উইলসন যে নিলাম তত্ত্বে নোবেল প্রাইজ পেলেন তা মূলত এই ধরণের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিলামের বিশ্লেষণ করে।
এর পরে আসছে আন্তর্নির্ভরশীল মূল্যায়ন; এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোনও একজন ক্রেতার মূল্যায়ন অন্যান্য ক্রেতাদের মূল্যায়ন দিয়ে প্রভাবিত হয়, অর্থাৎ অন্যান্য ক্রেতা বস্তুর মূল্যায়ন কিভাবে করছে সেই তথ্য দিয়ে প্রত্যেক ক্রেতা বস্তুটার পুনর্মূল্যায়ন করে থাকে। মনে করা যাক কোনও একটা বিখ্যাত ছবির নিলাম হচ্ছে, সেখানে প্রত্যেক ক্রেতা বোঝার চেষ্টা করে যে ছবি সম্পর্কে তার যে জ্ঞান আছে তা যথেষ্ট কি না, যেমন ছবিটা সত্যিই কোনও বিশেষ শিল্পীর নিজের হাতে আঁকা কি না, যে শিল্পীর আঁকা তিনি এই ছবি আরও এঁকেছিলেন কি না, যদি এঁকে থাকেন তাহলে সেই ছবিগুলোর মধ্যে এতাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ছবিটা এটাই কি না ইত্যাদি, এবং সেই অনুযায়ী ক্রেতার ছবির জন্য মূল্য দেওয়ার ইচ্ছে বদলাতে পারে।
এই তিন ধরণের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিলামের ভারসাম্য এবং তার থেকে বিক্রয়লব্ধ আয়ের হিসেব কষার ধরণ কিছুটা আলাদা আলাদা হয় । এই সব হিসেব কষার ধরণ ধারণগুলো বেশ মজার, সেই গল্প আরেকদিন হবে।
ক্রমশ
জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর
গেম তত্ত্বের মতন এক কঠিন গাণিতিক তত্ত্বের এত প্রাঞ্জল উপস্থাপনা, আর তার সহযোগে নিলাম তত্ত্বের ব্যাখ্যা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছে। বোধহয়, শ্রবন্তীর পক্ষেই এটা সম্ভব।
LikeLike
…স্রবন্তী হবে, শ্রবন্তী নয়। অটো কারেকশনের বিড়ম্বনা।
LikeLike