বৈজ্ঞানিকের দপ্তর-তেজষ্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ-গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়-শীত২০২০

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের আরো লেখাঃ দেড়শো বছর আগের এক সূর্যগ্রহণের গল্প, স্বর্ণযুগের কাহিনি, কৃষ্ণগহ্বর, ব্যতিক্রমী বিন্দু ও স্টিফেন হকিং ,
তেজষ্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ ১ম পর্ব,  ২য় পর্ব ‌,  ৩য় পর্ব , ৪র্থ পর্ব , ৫ম পর্ব

নক্ষত্রের নাম বিভা

জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ বাড়ানোর জন্য ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন তাদের সদস্য দেশের প্রত্যেককে একটি করে নক্ষত্র ও তার একটি গ্রহের নাম দেওয়ার দায়িত্ব দেয়। ভারতের ভাগে পড়েছিল ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরত্বের HD 86081 ও তার গ্রহ HD 86081B। অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া জুলাই মাসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নাম আহ্বান করে। জমা পড়া নামগুলির উপর ভোট নেওয়া হয়। অবশেষে ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন নামগুলি অনুমোদন করেছে। HD 86081 এখন থেকে বিভা নামে পরিচিত হবে, তার গ্রহটার নাম দেওয়া হলো সন্তমস। সন্তমস অর্থ মেঘাচ্ছন্ন বা ঘোর অন্ধকার। এই নামটা প্রস্তাব এসেছিল পুনের তেরো বছরের এক স্কুল ছাত্র বিদ্যাসাগর দউদের থেকে। বিভা নামের প্রস্তাবক সুরাটের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির ছাত্র অনন্য ভট্টাচার্য। নক্ষত্রটার নাম পাঠানোর সময় বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরীর নাম মনে ছিল তাঁর। পাই মেসনের আবিষ্কারের ইতিহাসে বিভার ভূমিকার কথা এবার শুনে নিই।

১৯১৪ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মত বিনিময়ের জন্য  কলকাতায় শুরু হয়েছিল ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস। ১৯৩৮ সালের কংগ্রেসে এসেছিলেন দুই বিদেশি বিজ্ঞানী জিওফ্রে টেলর ও ভবিষ্যতের নোবেলজয়ী ওয়াল্টার বোথে। তাঁরা ব্লাউয়ের পদ্ধতিতে ফটোগ্রাফিক প্লেট দিয়ে কেমন করে মহাজাগতিক রশ্মি ধরা যায় তা আলোচনা করেছিলেন। সেখানে দেবেন্দ্রমোহন বোসও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ডি.এম বোস নামেই বেশি পরিচিত। তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্রের ভাগনে। আগে ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তখন মামা মারা যাওয়ার পরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ডাইরেক্টরের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। তাঁর ছাত্রী বিভা চৌধুরী তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বসু বিজ্ঞান মন্দিরেই কাজ শুরু করছেন। বিভা আমাদের দেশের প্রথম মহিলা যিনি পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করেছিলেন।

বিভার জন্ম ১৯১৩ সালে কলকাতায়। তাঁর বাবা বঙ্কুবিহারী চৌধুরী ছিলেন ডাক্তার। মায়ের নাম ঊর্মিলা। মা ঊর্মিলার দিদি নির্মলা ছিলেন বিখ্যাত ডাক্তার নীলরতন সরকারের স্ত্রী। বঙ্কুবিহারী ছিলেন হুগলি জেলার ভাণ্ডারহাটি গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান। তিনি মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সময় ঊর্মিলাকে বিয়ে করার জন্য ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় গোঁড়া হিন্দুরা ব্রাহ্মদের পছন্দ করত না। তাই তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারেননি, পৈতৃক সম্পত্তি থেকেও তাঁকে বঞ্চিত হতে হয়। নবদম্পতি কলকাতায় ব্রড স্ট্রিটে বসবাস শুরু করেন।

বিভা ছিলেন পাঁচ বোন এবং এক ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়। এক বোন ছোটোবেলায় মারা যায়, বাকিরা সবাই পড়াশোনায় বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। বিভা কলকাতার বেথুন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করেন, এরপর ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স কলেজে জন্য ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে সেখান থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এম.এস.সি পাস করলেন। তাঁর আগে মাত্র দুজন মহিলা এই কৃতিত্বের অধিকারী।

এম.এস.সি পাস করার পরে ইচ্ছা গবেষণা করবেন। সেজন্য একটা সকালের স্কুলে চাকরি নিলেন যাতে গবেষণার জন্য সময় দিতে পারেন। সে সময় কলকাতায় কেন, আমাদের দেশেই প্রায় কোনো মহিলা বিজ্ঞান গবেষণা করতেন না। গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান দেবেন্দ্রমোহন বোসের কাছে। তিনি ছিলেন বিভার আত্মীয়, তাঁর মাসি নির্মলার বড়ো মেয়ে নলিনী ছিলেন ডি.এম. বোসের স্ত্রী। তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগের সবচেয়ে সম্মানজনক পদ স্যার তারকনাথ পালিত অধ্যাপক হয়েছেন তিন বছর আগে। তাঁর আগে সেই পদে ছিলেন চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন। ডি.এম. বোস প্রথমে রাজি হলেন না, বললেন, কোনো মহিলাকে দেওয়ার মতো কাজ তাঁর কাছে নেই। হাল ছাড়লেন না বিভা। শেষপর্যন্ত তাঁর আগ্রহে মাস্টারমশাই নরম হলেন, বিভা শুরু করলেন তাঁর অধীনে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণার কাজ। তাঁর আগে কোনো বাঙালি মহিলা আধুনিক বিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেননি।

ডি.এম. বোস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে ছিলেন। সেখানে তিনি হাতেকলমে মেঘকক্ষ বানানোর কায়দা শিখেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে তিনি মেঘকক্ষ বানিয়েছিলেন। তাঁর কাছে ফটোগ্রাফিক প্লেটের ব্যবহারের বিষয়টা খুব আকর্ষণীয় মনে হল। প্লেটের কোনো নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যদি কণার ধাক্কা লাগে, তাহলে তার পথটা বেঁকে যায়। বিভারা দেখালেন যে কতটা পথ বাঁকল তা মেপে তার থেকে কণার ভরটা নির্ণয় করা যায়। আবার ভারী কণারা একসঙ্গে বেশ কয়েকটা সিলভার আয়োডাইড অণুকে ভেঙে দেয় বলে বেশি রুপো মুক্ত করে। তাই রুপোর বিন্দুগুলো বেশি ঘন ঘন হয়। এভাবে বিন্দুর ঘনত্ব আর পথ কতটা বেঁকে গেছে তা দেখে কণাটার ভর নির্ণয় করা যায়। ১৯৪১ সালে বিভা চৌধুরী ও ডি.এম. বোস ভর নির্ণয় বিষয়ে তাঁদের গবেষণাপত্র ইংল্যান্ডের বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন।

কেমন করে বিভারা কাজ করেছিলেন দেখা যাক। আগেই বলেছি মাটির কাছে মহাজাগতিক রশ্মি আসে কম, বায়ুমণ্ডল তাদের বাধা দেয়। তাই সাধারণত ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলো পাহাড়ের উপরে বা বেলুনে রাখা হত। বিভারা দার্জিলিং, সন্দকফু এবং ভুটান সীমান্তের কাছে ফারি জং—এই তিন জায়গায় প্লেটগুলো রেখেছিলেন। এই জায়গাগুলো ২২০০ মিটার থেকে ৪৪০০ মিটার উঁচু। এখন অনেকেই নিশ্চয় সন্দকফু বেড়াতে গেছ। কিন্তু আশি বছর আগে তা ছিল খুব দুর্গম জায়গা, ফারি জং তো আরো দূরে। এমন দুর্গম জায়গায় এক বাঙালি মহিলা তখন গবেষণার জন্য গিয়েছিলেন! কোথাও তাঁরা প্লেটগুলো রাখলেন বায়ুতে, কোথাও জলের তলায়, কোথাও বা কাদা আর কাঠ দিয়ে তৈরি কাঠামোর নীচে। কয়েকমাস পরে প্লেটগুলো নিয়ে এসে পরীক্ষা করা হল।

বিভা ও দেবেন্দ্রমোহন দুই ধরনের ভর পেলেন, একটা মান হল ইলেকট্রনের ভরের দুশো গুণের কাছাকাছি, অন্য একটা মান তিনশো গুণের কাছাকাছি। এখন আমরা বুঝেছি যে তাঁরা দুই ধরনের কণা দেখেছেন। কিন্তু তাদের পুরোপুরি আলাদা করতে তাঁরা পারেননি, ভর নির্ণয়েও অনেকটা ত্রুটি ছিল। সে কথায় আমরা পরে আসছি। তাঁদের পরীক্ষা থেকে আমরা দেখতে পাই যে বেশি ভরের কণাগুলো পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বেশি, এর থেকে এখন আমরা বুঝি যে সেগুলো অবশ্যই পাই মেসন। পরপর কয়েকটি গবেষণাপত্র তাঁরা প্রকাশ করলেন। কয়েক বছর পরে ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনে সিসিল পাওয়েল ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে দুই ধরনের মেসন আলাদা করে পাবেন। ভর মাপার জন্য তিনি বিভাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিই ব্যবহার করবেন, তবে পদ্ধতিটা তিনি নিজেই বার করেছিলেন। আধুনিক যুগের ভাষায় আমরা বলি বিভাদের ফটোগ্রাফিক প্লেটেই প্রথম ধরা দিয়েছিল পায়ন ও মিউয়ন এই দুই ধরনের কণা। পায়নের ভর ইলেকট্রনের ভরের ২৭৩ গুণের কাছাকাছি, অন্যদিকে মিউয়নের ভর হল ইলেকট্রনের ভরের ২০৭ গুণ। পায়ন হল ইউকাওয়ার প্রস্তাবিত কণা, সে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে পিন বলের মাধ্যমে ক্রিয়া করে। মিউয়নরা পিন বলে অংশগ্রহণ করে না, একেই অ্যান্ডারসন খুঁজে পেয়েছিলেন। পাওয়েল এও দেখালেন যে পায়ন ভেঙে মিউয়নের জন্ম হয়।

পাওয়েল ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার শুরু করেছিলেন ১৯৩৮ সালে, বিভাদেরই সঙ্গে প্রায় একই সময়ে। তিনি ব্লাউদের গবেষণাপত্র থেকেই প্লেট ব্যবহারের কথা জেনেছিলেন। তিনি জানতেন যে বিভারা একই ধরনের কাজ করেছেন, তাঁর বইতে তিনি লিখেছিলেন যে ১৯৪১ সালেই বোস ও চৌধুরী তাঁদের প্লেটে ইলেকট্রনের থেকে ২০০ গুণ বেশি ভরের কণাদের খুঁজে পেয়েছিলেন। তাহলে কেন বিভারা পিছিয়ে পড়েছিলেন? বিভারা যে ফটোগ্রাফিক প্লেট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, তা হল ইলফোর্ড কোম্পানির হাফটোন প্লেট। আগেই বলেছি ইলফোর্ডের প্লেটের উন্নতিতে ব্লাউয়ের ভূমিকা ছিল। হাফটোন প্লেটের একদিকে ইমালশন লাগানো থাকে, ফুলটোন প্লেটের থাকে দু-দিকে। স্বাভাবিকভাবেই ফুলটোন প্লেট অনেক ভালো, কিন্তু তার দাম অনেক বেশি। নীচের ছবিদুটো দেখলেই ফুলটোন প্লেট কত ভালো বুঝতে পারব।

বিভারা কাজ শুরু করার অল্পদিন পরেই ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন সমস্ত ফুলটোন প্লেট সৈন্যবাহিনীর কাজে নিয়ে নেওয়া হয়। ফলে বিভাদের হাফটোন প্লেট দিয়েই কাজ চালাতে হয়। তাই তাঁদের ভর মাপাটা ত্রুটিমুক্ত হয়নি। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে কোডাক ও ইলফোর্ড কোম্পানি থেকে আবার ফুলটোন প্লেট গবেষণার জন্য পাওয়া যায়, যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তাদের মানও ইতিমধ্যে অনেক ভালো হয়েছে। পাওয়েলরা সরাসরি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্লেটের আরো উন্নতি ঘটান। বিভারা ১৯৪৪ সালেই এই বিষয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ব্লাউ মেক্সিকোতে, সেখানে গবেষণার কোনো সুযোগই নেই। ব্লাউ অস্ট্রিয়া ছাড়ার পর ওয়ামবাখার কাজ নিয়ে বিশেষ এগোতে পারেননি। পাওয়েলরা ব্রিস্টলে উন্নত প্লেট নিয়ে কাজ শুরু করে পরপর অনেক নতুন কণা খুঁজে পেলেন। ১৯৫০ সালে পাওয়েল পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ফটোগ্রাফিক প্লেটের সাহায্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণার পদ্ধতির উন্নতি ঘটানো ও তার সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের মেসন আবিষ্কারে জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ইউকাওয়া নোবেল পেয়েছিলেন তার আগের বছর।

আমি এমন বলি না যে পাওয়েলকে নোবেল দেওয়া উচিত হয়নি। মহাজাগতিক রশ্মি ধরার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেটের অনেক উন্নতি তাঁর ল্যাবরেটরি থেকে হয়েছিল। বিভারা বলেননি যে তাঁরা দুটো আলাদা কণা পেয়েছিলেন। পাওয়েল নিশ্চিতভাবে কণাগুলোকে চিনতে পেরেছিলেন। ১৯৫১ সালে ডি.এম. বোসও এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে পাওয়েলের গবেষণা নোবেল পুরস্কারের যোগ্য। নোবেল কমিটি বিভাদের নাম বিবেচনাতেই আনেনি, সম্ভবত সদস্যরা ভেবেছিলেন যে বিভারা শুধু মিউয়ন দেখেছেন। তার কারণ আগেই বলেছি, হাফটোন প্লেট ব্যবহার করে ভর মাপাতে কিছুটা ত্রুটি ছিল, ফলে দুই ধরনের কণার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। বিভা ও দেবেন্দ্রমোহন সেই দাবিও করেননি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না বাধলে বিভারা হয়তো ফুলটোন প্লেট ব্যবহার করতে পারতেন। তাহলে পাই মেসনের আবিষ্কর্তা হিসাবে বিভা চৌধুরী ও দেবেন্দ্রমোহন বোসের নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে লেখা থাকত। তবে বাস্তব হল বিভা ও ডি.এম. বোসের নাম নোবেলের জন্য কেউ মনোনীত করেনি।

ব্লাউয়ের নাম নোবেল কমিটি ভুলে গেল কেমন করে? ব্লাউ ও ওয়ামবাখারের নাম নোবেলের জন্য মনোনীত করেছিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দুই আবিষ্কারকের একজন, বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার। ওয়ামবাখারের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকেই, কারণ ব্লাউ নিঃসন্দেহে ছিলেন নেত্রী। ব্লাউয়ের পরে ওয়ামবাখার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একা বিশেষ কিছুই করতে পারেননি। ১৯৫০ সালে নোবেল কমিটি তার সদস্য অ্যাক্সেল লিন্ধকে ব্লাউদের বিষয়ে রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব দেয়। তিনি ইলফোর্ড কোম্পানির ইমালশন উন্নতিতে ব্লাউয়ের অবদানের কথা উল্লেখ করলেন না। আশ্চর্য এই যে লিন্ধ তার আগের বছরই সিসিল পাওয়েলের জন্যও রিপোর্ট লিখেছিলেন এবং সেখানে ইমালশনের উন্নতিতে ব্লাউ ও ওয়ামবাখারের অবদানের কথা ছিল। ওয়ামবাখারের যে প্রবন্ধের কথা আগে বলেছি, তার উল্লেখ করে লিন্ধ ইমালশনের মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া দেখার বিষয়ে ব্লাউয়ের কৃতিত্বকে আদৌ গুরুত্ব দেননি। নোবেল কমিটি বাস্তব পরিস্থিতিকেও অবহেলা করেছিল। লিন্ধ রিপোর্টে লিখেছিলেন যে ১৯৩৮ সালের পর ওয়ামবাখার গবেষণাপত্র ছাপালেও ব্লাউ ছাপাননি। মাইটনারের ক্ষেত্রেও একবার একইরকম মন্তব্য এসেছিল, নিউক্লিয় বিভাজন আবিষ্কারের পরে দুই বছর তিনি কোনো গবেষণা করেননি। দুজনকেই কোন পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, তা বিবেচনার প্রয়োজন ছিল। মাইটনারকে নানাভাবে পদার্থবিজ্ঞানী মহল মনে রেখেছে, ব্লাউয়ের ক্ষেত্রে আমরা সেই সান্ত্বনাটুকুও পাই না।

বিভা গবেষণার জন্য ১৯৪৫ সালে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি ম্যানচেস্টার থেকে প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের অধীনে কাজ করে থিসিস জমা দিলেন, বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে মহাজাগতিক রশ্মির সংঘর্ষের ফলাফল নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন। ব্ল্যাকেট তার আগের বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে বিভা ডক্টরেট ডিগ্রি পান। ব্রিটেনে তাঁর কাজ সাধারণের মধ্যেও ঔৎসুক্য জাগিয়েছিল, ম্যানচেস্টার হেরাল্ড পত্রিকাতে তাঁর সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল।

১৯৪৯ সালে বিভা বম্বের টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে প্রথম মহিলা বৈজ্ঞানিক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। ইন্সটিটিউটের প্রধান ভাবা নিজে উৎসাহ করে তাঁকে নিয়ে আসেন, মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে ভাবার গবেষণা পৃথিবী বিখ্যাত। ১৯৫৫ সালে ইতালিতে এক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বিভা, এছাড়া আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প দিন পড়িয়েছিলেন। বম্বেতে তিনি ছিলেন আট বছর। এরপর একবছর বিদেশে কাটিয়ে আমেদাবাদে ফিজিক্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন। বিখ্যাত মহাকাশবিজ্ঞানী বিক্রম সরাভাই তখন সেখানকার প্রধান। কোলার সোনার খনির ভিতরে নেমেও মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন। আমেদাবাদ থেকে তিনি স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও  ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মিলে গবেষণা তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন।

বিভার পরিচিত সকলেই একমত যে তিনি ছিলেন চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির। দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি এত গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণা করেছেন। আমেদাবাদে তাঁর কাছে গবেষণা করে ডক্টরেট করেছিলেন যোগেশ চন্দ্র সাক্সেনা। তিনি বিভার পড়ানো ও বিজ্ঞানে দখলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিভার কাছে তিনি ফরাসি ভাষাও শিখেছিলেন। বিভা মনে করতেন আরো বেশি সংখ্যক মেয়ের বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণায় আসা উচিত। ১৯৯১ সালের ২ জুন তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর নাম এখন মহাকাশে অমর হয়ে রইল।

——————–

(সম্পাদকীয় সংযোজন: সেক্সটান্স নক্ষত্রমণ্ডলে সৌরজগৎ থেকে ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরে একটি হলদে-সাদা বামন তারার নাম দেয়া হয়েছে বিভা। তার একটি গ্রহের খোঁজও মিলেছে। গ্রহের নাম দেয়া হয়েছে সংতামস। এর অর্থ হল ‘মেঘাচ্ছন্ন।’ ২০১৯ সালে ইনটারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ইউনিয়ন একটি বিশ্বজোড়া প্রতিযোগিতা করে নামদুটো বেছে নিয়েছে।বিভা নামটি রেখেছেন সুরাটের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ছাত্র শ্রী অনন্য ভট্টাচার্য আর সংতামস নামটা রেখেছে পুনণের তেরো বছুরে ছাত্র বিদ্যাসাগর দাউড়। সঙ্গে তাদের ছবি রইল। উৎস: vigyanprasar.gov.in

জয়ঢাকের বৈজ্ঞানিকের দপ্তর 

Leave a comment