ঘোড়ুইদাদু তাঁর বাগানটা বেচে দেবেন। খদ্দের দেখা হয়ে গিয়েছে। পাকা কথাও নাকি সারা হয়ে গিয়েছে। বিচ্ছিরি খবরটা কানে আসা ইস্তক কাজে আর মন বসছে না গুবলেটের। বার বার চোখ চলে যাচ্ছে ঝাঁকড়া মাথা কর্পূরগাছটার দিকে। এতদিনের সব আশা তবে কি ডাহা জলে গেল? মিন্টুর মা একদিন গল্প করেছিল, কর্পূরগাছটার গোড়াতেই নাকি পরিরা থাকে। কে নাকি কবে তাদের দেখেছেও! গুবলেট সাগ্রহে জানতে চেয়েছিল, “সত্যিকারের পরি? তুমি কোনোদিন দেখেছ কাকিমা?”
সে প্রশ্ন শুনে মুখ বাঁকিয়ে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে মিন্টুর মা তো হেসেই খুন! “হ্যাঁ রে ছেলে, আমি কি অত ভাগ্য নিয়ে এসিচি নাকি যে দিনেদুপুরে খোলা চোকে পরি দেখব? কপাল ভালো থাকলে ওসব হয় রে।”
কপালের কথা গুবলেটের মাও বলে। ঠিকই! কপাল ভালো হলে কী না হয়! অনেক ছেলেবেলায় গুবলেট অবশ্য দু-একবার শুনেছিল পরিদের দেখা যে একবার পায়, দুঃখকষ্ট অভাব-অভিযোগ তার নাকি জীবনের মতো ঘুচে যায়। তবে মন থেকে তাকে সৎ হতে হয়। সৎ কথাটার মানে গুবলেট বুঝত না সেসময়। আর পরিদের কথাও তখন বিশ্বাস করেনি ও। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর গুবলেটদের ঘরে যখন টাকাপয়সার খুব টানাটানি, খাবারের অভাব, তখন ওর মনে হয়েছিল, যে করেই হোক এ জীবনে একবার পরিদের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। গুবলেট গরিবের ছেলে, ওদের ভাঙা ঘর, হপ্তায় রোজ ভালো করে খাওয়া হয় না এসব কথা শুনলে কি পরিরা একটুখানি ম্যাজিক শিখিয়ে পড়িয়ে দেবে না? খুব দেবে। তা সেই আশাতে বুক বেঁধেই গত চার বছরে গুবলেট অনেকবার চেষ্টা করেছে। অনেকবার। কিন্তু নাহ্! পরির দেখা পাওয়া তো দূরের কথা, ঘোড়ুইদাদুর বাগানে যে সত্যি সত্যিই তারা থাকে, তেমন কোনো প্রমাণই পায়নি ও। উলটে বছর পাঁচেকের ছোটো বোন টুকটুকি ওকে হাঁদা গঙ্গারাম, বুদ্ধু, ক্ষ্যাপা এসব বলেছে।
পরির প্রসঙ্গ উঠলেই টুকটুকি বলে, “তুই না, ভারি বোকা ছেলে দাদা। মিন্টুর মা তোকে বলল, আর অমনি তুই বিশ্বাস করে নিলি? আচ্ছা, তুই-ই বল, পরিরা কি কখনো গাছের গোড়ায় থাকে? শুনেছিস তুই?”
গুবলেট হাঁ করে টুকটুকির মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ফর্সা, রোগা আট বছরের মেয়েটা বেণী দুলিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলেই চলে, “শোন, ঠাকমা বুড়ি একবার বলেছিল, পরিরা থাকে দূর আকাশে, অনেক দূরে স্বর্গরাজ্যে। মাঝ-রাত্তিরেরও পরে সবাই যখন ঘুমে একেবারে কাদা, তুলোর মতো মেঘের ভেলায় চড়ে তারা ঝুপঝাপ নেমে আসে ফুলের বাগানে। ছোট্ট ছোট্ট কুঁড়িগুলোকে ফুল করে ফুটিয়ে তুলবে বলে। বুঝলি কিছু? হ্যাঁ?”
তা ভালো! থাক তারা। আকাশের বাগানেই থাক। মেঘের নৌকা চড়ে বাতাসেই ভেসে ভেসে বেড়াক। লুকিয়ে লুকিয়ে এসে ফুলের কুঁড়িই ফুটিয়ে যাক। গরিবের কথা ভাববে, সে অবসর কোথায় তাদের? বোনের কথায় গুবলেট ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়, কিন্তু মনে মনে ছেলেটা হতাশ হয়ে পড়ে। অভিমানে মন টইটম্বুর হয়ে ওঠে ওর। চোখ ছাপিয়ে তখন বান আসব আসব অবস্থা। সত্যিই, এই পরি দেখার চক্করে পড়েই পাঁচ-পাঁচটা বছর ঘোড়ুইদের বাগানে পড়ে রয়েছে ছেলেটা। ওর কান্না পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। বিমল সাহার চায়ের দোকান, গোপাল পালের রুটি-পরোটার দোকান, এমনকি দাসেদের জুতো কারখানায় কাজের সুযোগ পেয়েও গুবলেট যায়নি। সে কি আর এমনি এমনি? আর এখন তো কর্পূরগাছ সমেত গোটা বাগানটাই অন্য লোকে কিনে নেবে। গাছগুলো কেটেও দিতে পারে। ধুর ধুর!
***
ঘোড়ুইদাদুর অনেক বয়স। প্রায় নব্বই ছুঁই ছুঁই। মিন্টুর মা, নেপালকাকা, দীনুপিসে সবাই তাঁকে বাবামশাই বলে ডাকে। গুবলেট ডাকে দাদুমশাই বলে। মস্ত বড়ো বাড়িটায় বৃদ্ধ মানুষটা একেবারে একলা থাকেন। তাঁর সহায় বলতে চার পাঁচজন পরিচারক। গুবলেট তাদেরই একজন। একটা লোকের কাজ সারতে আর কতটা সময় লাগে! ঘণ্টা খানেক। বড়োজোর ঘণ্টা দুয়েক। এত লোকজন মিলে ঘোড়ুই-বাড়িতে তবে করেটা কী? আসলে চারতলা বাড়ি আর মস্ত বাগানটার দেখভাল করার জন্যই একাধিক লোক রেখেছেন ঘোড়ুইদাদু। ঘোড়ুইদাদুর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি, জ্ঞাতিগুষ্টি আছে অনেকেই। কিন্তু তারা থাকে অনেক দূরে। নদী-সমুদ্দুর পেরিয়ে সুদূর বিদেশে। এইখানে এই দেড়শো বছরের বাড়ি, গাছগাছালি, পাখপাখালির সবুজ সংসার আগলে দাদু একলাই পড়ে রয়েছেন। অনেকবার জোরজার করেও কেউ তাঁকে নিয়ে যেতে পারেনি। মায়ার বাঁধন, চাইলেই কি আর ছিঁড়ে ফেলা যায়?
লোকে বলে, সুকুমার ঘোড়ুইয়ের বয়স যখন মোটে বারো, তখন থেকেই তিনি বাগান করছেন। মানুষটা নাকি গাছেদের সঙ্গে কথাও কইতে পারেন। গাছেদের আবেগ, আনন্দ, ব্যথা, ব্যায়রাম স-ব বুঝতে পারেন মাত্র একবার হাত ছুঁইয়েই! ঘোড়ুইদাদু নাকি গাছ দেখেই বলে দিতে পারেন ফুল ফুটবে, নাকি শুধু পাতার ঝাড় হয়ে থাকবে। লোকে এমন কত কথাই না বলে! গুবলেট যদিও নিজে চোখে দেখেনি কখনো। সবই কানে শুনেছে। দুপুরের খাবার খেতে খেতে এমন সব আজগুবি কথা আলোচনা করে দীনুপিসেরা! ওসবে অবশ্য বিশেষ পাত্তা দেয় না গুবলেট। তবে ও দেখেছে, মাঝেমধ্যে রুপো বাঁধানো লাঠি হাতে বাগানের গাছগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ুই-বুড়ো তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। পরম মমতায় চেয়ে থাকেন ইয়াব্বড় বড়ো গাছগুলোর দিকে। নিজের মনেই হাসেন।
***
বেশ কিছুদিন ধরেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। সারাদিনের খাটাখাটনি সেরে ভরদুপুরে গাছতলাতে খেতে বসে রোজই গুবলেট দেখে তার টিফিনবাটির খাবারগুলো খুঁটে খুঁটে খাওয়া। রুটি ক’টা খানিকটা করে ছেঁড়া! তরকারির আলু নেই! পেঁয়াজ, লঙ্কা কামড়ে খাওয়া! মনে মনে টুকটুকিকে একচোট কথা শোনায় গুবলেট। এ-কাজ বদ টুকটুকি ছাড়া কি আর কারো হতে পারে? মা তো সেই কোন সকালে রান্না সেরে, খাবারগুলো রান্নাঘরের মেঝেতে ঝুড়ি-চাপা দিয়ে রেখে কাজে বেরিয়ে যায়। মা নিশ্চয়ই কৌটোর খাবার খুঁটে খায় না! আর ইঁদুরে যে খাবে সে উপায়ও নেই। ঝুড়ি-চাপা থাকে যে!
সেদিন খিদের মুখে আধখাওয়া রুটি দেখে গুবলেটের মেজাজটা গরম হয়ে গেল। বাড়ি ফিরেই বোনকে বেদম জেরা শুরু করল ও, “এই পাজি মেয়ে, তোকে বুঝি ইশকুলের টিফিন দেয় না মা, আমার কৌটো থেকে চুরি করে খাস যে বড়ো? মা আসুক, আজ তোকে মার খাইয়েই ছাড়ব। দাঁড়া!”
টুকটুকি তো আকাশ থেকে পড়ল! শান্তশিষ্ট দাদাটার হলটা কী? খাবার নিয়ে ঝগড়া! এমন তো কোনোদিনও হয়নি আগে! অন্যসময় দাদা নিজের পাত থেকে খাবার তুলে খাওয়ায়! তবে? টুকটুকি গাল ফুলিয়ে পেন্সিল ঠোঁটে চেপে বসে রইল। মনে মনে দুঃখ পেল ঠিকই, কিন্তু মুখে কিচ্ছুটি বলল না। ঝগড়া করতে করতে রেগে আগুন তেলে বেগুন গুবলেট একসময় খুঁটে খাওয়া রুটিটা টুকটুকির গায়ে ছুড়ে দিল। তারপর ধুপধাপ করে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এদিকে জালের মতো রুটিখানা হাতে নিয়ে নিমেষেই টুকটুকি বুঝে ফেলল এ-কাজ কোনো মানুষের নয়। এমনকি ইঁদুর, ছুঁচো কারো নয়। টুকটুকি বুদ্ধিমতী মেয়ে। দাদা ঝগড়া করেছে বলে কান্নাকাটিতে সময় নষ্ট না করে মনে মনে জম্পেশ একখানা ফন্দি এঁটে নিল সে।
***
গরমের শুরুতেই একের পর এক খারাপ খবর। ছয়-সাতদিন ধরে খবরে বলছে মে মাসের শুরুতেই নাকি ভয়ানক এক ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়বে উপকূল অঞ্চলে। আয়লা, ফণী ওসব তো বাচ্চা ছিল। এ ঝড়টা নাকি আরো ভয়ংকর! গুবলেটরা একেবারে সমুদ্র-তীরের বাসিন্দা না হলেও ওদের জগৎসিংহপুর থেকে বঙ্গোপসাগর খুব দূরেও নয়। তার ওপর ওদের টিনের চালওয়ালা কুঁড়ে বাড়ি। ঘরের দরজা-জানলা সব ঢকঢক করছে। মেরামত হয়নি বহুকাল। ঝড়ে যদি সব উড়ে যায়, পোঁটলা নিয়ে ওদের গাছতলায় বসতে হবে। দুশ্চিন্তায় গুবলেটের মায়ের চোখে ঘুম নেই। গুবলেট কাজ থেকে ফিরলে রোজই ওর মা জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে বাবু, খবরে আজ কী বলল রে?”
ঘোড়ুইদাদুর বাড়িতে বিকেলের খবর শুনে যা যা জানতে পারে, মাকে সে-সব বুঝিয়ে বলে গুবলেট।
ওদিকে ঝড়ের খবর শুনে ঘোড়ুইদাদুর ভীষণ ভয় বাগানের বয়স্ক গাছগুলোকে নিয়ে। গোড়া উপড়ে গেলে যে তাঁর আত্মীয় বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী! কর্পূরগাছটার মোটা মোটা বুড়ো ডাল, একটু জোরে হাওয়া বইলেই পাগলের মতো দোলে! মড়মড় চড়চড় শব্দ হয়। ওই গাছটাকে নিয়ে তো গুবলেটেরও চিন্তা। ভালোমন্দ কিছু যদি হয়ে যায়, ওর স্বপ্নটা যে আর কোনোদিন সত্যি হবে না! সময় থাকতে থাকতেই কর্পূরগাছটাকে বেশি করে আগলাতে ইচ্ছে হয় গুবলেটের। প্রিয় গাছের যত্নআত্তিতে খুশি হয়ে যদি পরিদের কেউ একজন চোখের সামনে এসে পড়ে!
***
সকলের ভয় সত্যি করেই মে মাসের চার তারিখে শনিবার বেলার দিক থেকে আকাশের মুখখানা একেবারে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠল। কারেন্ট অফ। রেডিওতে ঘনঘন সতর্কবার্তা ভেসে আসছে। নারকেল, আম, জাম, কাঁঠালের ডালপালা পাগলা হাতির মতো মাথা দোলাচ্ছে। উলটোপালটা হাওয়া। অপেক্ষাকৃত নরম কাণ্ডের ফুলগাছগুলোর পাশে পাশে দড় কঞ্চির ঠেকো পুঁতে দিচ্ছিল গুবলেট। হঠাৎই একটা রিনরিনে গলা শুনে ও চমকে উঠল। কে যেন চিঁ চিঁ করে চেঁচাচ্ছে! সোঁ সোঁ করে হাওয়া চলছে। শুকনো পাতা, ধুলোবালি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে, কান খাড়া করেও কিচ্ছু বুঝতে পারল না গুবলেট। হাত চালিয়ে কঞ্চির সঙ্গে দড়ি দিয়ে গোলাপগাছের ডালগুলো বাঁধতে লাগল। পুষ্পপ্রদর্শনী থেকে কেনা বিলিতি গোলাপ। সারে সারে বসানো। দাদুমশাইয়ের বড়ো শখের। গুবলেট দেখেছে, একবার কাণ্ড ভেঙে গেলে এসব গাছ আর বাঁচে না। তাই ঝড়ের হাত থেকে ওগুলোকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছে গুবলেট।
দেখতে দেখতেই আড়াইটে তিনটে নাগাদ চারদিক অন্ধকার করে সন্ধে নেমে এল। কালো আকাশের বুকে মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ আলোর তরোয়াল চলছে। বাজের শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। মেঘগুলো যেন এক-একটা বিশালাকার দৈত্য। আকাশ রাজ্যের ভাগ-দখল নিয়ে একদল অন্যদলের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আজ। কালো মেঘেরা একপক্ষ আর নীলচে সাদা মেঘের দল আরেক পক্ষ। খানিকক্ষণ দুই পক্ষের তর্জন গর্জন চলল। তারপর বড়ো বড়ো বরফের ফোঁটা হয়ে আকাশ থেকে ঝরে পড়তে লাগল শিলাবৃষ্টি। বিরাট হল-ঘরে ঘোড়ুইদাদুর আরামকেদারার পাশে বসে ভয়ে কাঁপছিল গুবলেট। বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজেও গিয়েছে ও। ঠান্ডা লাগছে। ঘোড়ুই-বাড়ির দরজা-জানালাগুলো ঠকঠক করে কাঁপছে। পুরোনো জামরুলের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে ছাদের ওপর। বাগানের অবস্থা খুবই খারাপ। বড়ো বড়ো গাছগুলোর মাথায় কেউ যেন দড়ি বেঁধে টান মারছে। হাওয়ার দাপটে মাটির কাছাকাছি মাথা নুইয়ে একপাশে হেলে পড়ছে তারা। পরক্ষণেই ঝটকা খেয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় হিমশিম খাচ্ছে। গুবলেটের এক-একবার মনে হচ্ছে ঘোড়ুইদাদুর গোটা বাড়িটাই যেন থরথর করে কাঁপছে!
ঘোড়ুইদাদু রেডিও চালিয়ে নিজের ঘরে বসে রয়েছেন। এমন দুর্দিনে খবর শোনা খুব জরুরি। অন্য সহায়কেরা যে যার বাড়ি চলে গিয়েছে। আটকে পড়েছে কেবল গুবলেট। বেচারা একা বসে বসে ভাবছে ঝড়ের দাপটে এত বড়ো বাড়িটার যদি এই হাল হয়, তাহলে তাদের কুঁড়েঘরের কী অবস্থা হচ্ছে কে জানে! বোন আর মায়ের জন্য প্রবল দুশ্চিন্তা হচ্ছে গুবলেটের। সেদিন যখন টিফিন চুরি নিয়ে ঝগড়া করেছিল, টুকটুকি জোর করে কান্না চেপে মাথাটা নীচু করে বসে ছিল। থেকে থেকেই ছোটো বোনের কান্না মাখা মুখখানা গুবলেটের চোখের সামনে ভেসে আসছে।
***
“গুবলেট, ও গুবলেট… আমাকে একটু সাহায্য কর না। আমি যে আটকে পড়েছি।”
কতক্ষণ ঝড়বৃষ্টি চলেছে তার হিসেব নেই। মিষ্টি গলার ডাকটা শুনে ঝিমুনি ভাবটা কেটে গেল গুবলেটের। খুব সরু গলায় ধীরে ধীরে কে যেন ওকে ডাকছে!
“গুবলেট, এই গুবলেট… শুনতে পাচ্ছ? ধুর বাবা, এত ঘুমকাতুরে হলে চলে নাকি?”
এদিক ওদিক চেয়ে গুবলেট তো কাউকেই দেখতে পেল না। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। জানালার কাচ ঝাপসা। উঠে দাঁড়িয়ে চোখদুটো বার কতক কচলে জানালার কাছে যেতে যাবে, সেই সময় ওর চোখে পড়ল টিফিন-বাটিটা যেন অল্প অল্প নড়ছে। ডাকটা কি তবে কৌটোর ভেতর থেকে আসছে? মনে হতেই উবু হয়ে বসে গামছার বাঁধনটা খুলতে লাগল গুবলেট। অনেক পুরোনো স্টিলের টিফিন-কৌটো। মাজতে মাজতে বেঁকে গিয়েছে। দুটো বাটির মধ্যিখানে প্রায় আধ-আঙুল মতো ফাঁক। সেই ফাঁকের ভেতর থেকে পাতলা ফিনফিনে একটা সবুজ পালক বেরিয়ে রয়েছে। প্রায় মিনিট খানেক সেইদিকে তাকিয়ে হাঁ করে বসে রইল গুবলেট। পরক্ষণেই ওর বুকের মধ্যে একটা খরগোশ লাফিয়ে উঠল! এ কী দেখছে? মিন্টুর মা তাহলে মিথ্যে বলেনি? পরি আছে? সত্যি সত্যিই আছে?
টিফিন কৌটোর ওপরের বাটিটা সরাতেই গুবলেটের তো চক্ষু চড়কগাছ! একরত্তি ছোট্ট একটা মেয়ে ওর টিফিন বাটির ভেতর দাঁড়িয়ে। কাঁদো কাঁদো মুখ! মেয়েটা খুব ব্যস্ত হয়ে বলল, “এই দেখো গুবলেট, আজ তোমার টিফিন-বাটিতে রুটির ঠিক পাশে কে যেন খানিকটা আঠা লাগিয়ে দিয়েছিল। আমার গায়ের পালকগুলো আঠাতে আটকে গিয়েছে। বড্ড লাগছে আমার। আমাকে তাড়াতাড়ি বের করো লক্ষ্মীটি। আমাকে যে বাড়ি ফিরতে হবে!”
গুবলেট নিজের চোখ, কান কোনোটাকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কী হচ্ছে কে জানে! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে নাকি? তবুও মেয়েটার তাড়া খেয়ে রুটি তিনটে সরিয়ে ধীরে ধীরে আঠার বাঁধন থেকে মেয়েটার পালকগুলো ছাড়াতে লাগল ও। গুবলেটের হাতের নাগালেই অদ্ভুত এক প্রাণী। কথা বলছে। অঙ্গভঙ্গি করছে। ছোট্ট মুখ, নাক, চোখ, কান সব রয়েছে তার। অবিকল মানুষের মতোই দুটো হাত, দুটো পা। মাথাভর্তি চুল। শুধু সারা গায়ে সবুজ রঙের মোলায়েম পালকের আবরণ। অনেকটা জামার মতোই। এটাই কি তাহলে পরি? পরিদের বুঝি এইরকম দেখতে হয়? কিন্তু গুবলেট যে শুনেছিল পরিদের ডানা থাকে! তারা নাকি উড়তে পারে! কই, এই মেয়ের পিঠে তো ডানা নেই! যাই হোক, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা চালিয়ে মেয়েটাকে উদ্ধার করল গুবলেট।
বাইরে চারদিকে জল জমে গিয়েছে। তবে বৃষ্টির তেজটা এখন যেন একটু কম। জানালার বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে মেয়েটা লাফিয়ে উঠল। “এমা, কর্পূরগাছটার গোড়াতে অত জল! আমাদের বাড়িঘর সব বুঝি ভেসে গিয়েছে! বাড়িতে আমার মা আর বোন একা রয়েছে। আমি না ফিরতে পারলে কে বাঁচাবে ওদের?”
গুবলেটের বড্ড মায়া হল। বাগানের উত্তরে যেখানে কর্পূরের গাছটা দাঁড়িয়ে, সেখানে জল জমেছে ঠিকই, কিন্তু তাতে বড়োজোর মানুষের পায়ের পাতাটুকু ডুববে। তবে এই ছোট্ট ছোট্ট মানুষ, থুক্কি, পরিগুলোর কাছে ওটা একটা মহাসমুদ্র। মুচকি হেসে গুবলেট সবুজ মেয়েটাকে নিজের হাতের পাতায় তুলে নিল। “চিন্তা নেই। চলো আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”
ছলছল চোখে মেয়েটা গুবলেটের মুখের দিকে তাকাল। তার হাতে কাঁঠালপাতা দিয়ে তৈরি একটা ছোট্ট পুঁটুলি। একটু ছেঁড়া রুটি আর ভাঙা পাটালি ভরে নিয়েছে তাতে। গুবলেটের চোখে পড়েছে, কিন্তু কিছুই বলল না ও। মেয়েটা ওর আঙুল জড়িয়ে চুপচাপ বসে রইল। কাদা-জল পেরিয়ে, ভাঙা ডালপালা সরিয়ে সরিয়ে গুবলেট সেই একরত্তি সবুজ মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে চলল কর্পূরগাছটার দিকে।
ছোট্ট সবুজ পরিকে ফিরে পেয়ে তার পরিবার যারপরনাই খুশি হয়েছিল। মা-পরি গুবলেটকে অনেক আশীর্বাদও করেছিল। মানুষের দোষে পরিবেশটা বদলে যেতে কেমন করে চেয়েচিন্তে, এদিক সেদিক থেকে খাবারদাবার জোগাড় করে এখন পরিদের দিন গুজরান হয়, সে-সব গল্পও করেছিল মা-পরি। নিজের দুঃখের কথা গুবলেট আর মুখ ফুটে বলতে পারেনি ওদের। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে ও কেবল আদরের বোন টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছিল।
অলঙ্করণ-সৃজন কাঞ্জিলাল
কী সুন্দর! ভারী নির্মল, আর ঝকঝকে গল্প। মন ভালো হয়ে গেল।
LikeLike
ভীষণ সুন্দর একটা গল্প…
LikeLike