শেলী ভট্টাচার্যের আগের গল্প- ট্রি-বট
বহুবছর প্রবাসে থেকে ন’দিন ধরেই আমরা দুর্গাপূজার আনন্দ নিই। নবরাত্রির শেষদিনে মা গুরগাঁও বাস স্ট্যান্ডের পাশের মন্দিরটাতে যায়। তার বাইরের সিমেন্টের চত্বরে লেপ্টে বসে থাকে কিছু বাচ্চা। এক এক করে থার্মোকলের প্লেটগুলো মা তুলে দেয় ওদের হাতে। সকাল সকাল উঠে সুজির হালুয়া আর লুচি করে মা। নিজের হাতে রান্না করা সেই খাবারগুলোই ওদের খাইয়ে আসে।
তবে এবার মা বেশ চিন্তায় পড়েছিল। বলছিল, সেদিন এতজন ওদের খাওয়াতে হুড়োহুড়ি করে যে, ওদের পেটে আর জায়গাই থাকে না। ওইটুকু তো পেট। তারপর আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওইটুকু মনকে খুশি করা যায় কীভাবে বল তো?”
আমি চুপচাপ শুনে বলেছিলাম, “আমি কী করে জানব?”
“খাবার বাদে তুই কী পেলে খুশি হোস, তাই বল।” মা বলেছিল।
আমার প্রিয় জিনিস বেলুন জেনে এক প্যাকেট বেলুন কিনেছিল। বের হবার আগে সবক’টা বেলুন ফুলিয়ে লম্বা সুতো দিয়ে বেঁধে বেলুনওলার মতো নিয়ে গেলাম আমরা। সেদিন খাবার দেওয়ার পর আমার হাত দিয়ে বেলুনগুলোকে বাচ্চাদের হাতে তুলে দিয়েছিল মা। আমি দেখলাম, মুহূর্তে ওদের চোখগুলোতে কেমন যেন খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠল। কিন্তু আমার মনটা খারাপ লাগছিল। মা যে একখানা বাদে সব বেলুনই ওদেরকে দিয়ে এল।
বাড়ি ফেরার পথে মা আমায় একটা গল্প শোনাল। এক রাজা নাকি বেজায় ব্যস্ত থাকার জন্য জগন্নাথ ধামে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেও সময় করে যেতে পারছিলেন না। তখন তিনি তাঁর এক বিশ্বস্ত প্রজার হাতে একশো টাকা দিয়ে জগন্নাথজির পুজো দিতে পাঠিয়েছিলেন। সেদিন রাতে রাজা স্বপ্নে দেখেছিলেন, জগন্নাথজি সুপ্রসন্ন হয়ে তাঁর আটানব্বই টাকার উল্লেখ করলেন। রাজা ভাবলেন, বাকি দুই টাকা কোথায় গেল? পরে প্রজার কাছে জেনেছিলেন, সে নাকি আটানব্বই টাকার খাবার কিনে মন্দিরের বাইরের গরিবদেরকে দিয়েছিল। আর দুই টাকা দক্ষিণা দিয়েছিল মন্দিরে।
গল্পটা শুনে আমি মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলেছিলাম, “বুঝেছি।”
সেদিন রাতে আমিও স্বপ্ন দেখলাম, একরাশ রংবেরঙের বেলুন হাতে নিয়ে খালি পায়ে ছুটে চলেছে সেই বাচ্চাগুলো। আমি দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছি ওদের। আমার সারা গায়ে কে যেন স্নেহের হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ঠিক মায়েরই মতো।
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস