গল্প-হারানো হিরে- কিশোর ঘোষাল-জয়ঢাক৪৮

কিশোর ঘোষাল   এর  আরো গল্প-উপন্যাস- ছোট্ট হওয়া,   হেমকান্ত মীনভূতডাঙার গল্প, ভূতের ভরসাআমায় ওরা পোষেবাসাবদলওঁরাই তাঁরা, সরুতান্ত্রিকের চ্যালা, বাসাবদল, ছোট্ট হওয়া

golpohire01 (2)

ভীষণমামা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে আমরা দোতলার ঘর থেকেই টের পেয়ে যাই ও আসছে। প্রত্যেকটা সিঁড়ির ধাপে দুপায়ে দাঁড়িয়ে তারপর নেক্সট স্টেপে পা ফেলে। ওর ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের এবং পায়েরও ভারী আওয়াজ সহজেই কানে আসে। মামা ১৫৭.৬ সেমি লম্বা। ওজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন কেজির বেশি হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু আপাতত সেঞ্চুরি পার করে একটু থিতু হয়েছে ১০৩.৫ কেজিতে। তার মানে ওর বডি মাস ইনডেক্স ৪১.১। ওবেসিটির চূড়ান্ত।

সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি আমার ঘরে লাইফ সায়েন্স পড়ছিলাম। মা আমার ঘরেই বসে ছিলেন। পুজোর রেকাবি ঢাকা দেওয়ার খঞ্চপোশ বানাচ্ছিলেন মা –কাঁটা আর সাদা সুতো দিয়ে। মায়ের হাতের টানাপোড়েনে সুতোর লাচিটা মেঝের এধার থেকে ওধার গড়াচ্ছিল –হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে ওটা জ্যান্ত। মা বুনতে বুনতেই আমাকে বললেন, “কি ব্যাপার বল তো? সাগর আজ একটা করে স্টেপ জাম্প করে সিঁড়ি উঠছে…! কোনদিন এমন করে না তো। মনে হচ্ছে খুব টেনশনে আছে…।”

ভীষণমামার নাম কিন্তু মোটেই ভীষণ নয়, তাঁর নাম ভবসাগর সেন –সংক্ষেপে বি.এস সেন, সেখান থেকে আরও সংক্ষেপে –ভীষণ –অবিশ্যি এর পিছনে তাঁর মেদবহুল শরীরটিও অনেকাংশে দায়ী। ভোলাভালা, সরল সজ্জন এই মানুষটি আমার মায়ের সত্যি সত্যি ভাইও নন। বিয়ের পর আমার মা যখন এ পাড়ায় আসেন তখন বাবার চেয়ে বয়সে ছোট পাড়া-প্রতিবেশীরা মাকে স্বাভাবিকভাবেই বৌদি বলতেন। ভীষণমামার নাকি সেটা পছন্দ হয়নি, মাকে বলেছিল, “আমি সকলের মতো আপনাকে বৌদি ডাকব না…।” বয়সে অনেকটাই ছোট গুবলু-গাবলু লাজুক ছেলেটির কথায় মা হেসে ফেলে বলেছিল, “ওমা, তাই নাকি? তা হলে কি বলে ডাকবে?”

“তুমি আমার দিদি হলে বেশ হত, আমি তোমাকে দিদি ডাকব, ব্যস।”

“বাঃ, সে তো বেশ মজা হবে। আমরাও তো দুই বোন –কোন ভাই নেই। সেই ভালো, আজ থেকে তুমি আমার ভাই হলে…।”

এসব ঘটনা তো হয়ে গেছে আমার জন্মের অনেক আগে। ভীষণমামাকে আমরা তাই আমাদের সত্যিকার মামা বলেই জানি।

“দিদি, কী করছ? প্রতিমা বলল তুমি ওপরের ঘরে রয়েছ।”

বলতে বলতে ভীষণমামা ঘরে ঢুকলেন। মা মুখ না তুলেই বললেন, “এতক্ষণ তোর পায়ের শব্দ শুনছিলাম, এখন তোর গলা শুনলাম। বহুদিন ধরে বলছি ওয়েটটা এবার কমা, সাগর। এই বয়সেই বড়ো অসুখে পড়ে নিজেও ভুগবি –সব্বাইকে ভোগাবি।”

“চেষ্টা কম করছি ভাবছ? অনেক চেষ্টা করছি। খাওয়া-দাওয়া তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। রাত্রে মাত্র চোদ্দটা রুটি খাই। তার ওপর আলু খাওয়া অলমোস্ট ছেড়ে দিয়েছি বলতে পারো। তরকারির আলু তো খাইই না, ভাতের সঙ্গে শুদ্ধু আলুভাতে আর লুচি বা পরোটা হলে আলু চচ্চড়ি। ব্যস আর নো আলু। দ্যাখো না, কদিনের মধ্যে কেমন চিমসে মেরে যাই। তখন আমাকে চিনতেও পারবে না দিদি।”

“এই তোর খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেওয়ার নমুনা? বললে কথা শুনবি না, সে আমি জানি। কারণ আমি তো আর তোর সত্যি সত্যি দিদি নই, শুনবি কেন? নিজের দিদি হলে ঠিক শুনতিস।”

“এই দ্যাখো, কী কথায় যে কী কথা তুমি এনে ফেলো না, দিদি…।”

“থাক ওসব আর আমায় শুনিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে বল কী হয়েছে? মনে হচ্ছে খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছিস?”

মায়ের এই কথায় আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে ভীষণমামাকে দেখলাম। কোথাও দুশ্চিন্তার কোন লক্ষণ ধরতে পারলাম না। কিন্তু ভীষণমামার অবাক হওয়া মুখ দেখে বুঝলাম মা ঠিকই বলেছেন। মা কিন্তু একমনেই হাতের কাজ করছিলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণমামা বললেন, “তোর মা কী করে সব ধরে ফেলে বল তো? কিছুই বললাম না, কিছুই করলাম না –কিন্তু ঠিক ধরে ফেলল আমি ঝামেলায় পড়েছি?” আমি হেসে ঘাড় নেড়ে বললাম, “কার মা সেটা দেখ। আমারই তো মা।”

মা কিছু বললেন না। খুব মন দিয়ে খঞ্চপোশ বুনছিলেন –কাঁটা আর সুতোর দ্রুত ওঠানামায় সুন্দর নকশা বেড়ে উঠছিল মায়ের হাতে। গম্ভীর মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ভীষণমামা বললেন, “জানো দিদি, পরপর দুদিন আমাদের দোকানে চুরি হয়ে গেল।”

“সে কি? কবে?”

“কাল আর আজ।”

“কি করে?”

“সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না।”

“তোদের দোকানে তো সিসিটিভি ইনস্টলড রয়েছে, না ? তাতেও ধরা পড়ে নি?”

“সেখানেই তো রহস্য। কালকে এবং আজকেও –দুবার মিনিট পনের কুড়ির জন্য কারেন্ট ছিল না। মনে হচ্ছে সেই সময়েই ঘটেছে ব্যাপারটা।”

“তোদের জেনারেটর নেই?”

“না। ইনভার্টার আছে। তাতে কিছু লাইট জ্বলে। এসি আর সিসিটিভি চলে না। আজকাল লোডশেডিং তো তেমন হয় না।”

“যে জিনিসগুলো হারিয়েছে তার কিরকম দাম হতে পারে?”

“কাল একটা হিরে বসানো পেন্ডেন্ট আর আজ একটা হিরের আংটি। দুটো মিলিয়ে মোটামুটি সাড়ে তিনতো হবেই।”

“সাড়ে তিন হাজার?” আমি জিগ্যেস করলাম। মা খুব চিন্তান্বিত মুখে উত্তর দিলেন, “দূর বোকা, লাখ।” একটু পরে মা আবার বললেন,”আচ্ছা, তোরা কি সিইএসসিতে ফোন করেছিলি? ওইসময় ওপাড়ায় লোডশেডিং হয়েছিল কি?”

“না। সিইএসসিতে ফোন করিনি। তবে আশেপাশে কোন দোকানেই কারেন্ট যায় নি, আমাদেরটা ছাড়া।”

“শিয়োর?”

“হ্যাঁ গো, দিদি, শিয়োর।”

“হুঁ। তার মানে লোডশেডিং নয়।”

‘না।”

“আচ্ছা, দুদিন কি একই সময়ে কারেন্ট চলে গিয়েছিল?”

“না। কালকে এই ধরো সাড়ে বারোটা নাগাদ। আর আজ তিনটের একটু পরে।”

“কী করে রেস্টোরড হল?”

“মানে?”

“মানে, কী করে আবার কারেন্ট এলো?”

“মেন সুইচের দুটো কিটক্যাট মিসিং ছিল।”

“কাল এবং আজ – দুদিনই?”

“দুদিনই। আমাদের দোকানের আট দশটা দোকান পরেই  “বিজলি” – ইলেক্ট্রিক্যালসের দোকান আছে – সেখান থেকে নতুন কিনে লাগাতে হয়েছে। আমাদের দোকানের সজল কিনতে গিয়েছিল, তাকে “বিজলি”র একজন সেলসম্যান বলেছে, “কীরে, রোজ দুটো করে কিটক্যাট কিনছিস – তোরাও ইলেক্ট্রিকের দোকান খুলবি নাকি?”

মা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবলেন। তারপর আবার জিগ্যেস করলেন, “পুলিশে খবর দিয়েছিস?”

“হ্যাঁ।”

“কিছু বলল?”

“কী আর বলবে? দোকানের সবাইকে এক এক করে জেরা করল। বিশেষ করে পাঁচজন কর্মচারি, দুজন সিকিউরিটি আর সজল – চা-টা দেয় ফাই ফরমাস খাটে। আমাদেরও সকলকে।

“তোদের সকলকে মানে? কে কে?”

“বাবা, জেঠু, বড়দা, মেজদা আর আমি।”

“আর কর্মচারি পাঁচজন?”

“তিনজন বহুদিনের পুরোনো – আমি জ্ঞান হয়ে থেকে দেখে আসছি -খুব বিশ্বাসী লোক। আর অন্য দুজন মেয়ে। দুজনেই বছর দুয়েক হল জয়েন করেছে  কাউন্টার সামলানোর জন্য।”

“তোরা পাঁচজনই কি রোজ সারাদিন দোকানে থাকিস?”

“না, না। আমি আর বাবা রোজ প্রায় সারাদিনই থাকি। বাবা ক্যাশে বসেন। তবে কার্ড দিয়ে কিনতে হলে আমাকেই দেখতে হয়। কার্ড পাঞ্চ করার ব্যাপারটা বাবা ঠিক পারেন না। অন্যরা মাঝে মাঝে আসে। কাল বড়দা – মেজদা  এসেছিল। আজ ওরা তো ছিলই – জেঠুও এসেছিলেন।

“কারেন্ট চলে যাওয়ার সময় কি ওঁনারা ছিলেন?”

একটু চিন্তা করে ভীষণমামা বললেন, “হুঁ … কাল যখন কারেন্ট যায়,বড়দা মেজদা দুজনেই ছিল। কারেন্ট ফিরে আসার আগেই দুজনে একইসঙ্গে বেড়িয়ে গেল…।”

“এক মিনিট, কালকে ঠিক কখন প্রথম ধরা পড়ল যে নেকলেসটা খোয়া গেছে?”

“তা ধরো প্রায় সাড়ে চারটের সময়। তুমি তো জানো, দিদি, আমাদের শোরুমের বেশ সুনাম আছে, তার ওপর এখন বিয়ের সময় চলছে। এগারোটা সাড়ে এগারোটা থেকেই ভিড় বেশ জমে ওঠে। দুপুরের দিকে তো বটেই। আমাদের নানান আইটেম, ডিসপ্লে বক্সে বা ট্রেতে সাবধানে সাজিয়ে রাখা থাকে। ভিড়ের সময় তাড়াতাড়িতে, লোকজনের চাহিদা অনুযায়ী জিনিস দেখাতে গিয়ে ওই বাক্স আর ট্রেগুলো একটু এলোমেলো হয়ে যায় আর কি। ভিড়ের চাপ একটু কমলেই আবার আগের মতো সাজিয়ে ফেলি ঠিক ঠিক বাক্সে বা ট্রেতে। কাল সাড়ে চারটে নাগাদ দোকানে ভিড়টা একটু হালকা হতে ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ল নেকলেসটা নেই।”

“আর আজ?”

“কালকের মতো আজও কারেন্ট চলে যাওয়ায় আমাদের মনে একটা সন্দেহ হচ্ছিলই। কাজেই আজ কারেন্ট আসার পরই আমরা সব খুঁটিয়ে দেখতে আরম্ভ করি এবং তখনই ধরা পড়ে যে একটা হিরের আংটি মিসিং– তা ধরো প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ।”

“নেকলেস খোয়া যাওয়ার ব্যাপারটা কালকে যখন ধরা পড়ল,কে কে জানত?”

“কেন? দোকানের সবাই। এমনকি দুজন – না, তিনজন কাস্টমার ছিল তখন শোরুমে – তারাও।”

“তোর বড়দা, মেজদা, জেঠু?”

“না ওঁদেরকে জানানো হয় নি। আসলে কাল তো আমারাও ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না। অনেক সময় কি হয় নেকলেসের বাক্সের মধ্যে মখমলের যে আস্তরণ থাকে, তার তলায় চলে গেলে চট করে খুঁজে পাওয়া যায় না। কালকে আমরা সেটাই ভেবেছিলাম। প্রায় পঞ্চান্ন বছরের পুরোনো ব্যাবসা। আগে ছিল দোকান, এখন শোরুম – কিন্তু এমন তো কোনদিন হয় নি। তবে-”

“আজ যখন কারেন্ট চলে যায়,ওঁনারা কেউ ছিলেন না?”

“হুঁ, মেজদা ছিল। দুটো নাগাদ এসেছিল। আজও কারেন্ট চলে যাওয়ার পরপরই বেরিয়ে গেল। তারপর জেঠু, বড়দা আর মেজদা মিলে এসেছিল। আমিই ফোন করে ডেকেছিলাম। সাড়ে তিনটের সময় – যখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে ব্যাপারটা সিরিয়াস। ওঁনারা এলেন, এই ধরো, চারটে নাগাদ।”

“তারপর পুলিশকে কখন খবর দিলি?”

“জেঠুই সব শুনে বাবাকে বললেন পুলিশকে খবর দিতে। বড়দার সঙ্গে থানার ওসির চেনাশোনা আছে। বড়দাই ফোন করেছিল।”

“পুলিশ কখন এল?”

“প্রায় পৌনে পাঁচটা নাগাদ।”

“এসে কী কী করল?”

“বললাম না, সক্কলকে জেরা করল,কাউকে ছাড়ে নি।”

“সার্চ করে নি?”

“হুঁ, করল তো। সবাইকে। মেয়েদেরকেও। মেয়ে পুলিশও ছিল একজন। কিন্তু কিচ্ছু পাওয়া গেল না।”

“তোদেরকেও করেছিল?”

“আমাদেরকে? না, না। আমাদেরকে করেনি।”

“কেন?”

“যাঃ! কী যে বলো না তুমি দিদি! আমাদের দোকান আর আমাদেরকেই সার্চ করবে? নিজের দোকান থেকে কেউ মাল সরায় নাকি?”

“হতেই পারে। বলা যায় না।”

“কী বলছো, তুমি?”

মা কোন উত্তর দিলেন না। মুখ নীচু করে হাতের বোনাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, “ওই দ্যাখ, তোর কথা শুনতে শুনতে এক্কেবারে ভুলেই গেছিলাম। তুই সোজা দোকান থেকেই এসেছিস না? ছি ছি…নিশ্চয়ই তোর খিদে পেয়েছে। ভুটকু, প্রতিমাকে বলে আয় তো – সাগরের জন্যে দুটো পরোটা আর বেগুন চটপট ভেজে দিতে। একটু পরে চা। আমিও খাব এককাপ। নাঃ থাক, চা আর বলতে হবে না, এই অসময়ে। আর হ্যাঁ, পরোটাদুটো কড়া করে ভাজতে বলিসতো।”

আমি মায়ের কথা শেষ হবার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথা থেকে মায়ের কথাগুলো প্রতিমাদিকে ইকো করে দিলাম অবিকল। কারণ ঘর ছেড়ে বেরনোর ইচ্ছে আমার একটুও ছিল না। মায়ের কথাবার্তার ধরণটা ঠিক ফেলুদার মতো লাগছিল – জানিনা কেন মনে হচ্ছিল, মা ঠিক ধরে ফেলবেন এবং সেটা পুলিশের অনেক আগেই। আমি ঘরে ঢুকতেই ভীষণমামা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁরে, জ্যোতি, মোটে দুটো বললি?” আমি কিছু বলার আগেই মা বললেন –

“হ্যাঁ, মোটে দুটোই। এখন সওয়া আটটা বাজছে, তোরা আবার দশটার মধ্যে খেয়ে নিস- তখন আবার চোদ্দটা রুটি…”

“ঠিক আছে, দিদি, ঠিক আছে।”

“পরোটা আসতে আসতে আমার কয়েকটা ব্যাপার জানার আছে । তোদের এই জুয়েলারির শো রুম কি শুধু তোরাই চালাস, না তোর জেঠুরও অংশ আছে?”

“নাগো দিদি। বাবা আর আমিই চালাই। বাবারা দুভাই। আর দাদুর মোটা চারটে ব্যবসা ছিল। বাবাদের দুভাইকে সমান ভাগ করে দিয়েছিলেন। দুটো জুয়েলারি,একটা বস্ত্রালয় আর একটা ফার্মেসি। আমাদের ভাগে একটা জুয়েলারি আর ফার্মেসি, জেঠুর ভাগে আরেকটা জুয়েলারি আর বস্ত্রালয়।”

“তার মানে তোদের জুয়েলারি বা ফার্মেসির দোকানের লাভ লোকসানের দায়িত্ব তোর জেঠুদের নেই?”

“না।”

“হুঁ। আচ্ছা, দিনকয়েক আগে তোর মেজদা সম্পর্কে কী যেন বলছিলি…”

“মেজদা সম্পর্কে? কী বলেছিলাম বলো তো?”

“আরে বাবা, বলেছিলি না, মাধুরী মানে তোর বউদি মারা যাবার পর মেজদা কেমন যেন হয়ে গেছে…কী হয়েছে?”

“সে আর কী বলব, দিদি, ঘরের কথা। মেজদা আর আগের মতো নেই। বাজে লোকের সঙ্গে  মেলামেশা করে। অনেক রাত করে বাড়ি ফেরে। মানে কুসঙ্গে পড়লে যা হয় আর কি…।”

“তোর জেঠু কিংবা বড়দা নিশ্চই তোর মেজদাকে এসব ব্যাপারে প্রশ্রয় দেন না।”

“মোটেই না। তাই কেউ দেয় নাকি? জেঠু তো ভীষণ রাগারাগি করেন প্রায় রোজই। বড়দা- বড়বৌদিও কি কম বোঝাচ্ছেন? কিন্তু মেজদার কি মতিভ্রম হয়ে গেল… কারো কথাই শুনছেই না।”

“বদলোকের পাল্লায় পড়ে এইসব যে করে বেড়াচ্ছে, তার তো ভালোই খরচ-খরচা আছে নাকি? তা এতো টাকা পয়সা দিচ্ছে কে?”

মা যে কথাটা ভীষণমামাকে জিগ্যেস করলেন তা নয়। মাথা নীচু করে চিন্তা করতে করতে নিজের মনেই বললেন কথাটা। কিন্তু মায়ের কথাটা শুনে আমি তো বটেই, ভীষণমামাও হতভম্ব হয়ে গেলাম। তার মানে ভীষণমামার মেজদার কীর্তি এটা! তাঁর বদখেয়ালের খরচ মেটানোর জন্যে – কি সর্বনাশ! তাহলে কী হবে? ঘরের মধ্যেই আসামী!

এই সময়েই প্রতিমাদি ঘরে ঢুকল রেকাবিতে পরোটা, বেগুনভাজা আর জলভরা গ্লাস নিয়ে। ভীষণমামা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল উত্তেজিত হয়ে । কিন্তু সে কথা বলার আগেই মা বলে উঠলেন, “এখন ওসব কথা থাক, সাগর। আগে খেয়ে নে।” তারপর মা প্রতিমাকে ইশারায় কিছু বললেন, প্রতিমাদি মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মা বললেন, “হ্যাঁ, সাগর, কী বলতে যাচ্ছিলি বল। তখন তোকে থামিয়ে দিলাম, কারণ আমি চাই না প্রতিমার কানে এসব কথা যাক।”

ভীষণমামা গরম পরোটার বড়ো একটা টুকরো ছিঁড়ে বেগুনভাজার সঙ্গে মুখে পুরে নিয়ে ভরা গলায় বলল, “ঠিক কথা, দিদি, এসব কথা বাইরের কেউ শুনলে আমাদের কি বদনামটাই না হবে! কিন্তু দিদি, তুমি একদম শিয়োর, মেজদাই করেছে এটা?”

“মোটেই না। আমি একবারও বলিনি। আমি শুধু সম্ভাবনার কথা ভাবছি। দ্যাখ, পরপর দুদিন দুটো আইটেম যেভাবে হারিয়ে গেল তাতে বাইরের লোক যে কেউ করেনি, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। তার মানে করার মধ্যে তোরা – আর নয়তো তোদের কর্মচারীদের কেউ। তাই না?”

“ওরে বাবা, তাহলে তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ না বেরিয়ে পড়ে!” ভীষণমামা একখানা পরোটা শেষ করে দ্বিতীয়টাকে আক্রমণ করল।

“এবার তোর কর্মচারীদের কথা বলতো এক এক করে…।”

“কর্মচারী ? দাঁড়াও, বলছি… সলিলকাকা – সলিল মজুমদার। সবচেয়ে সিনিয়ার লোক।

মুর্শিদাবাদে গ্রামের বাড়ি। মাসে একবার বাড়ি যান, মাইনের পর। আর তাছাড়া পুজোয় কি বাড়িতে বিয়েটিয়ে থাকলে বাড়ি যান। সূর্য সেন স্ট্রিটের একটি মেসে থাকেন। দোকানে উনিই প্রথম আসেন – সন্ধ্যেয় সবার পড়ে মেসে ফেরেন। ভীষণ চাপা, নির্বিবাদী, কিন্তু খুব সিনসিয়ার, পরিপাটি মানুষ। কাজে কোনদিন গাফিলতি করেন না।”

“দাঁড়া। ভুটকু, সংক্ষেপে লিখে রাখ তো, সাগর যা বলছে। একদম নাম ধরে লিখবি। ভুল করিস না যেন।”

মায়ের কথার মধ্যেই প্রতিমাদি আবার ঘরে ঢোকে – আলাদা প্লেটে আরো দুটো পরোটা আর কাচের বাটি ভরা সুজির পায়েস – কিসমিস, কাজুর কুচি বিছানো। ভীষণমামা মুখে পরোটা নিয়ে আনন্দে একগাল হাসল। বলল, “আরো দুটো পরোটা, দিদি? তার সঙ্গে আবার পায়েসও? বা, বা। প্রতিমা তোমার রান্নার কিন্ত কোন জবাব নেই। প্রতিমাদি পরোটাদুটো ভীষণমামার প্লেটে ট্রান্সফার করে দিল আর পায়েসের বাটিটা রেখে দিল প্লেটের পাশে।

“নে, নে, বকিস না বেশি। এই শেষ কিন্তু। আর কিছু পাবি না এই বলে দিলাম।” মায়ের কথা শুনে প্রতিমাদি ফিক করে হেসে চলে গেল নীচেয়। মা আমাকে জিগ্যেস করলেন, “লিখেছিস। ভুটকু?”

“হুঁ। হয়ে গেছে…।” আমি উত্তর দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, ভীষণমামা আর কী বলে সেটা শোনা আর লেখার জন্যে। মা ভীষণমামাকে বললেন –

“আবার শুরু কর, সাগর, সলিলবাবুর সম্বন্ধে আর কী জানিস?”

“সলিলকাকার? ব্যস এই ত… আর কী জানবো?”

“সে কী রে? সলিলবাবু তোদের সবচেয়ে পুরোনো লোক। তাঁর সম্বন্ধে আর কিছু জানিস না? তাঁর কটা ছেলে মেয়ে? তারা কী করে? ওঁর স্ত্রীর শরীর স্বাস্থ্য কেমন – কিচ্ছু জানিস না?”

“দাঁড়াও, দিদি, দাঁড়াও। তোমার একদম  হাঁড়ির খবর চাই? তাহলে বলছি শোন। বছর চারেক আগে ওঁর মেয়ের বিয়ে হল। একটাই মেয়ে। আর এক ছেলে আছে – সেই বড়ো। ওই মেয়ের বিয়ের পরে আমাদের সকলকে মুর্শিদাবাদের মনোহরা আর ছানাবড়া এনে খাইয়েছিলেন। দারুণ মিষ্টি – দিদি, তুমি খেয়েছ কোনোদিন?”

“না। তারপর বল।”

“হ্যাঁ, ওঁর ছেলে বিএসসি পাশ করে অনেকদিন বসেই আছে। তেমন কোন কাজকর্ম জোটেনি। টুকটাক টিউশনি করে হাতখরচ চালায়। মাঝে কি একটা ব্যবসা শুরু করার ঝোঁক হয়েছিল। বাবার থেকে সলিলবাবু লাখদেড়েক টাকাও চেয়েছিলেন ধার হিসেবে। কিন্তু বাবা প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাদের ফার্মেসিতে চাকরি করার জন্যে। সলিলবাবু রাজি হননি। তারপরে ওই টাকা ধারের প্রসঙ্গটাও চাপা পড়ে গিয়েছিল।

“তারপর আছেন বংশীবাবু। বংশীধর দে – বংশীধর না ধারী মনে করতে পারছি না। আগে ভীষণ খিটখিটে ছিলেন, কিন্তু মানুষটা ভালো। পান থেকে  চুন খসলেই খুব রাগারাগি করতেন। তবে বাবাকে খুব ভয় করেন আর সম্মানও করেন। ইদানীং অবিশ্যি ওঁর খিটখিটে ভাবটা বেশ কমে গেছে, জানি না কেন, বেশ কিছুদিন হল শান্তভাবেই কাজকর্ম করছেন। এঁড়েদায় বাড়ি। দুই মেয়ে। একমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে বছর তিনেক হল। আর ছোট মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে – এই সামনের বোশেখে।”

“মেয়ের বিয়েতে টাকা পয়সা নিয়ে সমস্যা আছে – জানিস?”

ভীষণমামা তিন নম্বর পরোটা শেষ করে চারে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পায়েসও তুলছে চামচে করে। সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে আওয়াজ করছে পায়েস খাওয়ার সময়। আর আমি দ্রুত হাতে লিখে চলেছি ভীষণমামার দোকানের কর্মচারীদের বায়োডেটা।  মায়ের প্রশ্নে খাওয়া থামিয়ে ভীষণমামা বলল, “তুমি ঠিক ধরেছ,  দিদি। এই তো দিন পনের আগে বংশীবাবু আমাকে বলছিল লাখখানেক মতো টাকা ধার দেবার জন্যে। আমি বলেছিলাম বাবার সঙ্গে কথা বলতে। কারণ দশ-বিশ হাজার হত, সে আমি করে দিতে পারতাম, কিন্তু অত টাকা ধার দিতে গেলে বাবাকে জানাতেই হবে।”

“বংশীবাবু তোর বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলেন কিনা জানিস?”

“জানি না। বাবা আমাকে তো কিছু বলেন নি। আর আমিও ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি জিজ্ঞেস করাতে মনে পড়ল। তোমার কি মনে হয়,  দিদি, তবে কি বংশীবাবুই…?”

“আমার কিচ্ছু মনে হচ্ছে না, সাগর। আমি এখন শুধু শুনছি। আর কী কী জানিস, বল।

“হুঁ, বলছি। বংশীবাবুর বাপ-মা মরা ভাইঝি, কণা, আমাদের দোকানেই জয়েন করেছে বছর দুয়েক হল। যখন আমাদের দোকান রেনোভেট করে, নতুন শোরুম বানিয়ে তোলা হল – তার পরপরই।   ছোটবেলাতেই অ্যাক্সিডেন্টে ওর বাপ-মা মরে গিয়েছিল। সেই থেকে বেচারি কাকার কাছেই মানুষ। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বসেছিল। কাউন্টারের জন্যে মেয়ে খোঁজা হচ্ছে শুনে বংশীবাবু বাবা আর জেঠুকে বলে-কয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শান্ত-শিষ্ট ভালো মেয়ে – কেমন যেন ভিতু ভিতু টাইপের, খুব আস্তে কথা বলে, আর এমনিতে খুব চুপচাপ থাকে। তবে এটা বোঝা যায় কণা, কাকাকে খুব ভালোবাসে এবং কাকাও ভাইঝিকে।”

“ও কে। এবার নেক্সট, বল।”

“নেক্সট, হচ্ছেন, কুন্তল চ্যাটার্জি। ইনিও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন প্রায় বছর বিশেক তো হবেই। ব্যাচেলার, খুব শৌখিন লোক। একটু মেয়েলি টাইপ। সারাক্ষণ চুল আর মুখের প্রসাধন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকেন। জামা কাপড়ের দিকেও তীক্ষ্ণ নজর – সর্বদা ফিটফাট ধোপদুরস্ত থাকতে পছন্দ করেন। আর ওঁর ভীষণ শখ পারফিউমের – রোজই নতুন নতুন গন্ধ মেখে শোরুমে আসেন। এসবের মধ্যেও উনি নিজের কাজটা কিন্তু ভালই করেন। উনি অবিশ্যি কাউন্টারে বসেন না। আমাদের হিসেব-পত্র মানে অ্যাকাউন্টসটা উনিই সামলান। আমাদের কনসালটিং চার্টাড অ্যাকাউন্ট ফার্মের সঙ্গে উনিই যোগাযোগ করেন এবং যাবতীয় ট্যাক্সের ঝামেলা, আইনকানুন উনিই সামলান। উনি থাকেন বিকেপাল-হাটখোলায় নিমু গোঁসাই লেনে।”

“ঠিক আছে। কুন্তলবাবুর ব্যাপারটা পরে না হয় আবার জানব, নেক্সট বল।”

“নেক্সট হচ্ছে, মেয়ে দুটি। কণা, যার কথা তোমাকে আগেই বললাম, বংশীবাবুর ভাইঝি। আর আছে শিঞ্জিনী সাঁতরা। মা আর প্যারালাইসড বাবাকে নিয়ে  থাকে গড়িয়ার বোড়ালের কাছে। আসলে শিঞ্জিনী হচ্ছে মেজবৌদির মাসীর মেয়ে। বছর আটেক আগে ওর বাবা সেরিব্রাল হয়ে পঙ্গু হয়ে যান। তখন ও সবে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। চিকিৎসার খরচা সামলাতে সামলাতে মোটামুটি নিঃশেষ হয়ে যায় ওর বাবার জমানো টাকাপয়সা। পাশ করে বিএসসিতে ভর্তিও হয়েছিল, কিন্ত লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে নি। শেষমেষ বৌদির সুপারিশে আমরা ওকে চাকরি দিতে সত্যি ওর খুব সুরাহা হয়েছিল। খুব ভালো মেয়ে। এই বয়সেই খুব পরিণত। খাটিয়ে এবং ভীষণ খাঁটি। বাড়িতে এত দুর্যোগের মধ্যেও ভেঙে পড়ে নি – লড়ে যাচ্ছে রীতিমত। শুনেছি শিঞ্জিনীর বাজারে লাখ দুয়েকের মতো দেনা আছে। শোধ করছে আস্তে আস্তে।”

“শিঞ্জিনীর বয়েস কত হবে – চব্বিশ- পঁচিশ, না? দেখতে কেমন রে?”

“এই এপ্রিলে পঁচিশ হবে। দেখতে বেশ – মানে ভালই…আর কি। কিন্তু, তুমি দেখলে বুঝতে পারবে দিদি, মেয়েটা সত্যি আর পাঁচজনের মতো নয়…।”

“হুঁ। বুঝেছি। নেক্সট বল।”

“ব্যস, পাঁচজনই তো কর্মচারি আমাদের – হয়ে গেল তো!”

“বাঃ, সিকিউরিটি দুজন? তারপরে সজল?”

“ওদেরও শুনবে? সিকিউরিটিদের মধ্যে একজন রামপ্রীত মিশির। আমরা মিশিরজি বলি। জ্ঞান হয়ে থেকে ওকে দেখছি। আরা জেলায় বাড়ি। বছরে একবার মাসখানেকের জন্য বাড়ি যায় ওই সময়টা আমাদের ভীষণ অসুবিধে হয়। হাট্টাকাট্টা চেহারা। দেখলে বোঝার জো নেই যে ওর বয়েস সত্তরের কাছাকাছি। ওর কাছে বন্দুক থাকে। সারাটা দিন ও শোরুমের ভিতরে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে – ভেতর, বাইরে দুদিকেই লক্ষ্য রাখে। ওর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমাদের কারোর কোন দ্বিধা নেই দিদি, এটুকু বলতে পারি।”

“খুব ভালো কথা, নেক্সট?”।

“নেক্সট হচ্ছে জনার্দন মাজি। মেদিনীপুরের কোথাও বাড়ি। মেজদার সুপারিশে ওকে কাজে লাগানো হয়েছে মাস ছয়েক হল। আমি, বাবা বা জেঠু কেউই রাজি ছিলাম না। মেজদার জোরাজুরিতে বাবা নিমরাজি হয়ে ওকে রেখেছেন। জেঠু বাবাকে মানাও করেছিলেন অনেকবার। ওকে শোরুমের ভেতর ঢুকতেই দেওয়া হয় না। বাইরেই থাকে। কাস্টমার এলে কাচের পাল্লা খুলে দেওয়া আর সেলাম দেওয়াই ওর আসল ডিউটি।

“শেষমেষ সজলের কথা। সজল আমাদের বাড়িতে রান্না করে যে বিভামাসী – তার ছেলে। হুগলীর আদিসপ্তগ্রামে বাড়ি ছিল। বিভামাসীর সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে আমাদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। আমরাই ওকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছিলাম, তারপর আর পড়তে চাইল না। বছরখানেক হলো ওকে শোরুমে লাগিয়ে দিয়েছি। ফাইফরমাশ খাটে। সকলকে জল দেওয়া, চা দেওয়া – বড় কাস্টমার এলে কোল্ড ড্রিঙ্কস দেওয়া, দুপুরে লাঞ্চের সময় সকলের টিফিন এনে দেওয়া এই সব করে আর কি। বেশ ফুর্তিবাজ ভাল ছেলে, সর্বদা হাসিমুখ। সবার সঙ্গে জেঠু , কাকু, দিদিভাই সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেছে এবং সকলেই ওকে বেশ পছন্দ করে।”

“ঠিক হ্যায়। আপাতত এই অব্দিই থাক। তুই বাড়ি গিয়ে রেস্ট নে। তোরা রাত্রে মোটামুটি কটার সময় ঘুমোতে যাস?”

“এই ধরো এগারোটা, কেন বলোতো?”

“যদি দরকার পড়ে, আরো কিছু জানতে তোকে ফোন করব আরকি। আচ্ছা, আরেকটা ব্যাপার বলতো…পুলিশের সার্চিং আর ইনভেস্টিগেশন কটা অব্দি চলেছিল, পুলিশ যাওয়া পর্যন্ত সকলেই কি শোরুমে ছিল?”

“না, না, সব্বাই চলে গিয়েছিল, জেঠু, বাবা আর আমি ছিলাম শেষ অবধি। পুলিশ বেরিয়ে যেতে, বাবা ক্যাশ নিয়ে বেরিয়ে এলেন – আমরাও চলে এসেছি।”

“সকালে কটার সময় তোদের শোরুম খোলা হয়?”

“এই ধরো সাড়ে নটার মধ্যে আমি আর সজল চলে যাই। ঝাড়পোঁছ সাফসাফাই করার জন্যে এক মাসী আসে, তারপর দশটা – সোয়া দশটা থেকে শোরুম পুরো খুলে যায়।”

“গুড, কাল আমাকেও তুলে নিবি যাওয়ার সময়, আমি যাব তোদের সঙ্গে।”

মায়ের সুতোর গোলা গড়িয়ে গড়িয়ে চেয়ারের পা আর আমার পড়ার টেবিলের পায়ের সঙ্গে পাকিয়ে জড়িয়েমড়িয়ে বিচ্ছিরি জট পড়ে গিয়েছিল। ভীষণমামা চলে যাবার পর মা আমাকে সুতোর জট ছাড়িয়ে আবার গোলা পাকাতে বলে, আমার নোটগুলো নিয়ে বসলেন।

সুতোর জট ছাড়িয়ে গোলা পাকিয়ে আমি যখন সবে মায়ের পাশে বসে বুঝতে গেছি কতখানি রহস্যভেদ হল, মা বললেন,“দশটা কুড়ি হয়ে গেছে! চ, চ, খেয়ে নিই। বেচারা প্রতিমা খাবার কোলে বসে আছে।”

কাজেই রহস্য নিয়ে কথা আর হল না। নিচে খাবারের টেবিলে তো কোন কথাই সম্ভব নয়। কারণ মা তো আগেই বলে দিয়েছিলেন প্রতিমাদির সামনে এসব নিয়ে কোন আলোচনা না করতে। আমি ভীষণ টেনশনে চটপট খেয়ে নিলাম। কিন্তু মা প্রতিমাদির সঙ্গে কালকে কী রান্না হবে সেই নিয়ে আলোচনা করলেন খুব শান্তভাবে। সে সব সেরে ওপরে চলে এলাম। মা নিজের ঘরে গিয়ে ফোন করলেন ভীষণমামাকে।

“হ্যালো, সাগর, শোভাদিদি বলছি রে।”

“……”।

“একটা কথা, তোরা এবং পুলিশ শোরুমের সব জায়াগাই তো খুঁজেছিলি, না”?

“……”।

“টয়লেটে?”

“……”।

“ঠিক আছে। আমি কিন্তু কাল সকালে তোর জন্য ওয়েট করবো। শুয়ে পড়, গুড নাইট।”

“……”।

ফোনটা রেখে মা আবার আমার ঘরে এলেন। আমার বিছানা থেকে খাতাটা নিতে নিতে বললেন, “জানি রে সোন্টু, তোর পেট ফেটে যাচ্ছে সবকিছু শুনতে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত বলার মতো কিছু মাথায় আসছে না। রাতটা একটু ভাবতে দে। তাছাড়া প্রতিমাও এখুনি শুতে চলে আসবে। আজকের রাতটা একটু টেনশানে কাটা। কাল কিছু একটা হয়ে যাবে। তাছাড়া কাল তোর স্কুল ছুটি যখন, আমার সঙ্গে চল, অনেক কিছু দেখতেও পাবি হয়তো। গুডনাইট ভুটকু”।

মা চলে গেলেন আমার খাতাটা নিয়ে।

মায়ের ওপর বেশ রাগ হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু মায়ের যুক্তি না মেনে উপায়ও নেই। কাজেই টেনশন নিয়ে গোমড়া মুখ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। অন্যদিন রাত সাড়ে এগারোটা বারোটা অবধি পড়ি, আজ ইচ্ছে হল না। শুয়ে শুয়ে ঘরের সিলিংএর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম ভীষণমামার লোকজনের জীবন বৃত্তান্ত।

ভীষণমামাদের পরিবারটা খুব ভালো। বনেদি পরিবার। বাড়ি গাড়ি সবই আছে কিন্তু এতোটুকু অহংকার নেই। ছোটবড় সকলের সঙ্গেই দারুণ সম্পর্ক রেখে চলেন। তবে ওঁদের সকলের নামগুলো শুনলে মনে হয় মান্ধাতার আমলের কলকাতার ইতিহাস থেকে নেওয়া। ভীষণমামার জেঠুর নাম ভবতারণ সেন, আর বাবার নাম ভবশরণ সেন। ওঁনারা অবিশ্যি আমার দাদু হন, আর আমাকে খুব ভালোও বাসেন।  আমার নাম যদিও জ্যোতিষ আর ডাকনাম জ্যোতি, ওঁরা আমাকে ডাকেন নন্দকিশোর বলে। ওঁরা  রাধাকৃষ্ণের ভক্ত। বাড়ির একতলায় বিশাল ঠাকুরঘরে সোনার মুকুট মাথায় পড়ানো রাধা-কৃষ্ণের যুগলমূর্তি আছে- সেও দেখার মতো।

ভবতারণবাবুর দুই ছেলে- ভবনিধি আর ভবধারা। আর ভবসাগর মানে ভীষণমামা ভবশরণবাবুর একমাত্র ছেলে। জয়েন্ট ফ্যামেলিতে একসঙ্গে বড় হয়েছেন বলে ভীষণমামা ওঁদের বড়দা, মেজদা বলে। ভীষণমামার শোরুমে বার কয়েক গিয়েছি। নববর্ষের দিনতো বটেই। ওঁরা অবিশ্যি বলেন হালখাতা। লাল শালুমোড়া ভাঁজ করা একটা মোটা খাতা সকাল সকাল চলে আসে কালীঘাটে মাকালীর চরণ স্পর্শ নিয়ে। তার প্রথম পাতায় থাকে লাল আলতায় ডোবানো টাকার ছাপ, তার নিচে আলতায় লেখা থাকে “শুভ লাভ” আর স্বস্তিক চিহ্ন।

সন্ধেবেলা ভীষণমামার দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী লোকগুলোর বায়ো-ডেটা মনে করার চেষ্টা করলাম। ভীষণমামার মেজদা, সলিল মজুমদার, বংশীনাথ দে আর তাঁর ভাইঝি কণা দে,কুন্তল চ্যাটার্জী, শিঞ্জিনী সাঁতরা, রামপ্রীত মিশির , জনার্দন মাজি আর বিভা মাসীর ছেলে সজল। মেজদার কুসঙ্গের খরচের টাকা। সলিলবাবুর ছেলের ব্যবসার জন্য টাকা, বংশীবাবুর মেয়ের ও ভাইঝির বিয়ের টাকা। শিঞ্জিনীর বাবার অসুখের দেনা। টাকার দরকার তো সবারই।

মেজদা- যতই কুসঙ্গে মিশুক, নিজের কাকা এবং নিজের ভাইএর দোকান থেকে গয়না সরিয়ে নেবে, অন্তত আমার এটা মনে হচ্ছে না। যদিও “কুসঙ্গ” ব্যাপারটা ঠিক কী সে ব্যাপারে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই।

সলিল মজুমদার- ছেলেকে একটা কিছু করে দাঁড় করাবার চিন্তা, তার পক্ষে স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে তাঁর ছেলের ব্যবসার টাকা জোগানের জন্য হাত সাফাই করা খুব অসম্ভব নয়।

বংশীবাবু আর কণা দে- মনে হয় ভাইঝির দায়িত্ব নেবার জন্য তাঁর বাড়িতে অশান্তি ছিল। ইদানিং কণার চাকরি হওয়াতে তিনি অনেক নিশ্চিন্ত। কিন্তু তাঁর মাথায় আছে নিজের ছোট মেয়ে আর তারপরে ভাইঝিরও বিয়ে দেওয়ার দুশ্চিন্তা। কারণ তাঁর এই অসহায় ভাইঝিটিকেও তিনি নিজের মেয়ের মতই ভালবাসেন। কাজেই তাঁর পক্ষেও গয়না সরিয়ে টাকা জোগাড়ের এই ফন্দি অসম্ভব নয়।

কুন্তল চ্যাটার্জী- আপাতত কোন উদ্দেশ্য তাঁর পাওয়া যাচ্ছে না এবং তাঁর পক্ষে গয়না সরানোর সুযোগও নেই বললেই চলে।

শিঞ্জিনী সাঁতরা- বাবার অসুখের দেনায় বেচারা ডুবে আছে। তার পক্ষেও এমন কাজ করে ফেলা কিছু অসম্ভব নয়।

এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই জানি না কোথা থেকে নাকে ভীষণ কড়া পারফিউমের গন্ধ পেলাম। একজন লোক- মুখটা দেখা যাচ্ছে না, পিছন ফিরে অনেকক্ষণ ধরে চুল আঁচড়েই চলেছে আর হাত দিয়ে চুল সেট করে চলেছে। গন্ধটা মনে হয় ওই লোকটার গা থেকে আসছে। ওদিকে খুব তীক্ষ্ণ গলায় কেউ চিৎকার করে বলছে, “হিরেগুলো কে সরাল শুনি? আমি জানতে চাই কে সরাল? যত সব আহাম্মকের দল। এই ভাবে কেউ হিরে সরায়?”

হঠাৎ ভীষণমামা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “ হিরেগুলো কে সরিয়েছে আমি জানি। হিরে সরিয়েছে জ্যোতি, কারণ আমার বাবাকে বহুবার বলতে শুনেছি জ্যোতি হিরের টুকরো ছেলে।”

সেই শুনে লাগাতার চুল আঁচড়ানো লোকটা পেছন ফিরে থেকেই বলে উঠল,“ওমা তাই? তাহলে তো আমাদের জ্যোতি ভীষণ অসভ্য আর দুষ্টু…”

আমি বলে উঠলাম “মোটেই না, আমি মোটেই হিরে সরাই নি।” আর তক্ষুণি একটা মেয়ের গলা পেলাম, “ঠিক আছে, আগে তো ওঠ…ওঠ…ওঠ…ওঠ না! উঠে পড়। সেই থেকে ডাকছি! কি ঘুম রে বাবা তোর। এখনো উঠলি না? ”

ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বুঝলাম আমি এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম, আর বাস্তবটা হল মায়ের ডাক। স্নান-টান সেরে মা আমার ঘরে এসেছেন- আমার টেবিলের বইপত্রগুলো গোছাচ্ছেন আর আমাকে ডেকে চলেছেন- আমার ঘুম ভাঙানোর জন্যে।

নটা বেজে আট মিনিটে ভীষণমামার সাদা স্কর্পিও গাড়িটা আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। মা আর আমি তৈরিই ছিলাম। প্রতিমাদিকে বলে আমরা বেড়িয়ে পড়ে গাড়িতে উঠলাম। সজল বসেছিল সামনে। আমি মাঝখানে ঢুকে বসতে মা উঠে এলেন বাঁদিকে, আর আমার ডানদিকে ভীষণমামা। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভীষণমামার শোরুমে পৌছাতে পাক্কা আঠেরো মিনিট লাগল। আমরা দোকানে পৌঁছলাম নটা ছাব্বিশে।

golpohire01 (3)

দোকানের কোলাপসিবল গেট বন্ধ। তিনটে তালা ঝুলছে। ভীষণমামা মিশিরজিকে ডাকতে, ভিতরের কাচের ভারী দরজা খুলে , হাতে  চাবির বিশাল বোঝা নিয়ে বেরিয়ে এল মিশিরজি। হরেক রকমের – অন্তত পঞ্চাশটা চাবি আছে মস্ত রিংটায়। সেখান থেকে ঠিকঠাক চাবি বের করে তিনটে তালাই চটপট খুলে দিয়ে মিশিরজি গেট খুলে দিল। গেটটা পুরোটা খুলবে না কারণ মাথার একটু ওপরে লোহার চেন দিয়ে কোলাপসিবল গেটটা বাঁধা এবং তালা দেওয়া। একজন লোকের বেশি একবারে ঢোকা সম্ভব নয়।

ভারী দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে মিটার রুম। মা মিটার রুমের দরজাটা খুললেন। দরজাটা খুলেই সামনের দেওয়ালে দুটো মিটার লাগানো, তার সঙ্গে মেন সুইচ। নিচে –ওপরে ইলেক্ট্রিকের অনেক তার এলোমেলো ঝুলে আছে। মা গলা বাড়িয়ে ভিতরে দেখলেন , আমিও দেখলাম।  তিনটে ভাঙা প্লাস্টিকের চেয়ার, অনেকগুলো বাতিল গয়নার বাক্স, খালি ভাঙাচোরা পেটি, একটা কমপিউটার কিবোর্ড। একচিলতে ঘরটা আবর্জনার ঘর হিসেবেও ব্যবহার হয় বোঝা গেল। মা ভীষণমামাকে বললেন,“ওই জঞ্জালের মধ্যে চারটে কিটক্যাটই পাওয়া যাবে। বেশি খুঁজতেও হবে না। ”

“থাক ,থাক, তোমাকে আর ওই জঞ্জালের মধ্যে কিটক্যাট খুঁজতে হবে না। বেরিয়ে এসো দিদি। হিরে খুঁজতে এসে তুমি কিটক্যাট খুঁজছ?” ভীষণমামার গলায় কেমন যেন বিরক্তির সুর। আমরা মিটার রুমের দরজা ছেড়ে সরে আসতেই , ভীষণমামা খুব তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল, ভীষণমামাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। মায়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলতেও কোনদিন শুনিনি আমি। মা কি ভীষণমামার এই ব্যবহার লক্ষ করলেন না? বুঝতে পারলাম না , কারণ এরপরই মা জিজ্ঞেসা করলেন, “হ্যাঁরে, তোদের টয়লেটটা কোথায় রে? ”

“ওই তো সামনের বাঁদিকের কোণায় । কেন তুমি যাবে নাকি এখন?”

“হ্যাঁ। যাবো।জ্যোতি আমার সঙ্গে আয় তো…”,

মা টয়লেটের দিকে এগোলেন। সঙ্গে আমিও। হঠাৎ ভীষণমামা অদ্ভুত এক কান্ড করে বসল। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “দিদি তুমি এখন টয়লেটে যাবে না। আগে আমি যাবো তারপর। আগে আমি যাবই।”

আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম টয়লেট যাওয়া নিয়ে ভীষণমামার এই জেদ দেখে। মায়ের দেখলাম কোনও কোন তাপ উত্তাপ নেই। অনেকক্ষণ ভীষণমামার দিকে তাকিয়ে থেকে স্মিতমুখেই বলেলেন, “আমাকে তুই দিদি বলে মোটেই ভাবিস না সাগর। ভাবলে এতদূর নীচে তুই নামতে পারিতস না। পথ ছাড়, আমাকে যেতে দে। আমাকে আমার কাজ করতে দে। আমি বলছি তোর ভালই হবে। তুই আমাকে যাই ভাবিস, আমি কিন্তু তোকে নিজের ভাই ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না।

মায়ের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ভীষণমামা। তারপর কী বুঝল কে জানে, হাত নামিয়ে সরে দাঁড়াল।

মা আর আমি টয়লেটে ঢুকলাম। একটা কমোড আর একটা ওয়াশ বেসিন। ওয়াশ বেসিনের ওপর লিকুইড সোপ কন্টেনার। দেওয়ালে আয়না। বেশ পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে ন্যাপথলিন আর ডিজইনফেক্ট্যান্টের গন্ধ। টয়লেটের ভিতর ঢুকে মা চারিদিকটা চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর কমোডের সামনে গিয়ে  সিস্টার্নের ঢাকনাটা খুলে ফেললেন। তারপর নিচু হয়ে সিস্টার্ন ভরা জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিলেন। একটু পরে ভেজা মুঠি তুলে আনলেন জলের বাইরে। তারপর ঢাকাটা আবার লাগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “স্যানিটারি- প্লাম্বিং ব্যাপারটাও ভাগ্যিস অল্পবিস্তর জানা ছিল, কাজে লেগে গেল, কী বলিস সাগর?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ভীষণমামা দাঁড়িয়ে আছে। তার বিষণ্ণ ম্লান মুখ কাগজের মতো সাদা। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে মা কী তুলে আনলেন তাও জানি না। কিন্তু টয়লেট থেকে বেরিয়ে মা ভীষণমামাকে ডেকে বললেন, “আয় আমার সঙ্গে, কিছু কথা আছে, কোন ঘরে বসা যায় বল তো , সাগর? ভুটকু আয়।”

আগেই বলেছি আমার ডাক নাম জ্যোতি। মা ভালো মুডে থাকলে আমাকে অবিশ্যি ভুটকু, সন্টু, মান্টু যা খুশি নামে ডাকেন। আর আমার ওপর রেগে গেলে বা কোন টেনশনে থাকলে জ্যোতি ডাকেন। একটু আগে আমাকে জ্যোতি বলে ডেকেছিলেন, এখন আবার ভুটকু। তার মানে মা এখন ভাল মুডে আছেন। পুরোটা  না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম, মা রহস্যের জট মোটামুটি খুলে ফেলেছেন- আর সেটা পুলিশরা ধরে ফেলার আগেই।

বাবা , মা এবং আমি ভীষণমামার বাড়ি পৌঁছালাম সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ, ভীষণমামা নিচেই ছিল। বাবাকে গাড়ি রাখার জায়গা দেখিয়ে দিতে, বাবা গাড়ি লক করে বেরিয়ে এলেন। তারপর আমরা চারজনই বাড়িতে ঢুকলাম। নিচের ঠাকুরঘরে রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরের সামনে বসে মা গড় হয়ে প্রণাম করলেন। বাবা হাঁটু মুড়ে বসে প্রণাম করলেন আর দেখাদেখি আমিও একইভাবে প্রণাম করলাম। একটু আগেই আরতি হয়ে গেছে। ধুপের আর নানান ফুলের সুবাসে মনটা স্নিগ্ধ হয়ে এল। প্রণাম সেরে পিছন ফিরেই আমরা দেখলাম, ভীষণমামার বাবা ভবশরণবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে সৌম্য হাসি। আমাদের দেখে বললেন, “এসো, মা এসো। আসুন আসুন সমরেশবাবু, আসুন। অনেকদিন পর আপনাদের আবির্ভাব হল।” তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “কীরে? দাদাকে আর মনেই পড়ে না নাকি? আয় আয় ওপরে চল।”

golpohire01 (4)

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাঁদিকের প্রথম ঘরটাই বসার ঘর। বেশ বড়। সোফা,ডিভান, টিভি। কাচের দেওয়াল আলমারিতে শো পিস। দেওয়ালে রাধা-কৃষ্ণের রাস লীলার ছবি। ব্যাকগ্রাউন্ডে জ্যোৎস্নাসহ পূর্ণিমার চাঁদ এবং কদম গাছ, কাছে দূরে কয়েকটা ময়ূর আর হরিণ। আর কদমগাছের ডালে বাঁধা দোলনা থেকে দুলছেন কৃষ্ণকিশোর আর রাইকিশোরী। তেল রঙে আঁকা ছবিটার এমনি প্রভাব গোটা ঘরটাকেই খুব উজ্জ্বল আর আনন্দময় লাগে। আমি যতবার এসেছি ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

আমরা সবাই বসার পর ভবশরণবাবু বসলেন একটা সিঙ্গল সোফায়। ভীষণমামা বসল ওঁর পেছনে একটা কুশন আঁটা চেয়ারে। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ভবশরণবাবু বললেন, “প্রথমে  একটু নাতি শীতল সরবৎ সেবা হোক। তারপর সামান্য মিষ্টিমুখ। দাদা আসছেন। দাদা এলেই আমাদের কথাবার্তা শুরু হবে। কিন্তু যে বদনাম থেকে তুমি আমাদের পরিবারকে বাঁচালে শোভামা, তার কোন মূল্য হয় না। মেধা, বিশ্লেষণী শক্তি আর তার সঙ্গে পরিমিত মূল্যবোধ-খুব ভালো, মা। তুমি ভাবছ বুড়ো উচ্ছ্বাসিত হয়ে গেছে – তা নয় মা – বরং ভেবে নিশ্চিন্ত লাগছে- আমার চোখ বুজলেও সাগরের মাথার ওপর সর্বদা তার দিদির মমতার হাত রাখা থাকবে।”

ভীষণমামার মা এলেন ঘরে, সঙ্গে কাজের মেয়ের হাতের ট্রেতে সুদৃশ্য মার্বেলের গ্লাসে শরবৎ। ভীষণমামার মায়ের পরণে চওড়া লাল আর মেরুনের ডোরা পাড় সাদা খোলের শাড়ি।  পায়ে আলতা। কপালে – সিঁথির সিঁদুর – স্মিত , শান্ত মুখ। দুই হাতেই অনেকগুলি চুরি আর শাঁখা পলা। নিজে হাতে সবাইকে শরবতের গ্লাস পরিবেশন করলেন। পরিবেশনের শেষে মায়ের পাশে এসে বসলেন। মায়ের একটি হাত টেনে নিজের হাতে নিয়ে বললেন, “কতদিন পরে এলি বল দেখি,শোভা। ভুলেই গেছিলি মনে হয়?”

“না, না, মাসীমা , ভুলব কেন? আসলে ও বাইরে থাকে, জ্যোতির স্কুল, টিউশন, লেখাপড়া, সব সামলেসুমলে আর হয়ে ওঠে না।”

 “তা ঠিক , আজকাল সকলে এত ব্যস্ত, কারুর হাতে সময় নেই তবু ভাল সাগর এই কেলেঙ্কারি করল বলে তোর সময় হল… মাসীমার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হল।”

মা কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন , কিন্তু তার আগেই ভীষণমামার জেঠু ঘরে ঢুকলেন। সকলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “আমার একটু দেরি হয়ে গেল দোকান থেকে ফিরতে। অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম আপনাদের।”

মা বললেন, “না না জেঠু, আমরা এই একটু আগেই এসেছি। মাসীমার সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই-ইনি আমার স্বামী সমরেশ সান্যাল, আর এটি আমার পুত্র জ্যোতিষ্ক সান্যাল।” বাবা আর আমি ভদ্রলোককে নমস্কার করলাম, উনিও প্রতি নমস্কার করলেন।

“ভেরি গুড। আলাপ হয়ে ভাল লাগল। খাঁদুর মুখে যা শুনলাম আপনার কথা- আপনি তো মির‍্যাকল করে দিয়েছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন থানা পুলিশের হ্যাপা হুজ্জোত আর বদনাম থেকে।”

শেষ কথাগুলো উনি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন। “খাঁদু” নামটা কার আমি বুঝতে পারলাম না, ভীষণমামার নয় জানি। ভীষণমামার বাবার কি? হতেই পারে। মায়ের মুখে শুনেছি আগেকার দিনে এমন নাকি হত- যার ভাল নাম হয়তো সমরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরি, তাঁর ডাকনাম হল “ন্যাপা।”

ভীষণমামার জেঠু সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “আমরা তো সবাই রেডি। তাহলে শোভামা, শুরু কর তোমার কথা। আর দেরি করার কোন কারণ নেই। কী বলিস রে খাঁদু?”

ভীষণমামার বাবা ভবশরণবাবু মাথা নেড়ে জেঠুর কথায় সায় দিলেন। তার মানে আমার অনুমান ঠিক। ভীষণমামার বাবা ভবশরণ সেনের ডাকনাম খাঁদু।

ঘরের সকলের দৃষ্টি এবার মায়ের দিকে। মা বাবার দিকে একবার তাকালেন তারপর শুরু করলেন-

“কাল সাগর এসে যখন বলল আপনাদের দোকান থেকে পরপর দুদিন হিরের গয়না চুরি গিয়েছে, শুনে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। পরপর দুদিন কীভাবে চুরি হওয়া সম্ভব? একই লোক দুদিন চুরি করল? নাকি দুদিন আলাদা দুজন লোক? তারপর সাগরের থেকে জিজ্ঞাসা করে সবটা শুনে আবার আশ্চর্য হলাম। চুরির পদ্ধতিটাও এক। খালি সময়ের হেরফের। অর্থাৎ যে কাজটা করেছে সে সিসিটিভি অফ রাখতে চাইছে এবং তার সঙ্গে আচমকা লাইট চলে যাওয়াতে সকলের অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। তখন একটা ব্যাপার আমার মাথায় এলো- মেন সুইচ থেকে কিটক্যাট সরানো আর কাউন্টার থেকে গয়না সরানো একজনের কাজ হতে পারে না। অন্তত দুজন থাকতেই হবে।”

“দুজন থাকার কথাটা যখন আমার মাথায় এলো, তখন আমি জুটি খুঁজতে শুরু করলাম। এমন জুটি যাদের নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস আর ভাল তালমিল থাকা জরুরি। সাগরের বর্ণনা অনুযায়ী দেখলাম তিনটে জুটি দাঁড়াচ্ছে। প্রথম বংশীধরবাবু আর তাঁর ভাইঝি কণা। সাগরের মেজদা আর শিঞ্জিনী – কারণ ওরা পুর্ব পরিচিত। শালি-জামাইবাবু। অথবা মেজদা আর জনার্দন, কারণ জনার্দনকে মেজদাই একরকম জোর করে ঢুকিয়েছেন।”

এই অবধি বলে মা একটু থামলেন। সকলেই আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন। কেউ কিছু বললেন না- অপেক্ষা করতে লাগলেন কতক্ষণে মা আবার শুরু করবেন। আমি ভাবছিলাম এই সহজ যুক্তিগুলো কেন আমার মাথায় আসে নি? যাই হোক মা আবার শুরু করলেন-

“এরপর সাগরের বর্ণনা শুনে বুঝলাম বংশীধরবাবু, কণা, শিঞ্জিনী, মেজদা সকলেরই বেশ কিছু টাকার দরকার। বংশীধরবাবুর মেয়ের এবং ভাইঝি কণার বিয়ের গুরুদায়িত্ব, শিঞ্জিনীর মাথায় বাবার চিকিৎসার অনেক দেনা, মেজদার বাজে খরচের বোঝা । জনার্দন এখানে খুব বড়ো ফ্যাক্টর নয়- গরিব ছেলে। দশ বিশ হাজারই তার কাছে অনেক ।

এরপর আমার মাথায় এলো কাজটা সুন্দর করে সমাধা করার সু্যোগ কার বেশি। এখানে দেখলাম জনার্দনের কোন ভুমিকা থাকতেই পারছে না। গেটের ভেতরে তার ঢোকার অনুমতি নেই। তার পক্ষে কিটক্যাট খুলে ফেলা বা ভিতরে ঢুকে গয়না সরানো সম্ভব নয়। মেজদার পক্ষে কিটক্যাট সরানো হয়তো সম্ভব কিন্তু গয়না সরানো অসম্ভব। তিনি কাউন্টারের ওপারে গিয়ে গয়নার বাক্সে হাত দিলে সবার চোখে পড়ে যাবেন। কারণ কোনদিনই মেজদা আপনার দোকানের কাউন্টারে বসেন না, বা গয়না ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। কাজেই রইল বাকি তিনজন। বংশীধর, কণা আর শিঞ্জিনী।

এইখানে আমার আবার একটা ব্যাপার মাথায় এলো- সাহস। কার পক্ষে কতটা সাহসী হওয়া সম্ভব? চুরি কে করল- এটা নিয়ে হইচই হবেই। আমি চুরি করলাম অথচ আমাকে ধরা যাবে না তখনই, যখন আমি অন্য কারুর ঘাড়ে চুরির দায়টাকে গছাতে পারব। আর যদি সেটা আমি না পারি, ধরা পড়তেই হবে। সেক্ষেত্রে আমার বা আমাদের চাকরিটি যাবে। এইবার আরেকটা দিক ভাবার কথা, এই বাজারে বংশীবাবু ও কণার পক্ষে একসঙ্গে সেই ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব কি ? সাগরের মুখে যা শুনেছি একেবারেই সম্ভব নয়। ওঁদের এতদিনের চাকরিটা গেলে ওঁরা আক্ষরিক অর্থেই পথে বসবেন। কাজেই রইল বাকি শিঞ্জিনী আর মেজদা।

এইখানেই সাগর আমাকে বেশ খানিকক্ষণ ভাবিয়ে তুলেছিল। শিঞ্জিনী মেজবৌদির মাসতুতো বোন। কাজেই মেজদার শালী। কাজেই সন্দেহটা মেজদার ওপরে যেতেই পারত। কিন্তু হঠাৎ করেই খেয়াল হল, শিঞ্জিনীর পরিচয় দেবার সময় সাগরের গলায় খুব একটা আবেগ ছিল- যেটা অন্য কারোর ক্ষেত্রে আমি পাই নি। জিনিসটা আমাকে খুব ভাবিয়ে তুলল। সাগর শিঞ্জিনীর জন্মদিন জানে, বয়েস জানে, যেটা যথেষ্ট ঘনিষ্ট না হলে জানার কথা নয়। এতগুলো লোকের এবং কণারও পরিচয় দিল খুব স্বাভাবিক নির্লিপ্ত স্বরে, কিন্তু শুধুমাত্র শিঞ্জিনীর ক্ষেত্রেই সেটা পাল্টে গেল। কেন? সেটা তখনই সম্ভব যখন শিঞ্জিনীর ওপরে ওর একটা গভীর টান থাকে। কাজেই তার বিপদে সাগর চাইতেই পারে তাকে যেকোনভাবে সাহায্য করতে। ভেবেছিল এতগুলো লোকের মধ্যে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা রহস্য হিসাবেই থেকে যাবে। সকলেই সকলকে সন্দেহ করবে – কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কাউকেই নিশ্চিতভাবে সাব্যস্ত করা যাবে না। দু-ছমাস পরে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়ে যাবে দুঃস্বপ্নের মত।”

একটানা কথা বলার পর মা একটু থামলেন। টেবিলে রাখা গ্লাস তুলে এক চুমুকে বাকি শরবৎটুকু খেয়ে গ্লাসটা আস্তে আস্তে টেবিলে রাখলেন, যাতে কোন শব্দ না হয়। ঘরে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভীষণমামার বাবা ও জেঠু মুখ নীচু করে গভীর চিন্তায় মগ্ন । ভীষণমামার মা প্রথম কথা বললেন কান্নাভেজা স্বরে, “কী বিপদের হাত থেকে যে, তুই আমাদের বাঁচালি, শোভা! গয়না যেত সে তো যেতই। তার চেয়েও বড়ো ক্ষতি হতো এই পরিবারে। আমাদের নিজেরদের সংসারেও ঢুকে পড়তে পারত অবিশ্বাস, সন্দেহ আর অশান্তি। এ বাড়ির তিন ছেলেকে আমরা কেউই আলাদা করে দেখিনি কোনদিন। আমি মুখ দেখাতে পারতাম না রে, তোর জেঠু আর জেঠিমার কাছে । নিধি আর ধারার কাছেও লজ্জা রাখার জায়গা থাকতো? তুই গত জন্মে নির্ঘাৎ আমার মেয়ে ছিলি রে শোভা।”

“বারে, আর এই জন্মে আমি কেউ নই বুঝি?” মায়ের এই কথা শুনে ভীষণমামার মা কান্না ভেজা চোখেও হেসে ফেললেন। বললেন, “তোর সঙ্গে কথায় আমি পারব না রে, পাগলি।” বলে মাকে টেনে নিলেন আরো কাছে। তারপর ভীষণমামাকে বললেন, “কীরে? সেই থেকে বসে বসে নিজের কুকম্মের বৃত্তান্ত গিলছিস, যা না বামুনদিকে গিয়ে বলে সবার জলখাবারটা এখানে পাঠিয়ে দে।”

ভীষণমামা বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে, ভীষণমামার বাবা জেঠুকে বললেন, “কী করা যায় বলতো, দাদা? সব তো শুনলি। আমার তো মাথায় কিছু আসছে না। ভীষণটা শেষে এমন একটা কাজ করে বসল যে–”

হঠাৎ মা মাঝখানে বলে উঠলেন, “যদি অনুমতি দেন তাহলে একটা কথা বলি। সাগর সম্বন্ধে কোন ভুল ধারণা আপনারা প্লিজ রাখবেন না। শিঞ্জিনীর পাওনাদারের হাতে নাস্তানাবুদ হওয়াটা ও চুপ করে সইতে পারে নি। তাকে ও সাহায্যই করতে চেয়েছিল। সেই অসহায়তা থেকেই ওর এমন মতিভ্রম। কাজটা ও ভালোই করতে চেয়েছিল। পথটা ভুল নিয়েছিল এই যা। কাজেই আমাদের সকলেরই উচিৎ ওর পাশে দাঁড়ানো।”

গাড়িতে বাড়ি ফেরার পথে মাকে জিগ্যেস করলাম,“মা তোমার যুক্তি সব তো বুঝলাম। কিন্তু টয়লেটের সিস্টার্নের ভেতর হিরের আংটি আছে তা তুমি কী করে জানলে?”

           মা বললেন, “ওটা একটা ক্যালকুলেটেড গেস ছিল, খেটে গেছে। ভেবে দ্যাখ, আগের দিন ওরা বের হবার আগে পর্যন্ত পুলিশ ছিল , আর সকলকে সার্চ করেছিল। কাজেই আংটিটা নিজের কাছে কেউই রাখবে না, বা নিশ্চয় বাইরে পাচার করতেও পারে নি। মোটামুটি নিরাপদ, আর সাধারণত কেউ ওই জায়গার কথা ভাববেও না , তাই ওই জায়গাটাই আমার মনে হয়েছিল।”

          গাড়ি চালাতে চালাতে বাবা বললেন, “গোয়েন্দা মিসেস সান্যাল, ভবিষ্যতে বহুলোকের বদ মতলব বানচাল করে দেবে মনে হচ্ছে”।

          “কিন্তু বাবা দেখেছো , ফেলুদা যেমন পারিশ্রমিক পেতে, মাকে কিন্তু একটা সন্দেশ খাইয়ে ছেড়ে দিল, কোন পারিশ্রমিকই দিল না।”আমার কথা বাবা উড়িয়ে দিয়ে বললেন-

            “ধুস, কটা টাকায় কী আসে যায়? স্যাটিসফ্যাকসানটা চিন্তা কর।”

          কিন্তু এই কথার দুদিন পরে ভীষণমামার মা ভীষণমামার সঙ্গে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, আর মায়ের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন সরু চেনের সোনার হার- তাতে চারটে ছোট্ট হিরে বসানো একটা পেন্ডেন্ট।

ছবিঃ সোমা চক্রবর্তী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস