গল্প ভূতের ভরসা কিশোর ঘোষাল বর্ষা ২০১৭

কিশোর ঘোষাল এর সমস্ত লেখার লিঙ্ক

থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিয়ে কলেজে এখন ছুটি। সর্বজিৎ প্রফুল্লনগরে এসেছে মাসিমার বাড়ি বেড়াতে। এই জায়গাটা সর্বজিতের খুব পছন্দের জায়গা। ছোট্ট শহর বলেই, শহরের সব সুযোগসুবিধে যেমন মেলে, তেমনি মেলে দেদার গাছপালাওয়ালা নিরিবিলি ফাঁকা মাঠঘাট। মনটা হালকা হয়ে যায়, ভালো হয়ে যায়। এর সঙ্গে অবশ্য আছে মাসিমার দারুণ রান্না। নানান পদ রান্না করে সর্বজিতকে খাওয়াতে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। মেয়েরা তাঁর পেছনে লাগার জন্যে কিছু বললে তিনি বলেন, “তোরা তো আমার হাতে সারাবছর খাস, তা সত্ত্বেও তোদের মন পাই না। আর ও বেচারা সারাটি সময় হস্টেলে ছাইপাঁশ কী খায় না খায় তার ঠিক নেই; দু’দিন বাড়ি এলে খাওয়াব না? একশোবার খাওয়াব, সে তোরা হিংসে কর আর যাই কর।”

তাদের তিনবোনের কেউই সর্বজিৎকে হিংসে করে না। বরং সর্বজিৎকে খুব ভালোবাসে। সর্বজিতের ডাকনাম সরু। সরুদা এলে বরং খুব মজা হয়। এই ক’টাদিন মা কিংবা বাবা লেখাপড়া নিয়ে খুব চাপ-টাপ দেন না। রোজই বিকেলের দিকে পাহাড়চূড়ায় বেড়াতে যাওয়া হয়, নেমে এসে বাজারের সামনে ফুচকাওয়ালার থেকে ফুচকা, চুরমুর খাওয়া হয়। আর সারাদিন গল্প তো আছেই। সরুদার কাছে গল্প শোনাও দারুণ মজা। নানান জায়গার নানান ঘটনার কথা এমন করে বলবে, হাসতে হাসতে চোখে জল চলে আসে। মাও থাকেন সেসব সময়, তিনিও খুব হাসেন।

সেদিন সন্ধেবেলা বারান্দায় বসে সবাই মিলে গল্প হচ্ছিল, বাবা-মাও ছিলেন। হঠাৎ সরুদা বলল, “রুন্টু-ঝুন্টু, তোদের সেই বেস্ট ফ্রেন্ড রুকু-সুকু কোথায়, দেখছি না যে!”

সামনের পেয়ারাগাছের আড়াল থেকে রুকু-সুকু হালকা ধোঁয়ার মতো বেরিয়ে এল। তাদের মুখে একগাল হাসি। মৃদু হাওয়ায় দুলতে থাকা ভারী পর্দার মতো দুলতে দুলতে রুকু বলল, “আজ্ঞে, এখানেই আছি দাদা। আপনি সকালে এলেন, সারাটাদিন মজার মজার কথা বলছেন, শুনছি। তারপরে আপনারা বিকেলে পাহাড়চূড়ায় বেড়াতে গেলেন, আমরাও সঙ্গী হলাম। আপনি এলে বাড়িটা খুব জমজমাট লাগে। এবারে কিন্তু বেশ ক’টাদিন থাকতে হবে, দাদা। সেই কবে এসেছিলেন, আপনাকে তো প্রায় ভুলেই গেছিলাম। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সকালে হুট করে দরজা খুলে যেভাবে ঢুকলেন, আমি তো ভাবছিলাম আপনাকে ঠেলে বের করে দেব। সুকু চিনতে পেরে বলল, আরে ইনি তো সরুদাদা! তা না হলে কী যে অসৈরণ কাণ্ডটা ঘটে যেত!” লজ্জায় মাথা নিচু করে দুলতে লাগল রুকু।

সরুদা মুচকি হেসে বলল, “বোঝো কাণ্ড, রুন্টু-ঝুন্টু তোদের বন্ধুরা আমাকে ঠেলে ফেলে দিতে আসছিল!”

“ঠিকই তো বলেছে। ওদের কী দোষ? বছরে এক আধবার এলে ওরকমই হবে।” রুন্টু হেসে উত্তর দিল।

রুন্টুর খোঁচাটা সরুদা গায়ে মাখল না। গম্ভীরমুখে সরুদা জিগ্যেস করল, “সে না হয় হল। কিন্তু রুকু, প্রমোটার প্রমথবাবু আর জ্যোতিষী কাত্যায়ণ শাস্ত্রী কী করছে এখন?”

“দু’জনেই বড়ো কষ্টে আছে, দাদা। প্রথমবাবুর ফ্ল্যাট যারা বুক করেছিল তারা রোজ এসে সকাল থেকে রাত অব্দি প্রথমবাবুর ঘরে ধর্না দিয়ে বসে থাকে। প্রথমবাবু ভোরে বেরিয়ে যায়, মাঝরাত্রে ঘরে ফেরে। আর নাত্যায়ণ শাস্ত্রী কলকাতায় কার্জনপার্কের সামনে টিয়াপাখির খাঁচা নিয়ে বসে। হপ্তায় পঞ্চাশ-ষাট টাকার বেশি রোজগার হয় না। দু’জনের দুর্গতি দেখলে আপনার চোখে জল চলে আসবে, দাদা।”

“তোরা প্রমথকে প্রথম আর কাত্যায়ণকে নাত্যায়ণ বলছিস কেন রে?” সরুদা বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করল।

“ওরা তো অশরীরি, ঠাকুর-দেবতার নাম নিতে পারে না, তাই ওরকম বলে।” রুন্টু ওদের হয়ে উত্তরটা দিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সরুদা। তারপর বলল, “অ। এতসব নিয়মকানুন তোদেরও মানতে হয় বুঝি? বুঝলাম। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, ওরা আমাদের সর্বনাশ করতে এসেছিল, তাই আমরা ওদের শাস্তি দিয়েছি রুকু। কিন্তু ওদের সর্বনাশ তো আমরা চাইনি।”

“একদম ঠিক বলেছেন, দাদা। এই নিয়ে আমাদের সমাজে খুব কথা শুনতে হচ্ছে। বলছে আমাদের জন্যেই নাকি মানুষেরা ভুল বোঝে।” সুকু খুব উত্তেজিত হয়ে বলল।

“তোদের সমাজ? সেটা কীরকম বস্তু?” সরুদা কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করল।

রুকু বলল, “আমাদের সমাজকে নিরাকার সমাজ বলে। আমাদের সমাজেও নেতা আছে, মন্ত্রী আছে, প্যাঁচ-পয়জার আছে, দলবল আছে। পুলিশ আছে, আইন আদালত আছে। একদমই মানুষদের মতো। তবে কিনা মানুষরা যেমন নিজেদের মধ্যে মারদাঙ্গা, লুটপাট করে, খুনোখুনি করে, আমাদের তেমন হয় না। আগে ভূতেরা খুব হিংস্র হত, মানুষের ঘাড় মটকাত, ভয় দেখাত। বেশ ক’বছর হল সেসব একদম বন্ধ।”

“হঠাৎ তোদের এই সুবুদ্ধির কারণ?” সরুদা ঠাট্টার সুরে জিগ্যেস করল।

রুকু তার উত্তরে বলল, “দাদা, মানুষ মরেই তো ভূত হয়। মানুষ যে হারে মরছে, ভূতেদের সংখ্যাও তো বেড়ে চলেছে। আজকাল মানুষরা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করেই এত মরছে, তার ওপর আমরা ঘাড় মটকালে ভূতেদের আর পা ফেলার জায়গা থাকবে না। সেই কারণেই আমাদের নেতারা সকলে মিলে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, আর কোনও নরহত্যা নয়। বরং মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব কর, পারলে উপকার কর।”

সুকু এতক্ষণ চুপ করে বসে শুনছিল। এখন বলল, “একটা কিছু ভাবুন দাদা, যাতে প্রথমবাবু, নাত্যায়ণ শাস্ত্রী আর ওই ফ্ল্যাট বুকিং করা আটষট্টি জন লোক দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারে, আগের মতো আবার সব যেন ঠিকঠাক চলতে থাকে।”

সরুদা গম্ভীরভাবে বলল, “হুম, সেটাই তো ভাবছি, কীভাবে কী করা যায়। আমার মনে হচ্ছে, নাত্যায়ণ শাস্ত্রীই আমাদের হয়ে পুরো কাজটা সামলে দিতে পারবে যদি তোরা দু’জনে তাকে একটু সাহায্য করতে পারিস।”

“আমরা সাহায্য করার জন্যেই তো বসে আছি, দাদা। আপনি শুধু হদিশটা বাতলে দিন।” রুকু-সুকু একসঙ্গে বলে উঠল।

কাত্যায়ণ শাস্ত্রী ফুটপাথের একধারে সকাল ন’টার মধ্যেই গুছিয়ে বসে পড়ে। তার সামনে প্লাস্টিকের চাদরের ওপর টিয়াপাখির খাঁচা, খাঁচার সামনে সাজানো ভাগ্যফল লেখা সারি সারি কার্ড। দুটো টাকা দিলে কাত্যায়ণ খাঁচার দরজা খুলে দেয়। পোষা টিয়াপাখি বাইরে বেরিয়ে এসে একটা কার্ড ঠোঁটে নিয়ে কাত্যায়নের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার খাঁচার মধ্যে ঢুকে পড়ে। খাঁচার দরজা বন্ধ করে কাত্যায়ণ ভাগ্য বিচার করতে আসা গরিব-গুর্বো মানুষগুলোকে সেই কার্ডের লেখা পড়ে শোনায়। সেসব কার্ডের কোনওটায় লেখা থাকে – ‘আপনার শুদীন আশতে আর দেরী নেই। আর মাত্র কয়েকটা দীনের প্রতিক্‌খা’।  কোনওটায় – ‘আপনার দূঃখের দীন শেষ হয়ে এসেছে, আর কটা দীন পরেই আপনি যা চাইছেন সব পেয়ে যাবেন’।

সেদিনও কাত্যায়ণ শাস্ত্রী সকাল ন’টার আগেই গুছিয়ে বসেছিল কার্জনপার্কের উলটোদিকের ফুটপাথে। সকলের অলক্ষ্যে তার দু’পাশে এসে বসল রুকু আর সুকু। কাতারে কাতারে অফিসের বাবুরা দৌড়চ্ছে তাদের অফিসের দিকে। কাত্যায়ণ তাদের দেখছিল আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল। রোজ বাড়িতে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে নিশ্চিন্তে অফিস করা এই বাবুরা কত কত টাকা মাইনে পায়, আর দুটো টাকা দিয়ে নিজের ভাগ্যটা জানতেও এদের কোনও ইচ্ছে হয় না? মাত্র দুটোই তো টাকা!

রুকু খুব চাপা স্বরে বলল, “ও টাকায় টিয়ার জন্যে ভিজে ছোলার দামও তো ওঠে না, শাস্ত্রীজি। আপনার কী হবে?”

ঘাড় ঘুরিয়ে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী চারদিকে তাকাল। আশেপাশে কাউকেই দেখতে পেল না। তাহলে কে বলল কথাটা? কথাটা তার একদম মনের কথা। কিন্তু মনের কথা এমন স্পষ্ট করে কানেও শোনা যায় নাকি? একটু চমকে গেলেও কাত্যায়ণ শাস্ত্রী ঘাবড়াল না। তার মনে আছে প্রফুল্লনগরের সেদিনের ঘটনার কথা। কিন্তু এটা তো আর প্রফুল্লনগর নয়। কলকাতা শহর। পেছনদিকে রাজভবন, সামনে কার্জনপার্ক। মাঝখানের চওড়া রাস্তা দিয়ে দৌড়ে চলেছে অজস্র বাস আর গাড়ি। দৌড়ে চলেছে হাজার হাজার চাকুরে লোক। এ হচ্ছে সরকারি খাস জায়গা। প্রকাশ্য দিনের বেলা এখানে কোন ভূতের বাপের ক্ষমতা হবে না তার কোনও ক্ষতি করার।

রুকু আবারও বলল, “আমরা এখানে এসেছি আপনার কোনও ক্ষতি করতে নয় শাস্ত্রীজি, বরং উপকার করতেই এসেছি।”

এই কথা শুনে কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর ঘাড় একদম শক্ত হয়ে গেল। ঘাড় বেয়ে নেমে আসতে লাগল বরফ-শীতল ভয়ের স্রোত। কোনওরকমে তিনবার ঢোঁক গিলে বলল, “যা ক্ষতি করেছ ভূতভাইরা, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন আবার উপকার?”

“হুঁ, উপকার। ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ।” রুকু হাসল প্রমথবাবুর মতো। “অপকার যারা করে তারা উপকারও করতে পারে।”

রুকুর হাসি শুনে আরও চমকে গেল কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। ভাবল, প্রমথবাবুও এসেছেন বুঝি সঙ্গে। বলল, “প্রমথদাও এসেছেন নাকি? তিনি কবে অশরীরি হয়ে গেলেন, জানতে পারিনি তো!”

“বালাই ষাট! তিনি কোন দুঃখে অশরীরি হবেন? তবে হ্যাঁ, তিনি খুব মনোকষ্টে আর দুশ্চিন্তায় আছেন। তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন একমাত্র আপনি!” সুকু কাত্যায়ণ শাস্ত্রীকে বলল।

এত দুঃখেও কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর হাসি পেল। বিষণ্ণ হাসিমাখা মুখে বলল, “আমাকে এই দুর্গতি থেকে কে উদ্ধার করে তার ঠিক নেই, আমি উদ্ধার করব প্রমথদাকে?”

“ঠিক তাই। আপনি এই টিয়াপাখির খাঁচা যার কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন, তাকে ফেরত দিয়ে চলে যান প্রথমবাবুর হিমঘরে। সেখানেই তিনি সারাটাদিন বসেন। বাড়ি ফেরেন প্রায় মাঝরাত্রে। বাড়ি থেকে বেরিয়েও পড়েন ভোররাত্রে।”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর ভয়টা এবার একটু কেটে যেতে লাগল। বুকে যেন একটু বল পাচ্ছে। মুচকি হেসে বলল, “ভূতেরাও যে এমন পাগল হয় জানা ছিল না ভাই! প্রমথদার সামনে দাঁড়ালে আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন। আমার কোনও কথাই শুনবেন না।”

রুকু বলল, “শুনবেন, শুনবেন। ঠিকমতো বলতে পারলে সবকথা শুনবেন, এমনকি মেনেও নেবেন। মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁর আর অন্য রাস্তা নেই কিনা!”

“আচ্ছা, শুনিই তাহলে কী করতে হবে।” কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর মনে ভয়টা আর নেই বললেই চলে।

“খুব ভালো। আপনি যে আমাদের ভরসা করেছেন আর ভয় পাচ্ছেন না, ধরে নিন এতেই আপনার আদ্দেক কাজ হয়ে গেছে। এবার কী করতে হবে শুনুন। ছেঁড়াখোঁড়া এই জামাপ্যান্ট ছেড়ে লাল কাপড় পরতে হবে, যাকে বলে রক্তাম্বর। ঘাগু তান্ত্রিকেরা যেমন পরেন আর কি! এমন মিনমিন করে কথা বললেও হবে না। বেশ রোখ-টোখ নিয়ে ডেকে-হেঁকে কথা বলতে হবে। আপনি-আজ্ঞে না বলে, তুই বলতে হবে, এক ধাক্কায়।”

“প্রমথদাকে আমি ‘তুই’ বলব, আমাকে কি ভূতে পেয়েছে, নাকি?” কাত্যায়ণ শাস্ত্রী খুব বিরক্তমুখে বলল।

রুকু ধৈর্য হারাল না। বলল, “ভূতে তো আপনাকে পেয়েইছে। আমরাই কি ভূত নই? রাজভবনের ফুটপাথে বসে এই যে আপনি আপনমনে বক বক করে চলেছেন, অনেকেই কিন্তু আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছে। ভাবছে, আপনাকে ভূতে পেয়েছে নয়তো আপনার মাথাটা গেছে!”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রী আশেপাশে লোকজনের দিকে তাকাল। উল্টোদিকে একজন কচি শসা ছাড়িয়ে বিটনুন মাখিয়ে বিক্রি করছে। সে সত্যি সত্যি তার দিকে বার বার দেখছে। ডানদিকে একটু তফাতে এক বুড়ি পা ছড়িয়ে বসে ভিক্ষে করছে। সেও তার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। এতক্ষণ কাত্যায়ণ শাস্ত্রী লক্ষ করেনি, এখন লক্ষ করে বেশ ভড়কে গেল।

রুকু বলল, “আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন তো? কথা কম বলে আমাদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন। যেমন বলছি, সেভাবে কাজ করলে প্রথমে প্রথমবাবুর ভালো হবে, তারপর আপনারও উপকার হবে। আপনার হারিয়ে যাওয়া সুনাম চাই কি আগের থেকে অনেক বেড়েও যেতে পারে। কী ঠিক করলেন বলুন, আমাদের কথামতো কাজ করবেন? হ্যাঁ কিংবা না-তে উত্তর দিন, বেশী কথা বলবেন না।”

ভাববার জন্যে কিছুক্ষণ সময় নিল কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। টিয়াপাখির ভরসায় তার যে দিন চলবে না সে ব্যাপারে তার চেয়ে ভালো আর কে জানে? তবে ভূতের ওপর ভরসা করাটাও উচিত হবে কি না কে জানে। কিন্তু এখন তো আর কোনও উপায়ও নেই। বিশেষ করে এই দুই ভূত যখন তার পেছনে পড়ে আছে তার থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায়ও তো তার জানা নেই। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী ঘাড় ঝুঁকিয়ে বলল, “হুঁ।”

“ভেরি গুড। টিয়াপাখির ঝাঁপ গুটিয়ে তুলে এখন তাড়াতাড়ি চলুন, হাওড়ার ট্রেন ধরতে হবে।”

তালতলার বিহারী মজনুর আলির হরেক ব্যাবসা। তার কাছে ম্যাজিকের সরঞ্জাম, টিয়াপাখির খাঁচা সমেত ভাগ্য গোনার বাক্স, মানুষের ওজন মাপার ঘড়ি আর ঘন্টা, বীণ সমেত তিন সাপের ঝাঁপি, একখানা এয়ার গান, সিসের গুলি আর বেলুন চিপকানো বোর্ডে টিপ প্র্যাকটিস করার সরঞ্জাম, আরও অনেক জিনিস পাওয়া যায়। সে সকালবেলা টাকা জমা নিয়ে এসব সরঞ্জাম ভাড়া দেয় আর রাত্রে ভাড়ার টাকা নিয়ে জিনিস ফেরত নেয়। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী অসময়ে হাজির হয়ে খাঁচা জমা দিতে খুব অবাক হল মজনুর আলি। বলল, “কা কাত্যায়ণ ভাই, আভি আভি লিয়ে গেলে, আভি আভি ওয়াপসভি লিয়ে এলে, বেওসাটা ভালো লাগল না?”

“তা নয় মজনুর ভাই। অন্য একটা ব্যাবসা মাথায় এসেছে। তুমি একটু হেল্প করলে ভালো হয়।”

“লতুন বেওসা? সে কীরকম আছে, একটু বোলেন তো?”

“লাল ধুতি আর চাদর আছে, মজনুর ভাই? সঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা-টালা হলে ভালো হয়।”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর এই কথায় খুব একচোট হো হো করে হাসল মজনুর আলি। বলল, “কাপালিকবাবার বেওসা? এ তো বহোত পুরানা বেওসা হল। তুমি কাপালিক বনবে, ব্যোমকালী কলকাত্তাওয়ালি? হা হা হা হা। কাপালিকের সোব তামঝাম হামার কাছে মিলবে, হে রতনোয়া, কাত্যায়ণ ভাই কো ও কাপালিকওয়ালা ড্রেস দিখাও।”

মজনুর আলির শাগরেদ রতন ঘরের ভেতর থেকে খুঁজেপেতে কাপালিকের ড্রেস নিয়ে এল। রক্তাম্বর, সঙ্গে লাল কাপড়ের ঝোলা। রুদ্রাক্ষের মালা তিন সেট – গলায় পরার জন্যে একটা বড়ো, হাতে পরার জন্যে একজোড়া ছোটো। একটা লাউয়ের খোলায় বানানো কমণ্ডলু আর একটা খুব ব্যাঁকাত্যারা পাকানো অদ্ভুত দেখতে লাঠি। আর একজোড়া খড়ম। কাপালিক সাজার মোক্ষম ড্রেস দেখে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী নিশ্চিন্ত হল।

মজনুর আলি বলল, “পসন্দ হলো তো, কাত্যায়ণভাই? তোবে রেট একটু বেশি পড়বে। জোমা একসো টাকা, আর ভাড়া রোজ তিরিশ টাকা।”

“একশো টাকা জমা! অত টাকা কোথায় পাব মজনুর ভাই? টিয়াপাখির পঞ্চাশটাকা সকালে জমা দিয়ে গেলাম, ওটাতেই কাজ চালিয়ে দিন মজনুরভাই।”

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে মজনুর আলি বলল, “ঠিক আছে কাত্যায়ণভাই, লেকিন ভাড়া চালিস টাকা রোজ দিতে হোবে! কোতোদিনের জন্যে লিবেন?”

“চার-পাঁচদিন তো বটেই, দু-একদিন বেশিও হতে পারে। চল্লিশ টাকা রোজ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? মজনুর ভাই, পঁইত্রিশ হলে ভালো হত।”

“চালিস বোলে দিলোম, বাস চালিস। লিতে হয় লিন, না লিবেন তো না লিন। এক পয়সা কোম হোবে না।”

স্টেশন থেকে প্রমথবাবুর হিমঘর শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূরে বড়ো রাস্তার ধারে। ট্রেন থেকে নেমে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী হাঁটা লাগাল হিমঘরের দিকে। যদিও সে এর আগে কোনওদিন যায়নি, তবে চিনতে অসুবিধে হবে না। কারণ, সারাক্ষণ রুকু-সুকু তার সঙ্গেই রয়েছে। ছোট্ট শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা মাঠের ধার দিয়ে যাবার সময় একটা বড়ো গাছতলার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী জামা-প্যান্ট বদলে কাপালিকের রক্তাম্বর পরে নিল। তারপর রুদ্রাক্ষের মালা পরে হাতে কমণ্ডলু আর সেই ব্যাঁকা লাঠি নিয়ে যখন দাঁড়াল, কে বলবে এ সেই কার্তিকচন্দ্র হাতি, ওরফে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। কাঁধের লাল ঝোলার মধ্যে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে নিল পুরনো জামা-প্যান্ট। তার এই বেশ বদলের সাক্ষী রইল রুকু-সুকু দুই ভাই, মাঠে চড়তে থাকা একটি গরু আর তিনটে ছাগল।

বিশাল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর বুকটা কিন্তু কেঁপে উঠল। রুকুসুকু পাশে থেকে বলল, “কাউকে আপনি বা তুমি বলবেন না শাস্ত্রীজি, তুই বলবেন। আর যত জোরে আর ধমকে কথা বলবেন লোকে ততই আপনাকে ভক্তি করবে, এ কথাটা মোটেই ভুলবেন না যেন।”

“ভয়ে যে আমার পা কাঁপছে, ভূতভাই।” কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর গলাও কেঁপে উঠল।

“পা কাঁপছে, কাঁপতে দিন। গলা যেন না কাঁপে। খুব জোরে শ্বাস নিয়ে গলাটা সাফ করে নিন।”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রী তাই করল। তারপর বন্ধ লোহার গেটে ঠকঠক আওয়াজ তুলল। একজন দারোয়ান গেটের সামনে কাপালিককে দেখেই নিচু হয়ে নমস্কার করল। বলল, “গোড় লাগি, মহারাজ। ইধার কুছ ভিখ নহি মিলেগা, আগে যাইয়ে।”

ভিক্ষে চাওয়ার কথাটা কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর ভীষণ গায়ে লাগল। প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠল তার শরীর। বলল, “চোপরাও, বেয়াদব! সাধুসন্ত কো ভিখারি বোলতা হ্যায়, মুরখ? যা, যাকে আপনা মালিক, প্রমথ্‌ কে বুলা। বোল, সাধু মহারাজ আয়ে হ্যায়।”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর বলার দাপটে দারোয়ানজি তো বটেই, রুকু-সুকুও রীতিমতো চমকে উঠল। রুকু-সুকু একটু দূরে সরে দাঁড়াল। দারোয়ানজি আর কথা না বাড়িয়ে আরেকবার নিচু হয়ে নমস্কার করল। তারপর দৌড়ে চলে গেল অফিসের দিকে। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী চুপিচুপি জিগ্যেস করল, “ঠিক আছে তো, ভূতভাই?”

“একদম, মোক্ষম দিয়েছেন শাস্ত্রীজি। ব্যস, এই দাপটটা ধরে রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে। আপনার সুদিন ফিরে আসবে।”

দারোয়ানজির কথায় প্রমথবাবু অফিসের থেকে বাইরে এসে দেখলেন গেটের বাইরে কে একজন লাল কাপড় পরা সাধু মহারাজ এসে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে অদ্ভুত লাঠি আর কমণ্ডলু। এমনিতেই তাঁর এখন মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। প্রমোটারি করতে গিয়ে এমন ডুবেছেন, সেখান থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন তার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। মাদুলি, গাছের শেকড়, নানান ধরনের রত্ন, যাগ-যজ্ঞ, স্বস্ত্যয়ন, ঝাড়-ফুঁক কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এই সাধু মহারাজ নিজে নিজেই এসে যখন দেখা দিয়েছেন কথা বলতে দোষ কী? কার মধ্যে কী আছে কিছু বলা যায়? তিনি দারোয়ানজিকে বললেন, “জলদি যাকে গেট খোল দো, মহারাজ কো আনে দো।”

দারোয়ান দৌড়ে গেল। পেছনে প্রমথবাবুও এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী খোলা গেট দিয়ে ঢুকে প্রমথবাবুর সামনে দাঁড়াল। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জোর গলায় বলল, ‘চিনতে পারছিস?”

প্রমথবাবু চিনতে ভুল করেননি। এ তো সেই কার্তিক, কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। তাঁরা একসঙ্গেই ভূতের তাড়া খেয়ে পালিয়েছিলেন। সে ব্যাটার এত সাহস, আজ তাঁকে ‘তুই’ বলছে? রাগও হচ্ছিল, আবার অবাকও হচ্ছিলেন মনে মনে। কোনও কথা না বলে তিনি তাকিয়ে রইলেন কার্তিকের দিকে। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী মৃদু হেসে বললেন, “মূর্খ, চিনতে পারলি না তো? আমি কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। ভূতের তাড়া খেয়ে ভয়ে তুই পালিয়ে এসে বাসা বেঁধেছিস এই হিমঘরে! আর আমি সেই অপমানের শোধ তুলব বলে চলে গেছিলাম হিমালয়ে। গুরুদেবের কাছে মন্ত্র নিয়ে তিনমাস তপস্যা করে গত পরশু সিদ্ধিলাভ করেছি। গুরুদেব বললেন, যা বেটা, আভি যাকে লড় যা ভূতোঁ কে সাথ। সমঝা দে উনকো, তু কৌন গুরু কা চেলা হ্যায়। আজই ফিরলাম। সোজা চলে এলাম তোর এখানে। রাজি থাকিস তো চল আমার সঙ্গে। কাল বাদে পরশু শনিবার রাত্রে বোঝাপড়া হয়ে যাক সেই ভূতেদের সঙ্গে। ভূতেদের বাবার নাম না ভুলিয়ে দিয়েছি তো আমার নাম কাত্যায়ণ শাস্ত্রী নয়।”

এই কথায় রুকু-সুকু একটু বিরক্ত হয়ে কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর কানে কানে বলল, “আপনার এতটা উপকার করতে চলেছি আমরা শাস্ত্রীজি, তার পরেও আমাদের বাবার নাম ভুলিয়ে দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?”

খুব আস্তে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী বলল, “স্যরি, ভূতভাই। ওটা ফ্লোতে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”

রুকু বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি চালিয়ে যান, প্রথমবাবু মোটামুটি ঘায়েল হয়ে এসেছেন।”

প্রথমদিকে প্রমথবাবুর যে একটু রাগ হচ্ছিল না তা নয়, বেজায় হচ্ছিল। ব্যাটা কাত্তিকচন্দ্র হাতি, কাত্যায়ণ শাস্ত্রী হয়েও তাঁর সামনে বিনয়ের অবতারটি হয়ে থাকত। তার আজকের এই চেহারা আর ব্যবহার দেখে ঠিক কী করা উচিত তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তবে এটা বুঝতে পারলেন, সেই মিনিমিনে কার্তিক আর মিনমিনে নেই। যেন বাঘ হয়ে উঠেছে। এদিকে তাঁর সময়টাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। প্রমোটারির জমিটা নিয়ে আর অনেক লোকের থেকে ফ্ল্যাটের অ্যাডভান্স বুকিং নিয়ে তিনি অথৈ জলে পড়ে আছেন। সেক্ষেত্রে এই নতুন কাত্যায়ণ যদি আবার সব ঠিকঠাক করে দিতে পারে, মন্দ কী? তাতে যদি কাত্যায়ণ তাঁকে তুই-তোকারি করে কিংবা তাঁকে যদি কাত্যায়ণকে আপনি-আজ্ঞে করতে হয়, তাতেই বা ক্ষতি কী? জমির ব্যাপারটা মিটে গেলে তাঁরই লাভ। আর না মেটাতে পারলে ব্যাটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দেশছাড়া করতে তাঁর কতক্ষণ সময় লাগবে?

“কী ভাবছিস রে, বেটা? মনে কোনও দ্বিধা রয়েছে, কোনও সংশয়?” তারপর কাত্যায়ণ শাস্ত্রী একটু মোলায়েম স্বরে ঠাট্টার সুরে বলল, “তোদের কি এখানে অতিথি এলে বসতে বলার রেওয়াজ নেই? চা-জলখাবারেরও কোনও ব্যবস্থা নেই? এই করে তুই ব্যাবসা চালাস রে, প্রমথ?”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর এই কথায় প্রমথবাবু থতমত খেয়ে বললেন, “আসুন আসুন কাত্যায়ণজি, ছি ছি, কী অন্যায় বলুন দিকি। সেই থেকে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছি। আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। অ্যাই কানাই, বাইকটা নিয়ে চট করে শিঙাড়া, জিলিপি, মিষ্টি-টিষ্টি কী পাস নিয়ে আয় তো। শিঙাড়া যেন গরম হয়। আসুন আসুন, আপনি এখানটায় আরাম করে বসুন।”

তক্তপোশের উপর বিছানো গদিতে আরাম করে বসল কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। ঘরে এসি চলছে, মাথার উপরে হাল্কা স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। আরামে কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর শরীরটা জুড়িয়ে গেল। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে স্বস্তিতে। এতক্ষণ সব ঠিকঠাক চলছে। এবার পরশু রাতের যজ্ঞটা যদি ভালোয় ভালোয় মিটিয়ে ফেলতে পারে তাহলেই তার পাথরচাপা কপাল আবার খুলে যাবে! ভূতভাইয়েরা যখন তাকে এতটাই সাহায্য করছে তখন বাকিটাও ভালোয় ভালোয় মিটবে বলেই তার আশা। আরামটা একটু ধাতস্থ হতে বলল, “বেটা প্রমথ, এখন ওদিকের কী অবস্থা বল তো?”

মেঝেয় পাতা কার্পেটে প্রমথবাবু বসে পড়ে বললেন, “সেই যে ভূতের অত্যাচারে আপনি আর আমি পালিয়ে এসেছিলাম, সে কথায় তো চারদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল। আমার সেই জমিটার নামই হয়ে গেল ভূতডাঙা। কেউ আর সেখানে কাজ করতে যেতে চায় না। আটষট্টি জন ফ্ল্যাট বুক করে অগ্রিম টাকা দিয়েছিল, তারা একে একে আসতে লাগল টাকা ফেরত নেবার জন্যে। এক-আধ টাকা নাকি? প্রত্যেকের দু’লাখ করে হলে কত টাকা বুঝে দেখুন। বাবা, সে কি আর হুট করে ফেরত দেওয়া সম্ভব?”

“ঠিক কথা। তারপর?” চোখ বন্ধ করে হাল্কা পা নাচাতে নাচাতে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী বলল।

“তারপর আর কী, বাবা? প্রথমদিকে তারা একজন দু’জন করে আসত। তারপর তারা সবাই মিলে ‘প্রতারিত ফ্ল্যাট ওনার্স সমিতি’ খুলে ফেলেছে। এখন সেই সমিতির পাঁচ থেকে ছ’জন প্রতিনিধি রোজ সকাল ছ’টায় আমার বাড়ি এসে রাত দশটা অব্দি বসে থাকে। দুটো শিফট। সকাল ছ’টা থেকে দুপুর দুটো, আবার দুটো থেকে রাত দশটা। কত বুঝিয়েছি, কত অনুরোধ করেছি, ক’টা মাস সময় দেওয়ার জন্যে। কিন্তু কে কার কথা শোনে? এখন আমিই বাড়িছাড়া। ভোর পাঁচটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, রাত এগারোটার পরে বাড়ি ঢুকি।”

“বুঝতে পারছি, খুবই কষ্টের মধ্যে রয়েছিস রে, প্রমথ। যাক গে, আর মাত্র দুটো দিন। তোর দুঃখের দিন শেষ হয়ে গেছে। আমি যখন এসে গেছি তোর আর কোনও চিন্তা নেই। শনিবার মাঝরাতে আমার কাজ আমি করে দেব। রবিবার সকাল থেকে জমিতে লোকজন লাগিয়ে তোর কাজ শুরু করে দে। ঝোপঝাড় কেটে জমি সাফ করা আর মাটি কাটার কাজ আমি দাঁড়িয়ে থেকে শুরু করিয়ে দিতে চাই। ব্যস, তাহলেই তোর ফ্ল্যাট কেনা লোকেরাও স্বস্তি পাবে, তোকে আর জ্বালাবে না। কী রে ব্যাটা, ঠিক আছে তো?”

“হ্যাঁ বাবা, ঠিক তো আছে, কিন্তু…”

“কিন্তু কী? কাত্যায়ণ শাস্ত্রী যা বলছে তা করে দেখাতে পারবে কি না? তাই তো?”

“না মানে, ওই ইয়ে আর কি! মনে খুব ভয় ধরে গেছে বাবা।”

“ভয়? কীসের ভয়? হা হা হা হা…” কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর দমফাটা হাসিতে রুকু-সুকুও চমকে উঠল।

“তা মানে, আপনি যখন ইয়ে, ভরসা দিচ্ছেন তখন আর কীসের ভয়, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ…” বহুদিন পরে প্রমথবাবু তাঁর হারানো হাসিটা আবার ফিরে পেলেন।

কাত্যায়ণ শাস্ত্রী সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “তোর হাসিটা কতদিন পরে ফিরে পেলি বল? ওই সঙ্গে দ্যাখ তোর কানাই শিঙাড়া-জিলিপিও নিয়ে এল।”

সত্যি সত্যি কানাই ঘরে ঢুকল শিঙাড়া আর জিলিপির মস্ত ঠোঙা নিয়ে। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী বলল, “আমাকে দেওয়ার আগে একটা প্লেটে চারটে শিঙাড়া আর চারটে জিলিপি দে। আমার সঙ্গে দু’জন আছে, তাদেরও খাওয়াতে হবে।”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর সঙ্গে দু’জন? কোথায়? কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তো! প্রমথবাবু, কানাই এবং ঘরে আরও তিনজন ছোকরা ভয়ে ভয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। কানাই একটা প্লেটে চারটে শিঙাড়া, চারটে জিলিপি সাজিয়ে ভীষণ ভয়ে ভয়ে বলল, “বাবা, এগুলো কাকে দিতে হবে বললেন?”

“হা হা হা হা… আমার বন্ধুদের! তারাও তো আমারই মতো অনেকক্ষণ না খেয়ে রয়েছে রে ব্যাটা।” তারপর পাশের ঘরটা দেখিয়ে বলল, “ওঘরে কে আছে?”

“আজ্ঞে, ওটাই আমাদের অফিস ঘর। এখন কেউ নেই।”

“খুব ভালো। ওই ঘরে টেবিলের ওপর প্লেটটা রেখে দিয়ে বেরিয়ে আয়। দরজাটা ভেজিয়ে দিবি। আর দেখিস, কেউ যেন ও ঘরে এখন না যায়।”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর এই কথায় সকলেরই ভয়ে প্রাণ উড়ে যাবার যোগাড়। কানাই কোনওমতে প্লেটটা অফিস ঘরের টেবিলে রেখে বেরিয়ে এল দৌড়ে। তারপর দরজাটা ভেজিয়ে দিল ধড়াম করে।

“ভয় কী রে পাগলা, আমি তো আছি।” মুচকি হেসে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী বলল, “আয়, এবার আমরা সবাই মিলে ভাগ করে খাই।”

প্রমথবাবু এতক্ষণ ফ্যালফ্যাল চোখে দেখছিলেন সবকিছু। এবার মেঝে থেকে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর পায়ের ওপর, “যদি কোনও দোষত্রুটি হয়ে থাকে তো ক্ষমা করে দেবেন বাবা। অবোধ শিশু আমরা, কী বুঝব আপনার লীলা?”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর শিঙাড়ার গন্ধে খিদেটা চনমন করে উঠেছিল। প্রমথবাবুর এই আদিখ্যেতায় খুব বিরক্ত হল, “আহ্‌, ছাড় ছাড়। আমি কেউ নই রে পাগল। এ আমার গুরুর লীলা, এ আমার তারামায়ের লীলা। ছাড় ছাড়, খিদে পেয়েছে। অ্যাই কানাই, প্লেটে শিঙাড়া দে।”

গরম শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী খুব আনন্দ পেল। এমন মজা আর আনন্দ সে জীবনে কোনওদিন পায়নি। প্রমথবাবুর মতো জাঁদরেল লোক তার পায়ের ওপর মেঝেয় বসে আছেন। সে কথা বলে চলেছে আর প্রমথবাবু জোড়হাতে সে কথা ভক্তিভরে শুনছেন। এ জিনিস সে কোনওদিন কল্পনাও করেনি। তার পাথরচাপা কপাল যে খুলে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না। একটা শিঙাড়া শেষ করে দ্বিতীয়টা খাবার সময় দেখল, প্রমথবাবু কিছু খাচ্ছেন না। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী বলল, “খুব ভালো গরম শিঙাড়া। খেলে চিত্তশুদ্ধি হয়। কী রে, তুই খাবি না?”

“না বাবা, আপনি খান। আপনার সেবা মানে আমারও সেবা।” প্রমথবাবু গদগদ হয়ে বললেন।

“এই নে, তবে তুই আমার প্রসাদ পা।” আধখাওয়া দ্বিতীয় শিঙাড়াটা প্রমথবাবুর হাতে তুলে দিল কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। দু’হাতে সেই এঁটো শিঙাড়া মাথায় ঠেকিয়ে প্রমথবাবু বললেন, “জয়, বাবা কাত্যায়নের জয়। জয়, তারা মায়ের জয়।”

তারপর সেই শিঙাড়ার টুকরো ভেঙে ভেঙে সকলে মিলে ভাগ করে নিলেন নিজেদের মধ্যে।

শিঙাড়া জিলিপি চা খেয়ে খুব তৃপ্তি পেল কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। বলল, “চ, এবার বাড়ি যাবি না? সন্ধে হয়ে এল তো! এ ক’টা দিন তোর বাড়িতেই এককোণায় থাকতে দিবি তো রে ব্যাটা?”

প্রমথবাবু আঁতকে ওঠার মতো বললেন, “আজ্ঞে কাত্যায়ণবাবা, সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু এখন বাড়ি ফিরলেই যে সেই সমিতির লোকেরা চেপে ধরবে। আমি তো এগারোটার আগে বাড়ি ফিরতে পারি না বাবা!”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রী খুব বিরক্ত হয়ে ধমকে বলল, “ধুর ব্যাটা, সেই থেকে বলছি তোর কোনও ভয় নেই। কথা কানে যাচ্ছে না, নাকি? বাড়ি চল। কতদিন এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবি, অ্যাঁ? তোর নামে ক’দিন আগেও বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত। সেসব কথা ভুলে গেলি কী করে র‍্যা?” তারপর একটু নরম সুরে বলল, “রাত্রে কী খাওয়াবি বল? পাঁঠার মাংস যেন থাকে। তাছাড়া তোর যা প্রাণ চায়।”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এল। পেছনে প্রমথবাবু ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে। কানাই খুব ভয়ে আর নিচু হয়ে জিগ্যেস করল, “বাবা, আপনার বন্ধুরাও যাবে তো? অফিস ঘরে ঢুকব?”

কাত্যায়ণ শাস্ত্রী কানাইয়ের পিঠে আদর করে একটা হালকা চাপড় মারল। বলল, “বোকা ছেলে! আমার বন্ধুদের কোথাও যাবার জন্যে গাড়িঘোড়া লাগে না রে ব্যাটা। তেনারা সব অশরীরি। যা যা ব্যাটা, আর ভয় নেই। অফিস ঘর থেকে প্লেটটা বের করে নিয়ে আয়।”

অফিস ঘরে ঢুকে কানাইদের চক্ষু চড়কগাছ! টেবিলের ওপর প্লেটটা খালি। জিলিপির দু-একফোঁটা রস ছাড়া কিচ্ছু পড়ে নেই প্লেটে!

শনিবারের মাঝরাতে যজ্ঞ শুরু করে শেষ হল যখন তখন সকাল হয়ে গেছে। সকালে হাঁটতে বেরনো লোকজন অনেকেই এসে জড়ো হতে থাকল একে একে। কয়েকমাস আগে এই মাঠেই ভূতেদের তাণ্ডবের কথা সকলেরই মনে ছিল। আজ প্রমথবাবুকে তাঁর দলবল নিয়ে মাঠের মধ্যে জাঁকিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখে সকলেই খুব অবাক হল। প্রমথবাবুর পাশেই দাঁড়িয়েছিল কাত্যায়ণ শাস্ত্রী। আজ কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর ভয়ংকর চেহারা। পরনে রক্তাম্বর। পায়ে খড়ম। গলায় হাতে রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে টুকটুকে সিঁদুরের বিশাল তিলক। সারা গায়ে মুখে ছাইভস্ম মেখে ভয়ংকর।

প্রমথবাবুর আজ বড়ো আনন্দের দিন। তাঁর জমিতে এমন নির্বিঘ্নে যজ্ঞ সম্পন্ন হয়ে যাবে তিনি ভাবতেও পারেননি। কোনও লোকই এখানে কাজ করতে আসতে চাইছিল না। হাতে পায়ে ধরে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে কিছু লোককে আনা গিয়েছে। সকাল থেকেই তারা লেগে পড়েছে ঝোপঝাড় কেটে জমি সাফ করার কাজে। কিছু লোক লেগে পড়েছে বাড়ির ভিতের জন্যে মাটি কাটার কাজে। প্রথমে সকলেরই মনে একটু ভয় ভয় ছিল। এখন আর নেই। অনেকেই এসে মহাতান্ত্রিক কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর পায়ে প্রণাম করে গিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করে চলেছে।

ভালোয় ভালোয় সবকিছু মিটে যাবার পর কাত্যায়ণ শাস্ত্রীকে নিয়ে প্রমথবাবু বাড়ি ফিরলেন। স্নান সেরে কাত্যায়ণ শাস্ত্রী লুচি, আলুর দম, একগাদা মিষ্টি দিয়ে জলখাবার খেয়ে বড়ো আরামে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল। কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর পায়ের কাছে মেঝেয় বসে প্রমথবাবু বললেন, “কাত্যায়ণবাবা, এরপর আপনার কী প্ল্যান?”

সারারাত জেগে যজ্ঞ করে ক্লান্ত কাত্যায়ণ শাস্ত্রীর চোখে ঘুম আসছিল আরামে। বলল, “কাল ভোরবেলায় বেরিয়ে যাব। হিমালয়ে। গুরুদেবের সঙ্গে বাকি জীবনটা সাধন ভজনেই কাটিয়ে দেব ভাবছি।”

“হিমালয়ে? না না বাবা, তা কী করে হয়? আমাদের কে রক্ষা করবে? আপনাকে যখন এই রূপে আবার ফিরে পেয়েছি আর ছাড়ছি না।”

“তোদের রক্ষা করবেন মা তারা। আমি তো নিমিত্তমাত্র রে পাগল!”

“আমরা বাবা, পাপীতাপী মানুষ, আমাদের ডাকে মা তারা মোটেই সাড়া দেন না। আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন আপনি! আপনাকে কিছুতেই ছাড়ছি না। আপনাকে এই প্রফুল্লনগরেই থাকার বাসা দেব। আপনি এখানেই থেকে আমাদের মতো সংসারের মায়ায় বাঁধা পড়া মানুষদের বিপদে আপদে একটু উদ্ধার করে দেবেন, ব্যস। আর কিচ্ছু চাই না। গতরাত্রের যজ্ঞের জন্যে আপনার সেবায় তিরিশ হাজার, না না, তিরিশ বড্ডো কম হয়ে যাচ্ছে, পুরো পঞ্চাশ দেব বাবা। দয়া করে আপনি আর না করবেন না বাবা।”

“আচ্ছা আচ্ছা, এখন যা, আমি ভেবে দেখব না হয়। আমার এখন বিশ্রামের সময় হল। যাবার সময় দরজাটা চেপে দিয়ে যাস। আর দেখিস কেউ যেন বিরক্ত না করে। দুপুরে সেবার আগে আমাকে আর ডাকবি না। এখন যা।”

প্রমথবাবু কাত্যায়ণ শাস্ত্রীকে গড় হয়ে প্রণাম করলেন। তারপর পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা চেপে বন্ধ করে দিলেন। কাত্যায়ণ শাস্ত্রী চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল। তারপর নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে পড়ল।

* * *

সন্ধের পর রুকু-সুকুর কাছে সব ঘটনা শুনে সরুদা বলল, “তার মানে যেমন যেমন বলেছিলাম, ঠিক তেমনই সব করে ফেলেছিস তোরা?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ দাদা, কোথাও কোনও গণ্ডগোল হয়নি।”

“এই ব্যাপারে আমার এই দুইবোন রুন্টু-ঝুন্টুর কথা কেউ জানবে না তো?”

“ঘুণাক্ষরেও না। আমরা এই ক’জন ছাড়া কেউ না।”

“প্রমথবাবু তাঁর প্রমোটারির সঙ্গে আবার শপিংমল বানানোর কথাও আর ভাববেন কি?”

“একদম না। মলের কথা তিনি নোংরা মলের মতোই ত্যাগ করেছেন।” রুকুর এই কথায় সুকু হাসল, ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ ঘুঁ।

“যাক, মনের মধ্যে একটা কাঁটা বিঁধে ছিল সেটা দূর হল। এবার প্রমথবাবু তাঁর ক্ষতিটুকু সামলে নেবেন। আর কাত্যায়ণ শাস্ত্রীও তার পুরনো চেম্বার আর তন্ত্রচর্চার ঠিকানা পেয়ে গেল আগের মতোই।” সরুদা বলল।

সরুদা আরও বলল, “অন্যায় কাজ করলে শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু তাই বলে কারও সর্বনাশ করাটা কোনও কাজের কথা নয়। বুঝলি রুন্টু-ঝুন্টু? যা হল, এই বেশ হল।”

ছবিঃ শিমুল

জয়ঢাকের গল্পঘর    

1 thought on “গল্প ভূতের ভরসা কিশোর ঘোষাল বর্ষা ২০১৭

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s