অনিরুদ্ধ সেন-এর আরো গল্প- জটিল হিসেব , পঞ্চু প্রধানের দোয়ায়, রক্ষক, পেঁচো ও বেয়ারা ইমেল, ভূতুড়ে দ্বীপ, পেঁচোর সাত সতেরো, কাছে থেকে দূর রচিল, ভূতুড়ে দ্বীপ, কালের পথিক
অরুণ, দেবাঞ্জন আর কনিষ্ক ক্লাব লাইব্রেরিতে বসে। সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। লাইব্রেরিটা তাদের মতো কয়েকজন বইপ্রেমী চেষ্টাচরিত্র করে দাঁড় করিয়েছে। স্কুল-কলেজের বইয়ের সঙ্গে নতুন, পুরোনো অনেক গল্পের বইও এখানে আছে।
ওরা তিনজনই কলেজের ছাত্র, পড়াশোনায় জুয়েল। অরুণ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, দেবাঞ্জন ম্যাথমেটিকস ও স্ট্যাটিস্টিক্স। আর কনিষ্ক একটা নামি কলেজের কমার্সের ছাত্র। তিনজনের চোখেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন। উদ্যোগী মানুষের সামনে আজ বিরাট পৃথিবীর অগুনতি দরজা খোলা। দেশে হোক বা বিদেশে, ঠিক কোনও সম্ভাবনার রাজ্যে গিয়ে পৌঁছবে, এই বিশ্বাসে তারা কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে।
তার মানে এই নয় যে তাদের পড়াশোনার বাইরে কোনও আকর্ষণ নেই। কনিষ্ক খেলাধুলা ভালোবাসে, অরুণ গান আর তিনজনই গল্পের বইয়ের পোকা। আজ সন্ধ্যায় যেমন তিন জিগরি দোস্ত তিনটে গল্পের বই নিয়ে বসেছে, তার সঙ্গে চলছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা। আজকের আলোচনা শুরু হয়েছিল রূপকথা নিয়ে।
“আশ্চর্যের ব্যাপার কী জানিস!” বলছিল দেবাঞ্জন, “এইসব ফেয়ারি টেল বা রূপকথা ছোটোদের জন্য লেখা হলেও তাতে এমন সব নিষ্ঠুর ঘটনা রয়েছে, যা ছোটোদের উপযুক্ত নয়। যেমন ধর, সিন্ডেরেলা গল্পে দুষ্টু বোনেদের চোখ পায়রা ঠুকরে তুলে ফেলল, আমাদের রূপকথায় দুষ্টু সুয়োরানিকে হেঁটে কাঁটা, মাথায় কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলা হল অথবা আরব্য উপন্যাসে মর্জিনা সাঁইত্রিশ দস্যুকে গরম তেলে পুড়িয়ে মারল।”
“এইজন্য তো আজকাল এইসব গল্পের একটু ভব্য রূপ বা ‘স্যানিটাইজড ভার্শন’ বাজারে ছাড়া হচ্ছে।” বলল অরুণ।
“কিন্তু এর সবটাই নির্ভর করে যুগ বা কালের ওপর। যখন গল্পগুলি লেখা হয়েছিল তখন হয়তো সমাজ যা ছিল তাতে ওই নিষ্ঠুরতাগুলি বাড়াবাড়ি কিছু মনে হত না। এখন হয়।”
ব্যস, এরপর কীভাবে যেন আলোচনা চলে গেল বিভিন্ন কালের তুলনায় আর তার থেকে টাইম ট্র্যাভেল বা কালযাত্রায়। দেবাঞ্জন ওয়ার্ম হোল ইত্যাদি উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছিল, কালযাত্রা বিজ্ঞানসম্মত ধারণা। অরুণের পালটা যুক্তি, এটা এখন অবধি স্রেফ বিজ্ঞান কল্পনা। আর যদি কালযাত্রাকে বাস্তবে রূপ দেওয়াও যায় তবে তা হবে সেকেন্ডের এক ভগ্নাংশের জন্য, যাতে কোনও কাজের কাজ হবে না। তাছাড়া অতীত যাত্রা যদি-বা সম্ভব হয়, যা ঘটেনি সেখানে যাওয়া একেবারেই অবাস্তব। কনিষ্কর অবশ্য ধারণা, বিজ্ঞান এগিয়েই চলেছে। আজ যেটা অবাস্তব, কাল হয়তো সেটা প্রযুক্তির আওতায় এসে যাবে।
এইসব মনোজ্ঞ আলোচনায় মেতে কেউ খেয়াল করেনি কখন একটা দমকা ঝড় ছেড়েছে আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে সঙ্গে কারেন্টও গেল চলে। সাধারণত ঝড় এলেই বিদ্যুৎ বিভাগ দুর্ঘটনা এড়াতে ঝড় না থামা অবধি বিজলি বন্ধ রাখে। সবারই বাড়ি কাছে, তবু অন্ধকারে এই ঝড়বাদল মাথায় করে ফেরা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই বাড়িতে ফোন করে চিন্তা করতে বারণ করে তারা আবার আলোচনায় ফিরে গেল। ইতিমধ্যে লাইব্রেরিতে ব্যাক-আপ ইনভার্টারের আলো জ্বলে উঠেছে। একমাত্র এল.ই.ডি টেবল ল্যাম্পগুলোই ইনভার্টারে জ্বলে। ভরসন্ধ্যায় তার মৃদু আবছায়ায় তিন বন্ধু আবার আলোচনায় ডুবে গেল।
কড়-কড় করে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এই দুর্যোগে কে লাইব্রেরিতে এল? কনিষ্ক দরজা খুলল। এক অপরিচিত মধ্যবয়সি পুরুষ বাইরে দাঁড়িয়ে। সুঠাম, বলদৃপ্ত চেহারা। আবছা আলোয় বোঝা শক্ত কোন দেশ বা প্রদেশের অধিবাসী। তবে পোশাক দেখে সন্দেহ হয়, উত্তর ভারতের কোনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ।
“ভেতরে আসতে পারি কি?” একটু বিচিত্র অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে বললেন তিনি।
“আসুন, আসুন।” কনিষ্ক বলল, “বাইরে যা চলছে, তারপর কারেন্টও নেই।”
ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলে কনিষ্ক দরজা আবার বন্ধ করে দিল। উনি কুণ্ঠিতভাবে একটা চেয়ার টেনে বসলেন।—“আপনাদের ডিস্টার্ব করলাম।”
“না না, আমরাও বৃষ্টিতে আটকে পড়ে আড্ডাই মারছিলাম। আপনি কি বড়ো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন?” অরুণ জিজ্ঞেস করল। ওদের ক্লাব লাইব্রেরিটা একটা হাইওয়ের ঠিক পাশের একটা গলির মধ্যে।
“আমি অনেক দূর থেকে আসছি।” উদাস ভঙ্গিতে বললেন ভদ্রলোক, “হঠাৎ এখানে…”
“ঝড়বৃষ্টি দেখে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন? তারপর ক্লাবঘরটা দেখতে পেয়ে… তা, ভালোই করেছেন। এই আবহাওয়ায় বাইরে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়, তারপর যেমন বাজ পড়ছে। কিন্তু আপনার বাহনটিকে কোথায় রাখলেন?”
“ও নিয়ে ভাববেন না। সেটি একটি গাছতলায় নিরাপদে আছে।”
ওরা নিশ্চিন্ত হল। দেবাঞ্জনের অবশ্য মনে পড়ল, সে কোনও গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায়নি। হাইওয়ের গাড়ির শব্দ শুনতে শুনতে ওদের কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গলিতে গাড়ি ঢুকলেই শব্দ শুনে বুঝতে পারে কোন ব্র্যান্ড। এই আগন্তুকের গাড়িটি নিশ্চয়ই খুব দামি, প্রায় নিঃশব্দে চলে। তাই তার আওয়াজ বাজ আর বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কানে আসেনি।
“আপনারা বুঝি গল্পের বই খুব ভালোবাসেন?” টেবিলের ওপরে ছড়ানো বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন ভদ্রলোক, “তবে যে শুনেছিলাম, এখন ইয়ংম্যানরা আর এসব ছোঁয় না?”
“খুব ভুল শোনেননি।” দেবাঞ্জন বলল, “কাজকর্ম, পড়াশোনার চাপে ছেলেমেয়েরা সময় পায় না, পেলেও সিনেমা দেখে গল্পের খিদে মেটায়। কেন, আপনিও বুঝি গল্প ভালোবাসেন?”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভদ্রলোক বললেন, “উপায় কী? আমার জীবনটাই তো একটা গল্প হয়ে গেছে। তাও অসমাপ্ত গল্প।”
কনিষ্কের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, “হ্যাঁ, আপনাকে দেখেই মনে হয় গায়ে একটা ইন্টারেস্টিং গল্প লেপটে আছে। আকাশের যা অবস্থা, ঘণ্টা খানেকের আগে বৃষ্টি ধরবে না। ততক্ষণ যদি কাইন্ডলি ওই যা বললেন, আপনার জীবনের গল্পের কিছুটা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন। অবশ্য আমরা অপরিচিত, তাতে অসুবিধা না হলে।”
“না, তা নয়। তবে আমি তো পুরোনো আমলের লোক, আমাদের সময়কার গল্প কি আপনাদের আসরে জমবে? তাই যদি গল্পটাকে একটু বদলে আপনাদের জমানার ছকে এনে বলি, তাহলে কি অসুবিধে হবে?”
“অসুবিধে কীসের? বরং প্রস্তাবটা বেশ অভিনব মনে হচ্ছে। আমাদের সাসপেন্সে না রেখে এবার শুরু করে দিন। আর ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না।” অরুণ বলল।
“বেশ।” আগন্তুক বললেন, “তবে আবার বলছি, এ-গল্পের শেষটা কিন্তু আমারও জানা নেই। হয়তো আপনাদেরই তৈরি করে নিতে হবে।
“প্রথমেই পরস্পরের পরিচয় বিনিময়টা একটা প্রথা। কিন্তু…”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি দেবাঞ্জন, ও কনিষ্ক আর ওইদিকে অরুণ। আমরা…”
“বুঝতে পেরেছি, খুব মনোযোগী ছাত্র। তবে পাঠ্যের বাইরের পৃথিবীর থেকেও আপনারা মুখ ফিরিয়ে নেননি। কিন্তু আমি দুঃখিত, গল্পটা যেহেতু নতুন ছকে ঢেলে বলছি তাই আমার আসল নামধাম এখনই বললে মজাটাই মাটি হয়ে যাবে। বরং গল্পে আমার যে নাম সেটাই বলি, রাহীল। আমি বড়ো হয়েছি এক ছোট্ট শহরে, যার আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ছবির মতো সুন্দর। কিছু দূরেই এক পাহাড়ি উপত্যকা, যার গা ঘন সবুজে ঢাকা। পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসছে এক খরস্রোতা নদী আর অজস্র ঝরনা।
“এই শান্ত প্রকৃতির ছায়াতেও কিন্তু মানুষের মনে স্বস্তি নেই। ওই দুর্গম পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে আছে মহা উপদ্রব, এক মাফিয়া দল। তারা ডাকাতের মতো সরাসরি লুটপাট করে না, কিন্তু গোপনে নিষিদ্ধ মাদকের ব্যাবসার সাহায্যে কিশোর-যুবকদের সর্বনাশ করে। আর ইদানীং নেট ব্যাঙ্কিং চালু হবার পর নাকি তারা কৌশলে স্থানীয় অধিবাসীদের তথ্য চুরি করে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে একটু একটু করে টাকা সরাচ্ছে। পুলিশ তাদের ছুঁতেও পারে না। কেউ জানে না কোথায় তাদের লুকোনো ডেরা। আবার কেউ বলে, পুলিশ জেনেও কিছু করে না। তলায় তলায় মাফিয়াদের সঙ্গে নাকি তাদের একাংশের যোগসাজস আছে। মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যও তাই অবাধ।
“ভালোমন্দে মেশানো এই শহরেই জীবন কাটছিল আমার ও আমার পরিবারের। আমার বাবা ছিলেন একজন ছোটো ব্যবসায়ী। বিভিন্ন জিনিসের লেনদেন করতেন, বাড়ির এক অংশে একটা ছোটো মনোহারি দোকানও দিয়েছিলেন। আমরা ছিলাম দু ভাই—আমি বড়ো ভাই রাহীল আর ছোটো ভাই কাবিল। কাবিল ছিল পড়াশোনায় তুখোড়। ভালো রেজাল্ট করা ছাড়া কোনোদিকে তার মন ছিল না। আর আমার পড়াশোনায় বিশেষ আকর্ষণ ছিল না। আমার ঝোঁক ছিল হাতের কাজে আর ভালোবাসতাম প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়াতে; একটা মাউথ অর্গান হাতে নিয়ে পাহাড় জঙ্গল চষে বেড়াতে। ওখানে নাকি মাফিয়াদের ডেরা আর ওই সুবিস্তীর্ণ জঙ্গলের কোথাও কোথাও নাকি চলে তাদের নিষিদ্ধ ড্রাগের চাষ। তাই বাড়ির সবাই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত, কবে আমি ওই দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ি। তবে ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমার কখনও তেমন দুর্ভাগ্য হয়নি।
“লেখাপড়ায় অমনোযোগী আমি কলেজে উঠে কোনোমতে একটা ডিগ্রি জোগাড় করলাম। তারপর ও-লাইনে আর কিছু হবে না বুঝতে পেরে যাতে আমার কিছু এলেম ছিল সেই হাতের কাজে মন দিলাম। প্রথমে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল সারিয়ে টুকটাক রোজগার করতে লাগলাম। আমার ভাই কাবিল ওদিকে টপাটপ একটার পর একটা পরীক্ষা পাশ করে একটা কর্পোরেট সংস্থায় ভালো মাইনের চাকরি নিয়ে ঢুকল। এই সময় আমার বাবা মারা গেলেন। কাবিলই উদ্যোগ নিয়ে সম্পত্তি-টম্পত্তি দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করল, আমি শুধু তার কথামতো সইসাবুদ করলাম। ফলে ক’বছরের মধ্যে দেখা গেল, আমি আমাদের পুরোনো, ভাঙাচোরা পৈতৃক বাড়িতে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছি আর কাবিল বাবার সব টাকা গাপ করে শহরের কেন্দ্রে বিশাল ফ্ল্যাট কিনে সপরিবারে রাজার হালে বাস করছে। স্বাভাবিকভাবেই আমির ভাই গরিব দাদাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখতে লাগল।
“শেষে আমি পরিবার চালানোর তাগিদেই অনেক চেষ্টায় একটা চলনসই চাকরি জোগাড় করে ফেললাম। কম্পিউটার সারাতে সারাতে সফটওয়্যার ব্যাপারটাও কিছুটা শিখে ফেলেছিলাম। তারপর দু-একটা কোর্স করে সেগুলো দেখিয়ে ধরাকরা করে একটা সাময়িক চাকরি পেলাম, যাকে বলা চলে সাইবার পুলিশের কাজ।
“কী বন্ধুরা, গল্পটাকে আপনাদের জমানার উপযোগী করে তুলতে পারছি তো?”
“একদম, আঙ্কল। আপনি চালিয়ে যান।” তিন বন্ধু সমস্বরে বলে উঠল।
“বেশ। তবে ওসব আঙ্কল-ফাঙ্কল থাক, স্রেফ রাহীল বলুন। আমিও নয় আপনাদের নাম ধরেই ডাকব।”
“ঠিক আছে, রাহীল। গল্প জমে উঠেছে, বলুন।”
“আমার কাজ ছিল আমার কাছে কোম্পানি যেসব সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টিং পাঠাত, তার মধ্যে আপত্তিজনক কিছু থাকলে সেগুলোকে চিহ্নিত করে কোম্পানিকে জানানো। এই কাজ করতে করতে আমি মাঝে মাঝে গন্ধ পেতাম কেউ সংকেতে গোপন মেসেজ পাঠাচ্ছে। ব্যাপারটার পেছনে বেআইনি কিছু আছে সন্দেহ হলে সেটা সিভিক পুলিশকে জানানোর কথা। কিন্তু তাতে অনেক ঝামেলা। স্রেফ ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির জন্যও অনেকে অমনটা করে থাকে। নির্দোষ কাউকে শুধু সন্দেহের বশে হয়রান করা তো উচিত নয়। তাই আমরা বেশ কিছুদিন সেই লিডগুলি ফলো করতাম। বেআইনি কিছুর সন্দেহটা খুব জোরালো হলে তবেই পুলিশে জানাতাম।
“এইভাবে একটা লিড ফলো করতে করতে আমি হঠাৎ একটা বড়োসড়ো ব্রেক-থ্রু করে ফেললাম। প্রথমে সন্দেহ, তারপর নিশ্চিত হলাম যে লিডটা আসলে ওই কুখ্যাত মাফিয়া দলের! তক্ষুনি পুলিশকে ব্যাপারটা জানানো দরকার। কিন্তু তখনই মনে পড়ল স্থানীয় জনশ্রুতি, মাফিয়াদের সঙ্গে পুলিশের একাংশের তলায় তলায় যোগসাজশ আছে। আমার মাথায় এক দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। ভাবলাম, আমি নিজেই সাইবার গোয়েন্দাগিরি করব। তারপর একটা সময় যখন দলটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার মতো তথ্য আমার হাতে আসবে, স্থানীয় পুলিশকে ডিঙিয়ে সোজা ওপরমহলে ব্যাপারটা জানাব।
“কোম্পানির দায়িত্ব পালনের সৎ উদ্দেশ্যেই আমরা মাঝে মাঝে বাঁকাচোরা পদ্ধতির আশ্রয় নিতে দ্বিধা করতাম না। এইভাবে ‘হ্যাকিং’ জিনিসটা আমার কিছুটা সড়গড় হয়েছিল। এই বিদ্যা প্রয়োগ করে ওই কেসটায় আমি তরতরিয়ে এগোতে লাগলাম। আর শেষ অবধি যেখানে পৌঁছলাম সেটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। বুঝলাম, আমি মাফিয়াদের অন্দরমহলের অনেক গোপন তথ্য জেনে গেছি। তাদের একটা সাইটে লগ-ইন করতে যে পাসওয়ার্ড লাগে সেটা আমি হ্যাক করে ফেললাম। মনে হল, সেখানে তাদের গতিবিধি ও ধনসম্পদ সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু কাজটা করার আগে আমি থমকে গেলাম। হঠাৎ মনে হল, এটা একটা ট্র্যাপ নয়তো? বেশ, আর একটু সুলুকসন্ধান করা যাক। করতে গিয়ে আমি একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করলাম। ওই সাইটের দুটো পাসওয়ার্ড আছে—একটা ঢোকার, একটা বেরিয়ে আসার জন্য।
“প্রথমটা তো বোঝা গেল, দ্বিতীয়টা কী? একটু পরীক্ষানিরীক্ষা করে বুঝলাম, ওই পাসওয়ার্ডটা যারা জানে তারা ওই সাইট থেকে নিয়মমাফিক লগ-আউট করতে পারবে আর তার ফলে যে লগ-ইন করেছিল তার পরিচয়চিহ্ন সিস্টেমে থাকবে না। অনেক ভেবে বুঝলাম, এই মাফিয়ারা খুব ঘনিষ্ঠ কিছু স্যাঙাতদের এক গ্রুপ, যাদের পরস্পরের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস। তারা চায় কে কখন লগ-ইন করছে সে ব্যাপারে তাদের প্রাইভেসি অটুট থাকুক। আর বাইরের কেউ যদি বেরোবার পাসওয়ার্ড না জেনে দৈবাৎ হ্যাক করে ওই সাইটে ঢুকে পড়ে, তবে সে নিয়মমতো লগ-আউট করতে পারবে না। ফলে তার অস্তিত্ব গ্যাংয়ের কাছে ধরা পড়ে যাবে। একটা সময়ের বেশি ওই সাইটে কেউ থাকলেও তক্ষুনি ওদের কাছে অ্যালার্ট চলে যাবে।
“লগ-আউট পাসওয়ার্ডটার গোপনীয়তার ব্যাপারে ওরা খুব হুঁশিয়ার ছিল। কিন্তু অতি হুঁশিয়াররাও কখনও কাঁচা ভুল করে বসে। আমি দিনের পর দিন ওদের আই.পি অ্যাড্রেস আর কী-স্ট্রোক ট্রেস করে শেষ অবধি অমন একটা ভুলের সুযোগ নিয়ে ওই পাসওয়ার্ডটাও ক্র্যাক করলাম। কয়েকবার কিছু না করে স্রেফ ঢুকে আর বেরিয়ে এসে নিশ্চিত হলাম, ওরা আমার অস্তিত্ব টের পায়নি। তারপর আমি ধাপে ধাপে এগোতে লাগলাম আর একদিন ওদের এক গোপন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টেরও খোঁজ পেয়ে গেলাম।
“আবার দ্বিধায় পড়লাম। কিন্তু যখন আমার আর্থিক দুরবস্থা আর ভাই কাবিলের বোলবোলাওয়ের কথা মনে পড়ল, শেষ অবধি লোভই জয়ী হল। পুলিশে খবর না দিয়ে আমি একটু একটু করে ওই বিশাল ভাণ্ডার থেকে টাকা সরাতে লাগলাম। ফেক অ্যাকাউন্ট, প্রক্সি সার্ভার, আরও নানা চালাকি তদ্দিনে শিখে ফেলেছি। তাই মাঝে মাঝে সন্দেহ হলেও ওরা আমাকে ধরতে পারেনি।”
“ওরা পাসওয়ার্ড বদলায়নি?” অরুণের উত্তেজিত জিজ্ঞাসা।
“বদলেছে দু-একবার। কিন্তু তখন আমি এতটা ভেতরে ঢুকে গেছি যে সেসবও জেনে যেতাম। যাই হোক, ওই চোরের ওপর বাটপাড়ির টাকা আমি ধীরে ধীরে একটা গোপন অ্যাকাউন্টে জমাতে লাগলাম। যথাসাধ্য দেখনদারি এড়িয়ে চলতাম, যাতে আমার এই হঠাৎ ধনলাভ কারও চোখে না পড়ে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সঞ্চয়টা এত বেশি হয়ে গেল যে সামলাতে পেশাদার কারও সাহায্যের দরকার হয়ে পড়ল। আমার ভাই কাবিল পেশাগত সূত্রে একটা কনসালটেন্সি ফার্মের সঙ্গে যুক্ত। ওকে ফোন করে একজন সি.এ-র হদিস চাইলাম।
“ ‘সি-এ দিয়ে কী করবি? তোর যা রোজগার তাতে তো ট্যাক্সও দিতে হয় না।’
“ ‘সেইজন্যই।’ ঢোঁক গিলে বললাম, ‘একটা বড়ো কাজ উতরে দিয়ে একটা মোটা বোনাস পেলাম কিনা। তাই কীভাবে ইনভেস্ট করলে সবদিক দিয়ে সুবিধে…’
“ ‘হুম।’ একটু সন্দিগ্ধ মনেই কাবিল একটা নাম আর নম্বর জানাল।
“আর সেখানেই কপালটা পুড়ল। লোকটা পেশাদারি দক্ষতায় কীভাবে টাকাগুলো রাখলে আমার সুবিধে হবে আর ট্যাক্স কর্তৃপক্ষেরও নজরে পড়ব না সেসব পরামর্শ দিল। কিন্তু কাবিল তার একজন বড়ো ক্লায়েন্ট। কাবিলের চাপের কাছে সে পেশাগত গোপনীয়তা বজায় না রেখে আমার টাকার পরিমাণটা বলে দিল। পরদিনই কাবিল ড্রাইভ করে এল আমার বাড়িতে।
“ ‘কী সৌভাগ্য, গরিব ভাইয়ের বাড়িতে আবার তোর পা পড়ল।’
“ ‘গরিব!’ কাবিল চারদিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাড়ির হাল তো দেখছি বেশ ফিরিয়ে দিয়েছিস।’
“ ‘কোথায়! স্রেফ একটু মেরামত আর রঙ করিয়েছি।’
“ ‘তার অনেক বেশিই।’ ভাই বলল, ‘তবে এসবের কী দরকার ছিল? তোর এখন যা রমরমা, তুই তো বড়ো শহরে বাড়ি কিনে থাকতে পারিস।’
“ ‘কী যে বলিস! বলেছি তো, স্রেফ একটা বোনাস পেয়েছি।’ এড়াবার চেষ্টা করলাম।
“ ‘দ্যাখ, আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। সত্যি করে বল কী ধান্দা করছিস। নইলে উপযুক্ত জায়গায় ঠিক খবর চলে যাবে।’
“ওর চাপের সামনে বাধ্য হয়ে ওকে ব্যাপারটা খুলে বললাম। তারপর বললাম, ‘প্লিজ ভাই, কাউকে বলিস না। তোকে নয় আধাআধি বখরা দেব।’
“ ‘তোকে বিশ্বাস কী? ওসব না, তুই আমাকে সাইটের অ্যাড্রেস আর পাসওয়ার্ডটা দে। বাকিটা আমি বুঝে নেব।’
“কত বোঝালাম—‘দ্যাখ, ব্যাপারটা খুব রিস্কি। আমরা অনেকদিন এ-লাইনে কাজ করছি, তাই কী করে গা বাঁচিয়ে চলতে হয় সেসব ঘাঁতঘোত জানি। তুই পারবি না, ওরা জেনে যাবে।’
“ ‘আমি ঠিকই বুঝব।’ ওর সেই এক গোঁ। শেষে বাধ্য হয়ে ওকে সাইটের অ্যাড্রেস আর পাসওয়ার্ড দুটো লিখে দেখালাম। বললাম, ‘এগুলো কোথাও লিখবি না, মুখস্থ করে নে।’
“ ‘ঠিক আছে।’ বলে ও দেখি সাইটের অ্যাড্রেসটা ভালো করে দেখে একটু হেসে তারপর লগ-ইন পাসওয়ার্ডটা মনে মনে আওড়াচ্ছে।
“বললাম, ‘বেরোবার পাসওয়ার্ডটাও মনে রাখ। আর লগ-ইন করে পনেরো মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসবি। নইলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
“ ‘শিওর।’ আত্মবিশ্বাসী কাবিল বলল, ‘তুই চিন্তা করিস না, আমি সহায়হীন নই। কোনও বিপদ এলে তার মোকাবিলার ক্ষমতা আমার আছে।’
“মানল না আমার হুঁশিয়ারি। তারপর একদিন সন্ধ্যায় ফোনে শুনলাম ওর কাঁপা কাঁপা স্বর, ‘দাদা, কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। আমি লগ-ইন করে কিছু টাকা সরিয়েছিলাম। তারপর আবার সরাতে যাবার সময় একটা অ্যালার্ট এল।’
“ ‘সর্বনাশ! এক সেশনে আমি কখনও দু-বার টাকা তোলার চেষ্টা করিনি। নিশ্চয়ই টাইম আউট হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি লগ-আউট করেছিস তো?’
“ ‘ন্-না। তবে আমি আমার মেশিন চট করে শাট ডাউন করে দিয়েছি। ওরা জানতে পারবে না।’
“ ‘ওরা ইতিমধ্যে তোর আই.পি অ্যাড্রেস জেনে গিয়েছে। তুই বরং সেটা আমাকে এক্ষুনি পাঠিয়ে দে, দেখি ওরা তোর হদিস পাওয়ার আগে এটা-সেটা করে ব্যাপারটা ঘেঁটে দিতে পারি কি না। আপাতত তুই ওই লাইনটা আর ব্যবহার করিস না। আর আমি অল ক্লিয়ার দেওয়ার আগে ক’দিন কোথাও গা ঢাকা দে।’
“ ‘ছাড়, অত প্যানিক করার কিছু হয়নি।’ কাবিল আমার কথা উড়িয়ে দিল, ‘আমাদের সিস্টেম ম্যানেজার ঘাগু লোক, তাকে জানাচ্ছি। আর আমি ইমিডিয়েটলি সিকিউরিটি নিচ্ছি, ওরা আমার একটা চুলও ছুঁতে পারবে না।’
“আমার আর কিছু করার ছিল না, অপেক্ষা করা ছাড়া। তিনদিন পর খবর পেলাম, কাবিলকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর পান খাওয়ার অভ্যেস ছিল। বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে একজন সিকিউরিটি গার্ডকে নিয়ে নেমেছিল। তারপর আর কাবিলকে দেখা যায়নি, সেই গার্ডকেও নয়।
“কাবিলের বাড়িতে ছুটে গেলাম। সেখানে সবাই উদ্বিগ্ন। তবে মনে হল কাবিল ব্যাপারটা আর কাউকে বলেনি। তাদের আশ্বস্ত করে বললাম, ‘পুলিশ তো চেষ্টা করছেই। আমিও দেখছি। ঠিক কিছু হদিস মিলবে।’
“বললাম তো, কিন্তু কাবিলকে কি আর জীবিত পাওয়া যাবে? অনেক ভেবে মনে হল, যেতে পারে, তবে হাতে আর সময় নেই। এই মাফিয়ার দলের কুকাজ অজস্র, কিন্তু খুনখারাপির দিকে তারা বিশেষ যায় না। হয়তো ওই বাড়াবাড়িটা করে কেন্দ্রীয় পুলিশের নজর কাড়তে চায় না বলে।
“তাহলে হয়তো ওরা ভাইকে এখনও ধরে রেখেছে। এই আশায় আমি মাফিয়াদের ডেরা বলে পরিচিত সেই পাহাড়ে অভিযানে বেরোলাম। নিলাম এক গরিব গ্রামবাসীর ছদ্মবেশ আর পিঠের ঝোলায় রইল নানা দরকারি টুকিটাকির সঙ্গে একটা লোডেড রিভলভার।
“ওই পাহাড়ের পথঘাট আমার নখদর্পণে। ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় দিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। মাফিয়ার ডেরায় নয়, ভাইকে পেলাম জঙ্গলের মধ্যে, অজ্ঞান অবস্থায়। অনেক কষ্টে পাহাড়ি পথ বেয়ে তাকে কাঁধে করে শহরে নিয়ে এলাম, তারপর আমাদের বাড়ি।
“অনেক চেষ্টায় তার জ্ঞান ফেরালাম। গরম দুধ-টুধ খেয়ে সে একটু চাঙ্গা হল। ধীরে ধীরে নড়াচড়া, হাঁটাচলার মতো অবস্থায় ফিরল। বুঝলাম, দুর্বৃত্তরা তাকে বেহুঁশ করে ফেলে রেখে গিয়েছিল, যাতে এক সময় তার মৃত্যু হয় আর পরে দেহটা আবিষ্কার হলে মনে হয় যেন বেশি নেশা করে জঙ্গলের রাস্তায় পড়ে থাকতে থাকতে মারা গেছে। খোঁজ পেতে আর একদিন দেরি হলে তাকে আর বাঁচানো যেত না।
“কাবিল শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও কিন্তু শিগগিরই বোঝা গেল যে ঘটনার ধাক্কায় তার মানসিক বিপর্যয় ঘটেছে। কথা বলছে না, কাউকে চিনতে পারছে না, শুধু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার দরকার। আমি নিলোফারকে ডাকলাম।
“আগেই বলেছি, বাবার একটা ছোট্ট দোকান ছিল। বাবার মৃত্যুর পর সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার যখন আবার দু-চার পয়সা আসতে শুরু করল, আমি ওটাকে একটু একটু করে চালু করলাম। সম্প্রতি অবশ্য কাবিলের পাঠানো সি.এ আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল, দোকানের বদলে ধীরে ধীরে অনলাইন ডিস্ট্রিবিউশনে সরে আসতে। ওতেই নাকি আজকাল সুবিধা আর লাভও বেশি।
“দোকানটা আমার ছেলে রোহণ চালাত, সাহায্যের জন্য নিলোফারকে রেখেছিলাম। আমাদের অনেক টুকিটাকি কাজও সে করে দিত। মেয়েটির শিক্ষাগত যোগ্যতা মাঝামাঝি, কিন্তু সে খুব বুদ্ধিমতী আর করিৎকর্মা। অনলাইন বিজনেসেও তাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারটা আমার চিন্তায় ছিল।
“নিলোফার ব্যাপারগুলি জানত। সে সব শুনে বলল, ‘কিন্তু মাফিয়ারা নিশ্চয়ই কাবিল ভাইয়ের দেহটা না পেয়ে বুঝেছে তাকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। ভাই নামি লোক। তার কোনও ‘খবর’ হলে সেটা শহরে চাউর হবার কথা। তা যখন হয়নি তখন ওরা বুঝবে তার দোসর আরও কেউ ছিল যে ভাইকে পেয়ে নিয়ে গেছে, কিন্তু খবরটা চেপে গেছে। এখন ওরা তার খোঁজ করবে। ওরা আরও জানে, ভাইয়ের যা শারীরিক অবস্থা তাতে ডাক্তারের দরকার হবে। তাই ওরা নজর রাখবে শহরের নামি ডাক্তারদের ওপর। তারপর তার কাছ থেকে আপনার হদিস বের করবে।’
“ ‘কিন্তু সেটা কি ওরা কাবিলের কাছ থেকে পায়নি?’
“ ‘তাহলে ওরা ইতিমধ্যে এখানে চড়াও হত। নিদেনপক্ষে খোঁজখবর করত।’
“বললাম, ‘হুঁ, তা যখন করেনি, মনে হয় ওরা একটু গোলমাল করে ফেলেছে। শুনেছি ওরা বন্দিদের একটা ওষুধ খাইয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করে। ডোজটা হয়তো কাবিল সহ্য করতে পারেনি, তাই ওর এই হাল। ফলে ওর থেকে আর কোনও খবর পাওয়ার আশা নেই বুঝে মাফিয়ারা তাকে ফেলে রেখে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের পরিচয় গোপন রেখে ডাক্তারকে আনবে কীভাবে?’
“ ‘সেটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।’
“নিলোফারের শান্ত স্বর আমাকে ভরসা জোগাল। বললাম, ‘বেশ। তবে রোহণকেও সঙ্গে নিও।’
“পরের দিনই ওরা মেডিসিন স্পেশালিস্ট ড. কুরেশিকে নিয়ে এল। তিনি নাকি ড্রাগ কেসের চিকিৎসায়ও বিশেষ পারদর্শী। তাঁকে বলা হয়েছে, একজন মানী লোক ভুল করে ড্রাগ নিয়ে ফেলেছে। এতে যাতে পুলিশ কেস বা লোক জানাজানি না হয় তাই তাঁকে গোপনে আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে আসা হয়েছে। গাড়িতে উঠিয়ে নিলোফার ডাক্তারের চোখ বেঁধে দেওয়ায় তিনি পথঘাট দেখতে পাননি। কিন্তু তাঁর সব আপত্তিই নিলোফার থামিয়ে দিয়েছে মোটা অঙ্কের ফি কবুল করে।
“কাবিলকে দেখে ড. কুরেশি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ডোজ বড্ড বেশি নিয়ে ফেলেছে। চট করে সারার নয়। তবে কয়েকটা ওষুধ দিচ্ছি, নিয়মিত খাওয়াতে হবে। তারপর ঈশ্বরের ইচ্ছা।’
“মোটা ফি দিয়ে ডাক্তারকে আবার একইভাবে ফেরত পাঠানো হল। কাবিলের চিকিৎসা চলতে লাগল, কিন্তু চট করে কোনও ফল পাওয়া গেল না।
“কিছুদিন পর রোহণ এসে বলল, ‘বাবা, খারাপ খবর। বোধহয় মাফিয়াদের একজন ড. কুরেশির চেম্বারে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে।’
“বললাম, ‘জানলি কী করে?”
“ ‘আমি ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্টকে ফিট করেছি। সে আমাকে নিয়মিত খবর দিচ্ছে।’
“ ‘চিন্তার ব্যাপার। তবে ডাক্তার তো আর আমাদের হদিস দিতে পারবে না।’
“ ‘না। কিন্তু লোকটা ডাক্তারের কাছ থেকে সম্প্রতি কোনও ড্রাগ কেসের রোগী থাকলে তার তিনি কী প্রেসক্রিপশন করেছেন জেনে নিয়েছে। আর চাচাকে ডাক্তার এমন একটা ওষুধ দিয়েছেন যা খুব কম কেসেই ব্যবহার হয় আর খুব বেশি দোকানে মেলে না। তার খোঁজ করতে করতে লোকটা ওষুধের দোকান থেকে কে ওষুধটা কিনেছে বের করে ফেলতে পারে।’
“আমার বুক শুকিয়ে গেল। বললাম, ‘তাহলে উপায়?’
“মৃদু হেসে রোহণ বলল, ‘নিলোফার দেখছে।’
“সত্যিই তাই। মেয়েটি বেশ কয়েকজন গরিব মানুষকে কিছু টাকা দিয়ে ওই প্রেসক্রিপশনে বিভিন্ন দোকান থেকে ওই ওষুধটা তোলাল। পরে খোঁজ পাওয়া গেল একজন লোক ওই দোকানগুলিতে এসে খোঁজ করে শেষে সম্ভবত এই পনেরো-বিশজন গ্রাহকের কে আসল মুজরিম বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে ফিরে গেছে।
“তাতেও ওরা হাল ছাড়ল না। আবার একজন এল আর ডাক্তারকে জেরা করে জানতে পারল যে রোগী পরীক্ষার সময় তাঁর চোখে পড়েছিল বাড়ির সামনে একটা মাঝারি সাইজের আখরোট গাছ আছে। আবার চিন্তায় পড়লাম। আখরোট গাছ আমাদের রাজ্যে অনেক হয়, তবে তার বেশিরভাগই পাহাড়ি এলাকায়। জনবসতির মধ্যে এই গাছ তত নেই, আমাদের এলাকায় তো নয়ই। আমাদের বাড়ির গাছটা এক বিরল ব্যতিক্রম। যে জনা পনেরো ওষুধটা কিনেছে তাদের মধ্যে কার বাড়ির সামনে আখরোট গাছ আছে দেখলেই ওরা বুঝতে পারবে ওদের আসামি কে। কিন্তু এবারেও আমাদের বাঁচাল নিলোফারের বুদ্ধি।”
“সে বুঝি ওই লিস্টের সবক’টা বাড়ির সামনেই একটা করে আখরোট গাছ বসিয়ে দিল?”
“রাহীল হাসলেন।—‘অত আখরোট গাছ খুঁজে এনে রাতারাতি বসানো কি সহজ কথা? ও তার চেয়ে সহজ কাজটা করল।’ ”
“গাছটা কেটে ফেলল?”
“ ‘না, তাহলেও চিহ্ন থেকে যাবে। তাছাড়া আমরা সবাই বৃক্ষপ্রেমিক। তাই ও কিছু লোকজন জোগাড় করে গাছটা চুপিসারে তুলে ফেলে আমাদের মিউনিসিপালিটির অফিসের সামনে পুঁতে দিয়ে এল। ব্যস, কেল্লা ফতে!’ ”
কিছুক্ষণ কী ভাবার পর অরুণ বলল, “গল্পটা কি কোথাও শুনেছি?”
“হতেই পারে।” রাহীল মৃদু হেসে বললেন, “একজন বিখ্যাত লেখক বলেছিলেন, পৃথিবীতে যত গল্প আছে সব ইতিমধ্যে বলা হয়ে গেছে। কাজেই এখন যা লেখা হবে সেসব ওগুলিরই নতুন রূপ।”
“তুই থাম তো।” অধৈর্য কনিষ্ক বলে উঠল, “গল্প জমে উঠেছে। তারপর বলুন রাহীল, নিলোফার তাহলে এইভাবে আপনাকে মাফিয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল?”
“হ্যাঁ, তবে তখনকার মতো। গল্প অনেক বাকি।
“তারপর বেশ ক’মাস কেটেছে। কাবিল কিছুটা সুস্থ, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ কোনোদিন হবে কি না বলা শক্ত। মাফিয়ার ভয়ে একবার ভিজিটের পর ডাক্তারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করার সাহস হয়নি। কাবিলের বাড়িতেও কোনও খবর দিইনি। তারা অন্য সবার মতো জানে যে কাবিল নিখোঁজ। তবে এই দুর্দিনে আমি তাদের সাধ্যমতো সাহায্য করে যাচ্ছি।
“শেষ অবধি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে মাফিয়ারা সত্যিই আর আমার খোঁজ পেল না। আপাতত তাদের ভাণ্ডার থেকে টাকা সরানো বন্ধ রেখেছি। কিন্তু ইতিমধ্যে যে টাকা নিয়েছিলাম তার সদ্ব্যবহার করে একটা নতুন ব্যাবসা ধরেছি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। প্রথম প্রথম টুকটাক অর্ডার। তারপর একদিন একটা বড়ো অফার এল। একটা ফিল্ম কোম্পানি এখানে আউটডোর শুটিং করবে। তাদের তরফ থেকে ফোন করে জানতে চাওয়া হল ক্রুদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত, ট্রান্সপোর্ট, আরও নানা টুকিটাকি ব্যবস্থা আমরা করতে পারব কি না। কোম্পানিটা নতুন, কিন্তু তার পি.আর থেকে জানিয়ে দেওয়া হল সবকিছু সুষ্ঠুভাবে করতে পারলে টাকাটা সমস্যা হবে না।
“প্রাথমিক কথাবার্তার পর মোটামুটি কিছু ব্যবস্থা বন্দোবস্ত হল। সেই অনুযায়ী ওরা একটা মোটা অ্যাডভান্স পেমেন্টও করে দিল। তার ভিত্তিতে হোটেল বুকিং ইত্যাদি করে রাখলাম। তারপর একদিন ফিল্ম ডাইরেক্টর সোহম জানালেন যে তিনি এক সন্ধ্যায় শহরে আসছেন সাজসরঞ্জাম নিয়ে। পরদিন সকাল থেকে সাইটে কাজ হবে, সেখানে যন্ত্রপাতি সেট করে তাঁবু-টাবুও খাটানো হবে। শুধু এক রাতের জন্য যদি আমি তাঁর মালপত্রসুদ্ধ তিনটে ভ্যানের একটা নিরাপদ পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করে দিই তো খুব উপকার হয়।
“ ‘আপনি সোজা আমার বাড়ি চলে আসুন।’ তাঁকে জানালাম, ‘লাগোয়া মাঠে তিনটে ভ্যানের পার্কিং হয়ে যাবে। আর আপনি নয় আমাদের সঙ্গে ডিনার করে হোটেলে ফিরবেন।’
“উনি সানন্দে রাজি হলেন। নিলোফার আর রোহণের ওপর ভার রইল যাতে অতিথির আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি না হয়। যথাসময়ে সোহম এলেন। লম্বাচওড়া জোয়ান, অমায়িক, কথায় কথায় হো হো করে হেসে ওঠেন। আর তাঁর শাণিত চোখে সর্বদাই বুদ্ধি ঝলসাচ্ছে।
“ ‘আগে দু-একটা অ্যাড ফিল্ম করেছি।’ তিনি জানালেন, ‘তবে কাহিনিচিত্রের চেষ্টা এই প্রথম।’
“গল্প জমে উঠল। যেখানে তিনি শুটিং করবেন সেই পাহাড়ি এলাকা সম্বন্ধে আমি বিস্তর জানি। তাই তিনি সাগ্রহে সাইট সিলেকশন সম্বন্ধে আমার নানা পরামর্শ নিলেন। কিন্তু এই বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপের তলে তলে যে ভয়ংকর দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছিল সেটা পরে আমি নিলোফারের কাছ থেকে জেনেছি। মেয়েটির ভদ্রতাবোধ তুলনাহীন। তার মনে হল, পার্ক করা ভ্যানের ড্রাইভারদেরও খেয়ে যেতে বলা উচিত। সন্ধের আবছায়ায় তাই সে মাঠে গেল। ড্রাইভাররা তাদের সিটে নেই, হয়তো কোনও দরকারে আশেপাশে গিয়েছে। নিলোফার একটা ভ্যানের পাশে অপেক্ষা করতে লাগল আর তখন তার কানে কিছু টুকরো টুকরো কথা ভেসে এল, যা শুনে তার বুক হিম হয়ে গেল।
“ ‘উহ্, আর কতক্ষণ এই দমবন্ধ ভ্যাপসা আবহাওয়ায় বসে থাকতে হবে!’ ভ্যানের ভেতর থেকে ভেসে এল একটা স্বর।
“ ‘একটু সহ্য কর, আর বড়োজোর ঘণ্টা দুয়েক। তারপর বস এসে ডাক দিলেই…’ একজন উত্তর দিল।
“ ‘রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবক’টাকে কাত করে বেঁধেছেদে ডেরায় নিয়ে তুলব। ক’জন আছে রে বাড়িতে?’
“ ‘জনা বারোর বেশি নয়, বস খবর পাঠিয়েছে।’
“ ‘কোনও ব্যাপার নয়। আমরা তিন ডজন, তাছাড়া আমাদের সঙ্গের যন্ত্রপাতি দেখেই সবক’টা হাত তুলে ফেলবে। তারপর আমাদের ডেরায় নিয়ে গিয়ে…’
“ ‘এবার সব চালাকি শেষ! চোরের ওপর বাটপাড়ি—কোথায় মালকড়ি লুকিয়েছে সব বস বের করে ফেলবে। তারপর…’
“তাহলে এরাই সেই মাফিয়া দল, শেষ অবধি মুজরিমের হদিস পেয়েছে! ভ্যানগুলোতে বসে আছে আর শয়তানদের সর্দারটা গৃহকর্তার সঙ্গে খোশগল্প জুড়ে অপেক্ষা করছে। রাত একটু গভীর হলেই এসে সাকরেদদের ডাকবে আর তারা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাড়ির সবাইকে বন্দি করে ওই ভ্যানে তুলে তাদের ডেরায় নিয়ে যাবে।
“চরম বিপদে পড়েও নিলোফার কাণ্ডজ্ঞান হারাল না। সে নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে এসে ভেতর বাড়িতে গেল। গৃহস্বামী তখন অতিথি অর্থাৎ মাফিয়া ডনের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত। তাই সে ছোটো মালিক রোহণের কাছে গিয়ে চটপট ব্যাপারটা জানাল।
“রোহণের কেমিস্ট্রিতে অগাধ ফান্ডা। সে কিছুক্ষণ ভাবল, গুগল ঘাঁটল। তারপর গাড়ি নিয়ে চট করে বেরিয়ে গিয়ে সুপার মার্কেট থেকে কীসব যেন কিনে আনল। সবশেষে কীটনাশক, ফিনাইল আর কী একটা কেমিক্যাল একটা কীটনাশক স্প্রের যন্ত্রে ভরে সাবধানে নাড়িয়ে মিশিয়ে নিল। এভাবে তিনটে স্প্রেতে ওই তরল ভরা হল। তারপর নিলোফার, রোহণ আর একজন বিশ্বস্ত কাজের লোক বিন্নু মুখে মাস্ক পরে স্প্রে তিনটে নিয়ে সন্তর্পণে মাঠে পার্ক করা ভ্যানগুলির দিকে এগিয়ে গেল। জায়গাটা নিস্তব্ধ। রোহণের নির্দেশে তিনজন ভ্যানের কাছে এগিয়ে গিয়ে কার্গো হোল্ডের ফাঁকফোকর দিয়ে পাগলের মতো স্প্রে করতে লাগল।
“কিছুক্ষণ একটু শোরগোল, বিস্মিত চিৎকার। তারপর দরজাগুলো খোলার জন্য উন্মত্ত ঠেলাঠেলি শুরু হল। কিন্তু কারও যাতে সন্দেহ না হয়, ডন তাই সেগুলো বাইরের থেকে বন্ধ করে রেখেছিল। লোকগুলো দরজা ভেঙে বেরোবার আগেই তাদের দম ফুরিয়ে গেল আর একটু পরে ভেতরে আর কোনও নড়াচড়ার শব্দ শোনা গেল না।”
“কী সর্বনাশ!” কনিষ্ক বলল, “রোহণ আর নিলোফার লোকগুলোকে মেরে ফেলল? এতগুলো লাশ করল কী?”
“রাহীল মৃদু হেসে বললেন, ‘না। ডাকাতগুলো শুধু নির্গত গ্যাসের প্রভাবে অসাড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল। কপাল ভালো, গাড়ির চাবি গাড়িতেই লাগানো ছিল। বোধহয় যে ড্রাইভাররা ভ্যানগুলি চালিয়ে এনেছিল, তারা মাফিয়া দলের নয়। তাই অপারেশন সফল হলে তিনজন ডাকাতই আমাদের নিয়ে ভ্যান ড্রাইভ করে নিয়ে যেত। তার জায়গায় এখন নিলোফার, রোহণ আর বিন্নু ভ্যানগুলোকে চালিয়ে শহরের এক নির্জন জায়গায় রেখে এল। তারপর একটা পাবলিক বুথ থেকে ফোন করে নগরপালকে জানিয়ে দিল যে ওই জায়গায় কিছু ডাকাত অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
“এত তাড়াতাড়ি ঘটনাগুলি ঘটে গিয়েছিল যে ওরা আমাকে কিছু জানাতে পারেনি। ইতিমধ্যে আমার অতিথি সোহম আমাকে বলল, ‘আমি এক মিনিট ভ্যানগুলো ঠিকঠাক আছে কি না দেখে আসছি।’ বোধহয় সঙ্গীদের থেকে কোনও মেসেজ না পেয়ে তার চিন্তা হয়েছিল। সেখানে গিয়ে কাউকে না পেয়ে কেস গড়বড় বুঝতে পেরে সে চম্পট দিল। তার একটু পরেই নিলোফার আর রোহণ ফিরে এসে আমাকে খবরটা দিল।
“আবার একটা বিরাট ফাঁড়া কাটল। পরদিন শহরে বিরাট হইচই। অচেতন ডাকাতগুলোকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেদিনের মধ্যেই এক বড়ো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদল এসে তাদের চারপাশে নিরাপত্তার বেড়াজাল খাড়া করল; তারপর ওরা একটু সুস্থ হতেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।
“মাফিয়াদল ছত্রভঙ্গ। শুধু পালের গোদাটাকে ধরা গেল না। কিছুদিন অপেক্ষার পর আমি আবার চটপট ওদের গোপন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে বেশ কিছু টাকা আমার গোপন অ্যাকাউন্টে ট্র্যান্সফার করলাম। ওদের ইলেকট্রনিক অ্যাকাউন্টে বেশ কয়েকবার সাবধানে লগ-ইন করে বুঝতে পারলাম, দলটাই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শুধু ওই ডন মাঝে মাঝে লগ-ইন করছে। তবে মিডিয়ার রিপোর্ট থেকে বোঝা গেল, মাফিয়াদের কার্যকলাপ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। যে ছোটো গ্রুপটা গোপনীয়তার ভিত্তিতে সব কাজকর্ম সংগঠিত করত, তারা ধরা পড়ে যাওয়ায় দলের নেটওয়ার্কটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে নির্দেশ ও অর্থের অভাবে নীচুতলার কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। আরও আভাস পাওয়া গেল, হতাশ ডন সম্ভবত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যা টাকাপয়সা আছে সেটুকু নিয়েই নিরাপদে বাঁচার চেষ্টা করছে।
“নিশ্চিন্ত আবহাওয়ায় আমি কাবিলের বিষয়ে তার পরিবারকে জানালাম। সে যে বেঁচে, এটুকু জেনেই তারা খুব খুশি। সবার আশা, একদিন সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।”
“কিন্তু মাফিয়া দল শেষ অবধি আপনার হদিস কীভাবে পেয়েছিল?” বলল কনিষ্ক।
“নিলোফার ঘটনার পর ড. কুরেশিকে জেরা করে ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। সম্ভবত মাফিয়া ডন নিজে একদিন ডাক্তারের কাছে রোগী সেজে গিয়ে তাঁর মোবাইলটা হাতিয়ে নিয়েছিল। সেটার গুগল ম্যাপ টাইমলাইন থেকে ডাক্তার যেদিন কাবিলকে দেখতে এসেছিলেন, সেদিনের লোকেশনটা জোগাড় করে ফেলেছিল। তারপর আমাদের এলাকায় এসে ‘রেকি’ করে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিল কার হঠাৎ শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।”
“কী ধড়িবাজ, ঠিক শয়তান দলের লিডারেরই উপযুক্ত!” অভিভূত দেবাঞ্জন বলল।
“কিন্তু ব্যাপারটা শেষ অবধি ওই নিলোফার আর রোহণের জন্য আপনার কাছে শাপে বর হয়ে দাঁড়াল, তাই না?” অরুণ বলল, “এই অভিযান চালাতে গিয়ে মাফিয়া দল ধ্বংস হয়ে আপনার লাইন ক্লিয়ার করে দিল।”
ম্লান হেসে রাহীল বললেন, “হ্যাঁ, তখন আমিও তাই ভেবেছিলাম। তবে আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি।
“কয়েক বছর কেটে গেছে। অনলাইন সাপ্লাই আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যাবসায় আমি মাফিয়াদের আরও কিছু লুকোনো টাকা ঢালার ফলে ব্যাবসাগুলি রমরমিয়ে চলছে। আমার বয়স হচ্ছে। তাই শুধু সামগ্রিক পরিচালনা ও সিদ্ধান্তের ভার নিজের হাতে রেখে ধীরে ধীরে খুঁটিনাটি কাজের দায়িত্বগুলো রোহণের ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি। সেও দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে সাহায্য করার জন্য রয়েছে শাণিত-বুদ্ধি নিলোফার।
“ব্যাবসার সূত্রে রোহণের সঙ্গে অনেক হোমরাচোমরা লোকের যোগাযোগ হয়। তাদের মধ্যে অনেকে আমাদের ব্যাবসায় টাকা ঢালতে চায়, অবশ্যই অনেক লাভের আশায়। তাদের দু-একজনকে রোহণ আমন্ত্রণ জানায়। তবে আগের সেই ভয়াবহ ঘটনার পর আর কাউকে বাড়িতে ডাকা হয় না। হোটেলে পার্টির আয়োজন করা হয়।
“সামীর ছিলেন এই আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন। ইনি বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের বিভিন্ন প্রচেষ্টায় অর্থ লগ্নি করে এসেছেন। আমাদের আরেকটা বড়ো প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি কিছু জানতে চান। তাই একদিন তাঁর সঙ্গে এক মিটিংয়ের আয়োজন করা হল, তারপর হোটেলে ডিনার।
“সামীরের বয়স হয়েছে, শরীর দুর্বল। একটু নুয়ে পড়ে হাঁটেন, দরকারে হাতের বেতের ছড়ির সাহায্য নেন। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। মাঝে মাঝে কাশির দমক দেখা দেয়। কিন্তু শরীর দুর্বল হলেও তাঁর মনোবল অসাধারণ আর ব্যাবসা-বুদ্ধি ক্ষুরধার। অনেক চাপানউতোরের পরই তাঁর সঙ্গে একটা ব্যবসায়িক বোঝাপড়ায় আসা গেল। স্পষ্টতই এ-ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত হোম-ওয়ার্ক করে এসেছিলেন।
“ডিনারের আগে হোটেলে মাননীয় অতিথির সম্মানার্থে এক ছোটো বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। দায়িত্বে ছিল সেই নিলোফার। প্রথমে ছিল একটি সুন্দর লেজার শো। সামীর আমার পাশে বসেছেন, মাঝে মাঝে ঘাড় নেড়ে তারিফ করছেন। হঠাৎ ছন্দপতন—তিনি ‘চোখ, আমার চোখ!’ বলে ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
“সর্বনাশ, সম্ভবত লক্ষ্যভ্রষ্ট কোনও লেজার রশ্মি তাঁর চোখে লেগেছে। নিলোফার, রোহণ, আরও কিছু কর্মী তাড়াতাড়ি এসে সামীরকে ধরে ফেলল।
“ ‘এ কী করলে নিলোফার! এঁর চোখ দুটো তো নষ্ট হয়ে গেল। এমন মারাত্মক ভুলের কোনও ক্ষমা নেই।’ আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললাম।
“ ‘আমার আর উপায় ছিল না স্যার।’ নিলোফার মাথা নীচু করে বলল, ‘নইলে ওর হাতে আপনার প্রাণ যেত। সেজন্য লোকটা তৈরি হয়েই এসেছিল।’
“অবাক হয়ে দেখলাম, আমার লোকজন ততক্ষণে সামীরকে মাটির থেকে তুলে শক্ত করে ধরে ফেলেছে। নিলোফার এগিয়ে গিয়ে টান মেরে খুলে ফেলল সামীরের পরচুলা, নকল দাড়িগোঁফ। অবাক হয়ে দেখলাম, এ সেই সোহম বা মাফিয়া ডন। বদলা নিতে এসেছিল!
“ ‘সিসি টিভি ফুটেজ দেখলেই বুঝতে পারবেন, লোকটা অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে আঘাত করার চেষ্টা করছিল। ওর অস্ত্র হচ্ছে ওর হাতের ছড়ি। ওটার ডগায় লুকোনো ছিল একটা ধারালো বিষ মাখানো পিন। একটা বোতাম টিপে দিলেই সেটা বেরিয়ে আপনাকে আঘাত করত।’
“অবাক হয়ে বললাম, ‘কিন্তু যদি তোমার এক মুহূর্ত দেরি হত!’
“ ‘হত না। কারণ, লোকটা শোয়ের মধ্যে একটা অন্ধকার মুহূর্ত খুঁজছিল। সে-সুযোগ তাকে দিইনি। তাছাড়া, প্রথম থেকেই লোকটার চালচলন দেখে আমার সন্দেহ হচ্ছিল। তাই একবার মিটিং চলাকালীন ও ভুলে ছড়িটা সিটে রেখে টয়লেটে ঢুকতেই আমি চট করে সেটা পরীক্ষা করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওটাকে রোহণের সাহায্যে নির্বিষ করে ফেলি। ওটা লাগলেও আপনার ক্ষতি হত না।’
“ ‘কিন্তু লোকটা এত নিখুঁত ছদ্মবেশে এসেছিল, তুমি সন্দেহ করলে কীভাবে?’
“ ‘ওর চোখ দুটো দেখে। অমন কুটিল, ভয়ংকর চোখ আমি জীবনে ভুলব না।’
“দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘কিন্তু ওই চোখ আর বোধহয়…’
“ ‘সেটা এঁদের দয়ার ওপরে।’ তাকিয়ে দেখলাম, ততক্ষণে পুলিশ এসে মাফিয়া ডনের দায়িত্ব নিয়েছে। ‘ঠিকমতো চিকিৎসা হলে,’ নিলোফার বলল, ‘ও আবার দৃষ্টি ফিরে পাবে, তবে হয়তো পুরোটা নয়।’
“বাহ্, তাহলে তো হ্যাপি এন্ডিং!” দেবাঞ্জন বলল, “এরপর নিশ্চয়ই…”
“ঠিক ধরেছ!” ম্লান হেসে বললেন রাহীল, “আমার ছেলে রোহণ আর পুত্রবধূ নিলোফারই এখন আমার ব্যাবসাগুলি চালায়। কিন্তু হ্যাপি এন্ডিং আর হল কই? আমি তো নিষ্কৃতি পেলাম না।”
“কেন?”
“কারণ, তারপরই তো শুরু হয়ে গেল আরেকটা গল্প, এক না বলা গল্প।”
“কীরকম?” সবাই একযোগে বলে উঠল।
“বলছি।” কিছুক্ষণ থেমে, বোধহয় স্মৃতিচারণ করে রাহীল আবার শুরু করলেন—“আমার চালু ব্যাবসাগুলি তো ওরা দুজন দেখছে। কিন্তু আমি এবার নির্ভয়ে মাফিয়াদের গুপ্ত ভাণ্ডার ঘাঁটতে শুরু করলাম। দেখতে দেখতে আমি অবাক হয়ে গেলাম, সারা দেশে অবৈধ কারবার চালিয়ে এই দুর্বৃত্তরা কী বিপুল অর্থরাশি জমিয়েছে! আর এখন এই বিশাল রত্নভাণ্ডারের আমিই মালিক! কী করি একে নিয়ে?”
“আপনি সেগুলি সরকারের হাতে তুলে দিলেন? নাকি দান করলেন?”
ক্লিষ্ট হেসে বললেন রাহীল, “ওখানেই তো গণ্ডগোল, কিছুই করলাম না। আসলে মানুষের অর্থ আর ক্ষমতার লোভ সীমাহীন। তাই আমি…”
“সেই অপসাম্রাজ্য নিজের হাতে তুলে নিলেন?”
“অতটা পারলাম না। আমি মাফিয়াদের অর্থ ও রিয়েল এস্টেট সবকিছু কৌশলে দখল করলাম। তারপর প্রথমেই খোঁজখবর করে ওদের ইতিমধ্যেই ধাক্কা খাওয়া ড্রাগ সাম্রাজ্য ধ্বংস করলাম। তার জন্য জঙ্গলের অনেক গাছও পুড়িয়ে ফেলতে হল। এর আগেই আমি লক্ষ করছিলাম শহর ও আশেপাশের অনেক মানুষ কতগুলি অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একটু তদন্ত করে বুঝতে পারলাম, ড্রাগ সাপ্লাই বন্ধ হওয়ায় ওই মানুষগুলির ওইসব ‘উইথড্রয়াল সিম্পটম’ দেখা দিয়েছে। আমি চটপট আশেপাশে কয়েকটি রি-হ্যাব সেন্টার খুললাম, তাতে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়োগ করলাম। এইভাবে অজস্র আধমরা মানুষকে জীবনের পথে ফিরিয়ে আনলাম। ইন্টারনেট দস্যুবৃত্তিও বন্ধ করলাম।”
“এসব তো অত্যন্ত সৎকাজ। তাহলে আপনার প্রবলেমটা কী?”
“প্রবলেম এই যে তারপরেও রয়ে গেল অগাধ ধনরাশি, যা আমার গলার ফাঁস হয়ে উঠল। আমি সেই সম্পদ বিনিয়োগ করে নানা নতুন ব্যাবসা শুরু করলাম। যথাসাধ্য সৎপথে সেগুলোকে চালাতে লাগলাম। ওঠানামার মধ্যেও ব্যাবসাও এগিয়েই চলল। আমি যা চাইছিলাম—খ্যাতি আর অর্থ, সব পেলাম।”
“বাহ্!” কনিষ্ক অভিভূত।
“কিন্তু এই করতে করতে আমি একদিন আবিষ্কার করলাম, নিজের গড়া সেই কারাগারে আমি নিজেই বন্দি হয়ে গেছি। আমার কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা, সুখদুঃখ সব ওইটুকু গণ্ডিতেই বাঁধা। আমি আর আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা মারতে পারি না। রাস্তার পাশের দোকানে বসে চা-স্ন্যাকস খেতে পারি না। যে পাহাড় আর জঙ্গল কার্যত আমার সাম্রাজ্যের অঙ্গ, সেখানে মাউথ অর্গান হাতে প্রাণের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারি না। আমি বেরোবার পাসওয়ার্ডটা ভুলে গেছি।”
কিছুক্ষণ কারও মুখে কথা নেই। তারপর রাহীল বললেন, “তারপর, আমার গল্পটা আপনাদের কেমন লাগল?”
“দারুণ, রাহীল! ঠিক আমাদের সময়ের উপযুক্ত।” দেবাঞ্জন বলল।
“নিশ্চিন্ত হলাম। আসলে কালে কালে তো কত সংজ্ঞা বদলায়। যেমন এককালে অ্যামাজন বলতে বোঝাত গহন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এক দুরন্ত নদী।”
“আর আলিবাবা বলতে এক রূপকথার নায়ক।” বলেই অরুণ উঠে গিয়ে আগন্তুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “রাহীল, আপনি আপনার খাড়া করা পাঁচিলের দরজাটার কাছে গিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে বলুন, ‘খুল যা সিমসিম!’ তারপর পেছনে না তাকিয়ে মাউথ অর্গান হাতে বেরিয়ে পড়ুন।”
রাহীলের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি সবলে অরুণের পিঠ চাপড়ে বললেন, “সা-ব্বাশ! এই জন্যই আজকের জমানার ছেলেমেয়েদের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। আপনারাই আগামী দিনের ভরসা। আপনাদের অনাবিল দৃষ্টিই পারে এভাবে গোলকধাঁধা ভেদ করে মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে।”
বাইরে কড়কড় করে আবার বাজ পড়ল। সচকিত রাহীল জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে বললেন, “চলি। ঝড় থেমে গেছে, কয়েক মিনিটের মধ্যে বৃষ্টিও থামবে। থ্যাঙ্ক ইউ, আপনাদের কোম্পানিতে খুব ভালো সময় কাটল।”
তারপর দরজা খুলে তিনি আবার বাইরের অন্ধকারে মিশে গেলেন। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেবাঞ্জন আর কাউকে দেখতে পেল না।
সত্যিই ঝড় থেমেছে, বৃষ্টিও দু-এক মিনিটে বন্ধ হল। তারপর হঠাৎ সবার চোখ ধাঁধিয়ে আলো জ্বলে উঠল।
***
“আমরা যা দেখলাম তা কি সত্যি?” বাড়ি যেতে যেতে বলছিল অরুণ।
“কে জানে! আমি কিন্তু রাহীল বেরোবার পরও কোনও গাড়ির আওয়াজ শুনিনি।” বলল দেবাঞ্জন।
“তবে আমি একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনেছি, ঠিক যেন ঘোড়ার খুরের আওয়াজ।” কনিষ্ক বলল।
কিছুক্ষণ সবাই নির্বাক। তারপর অরুণ আবার বলল, “আজ আমরা একত্রে পথ হাঁটছি। কিন্তু কাল হয়তো এক-একজন এক-একটা সম্ভাবনার রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হব। তবে যেখানেই যাই, বেরোনোর পাসওয়ার্ডটা মনে রাখবি।”
অলঙ্করণ- মৌসুমী রায়
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস