গল্প – ওপরের দিদা – শুভশ্রী ভট্টাচার্য -পুরোনো জয়ঢাক৫০-শরৎ ২০১৫

শুভশ্রী ভট্টাচার্যের আরো গল্পঃ ওপরের দিদা, লাজুকলতা, লুকোচুরি

galpooporerdida01

আমার মামারবাড়িটা ছিল রাসবিহারীর মোড়ের কাছে। ভাড়াবাড়ি। সেখানে নিচের তলায় দাদু, দিদা আর মামা থাকত। দোতলায় থাকতেন বাড়িওলারা। আমি তো তখন বাড়িওলা-টোলা বুঝতাম না, ওনাদের ডাকতাম ওপরের দাদু আর ওপরের দিদা বলে।  

ওপরের দিদা এককালে নাকি খুব ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। ধবধবে ফর্সা রঙ, নাকটা টিয়াপাখির ঠোঁটের মত টিকলো, তাতে আবার জ্বলন্ত হীরের বিরাট নাকছাবি। চোখগুলো কটা, আর একটা অদ্ভুত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দু চোখে মাখানো। বিশেষ করে উনি যখন বাথরুম যাবার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেন, তখন আমার দিকে এমন একদৃষ্টে চেয়ে থাকতেন যে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসত। আমাকে আবার মাঝে মাঝে মুখখানা হাসি হাসি করে হাতছানি দিয়ে ডাকতেন। মুখে সর্বক্ষণই কী একটা চিবোতেন। আর সেই সময় ঠোঁটের দুদিকের কষ বেয়ে লাল-লাল কী সব যেন গড়াত।  আমার মনে হত রক্ত। ওঁর এককালের অত্যন্ত ধারালো মুখটা চামড়া কুঁচকে আর দাঁত পড়ে গিয়ে কেমন কেমন একটা যেন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

আমার স্থির ধারণা ছিল যে উনি আসলে মানুষ না, ডাইনি। ছাদে যে উনি পায়রা পোষেন, নিশ্চয়ই সবসময় তাদেরই মুণ্ডু ছিঁড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খান। আর পায়রাগুলো আসলে মানুষের বাচ্চা ছিল কিনা তা-ই বা কে বলতে পারে? ওনাকে দেখলেই তাই আমি একছুটে পালিয়ে গিয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়তাম। কাঠপিঁপড়ের কামড় অগ্রাহ্য করে। অথচ ওঁর ব্যাপারে কৌতুহলও ছিল ষোল আনার ওপর আঠারো আনা। আড়াল থেকেই উঁকি মেরে মেরে নজর রাখতাম ওঁর গতিবিধির দিকে। দিদার কাছে কেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উনি আমার কথা সব জেনে নিতেন। আমি কোন ক্লাসে উঠলাম, কী খেতে ভালোবাসি, আর কতদিন থাকব—এই সব। আপাতভাবে সবই নির্দোষ প্রশ্ন। কিন্তু আমার মনে হত সবের পেছনেই একটা ভয়ঙ্কর অভিসন্ধি আছে। আমাকেও হয়তো পায়রা বানিয়ে ফেলবার ইচ্ছে।   

আমি নিজের চোখে পাশের গলিতে হাড়গোড় পড়ে থাকতেও দেখেছি। যদিও দিদা বলল, ওটা নাকি মুরগির হাড়, কাকে বা বেড়ালে এনে ফেলেছে। কিন্তু আমি জানি ওটা পায়রার না হয়ে যায় না। একদিন আমি মনস্থির করলাম, এই পায়রার ব্যাপারটা নিজের চোখে না দেখলে আর চলছে না। সেদিনই সকালবেলা ওপরের দাদু যেই বেরিয়ে গেল, দাদু-দিদাও ধারেকাছে নেই, আমি পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলাম। দোতলায় কারোর সাড়া-শব্দ না পেয়ে সোজা তিনতলায়। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে, তার মুখোমুখি একটা বড় রান্নাঘর। চকচকে লাল মেঝে। পেছনদিকে আরো তিন-চার ধাপ উঠে ঠাকুরের ঘর। দেখি রান্নাঘরের দরজা ভেজানো। ভেতর থেকে ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ আসছে। আমি ততক্ষণে নিশ্চিত, যে ঠিক সময়েই এসে পড়েছি। ভেতরে নিশ্চয়ই গোপনীয় কোন কাজ চলছে, তাই দরজাটা বন্ধ। হতে পারে পায়রার ছাল ছাড়ানো জাতীয়।

অসীম সাহসে ভর দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি উনি পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে একটা রুপোলি হাঁসের ঘাড় মটকে, তার ডানা খুলে ফেলে তার ভেতর থেকে কী একটা নিয়ে খুব যত্ন করে মুখে পুরলেন। এদিকে মেঝেতে রাখা জ্বলন্ত গ্যাসের ওপর আলু, কুমড়ো, পটলের তরকারিতে পোড়া লেগে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়ালই নেই। পাঁচফোড়নের গন্ধে চারদিক ভরে গেছে, নইলে হাঁসের ভেতরে কী আছে গন্ধে খানিকটা বোঝা যেত।   

হঠাৎ তরকারির কথা মনে পড়ে গিয়ে দ্রুত হাতে উনি খুন্তি নাড়তে লাগলেন। তারপরেই জল গড়াতে  পিছন ঘুরে আমাকে দরজার ফাঁকে দেখে ফেললেন। অমনি মুখে ফুটে উঠল কান এঁটো করা হাসি। মুখের ঝোল টেনে ঢোঁক গিলে উনি বললেন, “আরে– গাল্লু যে! আমার কি ভাগ্যি। এতদিন পর নিজে থেকেই আজ বুঝি আসা হল?”

তারপর কড়ায় জল ছিটিয়ে, চাপা দিয়ে, হাঁটু চেপে ধরে কোনমতে কাতরাতে কাতরাতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর একটা জালের আলমারি খুলে একটা ডিবে থেকে চারটে নারকোল নাড়ু বার করে একটা বাটি করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। এভাবেই বোধহয় বাচ্চাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পায়রা করে রেখে দেওয়া হয়। তারপর, আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে বললেন, “কী? আমাকে এতো ভয় পাও কেন’?”

galpooporerdida02

আমার তখন গলা শুকিয়ে গেছে, কোন আওয়াজ বেরোল না। পেছন ফিরে যে পালাব, সেই অবস্থাও তখন নেই। পুরোপুরি সম্মোহিত। সাপেরাও নাকি শুধু নজর দিয়ে এরকম সম্মোহিত করে ফেলে শিকারকে। গিলে ফেলার আগে। কোন মতে ওঁর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে মেঝেতে রাখা রুপোলি হাঁসটার দিকে তাকালাম। উনি বললেন, “ওটা দেখবে?” বলে নিয়ে এসে ঠিক একই ভাবে ওটার ঘাড় মটকে, ডানা খুলে ভেতরে দেখালেন। ছোট ছোট গোল গোল বিভিন্ন খোপে পানের বিভিন্ন মশলা রাখা। সেই পাত্রগুলো সরালে তার তলায় পানপাতার ভাণ্ডার। লাল রঙের নরম একটা মশলা তুলে জিগ্যেস করলেন আমি খেতে চাই কিনা। আমি মাথা নাড়লাম। কিন্তু এসব দেখার পর নারকোল নাড়ুগুলোতে বিষ-টিষ নেই বলেই মনে হতে লাগল।

সেদিন দুপুরে দিদা-দাদুর মাঝখানে শুয়ে দাদুর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ব্যাপারটা ভাবছিলাম। এতদিন তাহলে যা ভেবেছি সবটাই ভুল! সব দেখেশুনে একটু হতাশও বোধহয় হয়েছিলাম। ওপরের দিদাকে আর পাঁচটা লোকের মতই সাধারণ ভাবতে ঠিক ভাল লাগছিল না। সবই তো বুঝলাম, কিন্তু তাহলে আমার দিকে তাকানোটা অমন লোম খাড়া করা কেন, সেটাই এখন রহস্য।

দাদু কিছুক্ষণ বাদেই যথারীতি লাল ঘোড়া- নীল ঘোড়ার গল্পটা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল। তখন দিদাকে সব ঘটনাটা খুলে বললাম। শুধু আমার সন্দেহের কথাটা চেপে গেলাম। কী জানি হয়তো হাসবে। শুনে দিদা বলল, অনেকদিন আগে ওপরের দিদা যখন এবাড়িতে বিয়ে হয়ে আসেন, তখনও দাদু-দিদারা এই বাড়িতেই ভাড়া থাকত। প্রথমে নাকি ওপরের দিদার একটা মেয়ে হয়ে কদিন পরেই মারা যায়। তারপর থেকে শোকে উনি কেমন একটু পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। পরে অনেক ডাক্তার-বদ্যি করাতে খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তারপর দুই ছেলেমেয়ে হওয়ার পর সেই শোকের ওপর পাথর চাপা পড়ে যায়। আমাকে জন্মের পর দেখতে নাকি হুবহু সেই মেয়েটির মত ছিল। তাই মা যখন আমাকে  হসপিটাল থেকে নিয়ে এসে বেশ কিছুদিন টানা মামারবাড়িতে ছিল, সেই সময় রোজ দুবেলা নিয়ম করে উনি নীচে আসতেন আমাকে দেখতে। আমি বিছানায় শুয়ে হাত-পা নেড়ে খেলা করতাম, আর উনি পাশে একটা চেয়ারে বসে অপলকে শুধু চেয়ে থাকতেন আমার দিকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর কিছু করতেন না।

ছবিঃ শিবশংকর ভট্টাচার্য

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a comment