সম্পূর্ণ উপন্যাস- হেমকান্ত মীন- কিশোর ঘোষাল -পুরোনো জয়ঢাক৫০-শরৎ ২০১৫

কিশোর ঘোষাল   এর  আরো গল্প-উপন্যাস   হেমকান্ত মীনভূতডাঙার গল্প, ভূতের ভরসাআমায় ওরা পোষেবাসাবদলওঁরাই তাঁরা, সরুতান্ত্রিকের চ্যালা, বাসাবদল

golpohemkant min-1

বাবা চাকরিসূত্রে বাইরে থাকলেও পুজোর কটাদিন অন্য কোথাও যান না। বাড়িতেই থাকেন। আর রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর প্রত্যেকবারই গাড়ি নিয়ে আমরা ঠাকুর দেখতে বের হই। একদিন কলকাতার উত্তর, একদিন দক্ষিণ আর একদিন পাড়ায় , মোটামুটি এই আমাদের প্রোগ্রাম থাকে। এইবারে ষষ্ঠীর দিন রাতে বাড়ি ফিরে বাবা খাওয়া দাওয়ার পর মাকে বললেন,‘আমাদের কলিগ  নীল, তোমার নীলকে মনে আছে তো?’

বারে। মনে থাকবে না কেন? কতবারই তো এসেছে আমাদের বাড়ি। মা বললেন।

‘নীলদের দেশের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়, বহুদিনের পুরোনো নাকি , প্রায় সত্তর-আশি বছর তো হবেই। একদম বাঙালি মতে সাবেকি পূজো। একচালা ঠাকুর, সবুজ রঙের মহিষাসুর আর সিংহটাও ঠিক সিংহ নয় , সিঙ্গি। বহুবারই বলে ওদের ওখানে যাবার কথা, এবারও বারবার বলছিল তোমাদের সকলকে নিয়ে যাবার জন্যে। যাবে নাকি, তাহলে অষ্টমীর দিন ভোরে বেরিয়ে পড়ব, সন্ধিপুজো দেখে নবমীর বিকেলে চলে আসব। ’

‘বাঃ তবে তো দারুণ ব্যাপার, চলো না, মা, ঘুরে আসি,’ আমি বললাম।

‘তাছাড়াও কি একটা সমস্যার কথা বলছিল নীলু। তোর মার সাহায্য চান নীলুর মা। ’

‘তাই নাকি? তাহলে তো ফাটাফাটি। তাহলে আর অষ্টমী কেন? কালই চলো। ’ আমি বললাম।

মায়ের আপত্তি নেই জেনে, বাবা ফোন লাগালেন নীলকাকুকে, আমরা আগামীকাল যে নীলকাকুর দেশের বাড়ি যাবো, বাবা সেটা জানিয়ে দিলেন।  

golpohemkant min-2

পরের দিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ বিশাল লোহার গেট পেরিয়ে আমরা ঢুকে পড়লাম নীলকাকুদের প্রাসাদোপম বাড়ির চৌহদ্দিতে। মুরাম বিছোনো রাস্তা গোল হয়ে ঘুরে গেছে গাড়ি বারান্দার নীচে দিয়ে। আমাদের গাড়িটা একদম দরজার সামনেই দাঁড়াতে, গাড়ির শব্দ পেয়ে দরজায় এলেন নীলকাকুর স্ত্রী রত্নাকাকিমা, নীলকাকুর দুই মেয়ে , ইতি আর উতি। ইতি বড়ো – ক্লাস থ্রিতে পড়ে আর উতি ছোট্ট তবে স্কুলে যায় – কেজি ওয়ান বা টুতে পড়ে। একটু পিছন থেকে ধীর পায়ে হেঁটে আসছিলেন বোধহয় নীলকাকুর মা। বেঁটেখাটো, একটু মোটাসোটা খুব ফর্সা বয়স্কা মহিলা। বয়সের কারণে চলতে একটু অসুবিধে হয় বোঝা যায় , হাঁটুতে ব্যথা পান নিশ্চয়ই। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে দরজার সামনে দাঁড়াতে উনি নিজেই বললেন,‘আমি নীলুর মা, আমাকে মাসীমা বলতে পারো, মা। এসো মা এসো। মায়ের বাড়ি এক মেয়ে এসেছে ছেলেমেয়েকে নিয়ে , কিন্তু সঙ্গে জামাই আসেনি। আর তুমি এলে মা, সঙ্গে জামাই নিয়ে, ছেলে নিয়ে , ঘর পূর্ণ হয়ে গেল, মা। এসো এসো, ভেতরে এসো। ’

খুব ভোরে উঠে কলকাতা থেকে রওনা হবার জন্যে দুপুরে খাওয়ার পর আমরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা ঘুম থেকে উঠে সবে বারান্দায় বেরিয়েছি, নীলকাকুর মা এসে পড়লেন সঙ্গে নীলকাকু। মায়ের পিঠে হাত রেখে নীলকাকুর মা বললেন,‘যে জন্যে তোর অপেক্ষায় ছিলাম, সেটা এই বেলা বলে নিই, তা নইলে ওদিকে আবার আরতির সময় হয়ে যাবে। মায়ের আরতি দেখবি তো?’

মা বললেন,‘মায়ের পুজো আরতি দেখতেই তো আসা , আপনি বলুন মাসীমা। কি কথা। ’

নীলকাকু বললেন,‘শুরুটা আমি বলে নিই, মা। তারপরে না হয় তুমি বোলো…’

‘সেই ভালো। তুইই শুরু কর। ’ নীলকাকু নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলেন, তারপর শুরু করলেন ,

‘আমাদের এই দত্ত পরিবারের উত্থানের শুরু আমার ঠাকুরদাদা – নরনারায়ণ দত্তর হাত ধরে। তার আগে আমরা এই গ্রামে স্বচ্ছল এবং সম্পন্ন এক পরিবার ছিলাম মাত্র, কিন্তু বাড়বাড়ন্ত আমার দাদু নরনারায়ণ দত্তর সময়েই। দাদু ছিলেন অসাধারণ মেধাবি। গ্রামের পাঠশালা আর প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পার করেও তাঁর লেখাপড়ার তীব্র আগ্রহ দেখে দাদুর বাবা, আমার প্রপিতামহ শিবনারায়ণ ছেলেকে বর্ধমানে পাঠান এবং সেখানেই বোর্ডিং-এ থেকে তিনি হাইস্কুলের পাঠ শেষ করেন। শিবনারায়ণের মুখ উজ্জ্বল করে আমার দাদু ভীষণ ভাল রেজাল্ট করলেন এবং তারপর তিনি বর্ধমান ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে লেখাপড়া শুরু করলেন। কিন্তু সেখানেও শেষ হল না। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পড়া সাঙ্গ করে তিনি চলে যান কালাপানি পার হয়ে বিলেতে, লন্ডন থেকে এম আর সি পি করে ফিরে এলেন দেশে। ’

আমার দাদু নরনারায়ণ বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়ে ফিরলেন, কিন্তু গ্রামে এসে তিনি খুব বিপদে পড়ে গেলেন। গ্রামের লোকেরা দাদুর জন্যে আমাদের পরিবারকে একঘরে করার হুমকি দিল। ’

‘একঘরে মানে?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘আগেকার দিনে সাগর পার হয়ে কেউ বিলেত গেলে সাধারণ হিন্দু সমাজে তাকে পতিত বলে মনে করা হত। পতিত মানে তার মধ্যে আর হিন্দুত্ব নেই। সে সায়েবদের দেশে গিয়ে, তাদের সঙ্গে মেলামেশা, ওঠাবসা, খাওয়াদাওয়া করার জন্যে তার জাত চলে গেছে ধরা হত। তুই এখন থাম, পরে তোকে আরো বুঝিয়ে বলব,এখন নীলকাকুকে বলতে দে,’ মা বললেন।

‘হ্যাঁ। একঘরে করে দেবার হুমকি দিল। আর বিধান দিল দাদুকে হিন্দু শাস্ত্রমতে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। দাদু রাজি হলেন না। তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন, কলকাতায় গিয়ে শুরু করলেন প্র্যাকটিস। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি দারুণ পসার জমিয়ে প্রচুর অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করে গ্রামে এই বাড়ি বানিয়েছিলেন এবং এই বাড়িতেই তিনি তুলে এনেছিলেন তাঁর বাবা-মা ও সমস্ত পরিবারকে। তাঁর অর্জিত বিপুল প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়ে গ্রামের লোকেরা তখন আর সাহস করে নি দাদুর বিরুদ্ধে যাওয়ার। বরং এই বাড়িতে তিনি যখন দুর্গাপুজো চালু করলেন, গ্রামের সমস্ত লোক নির্দ্বিধায় আমাদের এই বাড়িতে এসেছিল,এবং পুজোর প্রসাদ পেয়েছিল যথা বিধিমতো।

‘এই বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন আজ থেকে সাতাত্তর বছর আগে, আর এই বাড়ির পুজোও চলছে ওই সাতাত্তর বছর ধরেই সাবেকি নিয়ম মেনে। কিন্তু আমাদের পক্ষে যতদিন যাচ্ছে, এই বাড়ি মেনটেন করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। বাবা থাকতেই আমাদের কাছে এই বাড়ি বিক্রির অফার আসছিল বারবার, আমরা মনস্থির করতে পারছিলাম না। কিন্তু দিন দিন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে,আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি এই বাড়ি বিক্রি করে দেবার। এক প্রমোটার বেশ ভাল অফার দিয়েছে, মোটামুটি মাস তিন চারের মধ্যেই এই বাড়ি হস্তান্তর হয়ে যাবে। এই বাড়ি শুনেছি রিসর্ট হিসেবে ব্যবহার হবে। পিকনিক, পার্টি, গেট টুগেদার, হয়তো সিরিয়াল বা সিনেমার শুটিং…এইসব হবে আর কি। সে সব তো যা হবার হবে, এ বাড়ি বিক্রি করতে আমাদের যে মানসিক অবস্থা তাতো বুঝতেই পারছেন। কিন্তু এসব ছাড়াও আমাদের আরেকটা বড়ো দুশ্চিন্তা রয়েছে , যেটার জন্যেই আপনার সাহায্য চাইছি আমরা। মানে যেভাবে আপনি “স্বর্ণসুবর্ণ”-এর সেনদের হীরের গয়না চুরির সমস্যাটা মিটিয়েছিলেন,আশা করছি সেভাবে আমাদেরটাও…।  আমাদের ব্যাপারটা সকলকে বলার নয়। খুব চেনা জানা, বিশ্বাসী নিজের জন ছাড়া। এর পরেরটুকু মা তুমিই বলো। ’ 

নীলকাকু থামলেন। মা আর বাবা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। আমার তো ফাটাফাটি লাগছিল, কলকাতার বাইরে পুজো দেখতে এসে যদি একটা রহস্য ভেদ করে ফেলতে পারে মা, তার চেয়ে মজা আর কী হতে পারে? নীলকাকুর মা একটু পরে গলাটা সাফ করে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আমি এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে। আমার বয়েস তখন সতের। বিয়ের পর বউভাতের পরের দিন আমার ঘরে শ্বশুরমশাই, শ্বাশুড়িমা আর নীলুর বাবা এসেছিলেন। আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটা সোনার কাজললতা। খুব সুন্দর, ছোট্ট একটা সোনার মাছ। তার দুচোখে দুটো লাল রঙের পাথর বসান। মাছের পিঠে চাপ দিলে লেজের দিক থেকে খুলে যেত , ভেতরটা ফাঁকা – কাজল জমানোর জায়গা। মাথার দিকটা বাঁধা ছিল একটা ছোট্ট সোনার পিন দিয়ে , সেটাতেই ঘুরে যেত মাছের দুটো পিঠ। মাছের মাথায় একটা ছোট্ট সোনার হাতল ছিল ধরার সুবিধের জন্যে। নীলুর দাদু আমার হাতে ওই সোনার মাছ তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি মা, আমাদের ঘরে এসেছ মালক্ষ্মী হয়ে। তোমার জেনে রাখা ভালো, এই সোনার কাজললতা – এই সোনার মাছ, আমাদের কাছে , তোমার এই পরিবারের কাছে ভীষণ শুভ একটা সম্পদ। এর শুধু যে অনেক দাম তাই নয় , আমাদের এই পরিবারের সমৃদ্ধির পিছনে এই মৎস্যরূপী কাজললতার বিপুল অবদান। আমাদের বিশ্বাস আমাদের পরিবারে এই মাছের উপস্থিতি আমাদের সকল অমঙ্গল ও অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত রেখেছে। কাজেই, এর মর্যাদা যেন কোন মতেই ক্ষুণ্ণ না হয়, সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য। তুমি ছেলেমানুষ, এখনই তোমার ছোট্ট কাঁধে এর গুরু দায়িত্ব আমরা দেব না, মা। কিন্তু এই পরিবারের শুভাশুভের দায়িত্ব যখন তোমার কাঁধে চলে আসবে, তখন এরও দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে, মা। আর এর কথা খুব কাছের লোক ছাড়া কেউ যেন না জানতে পারে , কারণ এর অর্থমূল্যের লোভে অনেকেই লোভি হয়ে উঠতে পারে – সেটা আমাদের পক্ষে আদৌ মঙ্গলের হবে না। ”

‘সেদিন আমি সেই কাজললতাটি মাথায় ঠেকিয়ে মায়ের , মানে নীলুর ঠাকুমার হাতে ফেরত দিয়েছিলাম। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে, সেই সোনার মাছটি আমি আর একবার মাত্র দেখেছিলাম – নীলুর বিয়ের পর। নীলু আর রত্নার বিয়ের বউভাতের পরদিন ওদের হাতেও ওর বাবা আর আমি মাছটা তুলে দিয়েছিলাম এবং রত্নাও যথারীতি সোনার মাছটি ওর বাবার হাতে ফেরৎ দিয়েছিল। ব্যস, তারপরে আমি সোনার মাছটিকে আর দেখিনি। বহুদিন নীলুর দাদু মারা গেছেন, ঠাকুমাও মারা গেছেন অনেকদিন। নীলুর বাবাকে একবার জিগ্যেস করেছিলাম এই কাজললতাটির কথা , উনি বলেছিলেন ওঁনার কাছেই আছে, কিন্তু কোথায় রেখেছেন বলেননি। গতবছর নীলুর বাবা যখন চলে গেলেন, আমি তখন নীলুর নিউআলিপুরের বাড়িতে ছিলাম। বউমার শরীর খারাপ বলে দেখতে গিয়েছিলাম। ওই সময়ে নীলুও কলকাতায় ছিল না, তাই। ওর বাবার হঠাৎ শরীর খারাপের সংবাদ পেয়ে আমরা যখন এখানে এসে পৌঁছলাম, ততক্ষণে সব শেষ। ’ নীলকাকুর মায়ের গলাটা বেশ কেঁপে গেল। তিনি কেঁদে ফেললেন। মা নীলকাকুর মায়ের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখলেন।

মায়ের মানসিক অবস্থা বুঝে, নীলকাকু বলতে শুরু করলেন, ‘বাবা চলে যাবার পর, বাবার পড়ার ঘর আর মা্-বাবার শোবার ঘর – সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমরা কিন্তু ওই কাজললতার হদিশ আজও পাইনি। সেইজন্যে আমাদের এখন সবচেয়ে দুশ্চিন্তা হল, এই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলে, এই বাড়ির সঙ্গে ওই অমূল্য কাজললতাটাও না হাতছাড়া হয়ে যায়। অথবা বাবার মৃত্যু আর আমাদের এসে পৌঁছোনোর মধ্যে যে সময়টা ছিল, সেই সময়ে কেউ সেটা চুরি করে নিল কিনা… এটা জানা ভীষণ জরুরি। ’

নীলকাকুর মা এতক্ষণে সামলে উঠেছিলেন, তিনি বললেন, ‘আমার দৃঢ বিশ্বাস, ওই কাজললতা চুরি হয়নি, হতে পারে না। এই বাড়িতেই আছে। লুকোনো আছে কোথাও। সেটাই তোমাকে খুঁজে দিতে হবে, শোভা মা। কাল যখনই তুমি আসছ শুনলাম, নীলুকে বললাম এ ঈশ্বরের আশীর্বাদ। নীলুর মুখে তো তোমার দারুণ কীর্তির কথা শুনেছিলাম, আমি নিশ্চিত, পারলে তুমিই পারবে…’

নীলকাকুর মা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মায়ের উত্তর শোনার জন্যে। মা বললেন,‘মাসীমা, জানিনা আমি পারবো কিনা। তবে আমি চেষ্টা করব। নিশ্চই চেষ্টা করব। আমি বুঝতে পারছি আপনাদের পরিবারের কাছে এই সোনার কাজললতা কতখানি অমূল্য সম্পদ। ’ একটু ভেবে নিয়ে মা আবার বললেন, ‘আজকে তো আর সম্ভব নয়, কাল সকালে কিন্তু আমি ওই ঘর দুটো দেখতে চাই। মেসোমশাইয়ের পড়ার ঘর আর আপনাদের শোবার ঘর, দুটোই। ’

‘একশ বার দেখবে মা। তোমাকে তো দেখাতেই হবে। এখন আরতির সময় হয়ে এল, চলো, সবাই নীচেয় চলো। ’      

সকাল থেকে উপবাসী থেকে আমরা অষ্টমীর পুজো দেখলাম, অঞ্জলি দিলাম এবং প্রসাদ পেয়ে উপবাস ভাঙলাম। তারপর নীলকাকু আর নীলকাকুর মা আমাদেরকে নিয়ে গেলেন নীলকাকুর বাবার পড়ার ঘরে। দরজায় মস্ত তালা দেয়া ছিল, নীলকাকুর মা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন, আমরা ছিলাম তাঁর পিছনে। বদ্ধ ঘরে ঢুকতে পুরোনো পুরোনো একটা গন্ধ পেলাম , বহুদিনের পুরোনো বই থাকা গ্রন্থাগারে ঢুকলে যেমন পাওয়া যায়। ঘরে ঢুকে নীলকাকু ঘরের আলো, পাখা চালিয়ে দিলেন, খুলে দিলেন দুটো জানালা। ঘরটা অনেকটা আলোকিত হতে দেখলাম, ঘরের উত্তর আর দক্ষিণের দুটো দেওয়াল বরাবর বই ভর্তি আলমারি – জানালার জায়গাটুকু ছাড়া। আর পুবদিকের দেওয়ালে জানালার সামনে মস্ত টেবিল আর চেয়ার, টেবিলের ওপাশের চেয়ারটা জানালার দিকে পিঠ করে রাখা আর টেবিলের এ পাশে আরো চারটে চেয়ার। জানালার ওপরে উইন্ডো এসি। উল্টোদিকের দেওয়ালে পাশাপাশি দুটো বেশ বড়ো তেল রঙ ছবি,  বললেন ওঁরাই নীলকাকুর দাদু আর ঠাকুমা।

‘শোভা মা, এই হচ্ছে, নীলুর বাবার পড়ার ঘর। উনি চলে যাবার পর এই ঘর আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি কিন্তু কোথাও সেই সোনার কাজললতা পাওয়া যায়নি,’ নীলকাকুর মা একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন। মা, বাবা আর আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম বইয়ের আলমারিগুলো। মোটামুটি সবকটা আলমারি দেখা হয়ে গেলে মা বললেন,‘এই বইগুলি কি সবই মেসোমশাইয়ের? মাসীমা, মেসোমশাইও ডাক্তার ছিলেন না?’

‘হুঁ। ডাক্তার ছিলেন, কিন্তু ওঁনার নেশা ছিল বই পড়ার। অবসর পেলেই বই মুখে নিয়ে বসে থাকতেন,’ নীলকাকুর মা উত্তর দিলেন। নীলকাকু বললেন, ‘গতকাল আপনাদের দাদুর সম্বন্ধে বললাম, বাবাকে নিয়ে প্রায় কিছুই বলিনি। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন, কিন্তু বাবা মনে প্রাণে কোনদিনই মনে হয় ডাক্তার হতে চাননি। উনি কোনদিন বলেন নি, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, জেনেরাল লাইনটাই ওঁনার পছন্দের ছিল। ভালই ছাত্র ছিলেন, দাদুর চাপে পড়ে ডাক্তার হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এম.ডি পাশ করার পর দাদুর কলকাতার চেম্বারে উনি বছর খানেক প্র্যাকটিশ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরে সে সব ছেড়েছুড়ে উনি এলাহাবাদ চলে যান মেডিকেল কলেজে অধ্যাপকের চাকরি নিয়ে। সেখানে প্রায় বছর চারেক ছিলেন, তারপর দাদুর প্রভাবেই হোক বা অন্য কোন যোগাযোগেই হোক উনি কলকাতায় চলে আসেন, সারাটা জীবন তিনি বিভিন্ন কলেজে পড়িয়েই এসেছেন, কিন্তু সেভাবে জমিয়ে প্র্যাকটিস করেননি কোনদিনই। আর ওই মা যা বললেন ‘বিভিন্ন বিষয়ে’ যা ওঁনার বৃত্তির পক্ষে একান্তই কোন কাজের নয় , সেই সব বই পড়ার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। লেখাপড়া ব্যাপারটাই ওঁর খুব পছন্দের ছিল, খুব আরাম অনুভব করতেন বইয়ের রাজ্যে। আমি জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ডাক্তারি কারিগরি দুটোতেই সুযোগ পেয়ে, কারিগরি নিয়ে পড়ব বলেছিলাম, বাবা একবারের জন্যেও ডাক্তারি পড়তে বলেননি। সাধারণত  এমন হয় না, ডাক্তার বাবারা ছেলেকেও ডাক্তার করতে চান – বাবা চাননি। তাই আমার মনে হয় বাবা ডাক্তারি ব্যাপারটা ঠিক ভালোবাসতেন না। ’

নীলকাকুর কথা শুনতে শুনতে মা নীলকাকুর বাবার টেবিলে রাখা ডায়েরিগুলো উলটে পালটে দেখছিলেন। নীলকাকুর কথা শেষ হতে মা বললেন, ‘মাসীমা, এই ডায়েরিগুলো পড়ে দেখতে পারি? আপনাদের যদি কোন আপত্তি না থাকে। ’

‘ওতে বউদি, কী দেখবেন? আমি পড়েছিলাম। একটাতে বেশ কিছু রোগির নাম, ঠিকানা, বয়েস আর বোধ হয় তাদের অসুখের ডাক্তারি নাম লেখা আছে। বাকিগুলোতে নানান সময়ে খেয়াল খুশি যা মনে এসেছে তাই লিখে রেখে দিয়েছেন। পড়ে দেখতে চান পড়ে দেখুন, কিন্তু তেমন কিচ্ছু পাবেন না,’ নীলকাকু বললেন।

‘পড়ে দেখতে চাস, দেখ না, রেখে দে তোর কাছে…। কিন্তু তুই এই ঘরে একবার খুঁজে দেখবি না?’ নীলকাকুর মা বললেন।

‘মাসীমা, আপনারা বলছেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পাননি, সেখানে আমি একদিন এসে কি খুঁজে দেখব বলুন তো? এই ঘরে নেই, আপনার শোবার ঘরেও নেই…। আমি নিশ্চিত। আমায় হদিশ দিতে পারে এই ডায়েরিগুলিই…এগুলো আমি রাখলাম। যাবার আগে ফেরৎ দিয়ে যাব , দেখি কতদূর কি করতে পারি। ’

নীলকাকু আর নীলকাকুর মা দুজনেই খুব হতাশ ও অবাক হলেন। আমিও। আমি ভেবেছিলাম, মা নির্ঘাৎ কিছু একটা বুদ্ধি করে অসম্ভব কোন জায়গা থেকে জিনিসটা বের করে ফেলবেন। আমার মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি এসেছিল। বললাম ,‘মা, এমনও তো হতে পারে, এই এতো মোটা মোটা বইয়ের মধ্যে কোথাও লুকোনো আছে…’

‘ফেলুদার “বোম্বাইয়ের বোম্বেটে”? নাঃ। সে হতেই পারে না। মেসোমশাই পড়তে ভালোবাসতেন , বই ভালোবাসতেন, তাঁর পক্ষে কোন বইয়ের প্রায় সব পাতাই কেটে নষ্ট করে এই কাজ করা সম্ভব নয়। ও কাজ দুর্জনরাই করতে পারে, যাদের বই সম্পর্কে কোন অনুভূতিই নেই,’ মা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন।

কোণাগুলো দুমড়ে যাওয়া বহু পুরোনো ডায়েরিগুলো মায়ের হাত থেকে নিয়ে আমি ঘরের দিকে চললাম। আজ সকালটা যেভাবে সুন্দর শুরু হয়েছিল, ততটাই খারাপ লাগছে এখন। মা শেষ অব্দি হাল ছেড়ে দিয়ে এই ডায়েরিগুলোকেই সম্বল করল? নীলকাকু তো বলেই দিলেন , ডায়েরিতে কাজের জিনিস কিছু নেই, তবুও মা জেদ করলেন কেন? মা কী দেখলেন এই ডায়েরিগুলোতে? কে জানে?

কাল রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় সন্ধিপুজো দেখে এসে আমাদের শুতে শুতে প্রায় একটা বেজে গিয়েছিল। মা অবিশ্যি ফিরে এসে আবার টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ডায়েরি মুখে নিয়ে বসে পড়েছিলেন , আমাদের ঘরের টেবিলে। বাবা একবার বলেছিলেন ‘শুয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়েছে। ’

মা উত্তরে বলেছিলেন, ‘হুঁ। ’

ওই উত্তর শুনে আমি চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলাম, বুঝে গিয়েছিলাম মা এখন গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছেন, বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। কাজেই মায়ের ডাকে আজকে যখন ঘুম ভাঙল, আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না, মা কখনই বা শুতে এলেন আর কখনই বা উঠে পড়ে স্নান টান সেরে ফেললেন। আমি উঠে বসে বললাম,‘এর মধ্যে তোমার চান হয়ে গেল?’

‘তবে? তোর আর তোর বাবার মতো নাকি? বেড়াতে এসে ভোঁসভোঁসিয়ে খালি ঘুম?’

‘বা রে ঘুমোলাম কোথায়? কাল তো শুতে শুতেই একটা বেজে গেল। তুমি কখন শুলে?’

‘শোয়াই হয়নি আমার। ডায়েরি পড়া শেষ করে ঘড়িতে দেখি সাড়ে চারটে বাজে। ব্যস। চানটা সেরে ফেললাম। নে নে চটপট রেডি হয়ে নে…। ’

আমি উঠে ব্রাশে পেস্ট নিয়ে ব্রাশ করতে করতে বললাম,‘কাজললতার কোন হদিশ পেলে, ডায়েরিতে?’

‘মনে হচ্ছে, পেয়ে গেছি। এখন একটা ব্যাপার শুধু যাচাই করতে হবে…ব্যস। ’

‘পেয়ে গেছ? বলো কি, সত্যি?’ আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম, বাবার হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে। তার মানে বাবারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, চুপটি করে শুয়ে শুয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন।

‘বাবা, তুমি জেগে? আমরা তো ভেবেছিলাম অঘোরে ঘুমোচ্ছ?’ আমি বললাম।

‘তোরা মা ছেলেতে যা শুরু করেছিস মাঝরাত থেকে, ছুটির দিনে যে একটু ঘুমোবো মজা সে, সে উপায়ও নেই। যাকগে’, বাবা উঠে বসলেন, কোলে মাথার বালিশটা নিয়ে বললেন,‘হদিশ পেয়ে গেছ? কোথায় আছে মাছটা। ’

‘নিশ্চিত করে বলার সময় এখনো আসেনি, তার আগে আমার একটা খবর জানা দরকার, খবরটা সঠিক দিতে পারবেন একমাত্র মাসীমা,’ মা বললেন।

বাবা খুব কৌতূহল নিয়ে জিগ্যেস করলেন,‘কীসের খবর বলোতো?’

‘উঁহু, এখন নয়। যথা সময়ে সব zআনতি পারবে… এখন আমরা বেরোব…ভুটকু, তোর হলো?’   

নীচেয় ঠাকুরদালানে, নীল কাকুর মা পুজোর জোগাড় করছিলেন। মা হেসে নীলকাকুর মায়ের পাশে বসলেন, বললেন , ‘মাসীমা, আপনার কাছে কি একটা চাবি আছে? অনেকদিন আগে মেসোমশাই আপনাকে চাবিটা দিয়েছিলেন, কতদিন আগে , তা ধরুন বছর দশেক তো হবেই…। মনে পড়ে?’

নীলকাকুর মা সত্যি অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ, মুখ দেখে মনে হল মনে করার চেষ্টা করছেন, কিছুক্ষণ পরে বললেন,‘চাবি…হ্যাঁ, তুই বলাতে মনে পড়ছে বটে, একটা চাবি নীলুর বাবা আমাকে রাখতে দিয়েছিলেন, ওই রকমই হবে -প্রায় বছর দশেক – নীলুর বিয়ের কিছুদিন পরেই। কাল তোকে বললাম না, আমাকেও যেমন বিয়ের পর সোনার কাজললতা হাতে দিয়েছিলেন নীলুর ঠাকুমা আর দাদু, আমরাও নীলুর বউয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম ওই সোনার মাছ। হ্যাঁ, এই অনুষ্ঠানের ক’দিন পরে, ওর বাবা, আমাকে একটা চাবি দিয়ে বলেছিলেন, খুব যত্ন করে রেখো। কীসের চাবি, তা বলেননি, আমিও জিগ্যেস করিনি। রেখে দিয়েছিলাম যত্ন করেই। কবে কে জানে ভুলেও গিয়েছিলাম। তুই বলাতে মনে পড়ল। চাবি…চাবি…’

‘হ্যাঁ মাসীমা, চাবি। স্টিলের লম্বা, বড়সড় চাবি, সে চাবির গায়ে ১১৯ ছাপ দেওয়া আছে। ’

নীলকাকুর মা খুব চিন্তিত মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘ওই চাবিটা কি খুব জরুরি?’

‘জরুরি। ওই চাবি আর ওই নম্বর যদি মিলে যায়, আপনার “হেমকান্ত মীন” আপনি পেয়ে যাবেন। ’

‘“হেমকান্ত মীন” – মানে?’

‘সোনারবরণ মাছ। ’

golpohemkant min-3

পুজোর যোগাড় সেরে, নীলকাকুর মা নিজের ঘরে গেলেন। তারপর পুজো শুরু হয়ে যেতে নীলকাকুর মা আবার মায়ের পাশে এসে বসলেন, মাকে চুপিচুপি বললেন,‘চাবিটা পেয়েছি। আমার আলমারির লকারেই আলাদা করে এক কোণে রাখা ছিল। যেমনটি বলেছিলি সেরকমই, চাবির গায়ে ১১৯ লেখা আছে। ’

মা কিছু বললেন না। মুচকি হাসলেন শুধু।

‘তুই কি হাত গুণতে জানিস নাকি? কী করে সব ঠিকঠাক বললি? এমনকি চাবির নম্বরটাও?’

উত্তরে মা হেসে বললেন ,‘মাসীমা, দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা সবাই আপনার ঘরে বসব, আপনার ঘরটাও দেখা হবে আর সব কথাও হবে। এই ভিড়ে এ সব কথা..’

নীলকাকুর মা বললেন , ‘ঠিক বলেছিস – একদম ঠিক। ’

দুপুরে খাওয়ার পর মা, বাবা আর আমি নীলকাকুর মায়ের ঘরে গেলাম। সেখানে নীলকাকুও ছিলেন। নীলকাকুর মা আর আমার মা বসলেন বিছানায় আর আমরা তিনজন চেয়ারে। একটু পরে রত্না কাকিমা ঘরে এলেন, বিছানায় মায়ের পাশে বসতে বসতে বললেন,’দিদিভাই, এত তাড়াতাড়ি কী করে সব বের করে ফেললেন বলুন তো? ’

‘হ্যাঁ, শোভা মার থেকে আগে শুনি কী করে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করল, তাও একেবারে রাতারাতি!’

সকলে মায়ের দিকে তাকালেন, মা এখন কেন্দ্রবিন্দুতে, মা একটু চুপচাপ ভেবে নিলেন কিভাবে শুরু করবেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘আপনাদের, মানে মাসীমার আর নীলের কথা শুনে মেসোমশাই আর ওঁর বাবা সম্বন্ধে আমার যা ধারণা হয়েছে, সেটা আগে বলে নিই। কারণ তাতে স্পষ্ট বোঝা যাবে দুজনের দৃষ্টিকোণের ব্যাখ্যা।

‘নীলের দাদু ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং ভীষণ জেদি একরোখা একজন মানুষ। মোটামুটি নিজের চেষ্টায় লন্ডন থেকে ডাক্তারি পড়ে এসেছেন। গ্রামে ফিরে গ্রামের লোকেদের ব্যবহারে তিনি মাথা নত করেননি, উল্টে আরো বেশি জেদি হয়েছেন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে। মেধা আর অধ্যবসায় দিয়ে সফলও হয়েছেন খুব তাড়াতাড়ি। প্রায় ভেলকির মতো তিনি যশ, প্রতিপত্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে অর্থও অর্জন করেছেন। কথায় বলে না, ভগবান অধ্যবসায়ী লোকদেরই সহায় হয়ে থাকেন? ওঁর ক্ষেত্রে ব্যপারটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।

‘কলকাতা মেডিকেল কলেজে এই সময়েই, একমাত্র কন্যার চিকিৎসার জন্যে আসেন রায়বাহাদুর মহারাজ শ্রী দীপেন্দ্রনারায়ণ পালচৌধুরি। তিনি আগে থেকেই মহারাজ ও চৌধুরি ছিলেন, ‘ইংরাজ সরকার বাহাদুরকে তৈলাক্ত’ করে রায়বাহাদুরও হয়েছিলেন। তাঁর নয়নের মণি একমাত্র বালিকা কন্যা কোন এক দুরারোগ্য অজানা ব্যাধিতে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন। মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ব্রিটিশ ডাক্তার কেসটি পাঠান তাঁর প্রিয় ছাত্র নীলের দাদুর কাছে। আশ্চর্যজনকভাবে নীলের দাদু মেয়েটির অসুখের লক্ষণ দেখে সঠিক রোগটি ধরতে পেরেছিলেন এবং তাঁর সুচিকিৎসায় খুব সহজেই- মাস দুয়েকের মধ্যে মেয়েটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই রায়বাহাদুর মহারাজ দীপেন্দ্রনারায়ণ অর্থের ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করেননি, উপরন্তু তাঁর কন্যা আরোগ্য হবার খুশিতে তার ডাক্তারকাকুকে নিজের হাতে উপহার দিয়েছিলেন এই সোনার কাজললতাটি, যেটি একটি হেমকান্ত মীন।

‘এই ঘটনার পরে নীলের দাদুকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কোনদিন, এরপর সাফল্য আর উন্নতির সকল সোপান তিনি খুব সহজেই পার হতে পেরেছিলেন। এই চিকিৎসার সাফল্য, পরিচিত মহলে তাঁকে রাতারাতি প্রায় ধন্বন্তরি বানিয়ে তুলেছিল। এরপরই তিনি এই বাড়ি বানিয়েছিলেন, দুর্গাপুজা চালু করেছিলেন এবং সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাস। ’  

এই অব্দি বলার পর মা একটু থামলেন। সকলেই চুপচাপ ছিলেন, নীলকাকু কথা বললেন,‘বউদি, এসব কথা কি ওই ডায়েরিগুলোতে লেখা আছে? আপনি এতসব কী করে জানলেন? সত্যি বলতে আমিও জানতাম না এত কাহিনী, মহারাজের মেয়ের চিকিৎসা এবং ওই সোনার কাজললতা পাওয়ার ইতিহাস। আমি ভেবেছিলাম দাদুই ওটা বানিয়েছিলেন। মা, তুমি জানতে?’ নীলকাকু নিজের মাকে জিগ্যেস করলেন।

‘জানতাম। তোর বাবার মুখে শুনেছিলাম, তবে ওই নামটাম অত মনে ছিল না। তুই দেখাচ্ছিস বটে, শোভা। তোর কথা রত্না আর নীলুর মুখে অনেক শুনেছি, কিন্তু দেখছি তার অনেক বেশি। ’

মা একটু হেসে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘নীলের দাদু অনেক উপার্জন করেছেন, কিন্তু এই সোনার কাজললতাটি ছিল তাঁর সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ। এই জিনিসটি তাঁকে আত্মতৃপ্তি দিত খুব। তাই এত দামি জিনিসটি বাড়িতে রাখা বিপজ্জনক বুঝেও তিনি কোনদিন নিজের কাছছাড়া করেন নি। আজীবন নিজের ঘরে সিন্দুকের মধ্যেই রেখেছিলেন তিনি, হয়তো মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে, হাতে নিয়ে খুব সাবধানে দেখতেন জিনিসটা। তিনি মারা যাবার পর সোনার কাজললতাটি মেসোমশাইয়ের হাতে তুলে দেন তাঁর মা। এই কাজললতাটি মেসোমশাইয়ের কাছে কিন্তু হয়ে উঠল মস্ত বিড়ম্বনা। তিনি নির্বিবাদি সাদাসিধে মানুষ, তিনি এটা হাতে পেয়ে খুব বিপন্ন বোধ করলেন। কোথায় এবং কিভাবে এটিকে নিরাপদে রাখা সম্ভব সেই চিন্তাতেই তাঁর রাতের ঘুম ছুটে গেল। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এটিকে ব্যাংকের ভল্টে রাখার। ’

‘ব্যাংকের ভল্টে?’ নীলকাকু জিগ্যেস করলেন।

‘হ্যাঁ। ব্যাংকের ভল্টে। কলকাতায়। নিউআলিপুরের একটি ব্রাঞ্চে। প্রয়াগ ব্যাংক। আর তার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই খবরটা তিনি কাউকেই, এমনকি মাসীমাকেও স্পষ্ট করে বললেন না। এই গোপনীয়তার একটাই কারণ, তিনি ভীষণ বিপন্নবোধ করেছিলেন। কোনক্রমে যদি কোন উটকো লোকের কানে আসে এর অস্তিত্বের কথা, বিপদে পড়তে পারেন তিনি এবং তাঁর পুরো পরিবার। তাই এত গোপনীয়তা। ’         

‘ঠিক বলেছিস, শোভা মা, নিউআলিপুরের আমাদের বাড়ির কাছেই বসুধা ব্যাংকে আমাদের একটা ভল্ট ছিলই, যেখানে আমার আর রত্না বউমার গয়নাপত্র আজও আমরা রখি। কিন্তু যে ব্যাংক তুই বললি, সেখানে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওর বাবা আর একটা ভল্ট খুলিয়েছিল জয়েন্টলি। ওর দাদু মারা যাবার কিছুদিন পরে। তুই বলাতে আমার মনে পড়ল। আমি জিগ্যেস করেছিলাম, “একটা তো রয়েইছে, আবার ভল্ট নিয়ে কী হবে?” আমাকে ওর বাবা বলেছিল,“এমনিই …আর একটা থাকা ভালো। ” ওর বাবার নেহাত কোন খামখেয়াল ভেবে আমিও আর তেমন মাথা ঘামাইনি। ’

‘হ্যাঁ, মাসীমা। সে সময় আপনার হাতে উনি চাবিটাও দেননি। চাবিটা দিয়েছিলেন, নীলের বিয়ের পর। আপনাদের পরিবারের পরম্পরা অনুযায়ী, রত্নার হাতে কাজললতাটি আনুষ্ঠানিক সমর্পণের পর, তিনি আবার ওটিকে ব্যাংকে রেখে আসেন এবং তারপর চাবিটি আপনাকে গচ্ছিত করেন। ’

‘আচ্ছা বউদি, এত মূল্যবান জিনিসটির ঠিক কত দাম, তার কোন হদিশ বলতে পারেন?’

‘হদিশই দিতে পারি, সঠিক বলা সম্ভব নয়। তোমার দাদার মোবাইলে গুগ্‌ল সার্চ করে যা দাম জানতে পারলাম তাতে আমার ধারণা মতো তিরিশ-চল্লিশের কম নয়-’        

‘তিরিশ-চল্লিশ হাজার?’ আমি বলে ফেললাম।

‘দূর বোকা, লাখ। ’ মা মৃদু হেসে আমাকে বললেন।

‘তিরিশ-চল্লিশ লাখ?’ নীলকাকু রীতিমতো চমকে উঠলেন।

‘তারও বেশিই হবে হয়তো। রূপোর বডির ওপর ১৬০ গ্রাম ১৮ ক্যারাট সোনার পাত দিয়ে মোড়া এই মাছের চোখে বসানো আছে দুটো রুবি, বর্মিজ রুবি, ৮.৫ বাই ৭.৫ মিলিমিটার তার আকার। গুগ্‌ল্‌ সার্চ করে আমি যা দাম পেলাম তাতে এই রুবি, সোনা আর রূপোর দাম আমি ধরেছি। কিন্তু এ ছাড়াও আছে জিনিসটার শিল্পমূল্য এবং অ্যান্টিক ভ্যালু। যেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ’

অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বললেন না। জিনিসটা দামি সকলেই জানতেন, কিন্তু এতটা দামি কেউ কল্পনাও করে উঠতে পারেননি। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে, মা আবার বললেন,‘আপনারাও জানতেন না এই সোনার মাছের এতো দাম হতে পারে। মেসোমশাই জানতেন, তাই তিনি ঘরে রাখার কোন ঝুঁকি নেননি, রেখেছিলেন ব্যাংকে। আর পাছে পাঁচকান হয়ে কোন বিপদ ঘটে যায়, এই ভয়ে কাউকেই খোলসা করে বলতেও পারেননি। তবে তাঁর ডায়েরিতে, সব লিখে রেখে গেছেন,সরাসরি নয়, সংকেতে। ’

‘ওই ডায়েরি পড়ে আপনি সব কথা জেনে গেলেন, আর আমি ভেবেছিলাম, ওগুলো জঞ্জাল! ভাগ্যিস আমরা কেউ ফেলে দিইনি, দিলে আজ এত সব খবর আমরা জানতেও পারতাম না। এঘর সেঘর খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে, আমরা একসময় ধরেই নিতাম, ওটা চুরি হয়ে গেছে! কিন্তু সংকেতগুলো কী বলুনতো, বউদি?’

‘নীল, এখন আর নয়, চলো সন্ধে হতে চলল, আরতির সময় হয়ে যাবে, ঠাকুদালানে যাই। আরতি সেরে আবার বসা যাবে…। ’ নীলকাকুর মাও বললেন ,

‘এঃ হে, ঠিক বলেছিস মা, তোর কথায় একদম বুঁদ হয়ে গেছিলাম, ছি ছি অনেক দেরি হয়ে গেল, চল আরতির যোগাড় করি, বউমা, চলো চলো…আরতির পর আবার শুরু হবে শোভা মায়ের সভা। ’

নীলকাকুর মায়ের ঘরে আবার আমরা জমায়েত হলাম পৌনে আটটা নাগাদ। বাড়িতে বানানো গরম গরম বেগুনি আর সঙ্গে চা। আমি চা খাই না, তবে বেশ অনেকগুলো বেগুনি খেয়ে ফেললাম। দিব্বি লাগল খেতে। চায়ে চুমুক দিয়ে, মা তাঁর ডায়েরি খুললেন , অনেকগুলো পাতা উলটে তিনি এক জায়গায় থামলেন, মুখ না তুলেই বললেন ,‘মেসোমশাইয়ের ডায়েরিতে মোট ৮৬৭টা এন্ট্রি আছে, তার মধ্যে এই তিনটে নামে একটু বিশেষত্ব আছে-  

১. Hemkanta Meena, hearing plate, Village: Shashasthi, কে রাত ১৮.০০

২. Rupsa Majhi with red eyes , conjunctivitis (?)

৩. Chunilal Verma: age 75-85, Zero Point DI-GRAM – প্রাকৃতিক ও  চিকিৎসাই হয়নি।

মেসোমশাই সমস্ত নাম, অসুখের নাম অথবা যাই কিছু লিখেছেন এই ডায়েরিতে সমস্তই ইংরিজিতে। কিন্তু এর মধ্যে দুজনের ক্ষেত্রে তিনি বাংলা ব্যবহার করেছেন, আর রূপসা মাঝির চোখ লাল হয়েছে, কনজাংটিভাইটিস লিখেও তিনি দ্বিধায় রয়েছেন। কেন? আর আমরা ডাক্তার না হয়েও বুঝতে পারছি অসুখগুলো কেমন যেন – মোটেই বিশ্বাসযোগ্য কোন অসুখ নয়।  

‘প্রথমেই বলি হেমকান্ত মীনা , রাজস্থানী নাম। তাঁর হিয়ারিং প্লেট হয়েছে? সে আবার কী অসুখ? কিন্তু এটাকে বাংলা করলে দাঁড়াবে শোনার প্লেট, শোনার পাত, সোনার পাত। তালব্য শ টাকে দন্ত্য স ভাবলে কিন্তু আমরা সূত্রটা বেশ পেয়ে যাচ্ছি। এরপরে চট করে ধরে ফেলতে অসুবিধে হয় না, আ কার বাদ দিলে রাজস্থানী ভদ্রলোক আসলে হেমকান্ত মীন মানে সোনার বরণ মাছ , সোনার পাত। এরপরে আসছে ভিলেজ মানে গ্রাম। গ্রামের নাম শষষ্ঠী। গ্রামের এমন নাম হতে পারে? কে জানে হতেও পারে, বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি? কিন্তু শষষ্ঠী মানে ১৬০ হলেও তো হতে পারে। আর গ্রাম যদি ধরি ওজনের একক, তাহলে কী দাঁড়াল, সোনার বরণ মাছ, সোনার পাত, গ্রাম ১৬০, এই অব্দি বুঝে ফেললে বাকিটা নিয়ে ভাবতেই হয় না , কারণ বাঙালিরা অন্ততঃ ১৮.০০ – মানে সন্ধে ছ’টাকে খামোকা রাত বলবে না। আসলে ওটা ক্যারাট ১৮, সোনার মধ্যে খাদের পরিমাণ।

‘ বুঝে নেওয়ার পর পরেরটা বেশ সহজ হয়ে যায়, রূপসা মাঝি লাল চোখের কোন মেয়ে নয় মোটেই, রূপো মাঝে, মানে মাঝখানে রূপো যেটা সোনার পাতে মোড়া আর তার চোখটা লাল। কনজাংটিভাইটিস, মোটেই নয়। তিন নম্বরের ভার্মাসায়েব ইউপি বা বিহারের কোন ভদ্রলোক নন, তিনি বরং বিদেশী, মায়ানমার, যার পুরোনো নাম ছিল বার্মা, আজও সেরা চুণির উৎস হিসেবে বার্মার নামই বলা হয়, বার্মিজ রুবি। কাজেই চুণিলাল ভার্মা আসলে, বার্মিজ চুণি, যার রঙ লাল। এরপরে একটু গোলমাল ছিল, এজ ৭৫-৮৫, মানে কি অত বছরের পুরোনো? জিরো পয়েন্ট ডাই-গ্রামটাই বা কি ব্যাপার? প্রাকৃতিক মানে নেচারাল, আর চিকিৎসা হয়নি মানে তো আনট্রিটেড। তার মানে চুণিটা ন্যাচারাল আর আনট্রিটেড, কিন্তু মাঝের শব্দ গুলো কী বোঝা যাচ্ছে না। নীল, তোমার দাদার মোবাইলে গুগ্‌ল্‌ ঘেঁটে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল, age আসলে age নয়, ওটা আসলে edge, মানে চুণির সাইজ ৭.৫ বাই ৮.৫ মিলিমিটার। ওজন জিরো পয়েন্ট দ্বি গ্রাম মানে ০.২ গ্রাম। ব্যাস আর সমস্যা নেই। পুরো ব্যাপারটা এবারে সবটা মিলে হল, সোনার বরণ মাছ, মাঝখানে রূপো, ১৮ ক্যারাট – ১৬০ গ্রাম সোনার পাতে মোড়া, চোখদুটো লাল – বার্মিজ চুণি, আয়তাকার সাইজ ৭.৫ বাই ৮.৫ মিলিমিটার, প্রত্যেকটার ওজন ০.২ গ্রাম। ন্যাচারাল অ্যান্ড আনট্রিটেড। আসলে দামি মণির ব্যাপার স্যাপারগুলো তেমন কিছুই জানতাম না, তাই এই জায়গায়টায় বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। ’

golpohemkant min-4

-‘না, বউদি, এ ধাঁধাঁর সমাধান – আমার বাবা এলেও করতে পারতেন না। ’ নীলকাকুর এ কথায় বাবা খুব জোরে হেসে উঠলেন, বললেন,‘কী বলছো তুমি, নীল। তোমার বাবাই তো এই ধাঁধাঁটা বানিয়েছিলেন। ’ বাবার এই কথায় সকলেই এবার হাসলেন, নীলকাকুর মাও খুব মজা পেলেন কথাটায়। নীল কাকু একটু অপ্রস্তুত হয়ে, মাথা চুলকে হেসে বললেন ,‘তাও তো বটে। ঠিকই বলেছেন, সমরেশদা। তবে, যাই বলুন বউদির জবাব নেই। এবারে ব্যাংকের চাবির ব্যাপারটা, বউদি?’

‘হ্যাঁ। বলছি, ভাই। বলার আগে, আমি মেসোমশাইয়ের অন্য একটি ডায়েরির এই অংশটি আপনাদের পড়ে শোনাচ্ছি, একটু ভাবলে আপনারাও বুঝে যাবেন ইঙ্গিতটা। ’ দরকারি অংশটুকু মা নিজের ডায়েরিতে কপি করে নিয়েছিলেন, সেটা পড়া শুরু করলেন,“কলেজে অধ্যাপনার জন্য চারি বছর সাড়ে তিনমাস এলাহাবাদবাসী  হইয়াছিলাম। বহুদিনের সাধও ছিল, এলাহাবাদের সঙ্গম চাক্ষুষ করিবার, যেস্থানে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর তিন স্রোতধারার মিলন ঘটিয়াছে সেস্থানে অবগাহন করিয়া পুণ্যসঞ্চয় করিবার। সে সাধ পূরণ হইল, অধিকন্তু অবসর পাইলে সঙ্গম তীরে অলস সময় কাটাইতেও বেশ লাগিত। পুস্তকে পড়িয়া, লোকমুখে শুনিয়া যাহা কল্পনা করিয়াছিলাম, তাহা সবটাই যে পূরণ হইয়াছিল এমন নহে, তথাপি মনোবাসনা পূরণ হইল এমত বলিতেই পারি।

সঙ্গমের তীরে দাঁড়াইয়া তাহার বিস্তার দেখিয়া যারপরনাই মুগ্ধ হইতাম। গঙ্গা ও যমুনা মৃদুমন্দ স্রোতে প্রবাহিতা। গঙ্গার গৈরিক প্রবাহ অপেক্ষা যমুনার প্রবাহ অনেকটাই স্বচ্ছ, তৎকারণবশতঃ যমুনার জল কিঞ্চিৎ নীলাভ দেখাইয়া থাকে। জানিনা ইহার পিছনে আজন্মলালিত নীল যমুনার রোমাণ্টিক রং অবচেতন মনে মিশিয়া রহিয়াছে কিনা , কারণ শ্রীমতী রাধারানি ও গোপবালক পরমশ্রীমান কানুর ভালোবাসায় বিধুর হইয়া এই যমুনা যুগ যুগান্ত হইতে প্রবাহমানা। ত্রিবেণীর দুই বেণী প্রত্যক্ষ করিলাম, অন্য বেণী সরস্বতী নদী বহুকাল পূর্বেই অন্তঃসলিলা হইয়া লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রবহমানা।   

এই প্রসঙ্গে মনে পড়িল আমাদের হুগলীর ত্রিবেণী সঙ্গমেও সরস্বতী নাম্নী এক অন্তঃসলিলা নদীর কথা শুনিয়াছিলাম। সে কথা মনে স্মরণে আসিতে, এলাহাবাদের সঙ্গম তীরে দাঁড়াইয়া মনে হইল ইহার মধ্যে কোন গূঢ় অর্থ লুকাইয়া নাই তো?

গঙ্গা আমাদের সমগ্র উত্তর ভারতের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস এবং ভবিষ্যতও বটে। যমুনা আমাদের প্রেম ও ভক্তির ইতিহাসতো বটেই, কিন্তু ভবিষ্যত কিনা তাহা ভাবীকালই বলিতে পারিবে। কিন্তু বিদ্যাস্বরূপা সরস্বতী আমাদের সনাতন ভারতীয় জ্ঞান ও দর্শনের ইতিহাস হইলেও অধুনা অন্তঃসলিলা হইয়া বহমানা এবং তাহার ভবিষ্যত বড়ই অনিশ্চিত! এই তিনটি নদীর ত্রিধারার গর্ভে যেন সঞ্চিত হইয়া আছে আমাদের সনাতন ভারতের অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার।

এই সকল গভীর তত্ত্বকথা চিন্তা করিতে করিতে একটি কবিতা মনে আসিল, তাহা এইরূপঃ-

এলাহাবাদের প্রয়াগতীরে  গঙ্গাযমুনা বহে চলে ধীরে

গর্ভে তাহার সঞ্চিত বহুমূল্য ধন।

রুদ্ধ কক্ষ খুলিবে কি কেহ          মনে জাগে মোর ঘোর সন্দেহ,

চিন্তাবিকল হইতেছে মোর মন।

হারাইয়া যদি যায় সেই চাবি সাত সতেরং বসে বসে ভাবি।

বড় ক্ষতি হবে, হায়, অপূরণ। ”

পড়া শেষ করে মা ডায়েরি থেকে মুখ তুললেন। সকলেই একমনে মার পড়া শুনছিল, মা থামতে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে মা বললেন ,

‘নদীতীরের ইংরিজি ব্যাংক , রিভার ব্যাংক। প্রয়াগতীরে মানে , প্রয়াগ ব্যাংকে। “গর্ভে তাহার সঞ্চিত বহুমূল্য ধন” , এর আগে তিনটি নদীর প্রবাহর সঙ্গে ভারতের সনাতন জ্ঞান আর ঐতিহ্যের ভাণ্ডার হিসেবে যেন প্রয়াগগর্ভকে তুলনা করেছেন, সেটাও যেমন সত্যি, প্রয়াগ ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত রাখা তাঁর সোনার কাজললতাটিও একই রকম বহুমূল্য ধন। সেই ভল্ট কে খুলবে, সেই চিন্তায় তিনি উতলা। যদি এই ভল্টের চাবিটি হারিয়ে যায় তাতেই বা কি হবে , এই নিয়ে তিনি সাত-পাঁচ বা সাত-সতেরো ভাবতে পারতেন। কিন্তু তিনি ওসব না ভেবে ‘সাত-সতেরং’ ভেবেছেন, কেন?  আমরা ছোটবেলায় নামতা পড়েছিলাম , সাতসতেরং একশো উনিশ, তাহলে ওটা কি চাবির নম্বর? মনে হচ্ছে তাই। মাসীমাও তাই বললেন, চাবির নম্বর ১১৯। ’

মায়ের কথা শেষ হতেই, রত্না কাকিমা বললেন, ‘দিদিভাই, আমার মাথা আজ এর বেশি আর নিতে পারবে না, আজ এই পর্যন্ত থাক। ওদিকে আমার কন্যাদুটিও টিভি দেখতে দেখতে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে, ওদের ঘুম থেকে তুলে খাওয়াতে আমার ঘুম ছুটে যাবে। কাজেই আমি উঠলাম দিদিভাই। ’

১১

একাদশীর দিন ভোরে আমরা রওনা হলাম কলকাতার দিকে। রাস্তায় আমরা কেউই তেমন কথাবার্তা বলিনি। আসলে আমরা সকলেই নিজের নিজের মতো করে ভাবছিলাম এই কটা দিনের কথা। পুজো। প্রকৃতি। নীলকাকুদের আপ্যায়ন। আর নিশ্চয়ই হেমকান্ত মীনের কথা। বাবা বর্ধমানে থেমে মিষ্টির দোকান থেকে মিহিদানা আর সীতাভোগ নিয়ে এলেন। কলকাতায় নিয়ে যাবার জন্যে। বর্ধমান শহর ছাড়িয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে পড়ে বাবা গাড়িতে যখন বেশ স্পিড তুললেন, আমি বাবাকে জিগ্যেস করলা্‌ম, ‘বাবা, এবারে মায়ের পারিশ্রমিক কত হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? সেবার তো হীরে বসানো সোনার হার পেয়েছিল ভীষণমামার মায়ের কাছে – তাও তো মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকার গয়না উদ্ধার করে। এবার তো চল্লিশ লাখ বা তারও বেশি। ’

‘কি জানি। দিতেও পারে, নাও পারে, চেনাশোনার মধ্যে টাকা তো আর নেওয়া যায় না…। আর নীলদের তো আর সোনার দোকানও নেই যে একখানা সোনার গয়না দিয়ে দেবে…। ’ বাবা গাড়ি চালাতে চালাতে মায়ের দিকে তাকালেন। মা কিছু বললেন না, একদম সামনে তাকিয়ে ছিলেন রাস্তার দিকে। অনেকক্ষণ পর মা বললেন ,

‘আমার পারিশ্রমিক যথাস্থানে রাখা আছে। ’

‘তার মানে, কোথায়?’ বাবা খুব অবাক স্বরে জিগ্যেস করলেন। আমিও আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না।

-‘প্রয়াগ ব্যাংকের ভল্টে। ’ মা খুব নিরুত্তাপ গলায় বললেন।

-‘কী করে জানলে? ডায়েরিতে লেখা আছে?’ বাবা জিগ্যেস করলেন।

-‘হুঁ। ’

‘কী লেখা আছে?’ আমি জিগ্যেস করলাম মাকে।

‘ধাঁধা। ’ মা গম্ভীর স্বরে বললেন।

‘বলো না, মা’ আমি মায়ের কাঁধে হাত রেখে বায়না করলাম।

-‘ “পথের শেষে যে জন এসে খুলে দিবে রুদ্ধ দ্বার-

          আসুক সিদ্ধি, আসুক ঋদ্ধি গুণীর গুণে দু’ দু’ চার।

          আর কিছু থাক কিংবা না থাক বুদ্ধি আছে সাকুল্যে-

           তার আসল আদর, আসল কদর পাওনা কনকমূল্যে।

           ব্রাহ্মণ হোক, ক্ষত্রিয় হোক, হোক সে বৈশ্য শূদ্রা

          করে সেলাম, রেখে দিলাম চারটি সোনার মুদ্রা”।  

বুঝলে কিছু? না বুঝলে এখন থাক, প্রয়াগ ব্যাংকের ভল্ট খুললে বুঝিয়ে দেব। ’

‘বারে, এটা তুমি বললে না কেন, নীলকাকুদের?’

‘ছিঃ, নিজের কথা আগে থেকে ঢাক পিটিয়ে বলতে আছে?’ 

১২

লক্ষ্মীপুজো সেরে, দুদিন পরে নীলকাকুরা কলকাতায় ফিরলেন। ফিরেই প্রয়াগ ব্যাংকে দেখা করে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে ফেললেন। মাকে ফোন করে জানালেন – নীলকাকু আর নীলকাকুর মা ব্যাংকে গিয়ে ভল্ট খুলে দুটো বাক্স নিয়ে এসেছেন, একটা বড়ো আরেকটা ছোট। আর সঙ্গে একটা খামের মধ্যে সাদা কাগজে নীলকাকুর বাবার হাতে লেখা একটা কবিতা। বড়ো বাক্সে আছে সোনার কাজললতা। আর ছোট বাক্সে আছে চারটে সোনার কয়েন।

শনিবার আমরা নীলকাকুর বাড়ি গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা, বাবার অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা পৌঁছতেই লেখাপড়া ছেড়ে ইতি আর উতি দৌড়ে এল। আমরা আসাতে ওরা খুব আনন্দ পেয়েছে। আমরা নীলকাকুর মায়ের ঘরে গিয়ে বসলাম। কাকিমা ইতি আর উতিকে নিয়ে অন্যঘরে চলে গেলেন ভুলিয়ে ভালিয়ে। নীলকাকু আমাদের সঙ্গেই ছিল। নীলকাকুর মা স্টিলের আলমারি খুলে লকার থেকে বের করলেন বাক্সদুটো- সঙ্গে একটা ছোট খাম। সবকিছু নিয়ে নীলকাকুর মা বিছানায় বসলেন, মা বিছানাতেই বসে ছিলেন। আমার অবস্থা উত্তেজনায় টানটান। নীলকাকুর মা বড়ো বাক্সটা খুলে মায়ের হাতে তুলে দিলেন। নীল রঙের মখমলের নরম প্যাডের ওপর শোয়ানো রয়েছে মাছটা। সোনার মাছ। লাল রুবির চোখ। সারা গায়ে আঁশের নিখুঁত দাগ দাগ দেওয়া। লেজ আর পাখনাগুলিও খুব সুন্দর মানানসই। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত সুন্দর জিনিসটা। বাবা হাতে নিয়ে দেখে বললেন,‘অপূর্ব, অসাধারণ। দামের কথা যদি ভুলেও যাই,অদ্ভুত সুন্দর, সত্যিকারের শিল্পকর্ম। আগেকার দিনের রাজা মহারাজারা সুন্দর জিনিসের কদর জানতেন। ’

আমিও দেখার পর নীলকাকুর মায়ের হাতে ফেরত দিলাম বাক্সটি। নীলকাকুর মা বাক্সটি বন্ধ করে আবার আলমারির লকারে রেখে এলেন। এরপর খামটি খুলে, একটা সাদা কাগজ বের করে মাকে বললেন ,

‘শোভা মা, নীলুর বাবা আবার একটা ধাঁধা তোমার জন্যে রেখে দিয়েছেন, আমি পড়ছি, শোনো -“পথের শেষে যে জন এসে খুলে দিবে রুদ্ধ দ্বার”… এই লাইনটা শুনেই মা বাকিটাও বলে দিলেন 

‘ “আসুক সিদ্ধি, আসুক ঋদ্ধি গুণীর গুণে দু’ দু’ চার।   

  আর কিছু থাক কিংবা না থাক বুদ্ধি আছে সাকুল্যে-

  তার আসল আদর, আসল কদর পাওনা কনকমূল্যে।

  ব্রাহ্মণ হোক, ক্ষত্রিয় হোক, হোক সে বৈশ্য শূদ্রা

  করে সেলাম, রেখে দিলাম চারটি সোনার মুদ্রা”

-‘বউদি, এটাও ওই ডায়েরিতে ছিল? আপনি আগে বলেননি তো!’ মা কোন উত্তর দিলেন না, শুধু হাসলেন একটু।

-‘শোভা মা না বললেও আমি কিন্তু এটার মানে বুঝে ফেলেছি, তাই ছোট বাক্সটি আমি শোভা মায়ের হাতেই তুলে দিলাম। ’ নীলকাকুর মা এই কথা বলে মায়ের হাতে তুলে দিলেন ছোট বাক্সটি। মা দুহাতে বাক্সটি নিয়ে বললেন,‘এ আমার প্রতি আপনার আর মেসোমশাইয়ের আশীর্বাদ। ’ তারপর রেখে নিলেন নিজের হাতেই।

‘খুলে দেখবেন না বউদি, ভেতরে কি আছে?’ নীলকাকু জিগ্যেস করল মাকে।

‘জানি। চারটে সোনার কয়েন – দুটো গণেশঠাকুরের আর দুটো মালক্ষ্মীর ছবি। ’ মা বললেন।

‘নাঃ আপনার সঙ্গে পারা অসম্ভব। চারটে কয়েন তো বুঝলেন, কিন্তু ঠাকুরের ছবিগুলো কী করে ধরে ফেললেন?’

‘সিদ্ধি দান করেন গণেশজি, ঋদ্ধি দান করেন মা লক্ষ্মী, তাঁরাই আছেন, দুজন করে…। ’ মা উত্তর দিলেন।

 ‘আর কত গ্রামের কয়েন, সেটা?’ নীলকাকু পরীক্ষা নেওয়ার মতো জিগ্যেস করল।

‘না, সেটা লেখা নেই, মেসোমশাইয়ের ডায়েরিতে। আর তাছাড়া সে ব্যাপারে আমার খুব কৌতূহলও নেই। কারণ আমার কাছে মেসোমশাইয়ের আশীর্বাদের মূল্য অনেক বেশি। ’ মা খুব আবেগের সঙ্গে বললেন কথাগুলি।

‘সে আর তোকে বলতে হবে না, মা। সে আমি তোকে প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলাম। তবে ও চারটে মুদ্রা নীলুর বাবা দিয়েছেন, কিন্তু তুই আমাদেরকে যে কি চিন্তা মুক্ত করলি, মা, সে আমরাই জানি-’ নীলকাকুর মা বললেন।‘আর কি সহজ করে সবকিছু মিটিয়ে দিলেন , সেটা বলো, মা -’ নীলকাকু বলল।

‘ঠিক কথা, কাজেই আমি, নীলু আর বউমা মিলে একটা পঞ্চাশ হাজারের চেক তোর হাতে দিতে চাই…’ এই বলে নীলকাকুর মা মায়ের হাতে আরেকটি সাদা খাম তুলে দিলেন আর বললেন ‘এই খামে ওই চারটে সোনার কয়েনের সার্টিফিকেটটাও রাখা আছে , প্রয়াগ ব্যাংকের, রেখে দিস যত্ন করে। ’

সব কিছু মিটে যেতে, আমরা সেদিন নীলকাকুদের বাড়ি রাতের খাবার সেরেই ফিরেছিলাম। ইতি আর উতির পরের দিন রবিবার স্কুল নেই বলে জেগে রইল অনেক রাত অবধি। আর সোমবার দিন সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ নীলকাকুর মা ফোন করেছিলেন মাকে, ফোন রেখে মা আমাকে বললেন ,‘যাক বাবা, হেমকান্ত মীনামহাশয় আবার প্রয়াগতীরে নির্বিঘ্নে ঢুকে পড়েছেন। ’

ছবিঃ শিমুল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস