উপন্যাস-কালযন্ত্র-পুষ্পেন মণ্ডল শরৎ ২০২২

পুষ্পেন মণ্ডলের আরো লেখা: বাউটম্যানের বাংলো, কুয়াশার ডাক, অরেলস্টাইন ক্যাসেল, সমুদ্রগুপ্তের তরবারি, গৌরীভিটিলের অদ্ভুত গন্ধ, জলদস্যুর রক্তচক্ষু, মেজাম্বা

uponyaskalzantra (1)

১৫ই মার্চ, ২০১৫, হরিদ্বার

অনিরুদ্ধ গঙ্গার বাঁধানো ঘাটে বসে আছে প্রায় দু-সপ্তাহ হতে চলল। প্রায় একই জায়গায় ও রোজ এসে বসে বিকালের পর। নদীটা এখানে খুব একটা চওড়া নয়। কিন্তু প্রচণ্ড খরস্রোতা। কলকাতায় গঙ্গার এ-পাড় ও-পাড় দেখা যায় না। বাবুঘাট থেকে নৌকা করে পেরোতে সময় লাগে প্রায় আধঘণ্টা। অথচ এখানে সেই নদীটাই এত সরু আর তীব্র গতি! ভাবতেই অবাক লাগে অনিরুদ্ধর। ও যেদিকে বসে আছে সেদিকটা বেশ ফাঁকা। উলটোদিকে বিষ্ণুঘাট থেকে হর কি পৌরি। যতদূর চোখ যায় হোটেল, গেস্ট হাউস আর ধর্মশালাগুলি ভিড়ের মধ্যে যেন একে অপরের ঘাড়ের উপর উঠে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে মনসা পাহাড়। অনিরুদ্ধ রোপওয়ে করে উঠেছে দু-বার। নামার সময়ে হেঁটে নেমেছে সিঁড়ি দিয়ে। পাহাড়ের উপর থেকে খুব সুন্দর ছবি পাওয়া যায়। পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো জনপদ হরিদ্বারকে দেখা যায় এক লপ্তে। সামনে নদীর দু-ধারেই লম্বা বাঁধানো ঘাটের ধার ধরে জলের গোড়ায় মোটা লোহার শিকল। অজস্র পুণ্যার্থী ভোর থেকে রাত কনকনে ঠান্ডা জলে সেই শিকল ধরে ডুব দিয়ে চলেছেন। যত ডুব, নাকি তত পুণ্য! এখন চৈত্র মাসের শুরু। নদীর ধারে বেশ আরামদায়ক হাওয়া বইছে। দুপুরের সময়ে যখন সূর্য মাথার উপরে থাকে তখন নদীর ধারে বসা যায় না। কিন্তু ভোরের দিকে অথবা সন্ধ্যার পরেই ঠান্ডাটা একটু গায়ে লাগে। উলটোদিকেও দিগন্তরেখা বরাবর পাহাড়ের সারি। ওইদিকে চণ্ডী পাহাড় পেরিয়ে রাস্তা চলে গেছে হৃষীকেশ হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ, তারপর কেদার, বদ্রী। ওদিকেও বেশ কয়েকবার গেছে অনিরুদ্ধ। পাহাড়ি রাস্তা ওকে চুম্বকের মতো টানে। চারধামের যাত্রা করার জন্য পুণ্যার্থীরা ভিড় শুরু করেছে এখান। কিছুদিন পর থেকেই তারা বেরিয়ে পড়বে পাহাড়ি রাস্তায় উত্তরের দিকে। যুগ যুগ ধরে নাকি এরকমই হয়ে আসছে। ভক্তির মোহে মানুষ কত বিপদ অগ্রাহ্য করে ছুটে যায় হিমালয়ের দুর্গম পাহাড়ের কোলে। ভগবানকে কি সত্যিই খুঁজে পায় তারা?

অনিরুদ্ধও তো এখানে খুঁজতে এসেছে একজনকে। সে এখন সারাদিন বসে থাকে নদীর উলটোদিকে হিমগিরি আশ্রমের দিকে চেয়ে। একদম নদীর পাড় থেকে মলিন সাদা রঙের ছোটো দোতলা পুরোনো আশ্রমটা উঠেছে। সঙ্গে দেয়াল বেয়ে উঠেছে একটা ঝুরিওলা পুরোনো বটগাছ। বাড়িটার গায়ে একটা সবুজ কাঠের দরজা। সেটা খুলে চার ধাপ নামলেই গঙ্গা। অনিরুদ্ধ লক্ষ করেছে ভিতরে জনাচারেক মানুষ থাকেন। বাইরের লোক খুব একটা আসেন না। এই ক’দিনে ও সবাইকেই প্রায় চিনে গেছে। একজন বয়স্ক মহিলা থাকেন, তিনি সম্ভবত রান্নার কাজ করেন। একজন মধ্যবয়সি আর একজন অল্পবয়সি ছেলে থাকে। ওরা বাজারহাট করা, সঙ্গে বাইরের কাজগুলি করে। আর একজন অতি বৃদ্ধ মানুষ আছেন, একশোর কাছাকাছি বয়স, লাঠি হাতে বেঁকে ধনুকের মতো হয়ে হাঁটেন। মাথার চুল সব সাদা। হরিদ্বারে এসেই তাঁর সঙ্গে অনিরুদ্ধ একবার দেখা করেছিল। জানিয়েছিল, “আমি স্বামী পূর্বানন্দজির খোঁজে এসেছি।”

তিনি প্রথমে অনিরুদ্ধর কথা শুনতেই পেলেন না। পাশ থেকে অল্পবয়সি ছেলেটি বলল, “বাবুজি কো সুনাই নহি দেতা। জোরসে বোলিয়ে।”

ও তখন তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব জোরে জিজ্ঞাসা করল, “আমি কলকাতা থেকে আসছি। পূর্বানন্দজির সঙ্গে দেখা করতে চাই। কোথায় তিনি?”

তাঁর চোখগুলি গোল গোল হয়ে মুখটা সামান্য ফাঁক হল। অনিরুদ্ধ দেখল, দু-একটা বাদে সব দাঁত পড়ে গেছে। মাথা নেড়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে?”

ওঁকে নাম-ধাম সব বিস্তারিত জানিয়ে আবার অনুরোধ করল অনিরুদ্ধ, “পূর্বানন্দজির সঙ্গে আমার দেখা করাটা খুব জরুরি।”

ওকে হতাশ করে তিনি উত্তর দিলেন, “তিনি এখানে নেই।”

“সে কি! তাহলে কোথায় থাকেন? আমার বাবা তো এই ঠিকানাই দিয়েছিলেন!”

তিনি বার বার মাথা নাড়তে নাড়তে লাঠি ঠুকে ঘরে চলে গেলেন। কেন যে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন না, বুঝে উঠতে পারল না অনিরুদ্ধ। কিছু কি লুকাতে চাইছেন? ভিতরের ঘরগুলি সব অন্ধকার। বাড়িটাও বড্ড স্যাঁতস্যাঁতে। অনিরুদ্ধ উঠে পড়ল। কলকাতা ছাড়ার আগে ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে করেই হোক বাবাকে খুঁজে বের করবে। বাবা চলে যাওয়ার আগে বার বার পূর্বানন্দজির নাম নিতেই হরিদ্বারের কথা বলতেন। আরও কিছু নাম বলতেন হয়তো, কিন্তু সে কথাগুলি স্পষ্টভাবে আর মনে পড়ে না। এখানে এসে খোঁজ নিয়ে জানল, এই বৃদ্ধ মানুষটি ছাড়া আর কেউ পূর্বানন্দজির কথা শোনেনি কোনোদিন। কিন্তু তিনি এখানেই ছিলেন। অনিরুদ্ধর বাবার সঙ্গে এখানেই দেখা হয়েছিল তাঁর। বাবাকে খুঁজে পেতে গেলে পূর্বানন্দজিকে ওর খুব দরকার। উনিই একমাত্র যোগসূত্র। কিন্তু কোথায় খুঁজে পাবে তাঁকে?

বিষ্ণুঘাটের পাশে রাজস্থান গেস্ট হাউসের ঠিকানা অনিরুদ্ধকে দিয়েছিলেন কলকাতার এক বন্ধু। বলেছিল, ‘ওখানে খুব কম খরচে থাকা যায়। খাওয়াদাওয়া পাশেই দাদা-বৌদির হোটেলে করবি। কম বাজেটে নিরামিষ থালি।’ দু-বেলা ও তাই খেয়ে কাটিয়ে দিল বেশ ক’টা দিন। রাজস্থান গেস্ট হাউসের সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে একদিকে হর কি পৌরি ঘাট, আর উলটোদিকে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। এই রাস্তাটা বেশ জমজমাট। দু-পাশে গায়ে গায়ে লাগোয়া হরেক জিনিসের দোকান। পিতলের পিলসুজ থেকে প্রদীপ, বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতার মূর্তি, পুজোর বাসন, চন্দন কাঠ, শাঁখ, রুদ্রাক্ষ, পুজোর সরঞ্জাম—আরও কত কী! কিছু দূর ছাড়া ছাড়া মিষ্টির দোকান পড়বে এদিক ওদিক। বড়ো লোহার কড়ায় দুধ ফুটছে সামনে। কাচের র‍্যাকে সাজানো থরে থরে ক্ষিরের সন্দেশ, মালপোয়া, রাবড়ি ইত্যাদি। একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে এই গলির। পুজোর দোকানগুলি থেকে ধূপের গন্ধ আর মিষ্টির দোকানের পোড়া দুধের গন্ধ, পান-জর্দার গন্ধ, সঙ্গে শীত পোশাকের দোকানগুলির উলের গন্ধ মিশে একটা বিচিত্র অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। কাশীতেও গঙ্গা লাগোয়া পুরোনো গলিগুলিতেও এমন অনুভূতি হয়েছে ওর। এখন অফ সিজন। তাই লোকজন একটু কম। ভিড়ভাট্টাও তেমন নেই। ও বিকাল হলেই হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় হর কি পৌরি ঘাটে। সেখানে গঙ্গার সন্ধ্যা-আরতি দেখতে বেশ ভালো লাগে। কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ। আগুন জ্বলা পিলসুজের দুলুনি। সব কেমন যেন মায়াময় মনে হয়। বাবা বলতেন, ‘চারপাশে যা দেখছিস, সবই মায়া। এই আছে এই নেই। পৃথিবীর মধ্যে আরও অনেকগুলি পৃথিবী আছে। খালি চোখে যাদের দেখা যায় না। আর আমরা যেটা দেখি, সেটা ছাড়াও অনেকগুলি স্তর আর জগৎ আছে। কালের বিভিন্নরকম চাকা আছে। কোনোটা আস্তে ঘুরছে, কোনোটা জোরে। আমরা যেটাতে বিরাজ করি সেটাই সত্যি বলে ভাবি।’

অনিরুদ্ধ তখন খুব ছোটো ছিল। বাবার বেশিরভাগ কথাই কিছু বুঝত না। তিনি ওকে বলতেন, “প্রতিদিন নিয়ম করে দু-ঘণ্টা ধ্যান করবি। চোখ বন্ধ করে সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসা অভ্যাস করতে হবে। সেই বিন্দুটাই হল সমস্ত শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। সেখান থেকেই শুরু, সেখানেই শেষ। চোখ খুলে যা দেখিস, সেটা আসল পৃথিবী নয়। মহাবিশ্ব রয়েছে মানুষের মাথার মধ্যে।”

“এসব করে কী হবে বাবা! এই তো বেশ ভালো আছি।” ও বলত মাথা নীচু করে।

তখন তিনি ওকে বোঝাতেন, “না রে অনি! তোর পথ সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা। আমরা সিদ্ধাই। তুই বা আমি কেউ অন্যদের মতো নই। যত বড়ো হবি, তত টের পাবি। আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি, সেটা পালন করতে হবে। একটা দিন আসবে যখন তোকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। তখন বুঝবি আমার কথার অর্থ। ততদিন যা বলছি করে যা।”

অনিরুদ্ধ বুঝত না কী কাজের কথা বাবা বলেছেন। কবে সেই দিন আসবে? তারপর একদিন হঠাৎ বাবা ওকে ছেড়ে চলে গেলেন। মাকে অনিরুদ্ধ জ্ঞান হওয়ার আগেই হারিয়েছে। এবার একেবারে একা হয়ে পড়ল। একটা ব্যাবসা রেখে গিয়েছিলেন বাবা। ম্যানেজার আর কর্মচারীরা দেখাশোনা করত। তাতে পড়াশোনার খরচ চলে যেত ওর। কিন্তু ব্যাবসায় প্রচুর লস হয়ে গেল।

অনিরুদ্ধ শুনেছিল, ওদের পুরোনো বাড়ি আছে বীরভূম জেলার সাহাপুর গ্রামে। অজ পাড়াগাঁয়ে সেই বসতবাটি দেখাশোনা করার কেউ নেই। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভগ্নদশা। ও জন্ম থেকে কলকাতাতেই বড়ো হয়েছে। পুরোনো বাড়িতে যায়নি কোনোদিন। আলমারির ভিতর থেকে দলিল খুঁজে পেয়েছিল। বাড়ি সমেত প্রায় দু-বিঘা জমি। ব্যাবসাটাকে আবার দাঁড় করানোর জন্য ভাবল জায়গা-সমেত বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। হাতে কিছু টাকা এলে নতুন কিছু ভাবা যাবে। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই একদিন পুরোনো গ্রামেও গেল। পুরোনো বাড়ির মধ্যে একটা ঘর ঝাড়পোঁছ করে থেকে গেল দু-দিন। রাতে স্বপ্নের মধ্যে দেখল, ও যেন অন্য এক মানুষ। সম্পূর্ণ অন্য কোনও ব্যক্তি। অন্য পরিবেশ, অচেনা লোকজন, তাদের মধ্যেই ও ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে ওর নিজের কোনও মিল নেই। ভাঁড়ার ঘরে পুরোনো জিনিসপত্রের মধ্যে একটা টিনের বাক্স খুঁজে পেয়েছিল ও। সেটা নিয়ে ফিরে এল কলকাতায়। পাশের গ্রামের এক বৃদ্ধ পুরোহিতের কাছে জানতে পারল ‘জ্ঞানগঞ্জ’-এর কথা। একশো ছুঁই ছুঁই চক্কোত্তি ব্রাহ্মণ জানালেন, “মহেন্দ্র জ্ঞানগঞ্জের সন্ধান পেয়েছিল। তোমাদের পূর্বপুরুষ সেখানেই থাকতেন।”

অনিরুদ্ধ জানতে চাইল, “জ্ঞানগঞ্জ কী ঠাকুরমশাই?”

তিনি চোখ বুজে বসে রইলেন কিছুক্ষণ ধ্যান করার ভঙ্গিমাতে। তারপর জানালেন, “পুথিতে লেখা আছে সেটা নাকি স্বর্গ আর মর্ত্যের মাঝামাঝি কোনও এক স্থান। হিমালয়ের দুর্গম কোনও অংশে লুকিয়ে আছে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো এক শহর। কোনও সাধারণ মানুষ যেতে পারে না সেখানে। মহেন্দ্র সেখানেই গেছে। তুইও পারবি।”

আরও কত কী বলে চললেন তিনি। পড়ন্ত বিকেলে পুরোনো কালীমন্দিরের ইট বের হওয়া চাতালে বসে মনে হল সব সত্যি। কিন্তু সেখান থেকে চলে আসার পর অনিরুদ্ধ ভেবে দেখল, ওগুলো সব বৃদ্ধের ধর্মীয় চিন্তাভাবনার অতিরঞ্জিত ফসল।

তার কয়েকদিনের মধ্যেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একদিন গ্রীষ্মের দুপুরে ধর্মতলার মেট্রোর সামনে বড়ো রাস্তা পেরোচ্ছে, হঠাৎ দেখে প্রচণ্ড বেগে একটি বাস ছুটে আসছে ওর দিকে। মাথার উপর প্রখর সূর্য। ঝিমঝিম করে উঠল চারপাশ। শরীরের কোনও রিফ্লেক্স অ্যাকশন কাজ করল না। লাফিয়ে যে বাসের রাস্তা থেকে সরে যাবে চট করে, তেমনটা পারল না। স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার মাঝখানে। বাসটা ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পিষে দিল। কিন্তু একপলক পরেই দেখল ও একটু দূরে রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে। চারপাশ থেকে সব মানুষ হইহই করতে শুরু করেছে। কী ব্যাপার? বাস একজন মানুষকে চাপা দিয়ে চলে গেছে! ও এগিয়ে গেল ভয়ে ভয়ে। ভিড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখল, শার্ট-প্যান্ট পরা একটি ছেলে মরে পড়ে আছে। বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে বাসের চাকা। রক্তারক্তি কাণ্ড! ছেলেটাকে যেন চেনা চেনা লাগছে। পোশাকগুলি, হাতের ব্যাগটা—যেটা পড়ে আছে রক্ত মাখামাখি হয়ে—সবগুলোই ওর খুব চেনা। কারণ, ব্যাগটা ওর নিজের। আর ওই মৃতদেহটাও! চমকে উঠল। মনে হল, তাহলে কি মারা গেছে ও?

তারপরেই হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল। খেয়াল হল, ও তখনও মেট্রোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাটা পার হয়নি। আরও কিছুক্ষণ ওখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। তার মধ্যেই সামনে দিয়ে সেই ভিড় বাসটি তিরবেগে চলে গেল। ওই বাসটাই কিছুক্ষণ আগে ওকে পিষে দিয়েছিল! আশ্চর্য! সেদিন অন্য রাস্তায় বাড়ি ফিরল অনিরুদ্ধ।

সেই শুরু। এরকম অনুভূতি আরও ঘটতে থাকল। বার বার। প্রতিবার যেন ও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসছে। চোখের সামনে নিজের মৃত্যু দেখছে। কখনও বাস বা ট্রেনে চাপা পড়া, আবার কখনও জলে ডুবে বা আগুনে পুড়ে যাওয়া। কিন্তু কেন? এই মৃত্যুর দরজা ওর সামনে বার বার খুলে যাচ্ছে কেন? অথচ ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। সবসময় ওর মনে হতে লাগল, আমার চারপাশে কিছু একটা ঘটছে, যেগুলি আমাকে একটা অচেনা অনুভূতির গন্ধ দিয়ে যাচ্ছে। অথচ কেন হচ্ছে, তার নির্দিষ্ট কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছে না ও। বাবার সংগ্রহে বেশ কিছু বই ছিল। পুরোনো আলমারি থেকে সব পাড়ল। বেশ কিছু হিন্দি আর সংস্কৃতে লেখা। আরও কিছু অচেনা ভাষায়। হিন্দি বইগুলি তবু বুঝতে পারছে। স্কুলে থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল। কিন্তু সংস্কৃত শেখার জন্য একজন শিক্ষক রাখল অনিরুদ্ধ। প্রতি সপ্তাহে দু-দিন করে যেত বাগবাজারের এক তস্য গলিতে এক পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে সংস্কৃত শিখতে। তারপর বইগুলি পড়তে শুরু করল। ক্রমশ ওর কাছে অন্য এক জগতের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। যে জ্ঞানগঞ্জের কথা সেদিন গ্রামের পুরহিত অনিরুদ্ধকে বলেছিলেন, সেই জায়গা নাকি হিমালয়ের কোন গোপন স্থানে সত্যিই আছে। কিন্তু সেখানে যাবার পথ সাধারণ মানুষের জানা নেই। সভ্য মানুষ বহুবার চেষ্টা করেছে সেখানে পৌঁছানোর। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ সফল হয়নি। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, চিন, রাশিয়া এবং আমাদের দেশেরও অনেক অভিযাত্রী চেষ্টা চালিয়েছেন বহু যুগ ধরে জ্ঞানগঞ্জকে খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু অজানা কোনও কারণে জ্ঞানগঞ্জ নিজেকে সভ্য মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে হিমালয়ের কোন দুর্গম স্থানে। অনেকেই মনে করেন সে নিজে যদি কারও কাছে ধরা দিতে না চায়, তাহলে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। আবার অনেকের মতে, জ্ঞানগঞ্জ আসলে কোনও স্থান নয়। আমাদের মনের মধ্যেই চিন্তার একটা সর্বোচ্চ শিখর। এক্ষেত্রে নাকি অন্য মানুষদের থেকে সিদ্ধাইরা কিছুটা হলেও এগিয়ে আছেন। সিদ্ধাইদের মস্তিষ্কের গঠন নাকি এমন, যে তারা ধ্যানযোগের মাধ্যমে অন্য মানুষের থেকে কম সময়ে নিজের কল্পজগতে এমন একটি নিরাকার সত্ত্বার সৃষ্টি করতে পারেন, যেটা সময় আর স্থানের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে যায় জ্ঞানগঞ্জে। একবার সেখানে পৌঁছতে পারলে সময়ের রাস্তায় ইচ্ছেমতো সফর করা যায়। তবে সেটার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। একজন উপযুক্ত গুরুই পারেন তাঁর শিষ্যকে সঠিক পথ দেখাতে। আর সেই পথ নাকি ভারি কঠিন। অনিরুদ্ধর বাবা সেই জন্যই কি পূর্বানন্দজির কথা বার বার বলতেন? ওঁর লেখা ডায়েরিতেও এই হিমগিরি আশ্রমের কথা লেখা রয়েছে।

অনেক চিন্তাভাবনা করে অনিরুদ্ধর মনে হয়েছে পূর্বানন্দজিই হলেন সেই উপযুক্ত ব্যক্তি, যাঁর মাধ্যমে সে তার বাবাকে খুঁজে পাবে। বাবা বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায় গেলেন? কী হল তাঁর জীবনের অন্তিম পরিণতি? এই প্রশ্নগুলির উত্তর না পেলে অনিরুদ্ধ কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। কিন্তু পূর্বানন্দজিকে কোথায় পাবে সে? এখানে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে  তাঁর জন্য? জানা নেই।

১লা এপ্রিল, ২০১৫, ইংল্যান্ড।

সকাল আটটা। রেডিং স্টেশনের নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘ব্রিস্টল টেম্পল মিডস’ ধরবে পর্ণা। ট্রেনটি ঠিক দু-মিনিট লেটে ঢুকল স্টেশনে। এমনটা সাধারণত হয় না। আজকে বেশ ফাঁকাই আছে ট্রেন। গেটের পাশে জানালার ধারে একটা সিটে বসল সে। উলটোদিকে বসে আছেন একজন বয়স্ক মহিলা। তিনি মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। ট্রেন ছুটতে শুরু করল। উদাসীনভাবে জানালার বাইরে চোখ গেল পর্ণার। বিস্তৃত সবুজ মাঠ। আজকে ঝলমলে একটা দিন। ঠান্ডাটা একটু কম অন্য দিনের তুলনায়। নইলে স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াতে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। যদি বরফ পড়ে তাহলে তাপমাত্রা হঠাৎ করে কমে যায় অনেকটাই। বড়ো অস্বস্তিকর লাগে তখন। কিন্তু কিছুই করার নেই। চাকরির খাতিরে এটাই অভ্যাস করতে হয়েছে।

গুছিয়ে বসে ব্যাগ থেকে ট্যাব বের করে অন করল পর্ণা। কাল রাতে শেষ করা পেপারটাতে আবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগবে বাথ পৌঁছতে। ততক্ষণে কাজ অনেকটাই এগিয়ে যাবে। সেখানে স্টেশনের বাইরে থেকে বাসে করে বাথ শহরের মাথায় পাহাড়ের উপরে তার ইউনিভার্সিটি। দূর থেকে মনে হয় ঠিক যেন একটা ওলটানো বাটি। ইংল্যান্ডের প্রাচীন শহর এই বাথ। পর্ণার বছর দুই হল এখানে। রেডিংয়ে একটি নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছে সে কিছুদিন আগে। মা-বাবা ক’দিন হল কলকাতা থেকে এসে আছেন এখানে। সপ্তাহে তিন-চারদিন ইউনিভার্সিটিতে আসতে হয়। বাকি দিনগুলি বাড়িতে বসেই কাজ করে পর্ণা।

মহাবিশ্বের ইউনিভার্সাল থিওরির উপর কাজ করতে গিয়ে একটা নতুন সূত্র পেয়েছে সে। একটা ধারণা। আর সেটাই কিছুদিন হল বিচলিত করে রেখেছে ওকে। প্রায় চল্লিশ বছরের পুরোনো একটা নামহীন থিসিস আকস্মিকভাবে সে খুঁজে পেয়েছে লাইব্রেরি থেকে। ম্যানুস্ক্রিপ্ট। সেটা পড়ার পরে চমকে উঠেছিল। তারপর থেকেই ব্যাপারটা মাথার মধ্যে কামড়াচ্ছে। লেখাগুলি ভাসছে চোখের সামনে,‘আমরা যেমন দৈর্ঘ্য মাপার জন্য স্কেল ব্যাবহার করি, অথবা তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মোমিটার, তেমনি মহাবিশ্বকে পরিমাপ করতে গেলে দশ বা এগারোটা মহাজাগতিক মাত্রার প্রয়োজন পড়ে। তার মধ্যে প্রথম চারটি মাত্রায় মানুষের অবাধ যাতায়াত। অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এবং সময়। তাও আবার সময়ের মাত্রা আমাদের ক্ষেত্রে একমুখী। মানে শুধু সামনেই যেতে পারব। পিছনে বা পাশে, যেমন খুশি যাতায়াতের অধিকার আমাদের নেই। প্রথম চারটি মাত্রার পরে যে ছয় বা সাতটি মাত্রা আছে, সেগুলি মানুষের জন্য নয়। মানে ভর বা কঠিন সত্ত্বাধারী শরীর নিয়ে ওই মাত্রাগুলিতে যাতায়াত করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন হয় সূক্ষ্ম দেহের। এটাকে বুঝতে গেলে ধারণা করতে হবে একটা বিন্দুর, যার কোনও আকার, ভর বা ঘনত্ব নেই। তখন সে সমস্ত মাত্রায় যাতায়াত করতে পারবে। সময়ের চাকাকে সামনে-পিছনে-ডানে-বাঁয়ে যেমন খুশি ঘোরাতে পারবে। একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে উপস্থিত থাকতে পারবে। আবার একই জায়গায় অতীত ও বর্তমানেও হাজির হতে পারবে।

বিষয়টা অঙ্কের মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য দিনরাত এক করে দিয়েছে পর্ণা। অঙ্কের কিছু সূত্র ওই লেখার মধ্যেই ছিল। কিন্তু এটার কি কোনও প্র্যাক্টিকাল ইমপ্লিমেন্টেশন হতে পারে? সেটা নিয়েই আজকে একটা লেকচার আছে। পেপারটা তৈরি করে রেখেছিল গতকাল রাতেই। আরেকবার পয়েন্টগুলি ঢুকিয়ে নিচ্ছে মাথার মধ্যে। প্রাচীনকালে যে ভারতীয় মুনি-ঋষিরা ধ্যানে বসতেন এবং নিরাকার রূপে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে চলে যেতেন, এমনকি অতীত ও ভবিষ্যতেও তাঁদের ছিল অবাধ বিচরণ, সে-কথা উপনিষদে নাকি লেখা আছে। তবে যা লেখা আছে, সবই যে সত্যি এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। পর্ণার বারংবার একটা কথাই মনে হচ্ছে যে মানুষের মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ শক্তিকে যদি কোনোভাবে জাগানো যায়, তাহলে এই থিওরিটার প্র্যাক্টিকাল কার্যকারিতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। একটা বহু স্তরীয় চিন্তাভাবনার গোলকধাঁধার মধ্যে ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে সে।

ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা একটু স্লো হল। ট্যাব থেকে মাথা তুলতে পর্ণার খেয়াল হল, উলটোদিকের সিটে ভদ্রমহিলা আর নেই। সেখানে বসে আছেন দুজন গাট্টাগোট্টা লোক। তার মানে টেলিহাস্ট স্টেশনে নেমে গেছেন মহিলা। আর এই দুই ব্যক্তি সেখানেই উঠেছেন। কিন্তু সেই স্টেশনে দাঁড়ানো আর ছাড়ার কোনও অনুভূতি তার হয়নি। এতটাই গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবে ছিল সে।

পর্ণা আবার চোখ দিল ট্যাবের স্ক্রিনে। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখল একটা অচেনা নম্বর। ভুরু দুটো কুঁচকে গেল দু-সেকেন্ডের জন্য। কয়েকদিন হল এরকম বিভিন্ন অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছে। সার্চ করে দেখেছে, নম্বরগুলি আলাদা আলাদা দেশের। অপর প্রান্ত থেকে বিভিন্নরকম গলায় কে বা কারা প্রচ্ছন্নভাবে শাসাচ্ছে তাকে। ইংল্যান্ডে এরকম ঘটনা ঘটলে সরাসরি পুলিশ কমপ্লেন করাই রীতি। কিন্তু পর্ণা বিদেশে এসে এসব ঝামেলাতে জড়াতে চায় না। তাই গড়িমসি করছে। অনেক ছাত্রছাত্রী বা কলিগরাও প্রয়োজনে ফোন করেন। সে-সব নম্বরও তো সেভ নেই ফোনে। কোনও নম্বর ধরবে কি ধরবে না, সেটা আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব মুশকিল। সাতপাঁচ ভেবে ফোনটা নিয়ে নিল পর্ণা।

“হ্যালো!” অপর প্রান্ত থেকে একটা ভারী গলা।

“বলুন।”

“এটা কি প্রফেসর দতা?”

“হ্যাঁ, বলছি।” সাবধানে ছোটো করে উত্তর দিল পর্ণা। তার পদবি দত্ত। ইউরোপ-আমেরিকার লোকজন কেউ বলে দতা, কেউ দাতা বা দুতা।

“সামনে সুইনডন আসছে। নেমে যাও। স্টেশনের পার্কিংয়ে একটা কালো রঙের ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। সেটাতে উঠবে। গাড়ির ছবি আর নম্বর পাঠিয়ে দিয়েছি তোমার ফোনে।”

কথাটা শুনে পর্ণার মনে প্রথমেই প্রচণ্ড বিরক্তির উদ্রেক হল। কিন্তু স্বভাবসিদ্ধভাবে শান্ত গলায় বলল, “আমি তো বাথে নামব।”

“না। আজকে আমি যেটা বলছি সেটা করো।”

“তোমার নির্দেশ মানব কেন?” দাঁত চেপে বলল পর্ণা।

“তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর তোমার ব্রড স্ট্রিটের বাড়িতে দুজন অতিথি পৌঁছেছে। তাদের লাইভ ছবি পাঠাচ্ছি। এখন অবশ্য তোমার বাবা আর মায়ের সঙ্গে গল্প করছে। কিন্তু তুমি আমার কথা না শুনলে ওরা খারাপ কিছু করে বসবে।”

পর্ণা কথাটা শুনে ছিটকে উঠে পড়ল সিট থেকে। গেটের কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, “কী, ভেবেছ কী তুমি?”

“ভেরি সিম্পল। আমাদের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী কাজ করো। তুমি এবং তোমার পরিবার সুরক্ষিত থাকবে। না-হলে সবার প্রাণ যাবে।”

“কারা তোমরা?”

“কন্ট্রাক্ট কিলার অথবা কিডন্যাপার, যা ইচ্ছা বলতে পারো।”

“আমি কিন্তু পুলিশকে জানতে বাধ্য হব।”

uponyaskalzantra (2)

“গো অ্যাহেড। তবে তার আগে নিজের বাবা-মার কথা একবার ভেবে নিও।”

কেটে গেল ফোনটা। পর্ণা দেখল, ওর সামনের সিটে যে লোক দুজন বসে ছিল, তারা আবার ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের জ্যাকেটের পকেট থেকে বেরিয়ে আছে পিস্তলের বাঁট। ফোনে দুটো ছবি এসে ঢুকল টিং করে। একটা ছবি কালো রঙের টয়োটা ভ্যানের। আর দ্বিতীয়টা ওর রেডিংয়ের বাড়ির ড্রয়িংরুমের একটা মুভি ছবি। সেটাতে দেখা যাচ্ছে, ওর বাবা-মার সঙ্গে দুজন অচেনা লোক খুব হেসে কথা বলছে। বাড়িতে ফোন করতে গেল, কিন্তু সিগন্যাল পেল না পর্ণা। কারা এরা? সাধারণ গুন্ডা যে নয়, সেটা অর্গানাইজড হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এটা ওর আগেও মনে হয়েছে, কেউ যেন বেশ কিছুদিন থেকে ফলো করছে ওকে। ট্রেনে, বাসে, ইউনিভার্সিটিতে, বাজারে। ক’দিন আগে লন্ডন গিয়েছিল, সেখানেও। তারপর ওই উড়ো ফোনগুলি। সিদ্ধাই নামে একটি লোকের কথা বার বার জিজ্ঞেস করছে ওরা। কে এই সিদ্ধাই? নেটে সার্চ করে ওই নামে বিশেষ কোনও ব্যক্তির হদিস পায়নি পর্ণা। হঠাৎ ওকেই-বা কেন জিজ্ঞেস করতে যাবে সিদ্ধাইয়ের কথা, সেটাও তো বুঝতে পারছে না। বেশ কয়েকজন কলিগকেও জিজ্ঞেস করেছে। দু-দিন আগে পর্ণার এক কলিগ জেরি শিকাগো থেকে একটা মেল পাঠিয়েছে। সেখানে প্রায় চল্লিশ বছর আগের একটি রিসার্চ পেপারে লেখকের নাম পেয়েছে, মহেন্দ্র সিদ্ধাই। আমস্টার্ডমে বেশ কয়েক বছর রিসার্চ করেছে লোকটা। তারপরে ফিরে গেছে ভারতে। তাহলে পর্ণার হাতে আসা ওই টাইম ট্র্যাভেলের থিওরিটা কি এই সিদ্ধাইয়ের লেখা। কিন্তু তার সম্পর্কে বিশেষ কোনও তথ্য কেউ জানে না। এত বছর পরে হঠাৎ কিছু লোক তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। কিন্তু কেন?

ট্রেন সুইনডনে ঢুকছে।

“লেটস গো!” পিস্তলের নল দিয়ে একটা ষণ্ডামতো লোক খোঁচা দিল পিছন থেকে। পর্ণার আপাতত কিছু করার নেই। মাথা ঠান্ডা রেখে চুপচাপ ওদের সঙ্গে চলাই শ্রেয়। এরা ওর কাছ থেকে কী চায় সেটা আগে জানতে হবে। তবে বাড়িতে বাবা-মায়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব। লোকগুলো বেশ বিপদজনক। ওদের সঙ্গে যদি খারাপ কিছু করে বসে!

সুইনডন স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে ওরা পর্ণাকে পার্কিং লটে দাঁড়ানো একটা কালো ভ্যানের দিকে নিয়ে চলল ঠেলতে ঠেলতে। পর্ণা আড়চোখে দেখল, দূরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুলিশ। কিন্তু এখন কোনও সাহায্য চাইতে পারবে না ওদের কাছ থেকে। ভ্যানের পিছনের সিটে তুলে ওর মাথায় একটা কালো কাপড়ের ঢাকনা পরিয়ে দিল। নাকে এল একটা মিষ্টি কড়া গন্ধ। ক্লোরোফর্ম! অন্ধকার হয়ে গেল সব কিছু। গাড়ি চলতে শুরু করল।

***

মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। গাড়ি পালটেছে দু-তিনবার। কিন্তু পর্ণার কাছ থেকে কোনোকিছুই জানতে চায়নি। ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটা আন্দাজ করার কোনও রাস্তা নেই। অগত্যা শুধুই প্রতীক্ষা। মা-বাবার জন্য এবার কান্না পাচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও উপায় নেই। যে লোকগুলি ওকে কিডন্যাপ করেছিল, তাদেরকে আর দেখতে পায়নি। এরা প্রতিদিন একটা করে ইনজেকশন দেয় পর্ণাকে। তাতে প্রচণ্ড ঘুম পায়। যতক্ষণ জেগে থাকে যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। মাথাটা কাজ করে না।

কয়েকদিন পরে সে বুঝতে পারল তাকে কোনও একটা জলযানে তোলা হয়েছে। জাহাজ হতে পারে। কারণ, ইঞ্জিনের আওয়াজটা বেশ জোরালো। কানে তালা লেগে যাচ্ছে। হাত-পায়ের বাঁধন আর মুখের ঢাকনা খুলে দিয়েছে ওরা। এখন ছোট্ট এক-খুপরি কাঠের ঘরে বন্দি। দিনে দু-বার করে খাবার দিয়ে যায়। সে-খাবার মুখে দিতে পারে না পর্ণা। ক্রমাগত দুলুনিতে এমনিতেই সবসময় বমি পাচ্ছে তার। দিন-কাল সময় সব গুলিয়ে গেছে। বাইরের দৃশ্য কিছু দেখা যায় না ঘর থেকে। একটাই ছোট্ট দরজা। বাইরে থেকে বন্ধ। এক মাস, দু-মাস, তিন মাস… কতদিন বন্দি রয়েছে সে এই ঘরে, কিছুতেই মেলাতে পারছে না হিসেব। তার কাছ থেকে ফোন, ট্যাব, ঘড়ি সব নিয়ে নিয়েছে ওরা।

একদিন একটা হোমরাচোমরা লোক দেখা করতে এসেছিল ওর সঙ্গে। মুলাটো, শ্যামলা গায়ের রং। চোখ দুটো খুদে খুদে। ভাঙা ভাঙা ইংরাজি আর স্প্যানিশে নিজের পরিচয় দিল—“আমার নাম ড্রোগবা।” তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল টাইম মেশিনের কথা।

শুনে আকাশ থেকে পড়ল পর্ণা। বলল, “আমি টাইম মেশিনের ব্যাপারে কিছুই জানি না।”

“তোমার রিসার্চ পেপারে আছে টাইম মেশিনের ফর্মুলা।”

“সেটা শুধুমাত্র একটা থিওরি। প্র্যাক্টিক্যাল টাইম মেশিন বানানোর টেকনোলজি এখনও নেই আমাদের কাছে।”

“চল্লিশ বছর আগে এক ভারতীয়, নাম সিদ্ধাই, সে বানিয়ে ছিল। তবে পদ্ধতিটা বেশ গোলমেলে। হিমালয়ের এক দুর্গম জায়গাতে ওর ল্যাবরেটরি ছিল। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে তোমাকে।”

“আমি কী করে খুঁজব? আর কেনই-বা খুঁজব?”

“তোমার মা আর বাবাকে আমাদের সেফ হাউসে রাখা আছে। বয়স্ক মানুষ। এই কাজটা করে দিলে তাদের ফেরত পাবে। আর এত টাকা পাবে, যে সারাজীবন কোনও কাজ না করলেও চলবে। কিন্তু আমাদের কথা না শুনলে তাদের কোনও হদিস পাবে না। এখন ভেবে দেখো।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পর্ণা বলল, “আমি কি বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারি?”

“কথা বলা যাবে না, সিসি টিভি ফুটেজ দেখাচ্ছি।” বলে লোকটা তার ফোনের স্ক্রিনে একটা ভিডিও চালু করল। একটা অচেনা ঘর। একটা খাটের উপর শুয়ে আছেন বাবা-মা। দুজনেই ঘুমোচ্ছেন। ভিডিওর ডেট ১৪ই এপ্রিল। এটা যদি আজকের তারিখ হয়, তাহলে দু-সপ্তাহ হল তাকে কিডন্যাপ করেছে এরা। ওর মনে হচ্ছিল কয়েক মাস বন্দি আছে।

পর্ণা জিজ্ঞেস করল, “কী করতে হবে আমাকে?”

“কলকাতা যেতে হবে। সিদ্ধাইয়ের পুরোনো একটা ঠিকানা আছে কলকাতার। খুঁজে বের করতে হবে তাকে।”

পর্ণা জানতে চাইল, “কিন্তু চল্লিশ বছর আগের ঠিকানাতে এখন তাঁকে পাওয়া যাবে?”

“চল্লিশ নয়, পঁচিশ বছর আগে সেখান থেকে একটা চিঠি এসেছিল হাভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ম্যাথুর কাছে। তাতে সিদ্ধাই জানিয়েছেন যে তিনি টাইম ট্র্যাভেলের উপায় বের করে ফেলেছেন। প্রফেসর ম্যাথু উপহাস করে চিঠিটা ফেলে দিয়েছিলেন ডাস্টবিনে। তাঁর সেক্রেটারি চিঠিটা তুলে রাখে। আমরা কলকাতার একটা লোককে কনট্যাক্ট করে পাঠিয়েছিলাম সেই ঠিকানাতে। কিন্তু সে কিছুই খুঁজে পায়নি। আসলে এ-কাজ সবার দ্বারা হবে না। তুমি পারবে। আর তোমাকে করতেই হবে নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য। সিদ্ধাইয়ের একটা ছেলে আছে।”

১৮ই এপ্রিল, ২০১৫, হরিদ্বার

সেদিন রাত দশটা বাজে। হিমেল হাওয়ায় জ্যাকেটের উপর একটা মোটা চাদর মুড়ি দিয়ে অনিরুদ্ধ বসে ছিল গঙ্গার ঘাটে ঠিক সেই জায়গাতেই। আগের থেকে ভিড় অনেক বেড়েছে এখানে। কারণ, চারধামের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। সামনে স্রোতস্বিনী নদীর কালো জলের উপর তিরতির করছে উলটোদিকের পাড় থেকে আসা আলোর প্রতিবিম্বগুলি। পরিবেশটা নিঝুম হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। হিমগিরি আশ্রমের সব আলো নিভে গেছে। রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা সাধুগুলি একে একে ঢুকে যাচ্ছে কম্বলের নীচে। কানে আসছে শুধু উদ্দাম জলস্রোতের কলকল শব্দ। মাঝে কেটে গেছে আরও একটা মাস। এর মধ্যে ও চক্কর দিয়ে এসেছে হৃষীকেশ, রুদ্রপ্রয়াগ, হেমকুণ্ড, যোশিমঠ, কেদার, বদ্রী, গঙ্গোত্রী, যমুনত্রী। ওখানেও বিভিন্ন আশ্রমে খোঁজখবর করেছে। অনেককে জিজ্ঞেস করেছে পূর্বানন্দজির কথা। কিন্তু কোনও আশার আলো দেখতে পায়নি। কেউ এখনও পর্যন্ত সদুত্তর দিতে পারেনি অনিরুদ্ধকে। আশা ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে। সামনে কোনও রাস্তাই আর দেখতে পাচ্ছে না ও। হতাশা গ্রাস করছে ক্রমশ। এবার কি তাহলে ফিরে যেতে হবে? নদীর চাতালেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল আকাশের দিকে চোখ রেখে।

পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। উজ্জ্বল নক্ষত্ররাশি ঝলমল করছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কালপুরুষকে। বাবা ওকে ছোটোবেলায় আকাশ চেনা শেখাতেন,‘ওই দেখ কালপুরুষ। ওর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল যে তারাটা দেখছিস, ওটার নাম বানরাজ বা রাইজেল। বানরাজ নামে এক সিদ্ধাই পুরুষ পৃথিবীতে এখনও আছেন।’ আরও কত কিছু মনে আসছে। কত স্মৃতি, কত প্রশ্ন, তার সুন্দর ব্যাখ্যা দিতেন তিনি। বাবা কোনোদিন ওকে অলৌকিক জিনিসে বিশ্বাস করতে শেখাননি। তাবিজ, কবজ, মাদুলি, পাথর এসব নিজেও কোনোদিন পরেননি, আর ওকেও পরাননি। তিনি বলতেন, ‘অলৌকিক বলে কিছু হয় না। আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে সবকিছুরই একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। অনেক সময়ে আমরা তার সঠিক ব্যাখ্যা জানি না বলেই ভূতপ্রেত বা অলৌকিক কিছু কল্পনা করি।’

বাবা ওকে কালিম্পংয়ের একটা ভালো বোডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসতেন। সেই সময়টা খুব আনন্দে কাটত অনিরুদ্ধর। বছরে পুজোর ক’টা দিন একসঙ্গে কলকাতায় থাকত ও। দারুণ মজা হত সেই সময়ে। প্যান্ডেলে ঘোরা, রাতে রেস্তোরাঁয় খাওয়া। তারপর একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন তার বাবা। একেবারে কর্পূরের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেলেন ছেলের জীবন থেকে। শুধু ছোট্ট একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘আমি অনেক দূরে একটা কাজে চললাম। কবে ফিরব জানি না। তুই নিজের যত্ন নিস।’ বোর্ডিং স্কুলে পড়শোনা করার জন্য অনিরুদ্ধ বাবাকে ছাড়াই থাকতে শিখে গিয়েছিল। তখন তাই ওই লেখাটা ওর মনে তেমন দাগ কাটেনি। মাঝে মাঝে তিনি বিদেশে যেতেন কাজের প্রয়োজনে। এক বছর পরেও যখন তিনি ফিরে এলেন না, অনিরুদ্ধর মনে হল এই পৃথিবীতে নিজের বলে আর কেউ নেই। খুব একা লাগত। তখনও রাত হলে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকত অনিরুদ্ধ। তারপর অনেকগুলি বছর চলে গেল ঝড়ের মতো। ধীরে ধীরে পালটে গেল ওর চারপাশটা। কিন্তু সেবার সাহাপুর গ্রাম থেকে ফেরার পর থেকে যা ঘটতে শুরু করল, সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল।

মিশন রোতে ওরা যে দোতলা বাড়িটায় থাকত, সেটা বহুদিন হল সংস্কার হয়নি। সবে অনিরুদ্ধ ভাবছে যে হাতে কিছু টাকা এলে সারিয়ে-টারিয়ে রং করাবে। আগের বছর গরমকালে একদিন মাঝরাতে হঠাৎ একটা প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অনিরুদ্ধর। আলো জ্বেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখে বারান্দাতে রাখা একটা চিনামাটির লম্বা ঘড়া ভেঙে গেছে। বালিমাটি সমেত ভাঙা টুকরোগুলি চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এটা হল কীভাবে? ঝড় তো ওঠেনি। তাছাড়া দেয়াল ঘেঁষে বসানো ছিল। অনেক পুরোনো জিনিস। বাবারই কেনা। এক যদি না কেউ অন্ধকারের মধ্যে দেয়াল ঘেঁষে যেতে গিয়ে অসাবধানে ওটাকে ধাক্কা মারে। তার মানে এখানে কেউ এসেছিল। মাঝরাতে চোর ছাড়া লুকিয়ে আর কে ঢুকবে? নিশ্চয়ই পাশে নিমগাছের ডাল বেয়ে উঠেছিল কেউ। কিন্তু ওদের বাড়িতে চুরি করার মতো কিছু আছে নাকি! ব্যাঙ্কে জমানো টাকাকড়ি সামান্যই আছে। বাড়িতে সোনাদানা তো কিছুই নেই। তাহলে চোর এল কীসের সন্ধানে? শেষে ভাবল, ছিঁচকে চোর হবে। কিন্তু ওর ধারণাটা ভেঙে গেল কয়েকদিন পর।

প্রায় পনেরো দিনের মাথায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। সেবার অবশ্য অনিরুদ্ধর ঘুম ভাঙেনি। পরের দিন সকাল দশটা পর্যন্ত বেঘোরে ঘুমিয়েছে। আর সেটাই সবথেকে অবাক ব্যাপার। বোর্ডিং স্কুলে পড়ার জন্য ও বরাবর ভোর পাঁচটার সময়ে উঠে পড়ে। তারপর ঘণ্টা খানেকের শরীরচর্চা রোজকার রুটিন। তাহলে এতক্ষণ ধরে ঘুম ভাঙল না কেন? ঘরের মধ্যে আলমারি হাট করে খোলা। দেরাজ, কাবার্ড সব তছনছ করেছে কেউ। জামাকাপড় থেকে শুরু করে সবকিছু নামানো। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। পরিচারিকা বাড়ির পিছন দিক থেকে একটা ক্লোরোফর্মের খালি শিশি এনে ওর হাতে দিল। তার মানে এটা আবার চোরের কাজ। থানায় গিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে পুলিশের কাছে কমপ্লেনও করল অনিরুদ্ধ। তারা রুটিন ইনভেস্টিগেশন করে ধামাচাপা দিয়ে দিল কেসটা। কিন্তু ওর মনের মধ্যে কুরে খাচ্ছিল একটা কথা, কী এমন জিনিস আছে এই বাড়িতে যে জন্য বার বার চোর আসছে! ওর ঘরের মধ্যে যে আলমারি বা দেরাজ আছে, সেখানে যে কিছুই তেমন ছিল না, সে-বিষয়ে একশো শতাংশ নিশ্চিত। তবে বাকি সবক’টা ঘর ভালো করে দেখা দরকার। বাড়িটা তার নিজের হলেও সে তো ছোটো থেকেই হোস্টেলে মানুষ। তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করল সব জায়গা। নীচের তলার বন্ধ ঘরের পুরোনো আলমারি, বাক্স-প্যাঁটরা থেকে শুরু করে লফটের সব জিনিসপত্র টেনে নামাল। তারপর প্রতিটা জিনিস নিজে পরীক্ষা করল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই তেমন পেল না। শুধুমাত্র একটা পুরোনো ট্রাঙ্কের মধ্যে থেকে বেশ কিছু বই, খাতা, ডায়েরি ইত্যাদি বের হল। সেগুলি আরও বেশ কিছুদিন ঘাঁটাঘাঁটি করার পর ধীরে ধীরে চিত্রটা পরিষ্কার হচ্ছিল। ও একটা জিনিস বুঝতে পারছিল যে বাবা মহাজাগতিক মাত্রা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ডায়েরির সাংকেতিক সব ভাষা তার পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তবুও কিছু কিছু শব্দ ও ছবি দেখে যেটা বুঝল, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা ও সময়—এই চারটি মূল মাত্রা বা ডাইমেনশনের মধ্যে সময় হল শুধুমাত্র একমুখী। মানে মানুষ সময়ের মাত্রা দিয়ে শুধুমাত্র সামনে দিকেই যেতে পারে। অন্য মাত্রাগুলির মতো পিছনে, ডানে, বাঁয়ে, উপর, নীচে যাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের সত্ত্বাকে যদি আমরা একটি কাল্পনিক বিন্দুতে নিয়ে যেতে পারি, যার কোনও ভর বা আকার নেই, তাহলে সময়ের মাত্রা দিয়ে অন্য দিকেও যাওয়া সম্ভব। মানে ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জানা অসম্ভব নয়। শোনা যায়, খুব কম সংখ্যক মুনি-ঋষি ধ্যানযোগের মাধ্যমে মস্তিষ্কের অব্যবহৃত অংশকে কাজে লাগিয়ে এমনটা করতে পেরেছেন। তাহলে কি জ্ঞানগঞ্জ সেরকমই মননের একটি সর্বোচ্চ শিখর? এমনিতে মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্র দশ শতাংশ অংশকেই কাজে লাগাতে পারে সারাজীবনে। জ্ঞানগঞ্জে পৌঁছতে গেলে নাকি মস্তিষ্কের ষাট থেকে সত্তর শতাংশকে কাজে লাগাতে হবে। ওর বাবা চেষ্টা করছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে এমন একটি যন্ত্র তৈরি করতে, যেটা দিয়ে মানুষ তার মস্তিষ্কের সত্তর শতাংশ নিউরনকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত সত্ত্বা বা চেতনাকে একটি বিন্দুতে নিয়ে যেতে পারবে। ফলে মানুষ টাইম ট্র্যাভেল করতে পারবে। টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে ছোটো থেকেই অনেক গল্প পড়েছে অনিরুদ্ধ। কখনও সেটা খুব বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। বাবা যে এই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন, সেটা জেনে বেশ অবাক হল অনিরুদ্ধ। তবে আগ্রহ বাড়ল। এই বিষয়ে আরও পড়াশোনা শুরু করল। বেশ কিছু পুরোনো চিঠিপত্র পেল বাক্স থেকে। পৃথিবীর অন্যান্য শহর থেকে আসা এই বিষয়ে অনেক গবেষক অথবা বিজ্ঞানীদের চিঠি। তাঁরা কেউ বাবাকে তাচ্ছিল্য করেছেন, কেউ আবার সমর্থন করে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। এদিকে অনিরুদ্ধর জেদটা আস্তে আস্তে বাড়ছিল। যেভাবেই হোক ওকে এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে। খুঁজে বের করতেই হবে তার বাবার অন্তর্ধানের পিছনের আসল কারণ।

হরিদ্বারের গঙ্গার ঠান্ডা চাতালে শুয়ে উপরের দিকে চেয়ে আকাশগঙ্গার অগণিত নক্ষত্রগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হচ্ছিল, এই পুরো ব্রহ্মাণ্ডই মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকে বসে আছে। নিজের মাথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত রহস্য। মানুষ যেমন নিজের মস্তিষ্কের অতি সামান্য অংশকেই চিনতে পেরেছে, তেমনি পৃথিবীর বাইরে মহাকাশকেও চিনেছে একটুখানি। যেদিন সে নিজের মস্তিষ্ককে চিনতে পারবে সেদিন সমস্ত রহস্যের পর্দা সরে যাবে চোখের সামনে থেকে।

“উঠ বেটা, ইতনি ঠন্ড মে, খুলে আসমানকে নীচে সোনে পর তবিয়ত বিগড় যায়েগা।”

কথাটা কানে আসতে শরীরটা সোজা করে ঘুরে তাকাল অনিরুদ্ধ। একজন ঋজু লম্বা মানুষ চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পা পর্যন্ত কালো কম্বলে ঢাকা। অন্ধকারের মধ্যে মুখ বোঝা যাচ্ছে না।

“আপনি কে?”

তিনি মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “আমি নিমিত্তমাত্র। প্রভুর সেবক। তুই নাকি পূর্বানন্দজির খোঁজ করছিস? আমি জানি কোথায় গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে।”

কথাটা শুনে ধড়মড় করে উঠে পড়ল অনিরুদ্ধ,“কোথায়?”

“উত্তরকাশী।”

“পূর্বানন্দজি উত্তরকাশীতে আছেন?”

তিনি মাথা নেড়ে জানালেন, “উত্তরকাশীর কাছে উপরিকোট মহাদেব মন্দিরের পুরোহিত তিনি।”

কথাটা শেষ করে অন্ধকারের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন সাধুজি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে গেলেন।

১৮ই এপ্রিল, ২০১৫, কলকাতা

প্রায় বছর দশেক পরে দেশে ফিরল পর্ণা। তার ছোটোবেলা কেটেছে কলকাতাতেই। অনেক পুরোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু এখন এই শহরে পা দিয়ে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেভাবেই হোক মহেন্দ্র সিদ্ধাইকে খুঁজে বের করতেই হবে। মিশন রোয়ের যে ঠিকানা ওর হাতে আছে, সেটাই এখন গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ। হোল্ডিং নম্বরগুলিও সব পালটে গেছে। পুরোনো বাড়িগুলি ভেঙে এখন ঝাঁ-চকচকে বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। রাস্তার দু-ধারেই প্রচুর ইলেকট্রনিক্সের দোকান। বেশ কিছু লোককে জিজ্ঞেস করল পর্ণা। কিন্তু সবাই হোল্ডিং নম্বর জানতে চাইছে। কিন্তু পুরোনো ঠিকানাতে হোল্ডিং নম্বর দেওয়া নেই। বেঙ্গল কেমিক্যালসের একটা বড়ো বিল্ডিং চোখে পড়ল রাস্তার গায়ে। এ কোম্পানিটা অনেক পুরোনো। ঢুকে পড়ল ভিতরে। অফিসে গিয়ে খোঁজখবর করতে পুরোনো এক চাপরাসিকে পাওয়া গেল। সে এই পাড়ারই বাসিন্দা। সে শুনে বলল, ডানদিক দিয়ে দু-নম্বর গলির ভিতরে সিদ্ধাই ইলেকট্রনিক্সের দোকান। তবে সে অনেকদিন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। তার পিছনেই ওদের বাড়ি।

পর্ণা ছুটল সেখানে। গলির ভিতরে রঙচটা একটা বিল্ডিং। তার পিছনে দোতলা বাড়ি। গেটের বাইরে বড়ো তালা ঝুলছে। আশেপাশে কয়েকজন লোককে জিজ্ঞেস করতে তারা মাথা নেড়ে চলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরে এল গলির মুখে। টের পেল খিদে পেয়েছে। ওই জন্য হয়তো মাথায় বুদ্ধি খুলছে না। একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাবার মুখে পুরে পর্ণা ভাবল, বাড়িতে কোনও লোক যদি থাকে তাহলে নিশ্চয়ই কাছাকাছি দোকান থেকে মুদিখানা আর স্টেশনারি জিনিস কিনবে। গলির মুখেই একটা ছোটো মুদিখানা দোকান চোখে পড়েছে তার। খাওয়া শেষ করে দৌড় দিল। গিয়ে দেখল মুদিখানা দোকানটা ছোটো হলে কী হবে, ভিতরে মাল ঠাসা। একজন বয়স্ক টাক-মাথা লোক জিজ্ঞেস করলেন, “কী চাই?”

হাসিমুখে পর্ণা জানতে চাইল, “আপনারা হোম ডেলিভারি দেন?”

“হ্যাঁ, দিই। তবে কতটা মাল নেবেন তার উপর নির্ভর করছে।”

কিছু কথা বানিয়ে বলল পর্ণা, “অনেক জিনিস লাগবে। উলটোদিকের ফ্ল্যাটে আমরা থাকি। ঠাকুমা সত্যনারায়ণের পুজো করবেন। বেশ কিছু লোক খাবে। ওই জন্য আপনার কাছে পাঠালেন।”

দোকানদার ভুরু কুঁচকে বললেন, “আগে তো দেখিনি কখনও আপনাকে।”

“সবে দু-সপ্তাহ হল ভাড়া এসেছি।”

“অ। লিস্ট নিয়ে এসেছেন? বলুন লিখে নিই। পুরো টাকা দিয়ে যাবেন। তবে মাল যাবে।”

পর্ণা মাথা নেড়ে বলল, “বেশ। দিয়ে দিচ্ছি টাকা। আচ্ছা দাদা, এখানে গলির ভিতরে সিদ্ধাইরা থাকত জানেন? যাদের ওই ইলেকট্রনিক্সের দোকান ছিল?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“ওঁরা ঠাকুমার পুরোনো পরিচিত। ওঁদের নেমন্তন্ন করতে পাঠিয়ে ছিলেন। দেখলাম বাড়ির বাইরে তালা ঝুলছে। কখন পাব ওদের বলতে পারবেন?”

“ওটা তো পাগলের বংশ! বাপটা তো অনেকদিন আগেই নিরুদ্দেশ হয়েছে। ছেলেটাকেও কয়েক মাস দেখতে পাচ্ছি না। বিশু চ্যাটার্জির বাড়িতে খোঁজ করে দেখতে পারেন। ওর ছোটো ছেলে পার্থর সঙ্গে অনি পড়ত কালিম্পংয়ের বোর্ডিংয়ে।”

কথাটা শুনে বিদ্যুতের ঝিলিক দিয়ে উঠল পর্ণার চোখে,“বিশু চ্যাটার্জির বাড়ি কোনটা বলুন তো?”

“আরে এই তো উলটোদিকে পঁচাত্তর নম্বর গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ, আশা অ্যাপার্টমেন্ট থার্ড ফ্লোর। চ্যাটার্জিবাবু আমাদের পার্মানেন্ট কাস্টমার।”

“অনেক ধন্যবাদ দাদা। আমি চ্যাটার্জিবাবুর বাড়ি থেকে একবার ঘুরে এসে অর্ডার দিচ্ছি।” বলে দৌড় দিল পর্ণা।

আশা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হল না। লিফটে চারতলায় কোণের ফ্ল্যাট। কলিং বেল টিপল পর্ণা। কিছুক্ষণের মধ্যে এক পরিচারিকা উঁকি দিল দরজার ফাঁক দিয়ে।

“পার্থদা আছেন?” জিজ্ঞেস করল পর্ণা।

“দাদাবাবু তো অফিস গেছেন।”

“ও। কখন ফিরবেন?”

“আজকে তো শনিবার। তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আপনি কে?”

“আমি ওঁর পরিচিত বন্ধু। অনেক দূর থেকে আসছি।”

“আচ্ছা, ভিতরে এসে বসুন তাহলে।”

বৈঠকখানায় বসার মিনিট দশেকের মধ্যে একটি লম্বা মানুষ ঘরে ঢুকলেন,“নমস্কার! আমি পার্থ। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

“আমার নাম পর্ণা দত্ত, আমি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের প্রফেসর। এখন ইংল্যান্ডে থাকি। আসলে একটা প্রজেক্টের কাজে অনিরুদ্ধ সিদ্ধাইয়ের খোঁজে এসেছিলাম। ওঁর বাবা মহেন্দ্র সিদ্ধাই একজন নামকরা বিজ্ঞানী ছিলেন। জানেন নিশ্চয়ই?”

কথাটা শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলেন ভদ্রলোক। মাথা নেড়ে জানালেন, “অনিরুদ্ধ আমার বন্ধু। একই কনভেন্টে পড়াশোনা করেছি আমরা। ওর বাবাকে আমি দেখেছি খুব ছোটোবেলায়। ওদের একটা ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান ছিল। বহু বছর সেটা বন্ধ পড়ে আছে। অনিরুদ্ধর বাবা বিজ্ঞানী ছিলেন, তেমন তো শুনিনি কোনোদিন।”

“মহেন্দ্র সিদ্ধাই বিদেশেও ছিলেন অনেকদিন। সেখানে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স পড়াতেন। সে অবশ্য অনেক বছর আগের কথা।”

“তাই নাকি? আমি বেশ অবাক হচ্ছি কথাটা শুনে।”

পর্ণা জানতে চাইল, “অনিরুদ্ধ কোনোদিন কিচ্ছু বলেনি এই বিষয়ে?”

“আসলে কী জানেন, অনিরুদ্ধ ছিল খুব ইন্ট্রোভার্ট টাইপের ছেলে। ছোটো থেকেই মুখচোরা। মনের মধ্যে ওর কী চলত, সেটা কিছুতেই প্রকাশ করত না। খুব একা হয়ে গিয়েছিল ওর মা যখন মারা গেলেন। তার কয়েক বছর পর ওর বাবাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। ব্যাবসা দেখত ওদের ম্যানেজার সদানন্দকাকু। কর্মচারীদের দিয়ে কি আর ব্যাবসা চলে! আস্তে আস্তে কাস্টমার কমে গেল। বন্ধ হয়ে গেল দোকান।” একটু থেমে পার্থবাবু আবার বললেন, “কয়েকমাস আগে হঠাৎ অনি আমাকে ফোন করে বলল ওর বাড়িতে চোর ঢুকেছে। কিছু নিয়ে যেতে পারেনি, কিন্তু গোটা বাড়িতে কিছু একটা খুঁজে বেড়িয়েছে। রাতে ও বুঝতে পারেনি। কোনও ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করেছিল হয়তো। আমি ওকে নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম।”

“আচ্ছা, অনিরুদ্ধর সঙ্গে দেখা করা যায় কি? সে এখন কোথায়? বাড়ির বাইরে তো তালা ঝুলছে দেখলাম।”

“সে সম্ভবত এখন হরিদ্বারে।”

“হরিদ্বারে কেন?”

“বলল, বাবাকে খুঁজতে যাচ্ছি। তিনি নাকি হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়েছেন।”

“হরিদ্বারে কোথায় উঠেছে বলতে পারবেন?”

“বিষ্ণুঘাটের কাছে রাজস্থান গেস্ট হাউসের কথা বলেছিলাম আমি। তবে সেখানেই উঠেছে কি না জানি না। নেটে সার্চ করলে রাজস্থান গেস্ট হাউসের নম্বর পেয়ে যাবেন আপনি।”

পর্ণা আবার জিজ্ঞেস করল, “অনিরুদ্ধর ফোন নম্বরটা যদি দেন।”

“নিশ্চয়ই।”

“আরেকটা কথা, ওদের পুরোনো ম্যানেজার সদানন্দবাবু কোথায় থাকেন বলতে পারবেন?”

পার্থবাবু মাথা নেড়ে জানালেন, “তা বলতে পারব না ম্যাডাম। সে তো অনেক বছর আগের কথা। ভদ্রলোক এখনও বেঁচে আছেন কি না, কে জানে?”

“আসলে মহেন্দ্র সিদ্ধাই সম্পর্কে আর কিছু তথ্য চাই। ওঁর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললে সুবিধা হত।”

পার্থবাবু আবার মাথা নাড়লেন। অগত্যা ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পড়ল পর্ণা।

নীচে এসে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে আবার যখন সে দাঁড়াল, সন্ধ্যা নেমেছে। চারদিকে ঝলমল করছে আলোতে। রাস্তার উপর দিয়ে অনবরত হর্ন দিতে দিতে চলে যাওয়া অসংখ্য ছোটোবড়ো গাড়ি। পর্ণা মনে মনে হিসাব কষছিল, অনিরুদ্ধ যদি তার বাবাকে খুঁজতে হরিদ্বার গিয়ে থাকে, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকেও পৌঁছতে হবে সেখানে। রাতের যে-কোনো ফ্লাইটে দিল্লি পৌঁছে, সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে হরিদ্বার চলে যাবে সে। মানে কালকে সকালের মধ্যে পর্ণা পৌঁছে যাবে সেখানে। কিন্তু কলকাতা ছাড়ার আগে ম্যানেজার সদানন্দবাবুর সঙ্গে দেখা করাটা জরুরি। কোথায় খুঁজে পাবে তাকে?

পর্ণা আবার হাঁটতে হাঁটতে ঢুকল অনিরুদ্ধর বাড়ির গলিতে। স্ট্রিট লাইট জ্বলছে। রাস্তায় লোকজনের সমাগম ভালোই। এসে দাঁড়াল সেই পুরোনো বাড়িটার সামনে। তালা দেওয়া গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভিতরে একটা আলোও জ্বলছে না, পুরো অন্ধকার।

“আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?”

ঘুরে তাকাল পর্ণা। এক মধ্যবয়স্ক মহিলা।

“হ্যাঁ, মানে অনিরুদ্ধ…”

“অনি তো নেই। কোথায় গেছে জানি না। কবে ফিরবে ঠিক নেই। আমি রান্না করতাম এ-বাড়িতে। এখন অন্য ফ্ল্যাটে কাজ নিয়েছি।”

“আচ্ছা, আপনি সদানন্দবাবুকে চিনতেন? অনিরুদ্ধর বাবার ম্যানেজার ছিলেন তিনি।”

“খুব চিনি। তিনিই তো আমাকে নিয়ে এসেছিলেন এখানে। খুব ভালো মানুষ।”

কথাটা শুনেই পর্ণার ঠোঁটের কোণে একটা হাসির ঝিলিক দিয়ে গেল,“তাই নাকি! তাঁকে আমার খুব দরকার। কোথায় গেলে পাব বলতে পারেন?”

কথাটা শুনে মহিলা একটু কটমট করে তাকালেন পর্ণার দিকে,“কেন, তাঁর সঙ্গে কী দরকার?”

“সে আপনি বুঝবেন না। আপনি বরং এই টাকাটা রাখুন। আমাকে ওঁর ঠিকানাটা দিন। অনেকের জীবনমরণ সমস্যা।”

হাতে নোটগুলি পেয়ে বেশ আনন্দ হয়েছে মহিলার,“আচ্ছা, দাসবাবু থাকেন হাওড়ার শিবপুরে। তাঁর বাড়ি আমি চিনি না। একটা ফোন নম্বর আছে, কথা বলিয়ে দিচ্ছি দাঁড়ান।” বলে হাতে ঝোলা বাজারের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে একটা নম্বর খুঁজে ডায়াল করলেন,“এই যে রিং হচ্ছে। হ্যালো, দাসবাবু বলছেন? আমি মালতী। আরে সিদ্ধাইদের বাড়িতে রান্নার কাজ করতাম, আপনিই তো লাগিয়েছিলেন, মনে আছে? হ্যাঁ, আরে শুনুন না, অনি তো বেশ কিছুদিন বাড়িতে নেই। … না, ওর মনে হয় মাথার ব্যামো হয়েছে। আমাকে তিন মাসের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে দিল। তা একটি মেয়ে খুঁজতে এসেছে ওকে। হ্যাঁ, খুব সুন্দর দেখতে। আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলছে। ফোনটা ওঁকে দিচ্ছি। আপনার ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিন। এখুনি যাবে। ছেলেটার তো বাপ-মা নেই। আপনি ছাড়া আর কে আছে বলুন? যাক, পাকা কথা হলে আমাকে জানাবেন, কেমন?” এক গাল হেসে ফোনটা এগিয়ে দিল পর্ণার হাতে।

১লা এপ্রিল, ২০১৫, জ্ঞানগঞ্জ, হিমালয়

পুরু বরফের আস্তরণে ঢাকা গিরিশিরা। চূড়াটা গম্বুজের মতো নীল আকাশ ছুঁয়েছে। জনমানবহীন শ্বেতশুভ্র হিমবাহের উপর অসংখ্য ছোটোবড়ো পর্বতের সারি। শোঁ শোঁ করে হাওয়ার চাপে মাঝে মাঝে ঝড়ের মতো বরফের কুচি পাকিয়ে উঠছে। সূর্যের দিকে তাকালে তীব্রতায় ঝলসে যায় চোখ। হিমবাহ থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে এসেছেন বিস্বাদব্রহ্ম। এ-পথে মানুষের আনাগোনা নেই। সারাবছর হিমাঙ্কের নীচে থাকা এরকম জনশূন্য দুর্গম স্থানে জীবত কোনও প্রাণীকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু একটা শব্দ সেই কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছে কোথা থেকে—‘ওম!… ওমমমম… ওমমমম…’

বিস্বাদব্রহ্ম কান পেতে শুনলেন সেই আওয়াজ। বেশ কয়েক দশক পর তিনি এসেছেন এই পথে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে আসতে হয়েছে। তিনি না এলে আর কে আসত? এই গুপ্ত পথ আর কেউ জানে না। এমনকি তাঁর ছেলেও না। মুক্তিনাথের মঠ থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে শরীরে বেশ ধকল গেছে এই বয়সে। আগের মতো শক্তি তো আর নেই। বয়েস হয়েছে। চোখেও ঝাপসা দেখছেন। পাহাড়ি পথে আগে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতেন। এখন আর তা পারেন না। কিছুক্ষণ পরপর হাঁফ ধরে। জিরিয়ে নিতে হয়। তবু প্রায় গোটা উত্তর হিমালয় বিস্বাদব্রহ্মর হাতের তালুর মতো চেনা। প্রতিটা নদী, ঝরনা, শাখাপ্রশাখা, হ্রদ, জঙ্গল, গুহা, ফাটল, পশুপাখি সব চেনা। এখানেই তাঁদের পূর্বপুরুষ রাজত্ব করেছেন। জগৎ সৃষ্টির সময় বহির্বিশ্বের সঙ্গে পৃথিবীর যোগসূত্রের যে সূক্ষ্ম সাঁকো তৈরি হয়েছিল, সেই সাঁকোর দ্বারপাল হলেন বানরাজ। কোন নিয়মে পৃথিবী চলবে, সময়ের গতি কতটা ধীরে বা দ্রত হবে, কিংবা সামনে অথবা পিছনে যাবে, তা নির্ধারণ করেন বানরাজ। এখন তাঁর কার্যকাল প্রায় শেষের দিকে। চিরতরে সমাধিস্থ হবেন তিনি। মহাশূন্যে বিলীন হওয়ার আগে সেই অসীম শক্তি তিনি দিয়ে যাবেন পরবর্তী উপযুক্ত মহামানবের হাতে। এত বছরের কঠিন তপস্যা, সংগ্রাম, সাধনা, যুদ্ধ, কূটনীতি সবকিছু পেরিয়ে প্রতীক্ষা শুধু সেই দিনটার জন্য যখন তিনি আর তাঁর বংশের উত্তরসূরিরাই হবে পৃথিবীর অধীশ্বর। এ সুযোগ নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। এই অধিকার তাঁর কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু আজকে আবার উত্তর-পশ্চিম আকাশে কালো মেঘ জমছে। ছলে-বলে-কৌশলে যাদের কয়েক পুরুষ আগে বিতাড়িত করা হয়েছিল হিমালয় থেকে, তাদের বংশধর আবার উঠে এসেছে সমতল থেকে। এই যুগসন্ধিক্ষণে পুনরায় একটা শক্তিপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে তাঁদের একছত্র অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য। তাই বিস্বাদব্রহ্ম এই দুর্গম পথ অতিক্রম করে উপস্থিত হয়েছেন বানরাজের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে। বানরাজ এই গিরিশৃঙ্গের মধ্যেই কোন গোপন গুহায় ধ্যানমগ্ন। তিনি চাইলে সব সম্ভব। কিন্তু রাজি হবেন কি?

“মহারাজ, কোথায় আপনি? দেখা দিন।” হাঁটু পর্যন্ত বরফে দাঁড়িয়ে করজোড়ে প্রার্থনা করলেন বিস্বাদব্রহ্ম। নিস্তব্ধ গিরিশিরার মধ্যে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল কথাটা। “মহারাজ… মহারাজ… মহারাজ…” কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর নেই। আবার তিনি কান পাতলেন বরফের দেয়ালে। শুনতে পেলেন, ‘ওম!… ওমমমম… ওমমমম…’ অনুভব করলেন, শব্দটা আসছে আরও কিছুটা উত্তরদিক থেকে। সেদিকেই এগিয়ে গেলেন তিনি। পাহাড়ের গা দিয়ে কয়েকটা ধাপ উঠেছে উপরে। বরফের উপর পা দিয়ে তিনি এগোলেন। কিছুটা দূরে বরফের চাঙড় সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পাথর। সেখানে কান পাতলেন আবার। মন দিয়ে শুনলেন শব্দটা। অনুমান করলেন দশ পা দূরেই বরফের আস্তরণে ঢেকে আছে গুহামুখ। গাঁইতি দিয়ে বার বার আঘাত করতে লাগলেন সেখানে। ছিটকে উঠছে বরফের কুচি। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় তাঁর সামনে থেকে খসে পড়ল বরফের মোটা আস্তরণ। পাথরের গায়ে আঁকা বানরাজের বিশেষ সংকেত চিহ্ন। রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন তিনি। চোখের কোণে তৃপ্তির হাসি ঝিলিক দিয়ে গেল বিস্বাদব্রহ্মর। বরফ পুরোপুরি সরিয়ে দিতে আরও কিছুটা সময় লাগল। একটা পাথরের দরজা পড়ল সামনে। এটাকে সরানোর জন্য চাই অতিরিক্ত শক্তি যা সাধারণ মানুষের থেকে অন্তত দশগুণ। পশমের পোশাকের ভিতর থেকে একটুকরো গাছের শিকড় বের করে জিভের তলায় রাখলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে হাত জড়ো করলেন বিস্বাদব্রহ্ম। মনে মনে বারংবার উচ্চারণ করতে লাগলেন পিতার দেওয়া মন্ত্র। ধীরে ধীরে ফুলে উঠতে লাগল তাঁর শরীরের শিরা, উপশিরা, ধমনী আর পেশিগুলি। মাত্র দশ ক্ষণকাল সময় পাবেন তিনি এই শক্তি ব্যবহার করার জন্য। পাথরের দরজাটিকে চাগিয়ে বাঁদিকে ঘোরাতে হবে। খাঁজে হাত লাগালেন। দম বন্ধ করে দশ হাতির শক্তিতে চাগিয়ে ধরে সরিয়ে দিলেন এক ঝটকায়। ফাঁক হয়ে গেল দরজার একটা অংশ।

ভিতরটা অন্ধকার। কত যুগ পরে বিস্বাদব্রহ্ম পা দিলেন জ্ঞানগঞ্জের মেঝেতে। এ যেন এক অন্য পৃথিবী। বাইরে উজ্জ্বল রোদ থেকে ভিতরে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে বিস্বাদব্রহ্মের। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে শারীরিক উত্তেজনাগুলিকে স্তিমিত হতে দিলেন। তারপর আবার তাকালেন। পাহাড়ের মধ্যে প্রাকৃতিক গুহা। বহু যুগ আগে এখানে এসেছিলেন তিনি তাঁর পিতৃদেবের সঙ্গে। তখন যেন গুহাটা আরও বড়ো মনে হয়েছিল। পিছনে দরজার ফাঁক গলে আসা আলোর রেখা আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই। সামনে পাথরের বেদি ফাঁকা। এ কী! রীতিমতো অবাক হলেন বিস্বাদব্রহ্ম। আগের বারে এই বেদিতেই উপবিষ্ট ছিলেন বানরাজ। এখন বেদি ফাঁকা! অথচ ‘ওম’ শব্দটা কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত কানে এসেছে তাঁর। বেদির পিছনটা ঘন অন্ধকার। সেখানে কি দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ? দৌড়ে গেলেন সেদিকে। নাহ্‌, এ তো পাথরের স্তম্ভ। মেঝে থেকে পাথরের ছাদকে ধরে রেখেছে। অন্ধকারের মধ্যে আতিপাতি করে খুঁজলেন তিনি। কিছুই নেই। আশ্চার্য! এত দূর, এত কষ্ট করে আসা তবে কি বৃথা হল! বানরাজ কি অন্তর্হিত হয়েছেন তাহলে? কিন্তু পৃথিবীকে চালানোর মন্ত্র তো তিনি দিয়ে গেলেন না! তবে কি মহেন্দ্র… না, না। তা কী করে সম্ভব? মহেন্দ্রকে তো তিনি বন্দি করে রেখেছেন পঁচিশ বছর ধরে। সেই কারাগার থেকে বেরোনোর সাধ্য কোনও পৃথিবীবাসীর নেই। কিন্তু সিদ্ধাই বংশের শেষ প্রদীপ যে এখনও জীবিত। মহেন্দ্রর ছেলের পা পড়েছে পাহাড়ে। সে-খবর পেয়েই বিস্বাদব্রহ্ম ছুটে এসেছিলেন এখানে। এদিকে বানরাজের অন্তর্ধান, সব হিসেব গুলিয়ে দিচ্ছে। মনের মধ্যে একটা ভয়ার্ত চিন্তা পাতাল থেকে উঠে আসতে চাইছে। বহির্বিশ্বের পথ একবার ওঁর বংশের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে জন্মজন্মান্তর কাটাতে হবে এখানে। এই কদাকার, মলিন, রোগ-জীবাণু, জরা-বার্ধক্য, মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে থেকে যেতে হবে অসহায় প্রাণীদের সঙ্গে। পোকামাকড়ের মতো মরতে হবে। আহ্‌! আর সহ্য হচ্ছে না।

“কোথায় গেলেন বানরাজ?” চিৎকার করে হাঁটু মুড়ে বসে মুষ্টিবদ্ধ হাতে জোড়া আঘাত করলেন মেঝেতে।

হঠাৎ কী মনে হতে সেই পাথরের মেঝেতেই কান পেতে শুয়ে পড়লেন তিনি। ক্ষীণ একটা শব্দ কানে আসছে, ‘ওম!… ওমমমম… ওমমমম…’ তার মানে এই মেঝের নীচেও কোনও ঘর আছে। পাথরের দেয়ালে যেখানেই কান রাখছেন, তিনি শুনতে পাচ্ছেন সেই শব্দ। কিন্তু সেখানে যাওয়ার রাস্তা কোথায়? গুহার প্রতিটা কোনা, প্রতিটা অংশ পরীক্ষা করলেন। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলেন না। একমাত্র ওই পাথরের বেদিটা সরালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সেই গোপন প্রকোষ্ঠ। বেদিটাকে হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে গিয়ে দেখলেন তাঁর একার শক্তি এক্ষেত্রে নস্যি। পুনরায় এক মাসের মধ্যে শক্তিবর্ধক মন্ত্র তিনি ব্যবহার করতে পারবেন না। তাহলে উপায়?

ভেবে দেখলেন, উপায় একটা আছে। কিন্তু তার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা তাঁকে করতেই হবে। আপাতত ফিরে যেতে হবে মুক্তিনাথে। কিছুদিন পরে আবার ছেলেকে নিয়ে আসবেন। পাথরের দরজা দিয়ে বাইরে এসে দেখলেন গুহায় প্রবেশের এই পথ অরক্ষিত রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। একটু দূর পর্যন্ত খুঁজে বেশ কিছু পাথরের টুকরো জড়ো করলেন ফাঁকা মুখটার কাছে। তার উপর ঝুরো বরফ দিয়ে মুড়ে দিলেন ভালো করে। এখন সূর্য ঢলে পড়েছে দিগন্তে। একেবারে অন্ধকার নামার আগে পাহাড়ের নীচের তাঁবুতে ফিরতে হবে বিস্বাদব্রহ্মকে। দ্রুত পা চালালেন সেইদিকে।

১৯শে এপ্রিল, ২০১৫, উত্তরাখণ্ড

ভোরবেলার প্রথম বাসে উঠে পড়েছিল অনিরুদ্ধ। হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশী প্রায় সারাদিনের সফর। বাসের মাঝামাঝি জানালার ধারে একটা সিট জোগাড় করেছে সে। আগের বারেও তাই করেছিল। এতে ঝাঁকুনিটা কম লাগে। ছোটোবেলা থেকেই ওকে পাহাড় খুব টানে। এজন্যই কালিম্পংয়ে থাকতে ওর খুব ভালো লাগত। কনভেন্টটা ছিল একদম পাহাড়ের গায়ে। ঝাউবনের ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশা ওদের হোস্টেলের করিডোর ছুঁয়ে উড়ে যেত। ভিজিয়ে দিত পোশাক। বেশ মজা হত তখন। বাবা প্রায়ই পাহাড়ে যেতেন। ওঁর পুরোনো ডায়েরিগুলি পড়তে পড়তে অনি আবিষ্কার করল, যে ওদের পূর্বপুরুষরা নাকি পাহাড়ের বাসিন্দা ছিলেন। কোথায় ছিল তাদের দেশ? সে-সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু লিখে যাননি ওর বাবা। কিন্তু এই হিমালয়ের মধ্যেই কোথাও ওর পূর্বজদের আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা ভেবে মনে বড়ো প্রশান্তি হয়। বাবাও হয়তো এখানেই কোথাও আছেন। হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই খুঁজে পাবে তাঁকে। একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছে মনে। বিক্ষিপ্ত রাশি রাশি পাথর, খরস্রোতা নদী, সবুজ জঙ্গল—এসব দেখলেই মনে হয়, সে একদিন এখানেই ছিল। এই তার আঁতুড় ঘর। সে হয়তো বহু যুগ আগের কথা।

ভাগীরথী নদী ডানহাতে বরাবর বয়ে চলেছে পথের উলটোদিকে। কখনও সরু, কখনও চওড়া, কখনও কাছে বা অনেক নীচ দিয়ে। বাসের জানালার ধারের সিটে বসার এই মজা। একদৃষ্টে লক্ষ করছে নদীটিকে।

ধারাসুতে দুপুরের খাওয়া সেরে মিনিট কুড়ির বিরতির পর বাস আবার চলতে শুরু করল। বাসে কতরকম যাত্রী। কেউ টুরিস্ট, কেউ স্থানীয় বাসিন্দা, কেউ ব্যবসায়ী। এক গাড়োয়ালি বয়স্ক মানুষ পাশে বসে ঢুলতে ঢুলতে চলেছেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে সূর্য ডোবার মুখে অনিরুদ্ধকে নামিয়ে দিল দিলসোরে। বাসের কন্ডাক্টর বলে দিয়েছে, এখান থেকে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে উত্তরদিকে। উপরিকোটের মহাদেব মন্দির দিলসোর থেকে প্রায় আঠারো কিলোমিটার। অনিরুদ্ধ ভাবল, রাতটা কোথাও কাটিয়ে সকালে ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তার ও-পারে কয়েক মিটারের মধ্যেই ভাগীরথীর বরফগলা জল প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে চলেছে। গোমুখ থেকে বেরিয়ে এই পথেই এঁকে-বেঁকে এক সময় পৌঁছে যাবে কলকাতা।

পাহাড়ি গ্রামে সূর্য নেমে গেলেই ঠান্ডা আসে হু হু করে। অনিরুদ্ধ একটা ছোটোখাটো হোটেল খুঁজে মাথা গোঁজার আশ্রয় জোগাড় করে নিল। হোটেলের অল্পবয়সি ছেলেটি বেশ করিতকর্মা। উপরিকোটের মহাদেব মন্দিরের কথা জিজ্ঞেস করতে বলল, “আপনাকে চিন্তা করতে হবে না বাবুজি। ঘোড়ার বন্দোবস্ত আমি করে রাখব। আমার এক বন্ধুর ঘোড়া আছে।”

পরের দিনে শুরুটা ভালোই হয়েছিল। রোদ ঝলমলে সকাল। হোটেলের ছেলেটিই প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একদম রেডি হয়ে বাইরে এসে দিগন্তে চোখ যেতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল অনিরুদ্ধর। সে দৃশ্যপট ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ঘোড়ায় করে পাহাড়ি রাস্তায় যত উপরের দিকে উঠতে লাগল, ধীরে ধীরে প্রবেশ করল হিমালয়ের নিবিড় সৌন্দর্যের খনিতে। স্তরে স্তরে রং পরিবর্তন। মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। প্রথম ধাপে ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়, তারপরে নীলচে সবুজ, পরে ঘন নীল, একদম শেষে চোখ ধাঁধানো সাদা বরফের শৃঙ্গশ্রেণি।

বারেথি আর খারওয়ান দুটো ছোটো পাহাড়ি গ্রাম। সেগুলি ছাড়িয়ে নির্জন পথে প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে গেল অনিরুদ্ধ। ঘোড়াওয়ালা এক অল্পবয়সি ছোকরা। তার নাম জিজ্ঞেস করতে লাজুক গলায় জানাল ভীম, আর ঘোড়ার নাম নিমো। নামের সঙ্গে তার চেহারার কোনও মিল নেই। রোগাপাতলা ছেলেটার বাড়ি কাছেই এক পাহাড়ি গ্রামে। এই রাস্তায় হেঁটেও উঠতে পারত অনিরুদ্ধ। কিন্তু সময় লাগবে দ্বিগুণ। তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে মহাদেব মন্দিরে। সেখানে গিয়ে যতক্ষণ না পূর্বানন্দজির দেখা পাচ্ছে, ততক্ষণ শান্তি নেই।

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এঁকে-বেঁকে রাস্তা চলেছে। বড়ো বড়ো শাল আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। কানে আসছে পাখির ডাক। মাঝে-মাঝেই ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে বন। বারবার কেন যেন অনিরুদ্ধর মনে হচ্ছিল কে বা কারা ওকে অনুসরণ করছে। কিছুক্ষণ ছাড়া-ছাড়াই পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল সে। কেউ কোথাও নেই। গাছের আড়ালে, ঝোপের পাশে, পাথরের আড়ালে চোখ চলে যাচ্ছিল বারংবার। কিন্তু কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না ও। দু-একজন পাহাড়ি মানুষ মাথায় বোঝা নিয়ে হেঁটে গেল। আরও কিছুটা যাওয়ার পর অনেকটা দূর পর্যন্ত ঢেউ খেলানো সবুজ জমি। রোদ পড়ে একদম চকচক করছে ভেলভেটের মতো। সেখানে একপাল ভেড়া চরছে। দুজন লোক গল্প করতে করতে ধূমপানে ব্যস্ত। সবকিছুই বড়ো শান্ত, নিস্তরঙ্গ, উদ্বেগহীন। কিন্তু কোথাও যেন কিছু একটা হচ্ছে। একটা সাংঘাতিক ঝড় আসার আগে যেমন সবকিছু অতিরিক্ত শান্ত হয়ে যায়, তেমনই থমকে আছে সবকিছু।

“বাবুজী উও দেখিয়ে, হমারা গাঁও কানওয়া।” বলে ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ভীম।

এ-রাস্তায় যাত্রী রোজ রোজ আসে না। তাও যারা আসে পায়ে হেঁটে ট্রেক করে। ঘোড়া লাগে না তাদের। তাই অচেনা পথিককে দূর থেকে নিজের গ্রাম দেখিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, ভীমের ক্ষেত্রে সেটা জোটে না রোজ রোজ। তাই ওর কান এঁটো করা হাসি, চকচকে চোখ, হাত দুটো উপরে তুলে লাফিয়ে ওঠা। কিন্তু পরক্ষণেই বুকে হাত দিয়ে বসে শুয়ে পড়ল সে। বাজি ফাটার মতো বাঁদিকে পিছনের জঙ্গলে একটা আওয়াজ হল। অনিরুদ্ধ লাফ দিয়ে নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। তারপর আবার একটা ফটাস করে শব্দ। ঘোড়াটা চিঁহি করে লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল। ভীম বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়েছে। আর কোনও নড়াচড়া নেই। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাহলে কি কেউ গুলি চালাচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে থেকে? কিন্তু কেন? সেটা ভেবে বের করার আগে নিজেকে বাঁচাতে হবে। ভীমের নাকের কাছে হাত দিল অনিরুদ্ধ। শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়েছে। বেঁচে নেই সে। কিছুক্ষণ আগেই নিজের গ্রাম দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল সে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচয়েই বড়ো মায়া পড়ে গিয়েছিল। অনিরুদ্ধর চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপের আড়ালে দ্রুত লুকিয়ে পড়ল সে। কিন্তু গুলিটা চালাল কে? গ্রামের নিরীহ ছেলেটাকে মেরে কার কী লাভ? নাকি গুলিটা চলেছিল অনিরুদ্ধর জন্য? আনন্দে যখন লাফিয়ে উঠেছিল ভীম, তখন ওর পিঠে গিয়ে লাগে। লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামার পরে আবার একটা গুলি ছুটে এসেছিল। সেটা লাগে ঘোড়ার পাছায়। কিন্তু অনিরুদ্ধকে কে মারার চেষ্টা করবে এখানে? জীবনে এই প্রথম সে এখানে এল। কাউকে সে চেনে না, তাকেও চেনে না কেউ। এদিকে তাকে মারার জন্য গুলি চালাচ্ছে! যুক্তিগুলো ঠিক সাজাতে পারছে না।

সে পিঠের ব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের কোল দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। ভীম আসার সময়ে বলেছিল, আর কিছু দূর পরেই পড়বে খুরকোট। তারপর সামেশ্বর দেবতার মন্দির। বুঝতে পারছে না, সেখান পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে কি না। তবু প্রধান রাস্তা ছেড়ে পাশে জঙ্গলের মধ্যে মিশে হাঁটতে লাগল অনিরুদ্ধ। রাস্তায় কয়েকজন কাঠুরের দেখা পেয়ে ভীমের কথা জানিয়ে দিল,“একটা লাশ পড়ে আছে রাস্তার উপর।” আবার ছুটতে শুরু করল। হাঁফ ধরছে, কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছে, আবার শুরু হচ্ছে পথ চলা। সঙ্গের জল প্রায় শেষ। খাবার তেমন কিছু নেই। বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে কাঁটা ঝোপঝাড়ে আটকে ধরছে জামাপ্যান্ট। তবু হাঁটা থামানো যাবে না।

এখন বাবার তৈরি যন্ত্রটা যদি হাতে পেত অনিরুদ্ধ, তাহলে হয়তো সময়ের পিছনে গিয়ে বাঁচাতে পারত ভীমকে। সত্যিই কি সে-যন্ত্র কাজ করত? বোর্ডিং স্কুল থেকে ক্রিস্টমাসের লম্বা ছুটিতে যখন সে কলকাতায় আসত, অনেক সময়েই দেখেছে বাড়ির নীচে পিছন দিকে একটা ঘরে বসে অনেক সময়ে সারারাত বাবা খুটখাট করে কীসব যন্ত্র বানাতেন। ছোটোবেলায় সে-ঘরে ঢোকা বারণ ছিল। এতদিন পরে একটা রাতের কথা মনে পড়ছে। মাঝরাতে হঠাৎ তিনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে। তারপর অনিরুদ্ধ যখন ছুটি শেষ হতে বোর্ডিংয়ে ফিরে গেল, পরে আর বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি। হয়তো তখনই তিনি টাইম মেশিন আবিষ্কার করে ফেলেছেন। কিন্তু তিনি কি সেটা ব্যবহার করতে পেরেছিলেন কখনও? কী জানি! অনিরুদ্ধ জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল, হয়তো এমন কোনও ফ্যাক্টর ছিল যন্ত্রটির মধ্যে যে সেটাকে বিশেষ কোনও ভৌগোলিক অবস্থানে নিয়ে আসতে পারলে তবেই কাজ করবে। সেজন্যই বাবা হিমালয়ে চলে এসেছিলেন? সেই ভৌগোলিক অবস্থান কি জ্ঞানগঞ্জ? হতেও পারে। উপরিকোটের মহাদেব মন্দিরের কাছেই কি জ্ঞানগঞ্জ? নাকি সেটা হিমালয়ের আরও দুর্গম কোনও স্থানে? কেউ কি চাইছে না অনিরুদ্ধ সেখানে গিয়ে পৌঁছাক? কিন্তু তাতে কার লাভ? অনেকগুলি প্রশ্নের উত্তর তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তবে টাইম মেশিনের উপর তার কোনও লোভ নেই। সে শুধু বাবাকে খুঁজতেই এসেছে এখানে। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করবে।

১৮ই এপ্রিল, ২০১৫, কলকাতা

রাত আটটাতেই হাওড়ার শিবপুরে এই পাড়া অজানা কোন কারণে অন্ধকার হয়ে গেছে। সরু গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকবে না, তাই পাড়ার মোড় থেকে হাঁটতে শুরু করেছে পর্ণা। বাষট্টি বাই দুই নবীন সেনাপতি লেন। সব বাড়িতে নম্বর লেখা নেই। সেটা একটা বড়ো সমস্যা। একেবারেই মধ্যবিত্ত পুরোনো পাড়া। দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে পর্ণা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেল বাষট্টি বাই দুই। রঙচটা পুরোনো বাড়ি। বাইরের লোহার গেটে ঢং ঢং করে আওয়াজ করল পর্ণা। তারপর গলা উঁচিয়ে জানতে চাইল, “সদানন্দ দাস কি এ-বাড়িতেই থাকেন?”

একজন মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, “আসুন, দাদু অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য।”

ছোটো ঘর। জিনিসপত্র, পোশাক-আশাক উপচে পড়ছে। খাটের উপর লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে শুয়ে ছিলেন সদানন্দবাবু। সত্তরের কোলে বয়স। মাথার চুল পাতলা। শীর্ণ শরীরে অজস্র বলিরেখা। মহিলা একটি কাঠের টুল টেনে এসে বসতে দিলেন পর্ণাকে।

ভদ্রলোক কাঁপা গলায় বললেন, “অনিও নিরুদ্দেশ হয়েছে? ওর বাবাও তো চলে গিয়েছিল। ছেলেটা খুব ভালো। মোট্টে বিয়ে করতে চায় না। জায়গা-জমি, বাড়ি পরে কে দেখাশোনা করবে? তোমার সঙ্গে কোথায় আলাপ হল, মা?”

পর্ণা একটু গলাটা ঝেড়ে নিয়ে সরাসরি আসল বিষয়ে এল,“অনিরুদ্ধর বাবা, মানে মহেন্দ্র সিদ্ধাই একজন বড়ো মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন। মহাকাশ বিজ্ঞানী। জানেন নিশ্চয়ই? আপনি ছিলেন ওঁর ম্যানেজার। সেইজন্য কয়েকটা বিষয় একটু জানার আছে আপনার কাছ থেকে।”

“অ! তা তুমি কি পুলিশের লোক?”

“না, আমিও একজন বিজ্ঞানী। ইংল্যান্ডের এক ইউনিভার্সিটিতে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স পড়াই। মহেন্দ্রবাবুর গবেষণা নিয়ে কিছু প্রশ্ন করব আপনাকে?”

তিনি গোমড়া মুখে জানালেন, “করো! তবে আমি তেমন কিছু জানি না।”

“তিনি বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে কী নিয়ে কাজ করছিলেন আপনার মনে আছে?”

কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন মাথার উপরে ঘুরন্ত পাখার দিকে চেয়ে। সম্ভবত কিছু পুরোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলেন,“মহেন্দ্রবাবু কী নিয়ে কাজ করছিলেন তা বলতে পারব না। কারণ, ওঁর কাজের ঘরে কাউকেই ঢুকতে দিতেন না। এমনকি নিজের ছেলেকেও নয়। তবে তিনি একজন জিনিয়াস ছিলেন। টিভি-রেডিও সারানো ছিল তাঁর বাঁহাতের কাজ। পুলিশের রেডিও ট্রান্সমিটারও ঠিক করে দিতেন। আমাকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন। শুনেছি আগে বিদেশে পড়াতেন।”

পর্ণা ওঁকে থামিয়ে আবার প্রশ্ন করল, “উনি কিছু যন্ত্রপাতি তৈরি করছিলেন কি?”

“যন্ত্র? হ্যাঁ, কীসব যন্ত্রপাতি মহেন্দ্রবাবু বানাচ্ছিলেন। ওসব মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝতাম না। আমাকে যা বলতেন, তাই জোগাড় করে দিতাম। তবে অনেকরকম সার্কিট, ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম কিনে দিয়েছি। বিদেশ থেকেও অর্ডার দিয়ে অনেকরকম যন্ত্রপাতি আনাতেন। দিস্তা দিস্তা খাতায় জটিল সব অঙ্ক কষতেন রাতের পর রাত জেগে। একদিন খুব উত্তেজিত হয়ে ডেকে পাঠালেন আমাকে। বললেন, যে-কাজে হাত দিয়েছিলাম, মোটামুটি এখানের কাজ মিটে গেছে। প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা করার জন্য আমাকে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যেতে হবে। ততদিন বাড়ি-ব্যাবসা সব তোমার দায়িত্বে রইল। নিজের মনে করে দেখো। আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব। তারপর একদিন দুটো বড়ো সুটকেস নিয়ে তাঁকে হাওড়া স্টেশনে ছাড়তে গেলাম।”

“কোন ট্রেনে উঠলেন তিনি?”

“এত বছর পর সে কি মনে আছে আমার? তবে খুব সম্ভবত উত্তর ভারতের কোনও ট্রেন। কিন্তু তিনি যে একেবারে ফিরবেন না তখন কি জানতাম? একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। পরে আমরা খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছি। কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম। কোনও কাজ হয়নি।”

“উনি চলে যাবার পরে ওঁর কাজের ঘরে আর কেউ ঢুকেছিল?”

মাথা নেড়ে সদানন্দবাবু জানালেন, “না, কে ঢুকবে? আর কেনই-বা ঢুকবে? উনি চলে যাবার পরে ব্যাবসার পুরো দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওঁর অভাব কোনোদিনই পূরণ হয়নি। কাস্টমার কমতে লাগল, ধীরে ধীরে ব্যাবসা বন্ধ হয়ে গেল।”

“হুম। অনিরুদ্ধর সঙ্গে পরে আর যোগাযোগ ছিল?”

“তেমন কিছু নেই। বছরে একবার। পুজোর সময়ে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি আর কিছু হাতখরচ পাঠায় প্রতিবছর।”

পর্ণা বলল, “আমি শুনলাম সে হরিদ্বার গেছে তার বাবাকে খুঁজতে।”

“এত বছর পর সে কি খুঁজে পাবে?”

এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর দেওয়া পর্ণার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব উঠে পড়ল। গাড়ি দাঁড় করানো আছে মোড়ে। এখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট। দরজা দিয়ে যখন পর্ণা বেরিয়ে আসছে, সদানন্দবাবু পিছন থেকে হাঁক দিলেন, “এক মিনিট দাঁড়িয়ে যাও। একটা চিঠি এসেছিল মহেন্দ্রবাবুর নিরুদ্দেশ হওয়ার দু-মাসের মাথায়। কিছু লেখা নেই। কীসব আঁকিবুঁকি করা আছে শুধু। আমার হাত ব্যাগে রেখেছিলাম চিঠিটা। পরে এ-বাড়িতেই রয়ে যায়। অনিকে আর ফেরত দেওয়া হয়নি। আসলে তখন বুঝতে পারিনি তো কী লেখা, গুরুত্ব দিইনি ব্যাপারটা। মাস খানেক আগে পুরোনো বইপত্র বিক্রি করতে গিয়ে একটা ডায়েরির মধ্যে থেকে খুঁজে পেলাম চিঠিটা। হাতের কাছেই আছে। দেখো যদি কোনও মানে উদ্ধার করতে পারো।” বলে শো-কেসের কোণ থেকে হাত বাড়িয়ে টেনে নিলেন একটা উইয়ে খাওয়া চিঠি। এগিয়ে দিলেন পর্ণার হাতে।

জিনিসটা হ্যান্ড ব্যাগে পুরে দ্রুত হাঁটা দিল মেন রাস্তার দিকে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিল্লির প্লেনটা ছেড়ে যাবে। রাস্তার উপরে পর্ণার গাড়িটার পিছনেই আরেকটা কালো স্করপিও এসে দাঁড়িয়েছে। পর্ণা কলকাতায় আসা থেকে গাড়িটা অনুসরণ করে চলেছে তাকে। মুল্যাটো লোকটা অবশ্য বলেছিল, যে ওকে দুজন লোক সবসময়ে ফলো করবে। কালো কাচের ভিতরে কারা বসে আছে, বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় নেই। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, “এয়ারপোর্ট।“ সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা বেজে উঠল ওর। এই ফোন আর সিম, সবই নতুন। এরাই দিয়েছে কলকাতায় আসার পর। এই গাড়ি, ড্রাইভার, হোটেল সবকিছুই ওদের ঠিক করা। মাঝে মাঝে নিজেকে কাঠপুতলি মনে হয়। কিন্তু কিছু করারও নেই। বাবা-মাকে যতক্ষণ না ছাড়াতে পারছে, ওদের সব শর্ত মেনে নিতে হবে। ফোনটা ধরল পর্ণা।

“হ্যালো!”

মি. ড্রোগবার ভারী গলায় আওয়াজ এল—“হোয়াট নেক্সট?”

“কলকাতা থেকে দিল্লি, তারপর বাই রোড হরিদ্বার।”

“টাইম মেশিন হরিদ্বারে আছে?”

“জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারলাম মি. সিদ্ধাই টাইম মেশিন তৈরি করতে পেরেছিলেন। তবে সেটা কীভাবে কাজ করবে, সে-সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। মনে হয় না কোনও মানুষ সশরীরে টাইম ট্র্যাভেল করতে পারবে।”

“হোয়াট এভার ইট ইজ, আই ওয়ান্ট দ্যাট!” উত্তেজিত গলার শব্দটা বেশ জোরে এল।

পর্ণা আরও জানাল, “মনে হয় টাইম ট্র্যাভেল করতে হলে নির্দিষ্ট জিওম্যাট্রিক ভাইব্রেশনের প্রয়োজন পড়বে, সিদ্ধাইয়ের থিওরিতেও এ-কথা লেখা ছিল। আর সেই জিওম্যাট্রিক ভাইব্রেশন হিমালয়ের বিশেষ কোনও একটি জায়গাতে পাওয়া যাবে। সম্ভবত সেটি একটি দুর্গম কোনও স্থান। সেজন্য আমাদের অভিজ্ঞ এক্সপিডিশন টিম রেডি রাখতে হবে। ওই মেসিন অ্যাক্টিভ হবে একমাত্র সেই জায়গাতে। প্রফেসর সিদ্ধাই সম্ভবত সেখানেই নিয়ে গেছেন মেশিনটাকে।”

লোকটি আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল,“দিস ইজ অ্যা মিরাকল! আমি অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল দিল্লি পৌঁছাচ্ছি। দেখা হবে শীঘ্র।” ফোনটা কেটে গেল।

পর্ণার মনের মধ্যেও উত্তেজনার পারদ রীতিমতো চড়ছে। টাইম মেশিন, টাইম ট্র্যাভেল এসব এতদিন ছিল কল্পবিজ্ঞান গল্পের পাতায়, না-হলে জটিল থিওরির মধ্যে। সেটা যে বাস্তব হতে পারে, ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। অনিরুদ্ধ মাস দেড়েক আগে হরিদ্বার পৌঁছেছে তার বাবাকে খুঁজতে। নিশ্চয়ই কোনও সূত্র পেয়েছিল সে। এখন তার পিছনে ধাওয়া করাটাই হচ্ছে একমাত্র টার্গেট।

বিমান মাঝ আকাশে উঠে যাওয়ার পর হঠাৎ পর্ণার মনে পড়ল, সদানন্দবাবুর দেওয়া চিঠিটা তার কোটের বুক পকেটে রয়ে গেছে। কী আছে চিঠিটাতে? খামটা বের করল পর্ণা। হলুদ হয়ে যাওয়া, উইয়ে খাওয়া পঁচিশ বছরের পুরোনো একটা চিঠির খাম। ইংরাজিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কলকাতার সিদ্ধাই বাড়ির ঠিকানা। ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা ট্রেসিং পেপার বের হল। খুলতে গিয়ে ভাঁজ থেকে কেটে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার ফল। সিটের সামনে ট্রেটা খুলে নিয়ে খুব সাবধানে ভাঁজটা খুলে বিছিয়ে ধরল তাতে। কালো কালি দিয়ে আবছা কয়েকটা আঁকাবাঁকা লাইন। হিজিবিজি আঁকিবুঁকি। তার মধ্যে একটা ক্রস চিহ্ন। আর কিছুই লেখা নেই। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না পর্ণা। আবার ভাঁজ করে সেটা রেখে দিল যথাস্থানে। খামের উপর কলকাতার জিপিওর স্ট্যাম্প। আরও কয়েকটা অস্পষ্ট স্ট্যাম্প। একটা সম্ভবত দিল্লির। আর কয়েকটা নীলচে রঙের আবছা হয়ে যাওয়া ডাকটিকিট। চূড়াওলা পাহাড়ি কাঠের তৈরি ঘরের ছবি। চোখের কাছে নিয়ে গিয়ে ক্ষুদে লেখাগুলি পড়ার চেষ্টা করল পর্ণা। মনোকামোনা, গোর্খা, নেপাল, ১৯৯০। তার মানে মহেন্দ্রবাবু এই চিঠি নেপাল থেকে পাঠিয়েছিলেন। তাহলে কি নেপালের অজ্ঞাত কোনও স্থানে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন তিনি? অনিরুদ্ধ কি জানে সে-কথা? তাহলে সে উত্তরাখণ্ডে কী করছে?

মাথার মধ্যে আবার তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। পোকার মতো কিলবিল করছে অনেকগুলি প্রশ্ন। তৈরি হওয়া নতুন পোকাগুলিকে সযত্নে লালনপালন করতে করতে পরের দিন সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে পর্ণা পৌঁছে গেল হরিদ্বারে। বিষ্ণুঘাটের কাছে রাজস্থান গেস্ট হাউসের খোঁজ পেতেও বেশি সময় লাগল না। বড়ো ঘিঞ্জি শহর। অলিতে-গলিতে হাজারো মন্দির। সংকীর্ণ অলিগলি, বাজারের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। বিষ্ণুঘাটে পৌঁছানোর একটু আগে ডানহাতে পড়ল গেস্ট হাউসটি। রিসেপশনে ঢুকে ম্যানেজারকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে তিনি খাতা খুলে জানালেন, “আগের দিন ভোরে অনিরুদ্ধবাবু চেক আউট করে বেরিয়ে গেছেন।”

“কোথায় গেছেন বলতে পারবেন?”

“উত্তরকাশীর জন্য বাসের খোঁজ করছিলেন।”

“আচ্ছা, কোথা থেকে ছাড়ে উত্তরকাশীর বাস?”

“বিড়লা ঘাটের ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ও-পাড়ে বাস ডিপো।”

পর্ণা ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে দৌড় দিল বাস ডিপোর উদ্দেশ্যে। অনিরুদ্ধর ফোন নম্বরে অনেকবার চেষ্টা করেছে ধরার। কিন্তু নট রিচেবল বলছে। একটা অটো ড্রাইভারকে বলতে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পেরিয়ে পৌঁছে দিল বড়ো বাস ডিপোতে। সেখানে কয়েকজনকে প্রশ্ন করতে জানা গেল, গতকাল সকালে যে বাসটি হরিদ্বার থেকে উত্তরকাশীতে গিয়েছিল সেই বাস মিনিট দশেক আগে সবে ডিপোতে ফেরত এসেছে। পর্ণা আবার ছুটতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে বাসের কন্ডাক্টরকে খুঁজে বের করে অনিরুদ্ধর ছবি দেখাল সে,“চিনতে পারছেন এই লোকটাকে?”

ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কন্ডাক্টর উপর-নীচে মাথা নেড়ে জানালেন, “হ্যাঁ, কালকে উত্তরকাশীর আগে দিলসৌরে নামিয়ে দিয়েছিলাম এঁকে। উপরিকোটের মহাদেব মন্দিরের খোঁজ করছিলেন।”

“মহাদেব মন্দির? সেটা কোথায়?”

“দিলসৌর থেকে আঠারো কিলোমিটার উত্তরে উপরিকোট পেরিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় মহাদেব মন্দির। কালকে দিলসৌর পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। তার মানে উপরিকোটের জন্য গতকাল হয়তো বেরোতে পারেননি ভদ্রলোক। আজকে সকালে মনে হয় বেরিয়েছেন।”

পর্ণা আবার দৌড়তে শুরু করল। অনিরুদ্ধর যাওয়ার কথা নেপাল, অথচ সে উপরিকোট চলে গেছে। এটা কোনও ফাঁদ নয় তো? কেউ কি ওকে আসল রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়ে চাইছে? এখন সে কী করবে? একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। সেটাতে করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে উপরিকোটের মহাদেব মন্দির। কিন্তু শেষ আঠারো কিলোমিটার তো ট্রেকিং রুট! পৌঁছতে অনেক সময় লাগবে। খুব দেরি হয়ে যাবে না তো? তার সিক্সথ সেন্স বলছে, অনিরুদ্ধর খুব বিপদ। এদিকে অনিরুদ্ধকে ছাড়া নেপালে তার বাবাকে খুঁজে পাওয়াও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কীভাবে সাহায্য করবে তাকে? ঠিক সেই সময়েই ওর ফোনটা আবার বেজে উঠল। মি. ড্রোগবা জিজ্ঞেস করলেন, “কী খবর ওখানের?”

পর্ণা হরিদ্বারে আসার পর থেকে যা যা ঘটেছে, সব ব্রিফ করল মি. ড্রোগবাকে। তারপর বলল, “একটা গাড়ি নিয়ে আমি উপরিকোট যাচ্ছি। কিন্তু অনিরুদ্ধকে খুঁজে পেতে আরও প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা লাগবে। ততক্ষণে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

“গাড়ি নয়, টেক অ্যা কপ্টার। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সঙ্গে ট্রেন্ড লোকও থাকবে। ডোন্ট ওরি। তুমি যা বলবে, ওরা তাই করবে। এনি-হাউ অনিরুদ্ধকে রেসকিউ করো। আই উইল মিট ইউ ইন কাঠমান্ডু।”

ফোনটা আবার কেটে গেল। লোকটা আসলে কে? এত ক্ষমতা একটা মানুষের কী করে হয়?

এরপর অবশ্য পর্ণাকে বিশেষ কিছু করতে হল না। যা হওয়ার তা ঝড়ের বেগে আপনা থেকেই হয়ে চলল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটি সাদা এস.ইউ.ভি. এসে দাঁড়াল তার পাশে,“মিস দত্তা, প্লিস গেট আপ।”

গাড়িতে উঠে বসতে আরও দশ মিনিট লাগল জি.কে.ভি. হেলিপ্যাডে পৌঁছতে। সেখানে হলুদ রঙের ছোট্ট যাত্রীবাহী হেলিকপ্টার রেডি রয়েছে ওড়ার জন্য। আরও আধঘণ্টা লাগল সমস্ত কাগজপত্রের ফর্মালিটি পূরণ করতে। পর্ণাসহ আরও তিনজনের একটি টিম মাটি ছেড়ে উঠে পড়ল আকাশে। একটা জিনিস লক্ষ করল পর্ণা, টিমের সবাই সশস্ত্র ভারতীয়। চেহারা দেখে মিলিটারির লোক বলেই মনে হয়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, ওরা সবাই এক্স মিলেটারির ম্যান। এখন একটি বেসরকারি সিকিউরিটি এজেন্সির জন্য কাজ করে। একটার পর একটা পাহাড় পেরিয়ে চলল হেলিকপ্টার। এ অভিজ্ঞতা জীবনে তার কাছে এই প্রথম। কানে তালা লাগা গোঁ গোঁ আওয়াজ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উড়ছে কপ্টারটি। কখনও মনে হচ্ছে এই বুঝি ধাক্কা লেগে যাবে পাহাড়ের গায়ে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পাইলট আঙুল তুলে জানাল, “ওই যে পাহাড়ের মাথায় হলুদ রঙের টুপির মতো দেখছেন, ওটাই উপরিকোটের মহাদেব মন্দির। কিন্তু কাছাকাছি কোনও হেলিপ্যাড নেই। কপ্টার ল্যান্ড করবে কোথায়?”

“বেশ কিছুটা নীচে ফাঁকা সমতল জায়গা দেখা যাচ্ছে। ওখানেই ল্যান্ড করতে হবে। তারপর হেঁটে উঠতে হবে পাহাড়।”

১৯শে এপ্রিল, ২০১৫, উপরিকোট

কয়েকজন পাহাড়ি মানুষকে জিজ্ঞেস করে রাস্তা জেনে নিয়েছে অনিরুদ্ধ। সামেশ্বরদেবের মন্দির পর্যন্ত রাস্তাটা তবু চেনা যাচ্ছে। কিন্তু তারপর একেবারেই পাকদণ্ডি পথ। ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ঢালের উপর দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায় হলুদ রঙের মহাদেব মন্দির। একজন বয়স্ক গাড়োয়ালি পথ দেখিয়ে দিলেন। সঙ্গে কেউ একজন থাকলে বড়ো সুবিধা হত। কথা বলার লোক পাওয়া যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য ভীম হঠাৎ খুন হয়ে গেল। কিন্তু গুলিটা হয়তো চলেছিল ওকে খতম করার জন্য। ভুলবশত লেগেছে ভীমের গায়ে। গুলি যারা চালিয়েছে, তারা নিশ্চয়ই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা কি চুপ করে বসে থাকবে? মনে হয় না। গাছের আড়ালে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তারা এখনও অনুসরণ করছে অনিরুদ্ধকে। মাঝে-মাঝেই পাতার নড়াচড়া, গাছের উপর পাখি কিংবা বাঁদরের চিৎকার জানান দিচ্ছে তাদের উপস্থিতি। তারা ওত পেতে আছে শিকারি চিতার মতো। সুযোগ পেলেই হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেই সুযোগটা যতটা কম দেওয়া যায়, ততই ভালো। সেজন্য অনিরুদ্ধ মাঝে-মাঝেই নীচু হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছে। কখনও সুঁড়িপথ ছেড়ে ঢুকে যাচ্ছে পাইনের জঙ্গলে। উঁচুনীচু পাথরের গা দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে এগিয়ে চলেছে মহাদেব মন্দিরের দিকে। ওখানে গেলে কি তার বাবাকে দেখতে পাবে? পঁচিশ বছর পর চিনতে পারবে বাবাকে? বাবাও কি ওকে দেখে মনে করতে পারবেন? কত রাত জেগে কাটিয়েছে সে। একা যখন বড়ো ঘরের খাটে শুয়ে থাকত, হয়তো ঝড়জল হত বাইরে, সে বিছানাতে গুটিয়ে কেঁদেছে। কতবার অচেনা মানুষের গলা পেয়ে ছুটে গেছে, মনে হয়েছে হয়তো বাবা ফিরে এলেন। কিন্তু তিনি আসেননি। কেন আসেননি? কেন একা ফেলে রেখে চলে এসেছিলেন অনিরুদ্ধকে? কেউ কি তাঁকে ফিরে যেতে দেয়নি? তাঁকে কি কেউ আটকে রেখেছিল? না-হলে নিজের সন্তানকে মানুষ এমন করে কি ভুলে যেতে পারে? তাকে তো বাবা খুব ভালোবাসতেন। কথাগুলি ভাবতে ভাবতে জল চলে এল অনিরুদ্ধর চোখের কোণে।

পাহাড়ের মাথায় মহাদেব মন্দিরটি খুব একটা বড়ো নয়। লাল, হলুদ, গেরুয়া পতাকা উড়ছে চূড়ার মাথায়। স্থানীয় মানুষরা লাগিয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে উঠে এল মন্দিরের চাতালে। ভিতরে একটি পুজো করা শিবলিঙ্গ। তার পাশে ত্রিশূল। ছোটো ছোটো অনেক লোহার ত্রিশূল, কুঠার, তির-ধনুক সাজানো আছে শিবলিঙ্গের পিছনে। গাড়োয়ালে এটাই রীতি। কেউ কিছু মানত করলে অস্ত্রদান করে যায় শিবকে। এই প্রথার পিছনেও নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। মানত করার সময়ে লাল সুতো বেঁধে যায় লোহার গ্রিলে, সিঁড়িতে, পাথরের পিলারে।

কিন্তু মন্দিরে তো কেউ নেই। চারপাশটা বড়ো শুনশান। তবে পাহাড়ের মাথা থেকে পুরো রেঞ্জটা দেখা যাচ্ছে। সেই অপূর্ব দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না অনিরুদ্ধ। যেন ঢেউ খেলানো সবুজ ভেল্ট বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। দিগন্তে সাদা বরফে মোড়া পাহাড়ের সারি। কুচি কুচি মেঘ। মনে হয় এখানেই থেকে যাই। এর থেকে আনন্দের জায়গা বোধহয় পৃথিবীতে আর নেই।

কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে সম্বিৎ ফিরল অনিরুদ্ধর। মন্দিরের পুরোহিত কোথায় গেলেন? পূর্বানন্দজির তো এখানেই থাকার কথা। মন্দিরের পিছনে মোটা দেবদারু গাছের নীচে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর। মাথা নীচু করে সেখানে উঁকি মারল অনিরুদ্ধ। সেখানেও নেই। তবে কি কোনও কাজে বেরিয়েছেন? থাকার জায়গাটা দেখে মনে হল দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি এখানে নেই।

হাঁটতে হাঁটতে পিছন দিকে গেল সে। সেদিক দিয়েও একটা রাস্তা নেমে গেছে পাহাড়ের উলটোদিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছোটো গাছের ডাল ভাঙা। এক পায়ের জুতো পড়ে আছে উলটে। কিছুক্ষণের মধ্যে যেন কাউকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে টানতে টানতে। তাহলে কি লোকগুলো অনিরুদ্ধর আগেই পৌঁছে গেছে এখানে? ঝোপঝাড় ঠেলে কিছুটা নামতেই পাথরের পাশ থেকে একজনের পা বেরিয়ে থাকতে দেখল অনিরুদ্ধ। উপুড় হয়ে পড়ে আছেন একজন লোক। পরনে সিল্কের ধুতি। পুরোহিত! ধড়াস করে উঠল বুকটা। দৌড়ে গেল সে। গেরুয়া আলোয়ান জড়ানো, বড়ো বড়ো পাকা চুলদাড়িওলা একজন বয়স্ক মানুষ উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন। কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে তাঁকে সোজা করল অনিরুদ্ধ। বুকে গুলি লেগেছে। রক্তে ভিজে গেছে পাঞ্জাবি। এখনও শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে খুব কষ্ট করে। অনিরুদ্ধকে কাছে পেয়ে চোখ মেলে তাকালেন। মুখটা হাঁ হল একটু। পিঠের ব্যাগ থেকে দু-এক ফোঁটা অবশিষ্ট জল অনিরুদ্ধ ঢেলে দিল পুরোহিতের মুখে।

“আপনি পূর্বানন্দ মহারাজ? আমার বাবা মহেন্দ্রকে আপনি চিনতেন। মহেন্দ্র সিদ্ধাই।”

কথাটা শুনে তাঁর চোখ দুটো একটু বড়ো হয়ে উঠল। মনে হল কিছু বলতে চেষ্টা করছেন তিনি। অনিরুদ্ধ নিজের কানটা নিয়ে গেল তাঁর মুখের কাছে। অস্পষ্ট একটা শব্দ বের হল অতিকষ্টে, “মু..ক..ত.. মুক্ত…” ব্যস, তারপরেই নিথর হয়ে গেল শরীরটা।

অনিরুদ্ধ মাটির মধ্যে কয়েকটা ছায়ার নড়াচড়া দেখে যখন চোখ তুলে তাকাল, তার চারপাশে আরও কয়েকজন অচেনা লোক এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ি লোকের মতোই চেহারা সবার। তবে আধুনিক পোশাক। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। একজন মাঝবয়সি লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “কিউ আয়া ইধর?”

“আমার বাবাকে খুঁজতে।”

“কে তোর বাবা?”

“মহেন্দ্র সিদ্ধাই।”

“একশো বছর আগে সিদ্ধাইদের হিমালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জানিস না তুই? তোরা নরকের কীট। হিমালয়ে পা রাখার অধিকার তোদের নেই। গাড়োয়াল হিমালয় তোদের কাছে নিষিদ্ধ। তোর বাবা এখনও বন্দি আছে। আজীবন বন্দি থাকবে পাতালপুরীতে। কিন্তু আমি তোকে বন্দি করব না। মেরে খাদে ফেলে দেব। লাশ জন্তুরা খাবে।” বলে লোকটা কোমরের পিছনে গোঁজা পিস্তল বের করে কপালে ঠেকাল অনিরুদ্ধর।

সে একটা ঢোঁক গিলে প্রশ্ন করল, “বাবা কী করেছেন? তাঁকে কেন বন্দি করে রেখেছ তোমরা?”

লোকটা ট্রিগার টানতে গিয়েও থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য। পিস্তলটা নেমে গেল কপালের কাছ থেকে। তারপর বলল, “জ্ঞানগঞ্জের নাম শুনেছিস?”

উপর-নীচে মাথা নাড়ল অনিরুদ্ধ। লোকটা আবার মুখ খুলল, “জ্ঞানগঞ্জ হচ্ছে পৃথিবীর মাথা। বানরাজ সেখানে বসে লক্ষ রাখছেন সারা পৃথিবীর উপর। একশো বছর আগে বানরাজের কাছ থেকে সিদ্ধাইরা কালচক্রের মন্ত্র চুরি করেছিল। সেজন্যই সিদ্ধাইদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল হিমালয় থেকে। সেই মন্ত্র ব্যবহার করে এত বছর পর মহেন্দ্র কালযন্ত্র তৈরি করেছে। সেই যন্ত্র চালু করার জন্য সে আবার ফিরে এসেছে হিমালয়ে। চেষ্টা করেছিল জ্ঞানগঞ্জে প্রবেশ করার। আমরা তাকে আটকে দিয়েছি। আমার বাবা তাকে বন্দি করে রেখেছেন। বানরাজের সময় শেষ হবে কিছুদিনের মধ্যেই। সেই জায়গাতে আমার বাবা অভিষিক্ত হবেন ধরিত্রীর অধিপতি হিসেবে। স্বর্গ আর মর্ত্যের মাঝে যে সেতু আছে তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে একমাত্র আমাদের কাছে। বার্ধক্য, জরা, মৃত্যু আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।”

কথাগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝবয়সি লোকটা যখন বলছিল, অনিরুদ্ধর মনে হল, সে কোনও থিয়েটার মঞ্চের সামনে বসে আছে। মনে মনে হাসি পাচ্ছিল খুব। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এসব কথা লোকে বিশ্বাস করে? ভাবলেও অবাক লাগে। এরা বোধহয় কোনোদিন বিজ্ঞান পড়েনি। পড়লে বুঝত ওদের ধ্যানধারণা কত বস্তাপচা পুরোনো। কিন্তু এখন সেসব ওদের বোঝাতে যাওয়া বেকার। লোকটা মুহূর্তের মধ্যে চোয়াল শক্ত করে পিস্তলটা আবার তাক করল অনিরুদ্ধর কপালে। অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ভাবল, বাবা যে এখনও বেঁচে আছেন সেটা জেনে বেশ আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু তাঁকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে গেলে নিজের বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি। অতএব এখনই মরা ক্যান্সেল। ভাবার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকে মাথাটা পিস্তলের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে হাতটাকে এক হ্যাঁচকা টান দিতেই লোকটা হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়ল ঝোপের উপর। বাকি লোকগুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যখন অনিরুদ্ধকে আক্রমণ করতে গেল, পিস্তলটা হাতে নিয়ে সে গড়িয়ে গেছে পিছনের জঙ্গলে।

পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ কয়েক মিটার গড়াতে গড়াতে নেমে গেল অনিরুদ্ধ। লোকগুলো এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে উপর থেকে। কিন্তু গুলির শুধু আওয়াজই হচ্ছে। অনিরুদ্ধ তখন ওদের নাগালের বাইরে। ওদের পালের গোদাটা চেঁচাচ্ছে উপর থেকে, “যাও, পকড়কে লাও! ভাগনে না পায়।”

লোকগুলো হুড়মুড় করে নামতে শুরু করল ওর পিছনে। অনিরুদ্ধ হাতে পাওয়া নতুন যন্ত্রটি থেকে ফায়ার করার চেষ্টা করল। হল না। সেফটি লক ওপেন করে ট্রিগার টানল। একটা গুডুম করে আওয়াজ আর ঝটকা দিয়ে গুলি বের হল পিস্তল থেকে। এই প্রথম সে পিস্তল হাতে নিয়েছে জীবনে। গুলি চালাতে পিছনের লোকগুলো একটু থমকে গেছে। এই সুযোগ জঙ্গলের মধ্যে যতটা তাড়াতাড়ি পারবে লুকিয়ে পড়তে হবে। পাহাড়ের খাঁজে অনিরুদ্ধ দৌড়াতে শুরু করল। যেভাবেই হোক ওকে এখান থেকে বেরোতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে বাবাকে। হিমালয়ের যেখানেই তাঁকে বন্দি করে রাখুক, অনিরুদ্ধ ঠিক পৌঁছে যাবে।

ঢালু পাহাড়ি জমি। ঘন জঙ্গল। পাথরের খাঁজের মধ্যে দিয়ে দৌড়ানো প্রায় অসম্ভব। পিছন থেকে ছুটে আসছে লোকগুলো। ওরা সবাই পাহাড়ি মানুষ। অনিরুদ্ধর থেকে শারীরিক ক্ষিপ্রতা ওদের অনেক বেশি। ওদের চোখে ধুলো দেওয়া কি সম্ভব হবে? সে মনে মনে বলল, এদের সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে লড়তে হবে। শক্তি দিয়ে নয়। পাহাড়ের গা দিয়ে একটা মোটা গাছ উঠে গেছে। তার গায়ে পরজীবী লতানে গাছ। তার থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার নীচে একটুকরো পরিষ্কার ঘাসজমি। চট করে কয়েকটা লতা কেটে নিয়ে নিজের পিঠের ব্যাগটা বেঁধে ঝুলিয়ে দিল পাহাড়ের গা বেয়ে। ব্যাগটা গিয়ে পড়ল ঘাসজমির উপর। অনিরুদ্ধ নিজে সেদিকে না নেমে শক্ত গাছের ডাল ধরে উঠতে শুরু করল উপরদিকে। বেশ কিছুটা উঠে পাতার আড়ালে ঢাকা দিয়ে দিল নিজেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হল গাড়োয়ালি লোকগুলো। তার মধ্যে একজন চেঁচিয়ে উঠল নীচে পড়ে থাকা ব্যাগটা দেখে,“উও দেখো, নীচেসে ভাগা হ্যায়।”

“জলদি চল।”

হুড়মুড় করে তারা সবাই নামতে শুরু করল পাহাড়ের ঢালে।

মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর অনিরুদ্ধ যখন বুঝল লোকগুলো চলে গেছে, সেখান থেকে সে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগল উপরের দিকে। দৌড়াদৌড়িতে রাস্তা সব গুলিয়ে গেছে। জনমানবহীন জায়গা। পাহাড়ের গা দিয়ে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে অনেকক্ষণের চেষ্টায় একটা পায়ে চলা পথ খুঁজে পেল অনিরুদ্ধ। একটু জিরিয়ে নিয়ে শুরু হল আবার পথ চলা। সূর্যের অবস্থান দেখে আন্দাজে দিক খুঁজে নিল সে। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের উলটোদিক দিয়ে নামতে লাগল।

অন্ধকার হতে তখন আর হয়তো ঘণ্টা খানেক বাকি। দূর থেকে পাহাড়ের ও-পারে দেখতে পেল পাহাড়ি গ্রাম উপরিকোট। হ্যাঁ, এই পথেই সে এসেছিল। রাস্তাটা দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা চলে গেছে দিলসৌরের দিকে। অন্যটা গেছে উপরিকোট। কিন্তু সন্ধ্যা নেমে গেলে আর পথ চলা যাবে না। মাথা গোঁজার একটা আশ্রয় দরকার। জঙ্গলের মধ্যে ঠান্ডায় জমে বরফ হয়ে যাবে না-হলে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। খিদেও পেয়েছে। কাছকাছির মধ্যে উপরিকোটেই একমাত্র রাত কাটানোর ব্যবস্থা হতে পারে। সেদিকেই পা বাড়াল অনিরুদ্ধ। কিন্তু সে-রাস্তায় কয়েক পা যেতেই বুঝতে পারল, বিপদ ওত পেতে ছিল সেখানেই। শত্রুপক্ষ ঘিরে ধরেছে।

“বহুত ভাগ দৌড় কর লিয়া। অব সারে রাস্তে বন্ধ!”

অনিরুদ্ধর আর পালাবার পথ নেই। চারপাশে ফাঁকা জায়গা। ওদের সবার হাতেই প্রায় আগ্নেয়াস্ত্র। সবাই তাক করে আছে ওর দিকে। পালাতে গেলেই গুলি করবে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বাবার সঙ্গে আর দেখা হল না তার এ-জন্মে! শেষবারের মতো হিমালয়কে প্রণাম করার জন্য হাঁটু মুড়ে বসল। মাথাটা ঠেকাল মাটিতে। আবার গুলির শব্দ। ঘরে ফেরা পাখিদের চিৎকার। পরপর গুলি। অনিরুদ্ধ শুয়ে পড়েছে মাথায় হাত দিয়ে। কিন্তু পলকের মধ্যে পুরো ছবিটা পালটে গেল। মাথা তুলে যখন তাকাল অনিরুদ্ধ, লোকগুলো হাত-পা মুড়ে শুয়ে পড়েছে। গোঙাচ্ছে! তিনজন কালো পোশাক পরা কম্যান্ডো গোছের লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আর ইউ ওকে মি. সিদ্ধাই?”

মাথা নাড়তেই তাকে চাগিয়ে তুলে ধরল,“লেটস গো!”

“হু আর ইউ?” জানতে চাইল অনিরুদ্ধ। কিন্তু তারা কোনও উত্তর করল না।

পিছন থেকে একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বাংলায় বলল, “সব বলছি। আপনি চলুন তাড়াতাড়ি এখান থেকে। অন্ধকার হয়ে গেলে হেলিকপ্টার আর উড়বে না।”

বেশ অবাক হল অনিরুদ্ধ। এখানে বাঙালি মেয়েটা কোথা থেকে এল? চিনলই-বা কী করে তাকে? মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওই ষণ্ডামতো লোকটাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে উঠে পড়ল ওরা। মাটি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামল পাহাড়ের গায়ে।

২১শে এপ্রিল, ২০১৫, কাঠমান্ডু, নেপাল

কাঠমান্ডুর এক অভিজাত হোটেলের সুইটে ড্রয়িং প্লেসে কাউচের উপর মুখোমুখি বসে আছেন মি. ড্রোগবা, পর্ণা, অনিরুদ্ধ আর একজন নেপালি শেরপা। ঘরের পরিবেশ হিমশীতল। মোটা কাচের ও-পারে দিগন্ত রেখা বরাবর দৃশ্যমান উঁচুনীচু পাহাড়ের সারি। মি. ড্রোগবা উঠে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে দু-বার পায়চারি করলেন। মানুষটির উচ্চতা বেশি নয়, কিন্তু শারীরিক গঠন দেখে তাঁর ক্ষমতার অনুমান পাওয়া যায়। মাঝে-মাঝেই তিনি অস্থির হয়ে হাত কচলাচ্ছেন। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাও হোয়াট? জায়গাটা কোথায়? হ্যাভ ইউ গট এনি ক্লু?”

কথাটা শুনে কেউ কোনও উত্তর করল না। তিনি আরও দু-পাক পায়চারি করলেন। এবার অনিরুদ্ধর সামনে এসে গলার স্বরটা একটু চড়ালেন, “লিসন, মি. সিদ্ধাই। আপনার বাবাকে ওরা এখানেই কোথাও বন্দি করে রেখেছে। সে-কথা বিজয় নিজে মুখে জানিয়েছে আপনাকে। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি ওর পেট থেকে কথা বের করার, কিন্তু পারিনি। সে মুখ খুলছে না। অ্যান্ড টু বি ফ্র্যাঙ্ক, দিস ইজ নট মাই কান্ট্রি। তাই এখানে আমার কাজের অনেক বাধ্যবাধকতা আছে। যা-ইচ্ছা আমরা করতে পারি না। এবার আপনি বলুন সেকেন্ড ওয়ে কী। আমরা কীভাবে সেই জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারি? প্লিস সবাই একটু ভাবুন।” একবার থেমে তিনি আবার জানালেন, “আমার অফারটা কিন্তু খুব ক্লিয়ার। আই ওয়ান্ট দ্য টাইম মেশিন। সে যেভাবেই হোক। অনিরুদ্ধবাবু ওঁর বাবাকে ফেরত পাবেন। মিস পর্ণার বাবা-মাকে আমরা ছেড়ে দেব এবং আপনাদের দুজনকেই টেন মিলিয়ন ডলার গিফট দেওয়া হবে।”

অনিরুদ্ধ একটা ঢোঁক গিলে মুখ খুলল—“আমার শুধু একটা কথাই মনে পড়ছে। উপরিকোটের মহাদেব মন্দিরের সেই পুরোহিত পূর্বানন্দজি মৃত্যুমুখে বলেছিলেন ‘মু…ক…ত…’। এর কী মানে আমি জানি না।”

হঠাৎ পর্ণা লাফিয়ে উঠে বলল, “মি. ড্রোগবা, আপনার ল্যাপটপে নেপালের ম্যাপটা একবার খুলুন তো!”

ল্যাপটপটা রাখা ছিল টেবিলের উপর। সেটা নিয়ে এসে ম্যাপটা খুললেন মি. ড্রোগবা। পর্ণা পকেট থেকে বের করল সেই চিঠি যেটা সে সদানন্দবাবুর কাছ থেকে পেয়েছিল। ভিতর থেকে ট্রেসিং পেপারটা সাবধানে খুলে ম্যাপের উপর বিছিয়ে ধরল। এবার একটু ছোটোবড়ো করে উপর-নীচ ডানদিক বাঁদিক সরিয়ে ট্রেসিং পেপারটা সেট করল নেপালের ম্যাপের উপরে। তারপর সবাইকে ডেকে দেখিয়ে পর্ণা বলল, “আমার অনুমান যদি সত্যি হয়, মহেন্দ্র সিদ্ধাইকে বন্দি করা আছে মুক্তিনাথে। এই যে ওঁর হাতে আঁকা ম্যাপটা মিলে গেছে এখানে। ক্রস চিহ্ন দেওয়া জায়গাটা মুক্তিনাথ। উপরিকোটের পুরোহিত মারা যাবার আগে এটাই বলার চেষ্টা করেছিলেন অনিরুদ্ধকে।”

“মুক্তিনাথ! কী আছে এখানে?” জিজ্ঞেস করলেন মি. ড্রোগবা।

“হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রাচীন মন্দির আছে মুক্তিনাথে। হিমালয়ের কোলে চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা। একদিকে ধৌলগিরি আর অন্য দিকে অন্নপূর্ণার বিস্তৃত রেঞ্জ। পৃথিবীর উচ্চতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। তিন হাজার আটশো মিটার। জায়গাটা বুদ্ধিস্ট তন্ত্রসাধকদেরও পীঠস্থান বলে পরিচিত।” কথাগুলি বললেন এককোণে চেয়ারে বসে থাকা শেরপা লোকটি।

একটা হাসি ফুটে উঠল মি. ড্রোগবার ঠোঁটের কোণে। বললেন, “এঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। দ্য গ্রেট ক্লাইম্বার অফ হিমালয়ান রেঞ্জ, মি. ধিমাল।”

মাঝবয়সি শক্তপোক্ত লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে হাত জড়ো করে বললেন, “সঞ্জয় ধিমাল।”

“দেন লেটস গো টু মুক্তিনাথ। ধিমাল, অ্যারেঞ্জ করো তাড়াতাড়ি।”

ধিমাল জানালেন, “কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট থেকে জমসম এয়ারপোর্ট দুশো কিলোমিটার, সময় লাগবে আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো। আমাদের চাটার্ড ফ্লাইট বুক করা আছে, অতএব অসুবিধা হবে না। জমসম থেকে মুক্তিনাথ কুড়ি কিলোমিটার গাড়িতে। তারপর পাহাড়ের মাথায় দু-কিলোমিটার ট্রেক করতে হবে। আরও কয়েকজন শেরপাকে নিয়ে নিচ্ছে সঙ্গে মালপত্র বওয়ার জন্য।” ফোন করে ঝটপট কিছু নির্দেশ দিলেন তিনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের কি পাহাড়ে ট্রেক করতে হবে? যদি হয়, ট্রেকিংয়ের সরঞ্জাম কাঠমান্ডু থেকেই নিতে হবে। ওখানে কিছু পাওয়া যায় না। টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ, ট্রেকিং সুট, ওয়াকিটকি, আইস-অ্যাক্স, ক্র্যামপন, গেইটার, পিটন, রোপ, র‍্যাপল ইত্যাদি।”

“কত সময় লাগবে তোমার এগুলো জোগাড় করতে?” জানতে চাইলেন মি. ড্রোগবা।

“এক থেকে দু-ঘণ্টার মধ্যেই হয়ে যাবে। আপনারা প্যাকিং করে নিন। আমি এয়ারপোর্টে মিট করছি।” বলে গটমট করে বেরিয়ে গেলেন ধিমাল।

পর্ণা আর অনিরুদ্ধ কাঠমান্ডু মার্কেট থেকে কয়েকটা দরকারি জিনিস কিনে নিয়ে এয়ারপোর্টে এসে দেখল ছোট্ট হলুদ রঙের একটা চাটার্ড বিমান প্রস্তুত। মোট কুড়ি জনের টিম। তাঁবু, খাবারদাবার, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সব এসে গেছে নির্দিষ্ট সময়েই। সঞ্জয় ধিমাল বেশ করিতকর্মা লোক বোঝাই যাচ্ছে। তিনি ঠিক যেমনটি বলেছিলেন, প্লেন টেক-অফের পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় ওরা নেমে গেল জমসম এয়াপোর্টে। বরফে মোড়া পাহাড়গুলিকে এত কাছ থেকে দেখে মনে হচ্ছিল রাশি রাশি শিমূল তুলো ছড়ানো আছে নীচে। প্লেনের দরজা খুলে ঝাঁপ দিলে সোজা নরম তুলোর বিছানাতে গিয়ে পড়বে। পাহাড়ের কোলে কালীগণ্ডকী নদীর ধারে ছোট্ট বিমানপোত এই জমসম এয়ারপোর্ট। সেখানে প্লেন থেকে নেমে মালপত্র গাড়িতে চাপিয়ে বের হতে আরও আধঘণ্টা লাগল।

ধিমাল গাড়িতে উঠে জানালেন, “এই যে কালীগণ্ডকী রিভার দেখছেন, এখান থেকে শালগ্রাম শিলা বা নারায়ণ শিলা পাওয়া যায়। মুক্তিনাথ হল খুব প্রাচীন নারায়ণ বা বিষ্ণু মন্দির। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও কানেকশন আছে।”

মোট চাড়টে গাড়ি ছুটছে পরপর ধুলো উড়িয়ে। ফাঁকা জায়গা। শোঁ শোঁ করে শুকনো হাওয়া বইছে। জমসম থেকে রানিপাওয়া প্রায় কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা। কোথাও ধু-ধু রুক্ষ পাহাড়, কোথাও খাড়াই নদীর গা দিয়ে পাহাড় কেটে। খাগবেনি থেকে ডানদিকে বেঁকে গাড়ি ছুটল রানিপাওয়ার দিকে। এটি একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। ওই পর্যন্তই গাড়ির রাস্তা শেষ। এরপর পায়ে হেঁটে উঠতে হবে মুক্তিনাথ মন্দির।

পর্ণা বলল, “গাড়ি, মালপত্র আর বাকি শেরপারা এখানেই অপেক্ষা করুক। আমরা আগে মন্দিরটা ঘুরে আসি।”

সবাই রাজি হয়ে গেল তার কথায়। মি. ড্রোগবা, অনিরুদ্ধ, পর্ণা আর ধিমাল চললেন হাঁটতে হাঁটতে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্য পশ্চিমদিকে ধৌলগিরি পর্বতের চূড়াগুলিকে লাল রঙের তুলি দিয়ে আঁকতে বসেছে তখন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই অন্ধকার নামবে। পশ্চিম থেকে পূর্বে ধৌলগিরি আর অন্নপূর্ণার পর্বতশৃঙ্গগুলি ক্রমশ রক্তিম হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে হিমশীতল ঠান্ডার শিরশিরানি। পাথরের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে মুক্তিনাথের দরজায়। সিংহদুয়ারটা দেখা যাচ্ছে নীচে থেকেই। পথের দু-দিকে লাগানো অসংখ্য লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কাপড়ের পতাকাগুলি পতপত করে উড়ছে শীতল হাওয়ায় ভর করে। তোরণ পেরিয়ে মূল মন্দিরটির মাথায় তিন থাকের একটি কাঠের চূড়া। পর্ণা মন্দিরে ঢোকার আগে থেকেই প্রধান পুরোহিতের খোঁজ শুরু করে দিয়েছে। ধূপ, মোমবাতি, আর চমরীগাইয়ের চুরপি বিক্রি করছিলেন এক গাড়োয়ালি বৃদ্ধ। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে তিনি জানালেন, “প্রধান পুরোহিতের নাম বিস্বাদব্রহ্ম। তিনি এখন মন্দিরেই আছেন। এখুনি মন্দির বন্ধ হবে। আপনারা পা চালিয়ে যান।”

চারপাশে পাথরের বাঁধানো চাতাল। ওরা দৌড়ে গিয়ে দেখল, রঙচঙে গাড়োয়ালি পোশাক পরা এক পুরোহিত মন্দিরের দরজা বন্ধ করে চাবি দিচ্ছেন তালায়। পর্ণা তাঁর কাছে গিয়ে হিন্দিতে অনুরোধ করল, “আমরা ইন্ডিয়া থেকে আসছি। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।”

তিনি জানতে চাইলেন, “কী ব্যাপারে?”

“বিজয়ব্রহ্ম নিশ্চয়ই আপনার ছেলে?”

কথাটা শুনে বিস্ময়ের সঙ্গে ঘুরে তাকালেন তিনি,“হ্যাঁ, কেন?”

“আপনার নির্দেশে তিনি ভারতে একজনকে খুন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি।”

এ-কথাটা শুনে তিনি ধপাস করে বসে পড়লেন পাথরের উপর। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা জানলেন কী করে?”

পর্ণা উত্তর দিল, “বিজয় যাকে খুন করতে গিয়েছিল, সে এখন দাঁড়িয়ে আছে আপনার সামনে। এ হল অনিরুদ্ধ সিদ্ধাই। মহেন্দ্র সিদ্ধাইয়ের ছেলে।”

বৃদ্ধ পুরোহিতের দৃষ্টিটা ঘুরে গেল অনিরুদ্ধর দিকে। তারপর তাঁর চোখে-মুখে তৈরি হল এক অদ্ভুত আতঙ্ক। থরথর করে কাঁপছে তাঁর সারা শরীর,“ওকে নিয়ে যাও, চলে যাও এখান থেকে। সিদ্ধাইদের এ-পাহাড়ে আসা বারণ। দেবতা রুষ্ট হবেন। প্রলয় আসবে, মহা প্রলয়!”

কথাটা পাশে অন্য কয়েকজনের কানে যেতে পুরো চিত্রটা পালটে গেল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। ‘সিদ্ধাই… জয় বাবা সিদ্ধাই…’ বলতে বলতে সবাই শুয়ে পড়ে প্রণাম শুরু করল। কেউ বলল, ‘ভগবান ফিরে এসেছেন!’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোক জমা হতে শুরু করল চারপাশে। অনিরুদ্ধ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এককোণে। পর্ণা তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এসব কী হচ্ছে? কারা এরা?”

“আমি তো কিছু বুঝতেই পারছি না।” ধরা গলায় জানাল অনিরুদ্ধ।

ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। লোকেরা এসে সোজা শুয়ে পড়ছে অনিরুদ্ধর পায়ে হাত দিয়ে। ধূপ বিক্রি করা সেই বয়স্ক লোকটা এগিয়ে এসে বললেন, “ভগবানকে বসতে দাও।”

সঙ্গে সঙ্গে একটা কাঠের রাজকীয় চেয়ার এসে হাজির হল। অনিরুদ্ধকে তাতে বসিয়ে একজন সিল্কের উত্তরীয় পরিয়ে তিলক কেটে গাড়োয়ালি টুপি পরিয়ে দিল। আরেকজন পাথরের বাটি করে গরম চমরীগাইয়ের দুধ এনে হাজির,“প্রভু এটা খেয়ে নিন।”

অনিরুদ্ধ ভয়ে ভয়ে সেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে চুমুক দিল।

বেশ কিছুক্ষণ পর লোকজন একটু শান্ত হতে সে উঠে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে বলল, “আমি আমার বাবাকে খুঁজতে এসেছি এখানে। মহেন্দ্র সিদ্ধাই আমার বাবা। আপনারা চেনেন তাঁকে?”

একজন অতিবৃদ্ধ গাড়োয়ালি লোক লাঠি ঠুকে ঠুকে এগিয়ে এসে বললেন, “সিদ্ধাইরা ছিলেন এই মন্দিরের আদি পুরোহিত। তাঁরা ছিলেন যেমন জ্ঞানী, তেমনি দয়ালু আর পরোপকারী। গ্রামের মানুষ তাঁদের ভগবানের মতো ভালোবাসত। এখানের রাজাও সিদ্ধাইদের বিশ্বাস করতেন। প্রায় একশো বছর আগে বিস্বাদব্রহ্মের পূর্বপুরুষ সুতাব্রহ্ম এই মন্দিরে তীর্থ করতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সিদ্ধাইরা তাঁকে আশ্রয় দিলেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সুতাব্রহ্ম সুকৌশলে রাজার প্রিয় পাত্র হয়ে উঠলেন। তারপর সিদ্ধাইদের হঠাৎ একদিন কঠিন চর্মরোগ শুরু হল। হাত-পা সব একে একে পচে যেতে লাগল। সুতাব্রহ্ম তাঁদের কাশীতে এক বৈদ্যরাজের খোঁজ দিয়ে বললেন, তোমরা সপরিবারে সেখানে যাও। চিকিৎসা করিয়ে ভালো হয়ে গেলে ফিরে আসবে। তাঁরা কোনও উপায় না দেখে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন। এদিকে সুতাব্রহ্ম চারদিকে রটিয়ে দিলেন, ভগবানের অভিশাপে তাঁদের কুষ্ঠ হয়েছে। আসলে রোগটি কোনোভাবে সুতাব্রহ্মই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সিদ্ধাইদের মধ্যে। তাঁর লোভ ছিল যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত বিষ্ণু মন্দিরের বিশাল ঐশ্বর্য্যের উপর। তারপর শুরু হল এদের অত্যাচার। ভগবানের ভয় দেখিয়ে পয়সা আদায় করাই এদের একমাত্র নীতি। সিদ্ধাইরা আর কোনোদিন ফিরে এলেন না। গতবারে কুম্ভমেলায় গিয়ে হরিদ্বারে এক সাধুবাবার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, সময় এসেছে। ব্রহ্মদের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। এবার সিদ্ধাইরা ফিরবে।” একটু থেমে বৃদ্ধ মানুষটি অনিরুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আমরা এতদিন নিরুপায় ছিলাম। এখন আমাদের ভগবান ফিরে এসেছেন। ওই দুশ্চরিত্র, লম্পট, লোভীকে আর আমাদের পুরোহিত মানি না। এখন থেকে আবার সিদ্ধাই আমাদের পুরোহিত।”

বাকি সবাই চেঁচিয়ে উঠল, “জয় সিদ্ধাইয়ের জয়…”

অনিরুদ্ধ হতবাক হয়ে জানাল, “আমি তো পুজো করতে জানি না। আমি আমার বাবাকে খুঁজতে এসেছি এখানে। এই লোকটা আমার বাবা মহেন্দ্র সিদ্ধাইকে কোথাও বন্দি করে রেখেছে।”

একজন জোয়ান গাড়োয়ালি লোক এগিয়ে এসে বিস্বাদব্রহ্মের জামা খামচে ধরে দাঁড় করালেন,“ভালো চান তো বলে দিন মহেন্দ্র সিদ্ধাইকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, না-হলে পাহাড় থেকে এখুনি ছুড়ে ফেলে দেব নীচে।”

তিনি তখনও চুপ। এবার মি. ড্রোগবা এগিয়ে এসে বললেন, “ওঁকে বলো, ওঁর ছেলে বন্দি আছে আমাদের কাছে। যদি মহেন্দ্র সিদ্ধাইকে ফেরত দেন, তাহলে আমরাও ফেরত দেব ওঁর ছেলেকে। না-হলে ছেলেকে আর কোনোদিন খুঁজে পাবেন না।”

কথাটা ধিমাল নেপালি ভাষায় অনুবাদ করে জানিয়ে দিল। এবার কাজ হল ম্যাজিকের মতো। বিস্বাদব্রহ্ম জানালেন, “থোরাংলার কাছে একটা গুহায় বন্দি আছে মহেন্দ্র।”

“থোরাংলা কোথায়?” মি. ড্রোগবা জিজ্ঞেস করলেন।

ধিমাল জানালেন, “থোরাংলা পাস হল সতেরো হাজার সাতশো ফুট উচ্চতায় একটা গিরিপথ। বছরের বেশিরভাগ সময়ই বরফের নীচে থাকে এই থোরাংলা পাস। এই রাস্তা চলে গেছে সোজা তিব্বতের দিকে। এখানে যেতে হলে কাল ভোরবেলা বের হতে হবে। মুক্তিনাথ থেকে উত্তর অন্নপূর্ণার দিকে রাস্তা।”

সূর্য ডুবে যেতেই কনকনে ঠান্ডা নামছে তখন। অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ। পর্ণা বলল, “বেশ। এখন রাতে থাকার জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে?”

থাকার জায়গার কথা জিজ্ঞেস করতেই গ্রামের প্রধান হইহই করে উঠলেন। বললেন, “আপনারা সিদ্ধাইয়ের বন্ধু মানে আমাদের সম্মাননীয় অতিথি। থাকা-খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে না।”

থাকার জন্য আবার দু-কিলোমিটার নীচে রানিপাওয়ারে নামতে হল। অনিরুদ্ধ সিদ্ধাইকে বরণ করে নেওয়ার জন্য সেখানে নাচগানের আসর বসল। গ্রামের মধ্যে যেন একটা উৎসবের মেজাজ। পর্ণার কাছে এটা বেশ উপরি পাওনা। তবে এই নাচগানে সে মন দিতে পারছে না। বাবা-মার কথা মনে পড়ছে বার বার। হাজার হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ডে তাঁদের কোথায় লুকিয়ে রেখেছে কে জানে। মি. ড্রোগবাকে জিজ্ঞেস করলেই তিনি হেসে বলছেন, তাঁরা ভালো আছেন। যাই হোক তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল সবাই।

২২শে এপ্রিল, ২০১৫, মুক্তিনাথ, নেপাল

পরেরদিন ভোর থেকে শুরু হল হাঁটা। মুক্তিনাথের মন্দিরকে পাশ কাটিয়ে উত্তর-পূর্বদিকে রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। বিস্বাদব্রহ্মসহ গ্রামের আরও জনা তিনেক লোক ওদের পথ দেখাচ্ছে। মি. ড্রোগবা, ধিমাল, অনিরুদ্ধ, পর্ণা এবং প্রায় পনেরো জন শেরপা রয়েছে পিছনে। ওদের সঙ্গের জিনিসপত্র, পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জাম, তাঁবু, খাবারদাবার সব শেরপারা নিয়ে যাচ্ছে।

ঘণ্টা খানেক হাঁটার পরেই চারপাশের দৃশ্যটা বদলে গেল পুরোপুরি। সবুজ আর রুক্ষ পাহাড়গুলির গায়ে বরফের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। ঘাসগুলি ছোটো ছোটো হয়ে মিলিয়ে গেল পাথরের গায়ে। সবুজের আর কোনও চিহ্ন রইল না কিছুক্ষণ পর। তারপর শুরু হল বরফের উপর পথ চলা। ধিমাল জানালেন, “এটাই থোরাংলা পাস।”

প্রথমে বরফের পাতলা আস্তরণ দিয়ে শুরু হল। আরও ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর ক্রমশ মোটা হতে লাগল পায়ের নীচে বরফের স্তর। বরফের উপর চলার জন্য বিশেষ ধরনের হাঁটু পর্যন্ত স্পাইক লাগানো জুতো সঙ্গে এনেছেন ধিমাল। সেটা সবাইকে পরতে হল।

দিনের শেষে দুটো রুক্ষ খাড়াই পাহাড়ের নীচে এসে দাঁড়ালেন বিস্বাদব্রহ্ম। দুটো পাহাড়ের মাঝে একটা সরু ফাটল। তার ভিতর দিয়ে উঁচুনীচু রাস্তা। তিনি ঢুকে গেলেন ভিতরে। তারপর একে একে বাকিরা। কিছু দূর হাঁটার পর পর্ণা উপরদিকে করে তাকাতে দেখল সরু এক ফালি নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে শুধু। পাহাড়ের ফাঁকটা ধীরে ধীরে আরও সরু হচ্ছে। এবার সেই রাস্তা ফাটলের মধ্যে দুটো পাহাড় জুড়ে গিয়ে রাস্তা বন্ধ হল।

বিস্বাদব্রহ্ম এগিয়ে গিয়ে পাথারের আড়ালে থাকা একটা লোহার হাতলে চাপ দিতে সামনে একটা সুড়ঙ্গ খুলে গেল। সরে গেল পাথরের দরজা। ভিতরটা ঘন অন্ধকার। ধিমাল পিঠের ব্যাগ থেকে একটা টর্চ বের করে জ্বাললেন। দেখাদেখি শেরপারাও নিজেদের টর্চ বের করল। আলো পড়তে দেখা গেল একটা সুড়ঙ্গ নেমে গেছে নীচের দিকে। বিস্বাদব্রহ্ম এগিয়ে গেলেন। কালো পাথরের রাস্তা, কোথাও কোথাও বেশ পিচ্ছিল। চুইয়ে জল পড়ছে মাঝে মাঝে পাথরের গা দিয়ে। তবে বাইরের থেকে ভিতরের তাপমাত্রা অনেকটা বেশি। আনুমানিক পঞ্চাশ মিটার যাওয়ার পর রাস্তাটা চওড়া হয়ে বড়ো একটা প্রকোষ্ঠে পৌঁছল ওরা। সঙ্গে সঙ্গে নাকে রুমাল চাপা দিল পর্ণা। একটা ভ্যাপসা বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ ধাক্কা মারল নাকে। ধিমালের হাতের তীব্র আলো গিয়ে পড়ল ঘরের মাঝামাঝি একটা পাথরের খাঁজে, সেখানে যেন কিছু একটা নড়াচড়া করছে। এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে অনিরুদ্ধ দেখল বড়ো বড়ো চুলদাড়িওলা একজন বৃদ্ধ লোক বিড়বিড় করে প্রলাপ বকছেন। গায়ে শতচ্ছিন্ন গরমের পোশাক। জড়সড় হয়ে বসে আছেন। চুলে জটা। কিছু শুকনো বাসি রুটির টুকরো পড়ে আছে সামনে। টর্চের জোরালো আলো চোখে পড়তে অবাক চোখে তাকালেন তিনি। তারপর চোখ বন্ধ করে আরও কুঁকড়ে গেলেন। পায়ে লোহার শিকল দিয়ে বন্দি।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধ। তারপরেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল,“বাবা!”

বৃদ্ধ মানুষটির বুঝতে কিছুটা সময় লাগল। তারপর তিনিও জড়িয়ে ধরলেন ‘অনি’ বলে। দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। এতদিনের জমে থাকা আনন্দ, অভিমান, ভালোবাসা সব যেন সুনামির মতো বেরিয়ে আসছে ভিতর থেকে। বাকিরা সবাই চুপচাপ। সঙ্গে আনা ফ্লাস্কের গরম কফি, আর কিছু খাবার দিতে মহেন্দ্রবাবু খেলেন তৃপ্তি করে। কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হতে তাঁর ঠোঁটের কোণে দেখা গেল এক অনাবিল হাসি।

মি. ড্রোগবা এবার মুখ খুললেন,“নাইস টু মিট ইউ মি. সিদ্ধাই। বাবা ছেলেকে আর ছেলে বাবাকে খুঁজে পেয়ে গেল। খুবই আনন্দের কথা। এখন আমরা যেটা খুঁজতে এসেছি সেটা কোথায় পাব বলে দিন।”

মহেন্দ্র সিদ্ধাই আবার অবাক চোখে তাকালেন মি. ড্রোগবার দিকে। অনিরুদ্ধ পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে বোঝানোর চেষ্টা করল। শেষে পর্ণা এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে পাশে বসে মহেন্দ্রবাবুকে অনুরোধ করল, “আপনার তৈরি যন্ত্র এরা না পেলে অনেকের জীবন সংশয় হতে পারে। আমার বাবা-মাকেও বিদেশে বন্দি করে রেখেছে এরা। আপনার তৈরি করা টাইম মেশিন কোথায়?”

মহেন্দ্রবাবু এবার কাঁপা কাঁপা গলায় মুখ খুললেন—“কালযন্ত্র! সে-জিনিস মহা প্রলয় আনবে। আমার সারাজীবন নষ্ট হয়ে গেছে সেটা তৈরির জন্য। আমি যদি কালযন্ত্র না বানাতাম, তাহলে এখানে আসতেও হত না, আর ব্রহ্ম আমাকে বন্দিও করতে পারত না। কত বছর আমি আটকে আছি এখানে সে-হিসেব আমি নিজেও জানি না।” তাঁর গলায় আক্ষেপের সুর।

“সে-শোক আপনি ভুলে যান মি. সিদ্ধাই।” বললেন মি. ড্রোগবা,“এখন আপনি মুক্ত। আপনার ছেলেকেও খুঁজে পেয়েছেন। পুরোনো কথা ভেবে আর লাভ নেই। আমাদের পারিশ্রমিকটা এবার আপনি দিন।”

“পারিশ্রমিক?”

“হ্যাঁ, আপনার তৈরি ওই কালযন্ত্র! ওটা যেভাবেই হোক চাই আমার।”

মহেন্দ্রবাবু গলা কঠিন করে জানিয়ে দিলেন, “বিস্বাদব্রহ্ম চেয়েছিল, আমি ওকেও দিইনি। এত বছরের নির্যাতন, অপমান সহ্য করে চুপচাপ পড়ে আছি। কারণ, কালযন্ত্র মানুষকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে সবকিছু।”

“আই ডোন্ট কেয়ার!” গর্জে উঠলেন মি. ড্রোগবা,“বেশ! তাহলে আপনার ছেলের মৃত্যু দেখতে পারবেন তো চোখের সামনে?” বলে চোখে পলকে জ্যাকেটের ভিতর থেকে পিস্তল বের করে ঠেকালেন অনিরুদ্ধর কপালে।

সঙ্গে সঙ্গে ধিমালের হাতেও উঠে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র। গ্রামের লোকগুলো ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে এককোণে। মি. ড্রোগবা দাঁত শক্ত করে হুকুম দিলেন, “ভাবার জন্য তিন সেকেন্ড সময় পাবেন—এক… দুই…”

“থামুন। আমার ছেলেকে আমি চোখের সামনে মরতে দিতে পারি না। কালযন্ত্র আপনাকে দিয়ে দেব। কিন্তু কথা দিতে হবে কালযন্ত্র হাতে পেলে আমাদেরকে যেতে দেবেন এখান থেকে। সেটা চালু করার জন্য আরও দুর্গম জায়গাতে যেতে হবে আপানদের। কীভাবে চালু করবেন, আমি বলে দেব।”

“বেশ, তাই হবে।” আশ্বাস দিলেন মি. ড্রোগবা।

এরপরে তাঁর নির্দেশে ধিমাল একটা লোহা কাটার যন্ত্র এনে মহেন্দ্রবাবুর শিকল কেটে দিলেন। অনিরুদ্ধর সাহায্য নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন মহেন্দ্রবাবু। বললেন, “চলুন আমার সঙ্গে।”

যে-পথে সবাই গুহাতে ঢুকেছে, সে রাস্তা দিয়েই আবার বেরিয়ে এল বাইরে। বহু বছর পর চোখে আলো পড়তে চোখ বন্ধ করে নিলেন মহেন্দ্রবাবু। তাঁকে একটা কালো রোদচশমা আর জুতো পরিয়ে দিতে তিনি আবার হাঁটতে শুরু করলেন। বরফের উপর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অন্য পথ ধরলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর দু-মানুষ সমান উঁচু একটা গম্বুজাকৃতি পাথরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে পাথর থেকে পা গুনে কিছু মাপজোক করলেন। শেষে ড্রোগবাকে উদ্দেশ করে বললেন, “তোমার লোকেদের বলো এই জায়গার বরফটা সরাতে।”

প্রায় এক ফুট বরফ সরাতে খাঁজের মধ্যে পাথর চাপা দেওয়া একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক বেরিয়ে পড়ল। সেটাকে টেনে তোলা হল উপরে। সেটার গায়ে একটা তালা ঝুলছে বড়ো। মহেন্দ্রবাবু জানালেন, “পঁচিশ বছর আগে যন্ত্রটাকে নিয়ে আমি জ্ঞানগঞ্জের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। কিন্তু বিস্বাদব্রহ্ম সেটা জানতে পেরে যন্ত্রটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আমি ওর হাতে তুলে দিতে চাইনি। তাই এখানে পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ওরা অনেক চেষ্টা করেছে আমার মুখ থেকে কথা বের করার। কিন্তু পারেনি। আমি ওদের কাছে ধরা পড়ার আগে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম বাড়িতে।”

পর্ণা কথাটা শুনে উত্তর দিল, “এতদিন পরে সেই চিঠি আমি উদ্ধার করেছিলাম সদানন্দবাবুর কাছ থেকে। সেই সাংকেতিক ম্যাপ আমাদের রাস্তা দেখিয়েছে।”

মি. ড্রোগবা জং ধরা তালাতে দু-ফোঁটা কেমিক্যাল দিতেই কলকব্জা গলে গিয়ে খুলে গেল। স্টিলের ট্রাঙ্কটি বেশ মজবুত। সেটার ঢাকনা খুলতে দেখা গেল ভিতরে একটি গোল বলের মতো জিনিস বসানো আছে। মহেন্দ্রবাবু সেটাকে বের করে এনে বললেন, “এটা একটা হেলমেটের মতো যন্ত্র। এটাকে চালু করার আগে সূর্যের আলোয় বারো ঘণ্টা রেখে চার্জ দিতে হবে। তারপর মাথায় পরে কানের পাশে এই সুইচটা অন করে ধ্যানে বসলে আমাদের মাথার মধ্যে সমস্ত অব্যবহৃত নিউরনগুলি ধীরে ধীরে কাজ করতে শুরু করবে। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কের আশি থেকে নব্বই শতাংশ নিউরন অ্যাক্টিভ হয়ে গেলে মানুষ অতীত এবং ভবিষ্যতের ঘটনা ইচ্ছামতো দেখতে পাবে। ব্যাপারটা অনেকটা দিব্যদৃষ্টির মতো। তবে যন্ত্রটিকে অ্যাক্টিভ করতে গেলে বিশেষ একধরনের ভূগর্ভস্থ রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আনতে হবে এটাকে। পৃথিবী থেকে বের হওয়া অনেক ধরনের রেডিয়েশন পরীক্ষা করে বুঝেছিলাম, আনুমানিক ২৮ ডিগ্রি ৪৩ মিনিট উত্তর আর ৮৪ ডিগ্রি ৬৪ মিনিট পূর্ব, এই অবস্থানে হিমালয়ের মধ্যে একটি ভূগর্ভস্থ ছিদ্র আছে, সেখান দিয়েই এই বিশেষ রেডিয়েশন বের হয় পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে। এই স্থানকেই আগেকার দিনের ঋষি-মুনিরা জ্ঞানগঞ্জ বলতেন।”

“তাহলে এই যন্ত্রটা সেখানে নিয়ে যেতে হবে?” জিজ্ঞেস করলেন মি. ড্রোগবা।

মহেন্দ্রবাবু মাথা নেড়ে জানালেন, “বিস্বাদব্রহ্ম জ্ঞানগঞ্জের রাস্তা জানে। জায়গাটা হিমালচুলি পর্বতের কাছে।”

“বেশ। চলুন তাহলে, যাওয়া যাক সেখানে।”

ধিমাল জানালেন, “খুব দুর্গম রাস্তা। কোনও হেলিপ্যাড নেই। পুরোটাই হেঁটে যেতে হবে।”

মি. ড্রোগবা হেসে বললেন, “টাইম ট্র্যাভেল করার জন্য আমি পাতালেও যেতে রাজি আছি।”

২৫শে এপ্রিল, ২০১৫, দিল্লি

পর্ণা বসে ছিল দিল্লির এক হোটেলের রুমে। ওর বাবা-মাকে ছেড়ে দিয়েছেন মি. ড্রোগবা। ফোনে কথা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে। হিথরো থেকে তাঁরা আজকে সকালেই বিমানে উঠবেন দিল্লির উদ্দেশ্যে। মুক্তিনাথ থেকে কাঠমান্ডু হয়ে পর্ণার দিল্লি ফিরতে প্রায় দেড় দিন সময় লেগেছে। টিমের বাকি সবাই হিমালচুলি পর্বতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। পর্ণার মন টানছিল বাবা-মাকে দেখার জন্য। অনিরুদ্ধ আর তার বাবা মহেন্দ্র সিদ্ধাইকে মি. ড্রোগবা জোর করেই ধরে নিয়ে গেছেন জ্ঞানগঞ্জে। এই জায়গাটার কথা সে বইয়ে পড়েছিল আগে। কতটা সত্যি, কতটা কল্পনা মিশে রয়েছে তা যাঁরা গেছেন তাঁরাই জানতে পারবেন। এটা নাকি এই পৃথিবী থেকে বহির্বিশ্বে যাবার একটা শর্টকাট রাস্তা। মহেন্দ্রবাবু তাই বললেন। পর্ণার কাছে এই গোটা ব্রহ্মাণ্ড একটা গোলকধাঁধাই। পেঁয়াজের খোসার মতো যতবার একটার পর একটা স্তর ভিতরে ঢুকে ব্রহ্মাণ্ড রহস্য সমাধান করার চেষ্টা করতে যায়, ততবার সামনে একটা নতুন প্রশ্ন চলে আসে। কোটি কোটি নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে গ্যালাক্সিতে। তার মধ্যে কত কোটি গ্রহ? সেই গ্রহগুলির মধ্যে কতগুলিতে প্রাণ আছে? সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণের মধ্যে মানুষই কি একমাত্র বুদ্ধিমান যে এই ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য ভেদ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে? নাকি যারা আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধিহীন প্রাণী তারাই আসলে রক্ষা করছে জগৎকে! এত বিশাল ব্যাপ্তি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা মানুষের তৈরি ক’টা ক্ষুদ্র যান মহাকাশে পাঠিয়ে তার পরিমাপ করা বা তার সৃষ্টি রহস্য জেনে ফেলা প্রায় হাস্যকর। তবু মানুষ চেষ্টা করে যাবে। নিজের থেকে লক্ষ কোটিগুণ বড়ো ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য সে একদিন অঙ্ক কষে সমাধান করবেই।

রুমের মধ্যে টিভি চলছিল। হঠাৎ চোখটা আটকে গেল টিভির কাচে। একটা সাংঘাতিক ভূমিকম্পের খবর দেখাচ্ছে! আজকে দুপুরে পর্ণা ভূমিকম্পটা টের পেয়েছিল দিল্লিতে বসেই। টেবিল-চেয়ার নড়ে উঠেছিল হঠাৎ করে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলেছিল ব্যাপারটা। এখন খবরে দেখাচ্ছে, ভূমিকম্পের উৎসস্থল নেপালের উত্তরে হিমালচুলি পর্বতের কাছে। তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে প্রায় আট। ধ্বংস হয়ে গেছে অর্ধেক নেপাল। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে দশ হাজার। বহু সৌধ্য, বাড়িঘর, ইমারত ধুলোয় মিশে গেছে। তবে কি টাইম মেশিন চালু করার জন্যই এই ভূমিকম্প? এই প্রশ্নের উত্তর কি আর পাওয়া যাবে? হিমালচুলি পর্বতের বেশ কয়েক কিলোমিটার রেডিয়াসে কেউ বোধহয় আর বেঁচে নেই। কালযন্ত্র বোধহয় তলিয়ে গেল কালের গহ্বরে। কিন্তু পর্ণাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আবার নেপাল যেতে হবে। যেভাবেই হোক খুঁজতে হবে ওর ফেলে আসা টিমকে। আর অনিরুদ্ধকে।

অলঙ্করণ-দেবসত্তম পাল

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

adokakamikeজয়ঢাক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত পুষ্পেন মণ্ডলের থ্রিলার সংগ্রহ। ডিসকাউন্টেড দামে বিনা কুরিয়ার চার্জে দেশের সর্বত্র পেতে ছবিতে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s