গল্প

অরেলস্টাইন ক্যাস্‌ল্‌-পুষ্পেন মণ্ডল

galpoORELSTINE CASTLE-2 (3) (Small)বড়ো স্কুল লাগোয়া মাঠে গিয়ে যখন ওরা নামল তখন সূর্য অনেকটা মাথার উপরে। চারপাশে ভিড় আস্তে আস্তে জমছে। দূরে গাছেদের সারি। বেশ মনোরম পরিবেশ। সপ্তাদুয়েক আগে রবিবারের ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে মিলন স্যার বলেছিলেন, “আগামী রবিবার হরিপুরে খেলা আছে। তোমরা সবাই যাবে। সকাল ছটায় এখান থেকেই বাস ছাড়বে। আবার সন্ধ্যাবেলা বাড়ি পৌঁছাবে। সবাই বাড়ি থেকে পারমিশন চিঠি নিয়ে ঠিক সময়ে হাজির থাকবে।”    

এরকম এক দিনের আউটিং-এ রাতুল আগেও দু’বার গেছে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া, খেলা আর হইহুল্লোড়। পিকনিকের মত। বন্ধুদের সাথে খুব মজা হয়। ও তো শুনেই এক পায়ে খাড়া। তাছাড়া সতের বছরের টিমে ওর মত অলরাউন্ডার দ্বিতীয় নেই। তাই মিলন স্যার স্পেশালি ওর বাড়িতে ফোন করেছিলেন। সেদিন ভোরবেলা উঠে রেডি হয়ে ঠিক সময়ে এসে বাসে উঠে পড়ল। শিবম আর মৈনাক আসতে একটু দেরি করেছে। তাই বাস ছাড়তে আধঘণ্টা দেরি হল। জানালার ধারে বসেছিল রাতুল। পাশ দিয়ে একটা লম্বা কালো গাড়ি হুস করে চলে গেল। মনে হল লাল জামা পরা সেই লোকটা বসে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কদিন থেকেই লোকটাকে চোখে পড়ছে।

হরিপুর জায়গাটা শহরের দক্ষিণে। বেশ অনেকক্ষণ বাসে করে যেতে হয়। এদিকে অনেকটা গ্রাম্য পরিবেশ। টিফিন খেয়ে খেলা শুরু হল। ওয়ান ডে শর্ট টুর্নামেন্ট। দশ ওভার করে। একদিক থেকে ওরা ফাইনালে উঠল, আর একদিক থেকে নন্দনপুর। শেষে টসে জিতে নন্দনপুর প্রথমে ব্যাট শুরু করল।

দ্বিতীয় ওভারে দুটো চার একটা ছয় মারার পরে ক্যাপ্টেন রাতুলকে ডেকে বল করতে বলল। ভাগ্য ভালো ছিল। সেই ওভারেই দু নং আর চার নং বলে দুটো উইকেট তুলে নিল। ম্যাচটা আবার ওদের হাতে। আবার আট নং ওভারে একটা উইকেট পেল।

কিন্তু অপর পক্ষ ভালোই রান খাড়া করেছে। ওদের ব্যাটসম্যানরা সবাই ভাল। ব্যাট করার সময়ে ওপেনিং জুড়িতে ওদের সেরা দুজন ব্যাটসম্যান রাতুল আর ধীমান নামল। দ্বিতীয় ওভারেই ধীমান আউট। রাতুলকেই পুরো রানটা এবার মাথা ঠাণ্ডা করে তাড়া করতে হবে। বোলিংটা খুব টাইট করছে। ওদের আরও চারটে ব্যাটসম্যান কিছুটা বাদেই আউট হয়ে গেল।

এইবার দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরু হল। শেষ ওভারে দশ রান করতেই হবে। প্রথম দুটো বল নো রান হল। আর চারটে বল বাকি। তিন নং বলটা ফুলটস। রাতুল সোজা হুক করল। মিড উইকেটের উপর দিয়ে ছয়। প্রবল হাততালি। আর তিন বলে চার রান। চার নং বলটা স্লো দিল। ঠুকে এক রান। পরের বলে অভীক ঠুকে দৌড়ে এক রান করে রান আউট হল। আবার রাতুল ব্যাটে। বাকি এক বলে দু রান। কী করবে? ও  চোখদুটো বন্ধ করল একবার। মায়ের হাসি মুখটা মনে পড়ল। নাঃ পারতেই হবে। একটা চার অন্তত মারতেই হবে। মাঝারি পেসের বল উড়ে এলো। রাতুল বলটাকে ভালো করে দেখে সজোরে ঘুরিয়ে দিল ব্যাটটা।

galpoORELSTINE CASTLE-2 (1) (Small)‘ঠকাস’ করে একটা আওয়াজ, আর বল সোজা উড়ে গেল গ্যালারিতে। হইহই করে একটা চিৎকার। স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রাতুল দেখল চার রানে জিতে গেছে ওরা।

গ্যালারিতে যেখানে বলটা গিয়ে পড়েছিল সেদিকটা একবার ফিরে দেখল রাতুল। আর তক্ষুনি বুকটা একটু ছাঁৎ করে উঠল তার। সেখানে সেই যেন লাল জামা পরা লোকটা বসে আছে। এইখানেও পিছু পিছু এসেছে?  ঠিক দেখেছে তো রাতুল? ফের একবার তাকিয়ে দেখল সে। লোকজন তখন সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। তার মধ্যেই লোকটা হারিয়ে গেল ভিড়ে। অত আনন্দের মধ্যেও মনের মধ্যে কেমন খচখচ করছিল তার।

তারপর প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন, নাচানাচি, খাওয়া-দাওয়া, হইহুল্লোড় মিটতে দেরিই হয়ে গেল অনেকটা। বাড়িতে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিল সে। সব মিটে টিটে বাস যখন হরিপুর থেকে ছাড়ল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

ঘটনাটা ঘটল প্রায় চল্লিশ মিনিট যাওয়ার পর। হঠাৎ একটা কান ফাটানো দুম করে আওয়াজ। সঙ্গেসঙ্গেই ড্রাইভার বাসটা সাইড করিয়ে দিয়ে জানাল টায়ার ফেটেছে। 

মিলন স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “কতক্ষণ লাগবে স্টেপনি বদলাতে?”

“স্টেপনি বদলাতে বেশি সময় লাগবে না, কিন্তু স্টেপনিটাও তো পাংকচার।”

“সে কী! এত গুলো বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে এতটা রাস্তা কীভাবে যাব?”

“স্যার, এখন রাস্তা একটাই। আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। আমরা ভ্যান ডেকে একটা চাকা নিয়ে গিয়ে কাছাকাছি কোথাও থেকে সারিয়ে নিয়ে আসছি। একটু সময় লাগবে কিন্তু ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।”

“এখন পৌনে আটটা বাজে। এদের তো খিদেও পেয়ে গেছে। কখন বাড়ি পৌঁছাবে? বাড়ির লোক চিন্তা করবে। এই অন্ধকারে কতক্ষণ বসে থাকব?” মিলন স্যারের তো চিন্তায় তখন পাগল হয়ে যাবার মত অবস্থা।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা সাইকেল রিকশা জোগাড় করে ড্রাইভার আর হেল্পার চলে গেল।

ছেলেরা বাস থেকে নেমে দলে দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। স্যার বলে দিলেন যেন কেউ বেশি দূরে না যায়। রাতুল দেখল, দু দিকেই ধু ধু অন্ধকার চাষের জমি। বড়ো বড়ো গাছ আছে রাস্তার ধারে কিছুটা ছাড়া ছাড়া। জনবসতি একেবারেই নেই। উপরে কুচকুচে কালো পরিষ্কার আকাশ। তার মধ্যে মিটমিট করে জ্বলছে তারারা। কলকাতার শহরে এত সুন্দর আকাশ দেখা যায় না। সেখানে যত আকাশচুম্বী সারি সারি বাড়ি। কত আলো! তার মধ্যে আকাশের তারাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

galpoORELSTINE CASTLE-2 (2) (Small)রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের ফেলে একা বেশ অনেকটা এগিয়ে গেছে রাতুল, হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে একটা মোটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো লম্বা লোকটা। গায়ে সেই লালের উপর সাদা ফুলের ছাপ দেওয়া জামা। বরাবর ও এই জামাটাই পরে। তার মানে সে আজকে সারাদিন রাতুলকে অনুসরণ করছে। কী চায় লোকটা? গত মাসখানেক ধরে রাতুল বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছে ওকে। কখনও কফি শপে, কখনও ভোরবেলা লেকের ধারে, কখনও স্কুলের বাইরে। ওকেও যে রাতুল লক্ষ করেছে সেটা কি ও জানে?

“তোমার সাথে একটু কথা ছিল।” লোকটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল।

“আমার সাথে কী কথা? কে আপনি?”

“আমার নাম মহেন্দ্র সিংহ। কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন বলব?”

“আপনি আমার পিছু নিয়েছেন?”

“বাধ্য হয়ে। তোমার সাথে একা কথা বলাটা খুব জরুরি। কোথাও তো তোমাকে একা পাচ্ছি না। তাই পিছু নিতে হয়েছে। আজকে বাসের টায়ারটা ফাটার জন্য আমিই দায়ী। একটা চান্স নিলাম। যদি তোমার সাথে সামনাসামনি হওয়া যায়।”

“আপনি টায়ার ফাটিয়েছেন? তাহলে তো খুবই বদমায়েশ লোক আপনি!”

“হ্যাঁ, তা বলতে পার। এককালে অনেক বদমায়েশি বুদ্ধি মাথায় খেলত। এখন আর অতটা নেই।”

“আপনি স্বীকার করছেন আপনি বাজে লোক। ইচ্ছা করে এতগুলো ছেলেকে বিপদে ফেললেন। আবার বুক ফুলিয়ে বলছেন। যাক, কী বলার জন্য এসেছেন সেটা তাড়াতাড়ি বলুন।”

“তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।”

“মানে? কী বলছেন? আমি কোথায় যাব আপনার সাথে? আর কেনই বা যাব?”

“না গেলেও তো উপায় নেই। ভালোয় ভালোয় লক্ষ্মী ছেলের মত আমার সাথে গেলে আর অহেতুক জোর করতে হয় না। তাতে তোমারও মঙ্গল আর আমারও।”

“কী ব্যাপার খুলে বলুন তো। আমি যদি না যেতে চাই, আপনি আমাকে জোর করে নিয়ে যাবেন। তাও একা। কী ভেবেছেন বলুন তো আমাকে। আমি ক্যারাটেতে ব্রাউন বেল্ট, সেটা জানেন তো?”

“সে আর জানব না? দেড় মাস ধরে তোমার পিছনেই তো নাগাড়ে ঘুরছি। শরৎ বোস রোডে যেখানে তুমি ক্যারাটে শিখতে যাও সেখানে গত প্রতি রবিবারে মোট পাঁচবার ঢু মেরেছি। সেদিন হাওয়ায় উঠে রোশনকে যে ঘুরিয়ে তাইকুন্ডুর আপার কাটটা মারলে, সেটা দেখে আমিও দূর থেকে হাততালি দিয়েছি।”

“তাই নাকি! তা আমাকে নিয়ে এত টানাটানি কেন?”

“একটা ভল্টের লক খোলা যাচ্ছে না। তোমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।”

“কী! আমি কি তালা ভাঙার মেকানিক? না চোর?”

“না, এর কোনটাই নয়।”

“তাহলে?”

“তুমি হলে চাবি।”

“মানে?”

“হরিমোহন হালদারের নাম শুনেছ?”

“না। ইনি কে?”

“তোমার ঠাকুরদার বড়োভাই। যিনি জার্মানিতে থাকতেন।”

“এরকম কারো নাম তো আমি শুনিনি।”

“তিনি বার্লিনে গিয়েছিলেন কবিরাজি চিকিৎসা করার জন্য। তোমার ঠাকুরদার বাবা তখন তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। সেখানে ডেভিড অরেলস্টাইনের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। পরে একসাথে গবেষণার কাজ শুরু করেন। অরেলস্টাইন ছিলেন পোটসডামের একজন অভিজাত ধনী এবং শখের বিজ্ঞানী। তিনি তোমার দাদামশাইকে তাঁর পৈত্রিক ক্যাসেলের কিছুটার অংশীদারিত্ব দিয়েছিলেন। তোমার দাদামশাই মারা যাবার আগে উইল করে সেই সম্পত্তি তোমার বাবার নামে করে দিয়ে যান। সেখানেই তাঁদের ল্যাবরেটরি ছিল। ডেভিড অরেলস্টাইন মৃত্যুর আগে তাঁদের যাবতীয় গবেষণার তথ্য একটি ভল্টে রেখে গেছেন। এই ভল্ট বা সিন্দুকটি বিশেষ ভাবে তৈরি। এটা খোলার জন্য তাঁর এবং হালদার মশাইয়ের উত্তর পুরুষকে উপস্থিত থাকতে হবে। দুজনেরই জীবন্ত ডি.এন.এ. স্ক্যান লাগবে। তিনি নিজে বিয়ে করেন নি। সে জন্য এখন তাঁর ডি.এন.এ. তোমার বাবা বা তুমিই দিতে পার। সিন্ধুকটি যদি ভাঙার চেষ্টা করা হয় তাহলে পুরোটাই বিস্ফোরণে উড়ে যাবে। কিছুই পাওয়া যাবে না।”

“কী এমন বিশেষ তথ্য তার মধ্যে আছে, যে এত সাংঘাতিক পাসওয়ার্ড?” রাতুল জানতে চাইল।

“এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমি কিছুই জানি না। তবে বিষয়টি খুবই মূল্যবান এবং গোপনীয়। এই কাজটি করার জন্য তুমি অনেক টাকাও পাবে। তোমার বাবার সাথে আমরা অনেকবার কথা বলেছিলাম। তিনি কিছুতেই জার্মানি যেতে রাজি নন। কিন্তু ডেভিড অরেলস্টাইনের ভাইপো জেমস সেই সিন্দুক খোলার জন্য নাছোড়বান্দা। প্রয়োজনে তোমাদের পরিবারের কারো প্রাণ নিতেও পিছপা হবে না।”

“তার মানে আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?”

“হুমকি বললে কম বলা হবে। জেমসের দুটি পারিবারিক কেমিক্যাল কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক শো কোটি টাকা ব্যাঙ্কের কাছে দেনা। তাঁর ক্যাসেলটাও হয়ত নিলাম হবে। ওঁর ধারনা সিন্ধুকের মধ্যে গুপ্তধন আছে। যাতে ওঁর ভাগ্য খুলে যাবে। তাই যে কোন মূল্যে তিনি কাজটা হাসিল করবেন। এখন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি তোমাকে বোঝাচ্ছি। আমি ব্যর্থ হলে অন্য কেউ আসবে, খুনোখুনি করবে। তুমি ভেবে দেখ কোন পথে যাবে?”

রাতুল আর ভাবতে পারছে না। পৃথিবীতে বাবা-মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। তাদের যদি কিছু হয় তাহলে সে কী করে বাঁচবে? ইদানীং রাতের দিকে মাঝে মাঝে ফোন আসে। বাবা উত্তেজিত হয়ে কথা বলে। এখন মনে হচ্ছে, এই ব্যাপারেই হয়ত কথা হত। সে বলল, “এখন আমাকে কী করতে হবে?”

“আমার সাথে সোজা এয়ারপোর্ট যেতে হবে। আজকে রাতের ফ্লাইটে তোমার টিকিট কাটা আছে। ফ্লাইট টেক অফ করার পর তোমার বাড়িতে জানিয়ে দেওয়া হবে। দুপুরে যখন তোমার বাবা-মা অফিসে ছিলেন, তখন তোমার পোশাক, প্রয়োজনীয় জিনিস ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর পাসপোর্টেও আর্জেন্ট ভিসা করানো হয়ে গেছে।”

“সব কাজ সেরে রেখেছেন? এখন আমি যদি না যেতে চাই।”

“বোকার মত কথা কেন বলছ? আমরা সব আটঘাট বেঁধে তবেই নেমেছি। তোমাদের ফ্ল্যাটের ঠিক উল্টো দিকে গাঙ্গুলিরা দু সপ্তাহ ধরে রাজস্থানে বেড়াতে গেছেন। সেই ফ্ল্যাটে দুজন স্নাইপার বন্দুক নিয়ে বসে আছে। তুমি এখানে না বলবে, আর সেখানে গুলি চলবে। এই মুহূর্তে তোমার মা রান্নাঘরের জানালার সামনে রান্না করছেন।”  

রাতুল আর কিছু ভাবতে পারছে না। এর কয়েকঘণ্টার মধ্যেই চারপাশটা পাল্টে গেল হুহু করে। অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা দামী লম্বা গাড়ি এগিয়ে এলো। তাতে বসতেই দু ঘণ্টার মধ্যে দমদম এয়ারপোর্ট। তার দুঘণ্টা পরে জেট এয়ারবার্লিনে চেপে বসল সে। বিশাল বড়ো এয়ারবাস। আবুধাবি হয়ে সাড়ে তের ঘণ্টার মাথায় নামল “ফ্লুগাফেন বার্লিন টেগেল” ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। মনটা বার বার খারাপ হয়ে যাচ্ছে মায়ের কথা ভেবে। আসার সময়ে বাবা-মায়ের সাথে একবার কথাও হল না। মাকে না বলে সে কোথাও যায় না। আর এ তো একদম বিদেশ! সে কি কাজটা ঠিক করল? সেই লাল জামা পরা মহেন্দ্র সিংহ শেষ পর্যন্ত প্লেনে ওঠেনি। ওর সাথে এসেছে অন্য এক লোক। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা বডিবিল্ডারের মত চেহারা। গায়ের রঙ শ্যামলা। ছোট কালো ঘন চুল। হয়ত আফ্রিকান বা মুলাটো হবে। নাম বলল ডিফান।

এয়ারপোর্ট থেকে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে একটা বড়ো গাড়িতে উঠল তারা। এখানে সবে সকাল হচ্ছে। ঠাণ্ডাটা বেশি। রাতুল জ্যাকেট আর মাফলার বের করে পরে নিলো। ভাবল, গতকাল এই সময়ে কোচিং ক্লাব থেকে হরিপুরের জন্য বাসে উঠছিল। 

বাইরের পরিবেশ একদম আলাদা। ঝকঝকে রাস্তা ঘাট। তার পাশে সবুজ ঘাসে মোড়া লন, বাহারি গাছ, লাইট সবই সুন্দর করে সাজানো। দু’পাশে বড়ো বড়ো লম্বা লম্বা বিল্ডিং। কখনও ফ্লাইওভার আবার কখনও টানেলে রাস্তা ঢুকে যাচ্ছে। 

রাতুল বাড়িতে ফোন করার কথা বলতে ডিফান মোবাইলে ধরিয়ে দিল। মা তো ফোনটা পেয়েই কেঁদেকেটে একসা। “তুই আমাদেরকে না বলে জার্মানি চলে গেছিস?” রাতুল বুঝিয়ে বলল, “এরা ভয়ঙ্কর খারাপ লোক, এদের কথা না শুনলে আমাদের কাউকে ছাড়বে না। তাছাড়া, দু-তিনদিনের মধ্যেই আমি ফিরে আসছি। একদম চিন্তা করো না।” মা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ডিফান ফোনটা কেড়ে নিল। মাকে তো বলল যে চিন্তা কোরো না, কিন্তু ও নিজেও বুঝতে পারছে না ঘটনা কোন দিকে গড়াবে।

হাই রোডের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে মিনিট চল্লিশ যাবার পর গাড়িটা ডান দিকে সবুজে মোড়া একটা সরু রাস্তায় ঢুকে গেল। চারপাশে মোটা মোটা গাছের সারি। রাস্তার মোড়ে একটা বোর্ডের লেখায় চোখ পড়ল, “পোটসডাম”। একটা প্রাসাদের মত বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়িটা দাঁড়াল। তার সামনে লেখা “অরেলস্টাইন ক্যাসেল”।

মধ্যযুগীয় তামাটে গ্রানাইট পাথরের তৈরি ইউরোপিয়ান স্থাপত্য। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বিশাল বড়ো কাঠের দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল রাতুল। তিনতলা সমান উঁচু একতলার ছাদ, খুব লম্বা লম্বা দরজা জানালা লাগানো দু-তিনটে করিডোর পেরিয়ে ওকে একটা বড়ো ঘরে নিয়ে গেল। এত বড়ো ঘর যে ওদের কলকাতার গোটা বাড়িটাই এর মধ্যে ঢুকে যাবে। এক পাশে একটা বড়ো পাথরের পালঙ্ক। তার পাশে বড়ো বইয়ের র‍্যাক, টেবিল, চেয়ার। টেবিলের উপর দুটো ছবির ফ্রেম রাখা আছে। রাতুল কাছে গিয়ে দেখল, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইটে তোলা বহু পুরানো ছবি। একটাতে দাদুর বাবা মা আর তাঁদের দুই ছেলে। ছোট ছেলেটি রাতুলের দাদু আর বড়োটি নিশ্চয়ই হরিমোহন হালদার। তাঁকে ও কোন দিন দেখেনি। ঠাকুমার কাছে শুনেছিল দাদুর বড়োদা ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করে হিমালয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কয়েক বছর পর ফিরে অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে কবিরাজি চিকিৎসা শুরু করেন। তারপর জার্মানি পাড়ি দেন। কোটপ্যান্ট পরা পাশের ছবিটি মনে হয় তাঁর নিজের। ঝোলা গোঁফ, চাপ দাড়ি, চওড়া কপাল, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কোঁকড়ান চুল। দেখলেই বোঝা যায় বংশের সাথে মিল আছে। এই ছবিটা অল্প বয়েসেই তোলা।   

“ইওর ব্রেকফাস্ট ইজ রেডি।” আচমকা আওয়াজে পিছন ফিরে দেখল একজন বয়স্ক শ্যামলা মহিলা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। পরনে পরিচারিকার ইউনিফর্ম। “প্লিজ কাম।”

তাঁর পিছন পিছন গিয়ে একটা লম্বা হল ঘরে ঢুকল। এত লম্বা আর বড়ো খাবার টেবিল সে কখনও দেখেনি। প্রায় পঞ্চাশ জন লোক এক সাথে বসতে পারবে। অবশ্য এখানের বেশির ভাগ জিনিসই সে জীবনে প্রথম দেখছে। এত বড়ো টেবিলে সে একা খেতে বসল। অঢেল খাবার। সে সামান্য খেয়ে উঠে পড়ল। এত বড়ো বাড়ি কি ফাঁকাই পড়ে থাকে? দেয়ালের গায়ে বড়ো বড়ো ইউরোপিয়ান পেন্টিং। কত রকমের ঝাড়বাতি। সেই মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, “ক্যাসেলের এই অংশটি মিঃ হালদারের। সেই সূত্রে তুমিই এখন মালিক। স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারো। জেমস অরেলস্টাইন এখন ইউ.কে.তে আছেন। হয়ত কালকে সকালে এসে তোমার সাথে দেখা করবেন। আমার নাম মরিয়ম। যদি কিছু দরকার লাগে আমাকে বোল।”

“আচ্ছা ওনার ল্যাবরেটরিটা কি দেখা যাবে?”

“না, সেখানে কারোর যাওয়ার পারমিশন নেই। এই ক্যাসেলের নিচে একটা গোপন ঘরের মধ্যে ল্যাবরেটরি। তাছাড়া….” কী একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন মরিয়ম। রাতুল লক্ষ করল করিডোরের ওপাশ থেকে ডিফান এদিকে তাকিয়ে আছে। মহিলাটি তাকে দেখেই সরে গেলেন।

এরপর সারা দিনটা ঘুরে বেড়িয়ে কাটল তার। প্রাসাদে ঢোকার আর একটি মুখ আছে। সেদিকটা মনে হয় জেমসের। ভিতরে একতলা দোতলা মিলিয়ে অনেকগুলি ঘর। বেশিরভাগই অবশ্য তালা বন্ধ। একটা ঘরের ভিতরে বহু পুরানো অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান সমরসজ্জায় বিভিন্ন ব্যক্তির বড়ো বড়ো অয়েল পেন্টিং। বাইরে চারপাশে সুন্দর করে সাজানো বাগান। সবুজ আর রঙিন গাছগুলি সবই প্রায় অচেনা। কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে চিনার গাছ দেখেছিল। তার সাথে দু’একটার মিল আছে। পিছনদিকে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। কী সুন্দর! লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। চারিদিকে নিস্তব্ধ। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে নদীর দিক থেকে। আর একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ। মাঝে মাঝে শুধু অচেনা পাখির ডাক।

একটা বড়ো সাদা পাতাওয়ালা গাছের নীচে অনেকক্ষণ বসে রইল সে চুপ করে।

 বাড়ির কথা মনে পড়ছে। এত সুন্দর জায়গাতে এসেও মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি। প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে এরা নিয়ে তো এলো। এর পর যদি ফেরার টিকিট না দেয়? ঐ মহিলা বললেন রাতুলই এখন প্রাসাদের এক অংশের মালিক। তাহলে চিন্তা কী? বাবা-মাকে এখানে আনিয়ে নিলেই চলবে। কিন্তু বাবা-মা কি আসবে? মনে হয় না। তাছাড়া তার নিজের পড়াশোনা আছে। এখানের স্কুলে কি ওকে ভর্তি নেবে? আচ্ছা কী এমন জিনিস ঐ সিন্দুকের মধ্যে আছে যে এত গোপনীয়তা? ও লক্ষ করেছে, ডিফান সব সময়ে দূর থেকে ওকে চোখে চোখে রাখছে। হয়ত জেমস ওকে সে রকমই নির্দেশ দিয়েছে।

দুপুরে খাওয়ার পরে সেই বড়ো পালঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এক তো অচেনা জায়গা, অচেনা বিছানা, তার উপর মনের ভেতরে একটা আতঙ্ক। ঘুম যেন এসেও আসছে না। স্বপ্নের মধ্যে দাদুকে দেখতে পেল। সেই সাদাকালো ছবিটা থেকে বেরিয়ে এসে বলছেন, “পালা, পালা্‌ পালা–”

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল রাতুলের।

 অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশে। সন্ধ্যা,না রাত? হালকা পাওয়ারের মৃদু আলো জ্বলছে চারিদিকে। বাইরে করিডোরে বা বড়ো খাবার ঘরে কোথাও কেউ নেই। মূল দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ। ডিফানকেও দেখতে পেল না। এত বড়ো ক্যাসেলে ও কি এখন একা? ওকে এখানে বন্দি করে রেখে সবাই চলে গেছে! একটা ভয় জাঁকিয়ে বসছে মনের মধ্যে। বড়ো হলঘরে দেয়ালের পাশে দাঁড়ানো নাইটদের কালো ইস্পাতের বর্মগুলি যেন ওকেই লক্ষ করছে। সূর্য ডুবে যেতে ঠাণ্ডাটা আরও বেড়ে গেছে। রাতুল আবার এসে ঢুকল বড়ো ঘরে। ভাবল, উলটোপালটা চিন্তা করে ভয় না বাড়িয়ে যদি কোন বই পড়ে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। দরজা বন্ধ করে বইয়ের র‍্যাকটার দিকে এগিয়ে গেল সে।

*********

সব মিলিয়ে মনে হয় কয়েক হাজার বই রয়েছে। সবই প্রায় ইংরাজি, জার্মান, না হলে ফরাসী ভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞান অথবা রসায়নের উপরে লেখা। এসব বই ওর মাথায় ঢুকবে না। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ নীচে কোণের দিকে কয়েকটা বাংলা বইয়ের সন্ধান পেল। রবীন্দ্র রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাবলী ছাড়াও বেশ কিছু বাংলা পুরানো উপন্যাস ও আয়ুর্বেদের উপর বই আছে। এখানে আসার সময়ে দাদু নিশ্চয়ই এই বইগুলি সঙ্গে করে এনেছিলেন।

সামনের বইগুলি নামাতে একদম ভিতরের দিকে পাওয়া গেল হাতে লেখা একটা ডায়েরি। সেই ডায়েরিটা টেবিলের উপর তুলে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বসল। পাতা উলটে দেখল নিয়মিত প্রতিদিনের লেখাজোখা নেই। কখনও কোন বিশেষ কিছু ঘটনা ঘটলে সেই দিন ডায়েরি লিখেছেন, অনেকদিন ছাড়া ছাড়া। বাংলায় লেখা ছাড়াও ইংরাজি আর ডাচ ভাষায় অনেক কিছু লেখা আছে। দেখে মনে হয় সেগুলি বৈজ্ঞানিক তথ্য বা ফরমুলা।

রাতুল লেখাগুলো পড়তে আরম্ভ করল—

১৫ই মে, ১৯৫৪, বার্লিন

দেশ থেকে আসার পরে অনেক ঝড়ঝাপটার পর জার্মানির বার্লিন শহরের উইসেন্সিতে আমার নিজের ডিসপেনসারি চালু করতে পেরেছি। তবে স্বীকার করতেই হবে যে আয়ুর্বেদের উপর বিশ্বাস জার্মানদের অন্য দেশের লোকেদের তুলনায় বেশি। দেখা যাক কী লেখা আছে আমার ভাগ্যে।  

 ২রা আগস্ট, ১৯৫৫

আজকে আমার ডিসপেনসারিতে এক রোগি এসেছিলেন। নাম ডেভিড অরেলস্টাইন। দেখলেই বোঝা যায় অভিজাত রাজবংশ। বললেন তাঁর পূর্বপুরুষ নাকি পারস্যসম্রাট দ্বিতীয় ফেডরিকের আমলে বেবলসবার্গের নাইট অর্থাৎ জমিদার ছিলেন। পোটসডামে এখনও তাঁদের পৈত্রিক ক্যাসেল আছে। তাঁর মতে এলোপ্যাথি বা হোমিওপ্যাথির থেকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত এবং নির্ভরযোগ্য। ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের উপর তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। ভালোই হল, এরকম একজন জাঁদরেল মক্কেল থাকলে জার্মানিতে পসার জমতে বেশি দিন সময় লাগবে না।  

১৫ই অক্টোবর, ১৯৫৫

যতটা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক বেশি পেলাম। ডেভিড অরেলস্টাইনের যে সমস্যাটা হয়েছিল সেটা হল বদহজম থেকে পেটে ব্যথা। আমার কাছে আসার আগে ও অনেক ডাক্তারবদ্দি করেছিল। কিন্তু তেমন ফল পায়নি। আমি ওকে বিশেষ কিছু শিকড়বাকড় আর শুকনো ফলের মিশ্রণচূর্ণ জলে ভিজিয়ে প্রতিদিন সকালে খেতে বলেছিলাম। তাতে নাকি ম্যাজিকের মত ফল হয়েছে। ওর পঁচিশ বছরের পেটের সমস্যা ভ্যানিশ! এখন ওর আবদার হল, আমি যেন অনুগ্রহ করে ওর পোটসডামের ক্যাসেলে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে থাকি। রোজগারপাতির চিন্তা বলাই বাহুল্য, করতে হবে না। ইউরোপের যত ধনী ব্যক্তি আছেন সবাইকে ও চিঠি দিয়ে ওর নিজের অভিজ্ঞতা জানাবে। পেশেন্ট আগে থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে পোটসডামেই দেখা করতে আসবে। অতি উত্তম প্রস্তাব। তবে আমি এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। বলেছি ভেবে দেখব।

৩১শে জানুয়ারি, ১৯৫৬

এখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। মোটা বরফের চাদরে রাস্তাঘাট সব ঢেকে গেছে। রাতের দিকে তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই আমার পেশেন্ট সংখ্যা ভালোই বেড়েছে। এদিকে ডেভিড অরেলস্টাইন নাছোড়বান্দা হয়ে পড়েছে আমাকে পোটসডামে নিয়ে যাবে বলে। মাঝে এক সপ্তাহ গিয়ে থেকেও এলাম “অরেলস্টাইন ক্যাসেলে”। বার্লিন সেন্ট্রাল থেকে প্রায় চব্বিশ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে হাভেল নদীর তীরে মনোরম পরিবেশ। মধ্যযুগীয় বিশাল অট্টালিকা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল ডেভিডের আর একটা পরিচয় আছে, ও হল শখের অ্যালকেমিস্ট। ইউরোপের মধ্যযুগে এই অ্যালকেমির চল হয়েছিল। যদিও এর উৎপত্তি প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরে। ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রেও এর উল্লেখ আছে। তা এত বছর পরেও এদের অস্তিত্ব আছে জেনে অবাক হচ্ছি।

 

২২শে জুন, ১৯৫৬

শেষ পর্যন্ত ডেভিড আমাকে পোটসডামে এনেই ছাড়ল। আমার থেকে ও বয়েসে অনেক বড়ো হলেও সম্পর্কটা এখন বন্ধুর মত। আসলে ওর নিজের বলে কেউ নেই। এক দূর সম্পর্কের ভাই আছে। সে এক জুয়াখোর। এত বড়ো প্রাসাদ পুরোটাই ফাঁকা। পিছনের বাগানে অনেকটা জায়গায় বিভিন্ন ঔষধি গাছের চাষ করেছি। এখানে আসার সাথে সাথেই ডেভিড এদেশীয় সমস্ত সংবাদপত্রে আমার নামে বড়ো করে বিজ্ঞাপন ছেপেছে। আর তাতে ফল হয়েছে দারুণ। সকাল বিকাল ফোনের জালায় অস্থির। আমার দক্ষিণা দশগুণ করে দিয়েছি। তাতে এখানের লোকের অবশ্য কোন হেলদোল নেই।

১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২

ফেব্রুয়ারি মাসের আবহাওয়াটা এখানে সব থেকে মনোরম থাকে। হাভেল নদীর তীরে অসাধারণ পরিবেশে চেস্টনাট, চেরি, বিচ আরও কত রকমের সবুজ গাছের ছায়ায় বসে মাঝে মাঝে বাড়ির কথা মনে পড়ে। আমাদের গ্রামের সরু মাটির রাস্তা, বাঁশবন, শীতলাতলা, চড়কতলা, যেখানে আমি, ভাই আর বন্ধুদের সাথে মজা করতাম। কবে ফিরব দেশে কে জানে? এখন তো কাজের চাপে নিজের জন্যও সময় পাইনা। পেশেন্ট দেখা ছাড়াও আমাকে ডেভিডের সাথে গবেষণার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই ক্যাসেলের নিচে একটা গুপ্ত ঘরের মধ্যে ওর ল্যাবরেটরি। এ যেন আগুন নিয়ে খেলা। ডেভিড এই মাসেই উইল করে আমাকে এই ক্যাসেলের এক অংশের অধিকার আইনত দিয়ে দিয়েছে। যাতে আমি আর কোনদিন এই জাল কেটে বেরোতে না পারি। 

২৫শে অক্টোবর, ১৯৬৫

রোগি দেখা শিকেয় উঠেছে। এখন শুধু সারাদিন ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজ চলছে। এই ডাইয়েরিটাও অনেকদিন পরে খুঁজে পেলাম। অ্যালকেমি মানে হচ্ছে অপ-রসায়ন। বিজ্ঞান আর অপ-বিজ্ঞানের মিশ্রণ। হাজার রকম রাসায়নিক পদার্থের সাথে লাগে মৌলিক ধাতু, শিকড়বাকড়, জড়িবুটি, বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর হাড় ও রক্ত, মন্ত্রতন্ত্র, প্রেতাত্মা, ব্ল্যাক ম্যাজিক আর বহু রকমের বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম। একাদশ শতকের বিখ্যাত ইউরোপিয়ান অ্যালকেমিস্ট সেন্ট এন্সেলেমের একটা গবেষণাপত্রের অনুকরণে আমরা বয়েস কমানোর পদ্ধতি আবিষ্কারের কাছাকাছি এসে গেছি। আর মাত্র কয়েকটা ধাপ বাকি। আমার সঙ্গে আনা সংস্কৃত ভাষায় “কাকাসন্ধি কল্পতন্ত্র” আর “গোরক্ষ সংহিতা” বই দুটি অনেক কাজে লাগল। এখন মনে হচ্ছে আমাকে এখানে নিয়ে আসার পিছনে আসলে ডেভিডের এই গবেষণার উদ্দেশ্যই মুখ্য ছিল।

১লা জানুয়ারি, ১৯৬৭

সারা পৃথিবী যখন বর্ষবরণের উৎসবে মেতে উঠেছে, তখন আমার মৃত্যুঘণ্টা আমি শুনতে পাচ্ছি। আসলে একটা বহু প্রাচীন প্রবাদবাক্য আমি অগ্রাহ্য করেছিলাম, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”। যাক এখন তো আর কিছু করার নেই। মাকড়শা এখন তার জাল গুটাচ্ছে। ডেভিড ওর বয়স কমানোর জন্য আমাকে বলির পাঁঠা করতে চলেছে। সেন্ট এন্সেলেমের থিওরি অনুযায়ী একটি বিশেষ অমাবস্যার রাতে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত খাঁটি ভারতীয় প্রাণের বিনিময়ে তার সম্ভাব্য বয়স নিজের সাথে জুড়ে নেওয়া যায়। ডেভিড সেটাই করতে চলেছে। ডেভিডের বর্তমান বয়েস ষাট, আয়ু বাকি আছে আনুমানিক কুড়ি বছর। আর আমার এখন চল্লিশ, আরও আনুমানিক চল্লিশ বছর বাঁচব। এই পদ্ধতিতে ডেভিড আরও প্রায় ষাট বছর ধরে তার বয়েস একই জায়গায় ধরে রাখতে পারবে। আবার যখন দরকার হবে তখন কোন অল্পবয়সি ভারতীয় ছেলেকে জোগাড় করতে পারলে, পুনরায় বয়েস কমে যাবে। শুধু বৈশিষ্ট্যগুলি আমার সাথে মিলতে হবে। যেমন, কোঁকড়ান কালো চুল, চওড়া কপাল, কানের লতিটা জোড়া আর থুতনিতে তিল।

এই পর্যন্ত পড়ে রাতুলের গা হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। কারণ এই সবক’টা বৈশিষ্ট্য তারও রয়েছে। সে আর কিছু ভাবতে পারছিল না। বাঁচার কোন রাস্তা নেই। সিন্ধুক, গুপ্তধন সবটাই গল্প। আসল সত্যিটা অনেক বেশি ভয়ানক। শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল তার। 

কখন ক্লান্ত চোখে ঘুম এসে গেছে সে নিজেই টের পায় নি। টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ দরজায় দুম দুম আওয়াজ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ল সে। দরজা খুলে দেখল ডিফান ডাকতে এসেছেন।

“গুড ইভনিং, ইয়োর ডিনার ইজ রেডি। প্লিজ কাম।”

টেবিলে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন একজন অভিজাত চেহারার বয়স্ক জার্মান। “হ্যালো, মাস্টার রাতুল। আমি জেমস অরেলস্টাইন। খুবই দুঃখিত সকালে তোমাকে রিসিভ করতে পারিনি। একটা বিশেষ কাজে বাইরে ছিলাম। ওয়েলকাম টু জার্মানি, ওয়েলকাম টু ইয়োর হোম।”

রাতুল হেসে বলল, “ধন্যবাদ মিঃ অরেলস্টাইন।”

খাবার খেতে খেতে কথা হল। জেমস বললেন, “আমরা খাওয়া শেষ করে ল্যাবরেটরিতে যাব। আধঘণ্টার কাজ। তারপর ডিফান তোমাকে কালকে সকালে এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে প্লেনে তুলে দেবে। এই তোমার টিকিট। অবশ্য তুমি যদি মনে করো তাহলে কিছুদিনের জন্য বা পাকাপাকি ভাবে এখানে থেকে যেতে পারো।”

রাতুল ঠোঁটের কোণে হাসিটা বজায় রেখে বলল, “আগে আপনার কাজটা তো হোক। যার জন্য এত দূর থেকে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে আসলেন।” মুখে বলল বটে, কিন্তু মনের মধ্যে সাহসটা ঠিক দানা বাঁধছে না। একটা দুশ্চিন্তার ঝড় সব কিছু ওলটপালট করে দিচ্ছিল তার।

 কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জেমস বললেন, “হ্যাঁ সেটা তো হবেই।”

ল্যাবরেটরিতে ঢোকার রাস্তাটা ভারি অদ্ভুত। রাতুল যে ঘরটায় ছিল তার ঠিক পাশের তালাবন্ধ ঘরের মধ্যে ঢুকে প্রথমে সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলার একটা ঘরে যাওয়া হল। সেই ঘরের পাথরের খাটের পাশে একটা হাতল ঘোরাতে খাটটা সরে গেল। একটা গোল ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে পাতালে। পিছন পিছন ডিফানও এলো। অন্ধকার ঘরে নেমে প্রথমে সব কটা মশালে আলো জ্বালল। রাতুল দেখল এ ঘরে মেঝের মাঝখানে একটা বড়ো চৌবাচ্চা। তাতে কী একটা ঘন লালচে তরল পদার্থ ভর্তি। চারিদিকে রাসায়নিক জার, ফানেল, টিউব, বার্নার, ফ্লাস্ক। আর দেয়ালে একটা কাচের বাক্সে মানুষের কঙ্কাল সাজানো আছে।

“সিন্দুকটা কোথায়?” রাতুল প্রশ্ন করল।

“কীসের সিন্দুক?”

“যেটা খোলার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে আসা হল।”

“তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে তোমার গ্রান্ডফাদারের একটা অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার জন্য।”

“মিথ্যা কথা, মিঃ ডেভিড অরেলস্টাইন, আমাকে ভুল বুঝিয়ে এখানে আনা হয়েছে।” রাতুল চোখে চোখ রেখে বলল কথাটা। ভাবল এখন আর ভয় করে লাভ নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

“ডেভিড অরেলস্টাইন! তিনি তো মারা গেছেন পঁচিশ বছর আগে। আমি তাঁর ভাইপো জেমস।”

“না মিঃ অরেলস্টাইন। আপনি মারা যাননি। তবে জেমস আর তার পরিবারকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেছিলেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। কিন্তু আমার দাদুর চিকিৎসায় জেমস ভালো হয়ে যায়। আর আপনি আমার দাদুকে হত্যা করে তাঁর আয়ুটা নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে ছিলেন। এখন সেটাই আবার আমার সাথে করতে যাচ্ছেন?”

“এসব তুমি জানলে কী করে? আর এখন জেনেই বা লাভ কী? মরতে তো তোমাকে হবেই। তোমার দাদুর মত। হা হা হা। ঐ দেখ দেয়ালে তার কঙ্কাল ঝোলান আছে। ডিফান ধর ওকে। ওই টেবিলের উপর হাত পা বেঁধে শুইয়ে দে।”

ডিফান এগিয়ে আসতেই রাতুল একটু ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। পিছনে চৌবাচ্চাটা এক পলক দেখে নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে চার হাত শূন্যে লাফিয়ে উঠে পা’টা ঘুরিয়ে মোক্ষম একটা লাথি মারল তার বুকের মাঝখানে।

মাসলম্যান ডিফান ভাবতেই পারেনি বাচ্চা ছেলেটা এরকম অতর্কিত আক্রমণ করবে। সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই ক্ষিপ্র চিতার মত উঠে লাফ দিল রাতুলকে লক্ষ করে। রাতুল চোখের পলকে ডানদিকে সরে গেল। ডিফান সোজা গিয়ে পড়ল সেই চৌবাচ্চায় রাখা তরল পদার্থের মধ্যে। একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল। তার সারা গায়ে জড়িয়ে গেছে সেই চটচটে আঠালো পদার্থটা। সে উঠে আসার চেষ্টা করছে। কিন্তু গায়ের মাংসগুলো খসে পড়ছে চাকলা হয়ে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে সাদা হাড়। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল রাতুল।

“তোকেও আমি ইঁদুরের মত পারতে পারি।” বলে অরেলস্টাইন মুহূর্তের মধ্যে পকেট থেকে পিস্তল বের করে তাক করলেন রাতুলের দিকে।

কিন্তু তারপরেই মাথা নেড়ে নিজের মনেই বললেন, “কিন্তু না, আরও কিছুদিন তোকে বেঁচে থাকতে হবে।”

বলতেবলতে দেয়ালের গায়ে একটা হাতল ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। পিছনে একটা চোরা কুঠুরির দরজা খুলে গেল। ডেভিড অরেলস্টাইন ঢুকে গেলেন তার মধ্যে। বন্ধ হয়ে গেল দরজা। তারপর উপরের ভেন্টিলেটর দিয়ে একটা সাদা গ্যাস ঢুকতে লাগল। মশালগুলি নিভে যাচ্ছে এক এক করে। রাতুল বুঝল ঘরের মধ্যে অক্সিজেন কমছে। দ্রুত সেই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে সে উঠতে লাগল উপরে। নিচে ঘন অন্ধকার। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। উপরে বের হবার ঢাকনাটাও বন্ধ। বুঝতে পারছে না কী করে খুলবে? দুম দুম করে ধাক্কা দিল বেশ কয়েকবার। জ্ঞান লোপ পাচ্ছে আস্তে আস্তে। শেষে সিঁড়িতেই শুয়ে পড়ল নিথর হয়ে।

 ***********

জ্ঞান ফিরতে দেখল ও সেই বড়ো ঘরে পালঙ্কের উপর শুয়ে আছে। হাসি মুখে এগিয়ে এসে কোট প্যান্ট পরা মহেন্দ্র সিংহ বাংলায় বললেন, “হ্যালো, রাতুল। কেমন আছ?”

“আপনি!!” বলে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখল ডাক্তার, নার্স, বেশ কয়েক জন জার্মান পুলিশ, মরিয়ম আর একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছেন।

“জানি আমাকে তুমি এক্সপেক্ট করনি। নতুন করে পরিচয় দিই, আমি হলাম ইন্টারপোলের অফিসার। ডেভিড অরেলস্টাইনকে ধরার জন্য আমরা অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছিলাম। তিনি জেমসের নাম ভাঙিয়ে ক্রাইম করে যাচ্ছিলেন। ইনি হচ্ছেন এক কুখ্যাত আন্তর্জাতিক চোরাচালানকারী এবং মাফিয়া ডন। এখন অবশ্য জেল-এ। ওকে ধরার জন্য তোমাকে আমরা টোপ হিসাবে ব্যবহার করেছিলাম। ঐ যে দাঁড়িয়ে আছেন আসল জেমস অরেলস্টাইন মানে ওনার ভাইপো। উনি আর মরিয়ম আমাদের সাথে সহযোগিতা না করলে অবশ্য এটা হত না। চিন্তা করতে পার, ডেভিডের বয়স এখন প্রায় একশ দশ? দেখলে তো বোঝাই যায় না! এই করেই সে বার বার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েছে।”

 জেমস এগিয়ে এসে বললেন, “আমি তোমার গ্রান্ডফাদারের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। তিনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। ডেভিড কাল রাতে ক্যাসেলে ঢুকতেই পুলিশ গোপনে ক্যাসেল পুরো ঘিরে ফেলেছিল। আর তুমি জ্ঞান হারানোর পরেই আমরা ল্যাবরেটরির সিঁড়িতে পৌঁছেছি। তবে তোমার সাহসের তারিফ করতেই হবে। তোমাকে তোমার ক্যাসেলে পাকাপাকিভাবে থাকার জন্য আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”

রাতুল উঠে বসে হেসে উত্তর দিল, “না, আমি বাড়ি যাব। কলকাতা।”

 ছবিঃ শিমুল

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে