পুজোর উপন্যাস
পুষ্পেন মণ্ডল
চেরাপুঞ্জি মানে চিরহরিৎ পাহাড়ে ঢাকা, মোহময়, বৃষ্টিস্নাত, অসংখ্য ঝর্ণা আর অর্কিডে মোড়া পূর্ব হিমালয়ের কোলে রহস্যময় এক মেঘের রাজ্য। কথাটা বলেছিলেন তীর্ণার বাবা। আর সেই মত রেনকোট, ছাতা নিয়ে তৈরি হয়ে এসেছিল ওরা। কিন্তু এখানে এসে রীতিমত আশাহত হল তিনজনেই। মনে হল বরুণদেব তাদের উপরে মোটেই সদয় নন। শুধু দু এক টুকরো সাদা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ছাড়া পুরো আকাশ নীল। পুজোর ছুটি কাটানোর জন্য চেরাপুঞ্জির নাম প্রথম বলেছিল তীর্ণা। ঋজু আর পাতাকে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে ঘুমসি পাহাড়ের বাংলোয় এসে তাদের ভালোই লাগল। জায়গাটা চেরাপুঞ্জি থেকে কিছুটা ভিতরে। পুরো ছশো একর এলাকা জুড়ে রাবার গাছের জঙ্গল। মাঝামাঝি একটা পাহাড়ের মাথায় এই কাঠের বাংলো। পাহাড়ের মাথা থেকে অসাধারণ একটা ভিউ পাওয়া যায়। তীর্ণার বাবার এক বন্ধু এই রাবার গাছের জঙ্গল লিজ নিয়েছেন। ম্যানেজার সুরেশ বাবু অমায়িক ভদ্রলোক। বহু দিন আছেন এখানে। দুদিন ধরে পুরো জঙ্গল ঘুরিয়ে দেখালেন ওদের। চেনালেন কোন গাছের রস থেকে বেলুন আর কোন গাছ থেকে গাড়ির টায়ার তৈরি হয়। অসাধারণ কয়েকটা ঝর্ণা আছে গভীর অরণ্যের মধ্যে। আর দেখালেন বহু প্রাচীন ভগ্নপ্রায় একটা দুর্গ, রাজাদের তৈরি কালীমন্দির, তার পিছনে সুগভীর পাথরের কুয়ো আর একটা মাঝারি নীল জলের লেক।
তিন দিন অপেক্ষা করার পরে প্রথম বৃষ্টির দেখা পেল ওরা। বাংলোর বারান্দায় বসে তখন মুচমুচে পকোড়া আর চা সহযোগে আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। তীর্ণাই প্রথম প্রসঙ্গটি উত্থাপন করল। একটা বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে বলল, “সাইকোলজিক্যাল রিপ্রেসান অফ মোটিভেটেড ফরগেটিং। মানে বিশেষ কিছু কারণে মানুষ ধীরে ধীরে পুরানো কথা ভুলে যায়। অর্থাৎ স্মৃতিভ্রম।”
পাতা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “হঠাৎ স্মৃতিভ্রম নিয়ে পড়লি কেন?”
সে হাতের বইটা দেখিয়ে বলল, “সাইকোলজির জার্নালটা বুকশেলফ থেকে পেলাম। এই শব্দটির উপরে গোল করে লাল কালির দাগ দেওয়া আছে। তাই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি।”
ঋজু উদাসীন গলায় পকোড়ায় কামড় বসিয়ে মন্তব্য করল, “নিশ্চয়ই কোন পাগলের ডাক্তার এটা ফেলে গেছে।”
“বইটার শেষ পাতায় একটা সিগনেচার আছে। সি.এ.শঙ্খ সেন। ডাক্তার হলে ডঃ লেখা থাকত।”
“সি.এ. মানে কী চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট?”
“হতেও পারে।”
টুকরো কথাগুলি হয়ত ম্যানেজারের কানে গিয়েছিল। এগিয়ে এসে বললেন, “দেখি।”
বইটা হাতে নিয়ে ভ্রু দুটো কুঁচকে গেল তাঁর। বললেন, “বইটা এখানে থেকে গেছে জানতামই না।”
ঋজু প্রশ্ন করল, “কী ব্যাপার ম্যানেজারবাবু, কার বই এটা?”
“শঙ্খ সেন বছরদুয়েক আগে এসেছিলেন আমাদের বাগানের ইন্সপেকশনে। তারপর হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। সে এক অদ্ভুত ঘটনা।”
তীর্ণা সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, “উধাও হয়ে গেলেন মানে? একটু খুলে বলুন না।”
ঋজু বলল, “হ্যাঁ, এরকম বৃষ্টি বাদলার দিনে চা, পকোড়ার সাথে দু একটা অদ্ভুত ঘটনা না জুড়লে ঠিক জমবে না।”
সবাই মিলে চেপে ধরতে তিনি বসে পড়লেন সোফায়। কাচের জানালা দিয়ে ঝমঝমে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রায় পনের বছর হল আমি এখানে আছি। নির্জন জনমানবশূন্য জঙ্গলে প্রায় একা এতগুলি বছর কাটিয়ে দিলাম। আপাতশান্ত এই বনজঙ্গলের মধ্যে মিশে আছে অনেক ইতিহাস আর রহস্য। হাজার হাজার বছর ধরে এই বনভূমি লোকচক্ষুর আড়ালে নিজের অলৌকিক সত্ত্বাকে লুকিয়ে রেখেছে। তোমরা যারা শহরে বড় হয়েছ, হয়ত উপলব্ধি করতে পারবে না সেই রহস্যের শিকড় কতটা গভীর। সে রকমই এক অদ্ভুত ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা।”
হঠাৎ কথা থামিয়ে উঠে গিয়ে দেরাজ খুলে একটা ডায়রি বের করে আনলেন তিনি। তারপর আবার শুরু করলেন, “ভদ্রলোক যখন প্রথম আমার কাছে এসেছিলেন তখনও তাঁর কথাবার্তা সম্পূর্ণ অসংলগ্ন হয়নি। বেশ লম্বা চওড়া, ফর্সা, টিকালো নাক, অমায়িক ব্যবহার। প্রথম থেকেই তাঁকে আমি খুব পছন্দ করতাম। তিনি আমাকে যা বলেছিলেন আর এই ডায়রির নোট দেখে তাঁর জবানিতেই আমি ঘটনাটা বলছি।”
*******
কর্মসূত্রে বেশ কিছু দিন ছিলাম শিলং শহরের এক অভিজাত হোটেল “পাইন উড”-এ। সারাদিন অডিটের কাজে ঘুরে বেড়াতাম বিভিন্ন চা বাগানের অফিসে। কাজের চাপ যখন একটু কমল, তখন আকস্মিকভাবে একদিন আলাপ হল কৃষ্ণকিশোর গুপ্তার সঙ্গে। উনি একই হোটেলে পাশের কটেজে ছিলেন। শুনেছিলাম অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তা। সবাই ওঁকে ‘কেকে স্যার’ নামে সম্বোধন করত।
সকালে উঠে হোটেলের কম্পাউন্ডের মধ্যেই একটু হাঁটাহাঁটি করতাম। ভোর রাতের কনকনে ঠাণ্ডার পরে মিঠে রোদটা যখন পুবদিকের গাছপালার ফাঁকের মধ্যে দিয়ে এসে গায়ে লাগত, ভারি আরাম হত। কানে আসত ছোট ছোট চড়াইপাখির অবিরাম কিচিরমিচির।
একদিন একটু বেশি ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ি দেখলাম, সূর্য উঠতে তখনও ঘণ্টাখানেক বাকি। লেপকম্বল সরিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি সামনের একটুকরো ফাঁকা ঘাসে ঢাকা লনের উপর প্ল্যাস্টিকের ম্যাট বিছিয়ে আবছা অন্ধকারের মধ্যে একজন যোগাসন করছেন। পরনে ট্রাকসুট আর হনুমান টুপি। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, কিন্তু শরীর একদম ফিট। ধীরেধীরে আলো বাড়তে লাগল। ব্যায়াম শেষ করে ম্যাট গুটিয়ে ভদ্রলোক রুমের দিকে হাঁটা দিলেন।
আমি সামনাসামনি পড়ে যাওয়ায় বললাম, “গুড মর্নিং স্যার।”
ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অদ্ভূত একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “সূরজ সিংহ না?”
আমি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দিলাম, “না স্যার, আমার নাম শঙ্খ সেন, বাড়ি কলকাতায়।”
তিনি আরো কিছুক্ষণ আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করে, “আমারই ভুল,” বলে নিজের কটেজের দিকে চলে গেলেন।
ভদ্রলোকের সন্দেহজনক চাহনিটা মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকল। অবশ্য কাজ সেরে সন্ধ্যাবেলা যখন ফিরলাম সে কথা আর মনে নেই।
রাতে হঠাৎ দরজায় দুমদুম আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। লাইট জ্বেলে দেখলাম ঘড়িতে সাড়ে বারোটা। শৈলশহরে তখন মাঝরাত। এত রাতে কে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে! ছিটকিনি খুলে বেশ অবাক হলাম। শাল মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ‘কেকে’।
ভারি গলায় বললেন, “তোমার সাথে একটা জরুরি কথা ছিল। তাই এত রাতে বিরক্ত করলাম। আসলে কাল সকালেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।”
“আসুন, ভিতরে আসুন।” বলে দরজাটা বন্ধ করে এসে তাঁর সামনের চেয়ারে বসলাম। লক্ষ করলাম তাঁর চোখের চাহনিতে যেন একটা অস্থির ভাব। কিছুটা ইতস্তত করে, একটা ছোট্ট গলা ঝাড়া দিয়ে বললেন, “তুমি খুব অবাক হয়েছ বুঝতে পারছি। সকালে তোমাকে সূরজ সিংহ ভেবে ভুল করেছিলাম। কেন ভুল করেছিলাম সেটা এই ছবিটা দেখলে বুঝতে পারবে। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পরে এখানের স্টেট লাইব্রেরিতে গিয়ে অনেক খুঁজে ১৯৯১এর ২রা নভেম্বরের শিলং টাইমসে এই ছবিটা পেয়েছি।” বলে শালের ভিতরে বুক পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে তাতে একটা ছবি দেখালেন।
আমি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম ছবিটা পুরানো খবরের কাগজ থেকে নেওয়া। পাগড়ি আর শেরওয়ানি পরা সুপুরুষ চেহারার এক ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন সেখান থেকে। পাকানো গোঁফ। দীপ্তিমান চাহনি। মুখের আদলটা হুবহু আমার মত। জিজ্ঞাসা করলাম, “কে ইনি?”
“কোপিলাগড়ের রাজা ভান সিংহ। সূরজ সিংহ হল এঁর ছোট ছেলে। সে বহু বছর নিরুদ্দেশ। আনুমানিক বয়স তোমার মতই হবে। জীবিত না মৃত তা কেউ জানে না।” একটু থেমে আবার বললেন, “কোপিলাগড়ের নাম শুনেছ?”
আমি মাথা নাড়লাম।
“ও! তাহলে তোমাকে প্রথম থেকে সব কিছু বলতে হবে।” কোটের পকেট হাতড়ে একটা মোটা চুরুট বের করে ধরালেন। তামাকের গন্ধে ভরে গেল ঘরটা। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে শুরু করলেন, “ইংরেজরা আসার আগে আসামের নাম ছিল ‘কামরূপ’। সমুদ্রগুপ্তের আমলে তৈরি এলাহাবাদ পিলারে ‘কামরূপ’-এর উল্লেখ আছে। সমুদ্রগুপ্তের নাম বললাম কারণ এ ঘটনার একটা যোগ আছে তাঁর সাথে। ‘কামরূপ’এর মধ্যে বেশ কয়েকটা নেটিভ রাজ্য পড়ত। কোপিলাগড় তেমনই একটা রাজ্য। ছোটোছোটো রাজ্যগুলোর মধ্যে সবসময়েই লেগে থাকত যুদ্ধ বিবাদ। আঠারশো তিরিশের পরে এই জায়গাগুলি ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র অধীনে চলে যায়। এদের মধ্যে একমাত্র খাসি উপজাতিদের রাজা তিরট সিংহ মাতৃভূমি রক্ষার জন্য ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। যাই হোক, আমার গল্প শুরু ভারত স্বাধীন হওয়ার অনেক পরে। তোমাকে শুধু ইতিহাসটা বলে রাখলাম জেনে রাখার জন্য।”
কড়া তামাকের গন্ধে আমার ঘুম ঘুম ভাবটা ততক্ষণে চলে গেছে। পা মুড়ে গদিওয়ালা চেয়ারের উপরে বসে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে ঠাণ্ডাটাও কীরকম জাঁক দিয়ে পড়ছে। রুম হিটার চলছে অথচ কাঠের ঘরগুলো যে কে সেই হিমশীতল।
“উনিশশো বাহাত্তরের পরে মেঘালয়, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ আলাদা আলাদা রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর জমিদারী প্রথা বিলোপ হওয়ায় এই সব ছোট ছোট নেটিভ রাজ্যগুলির রমরমা ধীরে ধীরে চুপসে যেতে থাকে। মোট কথা তাদের খেটে খাওয়ার দিন শুরু হয়। কেউ জঙ্গলের কাঠের ব্যবসা শুরু করে, কেউ চায়ের বাগান। আবার অনেকে পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করে অর্থের সংস্থান করতে থাকে। এরকমই, কোপিলাগড়ের রাজা ভান সিংহ কিছু বিদেশি খদ্দেরের কাছে ঐতিহাসিক জিনিস বিক্রি করতে এসেছিলেন এই শিলংয়ে। সেটা ছিল উনিশশো নব্বইয়ের গোড়ায়। তাঁর নিজের একটি বাংলো আছে কাছেই। আমি তখন এখানে পোস্টেড। এক রাতে বাংলোতে জবরদস্ত পার্টি দিলেন। বহু নামিদামি লোকেদের সাথে আমিও উপস্থিত ছিলাম সেখানে। পুরোপুরি রাজকীয় সাজে উপস্থিত হলেন রাজা ভান সিংহ। মাথায় দামি পাথর বসানো পাগড়ি, রঙিন পাথর আর সোনার সুতো দিয়ে কাজ করা শেরওয়ানি, কোমরে ঝোলান সোনালি তলোয়ার। পায়ে নাগরা জুতো।”
“অনুষ্ঠান তখন শেষ পর্যায়। হঠাৎ, প্রায় দেড়শ লোকের সামনে কোমরের তলোয়ারটা খুলে আকাশের দিকে উঁচিয়ে রাজা বললেন, ‘এটা হল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের তলোয়ার। আমাদের বংশের পূর্বপুরুষকে সমুদ্রগুপ্ত এটা উপহার দিয়েছিলেন তাঁর হয়ে পূর্ব ভারতকে শাসন করার জন্য।’ কথাটা বলতেই করতালিতে গোটা হল ফেটে পড়ল। তারপর বাকি অনুষ্ঠানে একমাত্র আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াল এই তলোয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য।”
“তারপর?” আমার উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করেছে।
“সোচ্চারে এই কথাটা ঘোষণা করার উদ্দেশ্য ছিল ঐ তলোয়ারটি তিনি বিক্রি করতে চান এবং অতিথিদের মধ্যে কিছু বিদেশি খরিদ্দাররাও উপস্থিত ছিলেন। আমি সেদিন নিজের হাতে তলোয়ারটা ধরে দেখেছিলাম। খাপটা পুরো সোনার তৈরি, তার উপরে সূক্ষ্ম কারুকাজ। হাতলটাও সোনার। তার ওপরে গড়ুরস্তম্ভের খোদাই করা ছবি। ফলাটা খাঁটি লোহার। কিন্তু এতটুকু মরচে পড়েনি। তলোয়ারটির গায়ে অচেনা ভাষায় কিছু লেখা। অনুষ্ঠানে হাজির এক ভদ্রলোক সেটা দেখে বললেন ভাষাটা পালি ভাষা আর ওতে সমুদ্রগুপ্তের নামটাই লেখা রয়েছে।”
“কত দামে বিক্রি হল?”
“বিক্রি আর হল কই? সেই রাতেই রাজা ভান সিংহ তাঁর বাংলোতে আত্মহত্যা করেছিলেন। তলোয়ারটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর তখন থেকেই তাঁর ছোট ছেলে সূরজ সিংহও বেপাত্তা। অনেকের ধারণা রাজাকে খুন করা হয়েছিল।”
“কে খুন করল ভান সিংহকে? তাঁর ছেলে?”
“সেটা একরকম অসম্ভব। কারণ ছোট ছেলের বয়স তখন পাঁচ বছর। তার জন্মদিন উপলক্ষেই দিয়েছিলেন পার্টিটা। সে জন্যই তোমাকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। বড়ো হলে সে একদম তোমারই বয়সী, তোমার মতই দেখতে হত।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “তা শেষ পর্যন্ত খুনের কোন কিনারা হয়নি?”
“না। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেছিল। আমি নিজে তদন্তের খুঁটিনাটি দেখেছিলাম। কিন্তু কোন সূত্র পাওয়া যায়নি। শেষে আত্মহত্যা তত্ত্ব মেনে নিয়ে পুলিশ ফাইল বন্ধ করে দেয়। সেই সময়ে চীন সীমান্তে আবার নাগা আর বোরো জঙ্গিদের উৎপাত চলছিল খুব। তাই ধীরে ধীরে এ ব্যাপারটাও ভুলে যায় সবাই।”
“কীভাবে মারা গিয়েছিলেন তিনি?”
“পরদিন বন্ধ দরজা ভেঙে দড়ির ফাঁসে ঝুলন্ত শরীর উদ্ধার হয়েছিল। কোন সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি। ঘরে একটা বড়ো সিন্দুক ছিল। পুলিশ সেটা খুলে দেখল অন্যান্য দামী জিনিস, টাকাপয়সা সব আছে, কিন্তু তলোয়ারটা নেই। তাঁর স্ত্রী বাংলোতেই অন্য ঘরে ছিলেন। ছোট ছেলেটা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তাকেও খোঁজার কোন ত্রুটি হয়নি। কিন্তু যেন কর্পূরের মত উবে গেল সে। রাজার স্ত্রীর শোকে পাগলের মত অবস্থা হয়। বড় ছেলে বিরজু সিংহের বয়স তখন কুড়ি। দিল্লীতে মামার বাড়িতে ছিল।
“রাজবংশের মধ্যে এ রকম অপঘাতে মৃত্যু বা নিরুদ্দেশ অনেক দেখা যায়। ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। আমার একটাই আফশোষ ছিল, সমুদ্রগুপ্তের তলোয়ারটা হাতে পেয়েও ফসকে গেল। অত দামি জিনিস! ঐতিহাসিক মূল্যও অনেক। জাতীয় সম্পদ আমাদের।”
আমি বললাম, “সে কথা যদি বলেন, জিনিসটা তো বিদেশিদের কাছে বিক্রিই হয়ে যেত।”
কেকে মাথা নেড়ে বললেন, “না, আমরা সেটা কখনই হতে দিতাম না। পুলিশ সবার উপর নজর রাখছিল।” চুরুটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, “এর বেশ কয়েকবছর পর, আমি তখন দিল্লীতে ট্র্যান্সফার হয়েছি। কনটপ্লেসের এক বড়ো জুয়েলারির দোকানে সরকারি রেড-এ গুপ্তযুগের বেশ কিছু সোনার মুদ্রা পাওয়া যায়। তদন্তে জানা গেল এই প্রাচীন মুদ্রাগুলি কোন মিউজিয়াম থেকে চুরি যাওয়া নয়। দোকানের মালিক জানায়, সেগুলি তাদের বংশের জিনিস। তার দিদির শ্বশুরবাড়ি কোপিলাগড় থেকে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার ভান সিংহের বড়ো ছেলে বিরজু সিংহ-এর কথা মনে পড়ল। এটা কি তার মামার দোকান? বাবার মৃত্যুর পর থেকে তার একবারও দেখা পাওয়া যায়নি।”
“দেখা গেল আমার অনুমানই সত্যি। বিরজু সিংহকে জেরা করে জানা গেল অদ্ভূত কিছু কথা। জানি না আমাদের তদন্ত বিপথে চালনা করার কোন অভিসন্ধি তার ছিল কি না!”
“কী জানা গেল?” আমি প্রশ্ন করলাম।
সে জানাল, “কোপিলাগড়ের পুরানো দুর্গের নিচে আছে হাজার বছরের পুরানো ধনরত্নের ভাণ্ডার। তাদের বংশের পূর্ববর্তী রাজারা সেই রত্নভাণ্ডারের হদিশ জানতেন। কিন্তু তার বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর সেই রাস্তা নাকি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে।”
“আপনারা বিশ্বাস করলেন সে কথা?”
“বিশ্বাস করা বা না করা দুটোই প্রমাণ সাপেক্ষ। তবে এরপর বিরজু সিংহও একেবারে বেপাত্তা হয়ে যায়। — আমি নিজের সোর্স লাগিয়ে কোপিলাগড়ে খোঁজ খবর চালিয়ে জানতে পারি গ্রামের আদিবাসীদেরা বিশ্বাস করে দুর্গের নিচে লুকানো আছে গুপ্তধন।”
এদিকে রাত বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠাণ্ডা। গল্পের গন্ধে তখন আর আগের মত ঠাণ্ডাটা মালুম হচ্ছে না আমার।
একটু থেমে থেকে কেকে ফের শুরু করলেন, “কোপিলাগড় চেরাপুঞ্জির কাছে এক জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা টিলার মাথায়। আগেও আমি গিয়েছিলাম রাজা ভান সিংহের মৃত্যুর তদন্ত করতে। এই ঘটোনার পর আবার গেলাম সেখানে। আরকিওলজি ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন লোকও ছিল আমাদের সাথে। কিন্তু পুরো দুর্গ এক মাস ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলাম না।”
“তারপর?” আমি প্রশ্ন করলাম।
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “আমার কেরিয়ারের সব থেকে বড়ো অমীমাংসিত রহস্য বলতে পারো। রিটায়ার করার পরেও ঘটনাটা আমার মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারছিলাম না। খোঁজখবর চালিয়েই যাচ্ছিলাম এদিকসেদিক। সেই করতেকরতেই বেশ কয়েকবছর পর কামাখ্যা পাহাড়ে অম্বুবাচির মেলায় এক তান্ত্রিকের খোঁজ পাই। উত্তর পূর্ব হিমালয়ের প্রত্যন্ত গুহায় তিনি সাধনা করেন। বয়েস নাকি একশর উপরে, যদিও দেখে বোঝার জো নেই। যাই হোক, শুনেছিলাম তিনি কোপিলাগড়ের রাজাদের চিনতেন। এবং রাজবংশের সাথে তাঁর একটা সম্পর্কও ছিল। তবে অনেক সাধাসাধি সত্ত্বেও এই বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করলেন না।”
এরপর কেকে একদৃষ্টি আমার দিকে চেয়ে রইলেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল সেই ঘোলাটে চাহনির সামনে চুপচাপ বসে থাকতে। শেষে আমি প্রশ্ন করলাম, “আপনি কি আমাকে আর কিছু বলবেন?”
শুনে একটু নড়ে উঠে অদ্ভুত প্রশ্নটা আবার করে বসলেন তিনি, “তুমি সত্যি সূরজ সিংহ নও? সেই এক চোখ, একইরকম জোড়া ভ্রু। নিজের ছোটোবেলার কথা কি তোমার মনে পড়ে?”
ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্ত গলায় বললাম, “না গুপ্তাজি, আমার মনে হয় আপনার কোন ভুল হচ্ছে। রাত অনেক হল। কালকে আমার জরুরি মিটিং আছে। গুড নাইট।”
ভদ্রলোক একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বলে মনে হল, কিন্তু মুখে আর কিছু না বলে তিনি উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। বাকি রাতটা প্রায় না ঘুমিয়েই কাটল আমার। মাথার মধ্যে অদ্ভূত অদ্ভূত চিন্তার উদয় হচ্ছিল। একই ধরনের দেখতে কত মানুষই তো পৃথিবীতে আছে। আমিই যে সেই হারিয়ে যাওয়া সূরজ সিংহ, এ বিষয়ে এতটা নিশ্চিত ভদ্রলোক কী করে হচ্ছেন?
আসলে আমার মনের মধ্যে একটা খটকা লেগেই থাকছিল। সেটা হল, নিজের ছোটোবেলার কথা আমার বিশেষ কিছু মনে নেই। কলকাতার নামকরা এক স্কুলে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু তার আগের ঘটনা মনে নেই কেন?
এপাশ ওপাশ করতে করতে ভোররাতের দিকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। পরদিন ঘুম ভাঙল দশটা নাগাদ। কেকের খোঁজ করায় জানতে পারলাম, তিনি চেক আউট করে গেছেন ঘণ্টাদুয়েক আগেই। আমিও তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন মেঘালয়ের নাম করা এক টি এস্টেটে অডিট ছিল। কাজের ফাঁকে বয়স্ক ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, কেকে এক সময়ে এখানকার খুব নামকরা পুলিশকর্তা ছিলেন। শায়েস্তা করেছিলেন আলফা আর বোরো জঙ্গিদের। কিন্তু কোপিলাগড়ের রাজা ভান সিংহের কাছে সমুদ্রগুপ্তের তরবারি ছিল বলে কেউ কোন দিন শোনেনি। তবে রাজার খুব দুর্নাম ছিল জুয়ারি হিসাবে। বদমেজাজি, খামখেয়ালি ধরনের লোক ছিলেন। শেষ বয়েসে পাগল হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বলে শোনা যায়।
এর দিন দুয়েক পরেই আমার কাজ শেষ হয়ে যাওয়াতে কলকাতায় ফিরে আসি। তারপর ওই ঘটনাটা মন থেকে আবছা হয়ে গিয়েছিল ধীরে ধীরে।
মাস ছয়েক পরে আমার নামে একটা চিঠি এলো। প্রেরকের নাম কৃষ্ণকিশোর গুপ্তা। তিনি আমার নাম ঠিকানা নিশ্চয়ই সেই হোটেল থেকেই জোগাড় করেছিলেন। চিঠিটা এইরকম,
“স্নেহাস্পদেষু,
তোমার মনে থাকবে কিছুদিন আগে শিলংয়ে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। সেই সময়ে রাজা ভান সিংহ আর সমুদ্রগুপ্তের তরবারির বিষয়ে তোমাকে বলতে গিয়ে এক তান্ত্রিক সাধুর কথা বলেছিলাম। সম্প্রতি আমি সেই সাধুর সাথে আবার দেখা করেছি। তিনি বলেছেন, সেই ঐতিহাসিক ধনসম্পদ উদ্ধার করতে তোমার সাহায্য লাগবে। বাকি কথা সাক্ষাতে বলব। তোমার যাওয়া, আসা, থাকার সমস্ত ভার আমার। – ইতি, কেকে।”
চিঠিটা পড়ে মুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। প্রথমত কাজের চাপে কলকাতা ছেড়ে সেই সময়ে আমার পক্ষে বের হওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া কোন অজানা মরীচিকা বা রহস্যের পিছনে জীবনে আগে কোন দিন ছুটিনি, ছোটার ইচ্ছাও নেই। আর ঐতিহাসিক সম্পদ উদ্ধার করতে হলে সেটা সরকারকে অথবা প্রত্নতত্ত্ববিভাগে জানানোই উচিৎ। তাই এই মূহুর্তে আমি অপারগ, এই কথাটা সুন্দর করে জানিয়ে একটা চিঠি লিখে পোস্ট করে দিলাম।
কিন্তু ভাগ্যে আমার অন্যরকম কিছু লেখা ছিল। বছরদুয়েক পরে আবার কাজের সূত্রে শিলং যেতে হল আমাকে। দু’তিনটে চা কোম্পানির পাশাপাশি এবার একটা বড়ো রাবার বাগানের অডিট ছিল। জায়গাটা শিলং শহর থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে। সোরা-শিলং হাইওয়ে হয়ে চেরাপুঞ্জির দিকে। ঘন গাছপালায় মোড়া, স্যাঁতস্যাঁতে জোলো আবহাওয়া। প্রায় ছশো একর জায়গা জুড়ে রবার গাছের জঙ্গল। কাঠের বাংলোয় আমার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে।
ম্যানেজার সুরেশ পাঞ্জাবীর সাথে ঘোড়ায় করে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে অসাধারণ এক ঝর্ণার দেখা পেলাম। ঝর্ণার পাশে এক প্রাকৃতিক গুহা। দিনের আলো তার ভেতরে বিশেষ ঢোকে না। কয়েকটি পাহাড়ি পাখির ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। সুরেশ ভাই জানালেন, “এই গুহায় এক তান্ত্রিক থাকেন। শোনা যায় তাঁর বয়স দেড়শ বছর।”
শুনে আমার কেকে-র কথা মনে পড়ল। তিনিও এরকম এক তান্ত্রিকের কথা বলেছিলেন। বললাম, “ওঁর সাথে কি দেখা করা সম্ভব?”
“ওঁকে দিনের বেলায় কেউ দেখেছে বলে শুনিনি। আর রাত্রে এই গভীর জঙ্গলে কেউ আসে না। বছরে একবারই ওঁর দেখা পাওয়া যায়। কামাখ্যার মেলায়।”
হঠাৎ আমি প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, এখানে কাছাকাছি কোপিলাগড়ের দুর্গ বলে কোন জায়গা আছে?”
তিনি আঙুল তুলে বললেন, “সামনের এই বড়ো পাহাড়টার পিছনেই দুর্গ।”
দু দিন পরে কাজ শেষ করে সুরেশ ভাইকে নিয়ে সেই দুর্গের উদ্দেশ্যে রওঁ হলাম। মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। আমি যদি সত্যিই সূরজ সিংহ হই? তাহলে ছোটোবেলায় কলকাতায় পৌঁছলাম কীভাবে? গত দু’বছরে আমি অনেক খোঁজখবর করেছি। কিন্তু আমার পাঁচবছর বয়সের আগের কোন চিহ্ন পাইনি। বাবা প্রথম জীবনে চাকরি করতেন। বদলির কাজ ছিল। ছোটবেলার কোন ছবি, কোন বইপত্র, খেলনা, কিছুই খুঁজে পাইনি আমি। যেন জীবনের প্রথম পাঁচটা বছরকে যত্ন করে মুছে দেয়া হয়েছে।
সরু পাকদণ্ডী রাস্তা, কখনও চড়াই কখনও উৎরাই। সবুজে মোড়া পাহাড়ি জঙ্গলে ঘোড়ার পিঠে করে যাবার অদ্ভূত আনন্দ। নাম না জানা কত রকমের ফুল ফুটে রয়েছে দু’পাশে। পাহাড়ি পথে নামতে নামতে একটা জলের রেখা দেখা গেল। পাথরে পাথরে ঠোকা খেয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে। সেটা পেরিয়ে আবার ওপরে ওঠা। এদিকটা গাছের ছায়ায় পরিবেশ বেশ ঠাণ্ডা।
পাহাড়ের মাথায় দূর থেকে রাজবাড়িটা চোখে পড়ল। পাথরের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে অনেকটা। ঘোড়াগুলিকে নীচে রেখে হেঁটে উপরে উঠলাম।
রাজবাড়ির চৌহদ্দিতে পা রেখেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভূত অনুভূতি হল আমার। যেন কতকালের চেনা এ জায়গা। এই পাহাড়, এই গাছপালা সব যেন আমার স্বপ্নে দেখা। সুরেশভাই জানালেন, “রাজবংশের কেউ এখন থাকে না। শুধু মহেশ্বর প্রসাদ নামে এক বৃদ্ধ কেয়ারটেকার আছেন তাঁর পরিবার নিয়ে।”
পাথরের তৈরি ছোটখাটো একটা প্রাসাদ, এক সময়ে হয়ত জাঁকজমক ছিল। এখন ভগ্নপ্রায় অবস্থা। বোঝাই যাচ্ছে বহু বছর কোন সংস্কার হয়নি। ভিতরে একটা ফাঁকা লন পেরিয়ে মূল দরজা দিয়ে ঢুকে লম্বা হলঘর। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সারি সারি তালা দেওয়া বন্ধ দরজা। আরো উপরে উঠলে খোলা ছাদ। দিনের শেষে সূর্যের আলো কমে আসছিল। বাড়ছিল ঠাণ্ডা। পাখিদের ঘরে ফেরার কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছে বনজঙ্গল।
আমাদের দেখে বৃদ্ধ কেয়ারটেকার এগিয়ে এসেছিলেন কাছে। আমার সামনে আসতেই মূহুর্তের মধ্যে পালটে গেল তাঁর চোখমুখের চেহারা। কপালে মোটা বলিরেখাগুলি ফুলে উঠল, সাদা ভ্রুর নিচে ঘোলাটে হলুদ চোখগুলি বিস্ফোরিত করে বললেন, “তুমি!!”
“চেনেন আমাকে?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“তুমি আমাদের ছোট রাজকুমার সূরজ সিংহ। তোমাকে চিনব না? নিজের কাঁধে করে ঘুরিয়েছি ছোটবেলায়।”
আমি বললাম, “কিন্তু– আমি তো কলকাতায় বড় হয়েছি। ”
কথাটা যেন তিনি শুনতেই পেলেন না, “ভাবিনি তোমাকে আবার কোন দিন দেখতে পাব,” বলতে বলতে এগিয়ে এসে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
দেখি, আমার থেকেও বেশি অবাক হয়েছেন সুরেশভাই। শেষে তাঁকে গোটা গল্পটা খানিক ভেঙে বলে বললাম সে রাতটা প্রাসাদেই থেকে যেতে চাই আমি। যদি মনের অন্ধকার অংশে কিছুটা আলোকপাত করা যায়। সুরেশভাই প্রথমে মৃদু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু তারপর আমার জেদ দেখে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন।
তখন সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিমে পাহাড়ের আড়ালে। মহেশ্বর প্রসাদ এতক্ষণ কিছু বলেননি। এইবারে মাথা নেড়ে বললেন, “না বাবু, তুমি এখানে থেক না। এ হল অভিশপ্ত রাজবাড়ি। এখানে রাত্রিবাস করলে তোমার মৃত্যু অবধারিত।”
“কেন? অভিশপ্ত কেন?”
“সে অনেক কথা। রাজগুরু লিঙ্গেশ্বরের অভিশাপ। তাই তো তোমার মা রাধাদেবী তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।”
খানিক চুপ করে থেকে আমি দৃঢ় গলায় বললাম, “অভিশাপ থাক আর যাই থাক আমি এখানে রাতটা কাটাব। কিন্তু আপনি বলুন তো, এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে যে আমিই সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলে?”
মহেশ্বর প্রসাদ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর মুখে একটু মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন, “রাজবংশের তেজ! ও জিনিস চাপা থাকে না। থাকো তবে। আর, কে বলল তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে? সেবার শিলঙয়ের বাংলোয় সেনসাহেবকে তো রাজাবাবুই ডেকে এনেছিলেন। আমাদের এস্টেটের হিসাব দেখার জন্য।”
কথাটা শুনে আমি বসে পড়লাম চেয়ারে। মনের মধ্যে তখন তুফান চলছে। আমিই তাহলে সূরজ সিংহ? ঝিমঝিম করছে মাথাটা। জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু আমার ছোটবেলার স্মৃতি হারিয়ে গেল কী করে?”
“তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে তোমার ছোটবেলার স্মৃতি মুছে দিয়েছিলেন তন্ত্রসাধক হেমগিরি। আমি তার সাক্ষি।”
“ইনিই কি সেই তান্ত্রিক, যিনি পূর্বদিকে পাহাড়ের গুহায় থাকেন?”
মহেশ্বর প্রসাদ উপর নিচে মাথা নাড়লেন। আমি কিছুক্ষণ গুম খেয়ে থেকে প্রশ্ন করলাম, “রাজা ভান সিংহ কেন আত্মহত্যা করেছিলেন?”
“ঐ যে বললাম, রাজগুরু লিঙ্গেশ্বরের অভিশাপ।”
“কিন্তু এই অভিশাপের কারণ কী?”
“আমি সামান্য ভৃত্য। সব কথা জানি না। জানলেও বলতে পারব না। এই দুর্গের আনাচেকানাচে এখনও আমরা মৃত রাজাদের উপস্থিতি টের পাই।”
“তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?”
“এক জনই আছে যিনি সব কিছু জানেন, তান্ত্রিক হেমগিরি।”
“কিন্তু শুনেছি, তিনি কারো সাথে কথা বলা তো দূরের কথা, দেখাও করেন না।”
“তুমি এই বংশের ছোট রাজকুমার। আমার বিশ্বাস তিনি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। আমার ছেলে তোমাকে নিয়ে যাবে তাঁর কাছে।”
অজানা এই রাজবংশের রহস্যময় ইতিহাস ক্রমশ আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছিল আমায়। মনের মধ্যে একটা তীব্র উৎকন্ঠা, ভয় অস্থির করে তুলেছিল। অথচ বুঝতে পারছিলাম, এই অদৃশ্য বাঁধন কেটে বের হওয়ার সাধ্য আমার নেই। আমার কপালেও কী অপঘাতে মৃত্যু লেখা আছে? কে এই রাজগুরু লিঙ্গেশ্বর? কী তার অভিশাপ?
অন্ধকার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। চারপাশে পাথরের দেয়ালগুলো হিম-শীতল। ইলেকট্রিকের আলো এখানে এখনও পৌঁছায়নি। একটা লণ্ঠন জ্বেলে নিয়ে এলেন মহেশ্বর প্রসাদের পুত্রবধূ।
“রাতের আহার কখন করবেন রাজকুমার?” মহিলার গলার আওয়াজ শুনে সম্বিৎ ফিরল। বহুদিন পরে রাজকুমার এসেছেন। তাদের আনন্দ আর ধরে না। কীভাবে আমাকে আপ্যায়ন করবে এই নিয়ে তাদের চিন্তা।
তাকে খাবার সময়টময় বলে বিদেয় করে আমি বড়ো টর্চটা জ্বেলে মহেশ্বর প্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গটা ঘুরে দেখলাম। কেকের কাছে যা শুনেছিলাম সব বললাম তাকে বলে শেষে প্রশ্ন করলাম, “কোপিলাগড় সেই সময়ে এমন কোন শক্তিশালী বড়ো রাজ্য ছিল না। হয়ত একটা ছোট্ট সুবেদার বা সামন্ত হতে পারে। তাদের হাতে সমুদ্রগুপ্তের তলোয়ার এল কীভাবে?”
তিনি বললেন, “জানি না। তবে এটুকু জানি যে সমুদ্রগুপ্তের তলোয়ারটি এ অঞ্চলে এসেছিল বর্মন বংশের হাত ধরে। সেই সময়ে পুষ্যবর্মন এই অঞ্চলের সমস্ত রাজাকে পদানত করে বর্মন বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। সমুদ্রগুপ্তকে খুশি করার জন্য তাঁর ছেলের নাম রাখেন সমুদ্রবর্মন। কামরূপকে গুপ্তসাম্রাজ্যের অধীনে অঙ্গরাজ্য হিসাবে পরিচালনা করার শপথ নেন। সম্রাটের তরফে উপহার পান একটি তরবারি। তাঁর রাজধানী ছিল এখনকার উত্তর গুয়াহাটিতে। পরে রাজা তিমগাদেবের সময়ে তাঁর এক সৈন্যাধ্যক্ষ রাজপুত হরি সিংহ কোপিলাগড়ের জমিদারি পান। তারপর এই দুর্গ তৈরি হয়। সেই সময়েই হয়ত তলোয়ারটি এ বংশে এসেছিল কোন পুরস্কার হিসেবে। আপনি যা শুনেছেন তা সব সত্যি। এই দুর্গের নিচে আছে হাজার বছরের পুরানো ধনরত্ন। কিন্তু সেখানে যাবার রাস্তা আমরা কেউ জানি না। যে একবার সে রাস্তা জেনে যাবে অথবা বাইরের কাউকে জানাবে তার অপঘাত মৃত্যু নিশ্চিত। হয়ত সে জন্যই রাজা ভান সিংহের মৃত্যু হয়ছিল।”
ছোটোবেলা থেকে কলকাতায় মানুষ। বড়ো হওয়া, বেড়ে ওঠা সবই জ্ঞানের আলোয়। অলৌকিক ঘটনার সাথে সাক্ষাৎ হয়নি কখনো। তাই বিশ্বাসও নেই। কিন্তু এতো শহরের আলোকোজ্জ্বল কংক্রিটের জঙ্গল নয়, এ হল আদিম পাহাড়ের কোলে রহস্যে মোড়া বৃক্ষরাশির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্য এক জগৎ। সভ্য মানুষের বুদ্ধিতে যার তল পাওয়া মুশকিল। বাইরে তখন ঝমঝমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সঙ্গে বজ্রপাত।
বহুদিনের বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা একটা ঘর আমার জন্য খুলে দিলেন মহেশ্বর প্রসাদ। ভ্যাপসা গুমোট গন্ধ। জানালেন, এটা আমার মায়ের ঘর। এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
হলুদ লণ্ঠনের ভৌতিক আলোয় একটা মায়াবী জগৎ তৈরি করেছে। দেয়ালে একটা বড়ো অয়েল পেন্টিং। বংশের কোন পূর্বপুরুষ হবেন। মাথায় পাগড়ি, হাতে তলোয়ার। তার নিচে একটা গ্রুপ ছবি। মহেশ্বর বাবু চিনিয়ে দিলেন, উপরের ছবিটা আমার পিতামহ রাজা প্রতাপ সিংহের। নিচে মহিলার কোলে ছোট বাচ্চাটা নাকি আমি। পাশে পনের ষোল বছরের ছেলেটা আমার দাদা আর পিছনে বাবা ভান সিংহ। ভাবতেও অবাক লাগছে জীবনের এতগুলি বছর পেরিয়ে এসে এদের প্রথম দেখছি। নিজের অজান্তেই দেখলাম চোখের কোণে জল।
“তোমাকে খুব ভালবাসতেন তোমার মা।” আমার চোখে জল দেখে মন্তব্য করলেন মহেশ্বর প্রসাদ।
আমি প্রশ্ন করলাম, “বিদায় দেবার পর আর কোনদিন আমার খোঁজ করেছিলেন?”
“না, খোঁজ করেননি। কারণ, খোঁজ করলেই কোন না কোন ভাবে অজিত সিংহ জেনে যেত যে তুমি কোথায় আছ। ওর শকুনের চোখ। তারপর তোমাকে খুঁজে এনে হত্যা করা হত।”
“অজিত সিংহ কে?”
“ভান সিংহের ছোট ভাই। মহা শয়তান। গুপ্তধনের লোভে বহু লোককে হত্যা করেছে।”
আমি ঘুরতে ঘুরতে একটা দেরাজের লাগোয়া আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নিজের প্রতিবিম্বকেও যেন অচেনা লাগছে, যেন হঠাৎ উদ্দীপিত হয়ে উঠছে মনের মধ্যে সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো। তারা বলছে আমি যা দেখতে পাচ্ছি, যা শুনতে পাচ্ছি তার বাইরেও আমার চারপাশে অনেক কিছু আছে। এবং আরও সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে।
দেরাজ খুলে একটা কাঠের বাক্স বের করে খাটের এক পাশে রাখলেন মহেশ্বর প্রসাদ। বললেন, “এটা তোমার মায়ের। পুরানো কিছু জিনিসপত্র আছে।”
“এগুলি নিয়ে আমি কী করব?”
মহেশ্বরবাবু বললেন, “রাধাদেবী, শেষ জীবনে নিজেকে এই ঘরের মধ্যে বন্ধ করে তন্ত্র সাধনা করতেন। মারা যাবার আগে আমাকে বলেছিলেন, যদি তুমি কোন দিন ফিরে আস তাহলে এই বাক্সটা দিতে।”
বাইরে বৃষ্টির তোড় উত্তরোত্তর বাড়ছে। মহেশ্বর প্রসাদ চলে গেলেন দরজা বন্ধ করে। কারুকাজ করা কাঠের বাক্সটি খুলে দেখলাম, বহু বছরের পুরানো হলুদ হয়ে যাওয়া এক তাড়া কাগজ ভাঁজ করা আছে। বেশ কয়েকটা রুদ্রাক্ষ আর তাবিজ, কবজের মালা, কয়েকটা আংটি, একটা কাচের শিশিতে নীলচে রঙের খানিক তরল। কাগজগুলি খুলে দেখলাম সব দেবনগরী ভাষায় লেখা। বেশির ভাগই তন্ত্রমন্ত্র সংক্রান্ত। এগুলি মা কেন আমকে দিয়ে যেতে বলেছেন? কী মনে হতে মালাগুলি নিজের গলায় পরে নিলাম। তারপর কাচের শিশির ঢাকনা খুলে নাকের কাছে আনতেই একটা মিষ্টি গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। এটা কি গায়ে বা চুলে মাখার কোন সুগন্ধি তেল? না অন্য কিছু? ঢাকনা বন্ধ করে আবার সেটাকে যথাস্থানে রেখে কাগজগুলি খুলে পড়তে শুরু করলাম। দেবনগরী ভাষা শিখেছিলাম স্কুলের নিচু ক্লাসে। তারপর বহুদিন কোন চর্চা নেই। হিন্দি অক্ষরগুলির সাথে মিল থাকায় ধীরে ধীরে পড়তে পারছি। পড়তে পড়তে কখন চোখ ঘুমে জড়িয়ে ধরেছে বুঝতে পারিনি।
……. বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হল ঘরের মধ্যে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে টর্চের আলোয় দেখলাম কেউ কোথাও নেই। তাহলে কি মনের ভুল? আবার মনে হল কেউ যেন ফিসফিস করছে! অনেক দূর থেকে কোন কথা ভেসে এলে যেমন শোনায়। শান্ত থাকার চেষ্টা করেও পারছি না, হৃদপিণ্ড জোরে চলতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে আমার চারপাশটা বদলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। মশারির ভিতর থেকে বাইরের চিত্রটা কেমন যেন পালটে গেল। অনেকটা ত্রিমাত্রিক ছবি দেখার মত।
বাইরে কারা যেন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ভারি ভারি পায়ের ধুপধাপ শব্দ। কান খাড়া করে শুনলাম কিছু লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে। কিন্তু ভাষাটা পরিষ্কার বুঝতে পারছিনা। ব্যাপারটা কী? কৌতূহল বাড়ছে। আমি মশারি তুলে বেরিয়ে এলাম।
ঘরের আসবাবপত্রও মনে হল বেশ কিছু পালটে গেছে। দরজা খুলে বাইরে বের হলাম। বাইরে অনেক মানুষ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। আমি এগিয়ে গেলাম সেদিকে। কিন্তু মনে হল তারা আমাকে দেখতেই পেল না। কথাগুলি শুনে মনে হল ভাষাটা ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল নাগা আদিবাসীরা দুর্গ আক্রমণ করেছে। রাজপুত কর্মচারী আর সৈন্য সামন্ত দুর্গের সিংহ দুয়ার রক্ষা করার জন্য লড়াই করছে প্রাণপণ। আমি কথাটা শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আরও এগিয়ে দেখি, সত্যিই যুদ্ধ হচ্ছে। শত শত মশালের আলোয় তীর আর বর্শা ছুঁড়ছে সেনারা। দুর্গের খাড়াই দেয়ালের ওপারে হাজার হাজার নাগা মশাল নিয়ে হাজির। তারাও মুহুর্মুহু তীর ছুড়ছে। ভিতরে আহত সৈন্যদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যত্র। একজন রাজকীয় বর্ম পরা লম্বা চওড়া মানুষ দুর্গের মধ্যে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। কিন্তু লোকবল এদের খুব বেশি নেই। কাঠের সিংহদুয়ার যে কোন মূহুর্তে ভেঙে পড়বে। মোটা মোটা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ধাক্কা মারছে বাইরে থেকে। প্রাচীরের উপর থেকে ঝাঁক ঝাঁক বিষাক্ত তীর ছুটে যাচ্ছে শত্রুপক্ষকে লক্ষ করে। একদল ব্যর্থ হলে আবার অন্যদল পিছন থেকে এগিয়ে আসছে। কোন পক্ষই অন্যদের একচুল সুযোগ ছেড়ে দিচ্ছে না।
দুর্গের সৈন্যসংখ্যা সামান্য। হঠাৎ সেনাপতি রাজার কাছে এসে বললেন, “আপনি আর অপেক্ষা করবেন না মহারাজ। গুপ্ত পথে প্রস্থান করুন গারো পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। আর অল্প সময়ের জন্যই নাগাদের আটকে রাখা যাবে।”
রাজা বললেন, “কিন্তু রাজ তোষাগারের কী হবে সেনাপতি?”
“আমি তো আছি। চিন্তা করবেন না মহারাজ। যতক্ষণ আমার শরীরে প্রাণ আছে রক্ষা করে যাব। আপনি গুপ্তপথে এখুনি প্রস্থান করুন। শুধু বলে যান ঠিক কোনখানে আছে তোষাগার। আমি প্রাণপণে সেই জায়গাটিকে রক্ষা করে যাবো শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে।”
রাজা কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন, “সে কথা রাজবংশের উত্তরাধিকারীকে ছাড়া আর কাউকে জানানো নিষেধ সেনাপতি।” তারপর পুত্র, কন্যা, স্ত্রী আর দশজন সেপাই নিয়ে পিছনের গুপ্তপথে বেরিয়ে গেলেন। সেনাপতি জয়ধ্বনি দিলেন, ‘জয়, রাজা বিক্রম সিংহের জয়।’ এদিকে একে একে সৈন্যরা মারা যাচ্ছে। বিষাক্ত তীর বৃষ্টির তোড়ের মত আছড়ে পড়ছে দুর্গের ভিতরে।
একসময় প্রতিরোধের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল সিংহদুয়ার। এরপর শুরু হল সামনাসামনি তলোয়ারের লড়াই। নাগারা তলোয়ার চালনায় রাজপুত সেনাদের কাছে নিতান্তই শিশু। এক একজন রাজপুত দশজন নাগা সেনার সাথে বীর-বিক্রমে লড়াই করছে। কিন্তু কালো ভিমরুলের মত ঝাঁকে ঝাঁকে নাগা সেনারা উঠে আসছে নিচে থেকে। ধীরে ধীরে এই অসম যুদ্ধে পিছু হটছে রাজপুত সেনারা। নাগারা তাদের দেহ ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে পাহাড়ের নিচে।
তারপর ভিতরে ঢুকে তছনছ করতে শুরু করল সব কিছু। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে। ভুতের মত রক্তাক্ত দুর্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। নাগাদের সমস্ত আক্রোশ যেন দুর্গের দেয়ালের পাথরগুলির উপরে। প্রতিটি পাথরকে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে সবাই। যত মূর্তি আর শৌখিন সামগ্রী ছিল তার একটাও আস্ত নেই। ঘরের মেঝে থেকে পাথর সরিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে গুপ্তধন খুঁজছে ওরা।
হঠাৎ চোখের সামনে ঝাপসা অন্ধকার হয়ে গেল। চোখ কচলে তাকিয়ে দেখি সামনের দৃশ্য আবার পরিবর্তন হয়ে গেছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে অনেকগুলি ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের শব্দ। দূর থেকে ছুটে আসছে। গাছের নিচে দিয়ে যাবার সময় তাদের মাথার উপর লাফিয়ে পড়ল কয়েকজন লোক। মুখে কালো কাপড় বাঁধা। অত্যন্ত ক্ষিপ্র। নিমেষের মধ্যে খতম করল ঘোড়সওয়ারগুলিকে। শেষে কয়েকজনকে বন্দি করে আবার ঘোড়ার পিঠে তুলে ছুটতে শুরু করল।
কারা এরা? এসব কী দেখছি আমি? এটা কি কোন স্বপ্ন? আবার একবার চোখ বন্ধ করে খুলতে দেখি দৃশ্য পরিবর্তন হয়েছে। ঘোড়সওয়ারগুলি একটা পাহাড়ের নিচে এসে ঘোড়াগুলি রেখে বন্দিদের টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে গেল। আমি গেলাম পিছন পিছন। গুহার ভিতরটা বেশ বড়। সেনাপতি সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত। বন্দিদের মধ্যে একজনের মুখের কাপড় সরাতে দেখলাম রাজা বিক্রম সিংহ। সামনে সেনাপতিকে দেখে তিনি গর্জে উঠলেন।
“তুমি আমাকে ধরে এনেছ? এত স্পর্ধা তোমার?”
“মহারাজ, আমাকে মাপ করবেন। তোষাখানায় প্রবেশের গুপ্ত পথ খুঁজে পেলে আপনাকে কষ্ট দিতাম না। গোটা দুর্গ খোঁড়াখুঁড়ি করেও আমরা তোষাখানার পথ পাইনি। এখন আপনি যদি বলেন কীভাবে সেখানে যাওয়া যায়, তাহলে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।”
রাজা দৃঢ় গলায় বললেন, “সে পথ তোমার মত পাপীর জন্য নয়। আর আমার প্রাণ চলে গেলেও সে পথের হদিশ তোমাকে দেব না।”
এরপর সেনাপতির নির্দেশে একে একে রাজপরিবারের সবাইকে হত্যা করা হল। আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম। এসব নির্মম হত্যা দেখতে আমার একেবারেই ভালো লাগছে না।
ফের চোখ খুলতে দেখি সামনে একটা বিস্তৃত হ্রদ। চারিদিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা শান্ত নীল জল। সোচ্চারে মন্ত্রোচ্চারণের শব্দে দৃষ্টি গিয়ে পড়ল এক গেরুয়াধারী সাধুর দিকে। হ্রদের জলে স্নান সেরে সূর্যপ্রণাম করছেন তিনি। ধীরে ধীরে উঠে এলেন। হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা। গেরুয়াধারীর পা জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন।
“বাবা আমাকে বাঁচান।”
“কে তুমি? কী চাই?”
“আমি রাজা বিক্রম সিংহের দ্বিতীয় স্ত্রী। সেনাপতি শত্রুপক্ষ নাগাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে। রাজবংশের হবু সন্তানকে নিয়ে আমি আপনার শরণাপন্ন। আমাদের আপনি রক্ষা করুন।”
“মল্লারের এত সাহস। তুমি কোন চিন্তা কোর না মা। সন্তানের জন্ম থেকে আঠারো বছর বয়েস পর্যন্ত তোমরা আমার কাছে থাকবে। শত্রুকে বিনাশ করার সব শক্তি আমি তাকে দিয়ে যাব।”
“জয় রাজগুরু।” বলে সে মহিলা আবার তাঁর পায়ে প্রণাম করলেন।
রাজগুরু বললেন, “মহারাজা বিক্রম সিংহকে যারা হত্যা করেছে, সেই বিশ্বাসঘাতকরা কোন দিন রাজ ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারবে না। প্রত্যেকে অপঘাতে মারা যাবে। যক্ষ হয়ে পাহারা দেবে রাজ তোষাগার। ভবিষ্যতে কেউ যদি এই ধনরত্ন অসৎ উপায়ে দখল করতে চায়, তারও একই পরিণতি হবে। এটা লিঙ্গেশ্বরের অভিশাপ। সেখানে পৌঁছোবার জন্যও তার প্রয়োজন হবে একটি পবিত্র অস্ত্রের। রাজদেবী মা ভৈরবীর আশির্বাদ নিয়ে রাজ বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী নিজের রক্তে শোধন করলে তবেই সেই অস্ত্র প্রাণ পাবে আর তার সংস্পর্শে খোলা যাবে রাজ তোষাগারের গুপ্ত দরজা।”
এর পরের দৃশ্য রাজগুরু লিঙ্গেশ্বর রাতের অন্ধকারে মশাল হাতে একটা বড়ো গোল পাথরের কুয়ার মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। জল অনেক নিচে। গুনে গুনে দেড়শ সিঁড়ি নেমে দেয়ালের গায়ে একটা পাথরে জোরে ধাক্কা দিলেন কয়েক বার। পাথরটা ভিতরে সরে যেতে গেরুয়া চাদরে জড়ানো সোনালী পাতে মোড়া একটা অতিকায় তলোয়ার বের করে রানিকে দেখিয়ে রেখে দিলেন সেখানে। আবার পাশের পাথরে তিনবার ধাক্কা দিতে দেয়ালটি সমান হয়ে গেল। লিঙ্গেশ্বর এবার কাপড়ের ভাঁজ থেকে একটা মালা বের করে এনে রানির হাতে দিয়ে বললেন, “বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এই মালা গলায় ধারণ করলে তবেই এই পবিত্র অস্ত্রের সন্ধান পাবে। নচেৎ নয়।”
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত ঘোরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলাম। খেয়াল হল অন্ধকার ঘরের মধ্যে সত্যি খুব গুমোট করেছে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। গলা থেকে রুদ্রাক্ষ আর তাবিজ কবজের মালা গুলি খুলে বাক্সে ঢুকিয়ে সেটাকে যথাস্থানে রেখে দিলাম। জানালাগুলো খুলে দিতে এক ঝলক ঠাণ্ডা তাজা হাওয়া ভিতরে ঢুকে পরিবেশটা স্বাভাবিক করে দিল। রাত শেষ হতে তখনও বাকি। যা দেখলাম, সেটা কি শুধুই স্বপ্ন ছিল? স্বপ্নের মধ্যে গুপ্তধনের কিছু সঙ্কেত পেলাম মনে হচ্ছে। কিন্তু এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে বাকি। যাই হোক, বিছানায় আবার মাথা দিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন প্রাতরাশ সেরে মহেশ্বর প্রসাদের ছেলে শঙ্করের সাথে ঘোড়ায় করে বের হলাম হেমগিরি তান্ত্রিকের ডেরার উদ্দেশ্যে। রাজ সৌজন্য অনুসারে শঙ্করবাবু তান্ত্রিকের জন্য একটা পুঁটুলিতে চাল, ডাল, সবজি ও ফল বেঁধে নিয়েছেন। বললেন, “যখনই আমরা ওঁর সাথে দেখা করতে যাই, কিছু না কিছু নিয়ে যাই সঙ্গে। এটাই বংশের রীতি।”
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ায় করে যেতে যেতে লক্ষ করলাম, গতকালকে ভারী ঝড়বৃষ্টিতে বেশ কিছু বড়ো বড়ো গাছ ভেঙে পড়ে রয়েছে। ঘণ্টাখানেক সময় লাগল সেই গুহার মুখে পৌঁছাতে। আগের দিনের দেখা শান্ত ঝর্ণাটি উত্তাল হয়ে বয়ে চলেছে। কী তার গর্জন! শঙ্করবাবু ঘোড়া গুলিকে গাছের সাথে বেঁধে বললেন, “সাবধানে আসুন আমার সাথে।”
আমি তাঁকে অনুসরণ করে পিছল শ্যাওলাধরা পাথরের খাঁজে পা দিয়ে গাছের ডালপালা ধরে উঠে এলাম উপরে। গুহার ভিতরেও পড়ছে ঝিরঝিরে জলের ধারা। যত ভিতরের দিকে এগচ্ছি, তত সরু হয়ে যাচ্ছে পথ। খুব কষ্ট করে অনেকটা এগোনোর পর খেয়াল হল ভিতরের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা। শুকনো খটখটে এবং বেশ গরম। বুঝলাম পাহাড়ের মাঝামাঝি চলে এসেছি। ধীরে ধীরে গুহাটা চওড়া হয়ে বড়ো ঘরের মত চেহারা নিয়েছে। প্রথম চোখ পড়ল একটা কালীমূর্তির উপর। কালো পাথরের তৈরি। মুখখানা ভয়ঙ্কর। তার নিচে লাল সিঁদুর মাখানো মড়ার খুলি দিয়ে সাজানো পঞ্চমুণ্ডির আসন। কিন্তু তান্ত্রিক কোথায়? শঙ্করবাবু বললেন, “হয়ত কোন কাজে বেরিয়েছেন। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
পাথরের উপরে বসে ভাবলাম, গত কয়েকদিনে ঘটনা পরম্পরা এত দ্রুত পালটে যাচ্ছে যে মস্তিষ্ক কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, বাস্তব আর অবাস্তব সব গুলিয়ে ফেলেছে। কালকে রাতে যে স্বপ্নটা দেখলাম, সেটা কী সত্যি? না আমার মস্তিকের কল্পনা? শুধু একটা খটকা লাগছে। কেকের সাথে দু বছর আগে শিলঙয়ে আমার যদি দেখা না হত তাহলে কী আমি এই জায়গায় এসে পৌঁছতাম? কে জানে! আমি হয়ত কলকাতাতেই সারা জীবন কাটিয়ে দিতাম। কখনো জানতেই পারতাম না যে কোপিলাগড় নামে একটা দুর্গ আছে, আর আমিই তাদের হারিয়ে যাওয়া ছোট রাজকুমার।
গতকাল রাতের স্বপ্নটা শঙ্করবাবুকে বললাম। তিনি জানালেন, এর পরের ইতিহাস কিছুটা তিনি দাদুর মুখে শুনেছেন।
“রাজকুমার শিবমের বয়েস তখন আঠার। নিজে হাতে ধরে তাকে সমস্তরকম অস্ত্র চালনা শিখিয়েছেন রাজগুরু লিঙ্গেশ্বর। তেমনি দিয়েছেন রাজতন্ত্রের শিক্ষা। কামরূপের রাজা তখন ‘স্বর্গদেও চাওলুং সুখাপা’। তাঁর সৈন্যবাহিনীতে ভর্তির জন্য যুবকদের নিয়োগ করা হচ্ছে। ছিপছিপে চেহারার শিবম সমস্ত পরীক্ষায় প্রথম হয়ে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিল। সুখাপা উত্তর পূর্ব ভারতের সমস্ত ছোট ছোট রাজাকে পদানত করে ‘অহোম রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন। রাজার নির্দেশে বিদ্রোহী নাগাদের দমন করার জন্য বাহিনী এগিয়ে চলল কোপিলাগড়ের দিকে। সেই যুদ্ধে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতা আর বিচক্ষনতার জন্য রাজা সুখাপা, শিবমকে কোপিলাগড়ের সুবেদার করে দিলেন। বহুবছর পর কোপিলাগড় আবার নতুন করে সেজে উঠল। কিন্তু রাজ তোষাগারের কথা ভুলে গেল সবাই। এক রাজগুরু লিঙ্গেশ্বর জানতেন কীভাবে প্রবেশ করতে হয় সেখানে। তিনি তন্ত্রের সাহায্যে এমন মায়াজাল রচনা করলেন যাতে সেখানে শুধু মাত্র রাজপরিবারের প্রকৃত উত্তরাধিকারই পৌঁছাতে পারে। এখন মহারাজ হেমগিরি একমাত্র পারেন সেই মন্ত্র বন্ধন কাটিয়ে তোমাকে গুপ্ত তোষাগারের পথ দেখাতে।”
আমি বললাম, “কিন্তু সে সবে আমার কী প্রয়োজন। আমি তো ধনরত্নের জন্য এখানে আসিনি।”
এই সব কথা বলতে বলতেই একটা পায়ের শব্দ পেলাম। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবেশ করলেন এক শীর্ণকায় দীর্ঘদেহী কালো পোশাক পরা তান্ত্রিক। আর তাঁকে দেখা মাত্রই শঙ্কর বাবু “জয়, হেমগিরি মহারাজের জয়” বলে মেঝেতে শুয়ে পড়লেন।
“কী সংবাদ শঙ্কর? এই অসময়ে?” বলে তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল আমার উপর। কিছুক্ষণ কড়া দৃষ্টিতে লক্ষ করলেন আমায়। তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, “কে এই যুবক?”
“চিনতে পারলেন না মহারাজ? এই তো আমাদের হারিয়ে যাওয়া ছোট রাজকুমার।”
উত্তরটা সম্ভবত তাঁর পছন্দ হল না। আবার ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, “কোথায় পেলে একে?”
“আজ্ঞে, রাজকুমার নিজেই খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছেন এখানে। তবে ছোটবেলার স্মৃতি কিছু মনে নেই। তাই আপনার কাছে নিয়ে এলাম।”
আমার দিকে এগিয়ে এসে তান্ত্রিক বললেন, “দেখি তোমার ডান হাত।”
আমি হাতটা বাড়িয়ে দিতে হাতের রেখা গুলির দিকে এক দৃষ্টি তাকিয়ে থেকে বললেন, “না এই যুবক আমাদের রাজকুমার নয়। দেখতে অনেকটা একই রকম। কিন্তু হাতের রেখা ভুল কথা বলবে না। ফিরে যাও তুমি।”
কথাটা শুনেই মাথাটা ঘুরে উঠল আমার। এ কী করে হয়? কেকে চিনতে পারলেন, মহেশ্বরবাবু চিনতে পারলেন কিন্তু ইনি চিনতে পারলেন না! অথচ রাধাদেবী এঁর সাহায্যেই আমার পূর্বস্মৃতি মুছে দিয়েছিলেন। আশ্চর্য!
শঙ্করবাবু বললেন, “আপনি আর একবার ভালো করে দেখুন মহারাজ। রাজা ভান সিংহের মুখ একেবারে বসানো।”
“ভুল আমার হয় না শঙ্কর। তোমরা এখন এসো। আমার সাধনার সময় হয়েছে।”
এরপর আর কোন কথা হয় না। আমরা ফিরে এলাম। কিন্তু মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে। ঘোড়ায় উঠে শঙ্করবাবু বললেন, “বুঝতে পারছিনা হেমগিরি কেন তোমাকে চিনতে অস্বীকার করছেন। আমার মতে তাঁর ভুল হচ্ছে।”
আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, “এরপর কোপিলাগড়ের দুর্গে যাবার আর কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমি ঘুমসি পাহাড় বাংলোয় ফিরে যাচ্ছি। পরে ম্যানেজার সুরেশবাবু আমার জিনিসপত্র আনিয়ে নেবেন।”
শঙ্করবাবুকে বিদায় জানিয়ে ডাইনে বেঁকে কিছু দূর এসেই রাবার গাছের জঙ্গল পড়ল। এ রাস্তা আমার চেনা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ায় করে একাই ফিরলাম। ঘুমসি পাহাড়ের বাংলোয় পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে গেল। সুরেশবাবুকে বললাম, “বিকালের মধ্যে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিন। সন্ধ্যায় শিলং পৌঁছে যাব।”
কিন্তু আমার পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঝমঝমে বৃষ্টি শুরু হল। সুরেশবাবু জানালেন, “আজকে আর ফেরা যাবে না স্যার। কাল সকালের আগে গাড়ির বন্দোবস্ত হবে না।”
অগত্যা বাকি সারাটা দিন বাংলোর ঘরে বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখা। মন পড়ে আছে কোপিলাগড়ের দুর্গে। একটা একটা করে অঙ্ক মিলতে শুরু করেছিল। নিজের হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা, বংশ পরিচয় খুঁজে পাচ্ছিলাম। কিন্তু হেমগিরির সাথে দেখা হওয়ার পরেই সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আচ্ছা আমি যদি ঐ বংশের কেউ না-ই হব তাহলে রাজা ভান সিংহের সাথে আমার এত মিল কী করে হল? আর কাল রাতের সেই স্বপ্নটা!
কত রকমের চিন্তা মাথায় ভিড় করে আসছে। একটা সাইকোলজিক্যাল জার্নালে পড়ছিলাম স্মৃতি ভুলে যাওয়াটা একটা অসুখ। এটা অনেক সময়ে জিনগত হয়। যাদের এই অসুখ থাকে তারা মানসিক চাপের মধ্যে পড়লে আবার এর পুণরাবৃত্তি হতে পারে। তার মানে এই ঘটনাগুলি যে আমার জীবনে ঘটছে, পরে আবার মুছে যেতে পারে স্মৃতি থেকে। এরকম যে হবেই তার কোন গ্যারেন্টি নেই, কিন্তু সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। সুরেশবাবুকে কালকের ঘটনা বেশ খানিকটা খুলে বলেছি আমি। তাঁর চোখে অবিশ্বাস ছিল। তবু, তাঁর কাছ থেকে একটা নতুন ডায়রি চেয়ে নিয়ে দু বছর আগের শিলং থেকে শুরু করে পুরো ঘটনা যতটা সম্ভব গুছিয়ে লিখে রাখার চেষ্টা করছি।
এই পর্যন্ত বলে সুরেশবাবু ডায়রিটা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকালেন। ঋজু বলে উঠল, “তারপর?”
“এই ডায়রিটা পাওয়া যায় ঘরের মধ্যে। কিন্তু মানুষটাকে পাওয়া যায়নি।”
পাতা প্রশ্ন করল, “শুনতে তো গল্পের মত। এটা কি সত্যি ঘটনা?”
“আমি সশরীরে উপস্থিত আছি তোমাদের সামনে, এই ঘটনার সাক্ষী।”
তীর্ণা চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞাসা করল, “সেই সমুদ্রগুপ্তের তলোয়ার আর গুপ্তধন পাওয়া গেছে?”
“পাওয়া গেছে আবার যায়নি।”
“কী হেঁয়ালি করছেন ম্যানেজারবাবু?”
“বলছি বলছি, শেষ অংশটা এখনও বাকি।”
বাইরে বৃষ্টিটা তখন থেমে গেছে। সন্ধ্যা নামছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। ঘনান্ধকারের মধ্যে মৃদু আলোয় ঠাণ্ডা ঢুকছে ভিতরে। সুরেশবাবুর নির্দেশে এক বেয়ারা এসে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বেলে দিয়ে গেল।
তিনি বললেন, “যে রাতে শঙ্খবাবু এই বাংলো থেকে গায়েব হলেন সেদিনও সকাল থেকে ভারি বৃষ্টি হয়ে রাতের দিকে ধরেছিল আকাশ। আমি নিজের ঘরেই শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। উঠে বসে বেড ল্যাম্পের সুইচ অন করলাম। কিন্তু আলো জ্বলল না। বুঝলাম ইলেকট্রিক নেই। এখানে এ রকম প্রায়ই হয়। বড়ো টর্চটা জ্বেলে বাইরে বেরিয়ে দেখি শঙ্খবাবুর ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ভিতরে বিছানা পত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে। বেশ একটা ধস্তাধস্তির চিহ্ন স্পষ্ট। বাইরের বারান্দায় লক্ষ করলাম একজনের পায়ের ছাপ। জল কাদার উপর দিয়ে খালি পায়ে কেউ হেঁটে এসেছে। আবার ফিরেও গেছে। শঙ্খবাবুর জুতোগুলি ঘরের মধ্যেই পাওয়া গেল। মনে হল শঙ্খবাবুকে জোর করে কেউ তুলে নিয়ে গেছে। এত দিন এখানে আছি, এরকম ঘটনা কোন দিন দেখিনি। মিথ্যা বলব না সেই রাতে বেশ ভয় করছিল। মদনকে ডেকে তুললাম। তারপর দেরাজ থেকে রাইফেলটা নিয়ে বেশ কটা কার্তুজ পকেটে পুরে আমরা এগোতে থাকলাম ভিজে মাটিতে পায়ের ছাপ লক্ষ করে। মনে হল যে এসেছিল সে বেশ লম্বা আর বলশালী। কারণ একটা পায়ের ছাপের থেকে অন্যটার দূরত্ব সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি। এ জঙ্গল আমাদের দুজনেরই হাতের তালুর মত চেনা। তবু মাঝে দুয়েকবার গুলিয়ে ফেলছিলাম। যে ব্যক্তিটির আমরা পিছু নিয়েছি সেও সম্ভবত স্থানীয় লোক। রাতের অন্ধকারে জোরালো টর্চের আলো তার চোখে পড়ে যেতে পারে সেই ভয়ে টর্চ না জ্বালিয়েই আমাদের এগোতে হচ্ছিল।
“বেশ কিছুক্ষণ এগোনর পর পাথুরে জমি শুরু হয়ে গেল। পায়ের ছাপ মিলিয়ে গেছে। এবার কোন দিকে যাব? মদন বলল, এখনও পর্যন্ত যে রাস্তায় এগোচ্ছি, সেটা কোপিলাগড়ের দিকেই যাচ্ছে বলে মনে হয়। কথাটা ঠিক। অর্থাৎ শঙ্খবাবুকে কেউ ওখানেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওঁর মুখে আমি আগেই শুনেছিলাম কিছু অদ্ভুত ঘটনার কথা। তাহলে ওঁর প্রাণ সংশয়ও হতে পারে।
“প্রায় ঘণ্টা দুই পর আমরা কোপিলাগড় দুর্গে পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখলাম একেবারে নিঝুম, অন্ধকার। বাইরের ফটকে দুমদুম করে ধাক্কা দিলাম। মিনিট পাঁচেক পরে মহেশ্বরবাবুর ছেলে শঙ্কর প্রসাদ বেরিয়ে এসে আমাদের দেখে চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার? এত রাতে?’, আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ‘শঙ্খবাবু কোথায়?’ শুনে মনে হল আকাশ থেকে পড়লেন উনি। তারপর আমার মুখে সব কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আসুন তো আমার সাথে।’
“আমরা দুর্গের ভিতরে ঢুকলাম ওঁর সাথে। আমাদের সঙ্গে যেতে যেতে তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘সুরেশবাবু, আপনাকে শঙ্খবাবু আর কী বলেছেন?’
“তিনি বলেছেন, এই দুর্গের নিচে নাকি হাজার বছরের পুরানো গুপ্তধন লুকানো আছে। আমার যদিও কথাটা ঠিক বিশ্বাস হয়নি।
“ঠিকই বলেছেন উনি। তবে আজকে রাতে যখন শঙ্খবাবুকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, তার মানে আজকেই একটা হেস্তনেস্ত করবে ওরা।
“আমি জানতে চাইলাম, ‘ওরা মানে কারা?’
“ ‘অজিত সিংহ আর বিরজু। ওকে কোথায় নিয়ে গেছে একটা আন্দাজ পাচ্ছি। কিন্তু ওরা শুধু দুজনে তো থাকবে না। ওদের সঙ্গে লোকবল অনেক আছে। আমাদেরও দলে ভারি হতে হবে। দাঁড়ান আমার ছেলেকে ডাকি। ওকে দিয়ে গ্রামের মোড়লকে খবর পাঠাতে হবে।’ বলে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে দৌড়ে ভিতরে চলে গেলেন।
“কিছুক্ষণের মধ্যেই আঠারো কুড়ি বছরের এক ছেলেকে নিয়ে ফিরে এলেন। ‘আমি একে বুঝিয়ে দিয়েছি কী করতে হবে? আপনারা আমার সাথে আসুন।’ ছেলেটি প্রধান দরজার দিকে চলে গেল। আমরা শঙ্করবাবুর সাথে দুর্গের পিছন দিকে চললাম।
“জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
“প্রত্যুত্তরে শুধু মুখে আঙুল দিয়ে বারণ করলেন কথা বলতে। একটা বড়ো ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর কোনের দিকে দেয়ালের সাথে আটকান একটা পাথরের মুর্তিকে দু পাক ঘোরাতে মেঝের একটা পাথর সরে গেল। দেখলাম নিচে সিঁড়ি নেমে গেছে। টর্চ জ্বেলে আমরাও নামলাম তাঁর সাথে। ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে ঘুরে অনেকটা নেমেছে সিঁড়িটা। বুকের ভিতর তখন ঢিপঢিপ করছে। কোন পাতালে নেমে যাচ্ছি কে জানে? এর পরে আর ফিরতে পারব তো? দু দিকে খাড়াই পাথরের দেয়াল। পিছনে আমার শাগরেদ নামতে নামতে ক্রমাগত ইষ্টনাম জপ করছে। আনুমানিক দশতলা বাড়ির সমান সিঁড়িটা একটা গুহার মুখে গিয়ে শেষ হল। শঙ্করবাবু একটা ইসারা করে ঢুকে গেলেন গুহার ভিতরে। আমরাও তাঁর পিছু নিলাম। আরও প্রায় পাঁচশো ফুট গিয়ে শেষ হল গুহাটি। একটা বড়ো পাথরের কোল ঘেঁষে বেরিয়ে দেখলাম মাথার উপরে আকাশ, অন্ধকারে তারারা মিটমিট করছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম এতক্ষণে। ভিতরে যেন দম আটকে আসছিল।
“শঙ্করবাবু বললেন, ‘এ হল দুর্গে ঢোকা আর বের হবার গুপ্ত সুড়ঙ্গ। আমারা ছাড়া এ রাস্তা কেউ চেনে না। শঙ্খবাবুকে যেখানে আটকে রেখেছে, সেখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্য এই পথে এলাম। বাইরে দিয়ে আসতে গেলে দু’ঘণ্টা সময় লাগত। ততক্ষণে ওঁকে জীবিত পেতাম কিনা সন্দেহ। ঐ দেখুন ওখানে আলো জ্বলছে, চুপচাপ চলে আসুন আমার সাথে।’
“সামনে ঘন জঙ্গল, বড় বড় গাছে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা হলুদ আলোর আভা। আমরা গুটি মেরে এগোলাম সেই দিকে। বেশ কিছুটা গিয়ে হ্রদের পাড়ে পাহাড়ের সানুদেশে পৌঁছলাম। হাত ঘড়িতে দেখলাম রাত আড়াইটে। শঙ্করবাবু বললেন, ‘আমরা তিনজন আলাদা আলাদা ভাবে ঐ গুহার দিকে এগোব। শত্রুপক্ষ ক’জন আছে জানি না। তবে নিশ্চিত যে সংখ্যায় তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি। মনে রাখবেন, যে কোনভাবে ছোট রাজকুমারকে বাঁচাতেই হবে। আর একটা কথা, আপনার হাতে যে বন্দুকটা আছে সেটা সাবধানে ব্যবহার করবেন। অযথা গুলির আওয়াজ হলে ওরা সাবধান হয়ে যাবে। তাতে আমাদেরই বিপদ।’”
“তারপর?” কথা থামতেই সবাই সমস্বরে প্রশ্ন করল।
“বন্দুকে দুটো কার্তুজ লোড করে সেফটি ক্যাচ সরিয়ে নিলাম। তারপর গুঁড়ি মেরে এগোলাম সেই আলো লক্ষ করে। কাছে গিয়ে দেখি বাইরে দু’জন পাহারা দিচ্ছে। একজনের হাতে বড়ো বন্দুক, আর একজনের হাতে তলোয়ার। এখন কী করব? ভাবতে ভাবতেই একটা শিস দেওয়ার শব্দ হল আর তলোয়ার হাতে লোকটি ঘাড়ে হাত দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। অন্যজন সেদিকে এগিয়ে যেতেই চোখের পলকে গাছের আড়াল থেকে ক্ষিপ্র চিতার মত লাফিয়ে পড়ে তার ঘাড়ে এক জবরদস্ত রদ্দা মারলেন শঙ্করবাবু। সেও গড়িয়ে পড়ল বেঁহুশ হয়ে। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম প্রথমজনের ঘাড়ে একটা পালক লাগানো একটা তির বিঁধে রয়েছে। মদন ততক্ষণে আমাদের পিছনে এসে হাজির হয়েছে। পড়ে থাকা বন্দুকটা নিজে নিয়ে তলোয়ারটা তার হাতে তুলে দিলেন শঙ্করবাবু। বললেন, ‘তুমি বাইরেই থাক। গ্রামের লোকেরা এসে পড়লে সবাই একসাথে ভিতরে ঢুকবে।’
“আমরা দুজন এগিয়ে গেলাম গুহার মুখ লক্ষ করে। কাছাকাছি গিয়ে পাথরের আড়াল থেকে দেখলাম, ভিতরে একটা ধুনি জ্বলছে। আগুনের চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন লোক। একধারে একটা মোটা পাথরের থামের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে শঙ্খবাবুকে। মাথাটা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। মনে হল সংজ্ঞা নেই। শঙ্করবাবু চিনিয়ে দিলেন, লাল পোশাক পরে রাজা ভান সিংহের বড় ছেলে বিরজু। পাশে রাজার ভাই অজিত সিংহ। কালো পোশাক পরা এক তান্ত্রিক জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। শঙ্করবাবু বললেন, ‘ইনি হেমগিরির শিষ্য কালবৈঠা।’ জানতে চাইলাম, কী করছে এরা? উনি বললেন, ‘রাজ তোষাগারে প্রবেশের জন্য মন্ত্র-বন্ধন খুলছে। রাজগুরু লিঙ্গেশ্বর সাত জন নাগাকে জীবন্ত সমাধি দিয়ে যক্ষ করে মন্ত্রবন্ধন দিয়েছিলেন।’ পাশে দেখলাম চার জন লোক শাবল আর গাঁইতি দিয়ে পাথর সরানোর চেষ্টা করছে।
“হঠাৎ পিছনে একটা আওয়াজ হতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আগের দুজন লোক উঠে এসে আমার মাথার কাছে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়েছে। শঙ্করবাবু দেখি তাঁর বন্দুকের নলটাও আমার দিকে ঘুরিয়ে ধরেছেন। চাপা গলায় বললেন, ‘রাজকুমারের মুখ থেকে এ অনেক ভেতরের ঘটনাই জেনে গেছে। আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।’
“এইবার পাথরের পাশ থেকে আর একজন বয়স্ক কালো জ্যাকেট পরা লোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘তাহলে একেও খতম করে দিতে হবে। আপাতত বেঁধে ভিতরে নিয়ে চল।’
“কিছুক্ষণের মধ্যে আমাকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় শঙ্খবাবুর পাশে ছুঁড়ে ফেলা হল। আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে শঙ্করবাবু একটা অট্টহাসি দিয়ে বিদ্রূপের সুরে বললেন, ‘বেশি গোয়েন্দাগিরি মোটেই ভালো নয় সুরেশবাবু। গুপ্তধন পেয়ে গেলে আপনাদের দুজনকেই মরণ কুয়োয় ফেলে দেওয়া হবে। কেউ আপনাদের লাশ খুঁজে পাবে না।’
“অজিত সিংহ এগিয়ে এসে বললেন, ‘শঙ্কর আবার কাকে জুটিয়ে এনেছে কেকে?’
“আমি তো শুনে অবাক! কালো জ্যাকেট পরা লোকটি কেকে? আশ্চর্য! এঁর নাম আমি শঙ্খবাবুর মুখে শুনেছি। প্রাক্তন পুলিশকর্তা। তিনি দেখলাম আমাকে চেনেন। বললেন, ‘এ হচ্ছে ঘুমসি পাহাড়ের রাবার গার্ডেনের ম্যানেজার। রাজকুমার এর কাছেই উঠেছিল এসে। রাজপরিবারের অনেক গুপ্ত কথাই এ শঙ্খর কাছ থেকে জেনে গিয়েছে।’
“হঠাৎ বিরজু এগিয়ে এসে বলল, ‘পাথর সরানো হয়ে গেছে, এবার তালাটা খুলতে হবে। তলোয়ারটা চাই।’
“অজিত সিংহ প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু আপনি ঠিক জায়গাটা বেছেছেন তো কেকে?’
“কেকে মাথা নেড়ে মৃদু হাসলেন, ‘গোটা জীবনটাই তো গোপনে গোপনে ওই গুপ্তধনের খোঁজ করে গেলাম হে। জায়গা আমি ভুল বাছিনি। যারা এই তোষাগার তৈরি করেছিলেন তাঁদের বুদ্ধির তারিফ করতেই হবে। গুপ্তধন যদি দুর্গের মধ্যে থাকত তাহলে সেটা কবেই লুঠ হয়ে যেত। এত বছর ধরে বহুবার আক্রমণ হয়েছে, খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছে দুর্গের মধ্যে। কিন্তু আসল জায়গাটা কেউ খুঁজে পায়নি। গুপ্তধন আছে। কিন্তু দুর্গের মধ্যে না থাকলে, সেটা কোথায়? আমি যখন রাজা ভান সিংহের মৃত্যুর তদন্ত করতে এসেছিলাম, একটা জিনিস লক্ষ করি, রাজা যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরের একটাই জানালা। পূর্ব দিকের সেই জানালা দিয়ে সরাসরি এই গুহার মুখটা দেখা যায়। পরে ভেবে দেখলাম, পাহাড়ের মাথায় দুর্গের ঐ একটাই ঘর থেকে গুহার এই মুখটা দেখা যাবার পিছনে রয়েছে ক্ষুরধার বুদ্ধির ছাপ। ঐ ঘরে বসেই নজর রাখা হত এই গুপ্তধনের উপর। আর এই জায়গাটা চারিদিকে পাহাড়, টিলা আর হ্রদ দিয়ে ঘেরা ঘন জঙ্গলের মধ্যে। খুব সহজে বাইরের লোকের পা এখানে পড়বে না। তোষাগারটিকে রক্ষা করার জন্য দুর্গটি তৈরি করা হয়েছিল, দুর্গের মধ্যে তোষাগার তৈরি হয়নি। কিন্তু সবকিছু জানার পরেও গুপ্তধন আমি বের করতে পারিনি। কারণ বংশের আসল পবিত্র তলোয়ারটার দরকার ছিল মন্ত্রের মায়াজাল কেটে গুপ্তধনের কাছে পৌঁছোবার জন্য। এইবার সেটা হাতে এসে পৌঁছেছে।’
“ ‘আসল তলোয়ার –মানে? সেটা তো আগে থেকেই আপনার কাছে ছিল!’
“ততক্ষণে পিছন থেকে মহেশ্বরের ছেলে একটা লম্বা ব্যাগ কাঁধে করে এগিয়ে এসেছে। বুঝলাম, গ্রামের লোক ডাকতে যাওয়া সব নাটক। ছেলেটি ব্যাগ খুলে বের করল সোনার খাপে ভরা একটা তলোয়ার। বলল, ‘এই নিন সমুদ্রগুপ্তের আসল তলোয়ার।’
“তলোয়ারটা হাতে নিয়ে কেকে তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘রাজা ভান সিংহ ছিলেন অতি ধুরন্ধর লোক। সবাইকে বোকা বানিয়ে তলোয়ারের একটা রেপ্লিকা তৈরি করেছিলেন বিক্রি করার জন্য। শিংলয়ের বাংলোয় সবার সামনে সেটাই দেখানো হয়েছিল। আসল তলোয়ার হলে সেটা কখনও বিক্রি করার কথা ভাবতেন না। সেদিন রাতে বিরজু রাজাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর রাজার আত্মহত্যার ঘটনা সাজিয়ে নকল তলোয়ারটা নিয়ে পালানোর সময়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। আমি তখনই ওর মুখে গুপ্তধনের ইতিহাসটা জানতে পারি। নিজেকে বাঁচাতে তখন তলোয়ারটি আমার হাতে তুলে দিয়ে ও পালিয়ে যায়। পরে আমি সেই তলোয়ার নিয়ে এই গুহায় এসেছিলাম। কিন্তু সেটা দিয়ে যখন এই গুপ্ত দরজা খুলল না, তখনই বুঝেছিলাম এটা আসল তলোয়ার নয়। আমি তবু হাল ছাড়িনি। বছরের পর বছর খুঁজে গেছি। রাজবংশের পুরোনো গল্প জোগাড় করেছি লোকজনের মুখ থেকে। আর তাতেই জেনেছিলাম, কীভাবে সন্ধান মিলবে এই আসল তলোয়ারের। রাজবংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী যদি লিঙ্গেশ্বরের দেয়া মালা গলায় ধারণ করে একমাত্র তবেই তার চোখে ফুটে উঠতে পারে আসল তলোয়ারের গুপ্তস্থান।’
“কালবৈঠা প্রশ্ন করলেন, ‘বিরজু তো রাজার বড় ছেলে। তাকেই তো—’
“অজিত সিংহ মাথা নেড়ে বললেন, ‘বিরজু দাদার নিজের সন্তান নয়। দত্তক নেওয়া ছেলে। সোজা পথে এই ঐশ্বর্য সে কোন দিনই ভোগ করতে পারত না।’
“বিরজু বলল, ‘আমি শিলঙের বংলোয় একদিন রাতে বাবামায়ের কথা আড়ি পেতে শুনেছিলাম। তারা বলছিল আমি তাদের নিজের ছেলে নয় বলে রাজঐশ্বর্যের উপর আমার কোন অধিকার নেই। তখনই ঠিক করি ঐ তলোয়ারটা নিয়ে আমি পালাব। পরে যখন জানতে পারলাম ওটা নকল, তখন ভাবলাম সব কিছু শেষ। কিন্তু আসল সমুদ্রগুপ্তের তলোয়ারটা পাওয়া গেল কীভাবে?’
“বিরজুর প্রশ্নের জবাবে এইবার শঙ্করবাবু মুখ খুললেন, ‘কেকের মুখে শঙ্খবাবুর খোঁজ পাবার পর তাকে যেভাবেই হোক এইখানে আনবার চেষ্টা করা শুরু করি আমরা। কিন্তু কেকে-র চিঠিতে যখন কাজ হল না তখন কেকে সরকারী যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক কসরৎ করে ফের তাকে তার অফিসের কাজে এইখানে নিয়ে আসেন। তারপর সে নিজেই যখন দুর্গে এসে হাজির হল, তখন আমি তাকে চোখে চোখে রেখেছিলাম। সূরজ ওরফে শঙ্খ সেন সেদিন দুর্গে রাত কাটাতে গিয়ে স্বপ্নের মধ্যে একটা কুয়ো দেখেছিল। পরে কথাটা আমাকে যখন বলল, ভেবে দেখলাম সেরকম কুয়ো এ তল্লাটে একটাই আছে। দুর্গের পূর্ব দিকে পুরানো কালীমন্দিরের পিছনে। রাজগুরু লিঙ্গেশ্বর ঐ মন্দিরেরই পূজারী ছিলেন। কুয়ার মধ্যে গুনে গুনে দেড়শ সিঁড়ি নেমে দেয়ালের গায়ে একটা আলগা পাথরের ভিতরে ছিল এই তলোয়ার। আমিই বের করেছি সেখান থেকে। আর একটা কথা, শুধু এই তলোয়ার দিয়ে যদি গুপ্ত দরজা খুলে যেত তাহলে আমাকে কষ্ট করে লোক লাগিয়ে রাজকুমারকে আবার এখানে ধরে আনতে হত না। প্রকৃত উত্তরাধিকারী যখন নিজের রক্ত দিয়ে এই তলোয়ারকে শোধন করবে তখনই একমাত্র দৈব্যশক্তি এতে ভর করবে। আর খোলা যাবে গুপ্ত দরজা।’
“কেকে এগিয়ে এসে শঙ্করের কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, ‘সাবাস!’
“কালবৈঠা মন্ত্রের পাঠ শুরু করলেন। ধুনীতে আগুন জ্বলে উঠল আরও জোরে। উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রচ্চারণে গমগম করে উঠল গুহার ভিতর। কিছুক্ষণ পর শঙ্খবাবুর বাঁধন খুলে চাগিয়ে নিয়ে আসা হল যজ্ঞের আগুনের কাছে। লক্ষ করলাম তাঁর চাহনিটা কেমন যেন নেশার ঘোরের মত। নিজের পায়েও ঠিক মত দাঁড়াতে পারছেন না। টলমল করছেন। তলোয়ারের লোহার পাতটা ততক্ষণে যজ্ঞের আগুনে লালচে হয়ে উঠেছে। বিরজু কোমর থেকে একটা ছোরা বের করে শঙ্খবাবুর ডান হাতের তালুতে একটা আঁচড় দিতেই লাল রক্ত টপটপ করে ঝরে পড়ল তলোয়ারটির উপর।
“তারপর কেকে এগিয়ে এসে তলোয়ারটি কালবৈঠার হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন গুহার ভিতর। পিছনে বাকি সবাই এগোল। শঙ্খবাবুকে ছেড়ে দিতেই চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন পাথরের মেঝেতে। তাঁর শরীর থেকে যেন প্রাণ বায়ু শুষে নেওয়া হয়েছে। এদিকে কেকে একটা মোটা পাথরের দেয়ালের খাঁজের মধ্যে তলোয়ারটি ঢুকিয়ে চাপ দিলেন। কিন্তু কিছুই হল না।
“একে একে সবাই চেষ্টা করে দেখল, কিন্তু পাথরের দরজা এক চুলও সরল না। কিছুক্ষণ পর অজিত সিংহ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী ব্যপার? আসল তলোয়ার, আসল উত্তরাধিকারীর রক্ত, সব মিলে গেল কিন্তু দরজা খুলছে না কেন? এখন একটাই রাস্তা বাকি আছে ডিনামাইট দিয়ে পাথরের দেয়াল উড়িয়ে দাও।’
“কেকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি? ডিনামাইট দিয়ে রাস্তা খোলা গেলে আমি কবেই খুলে ফেলতাম। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, এই পাহাড়টা পুরো ফাঁপা। ডিনামাইট তো দুরের কথা বেশি শাবল গাঁইতি দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করতে গেলেও বিপদ। গুপ্তধন সমেত গোটা পাহাড় পাতালে ঢুকে যাবে।’
“ ‘তাহলে এখন উপায়?’
“ ‘একটু ভাবতে দিন,’ বলে কেকে দুবার পায়চারী করে বললেন, ‘মনে হয় কোথাও আমাদের ভুল হচ্ছে। আচ্ছা, লিঙ্গেশ্বরের দেওয়া মালাটি গলায় পরে তলোয়াটা যদি রাজকুমার নিজে হাতে ধরে এখানে প্রবেশ করায় তাহলে হয়ত এই দরজা খুলতে পারে।’
“সবাই কথাটাকে সমর্থন করল। বিরজু অচৈতন্য শঙ্খবাবুকে আবার চাগিয়ে নিয়ে গেল পাথরের দরজার কাছে। তারপর তাঁর গলায় একটা তাবিজের মালা পরিয়ে হাতে তলোয়ারটি দিয়ে নির্দিষ্ট যায়গায় প্রবেশ করানোর জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু অকস্মাৎ পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে গেল অন্য দিকে। প্রথমে শঙ্খবাবুর সারা শরীর কেঁপে উঠল, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে তলোয়ারটি হাতে করে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। এমন ভাবে দাঁড়ালেন যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি। তাঁর মুখ দিয়ে যে আওয়াজ বের হল সেটাও সম্পূর্ণ অচেনা আর গম্ভীর, ‘এই তোষাগারে প্রবেশের কোন অধিকার তোমাদের নেই। বাঁচতে চাও তো ফিরে যাও সবাই।’
“কাণ্ডকারখানা দেখে আমি তো একেবারে হতবম্ব হয়ে গেছি। বাকিরাও বেশ হকচকিয়ে গেছে মনে হল। বিরজু হঠাৎ একটা শাবল তুলে নিয়ে ‘রে..রে..’ মারতে তেড়ে গেল শঙ্খবাবুর দিকে। কিন্তু অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় মাথাটা সরিয়ে নিলেন তিনি। বিদ্যুৎ বেগে তলোয়ারের বাঁট দিয়ে বিরজুর মাথায় ঘুরিয়ে একটা আঘাত করলেন। সে পড়ে গেল মেঝেতে। শঙ্খ বাবুর চোখ দিয়ে যেন তখন আগুন বের হচ্ছে। সবাই সেই রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে পিছিয়ে এসেছে। আবার হুঙ্কার দিলেন, ‘বেরিয়ে যাও সবাই এখান থেকে। আমি বেঁচে থাকতে কেউ এই তোষাগারে প্রবেশ করতে পারবে না।‘
“তারপরেই একটা গুড়ুম করে গুলির আওয়াজ হল, শঙ্খবাবু পড়ে গেলেন। হাত থেকে ছিটকে পড়ল তলোয়ার। দেখলাম কেকে জ্যাকেটের পকেটের ভিতর থেকেই অব্যার্থ নিশানায় গুলি চালিয়েছেন। এগিয়ে এসে বললেন, ‘রাজরক্ত আর প্রবিত্র তলোয়ার এক হয়ে শরীরে দৈবশক্তির সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু নাইন এম.এম. পিস্তলের বুলেটের কাছে এসব নস্যি।’
“অজিত সিংহ এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এ কি মরে গেল? দরজা তাহলে কী করে খুলবে?’
“শঙ্কর প্রসাদ বসে নাকে হাত দিয়ে বললেন, ‘না মারেনি, নিঃশ্বাস চলছে। তবে জ্ঞান হারিয়েছে।’
“ ‘ওর হাতে তলোয়ারটা দিয়ে দরজার কাছে নিয়ে চল।’
“সবাই মিলে ধরাধরি করে আবার পাথরের দরজার কাছে নিয়ে গেল শঙ্খবাবুকে। তাঁর হাতে তলোয়ারটা দিয়ে একটা খাঁজের মধ্যে প্রবেশ করাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঘড়ঘড় শব্দ করে পাথরগুলি সরে গিয়ে একটা রাস্তা করে দিল। সবাই চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে। শঙ্খবাবুকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে মশাল হাতে একে একে ভিতরে ঢুকে গেল সবাই।
“সামনে যজ্ঞের আগুন তখনও ধিকিধিকি জ্বলছে। আমি হাতপা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি। অনেক কষ্টে ঘসে ঘসে এগোলাম আগুনের দিকে। তারপর হাতের বাঁধনটা এগিয়ে দিলাম। আগুন লেগে নাইলনের দড়িটা পুড়তে শুরু করল। দাঁতে দাঁত চেপে চার পাঁচবারের চেষ্টায় কেটে গেল দড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে পায়েরটাও খুলে ফেললাম। শঙ্খবাবুর কাছে দৌড়ে গিয়ে দেখি গুলিটা ডান হাতের কাঁধ ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। চিকিৎসা করলে বেঁচে যাবেন হয়ত। তাঁকে কোন রকমে চাগিয়ে ঘাড়ের উপর ফেলে গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। অন্ধকারে পায়ের কাছে কিছু ঠেকতে লক্ষ গেল মদনের দিকে। সেও হাত পা বাঁধা অবস্থায় গোঙাচ্ছে। ওঁকে একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে মদনের দড়িটা খুলে দিলাম। বললাম, কিছুটা দূরে ঝর্ণা থেকে জল এনে শঙ্খবাবুর শুশ্রূষা করতে। তারপর আবার ফিরে গেলাম গুহার ভিতরে।
“আমার টর্চটা ধস্তাধস্তির সময়ে গুহার মুখে পড়ে গিয়েছিল। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে পাথরটা যেখানে ফাঁক হয়েছিল সেটা দিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বহুকাল আগে পাথর কেটে বানানো হয়েছিল এই রাস্তা। কিছু দূর গিয়ে দু ভাগ হয়ে গেছে। এবার কোন দিকে যাব? কান খাড়া করে শুনলাম কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা। না, কোন দিক থেকেই কোন শব্দ পেলাম না। তারপর নিচের মাটিতে জুতোর দাগ টর্চের আলোয় ভালো করে লক্ষ করে মনে হল, ডানদিকের রাস্তায় ওরা প্রথমে গিয়েছিল কিন্তু আবার ফিরে এসেছে। বাঁ দিকেরটায় ঢুকেছে কিন্তু ফেরার দাগ নেই। অতএব সেই পথেই সন্তর্পণে এগোলাম। এদিকে ওদিক এঁকে বেঁকে বেশ কিছুটা যেতে কিছু মানুষের সমবেত চিৎকার কানে এলো। তারপরেই চোখে পড়ল আর একটা পাথরের দরজা। এক পা এক পা করে এগিয়ে দেখি দরজার ওপারে ধাপে ধাপে নেমে গেছে পাথরের সিঁড়ি। প্রায় একশ ফুট নেমে একটা বিশাল বড়ো ডিম্বাকৃতির গুহা। পাথরের দেয়ালের গায়ে অদ্ভূত সব খোদাই করা মূর্তি। মশাল হাতে সবাই এখানেই নেমেছে প্রশস্ত মেঝেতে এবং আনন্দে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। চিৎকারের কারণ হচ্ছে পুরো মেঝেতেই ছড়িয়ে আছে ঘড়া ঘড়া সোনা দানা, হাজার বছরের পুরানো রাজঐশ্বর্য। কুবেরের ভাণ্ডারও এর কাছে সামান্য মনে হবে। এই দৃশ্য দেখে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। টর্চ নিভিয়ে আমি সেখানেই ধপ করে বসে পড়লাম পাথরের উপরে।
“হঠাৎ মনে হল, সামনের ঐ জীবন্ত লোকগুলি ছাড়া আরও অনেকে আছে এখানে। মনের ভুল, না চোখের, বুঝে উঠতে পারলাম না। অন্ধকারের মধ্যে পাথরের দেয়ালে খোদাই করা মূর্তিগুলি যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাদের থেকে কালো ধোঁয়ার আকৃতির ছায়ার দল কাঁপতে কাঁপতে হাওয়ার সাথে ভেসে নেমে আসছে নিচের দিকে।
“মেঝের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা বেদীর উপরে রয়েছে একটা সোনার সিংহাসন। কেকে হঠাৎ সমুদ্রগুপ্তের তলোয়ারটি নিয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে গিয়ে সেই সিংহাসনের উপর বসে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সিংহাসনটি তাঁকে নিয়ে ভুস করে ঢুকে গেল গহ্বরে। ভিতরটা মনে হয় ফাঁপা ছিল। তারপরেই একটা মড়মড় করে বিকট আওয়াজ। পুরো গুহাটা কেঁপে উঠল ভূমিকম্পের মত। বাকিরা থতমত খেয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল। পাহাড় তখন প্রচণ্ড জোরে কাঁপতে শুরু করেছে। আমি দৌড়াতে শুরু করলাম পিছন দিকে। বড়ো বড়ো পাথর খসে পড়ছে গুহার মধ্যে। মনে হল ওরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার আগেই পাথরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। পড়িমরি করে যেখানে রাস্তা দু’ভাগ হয়েছিল সেখানে এসে দেখি প্রধান রাস্তাটা আগেই বন্ধ হয়ে আছে। কী করব বুঝতে না পেরে অন্য রাস্তা ধরেই দৌড়াতে শুরু করলাম। তারপর একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। আর আমার সামনে থেকে পাহাড়টা দু’ভাগ হয়ে গেল। আমি গড়িয়ে গিয়ে পড়লাম জলের মধ্যে। সাঁতার কেটে পাড়ে উঠতে না উঠতে পুরো পাহাড়টা হুড়মুড় করে ভেঙে ঢুকে গেল ভিতরে। ভাগ্য খুব ভালো ছিল। না হলে ঐ গুহা থেকে জীবিত বের হতে পারতাম না সেদিন। পরে ভেবে দেখলাম ঐ সিংহাসনটা ছিল একটা ফাঁদ। রাজার উত্তরাধিকারী ছাড়া অন্য কেউ সিংহাসনে আসীন হলে আপনা থেকেই ওটা ভিতরে ঢুকে যাবে। আর বিশাল ছাতার মত পুরো গুহাটা বন্ধ হয়ে সমস্ত ধনরত্ন সমেত পাতাল প্রবেশ করবে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঋজু প্রশ্ন করল, “আপনি যে রকম বলছেন, এত বিশাল ধনরত্ন এখানে এলো কীভাবে? সেটাই তো একটা বিস্ময়।”
“হ্যাঁ, এই ব্যাপারে আমিও পরে বেশ কিছু পুরানো বইপত্র ঘেঁটেছি। রাজা তিমগাদেবের সময়ে রাজধানীর দক্ষিণে এক গোপন জায়গায় পাহাড়ের মধ্যে একটা তোষাখানা তৈরি করা হয়েছিল। রাজ্যের উপার্জিত যত সোনা দানা, মোহর, দামি পাথর সব রাখা থাকত সেখানে। তখন বিদেশী লুটেরা এসে প্রায়ই ভারতীয় রাজাদের ধনরত্ন লুট করে নিয়ে যেত। সেই ভয় থেকেই তারা এমন গোপন জায়গায় তোষাখানাটি তৈরি করেছিল। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর লেখায় কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণের বিপুল ঐশ্বর্যের কথা শোনা যায়। বারোশ পাঁচ সালে আফগান শাহেনশা ‘মহম্মদ-ই-বখতিয়ার’ বিশাল সেনা নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। পাটলিপুত্র, কামরূপ হয়ে তিনি তিব্বতে যান। ইতিহাসে লেখা আছে তাঁর সেনা যে পথে যেত তার দু’দিকে শ্মশান হয়ে যেত। কিন্তু কামরূপ রাজ্যের তোষাখানার কোন হদিশ তিনি পাননি।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর পাতা জিজ্ঞাসা করল, “শঙ্খবাবুর কী হল?”
“পরে মদনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও বলল, ঝর্ণা থেকে জল এনে আর শঙ্খবাবুকে আর দেখতে পায়নি। তারপরেই কেঁপে উঠল পাহাড়। ও নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়ে যায়।”
“তাহলে মনে হয় উনিও পাহাড়ের ধ্বসে চাপা পড়ে গেছেন।”
সুরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হতে পারে। তবে কিছুদিন আগে গুয়াহাটিতে কামাখ্যা পাহাড়ে অম্বুবাচীর মেলায় তান্ত্রিক হেমগিরির পাশে তাঁর নতুন শিষ্যকে দেখলাম। বড় বড় চুল দাড়ি আর লাল সিঁদুরমাখা মুখ। সারা গায়ে রক্ত চন্দন আর রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে কালো জোব্বা। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগল। হঠাৎ মাথায় এলস ওর চোখ দুটোর সাথে শঙ্খবাবুর খুব মিল।”
তিন জনেই অবাক গলায় বলল, “সেকী!!”
“মনে হয় হেমগিরি শঙ্খবাবুর প্রাণ বাঁচানোর জন্যই ওঁকে চিনতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি আন্দাজ করেছিলেন এদের ষড়যন্ত্রের কথা। আর হেমগিরিই শেষ পর্যন্ত ওঁর প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন।”
তীর্ণা প্রশ্ন করল, “তার মানে শঙ্খবাবু এখনও বেঁচে আছেন। আপনি ওঁর সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি?”
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “করেও কোন লাভ হত না। ওঁর আগের স্মৃতি আর কিছুই মনে নেই। সাইকোলজিক্যাল রিপ্রেসান অফ মোটিভেটেড ফরগেটিং।” বলে বইটি হাতে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।
ঋজু কিছুক্ষণ ভেবে মন্তব্য করল, “তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে কারোর পূর্ব স্মৃতি মুছে দেওয়া যায়? এ কথাটা আমার ঠিক হজম হচ্ছে না।”
তীর্ণা বলল, “সম্মোহনের মাধ্যমে করতে পারে। আর এই ধরনের তান্ত্রিকরা সম্মোহন ভালোই জানে।”
বাইরে তখন ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের সাথে ভেসে যাচ্ছে কোজাগরীর পূর্ণ চাঁদের ডাকিনী জ্যোৎস্নায় মোড়া চেরাপুঞ্জির সবুজ পাহাড়গুলি। ওরাও সম্মোহিতের মত তাকিয়ে রইল সেই রহস্যময় অরণ্যের দিকে।
অলংকরণঃ মৌসুমী