আগের সংখ্যার আয় আয় ঘুম-এর গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান, লাল বেলুনের গল্প, রামধনুর গল্প, আলুর গল্প, বাড়ি আর ক্রেনের গল্প, ইদ্রিশ মিঞাঁর উটের গল্প, তিমি আর ডলফিনের গল্প জাফরি আর রেলিঙের গল্প, হাঁসুমনির গল্প, নিমগাছের গল্প, রঙমিলান্তি পেনসিলের গল্প, কুয়োর ব্যাং
লেখা সৌরাংশু সিংহ। ছবি ঈশান মিস্ত্রী
আমাদের ছোট্ট মিনি, সে সব জিনিসের নাম দিতে ভালোবাসে। সে বিড়ালকে বলে অধিরাজ, বাড়ির সামনের গাছে যেই কাকটা বাসা বাঁধে তার নাম চম্পকলাল আর তার বউ কাকলি কোলে। ঝাড়ুদার তো মঞ্জুনাথ আর বাড়িতে যে মাসি ঝাড়পোঁছ করে, তার আসল নাম রুপালি হলেও সে নাম দিয়েছে মালিনী শ্রীবাস্তব। বাড়ির সামনের পার্কের গাছগুলোরও নাম আছে। সদানন্দ, মনসুর আলি, ডেভিড অল্ডারম্যান, দীপশঙ্কর, কাঞ্চনবালা। এগুলো সব বট, অশ্বত্থ আর খান দুই দেবদারু। ছাতিমগাছটার নাম রেখেছে বসন্তবিলাপ। পার্কের রেলিঙগুলোর নাম পথে হল দেরী আর পার্কের নাম আনন্দ আশ্রম।
এই ভাবে মা আর বাপি হয়ে গেছে সিসি আর মোহনলাল। দাদুভাই জীবনানন্দ আর মাম্মাম সরোজিনী নাইডু। বাড়ির খাটটার নামটা একটু খটোমটো, লাগেচাকা ভ্যাবাচ্যাকা! ফ্রিজের নাম বরদাচরণ। টিভি আদর সৎকার। দরজা জানলা এক এক করে দীপঙ্কর, শুভেন্দু, অপর্ণা আর সুচিত্রা। এই রকম হাজারো নাম নিয়ে মিনির কারবার। এমন কি ওর যে সবথেকে ভালো বন্ধু অনুষ্কা, তার নাম রেখেছে কাবুলিওয়ালা।
এইভাবে, সেফটিপিন, লাল নীল ফ্রক, চটিজোড়া, ইউনিফর্ম, ড্রেসিং টেবিল সক্কলের নাম রেখেছে মিনি। কিন্তু সমস্যায় পড়েছে কাল থেকে। চিন্তামণি কাকু, যাকে মিনি আইসিআইসিআই বলে ডাকে, তিনি একটা বেলুন দিয়েছেন। যে সে বেলুন নয়, প্লাস্টিকের বেলুন। লাল টুকটুকে, হার্ট শেপের। তার মানে কাল দিয়েছে আর আজ সকালেই ফুস হয়ে ফট হয়ে যাবে না। এটা মোটামুটি থাকবে দু সপ্তাহ এক পক্ষকাল। তারপর ধীরে ধীরে রোগা হয়ে যাবে, যদি হাওয়া না পায়।
কিন্তু তাতেও সমস্যা নেই। সমস্যাটা হয়েছে তার নাম নিয়ে। যে নামেই ডাকে, বেলুনের পছন্দ হয় না। অরুণ, বরুণ, কিরণমালা, রবি, সুভাষ, নরেন, ঈশ্বর, মাধবী, ইন্দিরা। সব নাম পেরিয়ে, কাঁচ কটকট, পটল কুমার, ধীরেনচন্দ্র, সূর্য বাহাদুর থাপা। কিসসুটি তার পছন্দ হচ্ছে না। মিনি “ফোরেন” নামও দেখেছে রেখে। ভিক্টোরিয়া, কুয়োমিনতাং, ওয়াশিংটন, আলাস্কা, পোপ জন পল, সালাম বম্বে, রামালিঙ্গম, মুন্তাসির, বিয়র্ন বর্গ, গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি। এমনকি চে গুয়াভরা রেখেও লাভ হয়নি। দুদিনের মধ্যেই বেলুনও শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে আর মিনিও নাওয়া খাওয়া ভুলেছে।
এমন সময় মিনির মেজোমামা, যাকে মিনি ব্রন্টোসরাস বলে ডাকে। তিনি এলেন। তিনি হিমাচল প্রদেশে থাকেন। আর আসার সময় প্রতিবার এক বাক্স আপেল আনেন। কত্তো লাল টুসটুসে, সবুজ ছোঁয়া লাগা মিষ্টি মিষ্টি আপেল। খেয়ে খেয়েও আশ মেটে না মিনির। মিনি তাই আপেলগুলোর নাম রেখেছে মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।
তা ব্রন্টোসরাস এসেই জিজ্ঞাসা করলেন, “মিনি সোনার কী হয়েছে?”
মিনি কিনা বলতে চায় না কাউকে। কারণ সবাই এই বিচিত্র শখ নিয়ে হাসাহাসি করবে। কিন্তু ব্রন্টোসরাসের কথা আলাদা। তার ইয়াব্বড় শিং আর পিঠে খড়গ থাকলেও মনটা একদম আইসক্রিমের মতো নরম আর রসালো। আর কি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কথা বলে ব্রন্টো মামা।
তাই ব্রন্টোসরাসকে তো বলাই যায়! ছোট্ট মিনি ব্রন্টোসরাসের কোলে বসে বলল, “মেজো মামা! আমি তো সকলের নাম দিই। সব্বাই হাসে, রাগ করে। কিন্তু আমার ভালো লাগে। তাই আমি নাম দিই। কিন্তু ওই যে লাল বেলুন! ওর নাম দিচ্ছি কত্তো কিছু। কিন্তু তবুও ওর মন ভরে না। মুখ গোমড়া করে থাকে আর শুকিয়ে যায়। কত্তো নাম দিয়েছি! অরুণ, বরুণ, কিরণমালা, রবি, সুভাষ, নরেন, ঈশ্বর, মাধবী, ইন্দিরা। সব নাম পেরিয়ে, কাঁচ কটকট, পটল কুমার, ধীরেনচন্দ্র, সূর্য বাহাদুর থাপা! কিসসুটি তার পছন্দ হচ্ছে না। “ফোরেন” নামও দেখেছি রেখে। ভিক্টোরিয়া, কুয়োমিনতাং, ওয়াশিংটন, আলাস্কা, পোপ জন পল, সালাম বম্বে, রামালিঙ্গম, মুন্তাসির, বিয়র্ন বর্গ, গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি। এমনকি চে গুয়াভরা রেখেও লাভ হয়নি।”
মন খারাপ হয়েছে মিনির। মেজোমামার মায়া হল। তিনি বেলুনটার সামনেই হঠাৎ ডাক দিলেন, “মিনি! মিনিইই!” মিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “কী? অতো জোরে ডাকছ কেন? আমি তো তোমার সামনেই রয়েছি।”
মেজোমামা মুচকি মুচকি হেসে বেলুনটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আবার ডাকলেন, “মিনি! মিনিইই!” ওম্মা! মিনি দেখে বেলুনটা যেন নামটা শুনেই তরতরিয়ে এদিক ওদিক দেখে আনন্দে সাড়া দিয়ে উঠেছে। আর এই যে একদম শুকিয়ে যাচ্ছিল তাও লাগছে না। মেজোমামা আরেকবার “মিনি” বলে ডাকতেই ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া শুকিয়ে যাওয়া বেলুনটা আবার লাল টুকটুকে রূপ নিয়ে তরতরিয়ে মেজোমামার দিয়ে উড়ে এলো। তারপর হাওয়ার তালে তালে একবার ঘার ডান দিকে আরেকবার বামদিকে বাইয়ে বাইয়ে বইতে লাগল।
খন মেজোমামা ওরফে ব্রন্টোসরাস বললেন, “মিনি মা! এই বেলুনটা একদম তোমার মতন। অথবা বলা যায় বেলুনদের জগতে ও তোমারই রূপ। তামার নামই ওর নাম। ধরো দু সপ্তাহ পরে যদি ও চুপসে যায়, তাহলে আবার নিচ থেকে হাওয়া দিয়ে মিনি বলে ডাকলেই ও আবার ফুলে উঠে লাল টুসটুসে সাড়া দেবে। আর বেলুনটা যদ্দিন থাকবে তদ্দিন কিন্তু তুমি মন খাপ করতে পারবে না। বুঝলে?”
এক গোছা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ঘাড় দিয়ে এলিয়ে মিনি মাথা নাড়ল, বুঝেছে। তারপর? তারপর আর কি। মিনির নাম রাখা চলতে থাকল। তবে কাউকে সে বলত না। শুধু লাল টুকটুকে মিনি বেলুন এলে তাকে গলা জড়িয়ে মজার মজার নামগল্প করত সে। আর মিনি বেলুনও খুশিতে ডগমগিয়ে উঠত। ঠিক যেভাবে এখনও ওঠে সে।