আয় আয় ঘুম
লেখা সৌরাংশু ছবি ঈশান মিস্ত্রি
আগের সংখ্যার গল্প– আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি, কোকিলের গান
রাত্রির সময় যখন বাড়ির শিশুটি আহার করিয়াও ঘুমাইতে চাহে না তখন দিল্লির কোনো এক অঞ্চলের স্নেহপরায়ণ পিতা এই গল্পগুলি বলিয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া থাকেন। সেই শিশুটি বড় হইয়াও হয়তো এই গল্পগুলির মিষ্টতা ভুলিতে পারিবে না। আশা করি আমার ঝিলিমিলি পাঠক-পাঠিকার নিকটও এগুলি মিষ্ট লাগিবে।
রামধনুর গল্প
রামধনুকে ইংরাজিতে কী বলা হয়? রেইনবো না র্যাম্বো?
সে থাক আমরা আমাদের গল্পে চলে যাই। বর্ষাকালে মাঝ আকাশে যে কালো কালো মেঘের সারি দেখা যায়, তারই একটাতে আমাদের জলের কণা ছিল। জলের কণা। আর পাঁচটা বা পঞ্চাশ বা পঞ্চাশ হাজার জলের কণা যেরকম হয় সেরকমই দেখতে। তেমনই তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত গোল গোল ব্যাপার। তেমনই তার ভিতর আর বাইরে পরিষ্কার, স্বচ্ছ। কিন্তু সে ছাড়াও আমাদের জলের কণার একটা বিশেষ সুপার পাওয়ার ছিল। সুপার পাওয়ার। সে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পারত। অনেক দূর পর্যন্ত শুনতেও পারত। অনেক দূর বলতে পৃথিবীই।
এই যেমন আজকের কথাই ধরা যাক। আজ আমাদের জলের কণার ইচ্ছে ছিল বৃষ্টি হয়ে ঝরে। সেই মতো স্নান টান করে চুল টুল আঁচড়ে রোজকারের ইউনিফর্ম পরে যেই বেশ কয়েকজন জলের কণাকে নিয়ে দল পাকিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে বলে রেডি হয়েছে, অমনি জল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আজ বেশ দেরী হয়ে গেছে। এখন যা অবস্থা তাতে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে মোটামুটি ঘন্টা তিনেক লাগবে, এত্তো লাইন লেগে গেছে। যা থাকে কপালে আজ কাউকে না কাউকে সে ভেজাবেই। গত দু সপ্তাহ ধরে মাঝরাতে তার সুযোগ আসছিল। যখন রাস্তা শুনশান। কখনো কংক্রীটের রাস্তায়, কখনও বা ফাঁকা মাঠে ঝরে পড়ে নদী নালায় মিশে গিয়ে আবার সূর্যালোকে উবে গিয়ে বাড়ি ফিরে আসছিল সে।
আজ যেন পণ করেছে কাউকে ভেজাবেই ভেজাবে। সেই মতো নিচের দিকে তাকিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করল সে। ওই যে একটা লোক সাদা জামা আর নীল প্যান্ট পরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সে অফিসের সামনে নামলেই তাকে ভেজাবে? নাকি রাস্তার মোড়ে যে লোকটি ছেঁড়া কাপড়ে আর দশ দিনের দাড়িতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে আছে তাকে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটা মাছওলা, একজন মশলার ব্যাপারী, এক স্কুলের দিদিমণি, একটা ফুটবল খেলোয়াড় আরও সবাইকে খুঁজে পেল সে। পছন্দ হলও বা। কিন্তু হঠাৎ একটা ছোট্ট মিষ্টি আওয়াজে তার নজর ঘুরে গেল।
একটা রিনরিনে আওয়াজ তার বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করছে, ‘বাবা রামধনু কী?’ তার বাবা তখন মিষ্টি করে বলল, ‘বৃষ্টি হবার পরে যখন আকাশে জলের ফোঁটা থেকে যায়, তার ওপর রোদ পড়লে আকাশ জুড়ে সাতটা রঙের রামধনু তৈরি হয়। আলো আলো জুড়ে।’
আবার সেই রিনরিনে আওয়াজ কলকল করে উঠল, ‘তাহলে আজকে বৃষ্টি হলে আমি রামধনু দেখতে পাব?’ বাবা বলল, ‘পেতেও পার!’ মিষ্টি মেয়েটি মনে মনে বলল, ‘আমি কখনও রামধনু দেখিনি। দেখতে পেলে খুব মজা হবে!’
শুনতে পেল আমাদের জলের কণাটি। শুনলো আর ভাবলও। আর তারপর মনে মনে ঠিক করল, ‘আজ থাক! আজ না হয় না ঝরে, রামধনু হয়ে খুশি হয়ে যাক সে। ওই মিষ্টি মেয়েটাও হয়ে যাক আজ খুশি।’
যেমন ভাবা তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জলের কণাটি এক এক করে যতো পারল জলের কণাদের জড় করল। তারপর সবাইকে নিয়ে গুজগুজ ফুসফুস করে মন্ত্রণা করল সে। তারপর? তারপর একদল পরল বেগুনি রঙ, একদল নীল, একদল আকাশের রঙে রাঙালো নিজেদের, পরের দল সবুজ, তারপরের দল হলুদ, তারপরে কমলা আর শেষে সবার আগে থাকা আমাদের জলের কণা নিজের দলের বাকিদের মতোই পরল লাল রঙ। ততক্ষণে সামনের মেঘগুলো টিপটাপ শুরু করে তারপরেররা ঝমঝমিয়ে ঝরতে শুরু করে দিয়েছে। মিষ্টি মেয়েটি তখন বাকিদের মতোই দৌড়ে উঠে পড়েছে স্কুল বাসে। বাসটাও ওয়াইপার দিয়ে সব ঝমঝমে জল সরিয়ে রেখে এগিয়ে গেছে স্কুলের দিকে।
স্কুল পৌঁছতে পৌঁছতে সব ছিটপিটানি সব ঝমঝমানি থেমে গেছে। আর তখনই আমাদের জলের কণাটি বুঝল এই সুযোগ। ডাক দিল সবাইকে, ‘ভাই সকল! নিজের নিজের জায়গা বুঝে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়। এই বারে আমরা সূর্যের আলোয় ঝলমলিয়ে রামধনু হয়ে যাব।’ বাকি জলের কণারা অতশত বোঝে না। তারা খালি জানে যেমন যেমন হুকুম আসবে তেমন তেমন তামিল করবে তারা।
ব্যাস! সারা আকাশ জুড়ে রামধনু হয়ে ছড়িয়ে পড়ল তারা। আর ওদিকে মিষ্টি মেয়েটা বাস থেকে নামতেই দেখল, নীল আকাশ আর কালো নেই। তার মাঝ বরাবর গোল হয়ে সাত রঙের রামধনু হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে দেখে ভাবল, ‘আহা রামধনু কত্তো সুন্দর! কি আনন্দ হচ্ছে আমার!’ ভালো করে দেখল সে। লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, আকাশী, নীল আর বেগুনি রঙের রাজপথে রামধনুকে। আর তারই মধ্যে যেন দেখতে পেল একটা লাল রঙের জলের কণা তার দিকে হাত নাড়ছে।
খুব খুব আনন্দ হল তার। প্রথম, এক্কেবারে প্রত্থম বারের মতো রামধনু দেখে। আমাদের জলের কণাটিরও খুব আনন্দ হল।
আমাদেরও!
মিষ্টি গল্প। বাহ।
LikeLike
উফফফ কি দারুণ লিখেছ সৌরাংশু , আর তোমার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে মিষ্টি ঈশান ।
LikeLiked by 1 person