আগের গল্প- কথা বলা পাখি -১, কথা বলা পাখি (২), কথাবলা পাখি৩, কথা বলা পাখি (৪) গুলুর গল্প
আমাদের ছোটবেলায় প্রায় সবসময় বাপিকে দেখতাম বসে বসে কতরকমের ছবি আঁকছেন। আবার কখনও লিখছেন। ছবি আঁকতে-আঁকতেই আমাদের অঙ্ক শেখাতেন। পাটিগণিতের অঙ্ক, তৈলাক্ত বাঁশের ডগায় বানরটা কতবার উঠছে সেই ছবি এঁকে দেখাতেন। আবার কখনও প্ল্যাটফর্মে মুখোমুখি দুটো ট্রেনের ছবি। দু-টানে এঁকে তারপর প্ল্যাটফর্মের দৈর্ঘ্য নির্ণয় পদ্ধতিও দেখাতেন।
বাপি নিজে ছিলেন একজন প্রখ্যাত শিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক ধীরেন বল। সেজন্য আমরাও ছোটো থেকে শিল্পী মনোভাবের হয়ে তৈরি হয়েছিলাম। শুধু পড়াশোনা, ছবি আঁকা দেখা, লেখা এসব ছাড়াও বাপির নানাধরনের মজার মজার কাজকর্মে আমরা ভাইবোনেরা খুবই মজা পেতাম। এরকম একটা মজার গল্প বলি।
সব পুরোনো বাড়ির ঘুলঘুলিতেই চড়াই পাখিরা বাসা বাঁধে। খড়কুটো, ঘাস এসব এনে প্রায়ই ঘর নোংরা করত চড়াই পাখিগুলো। আমরা তখন সবে বেলগাছিয়ায় নিজেদের বাড়িতে এসেছি। এখানেও চড়াই পাখির খুব উৎপাত। কারণ, ওরাও অট্টালিকাতে থাকে। বাপি কিন্তু কিছুতেই মানবেন না সে নিয়ম। তাই চড়াই পাখিদের সঙ্গে বাপির শত্রুতা তৈরি হল। অবশ্য তার একটা বড়ো কারণও ছিল। ওরা বাপির আঁকা ছবি-টবির মূল্য বুঝত না। যেখানে সেখানে, টেবিলের ওপরে, সাদা কাগজে, কাপড়ে প্রায়ই বিষ্ঠা ফেলে চলে যেত।
একদিন কী হল, বাপির আঁকা একটা তৈরি ছবির ওপরে এক চড়াই বিষ্ঠা ফেলে ফুড়ুত করে উড়ে পালাল। ব্যস, আর যায় কোথা! বাপি রেগে বললেন, “ওরে দুষ্টু চড়াই, আজই তোকে বাসা থেকে সরাই।”
আমরা ভাইবোনেরা কাছেই ছিলাম। চড়াইটা কোথায় গেল, ওকে ধরতেই হবে। কোথায় গেল সে? ও তখন ঘুলঘুলি থেকে মুখ বার করে দেখছিল। তিন ভাইবোন সকলে ঘরের সব জানালা-দরজা বন্ধ করে তার পিছনে তাড়া করতে শুরু করলাম। তাকে ঘরের কোথাও বসতে দিচ্ছিলাম না। ঘর বন্ধ করে একবার এদিকে তাড়া দিই, তো আরেকবার অন্যদিকে তাড়া দিই। বার বার উড়ে উড়ে চড়াইটা হাঁপিয়ে গিয়ে মাটিতে নেমে বসল। ঠিক তখুনি বাপি একটুকরো কাপড় দিয়ে চড়াইটাকে হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তারপর আমার শিল্পী বাবা চড়াইটাকে বাঁহাতে নিয়ে বসে গেলেন তাঁর ছবি আঁকার টেবিলে। চড়াইটাকে কত কথা বলছিলেন; সেই দৃশ্য আর মজার মজার কথা আমরা বাপির পাশে বসে শুনেছি আর দেখেছি বাপির কাজকর্ম।
এরপর শুরু হল বাপির হাত দিয়ে রঙের কাজ। রঙের শিশি খুলে হাত দিয়ে আঙুলে করে রঙ তুলে বাঁহাতে ধরে রাখা চড়াইটার ডানায়, মাথায়, গলায়, লেজে, গোটা শরীরে রঙ লাগিয়ে দিলেন। এক-এক জায়গায় এক-এক রঙ। লাল, নীল, হলুদ নানা রঙ লাগিয়ে চড়াইটাকে আমার শিল্পী বাবা রঙিন একটা পাখি করে দিলেন। পালকের ওপর বেশি রঙ ধরছিল না, তাই বেশি বেশি করে রঙ লাগাতে হয়েছিল। কী যে সুন্দর দেখাচ্ছিল চড়াইটাকে, বলার নয়।
তারপর সেই রঙিন পাখিটাকে হাতে ধরে আমাদের খুব কাছ থেকে দেখালেন। আমরা ছটফট করছিলাম ওকে হাতে নেবার জন্য। তারপর নতুন চড়াইটাকে বাপি আয়নার কাচের সামনে ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রেখে ওকে ওর নিজের মুখটা দেখালেন। সেদিন চড়াইটা অনেকক্ষণ ধরে নিজের মুখটা বার বার দেখছিল। আর আয়নার ভেতরের রঙিন পাখিটাকে ঠোকরাচ্ছিল।
এরপর বাপি পাখিটাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন পাশের বাড়ির লাগোয়া টিনের চালের ওপরে। রঙিন চড়াইটাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক চড়াই এসে ওকে ঘিরে ধরল। কিচিরমিচির করতে লাগল। নতুন একটা রঙিন পাখি দেখে কাকেরাও কা কা করে উড়তে থাকল। চড়াইগুলো খুব কাছে এসে রঙিন চড়াইটাকে দু-চারবার ঠোকরাতে লাগল। ভাবল এটা আবার কী পাখি? এমনিভাবে কিছুক্ষণ বিস্ময় প্রকাশ করার পর চড়াইরা ঠিক চিনে নিল এটা ওদেরই জাতের কেউ হবে। মাসি-পিসি কিংবা কারও মা-চড়াই।
সেদিন আমাদের শিল্পী বাবা জানালায় দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলেন আর বলছিলেন, “দুষ্টু চড়াই, আমার কত ছবি নষ্ট করেছ তুমি, এবার আমি তোমায় ধরে আঁকিবুঁকি।”
এমন ধরনের কত রকমারি ঝগড়া, খামখেয়ালিপনা ছিল বাপির প্রকৃতির সবধরনের পশুপাখিদের নিয়ে। তাদের নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনা করে তিনি সৃষ্টিমূলক কাজে তাঁর শিল্পের অবদান রেখে গিয়েছেন। এইরকম মজার শিল্পী ছিলেন বলেই তিনিই প্রথম পশুপাখিদের জামাকাপড় পরিয়ে ছবি সৃষ্টি করেন ১৯৫৯ সালে ‘তুতু ভূতু’ বইটি লিখে, এঁকে—তুতু ভূতু চেঙা বেঙা গল্পে। এমন ধরনের ছবি সৃষ্টির জন্য তিনি বাংলার ওয়াল্ট ডিজনি উপাধিও পান। ধন্য তাঁর তুলি-কলম, ধন্য তুইও—রঙিন চড়াই।