আগের গল্প- কথা বলা পাখি -১, কথা বলা পাখি (২), কথা বলা পাখি (৪)
বাড়ির সামনে বাগানে একবার একটা পাখির বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছিল রুমি। সেটা বড়ো হতেই বোঝা গেল সেটা কাকাতুয়া পাখির বাচ্চা। পাখিটা ওদের সকলের কথা নকল করত। মা বলতেন, ‘রুমি, পড়তে বসো।’ কাকাতুয়াটা বলত, ‘রুমি, এ-সো বসো।’ ডানা মেলে উড়তে শেখার পর গাছ থেকে ফল এনে রুমিকে ডাকত, ‘রু-মি-রুমি-এটা-খা এটা খা।’
ছোট্ট রুমি মার কাছ থেকে জেনেছে কাকাতুয়া পাখিরা মানুষের কথা শুনে শুনে নকল করে কথা বলতে শেখে।
রুমিদের পোষা কাকাতুয়াটা এখন একটু বড়ো হয়েছে। খুবই সুন্দর দেখতে হয়েছে ওকে। সাদা পালকে গা ঢাকা। মাথার ঝুঁটিটা হলুদ আর লাল রঙে মেশানো। রুমি ওর নাম রেখেছিল পিয়া। কাকাতুয়াটার পিয়া নাম পছন্দ হয়নি। তাই ও বলেছিল, ‘রুমি, নাম দাও তুয়া-তুয়া।’ তারপর থেকে সকলে ওকে তুয়া বলেই ডাকত।
তুয়া এখন রুমি-ঝুমি দুই বোনের এত প্রিয় বন্ধু হয়েছে যে তুয়াকে কিছুক্ষণ না দেখলে ওরা ছটফট করে। ওকে একা বাড়িতে রেখে কোথাও যায় না। আবার খাঁচাতে বন্দি করেও রাখে না। বাগানে গাছের নীচু ডালটাতে এসে তুয়া বসে। ওখানে ওর বাটি আছে, জলের কাপ আছে। সবই আছে, তুয়ার নেই শুধু একটা বন্ধু পাখি।
রুমির পোষা কাকাতুয়াটা অন্য পাখিদের সঙ্গে বন্ধু পাতাতেও পারছে না। চড়াই, শালিক ওরা ওর পাশে এসে কিচিরমিচির করে, আবার চলে যায়। কাকাতুয়াটা কোনো কথাই বলে না ওদের সঙ্গে। রুমিদের সঙ্গে এত কথা বলে, কিন্তু অন্য পাখিদের দিকে তাকায়ও না। শুধু মাঝে মাঝে ডান পা’টা তুলে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় চড়াইদের দিকে।
বাড়ির সামনে যে গাছটাতে তুয়া বসে থাকে, সেখান থেকেই ও রুমি-ঝুমিকে ডাকে। রুমি-ঝুমি দৌড়ে তুয়ার কাছে আসে। বলে, “শুধু শুধু ডাকছিস কেন? কী চাই তোর? খিদে পেয়েছে তোর? কী রে, খিদে পেয়েছে?”
তুয়া বলে, “পেয়েছে, পেয়েছে রুমি, পেয়েছে।”
রুমি বলে, “একটা বন্ধু করতে পারিস না? ওই চড়াইটা বার বার আসে তোর কাছে, ওকেই বন্ধু করে নে না তুয়া।”
তুয়া বলে, “না-না না-না ও-না।”
রুমি বুঝতে পারল, চড়াইকে ও বন্ধু করবে না।
একদিন রুমি মাকে বলল, “আমাদের তুয়ার একটা কাকাতুয়া বন্ধু হলে ও খুব ভালো থাকত মা। ওরা দুজনে একসঙ্গে থাকত বন্ধু হয়ে।”
মা বললেন, “তা তো পাবে না রুমি। কাকাতুয়া আমাদের দেশের পাখি নয়। আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় ওদের বাস। কখনও দলের মধ্যে চলে আসে। তোমার ভাগ্য ভালো তুমি ওকে কুড়িয়ে পেয়েছ। হয়তো মা-কাকাতুয়াটা মুখে করে নিয়ে যাবার সময় মুখ থেকে বাচ্চাটা পড়ে গিয়েছিল বাগানে। তাই তুমি ওকে পেয়েছ। না-হলে কাকাতুয়া পাখি দুর্মূল্য জিনিস।”
রুমি বলে, “তাহলে আমার পোষা তুয়াটা সারাজীবন একাই থাকবে? ওর একটা কোনও বন্ধু হবে না?”
মা রুমিকে বললেন, “কেন, তুমি, ঝুমি তোমরাই তো ওর ভালো বন্ধু হয়েছ। তোমরা ওকে খেতে দাও, স্নান করিয়ে দাও, ওর সঙ্গে কথা বলো। তোমার তুয়া গাছ থেকে ফল পেড়ে তোমাকে দেয়। এর চেয়ে ভালো বন্ধু ও আর কোথায় পাবে? ওকে যদি আরেকটা কাকাতুয়া এনে দাও, তাহলে ওরা দু-বন্ধু মিলে অন্য কোথাও চলে যেতেও পারে। তার চেয়ে ও এখানে আছে, থাক।”
রুমি বলে, “মা, কাকুমণি তো অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। তুমি কাকুমণিকে বলো না তুয়ার জন্য একটা বন্ধু কাকাতুয়া এনে দিতে। ও কেমন একা গাছের ডালে বসে থাকে। কোনোদিন যদি ওর ইচ্ছা হয় তাহলে ও তো বন্ধু খুঁজতে চলে যাবে অনেক দূরে। তখন আমাদের কী হবে?” বলতে বলতে রুমি কেঁদেই ফেলল।
মা ভাবলেন, সত্যিই তো। রুমি ঠিকই বলেছে। তুয়া যদি বন্ধু খুঁজতে খুঁজতে অনেক দূরে কোথাও চলে যায়, তারপর পথ হারিয়ে ফেলে, তাহলে কী হবে? তুয়া যদি আর না আসে আমাদের কাছে!
এসব নানা কথা ভেবে ভেবে রুমি সারাদিন তুয়ার আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। ওর সঙ্গে কথা বলে, ভেঙায়। তুয়ার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে থাকে।
রুমি-ঝুমি দুজনেই বাগানে এসে তুয়াকে হাততালি দিয়ে ডাকে, তুয়ার সঙ্গে খেলা করে, দৌড়াদৌড়ি করে। তুয়া হাঁপিয়ে গেলে আবার গাছের নীচু ডালটায় গিয়ে বসে, জল খায়।
রুমি-ঝুমির সঙ্গে তুয়ার ওইরকম উড়ে উড়ে খেলা করা দূর থেকে দেখত অন্যসব পাখিরা। শালিক-ময়না-চড়াই এরাও তখন কিচিরমিচির করে তুয়ার চারপাশের গাছের ডালে এসে বসে এ-ডালে ও-ডালে উড়ে উড়ে তুয়ার খেলা দেখে।
একদিন হল কী, একটা ময়না পাখির ছোট্ট বাচ্চা ঝাঁকের মধ্যে থেকে উড়ে পড়ল এসে মাটিতে। রুমির পায়ের কাছে। রুমি সঙ্গে সঙ্গে পাখির বাচ্চাটাকে হাতে তুলে নিল। জল খাওয়াল। তারপর বাচ্চাটাকে তুয়ার ফাঁকা খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বাটিতে ছোলা দিল, জল দিল। তারপর খাঁচাটা এনে তুয়া যেখানে বসে সেই গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিল।
তুয়া তখন ওই ডালটাতেই বসে ছিল। বাচ্চা ময়নাটাকে দেখে ও তো অবাক। প্রথমে ডানা দুটো মেলে, “রুমি, রুমি, কে, কে?” বলে ডেকে উঠল। মাথার রঙিন ঝুঁটিটা ফুলিয়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ডানা ঝাপটাতে লাগল। রুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তুয়ার আনন্দ। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা মা, দেখো ওর কী আনন্দ! ও বন্ধু পেয়েছে। এই বাগানে কত পাখি, কাউকে দেখে তুয়া এত আনন্দ করেনি। আজ ছোট্ট কাকাতুয়াটাকে দেখে ওর কী যে আনন্দ হচ্ছে, বলার নয়!”
মা বললেন, “আমাদের এই ছোট্ট বাচ্চা ময়নাটাকে তুয়া নিজের কাছে পেয়েছে তাই ওর এত আনন্দ হচ্ছে। তুয়া ময়নাটাকে নিজের মনে করে নিয়েছে।”
মা তুয়াকে বললেন, “তুয়া, ও তুয়া, কী হল, কী হল? এত খুশি, এত খুশি! বন্ধু পেয়েছ, তাই এত আনন্দ?”
তুয়া এবার ডানা দুটো নামিয়ে ঝুঁটিটা ফুলিয়ে বলল, “এত খুশি, রুমি এত খুশি! বনধু পেয়েছি।”
এদিকে ঝুমি দৌড়োতে দৌড়োতে তুয়ার কাছে এসে দেখে ছোট্ট ময়নাটা খাঁচার মধ্যে বসে ছোলা খাচ্ছে। ঝুমি হাত তুলে বলে, “তুয়া, ও তুয়া, তোমার বন্ধু এসেছে।”
তুয়া এবার ধীরে ধীরে খাঁচাটার খুব কাছে গিয়ে ঠোঁটটা বাচ্চা ময়নাটার ঠোঁটের সঙ্গে ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে আদর করতে লাগল। ওদের দুজনের এমন আদর ভালোবাসা দেখে রুমি-ঝুমি আনন্দে লাফাতে থাকল।
ঝুমি চিৎকার মাকে বলল, “মা মা, দেখবে এসো, তুয়া ছোট্ট ময়নাটাকে কেমন করে আদর করছে। শিগগির এসো, তুয়ার আদর করা দেখে যাও।”
মা ও-ঘর থেকেই ঝুমিকে বললেন, “তুমি দেখো। সবে তো আদর করা শুরু হল। এখন তুয়া রোজই ওকে আদর করবে। কতরকমভাবে তুয়া ওকে আদর করবে দেখে তুমি অবাক হয়ে যাবে। তুয়া মায়ের মতন বাচ্চা ময়নাটাকে আগলে রাখবে, দেখো।”
অলঙ্করণ- সৃজন কাঞ্জিলাল
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস