গল্প কথা বলা পাখি-২-পৃথা বল-শীত ২০২০

আগের গল্প- কথা বলা পাখি -১

বাড়ির সামনের বড়ো গাছটার তলায় পালক ছাড়া একটা অজানা পাখির বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছিল রুমি। সবাই মিলে সেবাযত্ন করে বড়ো করেছিল বাচ্চা পাখিটাকে। পাখিটার সারা গা যখন সাদা পালকে ভরে গেল তখন সকলেই বুঝতে পারল এটা কাকাতুয়ারই বাচ্চা। রুমি-ঝুমির তখন কী আনন্দ!

দিনে দিনে বাচ্চা কাকাতুয়াটা ওদের পোষা পাখি হয়ে উঠল। ওদের কথা শুনে শুনে কথা বলাও শিখল। রুমির মা যা বলত, পাখিটাও তাই বলত। মা বলত, ‘রুমি এসো, পড়তে বসো।’ কাকাতুয়াটাও বলত, ‘রুমি রুমি এ-সো ব-সো।’ মা রেগে যখন বলত, ‘রুমি-ঝুমি, দুষ্টুমি কোরো না।’ কাকাতুয়াটাও বলত, ‘রুমি ঝুমি না না কোরো না।’

এইরকম যে যা কথা বলত, ছোট্ট সাদা কাকাতুয়াটাও শুনে শুনে তাই বলত।

একদিন রুমির ছোটো বোন ঝুমি মাকে বলল, “মা মা, কাকাতুয়াটা শুধু আমাদের ভেঙাচ্ছে। কেন, ও নিজের মন থেকে যা খুশি বলুক না।”

মা তখন বলল, “ও তো বাচ্চা কাকাতুয়া, তাই এখন আমাদের দেখে দেখেই কথা বলবে। পাখিরা কি কথা বলতে পারে? ওরা কিচিরমচির নানারকমের আওয়াজ করে, কাক কা-কা ডাকে। কোকিল কুহু কুহু ডাক দেয়। নানান পাখিদের নানারকম আওয়াজ। শুধু কাকাতুয়া পাখিই মানুষের মতো কথা বলে। ওদের কথা অস্পষ্ট। তাও আবার মানুষের কথা শুনে শুনে কথা শেখে। এখন ও সবে কথা শিখছে। যেমন তোমার ভাই সব কথা বলতে পারে না। শুধু মা, বাবা বলতে শিখেছে। ছোটো কাকাতুয়াটাও তাই। এবার আমাদের পোষা কাকাতুয়াটার একটা নাম রাখতে হবে। তাহলে ও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে।”

আনন্দে লাফিয়ে উঠে রুমি বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ মা, ওর একটা নাম দাও তুমি, ওর একটা নাম দাও।”

যেই না একথা রুমি মাকে বলেছে, অমনি ছোট্ট কাকাতুয়াটা বলে ওঠে, “না-ম দা-ও, না-ম দা-ও।”

শুনে রুমির কী আনন্দ! বাইরে গিয়ে গাছের ডালে বসে থাকা ওর কাকাতুয়াকে বলে, “নাম দেব? তোর নাম দেব?”

কাকাতুয়াটা অমনি ওর সুন্দর লাল ঠোঁটটা ফাঁক করে বলে, “না-ম দা-ও, না-ম দা-ও।”

অনেক ভেবেচিন্তে পোষা পাখিটার একটা নাম ঠিক করা হল—পিয়া। এবার রুমি ওর কাকাতুয়ার কাছে এসে বলল, “বুঝলি? তোর নাম দিলাম পিয়া।” বলেই ওকে ডাকতে থাকল, “পিয়া, ও পিয়া, এখন খাবি?”

পোষা পাখিটা গাছের নীচু ডালটায় বসে ঠোঁট নীচু করে মাথার ঝুঁটি ফুলিয়ে চোখদুটো ঘোরাতে থাকে। কিছুই বলে না। রুমি বুঝতে পারে নামটা ওর পছন্দ হয়নি। ও আবার ওকে ডেকে বলে, “তোকে কী নামে ডাকব বল। ও কাকাতুয়া, কাকাতুয়া, তোকে কী নামে ডাকব তুইই বল।”

ঝুমি এসে বলে, “ওকে কাকাতুয়া বলেই ডাক না দিদি।” বলেই ঝুমি পাখিটাকে দু-বার ডাকল, “কাকাতুয়া, ও কাকাতুয়া, তোর নাম কী কাকাতুয়া?”

বলেই ঝুমি পোষা পাখিটার দিকে তাকিয়ে রইল। গাছের ডালে বসে বসেই পোষা পাখিটা তক্ষুনি ঝুমিকে বলল, “তুয়া-তু-য়া ঝুমি ঝু-মি। না-ম তো-য়া।”

যেই কাকাতুয়ার মুখ থেকে তুয়া নামটা শুনেছে, অমনি রুমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, “তোকে তুয়া ডাকব? আচ্ছা, আমরা তোকে তুয়া বলেই ডাকব।”

পাখিটা অমনি বলে উঠল, “ডাকবি তু-য়া তুয়া।”

সকলে মিলে চেঁচিয়ে মাকে ডাকল, “মা মা, আমার কাকাতুয়া নিজের নাম নিজেই রেখেছে—তুয়া। তুমি ওকে ডাকো তুয়া বলে, ও মাথা ঘুরিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে তোমার কাছে আসবে।”

মা এসে ওকে বলল, “তোমার নাম তুয়া? ও তুয়া, তোমার নাম কী?”

অমনি পাখিটা বলে উঠল, “না-ম তু-য়া তুয়া।”

ব্যস, এবার থেকে সবাই ওকে তুয়া বলেই ডাকে। তুয়া বলে ডাক দিলেই কাকাতুয়াটা বাগানে যেখানেই থাকুক উড়ে এসে বারান্দায় বসবে, ডাকবে, “রুমি রুমি, আমি এসেছি, এসেছি।”

এরপর থেকে রুমিদের কাকাতুয়াটা ওদের বাগান ছেড়ে কোথাও যেত না। মাঝে মাঝে একটু বড়ো গাছের ডালে অনেক উঁচুতে উড়ে গিয়ে বসত। খুব বেশি দূরে উড়ে যেত না তুয়া।

একদিন রুমি বাগানে এসে দেখে বাইরে যে গাছটায় তুয়া বসে থাকত সেখানে ও নেই। কোথায় গেল তবে পোষা পাখিটা? ওকে দেখতে না পেয়ে রুমি-ঝুমি দুজনেই এ-ডালে ও-ডালে খুব খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। তারপর ডাকতে থাকল, “তুয়া-য়া… তুয়া-য়া… ও তুয়া, কোথায় গেলি?”

পোষা কাকাতুয়াটা অন্য একটা গাছের অনেক উঁচু ডালে বসে ছিল। ডাক শুনেই কাকাতুয়া কথা বলতে লাগল, “রুমি, রু-মি, বসো-বসো।”

বলতে বলতে সাদা ডানাদুটো মেলে উড়ে চলে এল। এসে বসল একেবারে ঘরের সামনের সেই গাছটার নীচু ডালটাতে। পোষা কাকাতুয়াটা এসে বসতেই রুমি দেখল ওর লাল ঠোঁটে একটা টুকটুকে লাল ফল। কী ফল ওটা?

রুমি জিজ্ঞাসা করে, “তুয়া তুয়া, ওটা কী ফল?”

তুয়া কিছুই বলে না। কারণ, কথা বললেই তো ফলটা নীচে পড়ে যাবে। তখন ফলটা ফেটে যাবে। তাই গাছের ডালে পাদুটো রেখে ওর ঠোঁটটা নীচু করে নামিয়ে ফলটা রুমির হাতে দিতে যাবে, তখনই রুমি বুঝতে পেরে হাত বাড়িয়ে ফলটা তুয়ার কাছ থেকে নিয়ে নিল। হাতে নিয়েই রুমি ওর পোষা পাখিকে বলল, “এটা তুই খা তুয়া, এটা তুই খা।”

অমনি তুয়াও বলে উঠল, “এটা তুই খা রুমি, এটা তুই খা।”

রুমি লাল ফলটা হাতে নিয়ে মার কাছে গেল। “মা মা, তুয়া এই ফলটা ঠোঁটে করে এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা তুই খা রুমি, এটা খা।”

মা বলল, “দেখলি তো, তুয়া তোকে কত ভালোবাসে, কত চেনে! নিজে না খেয়ে পাকা ফলটা তোর হাতে তুলে দিল। যাই হোক, তুই অর্ধেকটা ফল কেটে বাকিটা ওকে দিয়ে আয়। আর ওই অর্ধেক ফলটা তুই ওর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবি।”

রুমি তাই করল। অর্ধেকটা ফল খেতে খেতে বাকি অর্ধেকটা তুয়ার ঠোঁটের কাছে দিয়ে বলল, “তুয়া, এটা তুই খা। খা খা, এটা খা।”

আনন্দে রুমির পোষা কাকাতুয়াটা নিজের মাথার ঝুঁটিটা পেখমের মতো মেলে ধরল। তারপর চোখদুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠোঁটটা নীচে নামিয়ে অর্ধেক ফলটা রুমির হাত থেকে নিয়ে খেতে শুরু করল। তুয়ার মাথার ঝুঁটিটা ওইরকম ফোলানো দেখে আনন্দে লাফাতে লাফাতে রুমি চেঁচিয়ে ডাকল, “মা মা, কী সুন্দর কাকাতুয়ার মাথার ঝুঁটিটা! দেখবে এসো, কেমন পাখার মতো মেলে ধরেছে। শীগগির এসো মা।”

ডাক শুনে রুমির মা এসে দেখে, সত্যিই তো! কাকাতুয়া আনন্দে ওর ঝুঁটিটা কেমন মেলে ধরেছে।

“বাহ্‌, কী সুন্দর দেখতে লাগছে আমাদের তুয়াকে, তাই না মা?”

মা বলল, “ময়ূর যেমন আনন্দে পেখম মেলে, তোমার ভাই যেমন দুই হাত তুলে আনন্দে নাচতে থাকে, তোমার কাকাতুয়াও আনন্দে মাথার ঝুঁটিটা একবার ফোলাচ্ছে, একবার কমাচ্ছে। এই আনন্দের সময় সবাইকেই দেখতে ভীষণ ভালো লাগে, ময়ূরকেও।”

রুমি ওর পোষা কাকাতুয়ার মাথার ঝুঁটিতে হাত বুলিয়ে বলল, “তুয়া, তোর ঝুঁটিটা কী সুন্দর রে! কী সুন্দর!”

অমনি কাকাতুয়াটাও বলে উঠল, “রু-মি রু-মি, কী সুন্দর, কী সুন্দর।”

রুমি অবাক হয়ে মাকে বলল, “এ পাখিটা তো ঠিক মানুষের মতো কথা বলছে, মা!”

মা রুমিকে বলল, “হ্যাঁ, তুই যা যা বলবি, তোর সবকথা ও শুনে শুনে ঠিক ঠিক বলবে। এটাই কাকাতুয়া পাখিদের বৈশিষ্ট্য। ওরা অন্য পাখিদের মতো কিচিরমিচির, ফিসফিস আওয়াজ করে না। ওরা মানুষের থেকে কথা বলা শেখে, আবার সেই কথাগুলোই বলে। নানারকম ডাক, আওয়াজ ওরা নকল করতে পারে। তাই কাকাতুয়া পোষ মানলে ওরা মানুষের কাছ থেকে ওদের কথা শুনে শুনে কিছু কিছু সহজ কথা নকল করে বলতে পারে। তারপর কাকাতুয়া পাখি মানুষের মতোই কথা বলে। কিন্তু অস্পষ্টভাবে। তোমার তুয়াও একটু একটু করে কথা শিখেছে। ও যত বড়ো হবে, তত ভালো করে কথা বলতে শিখবে।”

অলঙ্করণঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s