গল্প-গুলুর গল্প-পৃথা বল-বসন্ত২০২২

আগের গল্প- কথা বলা পাখি -১, কথা বলা পাখি (২), কথাবলা পাখি৩, কথা বলা পাখি (৪)

golpogulurgolpo

মানুষের তাড়া খেতে খেতে গাছের উঁচু ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে একবার এক গ্রামের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল একপাল বাঁদর। বাবা-বাঁদর, মা-বাঁদর, বুড়ো বাঁদর, বাচ্চা বাঁদর—অনেক বাঁদরের দল। বনবাদাড় পেরিয়ে গাছপালা ভাঙতে ভাঙতে সেই বাঁদরের দল চলে গিয়েছিল এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে। ওদের দলের মধ্যে একটা মা-বাঁদর দু-কোলে দুটো বাচ্চা নিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফ দিচ্ছিল। হঠাৎ তার কোল থেকে একটা বাচ্চা পড়ে যায় নীচে। এক কুঁড়েঘরের বারান্দায়।

বারান্দার পড়ে সেই ছোট্ট বাঁদরটা চিঁ চিঁ আওয়াজ করছিল। আওয়াজ শুনে ওই বাড়ির বৌ নমিতাদেবী ছুটে আসেন। এসে দেখেন একটা বাঁদর-বাচ্চা মাটিতে পড়ে কাঁদছে। নমিতাদেবী তক্ষুনি তাকে কোলে তুলে মাথায়-মুখে জল দিলেন। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে করে দুধ খাইয়ে তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলেন।

এরপর থেকে বাঁদর-বাচ্চাটাকে নমিতাদেবী নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করতে লাগলেন। নমিতাদেবীর কাছে আদর-যত্নে-ভালোবাসায় বাঁদর-বাচ্চাটা বড়ো হতে লাগল। নমিতাদেবী বাঁদর-বাচ্চাটাকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতেন। বাঁদর-বাচ্চাটা ভাবত ও মায়ের দুধই খাচ্ছে। তাই ও কিছুই বুঝত না।

এতসব খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। আশেপাশের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা বাঁদর-বাচ্চাটাকে দেখতে আসত। প্রথম প্রথম একটু ভয় পেত, কিন্তু তারপর ওদের ভয়টা চলে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে বাঁদরের বাচ্চাটা যত বড়ো হয়, তত বাধ্য হতে থাকে। আস্তে আস্তে বাচ্চাটা নমিতাদেবীর সবকথা বুঝতে শিখল। নমিতাদেবী যা যা বলতেন, ও সেইমতো কাজও করত।

এবার বাঁদরটার নাম রাখা হল গুলু। নমিতাদেবী ডাকতেন, “গুলু, গেলাসটা দিয়ে যা।” গুলু সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিত মা কী চাইছে। গুলু রান্নাঘরে গিয়ে গেলাস নিয়ে এক লাফে চলে আসত নমিতাদেবীর কাছে মার হাতে গেলাসটা দিতে। নমিতাদেবীর ভাষা বুঝতে গুলুর একটুও অসুবিধা হত না। উপরন্তু গুলু কতরকমের কাজ শিখে ফেলেছিল। এরপর নমিতাদেবী গুলুর জন্য মানুষের মতো জামা-প্যান্ট বানিয়ে গুলুকে পরিয়ে দিলেন।

গুলু প্রথম প্রথম প্যান্ট পরতে চাইত না। নিজে পরতেও পারত না। কিন্তু যত বড়ো হতে থাকল গুলু প্যান্ট-জামা পরা ধরল। প্যান্ট নিয়ে নমিতাদেবীর কাছে যেত, নমিতাদেবী পরিয়ে দিতেন।

কিছুদিন এমনিভাবে জামা-প্যান্ট পরে গুলু মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াত। সব ছোটো ছোটো বাচ্চাদের দেখত জামা-প্যান্ট পরেছে, গুলুও নিজে নিজে জামা-প্যান্ট পরা শিখে ফেলল।

ধীরে ধীরে গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা সবাই গুলুকে ভালোবাসতে থাকল। ভয় করা ভুলে গেল। গুলুর সঙ্গে ওদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

বিকেলবেলা ছেলেমেয়েরা যখন মাঠে খেলতে যেত, গুলুকে ডাকত, “গুলু…উ, খেলবি আয়।”

গুলু বন্ধুদের সঙ্গে প্যান্ট-জামা পরেই খেলতে চলে যেত। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, লাফালাফি করতে গুলু খুব ভালোবাসত।  বন্ধুরাও বাঁদর-বাচ্চাকে খেলার সঙ্গী পেয়ে ভীষণ আনন্দ পেত। সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল গুলুর গল্প। ছোটো ছেলেরা গাছে উঠতে পারত না। গুলুকে সঙ্গে নিয়ে যেত আমবাগানে। গুলু গাছে উঠে টপাটপ আম পেড়ে পেড়ে নীচে ফেলত আর বন্ধুরা সেগুলো ঝুড়ি ভরে বাড়ি নিয়ে আসত, গুলুকেও দিত। গাছ থেকে যা ফল পাড়ত, গুলু আর সকলে ভাগ করে নিত।

একদিন এক বাড়ির বাগানে জামরুল গাছে গুলু উঠেছিল পাকা জামরুল পাড়বে বলে। বাড়ির মালিক দেখে গাছে কে একটা ছেলে জামরুল পাড়ছে, আর নীচে ছেলেদের হাতে ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছে। ছেলেরা কোঁচড় ভরে জামরুল জমা করছে। বাড়ির মালিককে দেখে সব ছেলেরা জামরুল নিয়ে দৌড়ে পালাল। এবার মালিক গাছে যে উঠেছে তাকেই মারবে বলে এগিয়ে এল। চেঁচিয়ে বলল, “কী রে ব্যাটা, গাছের অত ওপরে উঠেছিস? ওইটুকু ছেলে, পড়ে গেছে তো হাত-পা ভেঙে পড়ে থাকবি। নাম শিগগির! নাম, তোকে আজ মেরেই ফেলব।”

বলেই মালিক লাঠি উঁচিয়ে যেই ওপরে তাকিয়েছে, দেখে, এ বাবা! এ তো মানুষের বাচ্চা নয়, এ তো বাঁদর-বাচ্চা। তাও আবার প্যান্ট-জামা পরা বাঁদর! বাড়ির মালিক হেসে কুটিপাটি। সবাইকে ডাকে, “এসো এসো, দেখবে এসো, বাঁদর উঠেছে গাছের মগডালে। সে আবার মানুষের বাচ্চার মতো প্যান্ট-জামা পরে আছে।”

সবাই এসে বাঁদর-বাচ্চাটাকে দেখার আগেই গুলু এ-ডাল থেকে ও-ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে কখন মাটিতে নেমে দৌড় একেবারে মা নমিতাদেবীর কাছে। হাতে ক’টা জামরুল ছিল। সেগুলো এনে মায়ের হাতে তুলে দিল।

বিকেলবেলা গুলুর বন্ধুরা গুলুর সঙ্গে যখন খেলতে এল, কথা বলতে এল, গুলু ওদের সঙ্গে খেলতে গেল না। ইশারাতে কথা বলত, তাও বলল না।

“কারণ কী? গুলু কথা বলছে না কেন মাসি?” ছেলেরা প্রশ্ন করল মা নমিতাদেবীকে।

নমিতাদেবী বললেন, “গুলুর মনখারাপ। ও তোমাদের জন্যই গাছে উঠেছিল ফল পেড়ে দেবে বলে। আর তোমরা ওকে মালির হাতে ফেলে চলে গিয়েছিলে! এটা স্বার্থপরতার কাজ হয়েছে। তাই গুলু বন্ধুদের কাছে আর যেতে চাইছে না।”

গুলু কিন্তু ভালোবাসা কাকে বলে সেটা ওর মা নমিতাদেবীর কাছে শিখেছে ছোটো থেকে।

বন্ধুরা শুনে বলল, “গুলু, তুই আমাদের সঙ্গে খেলতে চল ভাই। আমরা আর এরকম কাজ করব না।”

একটা বাঁদর-বাচ্চাও মায়ের অমন ভালোবাসা পেয়ে বন্ধুদের স্বার্থপরতার কাজটা বুঝতে পেরে গিয়েছিল। আসলে গুলু বাঁদর হয়েও সত্যিকারের মানুষ হয়েছিল তার মানুষ করা মায়ের কাছে ভালোবাসা পেয়ে।

ছবি-শ্রীময়ী

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s