আগের গল্প- কথা বলা পাখি -১, কথা বলা পাখি (২)
রুমিদের বাড়ির সামনের গাছের নীচু ডালটাতে ওদের পোষা কাকাতুয়াটা বসে থাকত। পাখিটাকে খুব ছোটো অবস্থায় বাগানে কুড়িয়ে পেয়েছিল রুমি। ওর নাম তুয়া। তুয়া মানুষের মতোই কথা বলতে পারত। রুমি-ঝুমির সব কথা নকল করে করে ও কথা বলতে শিখে গিয়েছিল।
তুয়া এখন বড়ো হয়েছে, গায়ে সাদা পালক হয়েছে, মাথায় লাল-হলুদ ঝুঁটি বেরিয়েছে। দেখতে ভীষণ সুন্দর হয়েছে তুয়াকে। তুয়া সারাদিন কত কথা বলে রুমি-ঝুমির সঙ্গে গাছের ডালে বসে বসে। কিন্তু বাগানে অন্য কোনও পাখিদের সঙ্গে ও মিশত না। শুধু রুমি-ঝুমির সঙ্গেই ওর বন্ধুত্ব ছিল।
সেদিন বাগানে একটা ছোট্ট ময়নার বাচ্চা পড়ে ছিল। রুমি সেটাকে তুলে এনে খাঁচায় ভরে তুয়ার পাশেই রেখেছিল। ওকে জল-ছোলা খেতে দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিল। সেই ছোট্ট ময়নাটাকে কাছে পেয়ে তুয়া ভীষণ আনন্দ পেয়েছিল। ওকে ঠোঁট দিয়ে আদর করত। নিজের পায়ের আঙুল দিয়ে বাচ্চা ময়নাটার গা বুলিয়ে দিত। গাছ থেকে ফল এনে পাখিটার মুখের কাছে ধরত, ওকে খাইয়েও দিত। একেবারে মায়ের মতো।
এত আদর ভালোবাসা পেয়ে খাঁচার ছোট্ট ময়নাটা তুয়াকেও ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছিল। দিনে দিনে দুজনেই বেশ বুঝে গেল ওরা দুজনে আপনজন।
ওদের এত ভাবভালোবাসা দেখে ঝুমি মাকে বলল, “এবার ছোট্ট ময়নাটারও একটা নাম রাখতে হবে মা।”
মা ওর নাম রাখলেন পিয়া। বললেন, “কিছুদিন পিয়া পিয়া বলে ওকে ডাকবে। ও যদি সাড়া দেয়, তবে ওর নাম পিয়াই থেকে যাবে।”
তাই হল। রুমি-ঝুমি সবাই ওকে পিয়া পিয়া বলেই ডাকতে থাকল। আর সঙ্গে সঙ্গে তুয়াও মাথা নেড়ে ঝুঁটি ফুলিয়ে ডেকে ওঠে, ‘পিয়া, পিয়া, পিয়া।’
রুমি-ঝুমির ডাকে সাড়া দিত না পিয়া। কিন্তু তুয়া ডাকলেই পিয়া ‘ক্যা ক্যা চা চা’ আওয়াজ করত। রুমিও হেসে হেসে ময়নাটাকে বলত, “কী বলছিস পিয়া? চা খাবি, চা?”
এমনিভাবে তুয়ার কাছে আদর ভালোবাসা পেয়ে, ওর ডাক শুনে নকল করে করে পিয়াও বড়ো হয়ে উঠল।
পিয়া বড়ো হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু তুয়ার মতন স্পষ্ট কথা বলতে শিখে উঠতে পারেনি। তুয়া যখন ডাকে ‘রুমি-ঝুমি, এসো এসো’, তখন ময়না পাখিটা খালি ‘মিমি মিমি, এ’তো এ’তো’ আওয়াজ করে। তুয়াকে নকল করে। তুয়া কত শেখায়। পিয়া কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু সব কথা কাকাতুয়ার মতো কোনও পাখিই বলতে পারে না।
রুমির মাঝে মাঝে ভালো লাগে না। ও মাকে বলে, “মা, এ পাখিটা আমার তুয়ার মতো কথা বলতে পারবে না? তুয়া কত ছোটো থেকে কথা বলা শিখেছিল নিজে নিজে। কিন্তু পিয়া কত বড়ো হয়েছে, তাও আমাদের নাম স্পষ্ট করে বলতে পারে না। তবে পিয়া চেষ্টা করে কথা বলতে।”
একদিন রুমি বাগানে এসে পিয়াকে বলল, “পিয়া, আজকে তোকে বাইরে এনে গাছের ডালে বসিয়ে দেব, তুয়ার পাশে।”
তাই হল। বাইরে বেরিয়ে পিয়ার কী আনন্দ! ডালের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তুয়ার খুব কাছে গিয়ে তুয়াকে ঠোঁট দিয়ে আদর করতে লাগল। তুয়াও ওর ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ওকে ভালো করে সোহাগ করতে থাকল।
কিছুক্ষণ পরে ছোট্ট ময়না পাখিটা তুয়ার রঙিন ঝুঁটিটা পা দিয়ে ধরতে চাইছিল। ঠোঁট দিয়ে টানাটানি করছিল। তাই দেখে রুমি বলল, “তুয়ার রঙিন ঝুঁটিটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছে পিয়া? তোমার মাথায় ঝুঁটি নেই? কী করে থাকবে বলো, তুমি তো ময়না। তোমার ঝুঁটি নেই, কিন্তু লেজটা লম্বা, সুন্দর। আর একটু বড়ো হও, তোমার সুন্দর লম্বা লেজ হবে। তুয়ার মতন।”
বেশ কিছুদিন ঝুঁটিওলা তুয়া আর ছোট্ট পিয়া দুজনে বেশ আনন্দেই দিন কাটাতে লাগল।
পিয়া মাঝে মাঝে লক্ষ করে তুয়া ‘রুমি রুমি’ বলে ডাকলেই রুমি এসে কতকিছু খেতে দেয়। আবার তুয়া যখন উড়ে যায় অন্য গাছ থেকে ফল আনতে, তখন ও পিয়াকে খাঁচার ভেতরে রেখেই তবে কোথাও যায়। ছোটো তো, তাই।
তুয়ার এমনসব আচরণ দেখে রুমি-ঝুমি অবাক হয়ে যায়। কী বুদ্ধি তুয়ার!
এইভাবে তুয়াকে দেখে দেখে পিয়াও পোষ মেনে গিয়েছিল। কিন্তু তুয়ার মতন স্পষ্ট কথা বলতে পারত না। রুমি-ঝুমির মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল, পিয়াটা কত বড়ো হয়ে গেল, কিন্তু ঠিকমতো ‘রুমি’ বলে ডাকতে শিখল না।
মা বলল, “ছোটোতেই যখন ভালো করে ডাকতে শেখেনি, বড়ো হয়েও ও আর তুয়ার মতন স্পষ্ট কথা বলতে পারবে না। তবে ওর লেজটা তুয়ার মতন লম্বা হবে। ময়না পাখির ঝুঁটি থাকে না কাকাতুয়ার মতন।”
রুমি বলে, “ময়না তো কথা বলে, তাই না মা?”
মা বলল, “হ্যাঁ, ময়না কথা বলে। পিয়া একটু বড়ো হোক, ও অনেক কথা বলবে। তোমাদের নাম ধরে ডাকবেও। তবে পিয়া তুয়ার মতন অত ভালো করে কথা বলতে পারবে না। তুয়া কাকাতুয়া পাখি, ওরা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে।”
রুমি মনে দুঃখ পেল, পিয়ার মাথায় ঝুঁটিও বেরোবে না। ভালো কথা বলতে পারবে না। যাক, তবু তো তুয়া একটা বন্ধু পেয়েছে কাছে।
একদিন হল কী, তুয়া উড়ে গেল অন্য গাছে ফল আনতে। পিয়া তখন খাঁচার ভিতরেই ছিল। সারাটা দিন কেটে গেল তুয়া ফিরছে না।
সন্ধেবেলা রুমি এসে পিয়াকে জিজ্ঞাসা করল, “তুয়া কই? তুয়া কই?”
বার বার ডাকতে থাকল আকাশের দিকে চেয়ে। ডাকতে ডাকতে রুমি কেঁদেই ফেলল। রুমির কান্নার আওয়াজ শুনে পিয়ার মনটাও কেঁদে উঠল। ও বলতে থাকল, ‘তুয়া কই, তুয়া কই…’ খাঁচার ভিতর থেকে পা দিয়ে খাঁচার দরজাতে ধাক্কা দিতে থাকল। আর বলতে লাগল, ‘খোলো, খোলো, এটা খোলো।’
রুমি কিছুতেই দরজা খুলল না। খাঁচা খুলে দিলে পিয়াও যদি উড়ে যায় তুয়াকে খুঁজতে! সকলে বাগানে এসে খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “না না রুমি, খাঁচা কখনও খুলবে না।”
সন্ধে হয়ে গেল। আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। এখনও তুয়া বাগানে ফিরে এল না। রুমি-ঝুমি, ওদের মা যে যে ছিল সকলে বাগানে এসে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগল, “তুয়া, তুয়া, আয়, আয়। তুই কোথায়?”
ডাকতে ডাকতে রুমি কেঁদেই ফেলল। তারপর রুমির কী কান্না, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। ঝুমিও গাছতলায় এসে ডাকতে লাগল, “তুয়া, তুয়া, তুই কোথায় গেলি? সন্ধে হয়ে গেছে, ঘরে ফিরে আয় তুয়া।”
এত ডাকের পরেও তুয়ার কোনও সাড়াশব্দ নেই। এবার রুমি-ঝুমি আর পাশের বাড়ির ছোট্ট ভাই হাবু সবাই মিলে একসঙ্গে ডাকতে লাগল আর কাঁদতে লাগল ভ্যা ভ্যা করে।
মা এসে রুমিকে বলল, “কেঁদো না মা, কেঁদো না। দেখো তোমার তুয়া ঠিক ফিরে আসবে। ওর বন্ধু পিয়া আছে না খাঁচার ভিতরে? ও ঠিক ফিরে আসবে। চলো, তোমরা খেয়ে নাও।”
রুমি বলে, “মা, যদি তুয়া আর ফিরে না আসে তাহলে কী হবে? কী হবে মা? আমার তুয়ার মতন কাকাতুয়া পাখি আর কোথাও নেই। কোথায় গেল মা আমার তুয়া? কোথায় গেল? তুয়া আমাদের নাম ধরে ডাকে। ফল এনে ভাগ করে খায়। কত কথা বলে। ওর মতন কাকাতুয়া পাখি আর কোথাও পাব না। কী হবে মা? আমার কাকাতুয়া কোথায় চলে গেল?”
শুধু এইসব কথা বলে, আর কাঁদে রুমি। ঝুমি বলে, “ছোট্ট ময়নাটা এত বড়ো হল, কিন্তু তুয়ার মতন ও কথা বলতে পারছে না। তুয়ার কত বুদ্ধি! নিজে নিজে কল খুলে চান করে। এমন পাখি কোথাও দেখেছ?”
রুমি মনের দুঃখে সমানে ডেকে চলে, “তুয়া-য়া, তুয়া-য়া, তুই কোথায়? বাগানে ফিরে আয়।” বলে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে রুমি সমানে গলা ছেড়ে ডাকতে থাকল ‘তুয়া, তুয়া’ বলে।
রুমির কান্না দেখে রুমির মাও কেঁদে ফেলে। রুমিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “কেঁদো না রুমি, কেঁদো না। যত রাতই হোক, তুয়া ঠিক আসবে। আমাদের এই গাছে এসে বসবে।” বলেই মা রুমির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে, ঠিক এমন সময় কে যেন বলে উঠল, “না না, কেঁদো না রুমি, কেঁদো না।”
দূর থেকে অমন ডাক শুনতে পেয়ে রুমি হঠাৎ ওপর দিকে তাকিয়ে বলে, “কে? কে? তুয়ার মতন গলা!”
রুমি তাকিয়ে দেখে আবছা অন্ধকারে সাদা ডানা মেলে উড়ে এসে তুয়া ওর ডানা দুটো দিয়ে রুমির মাথায় একটা ঝাপটা মারল। রুমি বলে ওঠে, “তুয়া, তুই এসেছিস! আয় তুয়া, আয়।”
সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে ঝুপ করে মাটিতে এসে বসল তুয়া। হইহই করে সবাই কাছে এগিয়ে এল। কী হল, তুয়া ডালে বসল না কেন? সবাই তাকিয়ে দেখে তুয়ার পায়ের ওপরে সাদা পালকের ওপরে একটু রক্ত। কী হয়েছে তুয়া! তোর কী হয়েছে? তুয়ার চোখ দিয়ে তখন জল গড়াচ্ছে। রুমি মাকে বলল, “মা, কোনও কাঁটাগাছের কাঁটা বিঁধেছে তুয়ার পায়ে।”
মা এসে তুয়ার পায়ের কাঁটাটা তুলে আলতো করে ওষুধ লাগিয়ে দিল তুয়ার পায়ে। তারপর ওকে ঘরে নিয়ে একটা বিছানা পেটে শুইয়ে দিল। সারারাত তুয়া ঘরেই ঘুমিয়ে ছিল।
ভোর না হতেই তুয়া ডাকছে, ‘রুমি ওঠো, ঝুমি ওঠো। কেঁদো না, আমি এসেছি।’
তুয়ার ডাকে রুমির ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠেই ওকে অনেক আদর করল। কত কথা বলল। তারপর ওকে বাইরে খাঁচার পিয়ার কাছে এনে পিয়ার পাশে বসিয়ে দিল। মা এসে তুয়ার পা-টা দেখে বলল, “এখন তো তুয়া দাঁড়াতে পারছে। ও ভালোই আছে।”
রুমি মাকে বলল, “তুয়াটা কী ভালো, তাই না মা? আমার কান্না দেখে ও এসেই আমাকে বলল, ‘কেঁদো না রুমি, কেঁদো না।’ আর পিয়া? একবারও আমাকে বলেনি, কেঁদো না রুমিদিদি, কেঁদো না।”
মা বলল, “তুয়া একে তো কথাবলা পাখি, তার ওপর খুব বুদ্ধিমান। ও ভালো জাতের বিদেশি কাকাতুয়া, পিয়া ময়না পাখি। ময়না পাখি কথা বলতে পারে, তবে কাকাতুয়ার মতো অত স্পষ্ট কথা বলতে পারে না ওরা। তবে ছোটো থেকে ওদের পোষ মানালে ওরা অনেক ভালো কথা বলা শিখে যায়। তোমার তুয়া হল অনেক ভালো জাতের, কাকাতুয়ার মধ্যে সেরা। তাই তো ও এত ছোটো থেকে এত সুন্দরভাবে শুনে শুনে ঠিক মানুষের মতো কথা বলা শিখতে পেরেছে। এইসব কাকাতুয়া পাখিরা একটা ছোট্ট শিশুর মতো বুদ্ধি নিয়ে জন্মায়। পাখি হলেও ওরা সব কথা বোঝে, শুনে-শুনেই সব কথা শিখে ফেলে।” রুমি-ঝুমি, হাবু মার কথাগুলো সব মন দিয়ে শুনতে থাকল।
অলঙ্করণ- সৃজন কাঞ্জিলাল
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস